#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-১৬||
★
“-আঙ্কেলের ডেথটা স্বাভাবিক ছিলো না আরশ।
তীব্রের কথা শুনে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আরশ। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটে প্রথম টান দিয়ে তীব্রকে বলল,
“-৩মাস আগের পুরোনো কাসুন্দি ঘেটে লাভ?
“-আমি ৩মাসেই এটা খুঁজে বের করেছি যে আঙ্কেলের ডেথ স্বাভাবিকভাবে হয়নি। আমি হসপিটাল গিয়েছিলাম অনেকবার সেদিন রাতে ডিউটিতে থাকা নার্সকে জেরা ও করেছিলাম। কিন্তু প্রথমে সে স্বীকার করেনি পরে সে বলেছে সে ওইদিন রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ৩টায় আঙ্কেলের ডেথ হয়েছে আর তখন ও সে ঘুমিয়ে ছিলো। আমি আঙ্কেল কে কাফন পরানোর পর আঙ্কেলের মুখে দাগ দেখেছিলাম, আর তুই রিপোর্ট দেখেছিস? আঙ্কেলের মৃত্যু শ্বাসরোধ করাতে হয়েছিলো। এটা সম্পুর্ন ক্লিয়ার কেউ একজন ইচ্ছে করেই আঙ্কেল কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকায় আমি বা ডাক্তার রা কেউই জানেনা ওইদিন কি হয়েছিল। তাই আমি আন্দাজ করেছিলাম হয়তো, ফারহিনের উপর যারা অ্যাটাক করেছিলো তারাই আঙ্কেল এর মৃত্যুর জন্য দায়ী। কিন্তু করিডরে থাকা সিসিটিভি আমার ধারণা সম্পুর্ণ বদলে দিলো। সেই সিসিটিভির ফুটেজ চেক করতেই আমি যা পেলাম তা তুইও জানিস। ২ঃ১৫ তে তুই আইসিইউ তে প্রবেশ করেছিলি যা ভিজিটিং টাইম নয়। আর তুই বের হয়েছিলি ৩ঃ০৫ নাগাদ। আর আঙ্কেলের মৃত্যু হয়েছে ৩টা নাগাদ।
তীব্রের কথা শুনে আরশ গাড়ির হেডসাইডে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। দুহাত পকেটে রেখে জিজ্ঞেস করলো-
“-সরাসরি বল, কি বলতে চাস?
“-তুই ভেতরে কি করছিলি?
তীব্রের এহেন প্রশ্নে আরশ হেসে ওঠে। আরশের অট্টহাসি দেখে তীব্র থমকালো। তীব্র ভ্রু কুঁচকে বলল-
“-হাসার মত আমি কিছু বলিনি আরশ।
“-ভাই সিরিয়াসলি? তুই হাসার মত কথাই বলেছিস! তুই আমায় জিজ্ঞেস করছিস আমি কি করেছি সেখানে? তাহলে শোন!
বলেই আরশ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তীব্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বলল-
“-আমি নিজেই নিজের বাবাকে মেরে ফেলেছি। শুধু নিজের বাবাকে না, আমার শশুরমশাই কেও আমিই মেরেছি। আমি আমার বাবাকে এত কষ্ট দিতে চাইনি কিন্তু এক্সিডেন্টে বেঁচে গিয়ে আমার বাবা মস্ত বড় যে ভুলটা করেছে তার মাশুলই কষ্ট পেয়ে দিতে হয়েছে। তোর সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়ে দিলাম। এবার আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?
তীব্র দু কদম পিছিয়ে গেল। আরশের মুখে এমন কথা শুনে তীব্রের মাথায় যেন আসমান ভেঙ্গে পড়লো। তীব্র এতটাও আশা করেনি। তীব্রের মস্তিষ্কের সমস্ত নিউরন কেঁপে উঠলো। মেজাজ মুহুর্তেই উত্তপ্ত লাভার মত ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। দ্রুত এগিয়ে এসে আরশের কলার চেপে ধরলো সে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
“-কি করলি এটা তুই? কেন করলি? ফারহিন তোর জন্য এতিম হয়ে গেল! তুই এতটা নীচে কিভাবে নামলি? আরে ফারহিনের কথা ছাড় নিজের বাবাকে কিভাবে মেরে ফেললি তুই? একবারও হাত কাঁপলো না তোর?
আরশ কলার ছাড়িয়ে তীব্রকে ঠেলে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে বলল-
“-না কাঁপেনি। কেন জানিস? কারণ আমার ফারহিনের গায়ে ওইদিন যে আঘাত পরেছিলো, যে অ্যাটাক হয়েছিলো তা শুধু মাত্র ওদের জন্য। ওরা ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলো। যার কারণে ওদের শত্রু আমার ফারহিনের উপর হামলা করে বসলো। ওদের শত্রু পুরোপুরি ঝাপিয়ে পড়ার আগেই আমি ওদেরই শেষ করে দিয়েছি। ভালো করেছি। আর এতে আমার বিন্দু মাত্র আফসোস নেই। আজীবন আতংকে কাটানোর চেয়ে একবারেই সব সমস্যার নির্মুল করে দিয়েছি।
তীব্র দ্রুত এগিয়ে এসে আরশের মুখে ঘুষি বসালো। আরশের ঠোঁট কেটে গেল। ঠোঁটে আঙুল ঘষে চোখের সামনে ধরতেই দেখলো রক্ত। আরশ হাসলো। তীব্র বলল-
“-আমি নিজের ভালোবাসা তোকে দিয়েছিলাম এটা ভেবে যাত্র তোর শূন্যতায় পূর্ণতা আসে। যাতে তোর শূন্যতা কেটে যায়। তুই আজীবন যেই একাকিত্বের মাঝে বাস করেছিস তা যেন ঘুচে যায় আর তুই কিনা ফারহিনের মাথার ছায়া কেড়ে নিলি! নিজের বাবাকে মারতে যার হাত কাঁপেনি সে আর যাইহোক আমার ফারহিনের যোগ্য না। তোর মত জঘন্য মানুষের কাছে আমি আমার ফারহিন কে রাখবো না। আমি আমার ফারহিন কে সব সত্যি জানিয়ে দেব, আর তোর কাছ থেকে নিয়ে আসবো।
আরশ এতক্ষণ চুপচাপ শুনলেও তীব্রের মুখে বারবার ‘আমার ফারহিন’ কথাটি শুনে তার মেজাজ বিগড়ে গেল। চোখ ক্রমশ রক্তবর্ণ ধারণ করলো। কপালের দুপাশের রগ ফুলে উঠেছে। গলার পাশের শিরা ফুলে দপদপ করছে। তীব্রের গলা চেপে ধরে গাড়ির উপর শুইয়ে তীব্রের দিকে ঝুঁকে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে-
“-হুশ! তোর ফারহিন না। আমার ফারহিন। আমার বউ। আর তুই কি বলছিলি? ওকে বলে দিবি? তুই ওকে বললে ও বিশ্বাস করবেনা। কারণ এই ৩ মাসে আমি আমার জায়গা ওর মনে এমনভাবে গেঁথে দিয়েছি যা ও নিজে চাইলেও মুছে ফেলতে বা উপড়ে ফেলতে পারবেনা। আর যদি ও তোর কথা বিশ্বাস করেও নেয় তোর কি মনে হয়? আমি মেনে নেব? আমি এত সহজে ওকে ছেড়ে দেব? আমার শান্তির স্থান আমি তোর হাতে তুলে দেব এটা তুই ভাবলি কি করে? ও যদি আমার কাছে থাকতে না চায় তাহলে ও এই পৃথিবীতেও থাকতে পারবেনা। তুই আমার জীবন থেকে যত দূরে থাকবি ততই তোর জন্য ভালো হবে। আমার শান্তি হরণ করার চেষ্টা মোটেও করিস না। তোর জন্য খুব একটা মঙ্গল হবে না।
বলেই তীব্র কে ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো আরশ। তীব্রের শ্বাস বন্ধ হতে হতে বেঁচেছে। তীব্র হাপাতে হাপাতে বলল-
“-তুই কখনো শান্তিতে থাকতে পারবিনা। আমি ফারহিনকে সবটা বলে দেব। আর তুই? নিজের অপরাধের শাস্তি খুব শীগ্রই পাবি।
★কলিংবেল বাজতেই ফারহিন দ্রুত দরজা খুলে দিলো। সালমা কে দেখে ঝাপিয়ে পড়লো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল-
“-মা, মা, মা তুমি এসে গেছো। আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম।
“-আরে আস্তে এভাবে ঝাপিয়ে পড়লে কেন? আমাকে ভেতরে যেতে দেবে না নাকি?
“-আরে এসো এসো।
” হুম! এবার বলো এত তাড়াতাড়ি কেন ডাকলে? কিসের এত তলব?
সোফায় বসতে বসতে বলল সালমা। ফারহিন বলল-
“-ওয়েট।
ফারহিন উপরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসে বলল,
“-চোখ বন্ধ করো।
“-কেন ফারহিন?
“-করো না মা। প্লিজ…
“-আচ্ছা বাবা।
সালমা চোখ বন্ধ করতেই ফারহিন নিজের দুহাত সামনে এনে বলল,
“-এবার খোলো চোখ।
সালমা চোখ খুলতেই দেখলো ফারহিনের হাতে প্রেগ্ন্যাসির টেস্টের কিট। টেস্ট পজেটিভ দেখে সালমা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। দুহাতে মুখ চেপে ধরে কেঁদে দিলো। ফারহিন উঠে দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে বলল-
“-কি হলো মা কাঁদছো কেন?
“-কাঁদছিনা মা। এটা আমার সুখের কান্না। এত দিন পর এমন একটা খুশির সংবাদ হঠাৎ পাবো ভাবতে পারিনি। আলহামদুলিল্লাহ!!
বলেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর সোফায় বসিয়ে বলল-
“-আরশকে বলেছো?
“-না মা উনি অফিসে। সকাল থেকেই আমার শরীর খারাপ লাগছিলো, পরে ফারহানা বলল টেস্ট করিয়ে দেখতে তাই করালাম। আর তাতেই এটা..
“- আলহামদুলিল্লাহ! আমি অনেক খুশি মা। একটা ছোট্ট বাবু আসবে। তুমি একদম বেশি লাফালাফি করবেনা। একদমই না..
“-করছিনা মা। আমি নিজেই এত্ত এক্সাইটেড।
“-আস্তে আস্তে। কিছু খেয়েছো তুমি সকাল থেকে?
“-পারছিনা মা। পানি খেলেও আমার বমি হচ্ছে।
“-একি! এইসময় একটু আধটু হয় তাই হলে খাবে না নাকি,?
“-আমি পারছিনা মা। বমি করতে করতে আমার তো মাথাটাই ভার হয়ে গেছে।
“-খালি পেটে বমি করলে এমন তো লাগবেই, ভরা পেটে বমি করলে এত বেশি কষ্ট হবেনা। তুমি বসো আমি কিছু বানিয়ে আনছি।
“-না না মা আমার কিছু লাগবেনা। আমি খাবো না.. তুমি আমার কাছে কিছুক্ষণ বসো প্লিজ।
“-আচ্ছা বসছি। কিন্তু আগে কিছু খেয়ে নাও মামুনি।
“-মা! বাপি থাকলে অনেক খুশি হতো তাই না?
সালমার হাসোজ্জল মুখ মলিন হয়ে গেল। হালকা হেসে বলল-
“-অবশ্যই হতো। তুমি এখন এসব ভেবো না। একটুও কোনো চাপ নেবেনা। হাসিখুশি থাকবে সর্বদা। যাতে বেবির উপর কোনো খারাপ প্রভাব না পড়ে তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
“-কাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে শুনি? যার ক্ষতি নিয়ে এত চিন্তা করা হচ্ছে।
বাড়িতে প্রবেশ করতে করতে বলল আরশ। ফারহিন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। টেস্ট কিট লুকিয়ে ফেলল। সালমা বলতে গেলে ফারহিন হাত চেপে ইশারায় না বলল। আরশ এগিয়ে এসে সালমা কে সালাম করে জড়িয়ে ধরলো। কপালে চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“-কেমন আছেন মা?
“-ভালো আছি। একি তোমার ঠোঁটে কি হলো?
“-ও কিছু না। গাড়ির স্টিয়ারিং এর সাথে সামান্য ধাক্কা খেয়েছিলাম।
“-ইশ! একটু দেখে শুনে চলবে না? তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমরা নাস্তা করতে করতে গল্প করবো।
“-তা ঠিক আছে তবে তার আগে একটা কথা দিন।
“-বলো?
“-কয়েকটা দিন থেকে আমাদের সাথে তবেই যাবেন। যাওয়ার জন্য একদম তাড়াহুড়ো করবেন না মা।।
“-আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।
“-আচ্ছা।
সালমা রান্না ঘরের দিকে হাটা দিলো। আরশ ফারহিনের দিকে তাকিয়ে বলল-
“-এই বউ! একটু রুমে আসো।
“-আসছি।
মৃদুস্বরে বলল ফারহিন। আরশের ‘বউ’ ডাকটা মন প্রাণ ছুঁয়ে দেয়। এত আদর মিশিয়ে ডাকে লোকটা।
চলমান…..
||রিচেক দিইনি, ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।||