শুভ্র বর্ষণ পর্ব-১৬

0
1346

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১৬

আনোয়ার সাহেবের বাড়িতে উৎসব উৎসব রব চলছে। মিহার বিদায়ের সময় খুব বেশি দূরে নেই। এই সপ্তাহেই তারিখ দেওয়ার কথা ছিলো। নিশান্তের মা বলেছেন এসে তারিখ দেবেন মিহাকে অনুষ্ঠান করে তুলে নেওয়ার। কথাটা শোনার পর থেকে মিহা আনমোনা হয়ে উঠেছে। বাবার কথা মনে পড়ে ভীষণ। পুরোনো বাড়িটায় গিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কতদিন বাবার গায়ের ঘ্রান পাওয়া হয় না! তাই মিহা ঠিক করেছে দুয়েকদিনের মধ্যে একবার পুরোনো বাড়িটায় ঘুরে আসবে
ওর মন খারাপ দেখে বাড়ির প্রতিটা মানুষেরও মন ভারাক্রান্ত। সকলের এমন খাপছাড়া অবস্থায় আনোয়ার সাহেব আর কয়েকটা দিন সময় চেয়েছেন নাজমুল হকের কাছে। তারাও বুঝতে পারছে আনোয়ার সাহেবের বাড়ির অবস্থা। তাই বলেছে যা হবে সব ধীরে সুস্থে হবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

মিহা চলে গেলে ওর মা হয়ে উঠবে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। এখানে সবার সাথে হাসিখুশি থাকলেও সুমা বেগমের এক বুক হাহাকার রয়ে যাবে। স্বামীকে হারানোর পর মেয়েকে আকড়ে ধরেই বেঁচে আছেন তিনি। সেই মেয়ে দূরে যাওয়ার পর সুমা বেগমের প্রতি রাতের সঙ্গী হবে নিঃসঙ্গতা। এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন রোগ হলো এটি।নিঃসঙ্গতা একজন মানুষকে অল্প অল্প করে শেষ করে দেয়। দিনশেষে যখন পাশে কেউ থাকে না তখন জগতের সকল দুঃখেরা যেন আলিঙ্গন করে।

মিহা মায়ের শোক থেকেই মূলত অসুস্থ হয়ে পড়ছে বারবার। ঠিকমতো খাবারও খেতে পারে না। জ্বরের পর থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে নিশান্তের সাথে দেখা হয়েছিলো মাত্র একবার। এরপর রাগ করে আসেনি সে। মিহার অসুস্থতা নিয়ে নিশান্ত রেগে আছে। অনিয়ম করে শরীরের যত্ন নিচ্ছে না মেয়েটা। তাই নিশান্ত কড়াকড়ি ভাবে বলে দিয়েছে, নিজের যত্ন না নিলে, একদম সুস্থ না হয়ে উঠলে সে আর আসবে না। এতে অভিমানী মিহার মন খারাপ আরো একদফা বৃদ্ধি পেয়েছে।

শোভা অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে। ওর উচ্ছলতায় ভাটা পড়েছে। সেই কারণটাও মিহা। আজ হোক বা কাল, মিহাকে শ্বশুর বাড়ি যেতেই হবে। আজকাল বাহিরে ঘোরাঘুরি কম করছে শোভা৷ ঘুরে বেড়ানোর সেই সময়টুকু দুইবোন এখন একসাথে কাটাচ্ছে। একে অপরের চুল বেধে দেওয়া, ছাদে বসে কফি খাওয়া, পছন্দের মুভি দেখা কিংবা ছোটবেলার কোনো ক্রাসকে নিয়ে আলোচনা, শোভা সবদিক থেকেই মিহার সাথে কাটানো সময়টুকু আনন্দময় করে তুলছে। শোভ বুঝেছে মিহা চলে গেলে পরিবারে ওর ফাকা স্থানটুকু ওকেই ভুলিয়ে রাখতে হবে।

