শুরুটা অন্যরকম পর্ব-১৮

0
1123

#শুরুটা_অন্যরকম
#পর্ব_১৮
#অধির_রায়

নিয়তির ঘুম হারাম করে দিয়েছে নির্বণ। নির্বণের কথাগুলো শুধু নিয়তির মনে ঘন্টা বাজে যাচ্ছে। নিয়তির কখন চোখ লেগে এসেছে, সে নিজেও জানে না।

কিন্তু ঘুম ভেঙে যায় ভোর না হতেই৷ নিয়তি ঘুম নির্বণের আগে ভাঙার পর নিয়তি নির্বণের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকায়৷ নিয়তির দৃষ্টি আটকে যায় নির্বণের ঠোঁটে।

— নিয়তি মনে মনে বলে উঠে, ” একি নির্বণের ঠোঁটের হাসি ঘুমের মাঝেও ফোঁটে আছে।”
নির্বণের ঠোঁট নিয়তিকে টানছে। নিয়তির উদ্দেশ্য হলো নির্বণের ঠোঁটে আলতো করে একটা ভালোবাসার পরশ একে দেওয়া৷ নিয়তি ধীরে ধীরে নির্বণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ যেই নির্বণের ঠোঁটের কাছে যাবে ঠিক তখনই নির্বণ আঁখি মেলে তাকায়।

— ঘুম ঘুম স্বপনে নির্বণ বলে উঠে, ” নিয়তি তুমি এখানে কি করছো?”

নির্বণের চোখের দিকে তাকিয়ে নিয়তি খুব লজ্জা পায়৷ নিয়তির মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না৷ নিয়তি একইভাবে নির্বণের দিকে তাকিয়ে আছে৷

— কি হলো নিয়তি? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? তুমি ঠিক আছো তো?

— নিয়তি আহ্লাদী স্বরে বলে উঠে, ” হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি৷ আমি যতই দেখি ততই প্রেমে পড়ি৷ কি আছে আপনার মাঝে? ”

— উঁচু গলায় বলে উঠে, ” আর ইউ ক্রেজি? তুমি কি বলছো এসব আবোল তাবোল? তোমার মাথা ঠিক আছে৷ আমি তোমাকে কিন্তু… (থেমে যায়)”

নিয়তি নির্বণের উঁচু গলার আওয়াজ শোনে বাস্তবে ফিরে আসে৷ নিয়তি নিজেও জানে না এতক্ষণ সে কোথায় ছিল?

— নিয়তি হন্তদন্ত হয়ে বলে উঠে, ” আপনার কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন তো! এভাবে রেগে আছেন কেন?”

নির্বণ নিয়তির কথা শুনে হাসবে নাকি কান্না করবে ভেবে পাচ্ছে না৷ নির্বণ চোখ পাকিয়ে বলে উঠে, ” মিসেস নিয়তি আমার সামনে অতন্ত্য নাটক করা বন্ধ কর। আমি এসব নাটক একদম পছন্দ করি না৷”

নির্বণ ওয়াসরুমে চলে যায়৷ নিয়তি বোকার মতো নির্বণের যাওয়া দেখচ্ছে৷ নিয়তি মনে মনে বলে উঠে, ” আমি কি করলাম? সকাল সকাল আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছে কেন?”
নিয়তি আর কিছু না ভেবে রান্না ঘরে চলে যায়৷
__________

— “নিয়তি শালিক পাখি পছন্দ হয়েছে তো?” নিয়তিকে কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠেন।

— হ্যাঁ আমার খুব পছন্দ হয়েছে৷ আমি কতটা খুশি বলে বুঝাতে পারব না৷ আমি শালিক পাখিকে খুব ভালোবাসি। আমি ভাবতেই পারিনি নির্বণ আমার জন্য এমন একটা সারপ্রাইজ ব্যবস্থা করবে।

— আমাকে কিন্তু জানায় নি নির্বণ যে “তোমাকে পাখি এনে দিয়েছে৷”

— নিয়তি চকিত হয়ে, ” কি বলেন মা! তাহলে আপনি জানতে পারলেন কিভাবে?”

— অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ আজ সকালেই নির্বণ আমাকে বলেছে৷ আমায় জানায়নি কারণ আমি যদি তোমাকে বলে দেয় ৷

— মা এটা অন্যায় করেছে৷ আপনাকে জানানো উচিত ছিল৷ আজ রাতে অফিস থেকে ফিরে আসুক তার পর মজা দেখাবো।

— আমাকে ছেলেকে শুধু টর্চার করা হচ্ছে৷ একটু ভালোবাসা হচ্ছে না৷ আমি খুব রেগে আছি তোমার উপর৷

— ব্রু কুঁচকে, ” মা আপনি এসব কি বলছেন? আমি আপনার ছেলেকে টর্চার করব৷ বাহ্ বাহ্। যে কিনা আমাকে প্রতিনিয়ত টর্চার করে যাচ্ছে। আমাকে উঠতে বসতে বকা শুনিয়ে যাচ্ছে ৷”

— হয়েছে আর বলতে হবে না৷ এখন যা করার আমাকেই করতে হবে। তোমরা দুইজনেই সাপ বেজি৷

— আপনি কি করবেন? প্লিজ নির্বণকে কিছু বলবেন না৷ আপনার কথা উল্টো বুঝবে৷ আর আমাকে ভুল বুঝবে।

— নিয়তির হাত ধরে, ” মা’রে, আমি তো মা৷ আমি আমার ছেলেকে চিনি৷ আমার ছেলে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তোমাদের ভালোবাসা অটুট থাকবে সারাজীবন।”

— নিয়তি মনে মনে বলে উঠে, ” মা আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই নেই নির্বণের মাঝে। নির্বণ আমাকে একটুও ভালোবাসে ন। নির্বণের মনে আজও শাঁকচুন্নি ছোঁয়ার বাস। শাঁকচুন্নি আমার জীবনের একটা কাটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাকে এখন সামনে পেলে আমি তাকে দিয়ে ফুটবল খেলতাম৷ ”

— কি হলো নিয়তি? কি ভাবছো? এটাই তো ভাবছো, তুমিও নির্বণকে খুব ভালোবাসো। আমি জানি তোমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসো।

নিয়তি নির্বণের মায়ের কথাতে লজ্জা পায়৷ নিয়তি মাথা নিচু করে ফেলে। নির্বণের মা নিয়তিকে আরও লজ্জায় ফেলতে চাই৷

— আমার সামনে লজ্জা পেতে হবে না৷ তবে আমি আমার লজ্জাবতী বউমার কাছে খুশির খবর শুনতে চাই৷ আমি নাতি নাতনির সাথে খেলতে চাই৷

নিয়তি আর নিজেকে সামলাতে পারল না৷ নিয়তি লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে রুম থেকে দৌড়ে চলে আসে৷

_____________

— মা তোমার অবস্থা এখন কেমন? তোমাকে কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব৷ নিয়তি তোমাকে কিছু বলেনি৷

— নির্বণ আমি একদম ঠিক আছি৷ প্রতিদিন ২ ঘন্টা করে হাঁটা হচ্ছে। ফিজিওথেরাপি নিচ্ছি। এখন আমি পায়ে শক্তি পাচ্ছি৷ আমাকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না৷

— মা তুমিই আমার স্বর্গ। তোমাকে নিয়ে না ভাবলে আমি কাকে নিয়ে ভাববো?

— আরে বাবা আমি একদম ঠিক আছি৷ আমি সুস্থ হয়ে যাব যদি তোমরা…

— যদি কি? আর এখানে শুধু আমি আছি৷ আমি এখানে অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না৷ মা তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তোমার চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে৷

— আমার চোখের সমস্যা নেই৷ আমি তোমরা বলতে তুমি আর নিয়তিকে বুঝিয়েছি৷ আমি চাই তোমরা আমাকে একটা খুশির খবর দাও৷ আমি এই বুড়ো বয়সে আমার খেলার সঙ্গী চাই৷

— মা অনেক রাত হয়ে গেছে৷ প্লিজ মা ঘুমিয়ে পড়। এসব কথা মাথা থেকে ফেলে দাও৷ আমি আসছি৷

— আমার কাছ থেকে কি লুকাতে চাও? তুমি কি আজও নিয়তিকে মেনে নাওনি৷ তাহলে এত ভয় কেন?

— নির্বণ আমতা আমতা করে, ” কই ভয় না তো৷ বেশি রাত জাগলে তোমার শরীর খারাপ করবে। তাই বলছি ঘুমিয়ে পড়তে।”
আমি আসছি তুমি শুয়ে পড়৷ তোমাকে আর ডিস্টার্ব করব না৷ “গুড নাইট ”

নির্বণ রুমে থেকে বাহিরে এসে মনে মনে বলে উঠে, ” সরি মা! আমাকে ক্ষমা করে দিও৷ আমি নিয়তির কাছে আসলে আমার চোখের সামনে ছোঁয়ার ছবি ভেসে উঠে৷ কেন আমি ছোঁয়াকে ভুলতে পারছি না?

________

এভাবে কেটে যায় ৩০ দিন৷ আজ ছোঁয়ার চুক্তির শেষ দিন৷ রাত ১২ টার পর ছোঁয়ার এই বাডি থেকে চলে যাবে জানিয়ে দিয়েছে নির্বণকে৷ নির্বণ নিয়তিকে ভালোবাসে ফেলেছে৷ নির্বণ নিয়তির চলে যাওয়ার কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না৷

নিয়তি সবকিছু গুছিয়ে গাড়িতে রেখে এসেছে৷ নির্বণ অনেক বুঝিয়েছে সকালে চলে যেতে৷ কিন্তু নিয়তি নির্বণের কথায় রাজি নয়৷ সকাল হলে মা আর চলে যেতে দিবে না৷

— “স্যার আমার চুক্তিনামার আজ শেষ দিন৷ আর আপনি এই বিয়ের বন্ধন মানেন না। তাই আমি জোর করে এই বিয়ের বন্ধনে আটকে থাকতে চাই না৷” কথা বলার সময় নিয়তি গলা ভার হয়ে আসছিল।

— নির্বণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ” কাল সকালে চলে গেলে হয় না৷ আমি তোমার কাছে এই রাতটা চাইছি৷ মা সকালে জানতে পেলে কষ্ট পাবে।” মাকে তুমি বুঝিয়ে চলে যাও। আমি তোমাকে আটকাবো না।

— মা শুধু কষ্ট পাবে। আর তো কেউ কষ্ট পাবে না৷ কিছুদিন পর মা ঠিক বুঝতে পারবে৷ তবে আমি আমার জীবনে মায়ের আদরটুকু পেয়েছি উনার কাছ থেকে। কিছুতেই উনাকে ভুলতে পারব না৷

— নির্বণ টলমল চোখে নিয়তির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠে, ” তুমি একটা দিনের জন্যও আমার ভালোবাসা বুঝতে চাওনি৷ আমাকে দূরে সরিয়ে দিলে। আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না৷ তুমি আমায় ছেড়ে যেও না৷ আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

— নিয়তি নির্বণের দিকে ছোট করে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠে , ” আপনি আমাকে একটিও বারের জন্যও ভালোবাসার কথা বলছেন না৷ আমি আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি৷ আমি আপনাকে ছাড়া কিভাবে থাকব? আমি জানি আপনি কষ্ট পাবেন৷ কিন্তু একবারও জন্য বলছেন না৷ নিয়তি লাভ ইউ৷ আমি এই বিয়ের বন্ধনে থাকতে চাই৷”

একে অপরকের দিকে তাকিয়ে আছে৷ কারো মুখে কোন কথা নেই৷ চোখে চোখে কথা হচ্ছে। না বলা ভাষাগুলো আজ চোখের দেখায় শেষ হয়ে যাচ্ছে৷

— নিয়তির চোখের জল মুছে, ” স্যার আমি শালিকের জোড়া নিতে পারি৷ আমি আর কিছু নিব না৷ আমি পাখিগুলোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি৷ তাদের ছাড়া থাকতে পারব না৷”

— ভাঙা গলায় বলে উঠে “তোমার যা যা লাগে নিয়ে যাও৷ ”
একবারও তো বললে না আমায় ভালোবাসো৷ আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না৷ আজ আমি স্যার হয়ে গেলাম৷ মানুষের মন দুই মিনিটের মাঝেই পরিবর্তন হয়ে যায়। পাখিগুলো ছাড়া থাকতে পারবে না৷ কিন্তু আমায় ছাড়া দিব্যি ভালো থাকবে৷

নিয়তি পাখিগুলো নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখের জল মুছতে মুছতে মনে মনে বলছে, ” আমাকে আটকাবেন না৷ আমাকে একটুও ভালোবাসেননি৷ আমি একটুও আপনার মনে জায়গা করতে পারিনি।” নিয়তি অসহায় দৃষ্টিতে বার বার তাকাচ্ছে।

নিয়তি চৌকাঠে পা রাখার আগেই নির্বণ নিয়তির হাত ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিশে নেয়। নিয়তিও পরম আদরে নির্বণকে জড়িয়ে ধরে৷ কেউ কোন কথা বলছে না৷ শুধু দুইজনের চোখের জল তাদের ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে।

নির্বণ নিয়তিকে এমনভাবে দুই বাহুর মাঝে আটকিয়ে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে। নিয়তিও যেন আজ নির্বণের বুকে চির সুখের জায়গা খুঁজে পেল৷

পাতা উল্টে দেখো একটা গল্প লেখা।
একটু জানা কাহিনি কিছু কিছু অজানা।
একটা গোধুলি বেলা কনে দেখা আলোতে।
একটু উলো সানাই এ সাত পাকে বাঁধে যে। (২)
ছবির মতো একটা ছোট ঘরে৷
বরণ ডালায় সাজালো কে?

তুমি আমি দুজনে রয়েছি হৃদয়ের বাঁধনে
→→সাত পাকে বাঁধা ←←

— নিয়তি প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না৷ আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। আমি তোমাকে হারাতে পারব না৷

— আমিও আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।অনেক বার অনেক ভাবে বুঝাতে চেয়েছি৷ কিন্তু কোনদিন বুঝাতে পারিনি৷ কারণ আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।

— একদম এসব কথা আমার সামনে বলবে না৷ তুমি কোথায় থেকে বড় হয়েছো। সেটা আমার কাছে বড় কিছু নয়৷ সবার আগে তুমি একজন মানুষ৷ আমি তোমায় কখন ছাড়তে পারব না৷

— চলেই তো যাচ্ছিলাম। কই একবারের জন্যও মানা করেননি তো।

— তুমিও তো একবারও বল নি, তুমি আমায় ভালোবাসো। আমি না আটকালে তো তুমি চলেই যেতে।

— তো কি করব? আপনি তো সেই ছোঁয়াকে এখনো ভুলতে পারেন নি৷ আমায় ভালোবাসবেন কিভাবে? আমি আপনাকে ঠিকই ভালোবাসি৷ কিন্তু আমি আজ থেকে এই রুমে থাকতে পারব না৷

নিয়তি কথা শুনে নির্বণ নিয়তিকে ছেড়ে দেয়৷ নিয়তির দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ” আমি ছোঁয়াকে ভালোবাসি না৷ আর এই রুমে থাকবে না তো কই থাকবে?”

— আমি গেস্ট রুমে থাকব৷ যতদিন পর্যন্ত আপনি ছোঁয়াকে না ভুলে আমায় এই ঘরে নিয়ে না আসবেন, ততদিন আমি অপেক্ষা করব আপনার৷
নিয়তি মুচকি হেঁসে, ” আপনাকে নাকে দড়ি দিয়ে যদি না ঘুরাতে পারি আমিও নিয়তি নয়৷ আজই আমি ছোঁয়ার ভুত আপনার মাথা থেকে নামাব।

নিয়তি চলে যেতে নিলেই নির্বণ নিয়তির হাত ধরে ফেলে৷

— অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, ” হাত ধরলেন কেন।”

— আর এক পা এগিয়ে দেখো তোমার পা ভেঙে এখানে রেখে দিব৷

— আপনি তাই তো করতে পারেন। শুধু হুমকি দিয়ে পারেন৷ ভালোবাসা দিয়ে মন থেকে জয় করতে হয়৷

— কিভাবে ভালোবাসা আদায় করতে হয় আমার জানা আছে?

চলবে…..

বাবান ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে