শেকড়ের সন্ধানে পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

1
1079

৫|| (শেষপর্ব)

ফোন কাটার পরই আসিফকে দেখল। কোণের সিঙ্গেল সোফাটায় বসে আছে। চুপচাপ কণার কথা শুনছে। কণাকে তাকাতে দেখে উঠে কাছে এসে বসল।

‘ হঠাৎ কল্লোলকে ডাকলে যে ! কী বলবে ওকে ? ‘

‘ কিছু বলব না। একটা দায়িত্ব দেব।’ ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে আংটির বাক্স আর প্যাকেটটা তুলে আনল কোলে। ‘ এগুলো সাঈদকে ব্যাক করতে হবে। তোমাকেই দিতে বলতাম কিন্তু তুমি বড় ভাই। ঠিক ভাল দেখায় না। কল্লোল যেহেতু ওদের বাসা চেনে টেনে। ওই দিয়ে আসুক। যে সম্পর্কটাকে সে গলাটিপে হত্যা করেছে। তার দাফনও ওই করে আসুক। কলিজা ঠান্ডা হোক। ‘

‘ আচ্ছা, তুমি এই ব্যপারটা নিয়ে এত আপসেট কেন বলবে ? কুমকুম কী আমার বোন না ? এই পরিবারের মেয়ে না সে? তুমি তো এমন করছ যেন তুমিই কুমকুমের সব। আর কল্লোল তোমার দুশমন।’

কণার চোখে আহত পাখির কাতরতা। প্রিয়জনের ভুল বোঝাটা যে কত কষ্টকর তা ভুক্তভোগীই জানে। নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তোমার তা মনে হতেই পারে আসিফ। কারণ তুমি তো আমাকে অধিকার করেছ কাগজের জোরে। আর আমি সেই একই কাগজের দাবীতে তোমার পুরো পরিবারকে নিজের করে নিয়েছি। পার্থক্যটা বিস্তর। ‘

আসিফ স্থির হয়ে গেল এবার। কণা থামল না।
‘ এই এতটুকু বয়স থেকে কুমুকে দেখে এসেছি। ও তখন স্কুলে পড়ে৷ কতদিন সাথে করে স্কুলে নিয়ে গেছি। টিচারদের সাথে কথা বলেছি। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় পড়তে বসিয়েছি, অংক না পারলে কানমলে দিয়েছি। তোমরা খোঁজও নাওনি। আমার হাতে তুলে দিয়েই খালাস। আর আমি, অধিকার আর কর্তব্যের প্রবাহে ভেসে গিয়ে একটা সময় ভুলেই গিয়েছিলাম যে ও আমার আপন বোন না, ননদ। তবে তোমরা ভোলোনি। সময়মত ঠিকই স্মরণ করিয়ে দিয়েছো। যেমন আজ দিলে। মেনি থ্যাঙ্কস।’

‘ ব্যপারটাকে খামোকা জটিল করছ কণা। তুমি নিজেও জানো এটাই তোমার পরিবার। মতের অমিল মানে পর করে দেয়া নয়।’

‘ হ্যাঁ জানি। মতের অমিল তোমাদেরও হয়। কেউ তোমাদের শেকড় চিনিয়ে দেয়না। আমরাই শেকড় বিহীন প্রজাতি। আর তাই এটা না আমার পরিবার আর না আমার বাবার বাড়ি হবে কুমকুমের পরিবার। আমি আর কুমকুম এই দুই পরিবারে বেড়ে উঠেছি মাত্র। আমি যেমন বিয়ের সূত্রে এই পরিবারে এসেছি কাল কুমুও বিয়ে করে ঐ পরিবারে যাবে। জায়গার রদবদল। এটা আমাদের জন্য খুব বেশি পরিবর্তন আনবে না আসিফ।’

‘ তোমার কী হয়েছে বলো তো। সেই তখন থেকে আমার তোমার করছ। কী বলতে চাইছো সেটা স্পষ্ট কর। এ বাড়িতে তোমার কোন দাম দেই না আমরা, এই তো ? ‘ আসিফ সামান্য রেগে গেল এবার। ‘ আমার মাঝেমধ্যে তোমাকে অবাক লাগে কণা। তোমার কথা ছাড়া এ বাড়ির কোন বেলার মেন্যু ঠিক হয়না। তোমার কথার বাইরে কোন একটা কাজের লোক ছুটি পায়না। আমি নিজে তো তোমার…!’