টফি ইদানীং ছাড়া পেলেই শোভার বাড়ির আশেপাশে এসে ঘোরে। মিহার আদর খায়। কিন্তু শোভার থেকে পাত্তা পায় না। শোভা টফিকে দেখলেই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় আগে, যেন এই বজ্জাত ওর রুমে না ঢুকতে পারে।
টফি শোভাকে দেখলেই নিজের পা বাড়িয়ে দেয়। কেন দেয় সেটা শোভা জানে। টফি নেইলপলিশ পছন্দ করে।
সেইদিন ওর নখে গোলাপি রঙের নেইলপলিশ লাগানোর পর থেকেই টফি শোভাকে দেখলে পা বাড়িয়ে দেয় যেন শোভা আবার রঙ মাখিয়ে দেয়। এরপর পুরোটা সময় টফি পায়ের রঙিন নখের দিকেই তাকিয়ে থাকে, নখ চাটে, যতক্ষন না রিয়াদ ওর নেইলপলিশ তুলে দিচ্ছে।

শোভার নেইলপলিশের অত্যাচারে রিয়াদের ঘরে এখন নেইলপলিশ রিমুভার রাখতে হচ্ছে। শোভাকে না করেও কাজ হচ্ছে না। বরং মানা করলে মেয়েটা আরো বেশি বেশি সেই কাজ করে। অবশ্য টফি এবং শোভা নেইলপলিশ দেওয়া বাদে এখনো সেই শত্রুর মতো একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকে। টফি সুযোগ পেলেই শোভার কোনো একটা জিনিস নষ্ট করে ছুটে পালায়।
___

শোভা ভার্সিটি শেষে যখন বাড়ি ফিরছিলো আজ কাকতালীয় ভাবে অভির সাথে দেখা হয়ে গেলো। অভি সেই পথে বাইক নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলো। শোভাকে দেখে ব্রেক করলো।
হুট করে একটা বাইক নিজের সামনে এসে থামতে দেখে অবাক হলো শোভা। হেলমেট খুলে যখন অভি ওর দিকে ফিরলো শোভার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। অভি বললো,

“কেমন আছো শোভা?”

“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি ভাইয়া। আপনি এই পথে?”

“হ্যা কাজে যাচ্ছিলাম। তোমাকে দেখে থামলাম। বাড়ি যাচ্ছো?”

শোভা মাথা নাড়াতেই অভি আবার বললো,
“চলো তাহলে পৌঁছে দেই। আমি এই পথ ধরেই যাচ্ছি।”

শোভা ইতস্ততবোধ করে বললো,
“সমস্যা নেই ভাইয়া। আমি যেতে পারবো, সামনেই তো। আপনার দেরি হয়ে যাবে।”

“কিচ্ছু দেরি হবে না। আমাকে দেখে ইতস্তত করার কিছু নেই। তুমি আমার অনেক ছোট, বোনের মতো। বেয়াইন তো পরের কথা। আমার তো একটা দায়িত্ব আছে নাকি! চলে আসো নামিয়ে দেই।”

শোভার ইচ্ছে করছিলো না যেতে। কিন্তু অভি বোনের মতো শব্দটা উচ্চারণের পর একটা ভালোলাগা কাজ করলো ওর মনে। নিশান্তের বন্ধুরা যতটা না দুষ্টু ততটা দায়িত্বশীলও বটে। শোভা অভির বাইকে উঠতে সম্মতি দিলো। এককদম এগোতেই হঠাৎ রিয়াদ সামনে রিক্সা নিয়ে এসে হাজির হলো। হুট করে রিয়াদের আগমনে ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো শোভা। বিরক্তি নিয়ে বললো,

“কি ব্যাপার! আপনি এখানে?”

“কেনো আসতে পারি না?”

“পারবেন না কেনো! অবশ্যই আসবেন। এসে বসে থাকবেন। চাইলে শুয়েও থাকতে পারেন। সামনে থেকে সরুন আমি যাবো।”

রিয়াদ চোখমুখ শক্ত করে বললো,
“যাবে, তবে আমার সাথে।”

শোভা অবাক হয়ে একবার অভির দিকে তাকালো।অভি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। শোভা আবার বললো,
“আপনার সাথে যাবো মানে! আপনার সাথে কেনো যাবো?”

“আমার নতুন জব হয়েছে। তাই মায়ের জন্য শাড়ি কিনবো। আমি শাড়ি সম্বন্ধে ভালো বুঝি না। তাই তুমি আমায় সাহায্য করবে। চলো।”

রিয়াদের ক্রোধে ঢাকা চেহারায় তাকিয়ে কেনো যেন শোভার বিশ্বাস হলো না কথাটা। বললো,
“আমি আপনার সাথে কোথাও যেতে পারবো না। আপনি অন্য কাউকে খুজে নিন। আমি এখন অভি ভাইয়ার সাথে বাড়ি যাবো। দেরি হয়ে যাচ্ছে ওনার সরুন।”

“আমারো দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমার অভি ভাইয়ার দেরি হলে তাকে চলে যেতে বলো। তোমার তো নিশ্চয়ই কোন কাজ নেই বাড়িতে। তাই আমার সাথে যাবে তুমি।”

রিয়াদের কথায় শোভা বাক রুদ্ধ হয়ে গেলো। ওর কন্ঠে স্পষ্ট অধিকার বোধ। রিয়াদের এই কন্ঠস্বর শোভা শুনেছিলো সেই বৃষ্টির দিনে। যখন রিয়াদ ওকে রিক্সায় ওঠার জন্য বলেছিলো। এই স্বরের সামনে কেনো জানি শোভা উচ্চবাচ্য করার সাহস পায় না। যদিও মুখে কপট রাগী ভাব বজায় রাখে।
শোভার কোনো হেলদোল না দেখে রিয়াদ নিজেই এগিয়ে এসে শোভার হাতের কব্জি নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরলো। এতে যেন শোভা আকাশ থেকে পড়লো। হচ্ছে টা কি আজ! এই ছেলের মাথা ঠিক আছে তো! অভি ভাইয়ার সামনে কিনা হাত ধরলো! শোভা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। রিয়াদ সেসব উপেক্ষা করে অভির দিকে তাকিয়ে বললো,

“প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, আপনি চলে যান। ও আমার সাথে শপিংয়ে যাবে। দরকার ছিলো একটু।”

অভি এতোক্ষন দুজনকেই পরখ করছিলো। রিয়াদের কথায় ওদের হাতের বন্ধন থেকে চোখ সরিয়ে মৃদু হেসে বললো,
“সমস্যা নেই আপনারা আসুন। আমি তাহলে যাচ্ছি।” তারপর শোভার দিকে তাকিয়ে বললো,
“শোভা, তোমার সাথে নাহয় পরে আবার দেখা হবে। ভালো থেকো।”

অভির সামনে এভাবে হাত ধরায় শোভার ভীষণ লজ্জা লাগছে। অভির কথার জবাব পর্যন্ত দিতে পারলো না। কোনোমতে মাথা কাত করলো। মুচকি হেসে সে বাইক নিয়ে চলে গেলো। অভি চলে যেতেই রিয়াদ শোভার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,

“রিক্সায় ওঠো।”

শোভা রিক্সায় উঠে বললো,
“আপনি অভি ভাইয়ার সামনে আমার হাত ধরলেন কেনো?”

“হাতে ফোসকা পড়েছে নাকি আমি ধরায়!”

“সোজা প্রশ্নের বাকা উত্তর দিচ্ছেন কেনো? সোজা উত্তর দিন।”

রিয়াদ আগের সেই অ্যাটিটিউডে ফেরত এসে বললো,
“কথা শুনছিলে না বলেই ধরেছি। নেহাৎ মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনবো বলে। নাহয় তোমাকে সাথে আনার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলো না।”

শোভা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো কথাটা শুনে। ইচ্ছে ছিলো না মানে? অথচ রিয়াদের অমন অধিকার বোধে শোভা কিছুক্ষণ হলেও অন্য কিছু ভাবতে যাচ্ছিলো। আর ওকেই কিনা এতো বড় অপমান! চড়া গলায় বললো,
“আপনি সেধে ডেকে এনে রিক্সায় বসিয়ে বলছেন আপনার ইচ্ছে ছিলো না! যাবো না আপনার সাথে। অন্যকাউকে খুজে নিন। এই মামা রিক্সা থামান।”

“রিক্সা থামবে না। আর তুমিও নামবে না। চুপচাপ বসে থাকো। নাহলে বাড়ি গিয়ে মায়ের শাড়ি পছন্দ না হলে বলবো তোমার হ্যাল্প চেয়েও পাইনি। আর বাগানের ফুল কেলেঙ্কারির কথাতো আছেই।”

শোভা হাত জোর করার ভঙ্গিতে হিসহিসিয়ে বললো,
“আপনার বাগানমুখো আমি আর হবো না। আর না আজকের পর আপনার কোনো কথা শুনবো। শুধু আন্টির শাড়ি পছন্দটুকুই।”

“আপাতত ওটুকুই চলবে।”

_________

বিকেলের সিদুর রাঙা মেঘ জানান দিচ্ছে সূর্যের বিদায় নেওয়ার সময় হয়ে আসছে। পাখিদের কিচিরমিচির, রিক্সার টুংটাং কিংবা বাচ্চাদের খেলাধুলা কোনোটাতেই মনোযোগী হতে পারছে না মিহা। ওর উদাসী মন আকাশের দক্ষিণের কোণে একলা ভেসে বেড়ানো কালো মেঘের দিকে। প্রিয় মানুষটার রাগ ওকে ওই এক টুকরো কালো মেঘের মতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। শুভ্র অথবা সিদুর রাঙা মেঘের ছোয়া মনকে স্পর্শ করতে পারছে না। কি বিষাদময় এক বিকেল। সুন্দর আবহাওয়াও অনেক সময় মন খারাপের জন্য বিষাদময় লাগে। একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের মন, আবেগ, অনুভূতিকে এতোটা প্রভাবিত করতে পারে তা নিশান্ত ওর জীবনে না আসলে অজানাই থাকতো।

মিহা কিভাবে নিশান্তের রাগ ভাঙাবে বুঝতে পারছে না। এক সপ্তাহ হলো সে আসে না। ফোন দিলে দরকারি কথার বাইরে একটা শব্দও বলতে চায় না। এদিকে নিশান্তকে দেখার জন্য, তারসাথে অফুরন্ত কথা বলার জন্য মিহার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সবে বিকেল পাঁচটা বাজে। নিশান্তের অফিস থেকে বের হতে ছয়টা বেজে যায়। নিজেকে গুছিয়ে কল দিলো মিহা। আজ নিশান্তকে আসতে বলবে। এলে যেভাবেই হোক রাগ ভাঙাবেই সে। দুইবার বাজতেই ফোন রিসিভ হলো।

“আসসালামু আলাইকুম।”

নিশান্ত ক্লান্ত কন্ঠে সালামের উত্তর দিয়ে বললো,
“বলো কি বলবে?”

মিহার রাগ হলো। বলবে বলেই না কল দিয়েছে। ভালোমন্দ জিজ্ঞেসও করলো না। এতো রাগ কোথা থেকে আসে! অবশ্য নিশান্ত প্রতিদিনই শোভাকে কল দিয়ে ওর আদ্যোপান্ত জেনে নেয় সেটা মিহা জানে। বললো,
“না মানে মা বলছিলো আপনি আজ আসবেন কিনা, তাহলে আপনার জন্য রান্না করবেন। তাই জানতে কল দিলাম।”

“শুধু আম্মা জানতে চেয়েছে?”

“হু।”

“আচ্ছা, আমি আম্মার সাথে কথা বলে নেবো। আর কিছু?”

“না মানে আমিও জানতে চাইছিলাম আরকি।”

“তুমি জেনে কি করবে? আমার দেওয়া শর্ত কি তুমি মানছো? নিজের যত্ন নিচ্ছো? আমি খবর নিয়ে জেনেছি তুমি আবারো বৃষ্টিতে ভিজেছো।”

মিহা অভিমানী কন্ঠে বললো,
“সেই বৃষ্টিতে শোভাও ভিজেছে আমার সাথে। জ্বরও হয়নি। তাছাড়া আমার মন খারাপ হলে ভিজতে ইচ্ছে করে। কেউ তো আর মন ভালো করতে আসে না।”

নিশান্ত কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
“যদি আসি তাহলে আম্মার হাতের রান্না খেতে আসবো। কেউ যেন মনে না করে আমি তার জন্য আসছি। রাখছি।”

ফোন কেটে গেলো। মিহা মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“আসুন একবার। আমিও দেখবো কিভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকেন আপনি।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে