শেকড়ের সন্ধানে
৩||
আকদের দিন সকালেই দুর্ঘটনাটা ঘটল। কণা বাবুকে স্কুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে দেখল রেখে যাওয়া শান্ত পরিবেশটা কেমন যেন অস্থির আর অশান্ত। অথচ যাবার সময়ও সবকিছু শান্ত ছিল। প্রতিদিনের মত আজও ওরা চারজন একসাথেই নাস্তা করেছে। মিজানুর লায়লা, আসিফ আর সে নিজে। কুমকুম ঘুমিয়ে ছিল বলে ওকে ডাকেনি। বেচারি আজকাল ফজরে উঠে নামাজ পড়া ধরেছে। গত কয়েকদিন ধরেই সে এটা করছে। এর আগে তাকে রেজাল্টের টেনশন ছাড়া কোনদিন জায়নামাজে দেখা যায় নি। জায়নামাজ লায়লা বেগমের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। রেজাল্টের দুদিন আগে কুমকুম সেটা মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিতো। এবারই প্রথম রেজাল্ট বা পড়াশোনা সংক্রান্ত ব্যপার ছাড়া ব্যক্তিগত কারণে সে নামাজ পড়ছে। তারমানে প্রয়োজনটা রেজাল্টের মতই গুরুত্বপূর্ণ। ইদানীং সে নামাজ পড়ে কিছু সুরাও পড়ছে। জিজ্ঞেস করাতে বলল এটা সুরা নূহ। এটা সাতবার পড়লে নাকি মনের আশা পুরণ হয়। কোত্থেকে যেন একটা পকেট বই যোগাড় করেছে তাতে পাঞ্জেগানা সুরা শিরোনামে কিছু সুরা ও তার ফজিলত বর্ণনা করা আছে। কণা নিজেই নেড়েচেড়ে দেখেছে সেটা। মুখে কিছু বলেনি আর ওকে সকালে দ্বিতীয়বার ডাকেওনি।
শান্তা বাড়ি নেই। সে গতরাতেই নিজের বাড়ি ফিরে গেছে। কণা ওকে প্রথমে রাতে থাকতে বলেছিল। শান্তা রাজি হয়নি। পরে সকালে চলে আসতে বলেছিল। সে তাতেও রাজি না। সকালে এলে তার সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে পরার জন্য একগাদা কাপড় আলাদা বস্তা বাঁধতে হবে। শান্তা এত ঝামেলা করতে রাজি না। তারচেয়ে একেবারে সরাসরি বাড়ি থেকে তৈরি হয়ে আসবে সেটাই নাকি ভাল। কণার ধারণা ও পার্লার হয়ে আসবে। এসব নিয়েই নানান আলোচনা করে নাস্তা পর্ব শেষ করেছে ওরা। নাস্তা শেষে আসিফ নিজের কাজে বেরিয়ে গেছে। মিজানুর আর লায়লাকে দেখেছে তখনই নিজেদের ঘরে গিয়ে দিনের দ্বিতীয় দফা ঘুমের প্রস্তুতি নিতে। এটা তাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ভোর পাঁচটা থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত জেগে থাকার পর নয়টা থেকে এগারোটা পর্যন্ত একটা ছোট্ট ঘুম । তারপর উঠে গোসল নামাজ ইত্যাদি।
আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কল্লোল এসে বসে আছে ড্রইংরুমে। তবে সে একা আসেনি। তার সাথে আজ কণার মা সায়মা হকও এসেছেন। সাত সকালে মা ভাইকে দেখে খুশি হবার বদলে চিন্তার রেখা ফুটল কণার কপালে।
‘ কী ব্যপার তোমরা এসময় ?’ বলতে বলতে উদ্বিগ্নচিত্তে ড্রইংরুমে প্রবেশ করে আসিফকে বসে থাকতে দেখে আরেকটা ধাক্কা খেলো কণা। তার পাশেই মুখ কালো করে বসে আছেন মিজানুর রহমান আর লায়লা বাণু। লায়লা বাণু যথারীতি আঁচলে চোখ চেপে কাঁদছেন। কান্না ছাড়া তাকে ঠিক মানায়ও না। কুমকুম ঠিকই বলে ‘চোখের পানি রেডি থাকে তোমার। কল ছাড়তেই গলগল করে পড়ে। কই পাও এত পানি ? নাকি এটা মাগার মাছ কী আঁশু ? শেষের বাক্যটা বলে অবশ্য একদিন সপাটে চড় খেয়েছিল কুমকুম। তবে আজকের কান্নাটা মাগার মাছ তথা কুমিরের অশ্রু বলে মনে হচ্ছে না। আজ লায়লার কান্না যথার্থই আহাজারি মনে হচ্ছে।
কণা কোন প্রশ্ন করার আগেই লায়লা বিলাপের সুর তুললেন, ‘ আমার মেয়েটার কপালে কী একটু সুখ তুমি রাখো নি আল্লাহ ? এতো ঝামেলা কেন আমার মেয়ের জীবনে ? কী দোষ করেছিলাম আমরা…! কণা বিরক্তি চেপে আসিফের দিকে তাকাল।
‘ কী হয়েছে আসিফ ? ‘ কণা কল্লোলকে কোন প্রশ্ন করল না। শ্বাশুড়ির বিলাপ অসহ্য ঠেকছে। তার কান্নার ধরণ সবসময়ই অসহ্যকর। তবে মাঝেমধ্যে লাভও হয়। কান্নাটা পরিস্থিতির ভার কমিয়ে একে হালকা করে দেয়। এই যেমন এখন। বোঝা যাচ্ছে যা হয়েছে তা অপ্রীতিকর কিছু তবে ভয়ংকর না। ভয়ংকর হলে তিনি কাঁদতেন না। অধিক শোক মানুষকে পাথর করে দেয়। অল্প শোক কাতর। তার শ্বাশুড়ি সদাই কাতর। এটাও কাতর হবার মতই কিছু, পাথর হবার মত না।
আসিফই ইঙ্গিতে কল্লোলকে দেখাল। কণা কল্লোলের দিকে তাকাল।
‘ কী হয়েছে রে কল্লোল ? তুই সাত সকালে এখানে কেন ? অফিস নাই তোর ? ‘ কণার শান্ত অথচ কঠিন মাপের তিনটা প্রশ্নেই কল্লোলের বিষম খাবার দশা। প্রথম প্রশ্নটাই ঠিক ছিল। শেষের দুটা ইঙ্গিতপূর্ণ। আর কণার এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই সে তাকে একটু ভয় পায়। সেকারণে সমঝেও চলে। কল্লোল সামান্য কেশে শুরু করল।
‘ ইয়ে, ঐ পাত্রপক্ষের ব্যপারে একটা সংবাদ পেয়ে তোমাদেরকে জানানো দরকার মনে করলাম। চেপে যেতে পারতাম কিন্তু বিবেক সায় দিলো না।’ কণা নিরব। সে একদৃষ্টিতে ভাইকে দেখছে।
‘ কী সংবাদ ? ‘
‘ তোমরা নিজেরাই যাচাই করে নিও। আমি বলব না। আমার কথা তো তোমরা বিশ্বাসই কর না। এ কারণে আমার বলতেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কী করব। আজ রাতে আকদ আর আজই এখবর। জেনে শুনে তো আর চুপ থাকতে পারিনা।’
‘ কথা কম বলে সংবাদ কী সেটা বল। বাকিটা আমাদের ওপর ছাড়। কতটুকু নেব আর কতটুকু ফেলব ওটা আমাদেরকেই বুঝতে দে।’ কল্লোল বোনের দিকে তাকাল। কণার এই দাপটটাই অসহ্য লাগে। বেশি মাতব্বরি। রাগটা চড়তে গিয়েও থেমে গেল।
কণাকে মাঝেমধ্যে ভয়ই হয় ওর। আর এটা কোন আতঙ্ক বা অপরাধবোধ থেকে নয়। এটার উৎপত্তি নিগূঢ় শ্রদ্ধাবোধ। কণা সবসময়ই তাদের পরিবারের জন্য একটা স্তম্ভের মত। কেবল বড় বোন বলেই নয় অভিভাবক হিসেবেও কণার জুড়ি নেই। গত একযুগ ধরে কণা তাদের পরিবারে বসবাস না করলেও তার দুরদর্শীজ্ঞান থেকেই পরিবারকে যে দিক নির্দেশনা দেয় তাতে ওদের ভাইবোনদের খুব বেশি বেচাল হবার সুযোগ থাকেনা। কল্লোলের মা এখনও তার বাকি ছেলেমেয়েদের কণার কথা বলেই ভয় দেখায়। তাদের আটকে রাখে। তার বক্তব্য হয়, ‘ আগে কণার সাথে কথা বলে দেখি ও কী বলে। ‘ এই বাক্যটাই ওদের সব ভাইবোনের জন্য সেন্সরবোর্ডের পারমিশনের মত। ওদের মধ্যে একমাত্র কল্লোলই বেপরোয়া। সে কণার এই খবরদারি পছন্দ করেনা বলে ওর সাথে কণার অন্তরঙ্গতা কম। তাতে অবশ্য কণার ভালবাসা কমে যায়নি। ভাইয়ের এসব কীর্তির সবই সে জানে। তবু মুখে কখনও এ নিয়ে চোটপাট করেনা বরং এখনও কল্লোলের পছন্দের খাবার রাঁধলে সেটা আলাদা করে তুলে রাখতে বা দারোয়ান ছোকরাটাকে দিয়ে মায়ের কাছে পাঠাতে ভুল করেনা। কণার এসব নিরব ভালবাসার কাছে বারবারই পরাজিত হয় কল্লোল। ঠিক এ কারণেই কুমকুমকে প্রচন্ড ভালবাসা সত্ত্বেও কণার কাছ থেকে তার প্রশ্রয় আশা করতে পারেনা। কল্লোল ভাল করেই জানে কণা আদর করে মাথায় যেমন তুলতে পারে, এক আছাড়ে ভূপাতিতও করতে পারবে। সে নামেই কুমকুমের ননদ। আসলে বসে আছে ওর বড়বোনের পদমর্যাদায়। কল্লোলের বেপরোয়া জীবনে যে কুমকুমকে সে পছন্দ করবে না এটা তো স্পষ্ট। কুমকুম ওকে পছন্দ করলে একটা কথা ছিল। তাতে হয়ত সমর্থন করতে বাধ্য হত কণা। কিন্তু বেয়াদব মেয়েটা বিচিত্র কারণে ওকে পছন্দই করেনা। নানা ভাবে চেষ্টা করেও ওর মনে ঢুকতে পারেনি কল্লোল। একদিন তো জোর করে চুমুও খেয়েছিল। তাতেও কাজ হয়নি। শেষ চেষ্টা হিসেবে ছিল ঐ ভিডিও থেরাপি। সেটাও ফ্লপের পথে। যদিও হাল ছাড়েনি কল্লোল। সময়মত ভিডিও শো হবে। আপাতত যেটা হাতে পেয়েছে সেটাই যথেষ্ট। গত দুদিন ধরে যখন নিরাশার অন্ধকারে খাবি খাচ্ছিলো কল্লোল। তখনই এটা ওর হাতে আসে। এ যেন আকাশের চাঁদ স্বেচ্ছায় ওর হাতে নেমে আসা। কল্লোলের হাতে এখন মজবুত প্রমাণ।
কণার দাবড়ির মুখে বিপন্ন কল্লোলের ইচ্ছে করল চিৎকার করে বলে, তোমার ননদ কুমকুম বেগমের প্রাননাথ সাইদ পূর্ববিবাহিত। এক সন্তানের পিতা। বুঝেছ ? বিশ্বাস না হয় হাতে নাতে প্রমাণ দিব। তারপর কী করবে বিগবস কণা আপা ? আমাকে ননদাই বলে কবুল করে নেবে ? সেরকম কিছুই বলা হলো না। কল্লোল যথারীতি অপেক্ষাকৃত নরম সুরে বলল, ‘ ঐ ছেলেটা বিবাহিত। তার একটা বাচ্চা আছে। সেই বৌ এর বাসা মালিবাগ রেলক্রসিং এর গলিতে। আমি সব খবর নিয়েই এসেছি। খবর পাকা। বিশ্বাস না হলে ওদের ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারো। বরং করাই উচিত , কেন তারা কথাটা লুকালো। ‘ আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাটা বলে বোনের দিকে তাকাল কল্লোল। কণা কিছুটা চুপসে গেল এবার। এই প্রথম ওকে নরম আর উদ্বিগ্ন মনে হলো। আসিফ কথা বলে উঠল এবার ।
‘ আমি একটু আগে সাঈদের বড় ভাইকে ফোন দিয়েছিলাম। কথাচ্ছলে মালিবাগ মোড়ে তাদের কোন আত্মীয় কিনা জানতে চাইলাম। উনি আমতা আমতা করে এটা সেটা বলে ফোন কেটে দিলেন। এরপরে আবার কল দিলাম উনি ফোন ধরেন নি। যা বোঝার তা তো বোঝা হয়ে গেল। তুমি বরং এক কাজ কর। কুমকুমকে বল সাঈদকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে।’
‘ কুমকুম কেন জিজ্ঞেস করবে ? ‘ ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল কণা। ‘ কী আশ্চর্য কথা, ও কী সাইদের বিবাহিতা যে ফটাফট ওকে দিয়ে ফোন করাও। নিজে করতে পারো না ? বিয়ে না দিয়ে বাড়ির মেয়েকে মানুষের আধা বউ বানিয়ে ছেড়ে দেবে আবার যখন মন চায় পেছন টেনে ধরবে। ফাজলামি আরকি ! ‘
‘ লেকচার বন্ধ কর। তোমার এসব জ্ঞানগর্ভ কথা শোনার সময় নয় এটা।’ আসিফ খেপে গেল।
‘ আমার কথা তো এখন লেকচারই মনে হবে। এসব করে করেই তো তোমরা ছেলেমেয়েগুলোর লাইফে স্পট ফেলে দাও। তোমাদের মত ছানি পড়া রুগীর অভিভাবকদের কারণেই আজ কুপি দিয়ে খুঁজলেও একটা ছেলেমেয়ে পাওয়া যায়না যাদের গায়ে কোনরকম এ্যাফেয়ারের গন্ধ নেই। সমাজটাকে নষ্ট করে দিয়েছ তোমরাই।’
‘ কিছু বলার আগে একটু ভেবে টেবে বললে ভাল হয় না ? ওরকম অপদার্থ তো তোমাদের ঘরেও আছে।’ উষ্মা চাপতে না পেরে বলে বসল আসিফ। সাধারণত এ ধরণের পরিস্থিতিতে আসিফের মেজাজের তাপ চড়া দেখলে থেমে যায় কণা। আজ থামল না। দাঁতে দাঁত চেপে বলেই ফেলল।
‘ কিসের সাথে কিসের তুলনা দিতে হবে না জানলে চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি কিন্তু কুমুকে দোষ দেইনি তোমাদের কাজকে দোষ দিয়েছি। আর তুমি বোকার মত আঙুল তুললে কুমুর কাজের দিকেই। কুমু যা করেছে তা তোমাদের ছত্রছায়ায় করেছে। আমার পরিবারে এমন প্রশ্রয় নেই। যেটুকু পেয়েছে সেও তোমাদের করে দেয়া সুযোগেরই সদ্ব্যবহার থেকে। ‘
‘ আহ তোরা থামবি ? এটা কী ঝগড়ার সময় ?’ মিজানুর রহমান ধমকে উঠলেন এবার। আসিফ তেতে উঠে বলল,’ তোমার বউমাকে থামতে বলো। সবটাতে নসিহত করা চাই তার। পরামর্শ না দিয়ে তিনি এখন কথা শোনাতে ব্যস্ত। কুমকুমের এই সমস্যা কী করা যায় সেটা নিয়ে না ভেবে…। ‘
‘ তুমিই বসে বসে ভাবতে থাক। ভেবে বোনকে উদ্ধার কর। আমি কেন ভাবব।’ কণা মুখ ঘুরিয়ে নিলে লায়লা এবার জোরে কেঁদে উঠলেন।
‘ আজ রাতের কী করবি সেটা আগে ঠিক কর।’
‘ ঠিক করাকরির কী আছে। আকদ ক্যানসেল করব। ‘ আসিফ গর্জে উঠল এবার। কণা বলল,’ কুমকুমের সাথে কথা বলে নাও তার আগে। ‘
‘ একটু আগেই মানা করলে..!’
‘ আমি সাঈদকে ফোন দেবার কথা মানা করেছি।’ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল কণা।
‘ কী কথা বলব কুমকুমের সাথে শুনি ? ওর এখানে কোন কথা নেই। ও এক বাচ্চার বাপকে বিয়ে করতে চাইলেই কী দেবে নাকি ? ‘
‘ সিদ্ধান্তটা ওকেই নিতে দাও না। ‘
‘ কণা মেজাজ গরম কইরো না। পাত্র পছন্দ অপছন্দের সিদ্ধান্ত ওর থাকবে ঠিক আছে তাই বলে পাত্রের এতবড় দোষ থাকার পরও ওকে জিজ্ঞেস করাকরির কোন মানে দেখিনা।’
‘ বেশ ভাল কথা। এনগেজমেন্টের নামে বোনকে তুলে দিয়েছিলে কেন ছেলেটার হাতে ? দিনরাত যখন গুটুর গুটুর করে ফোনে কথা বলত তখন বলতে পারোনি বিয়ের আগে এত কথা বলিস না ? ‘
‘ আবারও ফালতু কথা বল ? আমরা দুজন কী কথা বলিনি ? বখে গেছি ? ‘
‘ আমাদের বেলায় দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে যে বাকিদের বেলায় ঘটবেনা তা ভাবা কী উচিত হলো ? মেয়েটার উপর জুলুম করছ তোমরা। তোমরা একা না, গোটা সমাজ করছে। ছেলেমেয়েদের অবাধে মিশতে দিয়ে, যা ইচ্ছে তাই করার সুযোগ করে দিয়ে আশা কর, যেহেতু তারা তথাকথিত শিক্ষিত তাই তারা নিজেদের সামলে চলবে। একটা কথা মনে রেখ উত্তাল তরঙ্গে কেউ দিক ঠিক রাখতে পারেনা। যত বড় সাঁতারু আর ডুবুরিই হোক না কেন। শুধু তোমাদের এই আচরণের কারণে আজ প্রায় প্রত্যেকটা তরুণ তরূণীর একটা করে নোংরা অতীতের জন্ম হয়েছে। যেটা তাদের বর্তমানকে তো পরিপূর্ণ করছেই না ভবিষ্যতকেও অনিশ্চিত করে দিচ্ছে। মনে রেখ এটার জবাব তোমাদেরকে একদিন দিতে হবে। বিচারপতিরও বিচার আছে জানো তো।’ কথাগুলো বলেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলো কণা। তার পেছনে পেছনে সায়মাও উঠে গেলেন।
পুরো ড্রইংরুমে বাজ পড়া নিরবতা। লায়লার কান্না থেমে গেছে। মিজানুরের কপালে হাত। কণা যে কথাগুলো আসিফের মাধ্যমে ওদেরকেই শোনালো তাতে সন্দেহ নেই। এটা তো সত্যি, কুমকুমকে তারা স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিয়েছেন। সে অবাধে সবার সাথে মিশেছে, যেখানে খুশি গেছে যা ইচ্ছা করেছে তারা নাক গলাননি। সেই সংস্কৃতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথম সমস্যা হয়ে দেখা দিলো কল্লোল। সেই কুফলের রেশ না কাটতেই আরেকটা। এনগেজমেন্টের আগে থেকেই সাইদের অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল কুমকুম। এনগেজমেন্টের পর মার্কেটে যাবার নাম করে যে সে সাইদের সাথে এদিক সেদিক ঘুরতে গেছে সেটাও জানতেন তারা। সব জেনেও না জানার ভান করেই থেকেছেন। তখনও ভাবতে পারেননি এত ভাল একটা পরিবারের ছেলের জীবনে এত নোংরা একটা অতীত আছে । কণার কথা এক অর্থে ঠিক। আজ এই ঘটনার জেরে কুমকুমকে টেনে সরাতে গেলে ওর ওপর অবিচারই করা হবে। এ যেন জীবনকে বেছে নেবার সুযোগ দিয়ে একটু পর তা ভাল না বলে ছিনিয়ে নেয়া। কাজটা যে সহজ হবে না তা তো বোঝাই যাচ্ছে। মিজানুর সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। লায়লা চুপ করে বসে রইলেন। এবার আর তাঁকে কাঁদতে দেখা গেল না। একটু পর পর দীর্ঘশ্বাসের উষ্ণ বাষ্প তার হৃদয়ের কান্নাকে বাইরে বের করে দিতে লাগল।
আসিফকে সে তুলনায় বেশ তৎপর। সে কল্লোলকে তাড়া দিলো।
‘ এই চল তো। আমি নিজেই যাব এখন ছেলের বাসায়। তারপর মালিবাগের সেই বাসায়। তোর বোনের সাথে কথা বলতে গেলে মাথার নাট বল্টু যা আছে সব খুলে যায় আমার। নারীনেত্রী হয়েছে।’
‘ আমি যাব আপনার সাথে? ‘
‘ তো কী, তুই যাবি না তো কী কালিমুদ্দি যাবে ? অফকোর্স তুই যাবি আমার সাথে যাবি। ফোন করে অফিস থেকে লিভ নে।’
‘ জি ভাইয়া। ‘ কল্লোল বিনয়ের অবতার সেজে একপাশে সরে দাঁড়াল।
কণার মুড খুব খারাপ। মেয়ের চেহারা দেখেই তা টের পেলেন সায়মা। তিনিও আর কথা বাড়ালেন না। চুপচাপ মেয়ের ঘরে বসে রইলেন। আজ তিনি আসতে চাননি। কল্লোল নিজেই তাকে হাতে পায়ে ধরে এখানে নিয়ে এসেছে। যেন সময় সুযোগমত বিয়ের প্রসঙ্গটা টানতে পারে। এখন তো মনে হচ্ছে না এলেই ভাল করতেন। প্রসঙ্গ এলে সবার আগে কণাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। মেয়ের যা রাগ। আপাতত চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
কণা ওর কব্জি থেকে হাতঘড়ি খুলতে যাবার সময়ই কুমকুমকে দেখল। আয়নায় ওর ছায়া পড়েছে। কণা ঘাড় ফেরাল।
‘ কী রে কুমু, কিছু বলবি ? ভেতরে আয়।’
কুমকুম ভেতরে এলো না। সেখানে দাঁড়িয়েই মাথা নাড়ল, ‘ তুমি একটু আসবে ভাবি? ‘
‘ আমি এসে কী হবে ? আমি এসে লাভ নাই। তোর বড় ভাইয়া নিজেই যাচ্ছে ছেলেদের বাসায় আর কথাটা সত্য বলেই মনে হচ্ছে। কাজেই তোর প্যানপ্যানানি শুনে আমার লাভ নাই। তুই যা ঘরে যা। আগে সিদ্ধান্ত হোক তারপর যা বলার তোর ভাইকে বলবি। আমি কে ? ‘ কথা শেষ করে বাথরুমে ঢুকে সশব্দে দরজা আটকে দিলো কণা। কুমকুমকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হলো।
বিকেলের মধ্যেই দৃশ্যপট বদলে গেল। আসিফ বাড়ি ফিরে এসেছে। কল্লোল ফেরেনি। আসিফ একাই ড্রইং রুমে বসে আছে। এসেই কুমকুম সহ সবাইকে ডেকে জড়ো করেছে। কণা একটু দেরিতে এসেছে বলে ওর জন্য অপেক্ষা করেছে নিজেই। কণাকে প্রবেশ করতে দেখে অনেকটা ঘোষণা দেবার মত করে বলল আসিফ।
‘ শোনো, আমি বিয়েটা ভেঙে দিয়ে এসেছি। সরাসরি সাঈদকে ওর বাবা মায়ের সামনেই ডেকে যা বলার বলেছি। আরও বলেছি ভদ্রতার কারণে ছেড়ে দিলাম নয়ত মানহানির মামলা করে এ পর্যন্ত যা খরচ করেছি তা তুলে নিতে পারতাম কিন্তু সবদিক বিবেচনায় তা করিনি। ‘
‘ তারমানে কল্লোল যা বলেছে তা ঠিক ? ‘ লায়লা বিস্মিত।
‘ অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ছেলেটা আসলেই পূর্ব বিবাহিত এবং বাচ্চা একটা আছে। তবে সেটা ওর না কার এই নিয়ে বিরাট ক্যাচাল আছে। আমাদের তা জেনে দরকার নেই। যেখানে বোনই বিয়ে দেব না সেখানে ছেলের ব্যপারে আর বাড়তি জেনে লাভ কী। তবে ব্যপারটা মামলা মোকাদ্দমা পর্যন্ত গড়িয়েছিল এটাও ঠিক। পরে সালিশে সুরাহা হয়েছে। যাই হোক, মোদ্দা কথা সাঈদ একজন বিবাহিত ছেলে উপরন্তু এক বাচ্চার বাপ। এরকম ছেলের কাছে আমি আমার বোন বিয়ে দেব না। ব্যস কথা শেষ।’ শেষের বাক্যটা থেমে থেমে উচ্চারণ করল আসিফ। ‘ তোমাদের কারো কিছু বলার আছে ? ‘ কথাগুলো বলার সময় আসিফকে কিছুটা উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
কণা কুমকুমের দিকে তাকাল। সে এ পর্যন্ত কোন মন্তব্য করেনি। কুমকুম মুখ নিচু করে বসে আছে। লায়লা বেগম আর মিজানুর রহমানও চুপ। একটু পর তারা দুজনই বললেন, ‘ ছেলে দুই নম্বরি করলে তার কাছে মেয়ে দেবার যৌক্তিকতা কী। কাজেই আমরাও এই বিয়েতে রাজি না।’
আসিফ কুমকুমের দিকে তাকাল, ‘ শুনেছিস কী বলেছি ? ‘
‘ হ্যাঁ, শুনেছি।’
‘ কিছু বলবি ? ‘
‘ কী বলব ? মানুষ দুই বিয়ে করলে পচে যায় আর তিন চারটা প্রেম করে ডাস্টবিনে বাচ্চা ফেলে আসলে পচেনা। এই থিওরীর বিপরীতে কী বলব আমি?’
আসিফের মুখ রাগে লাল হয়ে গেল এবার। নিদারুণ উত্তেজনায় সে তোতলাতে লাগল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ তোমার মেয়ের কথা বলার স্টাইল দেখেছ ? ভালভাবে কথা বলাটাও তো শিখাও নি। বেয়াদ্দব একটা।’
‘ সাঈদ বিবাহিত হলে আমার সমস্যা নেই। এটাই আমার জবাব।’ বলে ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়াল কুমকুম। গটগট করে বের হয়ে গেলে আসিফ এবার কণার উপর রাগে ফেটে পড়ল।
‘ এগুলো সব তোমার কাছ থেকে শিখেছে। তুমিই শিখিয়েছ এসব চটাং চটাং কথা। কতটা নির্লজ্জ হলে সে তার বাবার সামনে বসে বড় ভাইয়ের মুখের ওপর বলে বিবাহিত হলে সমস্যা নেই। ভদ্রতাজ্ঞান বলতে কিছু নেই। রুচি তো নেই।’
‘ আমি কী যেতে পারি ? ‘ কণা বলে উঠলে আসিফ থমথমে মুখ করে বলল, ‘ যাও আর আমার জামাকাপড় বের করে রাখ। আমি গোসল করব। ‘ কণা উঠে চলে গেল৷
ঘরে ঢুকেই দেখল কুমকুম কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। কণা কাছে যেতেই সে আঁকড়ে ধরল তাকে। কণা চুপচাপ ওকে দেখল। মৃদুস্বরে বলল, ‘ যার জন্য কাঁদছিস সে যে এতবড় মিথ্যাচারটা করল সেটা একবার ভাবলি না ? ‘ অপেক্ষাকৃত শান্ত কণ্ঠে বলল কণা।
কুমকুম এবার চোখ মুছে দম নিয়ে বলল,’ সাঈদ লুকায়নি ভাবি। বিশ্বাস কর। ওর এই ঘটনা আমি আগেই জানতাম। এনগেজমেন্টের আগের দিনই ও বলেছে আমাকে এটা। আমি জানতাম যে সাইদ বিবাহিত এবং মহিলার একটা বাচ্চা আছে। আর এ নিয়ে বিচার সালিশও হয়েছে।’
‘ খীই্ ? ‘ কণা অবাক হয়ে গেল এবার।
কুমকুম ফোঁপানো স্বরে বলল, ‘ মেয়েটা সাঈদের বড়চাচার শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়া। এই বিয়েটা সাঈদের বা ঐ মেয়ের ইচ্ছেতে হয়নি। সাঈদরা একবার গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে ওর দাদি আর ফুপুরা ধরে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে ৷ তাছাড়া এটা বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখনও ও পড়াশোনা শেষ করেনি। বিয়ের রাতে মেয়েটা কান্নাকাটি করে জানায় তার পক্ষে এই সংসার করা সম্ভব না। সাঈদ কাউকে কিছু না বলে পরদিন সকালে চলে আসে। কথাটা ওদের বাসায়ও জানায় কিন্তু কাজ হয়না। সবাই বলে বিয়ের আগে এরকম থাকেই। বড়চাচাকে রাগানো যাবেনা। তাই সাইদও মেনে নিতে বাধ্য হয়। এর মাস দুয়েক পরেই সবাই অনুষ্ঠান করতে উঠে পড়ে লাগে কারণ মেয়ে নাকি প্রেগনেন্ট। সাইদ তখনই হৈ চৈ বাঁধিয়ে দেয় আর মেয়েকে ডিভোর্স করতে চায়। সেই মেয়ে তখন সরাসরি সাইদের দোষ দেয়। বলে বাচ্চা সাইদেরই। ‘
‘ এটা কোন কথা হলো ? সাইদের ডিএনএ টেস্ট করলেই তো বের হয়ে যেত কার বাচ্চা কী ঘটনা ! ‘
‘ হ্যাঁ, সাইদ মামলা করতে চেয়েছিল। ডিএনএ টেস্ট করানোর কথাও বলেছিল কিন্তু বোঝোই তো। ভিলেজ পলিটিক্স কত খারাপ। ওর বড় চাচা গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে সাইদের উপরেই দোষ চাপায় আর মেনে নিতে বলে। সাঈদ তখন রাগ করে নিজেই ডিভোর্স দেয় আর মেয়ের পরিবারের নামে মানহানির মামলা করে। পরে সালিশে তা প্রমানও হয়। কিন্তু সাঈদের পরিবার থেকেই আপোষে রফা করা হয় ব্যপারটা । কিন্তু রিউমারটা রয়ে যায়। মুশকিল হলো সাঈদের বাকি আত্মীয়রা ওর এই দুর্বলতার সুযোগটা নিচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা নিজেদের পাত্রী গছাতে না পেরেছে তারা প্রত্যেকেই সমস্যাটা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তারপরেও ব্যপারটা একরকম মিটেই গিয়েছে অনেকদিন আগেই। সাইদ চাইলে লুকাতে পারত কথাটা কিন্তু লুকায়নি। আমাকে পারসোনালি সব বলেছে যেন আমি কখনও জানলেও ওকে ভুল না বুঝি। আর আজ তোমার ভা..ঐ কল্লোইলা কেঁচো খুঁড়ে সাপ বের করে এনেছে। যেন বিয়েটাতে ভেজাল লাগানো যায়।’
কণা চুপচাপ সব শুনে বলল,’ তোর ভাই এর ধারণা তুই আমার কাছ থেকে এসব কথা শিখেছিস। কাজেই তোর ব্যপারে আমার কথা বলার আর পথ নেই। সম্ভবত কল্লোলের সাথেই তোর বিয়ে হবে। আমি বলব, বুদ্ধিমতী হলে সত্যকে মেনে নিবি। যেখানে জয়ের আশা নেই সেখানে যুদ্ধ করা বেকার।
=====