শেকড়ের সন্ধানে পর্ব-০৪

0
771

৪||

আকদ বাতিলের দুঃখে পুরোটা সন্ধ্যা ঘর থেকেই বেরুল না কুমকুম। এমনকি সারা দুপুর সন্ধ্যা পার হয়ে যাবার পরেও কিছু মুখেই দিলো না মেয়ে। শান্তা এসে একচোট পীড়াপীড়ি করে ক্ষান্ত দিয়ে রাতেই ফিরে গেল। যদিও সে আজ রাত থাকার পরিকল্পনা নিয়েই এসেছিল। বাড়িতে সবার মানসিক অবস্থা দেখে সে নিজেই থাকতে রাজি হলো না। তাতে কারো কিছু এলো গেল বলে মনে হলো না। প্রত্যেকেরই প্রচন্ড রকমের মুড অফ। কেবল মিজানুর রহমান শান্তার বিদায় বেলায় ওর স্বামীর সামনেই আক্ষেপের সুরে বলে ফেললেন, ‘ সব ঠিক থাকলে এতক্ষণে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যেত। ছেলেটা ভাল ছিল। ‘
শান্তার স্বামী বলার মত কিছু খুঁজে না পেয়ে ‘রিযিকে নেই আব্বা’ বলে সান্ত্বনা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
পেছন থেকে লায়লা বেগম এসে স্বামীকে ধরলেন, ‘ তুমি যে বারবার বলছ ছেলে ভাল ছিল, ছেলে ভাল ছিল । ছেলেটাকে কোন দিক থেকে ভাল মনে হয়েছে তোমার শুনি ? ‘

‘ বারবার কই বললাম। একবারই তো বললাম।’

‘ একবার কোথায় ? এ পর্যন্ত তিনবার বলে ফেলেছ একথা। সকালে একবার আমাকে বলেছ, এখন শান্তার বরকে বললে, তখন দেখলাম ফোনে কাকে যেন বলছ। কী শুরু করেছ তুমি ! ছেলের বাইরেটা দেখলে শুধু হবে ? বাকি দিক দেখতে হবেনা ! ‘

‘ বাদ দাও তো। এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ‘ মিজানুর শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন। লায়লা পিছু ছাড়লেন না। তিনি স্বামীর পেছন পেছন গিয়ে তার পাশে বসে বললেন, ‘ শোন, আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। সাঈদ যে মিথ্যাচার করেছে এটা তো সত্যি। যে ছেলে বিয়ে নিয়ে এরকম মিথ্যাচার করতে পারে সে সংসার নিয়েও করতে পারবে। গিয়ে দেখো গে তার কোথায় আর কত কাহিনি আছে, কে জানে। তারচেয়ে তো কল্লোল লাখ গুণ ভাল। ওর দোষের মধ্যে দোষ ঐ ভিডিওটা। ওটা একসাথে ওঠাবসা করতে গেলে হয়ই। এগুলি সব আজকাল ছেলেপিলেদের একটা স্বভাব হয়ে গেছে। হাতের কাছে পায় এক ছাতার মোবাইল। ব্যস্, সবার আগে পুট করে একখান ছবি তুলে ফেলে। কল্লোলের ঐ দোষটা বাদ দিলে তো সবদিক দিয়ে ঠিকই দেখি আমি ওকে। বারো বছর ধরে দেখছি। হাসিখুশি, কথাবার্তাও ভাল। এখন তো ভাল চাকরিও করছে। দেখতেও খারাপ না। সবচে বড় কথা কণার আপন ভাই ও। ভবিষ্যতে কোনরকম ডান বাম করতে পারবে না। তেমন বেচাল দেখলে ওর বোনকে গলা টিপে ধরতে পারব আমরা।’

