শুভ্র বর্ষণ পর্ব-১৭

0
1278

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১৭

রাত ঘনিয়েছে অনেকক্ষন আগে। ক্রমশ তা গভীর হচ্ছে। বাড়ির পিছনের ঝোপঝাড় থেকে ঝি ঝি পোকার বিরামহীন ঝিম ধরা শব্দ ভেসে আসছে। সারাদিন সূর্যের বিরতিহীন প্রখরতা ছিলো বিধায় পরিবেশটা গরম হয়ে আছে। রাতের খাবার শেষে নিশান্ত খাটে আধশোয়া হয়ে মোবাইলে ডুবে আছে। যেন মোবাইল ব্যতীত আশেপাশে কিছুই নেই। পাশেই কাচের চুরির টুংটাং শব্দ তুলে তরুণী শাড়ির আচল ঠিক করছে। হালকা গোলাপি শাড়ি তার অঙ্গে জড়ানো। খোলা চুল, মোটা করে কাজল লেপ্টানো চোখ এবং দু’হাত ভরা সবুজ ও বেগুনি কাচের চুড়ি। আড়চোখে খাটে বসে থাকা মোবাইলে মগ্ন মানুষটাকে দেখছে মাঝে মাঝে। তরুণী বেশ অনেকক্ষন যাবত লোকটার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেও ব্যার্থ। একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না। বিরক্তি নিয়ে চুল ঝাড়া দিতেই কানের দুলের সাথে চুল আটকে গেলো। হুট করেই যেন মনোযোগ পাওয়ার একটা আশা ধরা দিলো চোখে। নিশান্তের পাশে বসে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,

“দুল থেকে চুলগুলো একটু ছাড়িয়ে দিন না। কানে ব্যাথা পাচ্ছি।”

নিশান্ত ফোন থেকে চোখ সরালো। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উঠে মিহার চুলে হাত দিলো। কয়েক মুহূর্তেই দুল থেকে চুল সরিয়ে আবার মোবাইলে ডুব দিলো সে। মিহা মুখ ফোলালো। শাড়ি পড়া দেখে কিছুই বললো না! এমনকি ভালো করে দেখলোও না। পুনরায় আগ্রহ নিয়ে বললো,

“আমাকে কেমন লাগছে?”

নিশান্ত একবার চোখ তুললো। মিহাকে একপলক দেখে মোবাইলে নজর দিয়ে বললো,
“হু, খারাপ না।”

মিহার উজ্জ্বল মুখে আধার নামলো। খারাপ না মানে! এতো যত্ন করে সাজলো অথচ বলছে শুধু খারাপ না! মিহার ইচ্ছে করছে মোবাইলটা ভেঙে ফেলতে। কি আছে এতো মোবাইলে? বউ রেখে মোবাইলে কি? কিন্তু আফসোস। মিহার দ্বারা এই কথাগুলো জীবনেও উচ্চারণ সম্ভব নয়। ওকে এভাবে চুপসানো মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিশান্ত আবার বললো,

“দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ঘুমাবে না? আর ঘুমানোর সময় আরামদায়ক পোশাক পড়া উচিৎ। এসব পড়ে ভালোমতো ঘুম হবে না।”

মিহার হঠাৎ কান্না পেলো। এতো রাগ পুষে রেখে কি লাভ হচ্ছে! অযথা দুরত্ব তৈরি করার কি খুব দরকার! মিহা লাইট অফ করে দিয়ে গটগট করে হেটে বারান্দায় চলে গেলো। থাকবে না এই লোকের সাথে। অথচ মিহা জানতেই পারলো না কেউ মোবাইলের ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে পুরোটা সময় ওকেই দেখে গেছে। মিহাকে বারান্দায় চলে যেতে দেখে সে মুচকি হাসলো।

রাস্তার সাইডের টিমটিমে আলোয় দুয়েকজন মানুষের পদচারণা আছে। আশেপাশের বাড়িগুলো অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে শুরু করেছে। মিহা অন্ধকারে গাল ফুলিয়ে নিশাচর হয়ে আশেপাশের সবকিছু দেখে চলেছে বিশ মিনিট যাবত। ভেবেছিলো নিশান্ত একবার হলেও আসবে। ওর হাত ধরবে কিংবা জড়িয়ে ধরবে। সেই ভাবনা যে বাস্তব রূপ ধারণ করবে না তা বুঝে গেছে এতোক্ষনে। মশার কামড়ে পা ফুলে উঠছে। এতো রাগ কেনো লোকটার! মিহার মনে হলো নিশান্তের অনুভূতিতে কম বলে কোনো শব্দ নেই। সবই বেশি বেশি। ভালোবাসাও বেশি, আবার রাগও বেশি।

নিশান্তের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়ছে ওর। হুট করেই একটা মুহূর্ত মনে পড়তেই মিহার ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি ফুটে উঠলো। সেই সাথে গালে ভেসে উঠলো গোলাপি আভা। একবার ফোনে দুইজন দুইজনের ভালো এবং মন্দ স্বভাবগুলো নিয়ে আলোচনা করার সময় নিশান্ত বলেছিলো,
‘তুমি রাগ করলে, অভিমান করলে আমি ভাঙাতে পারবো৷ কিন্তু আমি যদি কোনো কারণে তোমার ওপর রাগ করি, তুমি উল্টো রাগ করো না। তাহলে কেউই কারো মান ভাঙাতে পারবো না। বরং এগিয়ে এসে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। ব্যাস আমি তাতেই কুপোকাত। এমন এক বিড়াল ছানাকে বুকে নিয়ে রাগ পোষণ করার ক্ষমতা আমার এখনো হয়নি।”

মিহা লজ্জা চেপে রুমের ভেতর পা বাড়ালো। অন্ধকার চোখ সয়ে যেতে বুঝলো নিশান্ত এখনো সেভাবেই আধশোয়া হয়ে বসে আছে। মিহা ছুটে গিয়ে ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। লজ্জা রাঙা মুখ গুজে দিলো নিশান্তের প্রশস্ত বুকে। আজ আর মুখ তোলার শক্তি নেই ওর। নিশান্ত নিঃশব্দে হেসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তার মাহযাবীনকে। একটি কোমল বিড়ালছানার মতো মিহা মিশে রইলো ওর সাথে। নিশান্ত আফসোসের সুরে বললো,

“এতোক্ষণে মনে পড়লো তবে!”
“হু।”
“বোকা বউ আমার।”

_________

ইংলিশ আন্টির জন্য একটা ধুসর জামরঙা শাড়ি কেনা হয়েছিলো কাল। তিনি খুশিতে আজই পড়ে ফেলেছেন সেটা। শোভার পছন্দ বেশ মানসম্মত বলা যায়। ইংলিশ আন্টি আধুনিক ডিজাইন পছন্দ করে ভেবে শোভা বয়সের কথা চিন্তা না করে আধুনিক ডিজাইনের শাড়ি বেছে নিয়েছে। রিয়াদ প্রথমে ভেবেছিলো ডিজাইনটা ইয়াং মানুষদের মানাবে। ওর মা বোধহয় পছন্দ করবে না। কিন্তু রিয়াদের মা আরো বেশি গদগদ হয়ে পড়েছেন শাড়ি পেয়ে। মায়ের খুশি দেখে রিয়াদেরও ভালো লাগছে। সে বোঝে তার মায়ের বয়স হলেও মনটা এখনো অপরিপক্ক। রিয়াদের বাবাও সেটা মানে।

কিছু মানুষ কোনোদিনও বড় হয় না। তাদের চিন্তা ভাবনায়, আচার-আচরণে সেসব সারাজীবনই স্পষ্ট থাকে। রিয়াদের মাও তেমন একজন মানুষ। তারা ভেবে চিন্তে, ফলাফল বিবেচনা করে কোনো কাজ করে না। এ ধরনের মানুষ অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয় বেশি। যেমনটা তার মা। এলাকার কিছু আধুনিক মনা মহিলাদের সাথে বন্ধুত্ব করে পাশ্চাত্যের ছোয়া পেতে ইচ্ছুক তিনি। অথচ দেশীয় স্বত্তা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইছে। সেগুলো বের করে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সেই স্বত্তা আধুনিকতার মোড়কে ঢেকে রাখতে চান।

মায়ের অনুরোধে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য বাগানে এলো রিয়াদ। সবার আগে না চাইতেও শোভার বাড়ির দিকে নজর চলে গেলো। শোভা বাড়ির বাহিরেই আছে। সাথে আছে ওর মা শিরীন বেগম। বোধহয় কিছু নিয়ে বকা খাচ্ছে সে। রিয়াদ খুব বেশিক্ষন দৃষ্টি স্থির রাখতে পারলো না৷ নজর সরিয়ে মায়ের দিকে মনোযোগ দিলো।
শোভা রিয়াদ এবং ইংলিশ আন্টিকে দেখা মাত্রই মুখের অসহায় ভাবটা দূর করে স্বাভাবিক ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলো। অসহায় কন্ঠে বললো,

“হয়েছে, আর কত বকবে!”

“বকবো না তো কি করবো! এতো বড় মেয়ে হয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো কি ভালো কাজ? লোকে কি বলবে? সারাদিন কুকুর, বিড়াল নিয়ে থাকলে জীবন চলবে? গায়ে হাতে জীবাণু নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সব সময়। আর যদি দেখেছি রাস্তাঘাটে দৌড়াতে পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো। আজ আসুক তোর বাবা।”

বাবার কথা শুনে শোভা কিছুটা মিইয়ে গেলো। ওর বাবা এমনি ভালো মানুষ হলেও বাবার রাগ খুবই ভয় পায় সে। মাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আমতা আমতা করে বললো,
“আবার বাবাকে টানছো কেন? আমি আর বাহিরে যাবোই না আজ। তুমি দেখে নিয়ো।”

শিরীন বেগম হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“এই জীবাণু যুক্ত হাতে ধরবি না একদম। চুপচাপ ঘরে ঢুকে গোসল করবি আগে। এখনো বাচ্চা নেই তুমি যে সব ভালোমন্দ দেখিয়ে দিতে হবে।”

শিরীন বেগম বকতে বকতে ভেতরে চলে গেলো। শোভা মুখ নিচু করে ভেতরের দিকে পা বাড়াতে গেলে ইংলিশ আন্টি ডাকলো। না চাইতেও সেদিকে গেলো সে। ইংলিশ আন্টি আজ ভীষণ খুশি সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

“তোমার পছন্দ আমার বেশ ভালো লেগেছে শোভা। ভালো করেছো রিয়াদের সাথে গিয়ে। আমি ভাবছি এর পর থেকে শাড়ি কিনতে গেলে তোমাকে নিয়ে যাবো।”

শোভা হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু পাশে দাঁড়ানো রিয়াদকে দেখে হাসি আসতে চাইছে না। বরং না চাইতেও বিরক্তি ফুটে উঠছে। রিয়াদ মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
“শুধু শাড়ি কেনো মা! এমনিতেও ঘোরাঘুরি ছাড়া কোনো কাজ থাকে না শোভার। আমি যখন অফিসে থাকবো তুমি টফির দায়িত্বও ওকে দিতে পারো। শোভা আবার টফিকে ভীষণ ভালোবাসে। তাইনা শোভা?”

শোভা রিয়াদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বললো,
“হ্যা, ভীষণ ভালোবাসি।”

“কাকে?”

রিয়াদের প্রশ্নে শোভা হকচকিয়ে গেলো। বললো,
“মানে?”

রিয়াদ ক্ষীণ স্বরে বললো,
“এইযে ভালোবাসো!”

“আজব! কাকে আবার! আপনিই না বললেন টফিকে। আমিও তাই বললাম।”

“আর টফির মালিককে?”

শোভা বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ রিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। যখন প্রশ্নটার মানে বুঝলো শোভার সারা শরীরে কিছু একটা খেলে গেলো।
রিয়াদ শোভাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,

“জানি আমি হ্যান্ডসাম। এভাবে তাকিয়ে থেকে মনে করাতে হবে না।”

শোভা নিজেকে সামলে নিলো। কথাটা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো। নিচের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“টফির মালিককে সহ্য হয় না আমার। একদম না। ইচ্ছে করে কাপড়ের মতো ধুয়ে রোদে শুকাতে দেই।”

শোভার কথা শেষ হতেই রিয়াদ মুখে হাত চেপে ধরে অবাক হওয়ার ভাণ করে বললো,
“মাকে রোদে শুকাতে দেবে তুমি? এই কথাটা বলতে পারলে?”

শোভা থতমত খেয়ে গেলো। কি বলছে রিয়াদ! ও কখন ইংলিশ আন্টিকে এমন বললো! বললো তো রিয়াদকে। আর ও তো আস্তেই বললো। ইদুরের মতো দূর থেকেই কথা শুনে ফেললো রিয়াদ! ইংলিশ আন্টি ততক্ষনে বাগানে ঢুকে গেছে ছবি তুলতে তুলতে। শোভা রেগে বললো,

“কি যা তা বলছেন? ভুল শুনেছেন আপনি।”

“আমি ঠিক শুনেছি। তুমি মাকে এমন কথা বলতে পারলে?”

“আন্টিকে কেনো বলতে যাবো? বলেছি তো টফির মাথামোটা মালিককে।”
বলেই জিভ কাটলো শোভা। ইশ! স্বীকার করা একদম উচিৎ হয়নি।

“মাকে মাথামোটা বললে তুমি? এতো বড় সাহস তোমার?”

“আরে আন্টিকে কেনো বলবো এসব!”

“তো টফির মালিক তো মা’ই। টফি মায়ের পোষা তা কি তুমি জানো না? আমি আর বাবা তো টফির সঙ্গী মাত্র, বন্ধু বলতে পারো। দাঁড়াও তোমার এসব জানাচ্ছি মাকে।”

শোভা কি বলবে ভেবে পেলো না। কোন কথা কোথায় চলে গেছে বুঝেই উঠতে পারলো না সে। এই রিয়াদ যে এতো ধুরন্ধর! এভাবে ওকে কথায় ফাসাবে কে জানতো! রিয়াদ এক কদম এগোতেই তড়িঘড়ি করে রিয়াদের হাত চেপে ধরলো সে। রিয়াদ থেমে গিয়ে হাতের দিকে তাকাতেই শোভা হাত ছেড়ে দিলো। আমতা আমতা করে বললো,

“আমি আন্টিকে উদ্দেশ্য করে কিচ্ছু বলিনি বিশ্বাস করুন। টফি আপনাদের পালিত তাই টফির মালিক আপনাকে ভেবেছিলাম। আপনারা যে সম্পর্ক কে মালিক, সঙ্গী, বন্ধু এতোকিছু ভাবেন তা জানতাম নাকি?”

রিয়াদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কথাগুলো তাহলে তুমি আমাকে বলেছো?”

শোভার বলতে ইচ্ছা করলো, “হ্যা আপনাকেই বলেছি।” কিন্তু পারলো না। এই রিয়াদের বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে ওর মাকে গিয়ে আবার বলে দিয়েছে। কোনোমতে রাগ সামলে বললো,

“কিসব বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছেন বলুনতো। আমি বড়দের এসব বলতে পারি নাকি! আপনি ভুল শুনেছেন। আমি এসব বলিনি।”

“কোনটা বড়দের ঝগড়া আর কোনটা বাচ্চাদের ঝগড়া সেটা বোঝো তুমি?”

“হ্যা, অবশ্যই বুঝি। আপনি ইচ্ছে করে আমায় ফাসাচ্ছেন। কথার প্যাচে ফেলছেন। আমি কি বুঝি না ভেবেছেন?”

রিয়াদ মৃদু হাসলো। ঝুকে এসে বললো,
“কিছু কিছু বোকা চালাক হয় জানোতো। এরা নিজেদের খুবই চালাক ভাবে। ভাবে এরা সবই বোঝে।কিন্তু আসলে মাথাটা ফাকা। অল্পতেই চটে যায়। কানে শোনা কথা ব্যতীত কিছুই বোঝে না। অথচ একটু চোখ মেলে তাকালে কথা বাদেও অনেক কিছু নজরে আসতো।”

রিয়াদ দাড়ালো না। উল্টো হেটে মায়ের কাছে চলে গেলো। শোভা বোকা চোখে রিয়াদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলের হেয়ালি কথায় ও সবসময় দোটানায় পড়ে যায়। কখন কোন কথা দ্বারা কি মানে বোঝায় তা ওর বোধগম্য হয় না। শোভার মনে হলো ও বোধহয় সত্যিই বোকা হয়ে গেছে। অন্তত এই ছেলের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে