শেকড়ের সন্ধানে
২||
” আমার অবাক লাগে। যার বোন এত বড় মনের তার ভাই এমন ছোট মনের হয় কেমন করে। ভাবি কী আর ভাবির ভাইটা কী ! ‘ শান্তার খেদোক্তি শোনা গেল। কুমকুম এখন শব্দ করে ফোঁপাচ্ছে।
লায়লা মেয়ের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে গর্জে উঠলেন এবার, ‘ এখন কান্না দেখাচ্ছিস কেন ? পার্টি করে হুঁশ হারানোর সময় মনে ছিল না ? তোর মত অজাতের সাথে ঠিকই হয়েছে। ‘
‘ আমি কী করেছি ?’ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল কুমকুম। লায়লা তাতে আরো ক্ষেপে উঠলেন।
‘ এক্কেবারে থাপ্পড় মেরে তোর ঢং বার করব আমি, ফাজিল মেয়ে কোথাকার। বদ মেয়ে, তুই বিয়ার গিলেছিলি কেন ? জানিস না আমাদের ধর্মে মদ হারাম? ‘
‘ বিয়ার কী মদ নাকি ? ‘ কুমকুম কাঁদো কণ্ঠেই চেঁচাল। লায়লা এবার উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন। প্রায় তেড়ে গিয়ে তর্জনী তুললেন স্বামীর দিকে, ‘ এই তোমার মেয়েরে কিছু বলবা নাকি ভ্যাব্দা মেরে বসে থাকবা ? আমি কিন্তু মেরে ওর মুখ ভোঁতা করে দেব। বিয়ের কণে বলে মাফ করব না বলে দিলাম। তখন হাউকাউ করতে পারবে না। ‘ বলে ফের মেয়ের দিকে তাকালেন, ‘ চোরের মায়ের গলা কত বড়। নির্লজ্জ বেহায়া ফাজিল মেয়ে আবার কথা বলে। বিয়ার মদ না। তোর চাচার কোম্পানি তো। তাই মদও হালাল করে দিসে। ‘
‘ আহা, এর মধ্যে আবার চাচাদের জড়াচ্ছ কেন ? ‘ লায়লার ক্ষোভ দেখে শেষপর্যন্ত মন্তব্য করতে বাধ্য হলেন আসিফের বাবা মিজানুর রহমান। সাথে সাথেই ফুঁসে উঠলেন লায়লা।
‘ তুমি চুপ থাকো। ভাইদের কিছু বললেই গায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। এতক্ষণ তো দিব্যি বোবা মেরে ছিলে। ‘ মেয়ের উপর রাগ প্রকাশ করতে না পেরে বারবার স্বামীর উপরেই চড়াও হতে লাগলেন লায়লা। আসিফ তখনও চুপচাপ। বাবা মায়ের এসব ক্যাচালে সে নিরব দর্শক। ওকে এখন দেখাচ্ছে দিক নির্ণয় করতে না পারা বিভ্রান্ত পথিকের মত। সাংসারিক জটিলতায় সারাজীবন পাশে কণাকে পেয়ে অভ্যস্ত সে। কণাই ওর উপদেষ্টা, সৎ পরামর্শ দাতা। আজ সেই কণাই যেখানে আসামীর বোন হিসেবে কাঠগড়ায় সেখানে কার সাহায্য চাইবে আসিফ। আজই প্রথম নিজেকে একা আর অসহায় মনে হচ্ছে। মাথাটাও যেন ঠিকমত কাজ করছে না। একবার মনে হচ্ছে এক্ষুণি ছুটে গিয়ে যদি কল্লোলের টুটিটা চেপে ধরতে পারত তাহলে বেশ হত। পরক্ষণেই মনে হলো, নাহ্ এতে যদি কল্লোল রাগ করে সত্যিই ভিডিওটা লিক করে দেয়। তাহলে ব্যপারটা বিশ্রী হবে। তাছাড়া কুমকুমের সাথে আদৌ কোনরকম এফেয়ার ছিল কিনা তাই বা কে জানে। কুমকুম যে নিজের দোষ আড়াল করছে না তারই বা নিশ্চয়তা কী। এসব নাকিকান্নার আড়ালের মেয়েলি ভাব বোঝা ওর সাধ্যের বাইরে। কণা হলে এটা ঠিক ধরে ফেলত। তারচেয়ে থাক, পরে ধরা পড়ার পর সত্য বেরিয়ে এলে ওকেই লজ্জায় পড়তে হবে। কণার সামনে তখন নিজের মুখটাই দেখাতে পারবে না আসিফ। কী যে করা যায়। এখন তো মন চাইছে কুমকুমকেই চড় মেরে বেহুঁশ করে দেয় আগে। ওর পাত্তা না পেলে কল্লোল এতদুর এগোলো কী করে। নিশ্চয়ই এখানে কোন কিন্তু আছে।
বাবা আর ভাইকে নিরব দেখে এবার শান্তাকেই মা বোনের মাঝে পড়তে হলো।
‘ মা তুমি চুপ করো তো। এখন এসব কথা বলার সময় না। রাগ দেখানোরও সময় না৷ তাছাড়া যেটার কথা বলছো সেদিন আমরা সবাই ওখানে ছিলাম। কুমু একা ছিল না। ভোররাত পর্যন্ত সবাই একরকম জেগেই। পরে ছেলেরা সবাই ছাদে ত্রিপলের নিচে ফ্লোরিং করে শুয়েছে আর আমরা মেয়েরা সবাই চিলেকোঠার রুমটাতে ছিলাম। এর মধ্যে কল্লোল ভাই কোন ফাঁকে এসব ছবি টবি তুলেছে জানিনা। আর কোন বিয়ার ফিয়ার খাইনি আমরা। ওরাই লুকিয়ে কয়েক ক্যান এনেছিল। ওরা ওরাই খেয়েছে।
‘ তোর বোনও তো গিলেছে। নইলে লাশ হয়ে পড়েছিল কেমন করে যে বেগানা পুরুষ ধরল আর ** টের পেলো না।’
‘ উফ তুমি গালি দেয়া বন্ধ করবে ? ‘ শান্তা রেগে গেল মায়ের ওপর। মিজানুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন এবার।
‘ তোমরা যা খুশি কর। আমি জানি না। আমি গেলাম আমার ঘুম পাচ্ছে। ‘
‘ হ্যাঁ যাবেই তো। যাবেনা? ‘ লায়লা ফের চেঁচাতে গিয়েও থেমে গেলেন। দরজায় টোকা পড়ছে। আসিফ চমকে তাকাল দরজার দিকে। এ টোকা নিঃসন্দেহে কণার। কণার পাশে ও না থাকলে যে কণার ঘুম ভেঙে যায় জানে আসিফ। ওকে না পেয়েই এখানে এসেছে কণা। কথাটা মনে হতে আড়ষ্ট হয়ে গেল। শান্তাকে ইশারা করলে সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে কণাকে দেখে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
‘ ভাবি তুমি ? এখনও ঘুমোওনি ? আমরা ভাবলাম..!’
‘ স্যরি, তোমাদের বিরক্ত করলাম। আমি আসলে তোমার ভাইয়াকে মনে করিয়ে দিতে এসেছিলাম যে ভোরে ঘাটে লোক পাঠাতে হবে মাছের জন্য। ‘ বলে আসিফের দিকে তাকাল কণা। ‘ এই, তুমি না মজনু না কাকে পাঠাবে বলেছিলে ? ওনাকে ফোন করে একবার মনে করিয়ে দিলে ভাল হতো না। ভুলে গেলে তো আর মাছটা আনা হবেনা। পরে বাজার থেকে কার্বাইড দেয়া মাছ আনতে হবে । কাল নতুন মেহমানরা খাবে। ওনাকে এখনই ফোন করে দাও। ‘
কণা পুরোপুরি স্বাভাবিক। আসিফ তাকিয়ে আছে কণার দিকে। আপাতদৃষ্টিতে কণাকে সহজ স্বাভাবিক দেখালেও আসিফ জানে এটা আসল কণা না। নইলে ওর চোখ জোড়া আসিফের অচেনা ঠেকত না। তারমানে কণা কিছু না কিছু শুনেছে। যদিও ভান করছে সে কিছু শোনেনি। আসিফ নড়ে উঠল এবার। পকেট থেকে মোবাইল বের করে হাতে নিলো।
‘ হ্যাঁ, মনেই ছিল না। ভাল করেছ মনে করিয়ে দিয়ে। আমি এখনই ওকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। ‘ বলেই মজনুর নম্বরে ফোন করল আসিফ। মজনু জেগেই ছিল। ওকে সকালে ঘাটে যাবার কথা বলে ফোন কেটে দিয়ে কণার দিকে তাকাল, ‘ মজনুকে বলে দিয়েছি মাছের কথা। ও ফজরের পরপরই ঘাটে চলে যাবে। ‘
‘ আচ্ছা, ঠিক আছে। ‘ সুবোধ বালিকার মত মাথা নেড়ে চলে যেতে ধরল কণা। মিজানুর রহমান থামালেন ওকে।
‘ মা কণা। ‘
‘ জি বাবা ? ‘
‘ চলে যাচ্ছ কেন। এলে যখন তুমিও বস আমাদের সাথে। আমরা এমনিই নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলাম। তুমি ক্লান্ত ছিলে তাই আর ডাকিনি।’ কৈফিয়ত দেবার মত করে বললেন মিজানুর। কণা হাসল।
‘ কোন সমস্যা নেই বাবা। না ডেকে ভালই করেছেন। আমি আসলেই অনেক ক্লান্ত। তাছাড়া পারিবারিক মিটিং এ কতরকম কথা থাকে। সবার সামনে সব কথা বলা যায় না। আপনারা আলাপ করুন। আমি যাই, সকাল সকাল উঠতে হবে আবার।’ বলেই চলে যেতে ধরলে আসিফ আটকালো ওকে।
‘ কণা এক মিনিট। ‘ কণা থমকে দাঁড়াল। ওর হাত তখনও দরজার নবে। হাতটা তখনও সরায়নি। বাকিরা সবাই চুপচাপ। মিজানুর লায়লা দুজনেই কেমন যেন আড়ষ্ট। কুমকুম নিজেও সিঁটিয়ে আছে। শান্তার মুখটাই কেবল স্বাভাবিক তবে কিছুটা গম্ভীর।
আসিফ খানিক ইতস্তত করে বলল, ‘ সব কথা সবার সামনে বলা যায় না কথাটা বলে তুমি তোমার মনের চাপা ক্ষোভটাই প্রকাশ করে দিলে। আসলে আমরা একটা পারিবারিক জটিলতা নিয়ে আলাপ করছিলাম। তোমার ভুল বোঝার মত কিছু নেই এখানে।’
‘ আমি কখন বললাম ভুল বুঝেছি ? তোমরা আলাপ করো না, সমস্যা কী। আমি তো আগেই বললাম নিজেদের কত কথা থাকে। সবার সামনে বলা যায় না। আর এটাই স্বাভাবিক। আমার বাসায় কনফিডেনসিয়াল আলাপের সময় কী তোমাকে রাখা হয় ? কাজেই মনে করার যে কিছু নেই তা আমিও জানি।’ কণার চেহারায় কোনরকম কম্পন নেই। আসিফের দিকে দু সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করল। আসিফকে নিরব দেখে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। আসিফ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত দুটো ছেড়ে দিলো।
‘ এক ঝামেলা শেষ হয়নি, এখন আরেক হ্যাপা সামলাও, ধ্যাৎ। ‘ বলে নিজেও বেরিয়ে গেল সে। লায়লাকে পুনরায় কান্না জুড়ে দেবার পাঁয়তারা করতে দেখে লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়ল কুমকুম। মিজানুর বললেন, ‘ কণা কষ্ট পেয়েছে। ‘
‘ কেন কষ্ট পাবে কেন ? কষ্ট তো আমরা পেলাম। ওর ভাই ই তো…!’
‘ এই যে এতক্ষণে আসল রূপে এলে মা। ‘ শান্তা তিক্ত স্বরে বলল, ‘ তোমাদের এই রূপটা জেনেই কষ্ট পেয়েছে ভাবি। কারণ তুমি তাকে আগেই আলাদা করে দেখেছ। ঘরের বউ ভেবেছ, কল্লোলের বোন ভেবেছ। এই ঘরের একজন পরীক্ষিত শুভাকাঙ্ক্ষী সদস্য ভাবো নি। ভাবির জায়গায় আমি হলেও একই কষ্ট পেতাম। ছাতার শ্বশুরবাড়ি। সারাজীবন জান দিয়ে করলেও দাম নাই। পরই থেকে যেতে হয়।’
‘ এই তুই বেশি কথা না বলে যা এখান থেকে। ‘ লায়লা রেগে গেলেন।
‘ যাবই তো।৷ তোমাদের বাড়িতে থাকতে আসিনি। সাধে কী মহিলারা বলে আমার ঘর কোনটা ? তোমাদের মত কিছু পাথর চোখের মহিলাই তাদের ঘর চেনাতে ব্যর্থ হয়। তোমাদের কারণেই আমরা শেকড়বিহীন। তোমরা নিজেরা যখন শেকড় গেড়ে বসো তখন আর বাকিদের জায়গা দিতে চাওনা। ভাবো তাদের শেকড় গজালে তোমাদেরকে বুঝি উপড়ে ফেলে দেবে, যত্তসব। ‘ বলে শান্তা আর দাঁড়াল না।
লায়লা মুখ চুন করে বসে রইলেন। মিজানুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গিয়ে চোখ বুঁজলেন। আজ তার দীর্ঘ হিসেবি জীবনে একটা বড় রকমের ভুল হয়ে গেল। তাদের বোকামির কারণেই ভাল মেয়েটা কষ্ট পেল। ওর ছলছলে চোখ তার সাক্ষী।
===
আসিফ ভেবেছিল ঘরে ঢুকে হয়ত দেখবে কণা কাঁদছে বা ফোঁপাচ্ছে। সেরকম কিছুই হলো না। কণা শান্ত মুখে ঔষধের বাক্স খুলে তা থেকে স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে ঔষধ বের করে মুখে দিচ্ছে। আসিফ ডাকল, ‘ কী করো কণা? ‘
‘ ঔষধ খাচ্ছি। কিছু বলবে ? ‘ জায়গায় বসেই ঘাড় ফেরাল কণা। চোখে এতটুকু অভিমানের ছায়া নেই। ঘন কালো চিরল চিরল পত্র পল্লবে নেই এতটুকু জলছিটে। শান্ত কমনীয় মুখশ্রী। এই কণাকে খুব চেনে আসিফ। সাধে কী আর হার্ডনাট বলে ওকে ! কথা হাতড়াতে গিয়ে হাত নাড়ল বারদুয়েক।
‘ আসলে ব্যপারটা কল্লোলকে নিয়ে তো, তাই। তুমি ভুল বুঝো না কণা৷ তোমাকে না ডাকার এটাই কারণ…!’
‘ আমি জানি আসিফ। আমি রাগ করিনি। তোমাকে আর আলাদা করে বলে দিতে হবে না য়ে আমি কুমকুমের বোন নই, ভাবি।
‘ ঐ দেখ, আরো কঠিন করে ফেললে তো। ‘
‘ সহজ করে বল তাহলে ? ‘
‘ তুমি কষ্ট পেতে।’
‘ কল্লোলের জন্য ? ‘
‘ হ্যাঁ, না মানে। কুমকুমের জন্যেও।’
‘ যাক, এটুকু যে স্বীকৃতি দিলে। বাঁচলাম। শত্রু যে ঠাওড়াওনি।’
‘ তুমি রেগে গেলে অন্যমানুষ হয়ে যাও কণা এটাই খারাপ লাগে। তোমার চিরাচরিত শান্ত সমাহিত রূপটা একেবারে গায়েব হয়ে যায়। কল্লোলের কারণে তুমি অপমাণিত হবে সেকারণেই তোমাকে এড়িয়ে যাওয়া। আর কিছুই না। খামোকা তিল কে তাল করছ।’
কণার চোখ জোড়া জ্বলে উঠল এবার।
‘ কে করত আমাকে অপমান ? নামটা শুনি ! বাবা, মা, শান্তা, কুমকুম না তুমি ? নাকি কুমকুমের ব্যপারে কষ্ট পাবার অধিকার তোমাদের একার আর অপমানের ভার একা আমার ?
আসিফের মুখে তালা পড়ে গেল এবার। কণা বলল, ‘ যত ব্যপারটাকে এড়াতে চাইছি ততই নিজেদের বাহাদুরি জাহির করছ। আমি তিলকে তাল করছি ? বারো বছর একটা সংসারকে বুক দিয়ে আগলে রাখার পর ননদের বিপদে আমি ওর পর হয়ে গেলাম শুধুমাত্র এই অপরাধে যে দোষী আমার মায়ের পেটের ভাই ? এটা তো তোমরাই স্পষ্ট করলে যে কুমকুম তোমার বোন। আমার কেউ না। আমিও কুমকুমের কেউ না। ‘ শেষের দিকে গলা ধরে এলো কণার৷ দরজায় টোকা পড়ল। সাথে কান্না বিজড়িত কণ্ঠের ডাক।
‘ ভাবিইই…! ভাবি একটু দরজা খোল।
কণা উঠে গিয়ে দরজা খুলল, ‘ কী হয়েছে কুমকুম ? ‘
‘ ভাবি আমি স্যরি। আমার তোমাকে বলা উচিত ছিল। ‘
‘ নাথিং টু স্যরি। এত আপসেট হবার মত কিছু হয়নি। তুমি এটা নিয়ে ভেবনা কুমকুম । আমি বাসায় বলে কল্লোলকে সাইজ করার ব্যবস্থা করছি। ‘ বলে হাসার চেষ্টা করল কণা। কুমকুম হঠাৎ জড়িয়ে ধরল কণাকে।
‘ তুমি এভাবে কথা বলো না ভাবি। আমাকে কুমু না বলে কুমকুম ডাকছো কেন তুমি ? আ’ম স্যরি ভাবি । আমি বুঝতে ভুল করেছি। আমার তোমাকে সরাসরি জানানো উচিত ছিল। তাই বলে তোমাকে পর ভেবে লুকিয়েছি এটা ঠিক না। তুমি তো বুদ্ধিমতী ভাবি। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমার ভুলটা কোথায়। পারছো না ? ‘
কুমকুমের কান্নাভেজা মুখটা দেখে মায়া লাগল কণার। ওড়নার প্রান্ত দিয়ে চোখটা মুছে দিয়ে বলল, ‘ পারছি। আমি তোর উপর রাগ করিনি। করেছি তোর ভাইয়ের ওপর। যে বারো বছর এক বিছানায় থেকেও আজ পরের মত আচরণ করেছে। আর এজন্য ওকে আমি ক্ষমা করব না। ‘
‘ আমার উপর রাগ করোনি তো? ‘
‘ না। করিনি, প্রমিজ। তুই ঘরে যা। আমি দেখছি কী করা যায়। ‘
‘ কিন্তু ভাবি তুমি কোন স্টেপ নিলে সে ভিডিওটা..!’
‘ বললাম তো, ওসব ভাবনা আমার ওপর ছেড়ে দে। যা ঘুমাতে যা। রাত জাগলে চোখে কালি পড়বে।’
কুমকুম চলে গেলে দরজা সদর বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াবার আগেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল আসিফ। কণা শক্ত হয়ে গেল। শান্ত অথচ কঠোর গলায় বলল,’ কী, পোশাক বদলাতে হবে নাকি…? ‘
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে সরে গেল আসিফ। কণার হাত ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল সে। কণা আর কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে বসল। লম্বা চুলগুলো দু হাতে সামলে হালকা বেণী করে পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘ ভয় পেও না। আমি তথাকথিত নারীবাদীদের মত ঝোলা কাঁধে বের হয়ে যাব না। তারপর ঐ যে দৃপ্ত না কী যেন একটা পদক্ষেপ আছে, ঐ দিয়ে দুনিয়া ভেজে খাবার নাম করে টইটই করব না। নিশ্চিন্ত থাকো, আজীবন তোমার বউ হয়েই চুপটি করে সংসার করে যাব। তবে আমাকে আর আগের ভূমিকায় পাবেনা তুমি। আমি আজ থেকে এ বাড়ির বৌ, শুধু বৌ। কাজেই আমার কাছ থেকে এর বেশি আলগা খাতিরের আশা করোনা । বরং এটাই ভাল। যম্মিন দেশ যদাচার। ‘ বলেই চুপ করে শুয়ে পড়ল কণা। একটু পরেই ওর ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ এলো। ঘুমিয়ে পড়েছে সে। আসিফ রাতটা একরকম জেগেই কাটাল। কণার দিকে তাকাল একবার। পাশেই শুয়ে আছে অথচ যেন কতদূরের হয়ে গেছে। আহ্ মানুষ যখন ভুল করে তখন বোঝেনা কেন যে সে ভুল করছে ? ‘
====
পরদিন ভোরেই এসে মাছ দিয়ে গেল মজনু। কণা আসিফকে বলে মাছ কাটানোর লোক আনিয়ে একেবারে ধুয়ে পরিস্কার করিয়ে নিলো। লায়লার আশঙ্কা ছিল কণা হয়ত মুখ ভার করে রাখবে বা খোঁটা দিয়ে কিছু বলবে। সেরকম কিছু না হওয়ায় চাপা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিনি নিজেও স্বাভাবিক রইলেন। ভুলেও রাতের প্রসঙ্গটা আর তুললেন না। খামোকা খোঁচা মেরে প্রসঙ্গ তোলার দরকার কী। বরং কণা ওভাবে জেনেছে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। বলতে তো পারবে না যে শ্বাশুড়ি ডেকে কথা শুনিয়েছে। আল্লাহ যা করে ভালর জন্যই করে। কণা তার স্বাভাবিক নিয়মেই সব করল। আপ্যায়নে কোথাও কোন ত্রুটি রাখল না। কণার কাজে লায়লা বা মিজানুর বরাবরই সন্তুষ্ট বরং আজ তাদের উপলব্ধি যেন একটু বেশিই। মিজানুর তা প্রকাশও করে ফেললেন। কথাপ্রসঙ্গে গতরাতের ব্যপারটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন তিনি। কণা হেসে তাকে আশ্বস্ত করে বলল,’ আমি সত্যিই কিছুই মনে করিনি বাবা। তবে আপনার ছেলের আচরণে কষ্ট পেয়েছি এই যা।’
‘ আমার উপর রাগ রাখিস না মা ৷ বুড়ো মানুষ।’ কাতর স্বরে বললেন মিজানুর।
‘ একদম না বাবা। আপনি এটা নিয়ে ভেবে অস্থির হবেন না তো। বাবার উপর মেয়ে রাগ করতে পারে না করা উচিত ? ‘ মিজানুর সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে গেলেন ৷
রাতে যথাসময়েই কুমকুমের হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে লোকজন এলো। আজ যিনি এসেছেন তিনি কুমকুমের খালা শ্বাশুড়ি। ভদ্রমহিলা দেশের বাইরে থাকেন। গতদিন তিনি ঢাকায় ছিলেন না বলে এনগেজমেন্টে থাকতে পারেনি তাই আজ আসতে হলো। এ সপ্তাহেই নাকি তার যাত্রা। স্বল্প সময়ের ছুটিতে এসেছেন। এই সুযোগে ভাগনে বউকে দেখে গেলেন।
খাওয়া দাওয়ার পর এলো আসল প্রসঙ্গ। কণার মন বলছিল কথা এখানেই শেষ না। ধারণা সত্যি হলো। কথাবার্তার একপর্যায়ে অতিথি নিজেই বিশেষ অনুরোধের সুরে প্রস্তাব রাখলেন। তার একান্ত ইচ্ছে তিনি দেশে থাকতে থাকতেই তার ভাগনের আকদটা হয়ে যাক। যেহেতু অনুষ্ঠানের সময় তিনি থাকতে পারবেন না। কাজেই যে আকদটা দুদিন পরে হতো সেটা আগামীকাল বা পরশু হতে সমস্যা কী। কুমকুমের হবু খালা শ্বাশুড়ির এহেন প্রস্তাব শুনে লায়লা মিজানুর মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। আসিফও কণার দিকে তাকাল। কণা কারো দিকেই তাকালো না। বাধ্য হয়ে আসিফ নিজেই আলাদা করে ডেকে নিলো কণাকে।
‘ কী করা যায় বলো তো ? ‘
‘ তোমার বোন, তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই হবে। আমি কী বলব।’
‘ কণা ! এখনও রেগে আছো ? ‘
‘ রেগে নেই। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি।’
‘ একটা সাজেশন তো দিতে পারো ! ‘ উষ্মা চাপতে কষ্ট হলো আসিফের। কণা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,’ আমার মতে রাজি হয়ে যাওয়া উচিত। আকদ যেহেতু হবেই দেরি করে লাভ কী। ‘
‘ তাহলে হ্যাঁ বলি, কী বলো সোনামনি ? ‘ আসিফকে আদুরে ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে দেখে রেগে গেল কণা। দু হাতে ওর বুকে ধাক্কা মেরে বলল,
‘ ঢং করো নাকি ? হ্যাঁ বলবে কিনা সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে ? সেয়ানা পাগল আরকি।’ বলে মুখ ঝামটে চলে গেল। তাকিয়ে দেখল না আসিফ দাঁড়িয়ে আছে না পড়ে গেছে। তাকালে দেখতে পেত আসিফ হাসছে।
===
আকদের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। আগামী দুদিন পরেই আকদ। সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করল কুমকুমদের বাড়ির সবাই। রাতেই ফোন এলো কুমকুমের মোবাইলে। কুমকুম দেখলো ওটা কল্লোলের ফোন। রিসিভ না করেই সে ছুটল কণার কাছে। কণা তখন রান্নাঘরের কাজ শেষে হাত মুখ ধোবার জন্য সবে লিকুইড সোপটা হাতে নিয়েছে। তখনই কুমকুমকে ফ্যাকাশে মুখ করে ছুটে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ফোন হাতে নিলো।
‘ কী রে? ‘
‘ আহা দেখ না ! ‘
কণা কথা না বলে ফোনটা দেখল। নাম্বারটা পরিচিত দেখেই মুখটা শক্ত হয়ে গেল ওর। হাতের ইশারায় কুমকুমকে শান্ত হতে বলে সে নিজেই রিসিভ করল ফোনটা।
‘ হ্যাঁ রে কল্লোল, এতো রাতে কী মনে করে ? কুমকুমকে দরকার ? ‘ সহজ সাবলীল কণ্ঠ কণার। ওপাশে কল্লোলের ভিড়মি খাবার দশা। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’ আপা তুমি? এটা তো কুমকুমের নাম্বার ! ‘
‘ হ্যাঁ, ওর ফোন আমার কাছে ৷ কী বলবি আমাকে বলতে পারিস। পরশু দিন ওর আকদ জানিস তো৷ ওকে আমিই বলেছি রাত না জেগে শুয়ে পড়তে।’
‘ ওহ্, তেমন কিছু না। একটা দরকার ছিল।
‘ আমাকে বল।’
‘ না থাক ওকেই বলব।’
‘ ঠিক আছে। তবে দেখিস উল্টা পাল্টা কিছু বলে ভড়কে দিস না।’
‘ মানে ? কুমকুম কী বলেছে নাকি কিছু ? ‘
‘ না তো, কিছু আছে নাকি বলার মত ? ‘
‘ না তা নেই৷ এমনিই।’
‘ রাখলাম।’ ফোন কেটে দিয়ে কুমকুমের দিকে তাকাল কণা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ আবারও ওর ফোন আসবে। তবে তোর নম্বরে না। আমার অথবা তোর ভাইয়ের নম্বরে।’
‘ কেন ? ‘ ভীত চোখে তাকাল কুমকুম। কণা ম্লান হাসল, ‘ বিয়ে ভাঙার জন্য লোকে যা করে। কল্লোল এখন তাই করবে৷ ও এখন তোর হবুবরের একটা দোষ খুঁজে বের করবে। ভিডিও টিডিও দেখাবে না নিশ্চিত থাক। ওটা তোকে ভয় দেখানোর জন্য বলেছে। আমার ভাই তো, আমি চিনি ওকে। তাছাড়া অত সাহস থাকলে সরাসরিই বলত। মনে রাখিস অপরাধী চিরকালই ভীরু। এদের প্রবেশপথ সবসময় পেছনের দরজা। সামনের দরজা খোলা থাকলেও সেটা দিয়ে প্রবেশ করার সাহস এদের থাকেনা। ও এখন সিস্টেমেটিক ওয়েতে বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করবে। যা শুতে যা আর টেনশন করা বন্ধ কর। চেহারার যা অবস্থা করেছিস। আকদের দিন তো তোরে ভুতের মত লাগবে। সাঈদ ভয় না পেলেই হয়।’ কণার কথা শুনে মুখ কালো করে চলে গেল কুমকুম । আজ রাতে ওর ঘুম হবেনা নিশ্চিত।
চলবে।