মিজানুর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। লায়লা থামলে তিনি বললেন, ‘ কত ভয়াবহ চিন্তা তোমার। কত অনায়াসে কণাকে পর ভাবতে পারলে ৷ আগামী পাঁচবছরের ঘটনা পাঁচমিনিটে সাজিয়েও ফেলেছ। সত্যি, কণা মনপ্রাণ দিয়ে এ বাড়ির মেয়ে হতে পারলেও বাকি জীবনে তুমি ওর মা হতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে আমার।’

‘ শোন মেয়ে মেয়েই বউ বউই। আমার মেয়ের সবদিক আমাকেই ভাবতে হবে। কণার মত গোঁয়ার্তুমি আমার সাজে না।’

‘ মা হয়ে তুমি যা ভাবলে তাতে তোমার মেয়ের সমর্থন আছে তো ? ও তো দুপুরে ভাতও খেল না বিয়ে ভাঙার শোকে।’

‘ না খাক গিয়ে। এসব আলগা জিদ প্রশ্রয় দেবার কোন মানে নেই। ওকে পরিস্থিতি বুঝতে হবে। কোথাকার কোন ছোকরা দুদিন এদিক সেদিক নিয়ে বেড়াল। চাইনিজ ফাস্টফুড খাওয়ালো আর তোমার মেয়ে কাত। ‘

‘ দুনিয়াটাই এমন। কেবল তোমার মত শ্বাশুড়িরা সহজে কাত হয় না। যাক্ , এসব না বলে ওকে বোঝাতে পারো কি না দেখ। ও রাজি হলে চলো কণাদের বাসায় গিয়ে মিষ্টি নিয়ে দেখা করে আসি। বিয়েটা হয়ে যাক। তোমার যখন এতই ইচ্ছা। তোমার ছেলেরও আগ্রহ আছে দেখলাম। আমিই বা বাকি থাকি কেন। ‘

‘ না থাকার তো কারণ নেই। আচ্ছা , দেখি। তার আগে কুমুর সাথে কথা বলে দেখি। কণাকে দিয়েই বলাতে পারতাম। কিন্তু পারলাম কই। কণা তো এমন ভাব করছে যেন কুমকুমের না ওরই বিয়ে ভেঙেছে। ঢং আরকি। ঐ যে বলেনা মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ! আসলে কুমকুমকে বিয়ে করালে ভাইকে দিয়ে মোটা যৌতুক নিতে পারবে না তো। এজন্যই ফুলে আছে। ‘

‘ দয়া করে, তোমার এসব ফালতু কথা বন্ধ করবে? কণা শুনলে কী হবে একবার ভেবেছ! ‘

‘ শুনুক গে, আমি কী ভয় পাই নাকি ! আর আমি কোন ফালতু কথা বলিনা। ঠিকই বলি। কুমুর বিয়ের সময়ই আমার সন্দেহ হয়েছিল। এত পয়সাওয়ালা ফ্যামিলি একবাক্যে মেয়ে নিতে রাজি হয়ে গেল, কাহিনি কী। তা কণা আমাকে এটা সেটা বলে বুঝ দিলো। তাই তো বলি। গোমড়টা কোথায় ! ‘

‘ দুর, তোমার সাথে কথা বলাই আরেক বিপদ।’ মিজানুর সরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালে লায়লা পেছন থেকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘ এই যে শোনো, তুমি দয়া করে মেয়ের সামনে আর পুরোনো ডুগডুগি বাজিয়ো না। তোমার মেয়ে এমনিতেই নাচুনী বুড়ী। তোমার এসব কথা শুনলে ঢোলে বাড়ি পড়বে।’

‘ কোনসব কথা ? ‘

‘ আরে ঐ যে, সাঈদ ছেলে ভাল ছিল টিল..!’

‘ আরে নাহ্, ওর সামনে কেন বলব ? বোকা পেয়েছ নাকি! ‘ মিজানুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দার দিকে চলে গেলেন।

রাতে খাবার টেবিলে প্রথমে কাউকেই দেখা গেল না। কণাকেই গিয়ে সবাইকে ডেকে আনতে হলো। কুমকুম শান্তা থাকতেই ঘোষণা দিয়েছিল সে রাতে কিছু খাবেনা। তার নাকি খিদে নেই ৷ কণাও আর তাকে পীড়াপীড়ি করল না। বাধ্য হয়ে মিজানুর লায়লা আর আসিফকেই বসতে হল। কণা খাবার বেড়ে সামনে দিলো। মিজানুর রাতে ভাত খান না। তিনি রুটির কোণা ছিঁড়ে ঝোলে ডুবিয়ে মুখে দিলেন। আসিফ তখনও ভাতে হাত দেয়নি। সে চুপচাপ কণাকে দেখছে। কণার প্রতিটা মুখের ভাঁজ তার মুখস্ত। সে ভাল করেই জানে বিয়ে ভাঙার ব্যপারটা ওর পছন্দ হয়নি। তবে এ নিয়ে সে দ্বিতীয়বার উচ্চবাচ্যও করেনি। খাবার বেড়ে দিয়ে কণাকে নিঃশব্দে চলে যেতে দেখে আসিফ ডাকল।
‘ কী হলো, তুমি বসবে না ? ‘

‘ না, আমি আজ আর খাব না। সন্ধ্যের খাবারই হজম হয়নি।’ সহজ সুরে বলল কণা। আসিফের তাতে মন ভিজল না। সে অসন্তোষের সুরে বলল, ‘ সন্ধ্যায় এমন কী খেলে দেখলাম না তো।’

‘ একবাটি দইপাস্তা খেয়েছি।’

‘ খেয়েছ তাতে কী। এখন সবার সাথে অল্প করে খাও।’

‘ না, ইচ্ছে করছে না। খিদে লাগলে পরে হালকা কিছু মুখে দিয়ে নেব।’

‘ পরে না, এখনই বসো। অল্প করে মুখে দাও।’

‘ একবার তো বললাম আমার খিদে নেই। ‘

‘ আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আমিও পরে খাব।’ বলেই সশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল আসিফ। কণা এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এসে চুপচাপ বসে পড়ল একটা চেয়ার টেনে। ওর দেখাদেখি আসিফও ফিরে এসে বসে পড়ল। লায়লা কেবল মুখ তুলে দুজনকে দেখলেন। কোন মন্তব্য করলেন না। নিঃশব্দে খাওয়া সারল ওরা।

কণা টেবিল গুছিয়ে রান্নাঘরে গেলে আসিফ তার পিছু নিলো। লায়লা পেছন থেকে দেখলেন ব্যপারটা। তিনি ধীর পায়ে কুমকুমের ঘরে চলে এলেন। স্ত্রীকে মেয়ের ঘরের দিকে যেতে দেখে মিজানুর আর সেদিকে গেলেন না। নিজেদের শোবার ঘরে চলে গেলেন।

কুমকুমের রুমের দরজা খোলাই ছিল। লায়লা দেখলেন কুমকুম চোখ মুখ লাল করে শুয়ে আছে। মাকে দেখেও তার মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলনা।
লায়লা খাটের কিনারায় গিয়ে বসে একা একাই বলতে শুরু করলেন, ‘ মেয়েদের ভাগ্য হলো দাসীবান্দীর। এরা কপালজোরে রাণী হয় আর নয়ত দাসী। তা যেমন বাড়িতেই বিয়ে হোক না কেন। জামাই মাথায় তুলে রাখলে সে রাণী। তোর ভাবিকে দেখ। আমার ছেলের কাছে সে মহারাণী। জামাই পাত্তা না দিলে কোটিপতির ঘরে গেলেও মেয়েরা বাঁদীই থাকে। এই আমাকেই দেখ। তোর বাবার সাথে বিয়ের আগে আমার এক দূরসম্পর্কের মামাত ভাইয়ের সাথে বিয়ের কথা লেগেছিল। ঐ মামার বিরাট অবস্থা। মামা আমাকে তার ছেলের জন্য পছন্দ করলেন। সব ঠিক হঠাৎ আমার দাদু ঝামেলা পাকাল। ঐ মামাত ভাইয়ের নাকি কার সাথে লাইন জাইন আছে। ব্যস্, আমার বাবা তো বিগড়ে গেল। সে মেয়ে দেবেনা। তার উপর তোর দাদুর অবজেকশন। আগের দিনে তো মুরুব্বিদের কথার উপরে কেউ কথা বলার সাহস পেত না। বিয়েটা ভেঙে গেল। রাতারাতি বিয়ে হয়ে গেলো তোর বাবার সাথে। আমি কী খারাপ আছি ? ‘

কুমকুম জবাব দিলো না। তাকালও না। লায়লা বললেন, ‘ আজ তোর বিয়ে ভাঙার কারণে আসিফ আর কণার মাঝে মনোমালিন্য। কণা তো ঠিকমত কথাই বলছেনা আসিফের সাথে। খাবার টেবিলেও তেজ দেখিয়ে উঠে চলে যাচ্ছিল। আমার ছেলেকে পা ধরে বসাতে হলো ওকে। এখন বউ এর পেছনে পেছনে ঘুরছে আর লেজ নাড়ছে। দেখে এমন রাগ উঠল। মুখ ফসকে কী না কী বলে ফেলব তাই চলে এলাম। আরে বাবা এমন কী অন্যায় করেছে আমার ছেলে যে তোর হুজুর হুজুর করবে। ‘

কুমকুম আস্তে করে সোজা হয়ে বসল। ভাইয়া আর কণা ভাবির মধ্যে তাহলে সমস্যা বেঁধেছে ? অবশ্য এমন আশঙ্কা ওর নিজেরও হয়েছিল। কুমকুমকে খানিকটা চিন্তিত দেখাল। তবে মুখে কিছু বলল না। মায়ের বাড়িয়ে বলার অভ্যাসটা ভাল করেই জানা আছে ওর।

লায়লা মেয়ের নড়াচড়া দেখে বললেন ‘ কল্লোলের সাথে বিয়েতে তুই রাজি না কথাটা জেনেই কণা এত রাগারাগি করছে। হাজার হোক মায়ের পেটের ভাই তো। যে মেয়ে ওর ভাইকে পছন্দ করবে না তেমন মেয়ে সে বাড়িতে নেবে কেন। ওর মায়ের সাথে লাগালাগি করতে নেবে নাকি ! তোর আসিফ ভাইয়া সেই তখন থেকে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কণা তো কণাই। রেগে গেলে দারোগা। সবাই তো ওর ভাল মানুষের রূপটা দেখে। আসল রূপ তো দেখি আমরা।’

‘ মা চুপ কর তো। এসব শুনতে ভাল লাগছে না আমার ।’
‘ তা লাগবে কেন। ভাবির নামে তো দেওয়ানা মাস্তানা। তা ভাবি যখন এত প্রিয়, তো ওর ভাই কী দোষ করল ? ‘
‘ কী আশ্চর্য, সব জেনেশুনে একথা বলতে পারছ মা ? কল্লোল যেটা করেছে সেটা অন্যায়। আমাকে অপমান করা। আমাকে না বলে আমার ঘুমন্ত অবস্থার বিশ্রী সব ছবি তুলেছে সে। যেন পরে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। আর আমি সাঈদকে বিয়ে করতে পারব না বলে যে ওকেই বিয়ে করতে হবে এমন তো কথা নেই। এমনটা ভাবার দরকারও নেই। আমি দরকার হলে বিয়েই করব না। তবু ঐ বদমাশকে না।’

‘ তাহলে আর কী। বসে বসে ভাইয়ের সংসারে আগুন লাগতে দেখ।’

‘ এখানে আগুন লাগার কী আছে ! ‘

‘ নেই ভেবেছিস ? যেখানে কল্লোলের ব্যপারে আমাদের কারো দ্বিমত নেই। সেখানে কণা একা এর বিরুদ্ধে। কেন! তোর ভাইয়েরও তো ইচ্ছা কল্লোলের সাথে তোর বিয়ে হোক। শুধু আসিফ কেন কণার বাবার আর মায়েরও ইচ্ছা কল্লোলের সাথে তোর বিয়েটা হয়ে যাক। তাছাড়া কল্লোল ঘরের ছেলে। বারো বছর ধরে দেখছি। তোর জন্য পাগল। আসল জোরটাই তো এখানে। যেভাবে নাচাবি ঐভাবে নাচবে। এখন তো ভাল বেতনের চাকরিও করে। ঐ ভিডিওটা করা ছাড়া আর তো কোন দোষ করেনি বেচারা। ‘

‘ আমি তোমাদের কাউকেই বলে বোঝাতে পারছি না ব্যপারটা।’ কুমকুমের কণ্ঠ রুদ্ধ হলো এবার।

‘ কী বোঝাতে চাস বল দেখি বুঝি কিনা।’

‘ সাঈদ অনেক ভাল ছেলে মা। ওর আসলেই কোন দোষ নেই। ভাবিকে সব বলেছি আমি। তাছাড়া একটা মেয়ে হিসেবেও জানি সাঈদ ছ্যাবলা না। তোমার ঐ কল্লোলের তো নজরও ভাল না। সামনে গেলে সে মুখের দিকে না তাকিয়ে আগে গায়ের দিকে তাকায়। বদস্বভাবের পুরুষ কোনদিন ভাল হয় না মা। এদের স্বভাব বিড়ালের মত। খাবে ঘরেরটা নজর থাকবে পরের পাতিলে।’

‘ ওরে বাবা, পুরুষ জাতের উপর দেখি পিএইচডি করে ফেলছিস! পুরুষ মানুষ কেমন তুই আমাকে শিখাবি?’

‘ হ্যাঁ শেখাব। কারণ আমার বাবার মত সহজ সরল পুরুষ মানুষকে তুমি ভেড়া বানিয়ে রেখেছ।’

‘ হ্যাঁ, রেখেছি। তুইও রাখবি কল্লোলকে। সমস্যা কী। ‘

‘ মা তুমি যাও তো এখান থেকে। আমার তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্লিজ যাও।’ লায়লা মুখ কালো করে উঠে চলে এলেন।

=====

পাশ ফিরে থাকায় আবছা আলোয় কণার মুখ পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল না। আসিফ কাত হয়ে ওর বাহুতে হাত রাখতেই কণা আরো ঝুঁকে বুকের কাছে শুয়ে থাকা ছেলেকে আঁকড়ে ধরল। আসিফ মৃদু স্বরে বলল, ‘ তুমি কী এখনও আমার ওপর রেগে আছ ? ‘

‘ কোন কারণ আছে নাকি রাগ করার ? ‘

‘ আমার তো মনে হয় নেই। তুমি আছে ভাবলে আমি কীভাবে জানব। ‘

কণা নিরব। আসিফের স্বর গাঢ় হলো।
‘ কল্লোলের সাথে বিয়ে দিতে আপত্তিটা কোথায় বলবে ? ‘

‘ কোন আপত্তি নেই। গায়ের উপর থেকে সরে কথা বলো প্লিজ । ‘ আসিফ সরল না বরং আরো এগিয়ে এলো।

‘ আচ্ছা, আপত্তি আছে না নেই সেটা আপাতত বাদ থাক। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের মাঝখানে সমস্যা তৈরি হবে কেন বলো তো ! সংসারে এমন অনেক ঝড় আসবে যা এক দরজা দিয়ে এসে অপর দরজা দিয়ে চলে যাবে। আমাদেরকে কেন নাড়িয়ে দেবে। বারোটা বছরে ভালবাসার ভিত কী শক্ত হয়নি ? ‘ আসিফের স্বর অপেক্ষাকৃত নরম। আচরণে সে সদা তৎপর। কণাকে পরাস্ত হতে হলো। কণা বলতে চাইল কল্লোল নামের ঝড় আমার সংসারটাকে তচনচ না করে দেয় সেই ভয়েই কাঁটা হয়ে আছি আসিফ। কিন্তু বলার সুযোগ পেলে কই। আসিফ বরাবরই তার অধিকারে সবল।

====

পরদিন কোনরকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই কণার বাবা মা চলে এলেন। তাদের বক্তব্য যদিও বেয়াই যুগলকে সান্ত্বনা দেয়া কিন্তু উপলক্ষ যে কল্লোল তা বোঝার বাকি রইলো না কণার। কারণ তাদের হাতে একগাদা মিষ্টি সন্দেশ রাবড়ি রসমালাই। যদিও কণার জেরার মুখে সায়মা তা একবারও স্বীকার করলেন না। তিনি বগুড়ার দই কুমিল্লার রসমালাই বলে চালিয়ে দিলেন। একপর্যায়ে কপট রাগে মেয়েকেই ধমকে দিয়ে বললেন, ‘ এত জেরা করিস কেন। আমি কী তোদের ভাল মন্দে আসতে পারি না ! আমার আসতেও কারণ লাগবে ? ‘

‘ তুমি আর বাবা যে কল্লোলের কথায় এসেছ তা তো বোঝা যায় মা।’

‘ এলেই বা সমস্যা কোথায় তোর বল তো ? কেন নিজের ভাইয়ের সুখের পথে বাঁধা হচ্ছিস ! তোর কাছে কুমকুম বড় হয়ে গেল ! ‘

‘ তার মানে তুমিও জানো যে কুমু কল্লোলকে বিয়ে করতে রাজি না! ‘

‘ রাজি না হবার কারণ ঐ সাঈদ। সাঈদের ভুত মাথা থেকে নামলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো বলি দেরি না করে আকদ পড়িয়ে দেয়া হোক। কই যাবে সাঈদ ফাইদ।’

‘ আমার অবাক লাগছে মা। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের ফিলিংসের দাম নেই তোমার কাছে ? কুমু রাজি না জেনেও ঝুঁকি নিতে চাইছো ? ‘

‘ শোন্, সংসার জীবনটাই হলো যুদ্ধ ক্ষেত্র। এখানে ফিলিংস না বুদ্ধির জোর লাগে। কতদিন ধরে আমার কল্লোলটাকে ঘরে বাঁধতে চাইছি। কত মেয়ে দেখালাম, বান্দা বিয়ের নাম নেয় না। ঐদিকে দুনিয়ার আজেবাজে মেয়ের সাথে খাতির। এই প্রথম সে কুমকুমকে বিয়ের জন্য উতলা হলো। সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিত হবে তুইই বল ? ‘

‘ আর ভবিষ্যতে যখন তোমার ছেলে কুমুর সাথে সমস্যা করবে তখন আমার আর আসিফের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবেছ ? কল্লোল তার চাওয়ায় সৎ হলে আমি নিজেই আজ কুমুকে বোঝাতাম। কিন্তু কল্লোল কতটা ছটফটে মানসিকতার তা জানি বলেই ভয় পাচ্ছি মা।’

‘ ভয় পাওয়ার কী আছে। ছোটভাই সে তোর। বেচাল দেখলে সামলে নিবি, শাসন করবি। ভাইটা তো থিতু হলো। তুই বাবা কুমুর ব্যপারে একটু বেশিই করছিস। মানুষ শুনলে তো বলবে মায়ের জ্বলে না মাসির জ্বলে।’

কণা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল এবার। সে তার মাকে এই রূপে দেখে অভ্যস্ত নয়। সারাজীবন সব ব্যপারে ওর পরামর্শ ছাড়া চলতে না পারা মা আজ কত অনায়াসে ছেলেকে ঘরে বসানোর আগ্রহে পরামর্শ তো দুর সামান্য কৈফিয়তও শুনতে নারাজ। কণা বলার মত কিছু খুঁজে পেল না। আতিথেয়তার পুরোটা সময় ধরেই সে দুই মায়ের স্বার্থপরতা দেখল তাকিয়ে তাকিয়ে।

আসিফ আজ ততটা সরব না হলেও মৌণ সমর্থন নিয়ে তাদের পাশে গিয়ে বসল। ওর ভাবখানা এমন বিয়ে হলেও যা না হলেও তা। আমার কোনটাতেই আপত্তি নেই। একা কণাই প্রতিবাদের ব্যানার ঝুলিয়ে মেহমানদারি করল। যাবার সময় সায়মা নিজের গলার ভারি চেইনটা খুলে কুমকুমকে পরিয়ে দিয়ে গেলেন। কোন বড় ধরণের বাক্যবিনিময় ছাড়াই কথা আদানপ্রদান হয়ে যেতে দেখল কণা। এভাবেও বিয়ে পাকা করা যায় তাহলে।

রাতে কুমকুম এসে ডাকলে কণা নিজেই বেরিয়ে এলো৷ আসিফ এখন ঘরে নেই। সে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে গাড়িতে তুলে দিতে গেছে। কুমকুম এই সুযোগে কণার কাছে এসে একটা ছোট্ট কৌটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ ভাবি, এটা নাও। এটা এখনও ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। তুমি ভাইয়া বা অন্য কারো হাতে একটু কষ্ট করে পাঠিয়ে দিয়ো এটা।’ বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো কুমকুমের। বোঝা গেল সে প্রানপণ নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে।
কণা কৌটা আর ব্যাগ হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বলল,’ কী আছে এতে ? ‘

‘ সাঈদের পরানো আংটিটা। ফেরত দেয়া হয়নি এটা।’

‘ এনগেজমেন্টের আংটি আর চেইন তো তোর ভাই সেদিনই দিয়ে এসেছো।’

‘ না না। এটা এনগেজমেন্টের আংটি না। সাঈদ আমাকে আলাদা গিফট করেছিল। আর এই ব্যাগটাতে কিছু প্যাকেট। এগুলোও দিয়ে দিয়ো।’

‘ কী আছে প্যাকেটে ? ‘

‘ জানি না। খুলিনি। সাঈদ নিজেই মানা করেছিল খুলতে ৷ বলেছিল আকদ হবার আগে যেন না খুলি তাহলে নাকি ওকে ভুল বুঝব। এটা আকদের পরে খুলতে হবে।’

কণা কিছু না বলে প্যাকেটটা বের করে হাতে নিলো। চমৎকার নীল কাগজে র‍্যাপ করা একটা সুদৃশ্য মোড়ক। শুকিয়ে যাওয়া ফুলের নিচে গুঁজে দেয়া একটা ছোট্ট চিরকুট। কণা নিজেই সেটা খুলে লেখাগুলো পড়ল।

-” প্রিয় হবুবধূ, আর কেউ না জানুক আমি তো জানি, এ আমার প্রথম ভালবাসা। তবে ভালবাসা আর ভাল বাসা এক না। একজন স্ত্রী দুটোই। তুমি এখনও প্রথমটা। দ্বিতীয়টা মানে আমার স্ত্রী হবার পরই তুমি অধিকার পাবে এই প্যাকেটটা খোলার। নয়ত আমি চাইব না পৃথিবীর অন্য কেউ এসে আমার বুকের ভেতরের জমানো ইচ্ছেগুলোর মোড়ক উন্মোচন করুক। এই অসভ্যতা তো কেবল আমি আমার বঊ এর সাথেই করতে চাইব। যে আমার নিজস্ব নারী। আমার জীবনবৃক্ষের শেকড়। যাকে ছাড়া আমার জীবন সরাইখানা। যেখানে রান্না খাওয়া শোওয়া সবই হয় কেবল সংসার হয়না। ‘

কণা চিঠিটা ভাঁজ করে যেখানে ছিল সেখানে রেখে কুমকুমের দিকে তাকাল। কুমকুম মুখটা শক্ত করে রেখেছে। কণা বলল,’ কেঁদেকেটে চেহারাকে তো বাতের রুগীদের মত ফুলিয়ে ফেলেছিস। আজ সারাদিন নামাজও তো মনে হয় পড়িসনি।’

‘ না। ‘ শক্ত কণ্ঠে বলল কুমকুম। ‘ নামাজ সুরা কিছুই পড়িনি। কোন কাজে আসেনি ঐ সুরার আমল।’

‘ হুম। তোর মত সিজনাল ধার্মিকরা এরচে বেশি কী ভাববে। কমপাউন্ডারের কাছ থেকে হাবিজাবি ঔষধ কিনে খেয়ে বলবি রোগ সারেনি। দোষ অষুধের না তোর ? ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অষুধ খেলে তো এমনই হবে।’

‘ ডাক্তার আবার কে? ‘ কুমকুম বড় বড় চোখ করে তাকাল।

‘ আমলের ডাক্তার। তিনি তো একজনই। আল্লাহর রাসুল সাঃ। তাঁর কাছ থেকে যারা ডাক্তারী শিখেছেন তাদের কারো সাজেশন কী ছিল ওটা ? কোথাকার কোন বান্ধবী বলল আর কিতাব খুলে বসে গেলি ? ইসলামকে কী গাঁজাখোরদের ধর্ম পেয়েছিস। যখন যেখানে যা মন চায় জুড়ে দিবি ? ঐ আমল কী অথেনটিক ছিল? সোর্স কী ? ”

‘ তা আমি জানব কী করে? ‘

‘ খুঁজলে না জানবি। মিনিমাম দু রাকাত নামাজেও তো পরিত্রাণ চাইতে পারতি। ওয়াক্তের নামাজ বাদ দিয়ে হাজতের নামাজ পড়লি সেদিন। দেখলাম তো সবই। আস্ত কুরআনটা বাদ দিয়ে সুরা নূহ সাতবার। ফাজলামো করিস ? ‘

‘ ওটাও তো কুরআনেরই অংশ। সুরা পড়া তো ভাল কাজ।’

‘ নামাজ পড়াও তো ভাল কাজ। কাল থেকে পাঁচ রাকাত যোহর পড়িস তাহলে ?’

‘ যাহ তা কী হয়? ‘

‘ তা যদি না হয় তাহলে ফরয বাদ দিয়ে মনগড়া নফল করিস কোন সাহসে ? আবার বলিস কোন কাজে আসেনা। থাপ্পড় মেরে দাঁতগুলো ফেলে দেব। এসব বললে ঈমানই থাকবে না মনে রাখিস।’

‘ স্যরি। আর বলব না। ‘

‘ আচ্ছা যা এখন। আমি এগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। ভাল করেছিস প্যাকেট খুলিসনি। অন্যের স্ত্রীর প্যাকেট খোলা উচিত হত না।’
লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কুমকুম। কোন কথা না বলে চলে গেল। কুমকুম চলে যেতেই কণা কল্লোলকে ফোন দিলো।
‘ হ্যালো, কল্লোল, একটু আসতে পারবি ভাই ? ‘

‘ এত রাতে ? কাল সকালে আসি। বিছানায় শুয়ে পড়েছি আপা। উঠতে ইচ্ছে করছে না।’

‘ আসলে সকালে তো ব্যস্ত থাকি। বাবুর স্কুল থাকে, তোরও অফিস। ‘

‘ জরুরি কিছু আপা? ‘

‘ একটু জরুরিই। বাইকটা টান দিয়ে চলে আয় না ভাই, সমস্যা কী। ‘

‘ আচ্ছা আসছি। ফোন রাখ।’

[চলবে]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে