শেকড়ের সন্ধানে
১||
গত কয়েকদিন ধরেই কুমকুমের বিয়ের কথা চলছে। প্রস্তাবটা হঠাৎ করেই এসেছে । এক বিয়ের অনুষ্ঠানে পাত্রের মা কুমকুমকে দেখেন। কথাবার্তা বলে তার নাকি ভীষণ মনে ধরে যায়। পরিবারের বাকিদের ডেকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেন কুমকুমের সাথে। নিজে যেচে পরিচিত হন কুমকুমের বড় ভাবি কণার সাথে। কুমকুম সেদিন কণার সাথেই গিয়েছিল বিয়ের অনুষ্ঠানটাতে। কণা সম্পর্কে ভাবি হলেও কুমকুমের অভিভাবকও সে-ই। সে আরেক গল্প। তবে তার জের ধরেই আজ পাত্রপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন আসবে এ বাড়িতে। ধরে নেয়া যায় আজই কথাবার্তা পাকা হয়ে যাবে। ছেলেকে বাড়ির সবারই পছন্দ করেছে। উচ্চশিক্ষিত, ভাল ব্যবসা করে ৷ ব্যবসার সূত্রে দেশবিদেশেও ঘোরা হয়।
কণার কাছে নাকি কথা বলে ভাল লেগেছে। পরিবারটাও বেশ শিক্ষিত। কুমকুমদের বাড়ির তুলনায় যথেষ্ট অবস্থাপন্ন। সে-তুলনায় আচরণ আর কথাবার্তা বেশ নিরংহকারী। এই ব্যপারটাই নাকি কণার কাছে বেশি ভাল লেগেছে। সবচেয়ে বড় কথা ওরা কুমকুমকে খুব পছন্দ করেছে। পারলে এখনই বিয়ে করে তুলে নিয়ে যায় অবস্থা। তাদের কোন চাহিদা নেই। তাদের ভাষায় তারা এক কাপড়ে মেয়ে নেবে। যদিও এটা কথার কথা হিসেবেই নিয়েছে সবাই। আজকাল এক কাপড়ে মেয়ে নেবার রীতি নেই। মুখেই বলা কথা এগুলো। নেবার সময় পাঁচপদ সাথে না নিলে কথা একটাও মাটিতে পড়ে না। এক কাপড়ে নেয়া আর এক কথায় বিয়ে এসবই হারিয়ে যাওয়া দিনের গল্প। নতুন দিনে এমন গল্প বড় একটা শোনা যায় না। আশা করা যায় কুমকুমের বেলায় সেসব পুরোনো গল্পই হয়ত নতুন মোড়কে আবিস্কার হতে যাচ্ছে।
কথাগুলো জানার পর ভাবাবেগে ভেসে যাবার পাত্রী ছিল না কণা। শ্বশুর শ্বাশুড়ি বয়স্ক মানুষ। এ যুগের ভাব তারা বোঝে না। তাকেই যা করার করতে হবে। কণা সেটাই করেছে যা একজন যথার্থ অভিভাবকের কাজ। পাত্রপক্ষের অতি তৎপরতা দেখে সে আসিফকে দিয়ে মনের যাবতীয় খটকা দুর করেছে।
আসিফ সম্পর্কে কুমকুমের বড় ভাই হলেও কণার চিন্তা আসিফের চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং একটু যেন বেশিই। কারণ কুমকুম সেই কিশোরী বয়স থেকে কণার তত্ত্বাবধানে। ওকে ননদ কম সন্তান বেশি মনে হয় কণার। কণা জানে কুমকুম কেমন মেয়ে। মুখে কথা কম বলে চোখে জল ঝরানোয় পারদর্শী এই মেয়ে। তাই আসিফকে বরিশাল পাঠিয়ে মনের সংশয় দুর করেছে কণা। বাহ্যিক দিক থেকে যতই ভাল হোক খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া দরকার।
কণার পরামর্শ মেনে দুজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে পুরো বরিশাল চষে এসেছে আসিফ। ছেলের রাজত্ব দেখে এসেছে। ছেলের পূর্বপুররুষ নাকি জমিদার ছিল। সেই জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও সযত্নে সুরক্ষিত আছে সেখানে। বাড়ি ফিরে সংবাদটা সবাইকে জানালে কুমকুমের মা আনন্দে প্রায় শয্যাশায়ী হবার দশা। আজ সকাল থেকেই তিনি কুমকুমের ভাষায় সারেগামা শুরু করেছেন। একটু পরপরই বড় ছেলের বউকে ডেকে বলছেন, ‘ ও কণা , আমার খুব ভয় হচ্ছে রে মা। ‘
‘ কেন মা ? ভয়ের কী আছে ? ‘ শতেক কাজের মাঝেই বিরক্তি ঝেড়ে কাছে এসে দাঁড়ায় কণা। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসে। কণা সম্পর্কে একটু না বললে গল্পটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কণার সাথে এ বাড়ির সম্পর্ক প্রায় এক যুগের। প্রায় সাড়ে এগারো বছর ধরে সে এ বাড়ির বড় বউ। বলতে গেলে কণাই এ বাড়ির প্রাণ। আসিফের সাথে বিয়ের পর থেকে সে যেন নিজেকে যেন উৎসর্গ করেছে এই পরিবারটার জন্য। নিজের জব ক্যারিয়ার সব একপাশে সরিয়ে এই পরিবারটার সাথে একাত্ম হয়ে থেকেছে মেয়েটা। মাঝে কয়েকবছর একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেছিল। ছেলে হবার পর নিজেই ছেড়ে দেয়। পরের বছরই আরেক মেয়ে। কণার আর জয়েন করা হয়নি। কেউ যেমন ওকে কাজটা করতে বলেনি তেমনই ছাড়তেও উৎসাহিত করেনি। কারণ কণা তার চাকরি জীবনেও বাইরের ব্যস্ততার প্রভাব কখনও সংসারে পড়তে দেয়নি। সংসার ষোলআনা চমৎকার ভাবে সামলে নিতো বলে কারো মনে বিরূপ কোন মনোভাব জাগেনি। ওর চাকরি ছাড়ার সময়ও কেউ বাধা দেয়নি। কণার নিজেরই সিদ্ধান্ত এটা। ওর নিজের কাছেই মনে হতো সামান্য কটা টাকার জন্য বাচ্চাদুটোকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তার নিষ্পাপ বাচ্চা দুটোকে এতিমের মত কাঁদিয়ে রেখে সকাল দুপুর বনের মোষ তাড়ানোর কোন মানে হয়না। তাছাড়া আসিফ নিজেই যেখানে ওর মানিপার্সের ভূমিকায় আছে সেখানে কণার টাকার চিন্তা কী। আসিফ কখনই ওকে টাকার জন্য না বলেনি। কণা চেয়েছে আর আসিফ দেয়নি এমনটা কখনও হয়নি। বরং ওর সুবিধার জন্যই ড্রয়ারে টাকা রেখে দেয় আসিফ। বলাই আছে, কণার যখন যা লাগবে সে যেন ড্রয়ার থেকে নিয়ে নেয়। আসিফ কোনদিনই জানতে চায়নি কণা আজ কত বা কেন নিয়েছে। কণা নিজেই রাতের বেলা গুটগুট করে সেসব খরচের ফিরিস্তি দিত।
‘ এই জানো আজ না একটা নকশী কাঁথার চাদর কিনেছি। খুব সস্তা। লোকটা চার রঙের চারটা নকশীকাঁথা এনেছিল। আমি সবুজটা নিয়েছি। বুঝেছ ? ‘
‘ হম।’ আসিফ ঘুম ঘুম গলায় উত্তর দেয়।
‘ দাম কত নিলো জানো ? ‘
‘ কত ? ‘
‘ সাড়ে চার হাজার টাকা। সস্তা না? ‘
‘ হম।’
‘ আর শোনো, আজ মুনের মা তিনহাজার টাকা ধার চেয়েছিল। দিয়ে দিলাম। ‘
‘ এই কাজটা ঠিক করো নি।’ একথায় ঘুম কেটে যায় আসিফের।
‘ ওমা কেন ? ধার দেয়া তো দান করার চেয়ে বেশি সাওয়াবের কাজ।’ কণা অবাক হয়।
‘ হ্যাঁ বেশি সাওয়াবের কিন্তু সেটা প্রয়োজনশীলের ক্ষেত্রে।’ এ পর্যায়ে আসিফ উঠে বসে। ‘ মুনের মা যথেষ্ট অবস্থাপন্ন মহিলা। সে তোমার কাছে টাকা ধার চেয়েছে মানে কারণ ভিন্ন। সে অভাবে পড়ে চায়নি বরং মুনের বাবার অগোচরে কিছু করার জন্যই নিয়েছে। যাই হোক সেটা আমাদের বিষয় না। আমার ইচ্ছা, তুমি ওকে আর কখনও টাকা ধার দেবেনা। ‘
‘ কেন তোমার টাকা বলে ? ‘
আসিফ আহত হয়ে তাকালে ফিক করে হেসে দেয় কণা। দু চোখ একসাথে বুঁজে আবার খুলে বলে, ‘ একটু ঝগড়া করতে ইচ্ছে করল তাই ছোটলোকের মত জবাব দিলাম। ‘
আসিফ কিছু না বলে ফের শুয়ে পড়ে বলল, ‘ মুনের মার কথালাগানোর স্বভাব আছে। সে লোকজনের কাছে কথা লাগিয়ে বেড়ায়। দেখবে কোনদিন তোমার নামেও লাগবে। বলবে কণার তো টাকার অভাব নাই। জামাই এর টাকা ইচ্ছেমত ওড়ায়। তারপর সবাইকে বলবে তারা চাইলেই তোমার কাছ থেকে টাকা ধার নিতে পারবে। তারপর বাইচান্স যদি কাউকে দিতে না পারো তাহলে গল্প তৈরি হবে। শোন, তোমাদের এই মহিলা প্রজাতিটা কে কাজের সুবাদে আমি যত জানি তুমি অতটা জানো না। এরা সহজ জিনিস না।’
‘ আমিও ? ‘
এই প্রশ্নে আসিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কণার কোলে মুখ গুঁজে।
‘ বোকার মত কথা বল কেন। সব আম কী এক জাতের ? সব নারীও এক পদের না।’
‘ বুঝলাম। তা আমি কোন পদের ? মানে ফজলি না ল্যাংড়া ? ‘
কণার প্রশ্নের ধরণ শুনে আসিফ হাসে। চোয়াল চেপে ধরে বলে, ‘ তুমি তো আমার রূপালী। নিঁখুত আর মিষ্টি। সবদিক দিয়ে পার্ফেক্ট। যেমন…!’
‘ চুপ। ‘ খপ করে আসিফের মুখ চেপে ধরে কণা। জানে বাঁধ না দিলে কথার জোয়ারে ভাসিয়ে দেবে এই লোক। এসময় নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণা মনে হয় ওর। মাঝেমধ্যে নিজের সৌভাগ্যকেই ঈর্ষা হয় কণার।
আসিফরা চার ভাই বোন। আসিফ সবার বড়। দ্বিতীয়জন আসিফের ছোটভাই সাকিব। কণার একমাত্র দেবর। বউ বাচ্চা নিয়ে কানাডা থাকে। আসিফের দুই বোন ছোটজন কুমকুম আর সেজজন শান্তা। শান্তার বিয়েও কণার তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল। বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটা থেকে শুরু করে ছেলের বাড়ির সাথে কথাবার্তা সবই কণাই করেছে। দেবরকেও বিয়েশাদী সেই করিয়েছে। একসময় ওর বাজে সঙ্গ আর পড়াশোনার জন্য কণাই বকাঝকা করত। ওর ভয়েই রাত বিরেতে এখানে সেখানে আড্ডা দিতে পারত না সাকিব। এখন প্রবাসে সেটেলড হয়ে ভাল চাকরি বাকরি করছে। চমৎকার একটা বাচ্চাও আছে ওর। এ পর্যন্ত দু বার বেড়িয়ে গেছে এখান থেকে। যে কদিন ছিল ওদের নিয়ে খুব আনন্দ করেছে কণা। সাকিবের বউয়ের নাম দিঘী। ভারি আদুরে মেয়ে। দীঘির পছন্দমতো পিঠা করে খাইয়েছে ওকে। সাথে নিয়ে কেনাকাটা করেছে। দুজনে মিলে নতুন নতুন রেসিপি করে সবাইকে খাইয়েছে। দীঘি এখনও সেকথা সবাইকে বলে বেড়ায়। বেচারি এবার ননদের বিয়েতে আসতে পারবেনা বলে মনখারাপ। কণাকে বলে রেখেছে, সে যেন সবগুলো ইভেন্টের ভিডিও করে রাখে। দীঘি খুব মিস করবে অনুষ্ঠানটা।
আজ সন্ধ্যার পরই পাত্রপক্ষ চলে আসার কথা। বিয়ের কথাপাকা উপলক্ষে আসিফের খালা মামি চাচি ফুপু সবাই চলে এসেছেন। কণার আরেক ননদ শান্তাও চলে এসেছে। কণাদের বাড়িতেও বলা হয়েছিল। কণার বাবা দেশে নেই। ব্যবসার কাজে বাইরে গেছেন তাই মা আর ছোটভাই কল্লোল এসেছে। কল্লোল এবছরই সিএসই শেষ করেছে। এখন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর জব করছে। কল্লোলের নিয়মিত আসাযাওয়া এ বাড়িতে। জব হবার পরেই যা একটু কমেছে। কাজের চাপে আসার সময়ই তেমন পায়না। আগে প্রায় রোজই আসত। হুটহাট এসে সোজা টেবিলে বসে পড়ত। কখনও এমনও হয়েছে কুমকুমের প্লেট টেনে নিয়েই খেতে শুরু করে দিয়েছে কল্লোল । দুটিতে ভারি খুনসুটি।
আজ কুমকুমের বিয়ের কথা শোনামাত্রই ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। কল্লোলকে দেখে খুশি হয়ে ওর হাতেই ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়েছে কণা। যাক, ঝামেলা কমল। কাজের ভিড়ে সবটা ভিডিও করা ওর জন্য কঠিনই হত।
ভাইকে শাসনের সুরে বলল, ‘ কল্লোল, শোন। আজকের পুরো অনুষ্ঠানটা ভিডিও করবি। এটা দীঘিকে পাঠাব। দেখিস, কোন ম্যুমেন্ট যেন বাদ না যায়।’ কল্লোল কেবল মাথা নেড়ে সায় দিলো। হালকা স্বরে বলল, ‘ কুমু কোথায়? ‘
‘ আছে কোন রুমে। ওর রুম তো গেস্টদের দখলে। খুঁজে দেখ।’
কল্লোল আর কোন মন্তব্য না করে সোজা কণার রুমে চলে এলো। আর তখনই কুমকুমকে দেখতে পেল। কণার বিছানাতেই চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। কল্লোল ওকে একনজর দেখল। তারপরই আচমকা পায়ের কাছ থেকে চাদরের কোণটা ধরে টান দিয়ে সরিয়ে ফেলল সেটাকে।
হঠাৎ গা থেকে চাদর সরে যেতে লাফ দিয়ে উঠে বসল কুমকুম। প্রথমেই ঘুম ভাঙা চোখে কল্লোলকে দেখল। তারপরই দ্রুত পায়ের কাছে দলা পাকানো ওড়নাটা টেনে গায়ে দিলো। কল্লোল আয়েশ করে বিছানায় বসল ক্যামেরাটা দুহাতে নাড়াচাড়া করে সেটাকে দেখে নিলো একবার। সেভাবেই বলল, ‘ এই অসময়ে ঘুম কিসের ? উঠে বস। কথা আছে তোমার সাথে।’
‘ এসব কী কল্লোল ভাই ? এটা কোন ধরণের অভদ্রতা ? ‘ প্রচন্ড রাগ হলেও নিজেকে সামলে রাখলো কুমকুম। কল্লোল কণা ভাবির ভাই। সেকারণেই সহ্য করা নয়ত অমন ফাত্রামির জন্য কষে চড় মারত কুমকুম।
কণা ভাবির অসম্মান হয় এমন কাজ করা কুমকুমের পক্ষে সম্ভব না। কুমকুম একা না ওদের পুরো বাড়ি জানে এ বাড়িতে কণা ভাবির অবদান কতখানি। তারচেয়ে বড় কথা কুমকুম ভাবিকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে আর, ভালোও বাসে। সে কারণেই চুপ থাকা।
‘ আমার কাজটা তোমার অভদ্রতা মনে হলো। আর তুমি যেটা করলে সেটা কী? ‘
‘ কী করেছি আমি? ‘
‘ না বলে কয়ে হুট করে বিয়ে করতে যাচ্ছ। আর বলো কী করেছি?’
‘ কী বলেন এসব ? বাসা থেকে হুট করে বিয়ের আয়োজন করলে আমি কী করব ? ‘
‘ মানা করবে। ‘ কল্লোলকে খানিকটা উত্তেজিত দেখালো । কুমকুমের ঘুমের রেশ কাটতে শুরু করেছে এবার।
‘ মানা করব কেন? ‘
‘ মানা করবে কারণ তোমাকে আমি ছাড়া কেউ বিয়ে করতে পারবে না। ‘ কল্লোল সরাসরি তাকাল কুমকুমের দিকে। ‘ তুমি এত গাধা কেন ? তুমি কী টের পাও না যে আমি তোমাকে পছন্দ করি? ‘
‘ কিন্তু আমি তো করিনা। এসব ফালতু কথা বলার কোন মানে হয়না কল্লোল ভাই। সবসময় সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা চলে না।’
‘ এটা ঠাট্টা না কুমু। তুমি এই বিয়ে বন্ধ কর আর নয়ত দেখবে আসল ঠাট্টা কাকে বলে।’
‘ কী আশ্চর্য, এসব কী বলছেন আপনি ? ‘
এবার কিছুটা ভয়ই পেল কুমকুম। কল্লোলকে সে হালকা মেজাজের ছেলে বলেই জানে। পরিমিতজ্ঞান কম হলেও কণা ভাবির ভাই বলেই কখনও কিছু বলেনি কুমকুম। তাই বলে বিয়ে ভাঙার হুমকি দেবে ? কণা বিভ্রান্ত বোধ করল এবার। কী বলবে ভেবে না পেয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে খপ করে ওর হাত ধরে বসিয়ে দিলো কল্লোল।
‘ যাও কই, বসো এখানে। আর ভাল করে শুনে রাখো আমি ঠাট্টা করছি না। কিছু একটা বলে বিয়েটা ভাঙো। প্লিজ। আশ্চর্য, মাত্র একটা মাস ঠিকমত আসিনি আর এর মধ্যেই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছ।’
‘ এবার আপনি সীমা অতিক্রম করছেন কল্লোল ভাই। আপনি কে বিয়ে ভাঙতে বলার ? ‘ কুমকুমের মুখ গম্ভীর হলো। ‘ আপনি কণা ভাবির ভাই তাই অপমান করতে বাঁধছে। নয়ত এসব ফালতু কথা বলার জন্য আমি আসিফ ভাইকে দিয়ে আপনাকে সাইজ করাতাম।’
‘ ও রিয়েলি ? তাহলে তো ভয়ের কথা। ঠিকআছে, আর বিরক্ত করব না। আমি এখনই চলে যাবো। তার আগে তোমাকে আমার আপকামিং ঠাট্টার নমুনাটা দেখিয়ে দিয়ে যাই নয়ত তুমি আবার আমাকে আন্ডার এস্টিমেট করবে।’ বলতে বলতেই মোবাইল বের করল কল্লোল। একটা ভিডিও অন করে কুমকুমের চোখের সামনে ধরতেই আঁতকে উঠল কুমকুম। বাকরুদ্ধ হয়ে চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে নিলো।
‘ প্লিজ বন্ধ করুন এটা প্লিজ। আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে।’
‘ করলাম। এখন এই ক্লিপটা দুটো কারণে চালু হবে। অপশন এ, হয় এটা চলবে আমাদের বাসর ঘরে। দর্শক হবো আমরা দুজন। অপশন বি, তোমার হবুবরের মোবাইলে প্লাস তাদের ড্রইংরুমে। তাদের বাড়ির প্রত্যেকে দেখবে এটা। তুমি যে অপশনটা চয়েস করবে সেটাই মাথা পেতে মেনে নেব আমি। হাজার হোক আমার হবুবধূ তুমি। তোমার কথা না রাখলে কার কথা রাখব বল ? ‘
কুমকুম তখনও বিস্ময় কাটাতে পারেনি। ফিসফিস করে বলল,’ এই ভিডিও আপনি কখন করলেন? ‘
‘ শান্তার বিয়ের রাতে। মনে আছে সবাই আমরা রাত জেগে ছাদে বারবিকিউ করেছিলাম ? তোমাকে ঠাট্টা করে বিয়ার খাইয়ে দিয়েছিলাম ? তুমি এমন মড়ার মত ঘুমাচ্ছিলে যে আমি ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। পুরো দুদিন পর তোমার নেশা কেটেছে। আজব মানুষরে ভাই তুমি। সামান্য বিয়ার খেলে কেউ এমন আউট হয় ? ‘
কুমকুম কেঁদে ফেলল এবার, ‘ প্লিজ কল্লোল ভাই এটা ডিলিট করেন।’
‘ বিয়ে করবে তাহলে আমাকে? ‘
‘ না, আমার বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেছে। তাছাড়া আমি…!’
‘ উঁহু, নো অপশন। আমাকে বিয়ে করতে রাজি না হলে ভিডিও ডিলিট হবে না। যাকে ইচ্ছে বলো, যা খুশি কর। এই ভিডিও চাউড় হবে এটা নিশ্চিত। তুমি চুপ থাকলে আমিও চুপ। বাসর ঘরেও দেখতে হবে না তোমাকে এটা। যাও কথা দিলাম। তবে তুমি সামান্য টুঁ করলেই এটাও ফু হবে। বলে দিলাম।
‘ কল্লোল ভাই আপনি ? ‘ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল কুমকুম। এমন সময় কারো পদশব্দ পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে নিয়ে তাকাল। কণা ভাবি এসে দাঁড়িয়েছে।
‘ কী রে, কুমু তুই এখনও এভাবে বসে আড্ডা দিচ্ছিস। ওরা তো রওনা দিয়ে দিয়েছে। আজব মেয়েরে তুই। এ্যাই কল্লোল তুই অন্য ঘরে যা। ওকে রেডি হতে দে। আজকে কোন আড্ডা ফাড্ডা না৷ কুমু তুই ওঠ আর তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হ। বাথরুমে ঢুক। কই, ওঠ ! ‘ কুমকুম আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। কল্লোলও বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।
=====
মুখ কালো করে রাখার জন্য কয়েকবারই ধমক খেল কুমকুম। কণা নিজেই ধমকালো। একবার কানের কাছে মুখ এনে বলল, কী রে কুমু। তোর কাহিনী কী বলতো ? কন্সটিপেশনের সমস্যা নাকি ? চেহারাটা এমন আমাশার রুগীর মত করে রেখেছিস কেন ? তোর হবুবর কিন্তু লাইভ দেখছে তোকে। আমাকে ফোনও করেছে একবার। জিজ্ঞেস করল তোর শরীর ঠিক আছে কি না। ‘
‘ ন্…না। শরীর ঠিক আছে।’ আড়চোখে কল্লোলকে দেখল কুমকুম। অমানুষটা চোখ সরাচ্ছে না ওর দিক থেকে। কণা খিলখিল করে হেসে ফেলল এবার।
‘ তোর কপাল আমার চেয়ে ভাল রে। তোর আসিফ ভাইয়ের কথা মনে আছে ? বাবুর জন্মের সময়? হায় কী আহাজারি। যেন আমার না ওর পেট থেকেই বাবুটা হবে। পুরো হাসপাতাল মাথায় তুলেছিল। তোর বর তো দেখা যায় তোর আসিফ ভাইয়ের চেয়ে এককাঠি বেশি সরেস। বিয়ে হবার আগেই বউয়ের চিন্তায় বেচারার দুগাছি চুল পেকে গেছে । আমাকে বলে, না না ভাবি সামথিং ইজ রঙ। কুমুদকে জিজ্ঞেস করুন ওর কী হয়েছে, আমাকে জানান প্লিজ। আমি তো থান্ডার্ড। তুই কুমু থেকে কুমুদ হলি কবে রে ? ভাগ্যিস কামিনী বলেনি। হি হি হি।’ শব্দ করে হেসে উঠল কণা।
কুমকুম লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলো চট করে। ওর লজ্জা পাওয়া দেখে কণা হাসতে হাসতে উঠে গেল। যাবার আগে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে গেল। এ যেন শুভকামনার ছোঁয়া। কুমকুমের দু চোখ বন্ধ হয়ে এলো আবেগে। এমন ভাল মানুষের ভাই অমন জানোয়ার হয় কীভাবে ?
ছেলের মা আংটি সাথে নিয়েই এসেছিলেন। বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হবার পর তিনি আংটি তো পরালেনই, খুশির আতিশয্যে গলার চেইনটাও পরিয়ে দিলেন কুমকুমের গলায়। চারিদিকের আনন্দোচ্ছাস করতালি কিছুই কানে ঢুকছিল না কুমকুমের। কল্লোলের ক্যামেরা ওর দিকে স্থির। সেদিকে একপলক তাকিয়ে মনে হলো ক্যামেরার চেয়ে বেশি তীব্র তীক্ষ্ণ কল্লোলের দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণ দাঁতের নিচে ধরা। কেমন ক্রুর দেখাচ্ছে কল্লোলকে। কুমকুম যেন চোখ সরাতে পারছিলো না। মুখ নামিয়ে শান্তাকে বলল ওকে একটু ভেতরে নিয়ে যেতে। প্রচন্ড মাথা ধরেছে ওর। শান্তা আর জোরাজুরি করল না। বাকিদের অনুমতি নিয়ে কুমকুমের রুমে চলে এলো ওরা।
ঘরে এসেই হঠাৎ শান্তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল কুমকুম। শান্তা ভীষণ হকচকিয়ে গেল।
‘ কী রে, কুমকুম ? কী হলো কাঁদিস কেন ? ‘
কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কুমকুম যা বলল তা শুনে রীতিমতো পাথর হয়ে গেল শান্তা। অবিশ্বাসের সুরে বলল,’ আমাদের কল্লোল ভাই ? মানে কণা ভাবির ছোট ভাই? ‘
কুমকুম ওপর নিচ মাথা দোলাল। শান্তার মুখ লালচে হলো প্রথমে পরক্ষণেই সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘ এক্ষুণি ভাবিকে জানাব এটা।’
‘ তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে? ‘ শান্তাকে টেনে ধরল কুমকুম। ভাবি শুনলে কতটা মনে কষ্ট পাবে? কত লজ্জা পাবে ভাবি। ঐ অমানুষ ভাইয়ের নোংরামির কথা বলে তাকে সবার কাছে অপমানিত হতে দেব না আমি। ‘
‘ তাই বলে চুপ থাকব। জানোয়ারটার এত বড় সাহস..?’
‘ চুপ থাকব না কিন্তু করব টা কী শান্তাপা তুই বল। যেটাই করি না কেন, কল্লোল বলেছে ওকে বিয়ে করতে রাজি হওয়া ছাড়া আর যাই করি না কেন ভিডিও ফাঁস হবে। বিয়ে করতে চাইলে সে চেপে যাবে আর বিয়ের ব্যবস্থা করবে। ‘
‘ কত্ত বড় হারামি ! ‘ শান্তা রেগে আগুন হলো এবার।’ ঠিক আছে ভাবিকে না জানাই। ভাইয়া, মা বাবা ওদেরকে তো জানাতে পারি। চুপ করে থাকার বিষয় নয় এটা কুমু। হারামজাদার উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত। ‘
‘ কার উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত রে ? ‘ আচমকা কণার ডাকে দুবোনই কেঁপে উঠলো। কুমকুম দ্রুত নাকের নথ খোলায় ব্যস্ত হলো আর শান্তা কৈফিয়তে ৷
‘ আরে আমাদের বাড়িওয়ালার কথা বলছিলাম। বাদ দাও তো, ঐদিকের কী খবর ভাবি ? বিয়ের তারিখ পড়ল? ‘
‘ হম, পড়েছে। অঘ্রাণের শেষে। ইংরেজি মাসের হিসেবে ডিসেম্বর। ভালই হলো। বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। তবে কুমুর শ্বাশুড়ির ইচ্ছা এ মাসেই আকদ করে রাখে। ঐ নিয়েই কথা হচ্ছে। ‘
‘ ওহ, তাই নাকি? ‘ শান্তা আড়চোখে কুমকুমকে দেখল। সে গয়না খোলায় ব্যস্ত। কণা ত্রস্তে উঠে দাঁড়াল, ‘ আচ্ছা, আমি যাই। কুমু তুই চেঞ্জ করে নে। পারলে একবার ফোন করে কথা বলে নে তোর বরের সাথে। মাথাটা করে রেখেছে ব্যাটা।’
‘ বর হোক আগে। এখনই কিসের কথা ? বিয়ে হয় কিনা তাই দেখ। ‘ গলার হার খুলে রাখতে রাখতে শান্তভঙ্গিতে বলল কুমকুম। কণা বিস্মিত হবার আগেই ওকে ধাক্কা মারলো শান্তা।
‘ দুর ওর কথা ছাড় তো ভাবি। বিয়ে হবার আগেই মান অভিমান শুরু হয়েছে ওদের। বাদ দাও এসব। চলো ড্রইংরুমে যাই। দেখি কী অবস্থা। ‘ কণা কিছু বলার বা ভাবার আগেই ওকে ধরে নিয়ে সবার মাঝখানে সোফায় বসিয়ে দিলো শান্তা।
===
রাত একটা বা তার কিছু বেশি। সবাই জমা হয়েছে কুমকুমের রুমে। আসিফও আছে এখানে। নেই কেবল কণা। সে সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে একটু আগেই ঘুমিয়েছে। কুমকুমের বাবা মায়ের নির্দেশেই তাকে কিছু জানানো হয়নি। তাদের মতে, কল্লোল হাজার হোক কণার মায়ের পেটের ভাই। ভাইয়ের কান্ড শুনলে মেয়েটা লজ্জা পাবে, কষ্ট পাবে। অনুষ্ঠানেই হয়ত থাকতে চাইবে না। পুরো অনুষ্ঠান পন্ড হবে তাতে। কণাকে ছাড়া কিছু করাও সম্ভব না। কাজেই যা করার আসিফই করুক। মায়ের মুখে সব শুনে চুপ করে বসে রইলো আসিফ। ওর মুখটা বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে। খাটের ওপর কুমকুম তার ওড়নায় মুখ চেপে বসে আছে। ওর পাশে শান্তা। কুমকুম অনবরত কাঁদছে। লজ্জায় মুখ দেখাতে ইচ্ছে করছে না ওর। মনে হচ্ছে এরচে মরে যাওয়া বুঝি সহজ। ভিডিওটা বাবা বা ভাইয়া না দেখলেও তাদেরকে ব্যপারটা খুলে বলার সময় মনে হলো কুমকুমের মন হলো শান্তা কথাগুলো বলছে না যেন ওদের দেখিয়ে দিচ্ছে সেটা। এ লজ্জার দায় আসলে কার। কুমকুম আরেকটু সতর্ক হলে তো কল্লোল এটা করতে পারত না। সে কুমকুমের ঘুম ঘোরের সুযোগ নিয়েছে। যতবার ভাবছে ততবারই বুক ফেটে কান্না আসছে।
আসিফ হঠাৎ চাপা স্বরে চিৎকার করে উঠল। গালি দিয়ে বলল, ‘ আমি এখনই ঐ হারামজাদাকে ফোন করব। জানোয়ারের বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করব সে চায় কী। ‘
‘ আহা, হৈ চৈ করিস না তো। কণা শুনবে। ‘কুমকুমের মা ছেলেকে ধমকালেন এবার। ‘ সে কী চায় তা তো স্পষ্ট। বিয়ে করবে কুমুকে ৷ তা বাবা আগে বলবি তো। বিয়ে ঠিকঠাক হবার পর বললে কার কী করার আছে। ‘
‘ তাই বলে ভিডিও দিয়ে থ্রেট দেখিয়ে বিয়ে করতে চাইবে নাকি ? এটা কোথাকার ভালবাসা ? ‘
‘ বাদ দে। আজকালকার ছেলেমেয়ে ভালবাসার জানে কী যে একে সম্মান দিতে শিখবে। এদের বুঝটাই তো উল্টা। তুই আর হাঙ্গামা করিস না তো বাপ। ওকে ফোন করে ভদ্রভাবে বুঝিয়ে বলে দে। এখন এসব সম্ভব না। আগে বললে তবু হতো। এখন সবাই জেনে গেছে কাজেই এখন আর কোনভাবেই কিছু করা যাবে না। ওকে ভাই টাই বলে বুঝিয়ে ঠান্ডা কর৷ কণাকে জানানোর দরকার নাই। একটার মধ্যে আরেকটা ঝামেলা লেগে যাবে। শেষপর্যন্ত দেখা যাবে আমার ভাল বৌটাই হাতছাড়া হয়ে গেছে। হাজার হোক মায়ের পেটের ভাই।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কুমকুমের মা। জানালার বাইরে সেকথা শুনে পাথর হয়ে গেল কণা।
সে এসেছিল আসিফকে খুঁজতে। আর জানতে পারলো তার নিজেরই অস্তিত্ব আজ হারিয়ে গেছে। কণা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)