#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_২৩
সকালে ঘুম ভাঙলো পায়ে কারো সুড়সুড়ি পেয়ে। শোভা চোখ মেলতেই খাটের চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা টফিকে নজরে এলো। সকাল সকাল বান্দা এসে হাজির। শোভা হেসে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। টফিকে কাছে টেনে বললো,
“আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছিস? সবে পা ঠিক হলো, আবার বদমায়েশি শুরু।”
টফির সেই দুর্ঘটনার পর এক মাস কেটে গেছে। দুইদিন যাবত টফি আবারো দৌড়াদৌড়িতে লেগে গেছে। যদিও পায়ের আঘার এখনো পুরোপুরি সেড়ে ওঠেনি। সাবধানে থাকতে হবে যেন কোনো চোট না লাগে।কিন্তু এই বোবা প্রাণীকে সেটা কে বোঝাবে! সে তো লাফাতে পারলেই খুশি। টফি লেজ নেড়ে শোভার জামার কোণা কামড়ে ধরে টানতে লাগলো। শোভা বুঝলো ওকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্যই টানছে। চুলে আঙুল চালিয়ে ঠিক করে হেয়ার ব্যান্ড বেধে নিলো। তারপর টফির সাথেই চলতে লাগলো। টফি শোভাকে টেনে বাড়ির বাইরে এনে রিয়াদের বাড়ির বাগানে আসলো। থেমেছে একটা গোলাপ গাছের সামনে। দু’টো বড় বড় গোলাপ ফুল ফুটেছে সেই গাছে। টুকটুকে লাল রঙ। টফি গাছের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। শোভা হাসলো। টফি লাল রঙ দেখে খুশি। হয়তো ফুলটা চাইছে দলাইমলাই করতে। শোভা হেসে বললো,
“আমাকে আবার ফুল চোরের তকমা দিতে চাইছিস? আমি বাবা এই বাগানের কোনো ফুলই ধরবো না। তুই দেখেই খুশি থাক। ছোয়া লাগবে না। নাহলে তোর ওই নাক উঁচু বন্ধুকে গিয়ে বল, সে দেবে। আমি দিলে চোর হয়ে যাবো।”
শোভার কথার মাঝে হঠাৎ রিয়াদের দেখা পাওয়া গেলো। শোভা ভ্রু কুচকালো। বেশ অনেকদিন যাবত শোভা রিয়াদকে এড়িয়ে চলছে। আসলে রিয়াদকে না, সে নিজের নতুন অনুভূতিকে এড়িয়ে চলছে, যা রিয়াদের সামনে এলে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। সেই সন্ধ্যায় পরম ভরসায় একে অপরের হাত ধরে কাধে মাথা রেখেছিলো, তারপর থেকেই শোভা এই অনুভূতির সাক্ষাৎ পেয়েছে। নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বে পড়ে সে রিয়াদের সামনে যতটা সম্ভব কম আসে।
আগের সেই উপেক্ষাকারী রিয়াদ হলে বোধহয় শোভা এতোকিছু ভাবতো না। তবে রিয়াদের আচরণও ইদানীং ওকে অন্যকিছুর আভাস দেয়। যার ফলে কোমড় বেধে ঝগড়া লাগতে গেলেও শোভা হুটহাট কথা ভুলে যায়। রিয়াদের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কি ভয়ঙ্কর ইচ্ছা! মাঝে মাঝে আবার ইগো জেগে ওঠে। সে কেনো এই নাক উঁচু লোকটার দিকে তাকাবে? কেনো তাকে পাত্তা দেবে?
কিন্তু অবাদ্ধ চোখ এবং মন যে ভিন্ন কথা বলে। সেখানে ইগো এসে নির্বাক হয়ে যায়। রিয়াদ যখন অফিস যায় শোভা তখন পর্দার আড়ালে থেকে ওর যাত্রা পথে তাকিয়ে থাকে। যখন ক্লান্ত চোখে বাড়ি ফিরে ওর জানালার দিকে তাকায় শোভা আড়ালে থেকে আনমনেই হাসে। সেই ক্লান্ত চাহনি টুকু অজান্তেই শোভাকে প্রশান্তি দেয়। ইংলিশ আন্টির সাথে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করে। রিয়াদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র ছুয়ে দেখে। কিন্তু রিয়াদ যখন সামনে থাকে সে পালাতে চায়। পালাতে চায় দমবন্ধ কর অনুভূতি থেকে।
এখনো শোভা রিয়াদের দিকে না তাকিয়ে চলে যেতে চাইলো। রিয়াদ এগিয়ে এসে বললো,
“আজকাল কাউকে চোখেই পড়ে না দেখছি। তা দুজনের তো ভালোই ভাব হয়েছে। এখানে কি করা হচ্ছিলো?”
বলে রিয়াদ টফির পেটে হাত বুলিয়ে দিলো।
শোভা একপলক রিয়াদের দিকে তাকালো। চকলেট কালার টিশার্ট গায়ে বেশ লাগছে তাকে। দৃষ্টি ফিরিয়ে বললো,
“টফি লাল গোলাপ চাইছে। আমি বাবা ফুল ছিড়ে আর চোরের তকমা নিতে পারবো না।”
“চোর তো তুমি এমনিতেও।”
শোভা ক্ষেপে গেলো। কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
“এমনিতেও মানে? কি চুরি করেছি আমি?”
রিয়াদ উত্তর দিলো না। এগিয়ে গিয়ে গোলাপ গাছ থেকে কাটা সহ একটা ফুলের ডাল ছোট করে ভেঙে নিলো। অতি সাবধানে একটা একটা করে কাটা তুলতে তুলতে বললো,
“কারো অজান্তে, অনুমতি ব্যতীত কোনো জিনিস নেওয়াকে আমরা চুরি বলি। সেই ভাবে দেখতে গেলে কারো অজান্তে তার মন নেওয়াও চুরির সামিল। তাইনা!”
শোভা কথাটা বোঝার চেষ্টা করলো। রিয়াদ আসলে বোঝাতে কি চাইলো! বললো,
“কে কার মন নিলো?”
“একটা মেয়ে। ধরেও ধরতে পারছি না তাকে।”
শোভার শরীরে কিছু একটা খেলে গেলো। কথা না বলে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো রিয়াদের দিকে। রিয়াদ নিঃশব্দে হেসে একটু এগিয়ে এলো। সূর্যের সোনালি আভায় ছেয়ে আছে চারপাশ। বাতাস বিহীন স্তব্ধ, গুমোট পরিবেশের ফলে শোভার নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সোনালি আলোয় তা আদুরে লাগলো দেখতে। রিয়াদ ক্ষীণ স্বরে বললো,
“এক চঞ্চল হরিণী তার চঞ্চলতায় আমার মন চুরি করে নিয়েছে। তার কারণবিহীন হাসি আমার ভাবনা দখল করে নিয়েছে। বিশ্রামেও শ্রম হয়ে মস্তিষ্ক দাপিয়ে বেড়ায়। গোছালো আমিকে অগোছালো করে দিয়েছে। ওকে যে আমার চাই। খুজে এনে দেবে সেই মেয়েটাকে আমায়?”
শোভা থমকালো। প্রতিটা কথা রিয়াদ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছে। সুস্পষ্ট ভাবে রিয়াদ ওকে কিছু বোঝাতে চাইলো যেন। শোভা খেয়াল করলো ওর গলার স্বর আটকে গেছে। ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নিলে রিয়াদ আবার ডাকলো।
“এই মেয়ে, কোথায় পালাচ্ছো? তাকে খুজে এনে আমায় দেবে না?”
“আ আমি কিভাবে খুজে দেবো?”
রিয়াদ এগিয়ে এসে শোভার পেছনে দাড়ালো।তারপর আশেপাশে তাকালো। বাগানের পেছনে জনশূন্য ঝোপঝাড়। সামনের দিকেও কারো পদচারণা নেই। ওর হাতের গোলাপটা শোভার কানের গুজে দিলো সন্তর্পণে। আকস্মিক ঘটনায় শোভা নড়তে ভুলে গেলো। হাত মুঠ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রিয়াদ এমন খোলামেলা আচরণ বোধহয় এই প্রথম করলো ওর সাথে। রিয়াদ বললো,
“তোমায় একটা ক্লু দিচ্ছি কেমন। দেখো খুজে পাও কিনা।”
রিয়াদ হাত এগিয়ে শোভার সামনে ধরলো। খালি হাত। তবে হাতে একটা লম্বা চুল আটকে আছে। সেদিকে নজর পড়তেই শোভা ভ্রু কুচকালো। বললো,
“কার চুল এটা?”
“আমার ঘরে খাটের ওপর টফির লোমের পাশাপাশি এই একটা লম্বা চুল পেলাম। আমার নিশ্চয়ই নয়। আমি একশত ভাগ নিশ্চিত এটা সেই মানবীর রেখে যাওয়া চিহ্ন।”
শোভা ভড়কে গেলো। রিয়াদ অফিসে থাকলে প্রায়ই টফির সাথে সে রিয়াদের ঘরে গিয়েছে। ইংলিশ আন্টিও তেমন কিছুই মনে করেনি। ভেবেছে শোভা টফির সাথে খেলা করে। শোভা রিয়াদের সব আসবাবই ছুয়ে দেখে। রিয়াদের ব্যবহার্য বস্তু ওর ভালো লাগে। কাল ওর বিছানায় চোখ বুজে শুয়েও ছিলো অনেকক্ষণ। সেই সময়টুকু শুভ্র অনুভূতিতে ছেয়ে ছিলো ওর মন। কোনোভাবে কি তখনই চুলটা…। শোভা মনে মনে জিভ কাটলো। ধরা পড়ে গেলো বুঝি। গলা পরিষ্কার করে বললো,
“আপনার মায়ের চুলও হতে পারে। কিংবা জানালা দিয়ে উড়েও আসতে পারে।”
রিয়াদ চুলটা দুইহাতে ধরে দৈর্ঘ দেখালো। বললো,
“মায়ের চুল কাধ অবধি তা তো জানোই। মায়ের চুলে ব্রাউন কালার করা। কালো নয়। এটা কালো চুল। আর জানালা দিয়ে উড়ে আসার কোনো সুযোগই নেই। চুলের তো চোখ নেই যে উড়ে এসে বেছে বেছে আমার বালিসেই পড়বে, তাইনা। আমার বালিসে এখনো তার গায়ের গন্ধ লেগে আছে৷ তাছাড়া এই চুল যে আমার বড্ড চেনা।”
শোভা আর দাড়ালো না। ছুটে বাড়ি চলে এলো। ধরা সে না চাইতেও পড়ে গেছে। যেই অনুভূতি থেকে পালাতে চাইছে তাতেই ভীষণ ভাবে ফেসে গেছে। শোভা কি করবে ভেবে পেলো না। ওর এই অস্থিরতার মাঝে একমাত্র মিহার নামই মাথায় এলো। ছুটে গেলো বোনের ঘরে।
মিহার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে একসপ্তাহ আগেই। গায়ে হলুদ থেকে বৌভাত সবই হবে। দুইদিন বাদে গায়ে হলুদ। নিশান্ত অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়েছে। সেজন্য উঠতে বসতে মিহাকে ফোনের ওপরই রাখছে। পারলে এক্ষুনি চলে আসছে ওর কাছে। মিহা মানা করে দিয়েছে। একেবারে বিয়ের দিন দেখা হবে দুজনের। তার আগে যদি আসতে চায় তবে ফোনে কথা বলাও বন্ধ করে দেবে বলেছে। শুনে নিশান্ত হতাশ গলায় বলেছে,
“শুরু হয়ে গেছে বউগিরি। দেখবো সামনে দাঁড়িয়ে কত বউগিরি করতে পারো।”
উত্তরে মিহা হাসে। ইদানীং খুনসুটি করেই দুজনের সময় কাটে। ফোন রাখতেই শোভাকে নজরে এলো মিহার। শোভা এসেই মিহার গলা জড়িয়ে ধরলো।
________
“ভালোবাসিস ওকে?”
“জানি না।”
“আমি জানি। ইনফ্যাক্ট তোর ভাইয়াও জানে। শুধু অপেক্ষা করছিলাম তুই কখন সেটা স্বীকার করবি।”
শোভা অবাক হয়ে মিহার দিকে তাকালো। মিহা হেসে শোভার গাল টিপে দিলো। বললো,
“তোকে বেশ অনেকদিন ধরেই খেয়াল করেছি। কেমন একটা উদাসীন ভাব চলে এসেছে তোর মধ্যে। খাওয়া-দাওয়া কমে গেছে। সবসময় কিছু নিয়ে ভাবছিস। আগের মতো ছোটাছুটি করছিস না। তাই দেখে তোর দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলছিলাম। সে’ই আমাকে অনেককিছু জানালো। আমিও তাতে নিশ্চিত হয়ে গেলাম সমস্যা কোথায়। তাছাড়া তোদের টম এন্ড জেরীর মতো লেগে থাকা দেখে আমি আগেই বুঝেছিলাম কিছু একটা আছে।”
“কিন্তু আপু এটা কি ঠিক? বাবা জানলে আমি মুখ দেখাবো কি করে? আরিফ আঙ্কেল, ইংলিশ আন্টি জানলে আমায় কি ভাববে?”
” কি আবার ভাববে! দুজনের একটা ব্যবস্থা করার কথা ভাববে। ভালোবাসা এতো ঠিক ভুল বিচার করে হয় না। তুইতো আগে টফিকেও দেখতে পারতিস না। সারাদিন গালমন্দ করতি। এখন কি করিস? টফির পায়ে আঘাত পাওয়ায় সবথেকে বেশি কান্না তো তুই করেছিলি। হুট করে একটা আঘাতে বুঝে গেলি আসলে তুই টফিকে কতটা ভালোবাসিস। কিন্তু ঝগড়ার আড়ালে সেটা লুকিয়ে ছিলো।
ভেঙে পড়ার সময় কেউ হাত ধরলে বা ভরসা দিলে তাকে আমাদের সবচেয়ে আপন মনে হয়। পোষা প্রাণীদের সাথে তোর মানসিক সম্পর্ক দৃঢ়। তাই তাদের কষ্ট তুই সহ্য করতে পারিস না। টফির বেলায়ও পারিসনি। সেদিন কান্নারত তোকে রিয়াদ সামলেছিলো বলেই কিন্তু একটা অদৃশ্য ভরসার সম্পর্ক তোদের তৈরি হয়ে গেছে। হয়তো রিয়াদ।ভাইয়ার পক্ষ থেকে সেটা আগে থেকেই ছিলো। ভালোলাগা যেখানে আগেই তোর মনে লুকায়িত ছিলো, ভরসা সেখানে শুধু ভালোবাসা তৈরি করতে একটা ধাপ মাত্র।”
জানালা গলে বাইরে তাকালো শোভা। দুপুর গড়িয়েছে সবে। শোভার কানে এখনো রিয়াদের গুজে দেওয়া গোলাপ। নেতিয়ে পড়েছে সময়ের সাথে সাথে। শোভা সেটায় হাত বুলিয়ে মিহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার এখন কি করা উচিৎ?”
“রিয়াদ ভাইয়া যদি অপরিচিত হতো তবে আমি কখনোই এগোতে দিতাম না তোকে। আর না তোর দুলাভাই সব বুঝেও নীরব সম্মতি দিতো। আমরা সব ভেবেচিন্তে দেখেছি। কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত অবশ্যই তোকে নিতে হবে।”
শোভার অনেকটা হালকা লাগছে এখন। মনের সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব বোনকে জানাতে পেরে বেশ ভালো লাগছে। রিয়াদের চোখের ভাষা শোভা এখন বুঝতে পারে। হয়তো খেয়াল করলে আরো আগেই বুঝতো। শোভা বুক ভরে শ্বাস নিলো। শেষ সিদ্ধান্তটা তাহলে তারই হোক।
চলবে…