‘ এই অধিকারগুলো একজন তত্ত্বাবধায়ক এমনিতেই পায় আসিফ। স্কুলের সব রুমের তালাচাবি পিয়ন কিংবা দারোয়ানের হাতে থাকে। স্কুলের প্রিন্সিপালের হাতে না। আমরা বাড়ির বউরা হলাম পরিবারের দারোয়ান বা কেয়ারটেকার। দেখবে স্কুলে কিছু চুরি হলে বা ডাকাত পড়লে লোকে আগে দারোয়ানকে বাঁধে । প্রিন্সিপাল নিজেই তখন দারোয়ানকে আসামী করে মামলা করে কারণ সে নিজেও তখন ভিকটিম। তেমনই বাড়ির বউ দোষ করলে ঐ বউ একা হয় আসামী আর বাকিরা ভিকটিম। যেমনটা হয়েছিল কল্লোলের ভিডিওর কথাটা জানাজানি হবার পর। সেদিন আমি একা হয়েছিলাম আসামী আর তোমরা সবাই ভিকটিম। কাল ওদের বিয়ে হয়ে গেলেও ভবিষ্যতে কখনও আমি হব আসামী আর কখনও কুমকুম হবে আসামী। কল্লোল কিছু করলে তোমরা আমাকে ধরবে আবার কুমকুম ভুল করলে আমার মা ও আমাকেই ধরবে। সেদিন হয়ত কুমকুম আমার দিক তাকিয়ে চুপ থাকবে আবার কখনও আমি কুমকুমের দিকে তাকিয়ে চেপে যাব। তুমি বা কল্লোল এর বাইরেই থেকে যাবে। ”

‘ উফ্, আমি ক্লান্ত কণা। জানি না তুমি কেন এমন ভাবছ। ‘ আসিফকে হতাশ দেখাল।

‘ কেন ভাবছি ! এই যে, কল্লোলকে নিয়ে এত কিছু হলো, তোমার ওপর কোন আঁচড় এসেছে, তুমিই বলো ? তুমি তো এখনও আমার মায়ের নজরে ভাল ছেলে। অথচ তুমি নিজেই সেদিন কল্লোলকে বেল্ট পেটা করতে চেয়েছিলে। যদি সত্যিই তা করতে তাহলে আমার সম্মান বাড়ত ? সবাই আমার দিকেই তো আঙুল তুলত। বরং এটাই স্বাভাবিক। একটা মেয়ে চাইলেই তার দু দশ বছরের সবটুকু সময় দিয়ে কাউকে কিনে ফেলতে পারেনা, এটা দিবাস্বপ্ন। বউ কোনদিন মেয়ে হয়না। এটা তোমার মায়ের কথা। যাকে আমি দিনরাত মা বলে ডাকি সে বিশ্বাসই করেনা আমি তার মেয়ে। ঐদিকে আমার মা বলে আমি নাকি শ্বশুরবাড়ির ভক্ত। কখনও সময় মত হাজিরা দিতে না পারলে আমার মা-ই বলে আমার নাকি বাপের বাড়ির টান কম। আমরা কোথায় যাব বলতে পারো ? একটা যুগ পার করে ফেললাম শেকড়ের সন্ধান করতে করতে। কাল থেকে কুমকুমও করবে। তারপর যারা এই প্রতিযোগিতায় অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করবে তারা হবে শেকড়বিহীন নারীবাদী। কিছু মেয়েদের নারীবাদী সত্ত্বার পেছনে তোমাদের পুরুষদের অবদান যে সবচেয়ে বেশি এটা কী তোমরা জানো ? তোমরা ঠিকঠাক মত নিজেদের দায়িত্ব পালন করলে আজ একটা নারীও নারীবাদী হত না। তোমাদের কারণেই আজ একদল নিজ অধিকারের উপর এককাঠি বেশি সোচ্চার যাদেরকে তোমরা নারীবাদী বলো। আরেকদল অসহায়া নারী এবং বাদী। এ দুইয়ের বাইরে আমাদের জন্য জায়গা রাখোনি তোমরা।’

‘ তুমি দেখছি আমাকে ডিপ্লোম্যাটদের ভাষায় ধুয়ে দিচ্ছো। এভাবে কূটনীতিবিদরা সমাজপতিদের গালি দেয় জানো ? তুমি সেটাই করছো। অথচ তুমি ভাল করেই জানো তোমাকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়। ‘

‘ ওটা তোমরা সব পুরুষরাই অসহায়। ঐ অসহায়ত্ব ঢাকতে গিয়েই তোমরা কখনও আগ্রাসী কখনও চতুর। ধরো, এখন যদি আমি বলি আমি চলে যাব, তুমি তখন কী করবে জানো ? সবার আগে আমার বাচ্চা আটকাবে। আর এটা হবে আমাকে ঠেকানোর জন্য তোমার বৈধ একটা পথ যা তুমি ব্যবহার করবে অবমাননাকর ভাবে। যেমন কল্লোল করেছে। কুমকুমকে বিয়েতে রাজি করাতে ওর দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে। ও চাইলেই অন্য পথ ধরতে পারতো কিন্তু ঐ যে পুরুষালি ক্ষমতা ! ‘

‘ কল্লোলের কাজটার সাথে আমাকে মেলানো উচিত হয়নি কণা। তুমি চলে যেতে চাইলে আমি বাবুকে আটকাব না। বরং নিজের ব্যাগ গোছাব। তোমার সাথে চলে যাব যেখানে তুমি যাবে।’ বলে হেসে চট করে জড়িয়ে ধরল কণাকে। এতক্ষণ ধরে সে এই সুযোগটাই খুঁজছিল। কণার কঠিন বাক্যবাণের তোড়ে কাছে আসতে পারছিল না। সে ভাল করেই জানে কণা স্পর্শকাতর মেয়ে। ওকে ছুঁলে একশ সমস্যার সমাধান একমিনিটে হয়ে যায়।
কিন্তু কণা আজ রেগে গেল। ধাক্কা দিলো আসিফকে।

‘ দেখি ছাড়। কথায় না পারলেই খালি পাছড়াপাছড়ি। ‘ সবলে ওকে সরাতে চাইল কণা। কিন্তু গায়ের জোরে কুলিয়ে উঠতে না পেরে বলল, ‘ ওদের বিয়ের পর আমি দুদিন আম্মার কাছ থেকে ঘুরে আসব। কোন আপত্তি করতে পারবে না। একসপ্তাহ থাকব সেখানে।’

‘ যেও। তবে আমাকেও সাথে নিও প্লিজ।’

‘ না, তুমি এখানেই থাকবে। এ বিয়ে এমনিতেও তোমার আমার সম্পর্কে চিড় ধরাতেই হচ্ছে।’

‘ কী বললে ! ‘ থমকে গেল আসিফ।

‘ ভুল বলিনি। ভেবে দেখলেই বুঝবে।’

‘ তোমার কথাবার্তা আজ পার্ফেক্ট নারীবাদীদের মত । অথচ তুমি যথেষ্ট নামাজ রোজা কর। তুমি মোটামুটি ধর্মভীরু একজন মেয়ে। অথচ আজ তুমিই কিনা…!’ আসিফ সরে গেল না বা রেগে গেল না। শক্ত করে ধরে রেখেই তুলনামূলক নরম সুরে কথাগুলো বলল। জানে ছেড়ে দিলে কণার নাগাল পেতে বেগ পেতে হবে ওকে।

‘ তোমরা বারবার একটা ভুল কর আসিফ। ইসলামকে সবসময় তোমরা নারীবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাও। অথচ ইসলাম নিজেই একটা নারীবাদী ধর্ম। জানো এটা ? তথাকথিত নারীবাদের সাথে যায়না বলে ইসলামকে তোমরা নারীদের বিপক্ষে দাঁড় করাতে চাও। অথচ ইসলাম যতটা নারীর স্বার্থ রক্ষা করেছে আর কেউ ততটা করেনি। কণের অমতের বিয়ে ভাঙার রেকর্ড ইসলামে আছে। অন্য কোথাও নেই। রাসুল সাঃ নিজেই ভেঙে দিয়েছিলেন এরকম বিয়ে। শুধুমাত্র সেই কণের নালিশের প্রেক্ষিতে। ঐ সাহাবীয়্যার বাবা তাঁকে তাঁর অমতে একরকম জোর করেই অন্যত্র বিয়ে দিয়েছিলেন এবং ছেলে তার অপছন্দের ছিল। পরে সেই মেয়ে সোজা এসে রাসুল সাঃ এর কাছে নালিশ করে দেন। রাসুল সাঃ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কী তাঁকে পছন্দ করো না। মেয়ে স্পষ্ট মানা করায় রাসুল সাঃ ততক্ষণাৎ তাঁকে বিয়ে ভাঙার অনুমতি দিলেন। একইভাবে বাবার বা তার অনুপস্থিতিতে বৈধ অভিভাবক ছাড়া রাস্তাঘাটে অভিভাবক বানিয়ে একা একা করা বিয়ের ব্যপারেও কঠিন নিষেধাজ্ঞা দিলেন। অথচ কী আশ্চর্য, অভিভাবক এবং পাত্রী এই দুটো দলই আদেশ গুলোকে নিজেদের মত করে ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছে। মেয়েরা এখন একে স্বাধীন মতামত আর একা বিয়ের অধিকার বানাচ্ছে ঐদিকে অভিভাবকরাও তাদের মুরুব্বিয়ানা ফলিয়ে তাদের অবস্থানের গুরুত্ব জাহির করছে। আর মাঝখানে বলি হচ্ছে ইসলাম।’

‘ আচ্ছা, লেকচার বন্ধ কর। সোজা কথা বল। তুমি কী বোঝাতে চাও কল্লোল ছেলে ভাল না এই তো ? ‘

কণার চোখে চাপা রাগ ঝিলিক দিয়ে উঠল এবার।
‘ এতক্ষণে এই বুঝলে তুমি ? তোমাকে দেখা যায় ঢোলতবলা না বাজালে আজকাল কিছু বোঝানো যায়না। শোনো, কল্লোল আমার ভাই। সে ভাল হলেও আমার ভাই, মন্দ হলেও আমার ভাইই থাকবে। কিন্তু ওর মন্দের সময় আমি ওকে যেভাবে মেনে নিতে পারব সেভাবে তোমরা ওকে মেনে নিতে পারবে না। ফলে ওর কারণে আমিও বলি হব।’

‘ তুমি বলি হবে কেন। এটা কুমকুম আর কল্লোল বুঝবে। ওদেরটা ওরা বুঝবে।’

‘ কুমকুম তো সে দায় নিচ্ছে না। আমার আপত্তিটা সেখানেই। আজ যদি কুমকুম সমানভাবে কল্লোলকে চাইতো তাহলে আমি নিজে খুশিমনে ওদের বিয়ের আয়োজনে লেগে পড়তাম। বিয়েটা হচ্ছেই একটা বিশ্রী ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কল্লোল একটা ভুল বা অন্যায় যাই করল তার সমাধান না করে তোমরা সাঈদের একটা দুর্বলতা পেয়ে কুমুকে জোর করে ঠেলে দিচ্ছো কল্লোলের কাছে। ভবিষ্যতে এর দায়টা কার ঘাড়ে পড়বে তুমিই বলো ? তোমার আমার বিচ্ছেদের ভয় আসে কিনা। ‘

‘ ওহ্ বারবার একই ভয় দেখাচ্ছো তুমি। বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ। দুউর, আমি এখনই কল্লোলকে ফোন করে বলব ওর সাথে কুমুর বিয়ে দেব না আমরা। ওর আসারও দরকার নাই। খুশি ? ‘

‘ তোমাকে এত বোকা কোনদিন মনে হয়নি আমার।’ ক্লান্ত দেখাল কণাকে।

‘ জানিনা। আমার মাথার স্ক্রু সব ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। বাদ দাও তো, কাল সকালে কথা বলব এটা নিয়ে। চলো এখন ঘুমাই।’

‘ এক্ষুনি কল্লোল আসবে। ওকে ফোন করেছি দেখলে না ! ও আসুক। ওকে যা বলার আমি তোমার সামনেই বলব। সেগুলোই বলব যা তোমাকে বললাম। ওর উত্তরটা তুমি নিজেই শুনবে। সব শুনেও যদি ও বিয়ে করার জেদে অনড় থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু নিজের সংসার বাঁচাতে যে স্টেপ নেয়া দরকার তা অবশ্যই নেব আমি। আর হ্যাঁ, দয়াকরে আমাকে নারীবাদী না ভাবলেই ভাল করবে। আমি শুধুই একজন নারী। বাঁদী নই। কেউ চাইলেই আমাকে তার খেয়াল খুশিমত ব্যবহার করবে তা হবেনা।’ কণা উঠে দাঁড়াবার সাথে সাথেই বেল বাজল।

কণা প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে ড্রইংরুমের দিকে রওনা দিলে আসিফও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর পিছু নিলো। কল্লোলকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসল ওরা দুজন। কণা আর আসিফ। কণা প্রথমেই ওর হাতের প্যাকেট আর বক্সটা কল্লোলের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘ তুই তো সাঈদদের বাসা চিনিস। একটু কষ্ট করে ওদের বাসায় পৌঁছে দিস এটা। সাঈদের হাতে দিলে ভাল হবে।’

‘ কী এগুলো? ‘

‘ কুমকুমের সাথে সাঈদের প্রাক-বিবাহ কমিটমেন্ট। বোকার হদ্দ মেয়েটা না বুঝেই অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। যাই হোক, তোর চিন্তার কোন কারণ নেই। কুমকুম নিজেই ফেরত দিয়েছে এসব। ওর ধারণা তোকে বিয়ে না করলে আমি কষ্ট পাব, অপমানিত হব। সেকারণেই রাজি হয়ে গেছে। মেয়ে তো। রাজি না হয়ে উপায় কী। অসম্মান আর অপবাদ যে আমাদের ছায়া। এটা এখন কুমকুমও বুঝতে পেরেছে। ‘ এ পর্যন্ত বলেই থেমে গেল কণা। আসিফ ওর বাহুতে হাত ছুঁয়ে ওকে থামাল। হালকা গলা কেশে বলল,

‘ শোন্, কল্লোল। ব্যপারটা আমি পরিস্কার করি। তোর আপা যে ভয়টা পাচ্ছে সেটা হলো তোদের ভবিষ্যত। ওর ধারণা তোদের বিবাহ পরবর্তী যে কোন জটিলতার প্রভাব আমাদের দাম্পত্যের উপর পড়বে। সেকারণেই ও খুব চিন্তিত। এজন্য অবশ্য ওকে দোষ দেয়া যায় না। তোর ছোট্ট এক অপকর্মের জেরে আমি নিজেই রেগে আগুন হয়ে যাই। তোর বোনের অগোচরেই তোকে পিটাতে চেয়েছিলাম আর আমার পুরো পরিবার সাময়িকভাবে বয়কট করেছিল তোর বোনকে। কণার দুশ্চিন্তা করা স্বাভাবিক। ‘

কল্লোল বিস্ময়াহত চোখে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে। চুপচাপ আসিফের কথাগুলো শুনল তারপর আবার বোনের দিকে তাকাল। কণা তখনও মুখ নামিয়ে রেখেছে। আসিফ বলে চলল,’ তুই তো অন্তত নিজেকে ভাল করে চিনিস। হয়ত কণাও চেনে। বলা যায় না কাল আমার বোনের সাথে উল্টাপাল্টা কিছু হলে হয়ত আমি নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারব না। তখন তোর বোনের সাথে আমার নির্ঘাৎ ঝগড়া বেঁধে যাবে। কণা ভাল করেই জানে সেটা। তবে কুমকুম নিজে স্বতস্ফুর্তভাবে এই বিয়েতে রাজি থাকলে এটা কোন ব্যপারই ছিল না। তোরা দুজনই দায়টা ভাগ করে নিতে পারতি। আমাদেরকেও এর মাঝখানে আসতে হতো না। যেহেতু সেটা হচ্ছেনা তাই দায়টা তোর আপার উপর এমনিই চলে যাচ্ছে, অটোমেটিকালি। বোঝাতে পারলাম ! ‘

আসিফ থামল। কল্লোলকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। কণা কিছু বলতে গেলে ওকে থামিয়ে দিয়ে আসিফ বলল,’ প্রসঙ্গ যেহেতু উঠেই গেছে তাই আমিও সরাসরিই বলি। বিয়ের পর থেকে কণার একার ভার বলে কিছু থাকা উচিত ছিল না। তারপরেও কিছু ভার ও একা বহন করেছে। আজ থেকে তা আর হবেনা ইনশাআল্লাহ। যে ভার কণার সে ভার আমারও। ও দু:খী হয় এমন বিষয়ে আমি কোনদিন সুখী হতে পারব না। আমার সংসারের শেকড়ই কণা। আমার জীবনে ও না থাকলে আমি ভাসমান কচুরীপানার মতই। শেকড়বিহীন গাছের যেমন ফুল বা ফল হয়না। আমার অবস্থাও তাই। আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই তোর বোন ছাড়া আমি নিজেকে তেমন অক্ষম আর অকেজোই মনে করি। কাজেই যা করবি ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে করবি এটা আমার অনুরোধ। যেহেতু দুপক্ষের মুরুব্বীদের সাথে তর্কে যাব না কারণ তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা বৃথা। তারা যার যার নিজের স্বার্থ দেখছেন। কণা আর আমিও নিজের স্বার্থ দেখছি। তবে আমাদের স্বার্থ বাকি সবার সাথে জড়িত। এটা তো বুঝিস।’.

কল্লোল এবারও নিরব। আসিফ বলে চলল, ‘ গতকাল তোর দিক থেকে মানে তোদের বাসা থেকে মিষ্টি আর চেইন এসেছে। সাথে ছিল বিয়ের প্রস্তাব। আমার শ্বাশুড়ি করেছেন সেই প্রস্তাবটা। আমার কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতাও স্বাভাবিক ভাবেই রাজি। বুঝতেই পারছিস, তাদের কাউকে অসম্মান করার কথা ভাবতে পারছি না। আমি বা কণা দুই পরিবারের মধ্যস্থতাকারী হিসেবেই থাকব। বাকি যা হবে তার সবই তোর সামনে রাখলাম। এবার সিদ্ধান্ত তোর। ‘

কল্লোল মিনিট খানেক চুপ থেকে দু আঙুলে চোখের কোণ চেপে ধরে বলল, ‘ আসিফ ভাই, আপনার আর আপার অনুমতি থাকলে আমি কুমকুমের সাথে দুটো কথা বলতে চাই, পারব ? বলেই সে হাত তুলল।’ না, ভয় নেই। আপনাদের সামনেই বলব। আড়ালে না।’

কণা কিছু বলতে যাবার আগেই আসিফ বলল,’ অবশ্যই। বস তুই। আমি ডাকছি কুমুকে।’ বলে আসিফ নিজেই উঠে গেল। অমনিই কল্লোল চট করে বোনের পায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। কণার হাত ধরে তাতে গাল ঠেকিয়ে বলল,’ আমি অনেক স্যরি আপা। কাজটা সত্যিই ছোটলোকের মত হয়ে গেছে। আমার জন্য তোকে এতটা অপমানিত হতে হবে বুঝিনি। আসলে নিজের উপর ওভার কনফিডেন্স আর এ বাড়িতে তোর দাপুটে অবস্থান দেখে একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম তুই এই পরিবারের অল ইন অল ভাবতাম। শালারা যে…!”

‘ চুপ কর বেকুব ৷ যা জায়গায় যা। ‘ কল্লোলের কাঁধে ঠেলা দিলে সে সোফায় ফিরে গেল। এর পরপরই আসিফ ফিরল কুমকুমকে সাথে নিয়ে। কল্লোল ওর দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,’ কুমকুম, এসেছ ! শোনো, আমি আপা আর আসিফ ভাইয়ের সামনেই তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। সবকিছুর জন্য। আসলে এভাবে কাউকে ভালবাসা যায়না। পুরো ব্যপারটাই আমার বোকামী আর ছেলে মানুষী ছিল। তোমাকে পরাস্ত করতে না পারার জেদটাই কাজ করছিল বারবার। এখন মনে হচ্ছে গায়ের জোরে হয়ত পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব কিন্তু তুমি হয়ত আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। দুনিয়ার পয়সা খরচ করে এরকম ফাউল মার্কা নামকাওয়াস্তের প্রেম আর লোকদেখানো বিয়ের দরকার নাই আমার । তোমার সাঈদ মিয়া এখনও দিনে দুইবেলা ফোন করে আমার কানের পোকা নাড়িয়ে যাচ্ছে। আ পারফেক্ট লাভার । তুমি ঐ গাধারেই বিয়ে করো গে। আমার দিক থেকে তুমি ফ্রি। ‘ বলে কল্লোল প্রথমে বোন তারপর আসিফের দিকে তাকাল।

‘ আসিফ ভাই শোনেন। কাল আমি সাঈদ ভাইকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করব। আপনি প্লিজ এদিকটা সামলান। আপা, তুইও। ওনাকে একটু ভালভাবে আপ্যায়ন টাপ্যায়ন করিস। ব্যাটা আসলেই ভাল মানুষ। আর কুমু শোন, তোমার কোন বান্ধবী টান্ধবী থাকলে একটু দেইখো আমার জন্য। বিয়েটা ইমিডিয়েট করে ফেলা দরকার। তবে এফেয়ার ছাড়া মেয়ে দেখবা। এফেয়ারঅলা মেয়ে বিয়ে করব না বুঝলা! ‘

কুমকুম এতক্ষণ মুখ নামিয়ে রেখেছিল। এবার সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটগুলো নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরল।
‘ আচ্ছা ইনশাআল্লাহ।’ বলে কণার দিকে তাকিয়ে বলল,’ ভাবি, কাল বা পরশু একটা মহিলা মাদ্রাসায় গিয়ে একবার ঘুরে আসব। মাদ্রাসার বাইরে এরকম মেয়ে রেয়ার। যা দিনকাল পড়েছে। তারচে ঐখানেই যাব কী বল! ” বোঝা গেল খুশি চাপতে না পেরে মজা করছে কুমকুম। কণার কপালে ভাঁজ পড়ল।

‘ তুই যা তো এখান থেকে।’

কণার ধমক দিলে সুড়সুড় করে নিজের রুমে চলে এলো কুমকুম। বারান্দায় এসে দ্রুত মোবাইলের ব্লক অপশন খুলল। সাঈদ আহমেদ নামটা আনব্লক করেই কল বাটন চাপল। ফোন কানের কাছে ধরে জোড়াপায়ে লাফাতে লাফাতে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল।

গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,’ ওয়াআলাইকুমুস্সালাম। কেমন আছেন। ‘

‘ আলহামদুলিল্লাহ, ভাল। মেঘ কেটে গেছে তাহলে ! ‘

‘ জি। ‘

‘ আল্লাহর শোকর। একটু আগেই আল্লাহকে বলছিলাম। এই মেয়ে কপালে না থাকলে আমাকে ভুলিয়ে দাও আর আমার কল্যানের কাছে নিয়ে যাও।’

কুমকুমের চেহারার লালিমা মুছে গেল মুহূর্তেই। সে কৃত্রিম রোষে বলল,’ এই দোয়া করেছেন আপনি ? আর আমি কিনা বোকার মত আপনার নাম ধরে দোয়া করছিলাম।’

‘ ওটা ভুল দোয়া। বান্দা আল্লাহকে ঠিক করে দেবে তার কল্যান কোথায় বাঁধা আছে ? বোকা নাকি ? আমাদের দুরদর্শিতা কতটুকুই বা কুমুদ ? এমন বোকার মত দোয়া আর কখনও করবে না। সরাসরি কল্যান চাইবে। তা সে যেখানেই হোক। আমরা যাকে কল্যান ভাবি সে আমাদের জন্য কতটুকু কল্যানকর কে জানে ! ‘

‘ স্যরি। ‘

‘ মেনশন নট। তবে তোমার কণ্ঠ শোনার পর খুশিতে আমার বুক ব্যথা করছে জানো ? মরে টরে গেলে কল্লোলকে বিয়ে করে নিও।’

‘ সব কিছু নিয়ে ফাজলামি কিন্তু ভাল লাগে না। ধ্যুৎ। ‘ ফোন কেটে সুইচিং অফ করে দিলো কুমকুম। কবুল বলার পরও তা খোলা হলো না। সাঈদ এ পর্যন্ত কয়েকবারই ক্ষমা চেয়েছে। কুমকুম জবাব দেয়নি। ঠিক করেছে এর জবাব দেবে না। তুলে নেবার অনুষ্ঠান হোক। সাঈদের ঘরে যেদিন যাবে সেদিন ভেবে দেখবে কী করা যায় । আপাতত ওর শাস্তি চলুক।

কুমকুম এখন সাঈদের বাড়ির সবার সাথেই কথা বলে সাঈদ ছাড়া। দুঃখে সাঈদের এখন পা ধরাটাই বাকি। কুমকুমের তাতে আপত্তি নেই। ধরলে ধরবে সমস্যা কী। বলবে কেন বাজে কথা। কুমকুম আজ চিনে ফেলেছে ওর শেকড়টা কোথায়। কণাই চিনিয়ে দিয়েছে। ওর কাছ থেকেই কুমকুম জেনেছে সব মাটিতে গাছ তার শেকড় গজাতে পারেনা। মাটিকে প্রথমে চেলে সেখান থেকে কঙ্কর আর ইট পাথর আলাদা করতে হয় তারপর তাতে সার আর পানি মিশিয়ে তাকে গাছ লাগানোর উপোযোগী করতে হয়। তবেই ঐ গাছের শেকড় অনেকদূর পর্যন্ত যায়। নয়ত ছোটখাট কঙ্করে শেকড় বাধাপ্রাপ্ত হয় কখনও মরেও যায়। দীর্ঘ শেকড়ের গাছ চাইলেই কেউ উপড়ে ফেলতে পারেনা।

~ সমাপ্ত~

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে