শুভ্র বর্ষণ পর্ব-১৮

0
1330

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১৮

নিশান্তের কাছে খবর এলো দুপুরের পর। মিহা এক্সিডেন্ট করেছে। আজ ভার্সিটি যাওয়ার পথেই মিহার বারবার মন ছটফট করছিলো নিজের বাড়ি যাবার জন্য। নিজের মনের কথায় সায় জানিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলে সেই উদ্দেশ্যে। ঘন্টাখানেক পর পৌঁছে গেলো নিজের একতলা বাড়িটায়। বাড়িটায় ফাকা। কেউ থাকে না৷ শুধু একজন কেয়ার টেকার রয়েছে দেখা শোনা করার জন্য। বাড়ির ভেতর পা রাখতেই ছোট থেকে বড় হওয়া বাবার সাথে কাটানো উনিশ বছরের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো হানা দিচ্ছিলো। ভারী পল্লব ভিজে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিলো বারবার। মলিন দেয়াল, ঘরের টুকটাক আসবাব গুলো স্পর্শ করে অতীতে ডুবছিলো সে। স্মৃতির মোহাবিষ্ট হয়েই বেশ অনেকটা সময় অতিবাহিত করে বেরিয়ে এসেছিলো বাড়ি থেকে। অবচেতনে রাস্তার কোল ঘেঁষে হেটে যাওয়ার সময় কখন যে ফুটপাত ছেড়ে পিচ ঢালা রাস্তায় পা বাড়িয়েছিলো খেয়ালই করেনি মেয়েটা।

হুট করে চলন্ত রিক্সার সাথে ধাক্কা খেয়ে যখন হুশ আসে ততক্ষনে ছিটকে মাটিতে পড়েছে সে। আশে পাশের লোকেরা ছুটে এসে রিক্সাচালককে দোষী করতে নিলে মিহা নিজেই বাধা দিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করে। খুব বেশি আঘাত না পেলেও বাম হাত নাড়াতে গিয়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব হয়। এই হাতেই ধাক্কাটা লেগেছে। খেয়াল করে কনুইয়ের দিকে অনেকটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। কোনোমতে ফোন বের করে শোভাকে কল দিয়ে নিজের লোকেশন জানায় সে। শোভা ভার্সিটি থেকে গিয়ে ওকে নিয়ে আসে। হাতে এক্স-রে করে জানা গেছে বাম হাতের হাড়ে সামান্য চিড় ধরেছে।

প্লাস্টার করে যখন বাড়ি ফিরলো মেয়েকে দেখে সুমা বেগম মূর্ছা যায় যায় অবস্থা। স্বামীর রেখে যাওয়া একমাত্র সম্পদকে তিনি কখনোই কোনো আঘাত পেতে দেননি। আর সেই মেয়ের এমন কান্ড জ্ঞানহীন কর্মে সুমা বেগম কেদে ফেললেন। সকলের বকা, কান্না, শাসন শেষ হতেই আবির্ভাব হলো নিশান্ত এবং ওর বন্ধু রাফাত। শোভা আগেই নিশান্তকে সংক্ষেপে খবর দিয়ে দিয়েছে। নিশান্তের উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে মিহা আরেকদফা চুপসে গেলো। চোখ তুলে একবার তাকাতেই বুঝলো আতঙ্কিত চেহারায় রাগের আগমন ঘটেছে। এই এতোদিনে আজ প্রথম মিহা নিশান্তের সত্যিকারের রাগী চেহারার দর্শন পেলো। নিশান্ত শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

“কি করে হলো এসব?”

মিহার মনে হলো নিশান্ত নয়, অন্যকেউ তার ভেতর থেকে কথা বলছে। বিয়ের এতোদিনে আজ প্রথম এতো শান্ত অথচ কঠিন স্বরের সম্মুখীন হলো সে। কাপাকাপা গলায় বললো,

“ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম একটু। ফেরার পথে ওই একটু… আসলে আমি খেয়াল করিনি।”

“খেয়াল করিনি মানে! তুমি কি ছোট বাচ্চা? নাকি এখনো আবেগ নিয়ে থাকা কিশোরী?”

মিহা কথা বলতে পারলো না। মাথা নিচু করে ফেললো। নিশান্ত আবার বললো,
“বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসো বুঝলাম। কিন্তু তাই বলে স্মৃতিকাতর হয়ে নিজেকে হারালে জীবন চলবে? বাবা নেই। কিন্তু তুমি তো আছো। আজ যদি রিক্সা না হয়ে অন্য কোনো গাড়ি…”

বলতে বলতে থেমে গেলো নিশান্ত। কথাটা ভাবতেও কলিজা কেপে উঠছে। কিন্তু প্রচুর রাগ হচ্ছে ওর। এতোটা কান্ড জ্ঞানহীন হয় কি করে মেয়েটা! নিশান্ত শোভাকে ডাকলো। শোভা রুমের বাহিরেই ছিলো। ভেতর থেকে নিশান্তের ডাক পড়তেই ভেতরে গেলো সে। কেনো জানি আজ নিশান্ত ভাইয়াকে ভয় লাগছে তার। যদিও শোভার সামনে সে যথেষ্ট নমনীয় ভাব প্রকাশ করছে।

“তোমরা তো একসাথেই ভার্সিটি যাও। তাই না শোভা!”

নিশান্ত জিজ্ঞেস করতেই শোভা মাথা নাড়লো। যার অর্থ হ্যা।
নিশান্ত আবার বললো,
“তাহলে আজ কিভাবে ও একা পুরোনো বাড়িতে গেলো? তুমি ছিলে না কেনো?”

“আসলে ভাইয়া আমার কিছু নোটস নেওয়া এবং লাইব্রেরিতে কাজ ছিলো। তাই আপু বলেছিলো একাই যেন চলে যাই, আপু পরে যাবে। তাই আমিও আগেই বের হয়ে গিয়েছিলাম। আপু পরে একা যাওয়ায় জানতে পারিনি।”

নিশান্ত শোভার দোষ পেলো না। বরং মিহার ওপর রাগ বাড়লো। শোভা একবার নত মুখে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে থাকা মিহাকে দেখে আর না দাড়ানোই শ্রেয় মনে করলো। যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই বেড়িয়ে গেলো সে।

নিশান্ত মিহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তোমার বাহিরে চলাচল বন্ধ আজ থেকে। যত দ্রুত সম্ভব আমার বাড়ি যাবে। কোনো গাইগুই চলবে না। এরপর থেকে যেখানেই যাবে বাড়ির গাড়ি ব্যবহার করবে। নাহলে এধরনের কান্ড জ্ঞানহীন আচরনে নিজের সাথে সাথে অন্যদেরকেও মারবে।”

মিহার কান্নার বেগ বাড়লো। চেয়েও আটকাতে পারছে না। যদিও দোষটা ওর, তবুও নিশান্তের এমন রাগ মানতে পারছে না।
নিশান্ত পুনরায় মিহার দিকে নজর দিলো। সাদা ব্যান্ডেজ জড়ানো হাতে ক্রন্দনরত রমনীকে দেখে হয়তো বুকের ভেতর সুক্ষ ব্যাথা অনুভব হলো। তবুও শক্ত গলায় বললো,

“এভাবে কথায় কথায় কাদা বন্ধ করো। এসব চোখের জলে অন্যকে ভুলাতে পারবে, আমাকে না। অনুভূতির সঠিক ব্যাবহার শেখো। স্মৃতি নিয়ে আবেগী হয়ে বসে থাকা দুর্বলতা। বরং যেখানে যেমন আচরণ করা উচিৎ তাই করো। দৈনন্দিন জীবন ঝুকিতে ফেলে স্মৃতিতে যেখানে সেখানে এমন কাতর হওয়া চলবে না। স্মৃতি নামক মূল্যবান অনুভূতিকে স্মরণ করা ভালো কিন্তু পুষে রেখে নিজের ক্ষতি করা চরম রকমের বোকামি। আর যদি এমন আচরণ অব্যাহত রাখো তাহলে আমাকে আর পাবে না।”

নিশান্তের শেষ কথা শুনে মিহা মুখ তুলে তাকালো।ক্রন্দনরত কণ্ঠে বললো,
“এভাবে বলবেন না প্লিজ! আমি আর এমন করবো না।”

মিহার কাতর স্বরে নিশান্ত আর দাড়াতে পারলো না। হনহন করে বেড়িয়ে গেলো রুমে থেকে। রাফাত এতোক্ষন বাইরে বসার ঘরে ছিলো। নিশান্তকে বেরিয়ে আসতে দেখে সে অনুমান করতে পারলো নিশান্ত বিক্ষিপ্ত। তাই কিছু বললো না। বরং মিহাকে দেখতে এগিয়ে গেলো। রাফাত দরজায় মৃদু আওয়াজ করে বললো,

“আসবো ভাবী?”

মিহা তখনো কেদেই চলেছে। হঠাৎ রাফাতের গলা পেয়ে উঠে দাড়ালো। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে রাফাতকে অনুমতি দিলো ভেতরে আসতে৷ রাফাত রুমে আসতেই কান্নাচাপা গলায় বললো,

“বসুন ভাইয়া।”

রাফাত মিহার হাতের দিকে একবার তাকিয়ে সোফায় বসলো। বললো,
“এখন কেমন লাগছে ভাবী?”

“ভালো।”

রাফাত মৃদু হেসে বললো,
“এতো বকা খাওয়ার পরেও ভালো!”

মিহা জবাব দিলো না। রাফাতই আবার বললো,
“সবসময় সকলের খেয়াল রাখা ছেলেটা আপনার এমন অবস্থায় পাশে না থেকে উল্টো বকা কেনো দিচ্ছে জানেন?”

মিহা প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো৷
“কেনো?”

“কারণ কাছের মানুষকে হারানোর ভয়টা কয়েকমাস আগে ওর মনে গভীরভাবে গেথে গেছে। এখন সামান্য মেঘ করলেই ঝড় হওয়ার আশঙ্কা করে।”

“মানে?”

“আপনি জানেন নিশ্চয়ই যে আমরা তিন বন্ধু।”

“হ্যাঁ।”

“আমরা মাস সাতেক আগেও চার বন্ধু ছিলাম। আমি, অভি, নিশান্ত এবং অরন্য।”

মিহা মাঝপথে জিজ্ঞেস করলো,
“ছিলেন মানে? এখন নেই?”

রাফাত হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
“না।”

“কেনো?”

“বলছি। অরন্য আমাদের বন্ধুত্বের প্রাণ ছিলো বলা যায়। অভির থেকেও প্রানবন্ত ছিলো সে। বিশেষ করে নিশান্তের একদম ছোট বেলার বন্ধু ছিলো সে। যার ফলে আমাদের থেকেও নিশান্ত এবং অরন্য একে অপরকে চোখে হারাতো। ভাগ্যক্রমে নিশান্ত এবং অরন্য একই কোম্পানিতে চাকরিও পেয়েছিলো। আপনার সাথে নিশান্তের প্রথম দেখার দিন অরন্যও সাথে ছিলো। নিশান্তের আপনাকে প্রথম দেখে শুধু আকর্ষণ ও ভালোলাগা কাজ করেছিলো। হয়তো দুর্বলতাও। অরন্য ওর দুর্বলতা বুঝেছিলো। তাই সেটাকে ভালোবাসায় রূপান্তর করতে অরন্যই নিশান্তকে সাহায্য করেছে। আপনাকে ফলো করা কিংবা নিশান্তের বাবার সাথে আপনার মামার সখ্যতা বাড়ানো, এই সবই ছিলো অরন্যের বুদ্ধি। আপনাদের এক হওয়া নিয়ে অনেক এক্সাইটেড ছিলো ছেলেটা।”

মিহার কান্না সেই কবেই থেমে গেছে। এই কথাগুলো সে জানতোই না। বললো,
“এখন কোথায় তিনি?”

“নেই। সাত মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। প্রজেক্টের কাজে নিশান্ত এবং অরন্য ময়মনসিংহ গিয়েছিলো। রাতে আবার ফিরে আসার কথা ছিলো। নিশান্ত ড্রাইভিংয়ে পারদর্শী থাকায় সবসময় ওই ড্রাইভ করতো। অরন্য ড্রাইভিং জানলেও খুব একটা পটু ছিলো না বলে চালাতো না। সেদিন দুজনে ফেরার পথে অরন্য নিজে ড্রাইভ করার ইচ্ছা পোষন করলে নিশান্ত প্রথমে দিতে চায়নি। অনেক গাইগুই করে শেষমেষ রাজি হয়েছিলো। আর সেটাই ওর কাল হলো। নিশান্ত অরন্যকে ড্রাইভ করতে দিয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তীব্র এক ধাক্কায় ঘুম ভাঙলেও কিছু বোঝার আগে জ্ঞান হারায়। যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে হাসপাতালের বেডে পায়। জানতে পারে ওর গাড়িটা আরেকটা প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা লেগেছে৷ এতে নিশান্ত খুব একটা আহত না হলেও অরন্য আহত হয়। তবে মৃত্যু হতে পারে এমন আহত নয়।”

“তাহলে?”

“অরন্য এক্সিডেন্টের পরই ব্রেইন স্ট্রোক করে। সেই স্ট্রোকই ওকে টেনে নেয় অন্য জগতে। আর ফিরে আসেনি। আমরা খবর পেয়ে পৌছানোর আগেই অরন্য…।”

রাফাত থামলো। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে আবার বলতে লাগলো,
“সেই থেকেই নিশান্ত একটা অপরাধবোধে ভোগে। ও ভাবে যদি সেই রাতে অরন্যকে ড্রাইভ করতে না দিতো তাহলে এই ঘটনা ঘটতো না। অরন্য আমাদের ছেড়ে যেত না। সেই থেকে নিশান্ত ড্রাইভ করা ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ির গাড়িও নিজে চালাতে চায় না। এক্সিডেন্ট থেকে সচেতন হওয়ায় এখন বাড়ির কাউকে লোকাল পরিবহনেও চড়তে দিতে চায় না।”

মিহা কি বলবে ভেবে পেলো না। শুধু শুনেই যাচ্ছে। রাফাত আবার বললো,

“নিশান্তর রাগে মন খারাপ করে কাদবেন না। দেখবেন একটু পরই সব ভুলে ছুটে আসবে। আর আপনিও একটু নিজের দিকে সচেতন হোন। ওকে আর কষ্ট দেবেন না।”

মিহা এতোক্ষনে বুঝতে পারলো নিশান্তের হঠাৎ রাগ এবং বিষন্ন হওয়ার কারন। সেই রাতের কথাগুলোও আবার মনে পড়লো। এই জন্যই বোধহয় সে মিহাকে নিজের একান্ত প্রিয় বন্ধু বানাতে চায়।

নিশান্ত রুমে ফিরলো ঘন্টাখানেক পর। মিহার তখন চোখ লেগে গেছে। নিশান্ত নিঃশব্দে এসে মিহার মাথার কাছে বসলো। মিহার ঘুম হালকা হয়ে গেলেও চোখ মেললো না। নিশান্ত মিহার ব্যান্ডেজে আলতো করে হাত রাখলো। তারপর ঠোঁট। মিহার চুলে আঙুল গলিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মুখের দিকে। কান্নার ফলে চোখের চারপাশ কিছুটা স্ফিত হয়ে আছে মেয়েটার। এই মায়াবী মেয়েটার যদি কিছু হয় থাকবে কি করে ও! নিশান্ত ঝুকে এসে ফিসফিস করে বললো,

“আমি আর কাউকে হারাতে চাই না। তোমাকে তো একদমই না। অরন্য তোমার প্রতি আমার অনুভূতি মজবুত করতে চেয়েছিলো। অথচ তুমি এখন আমার অনুভূতির চেয়েও বেশি কিছু। আমাকে এভাবে মায়ায় বাধলে কি করে বলোতো!”

চলবে…

(ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে