শুভ্র বর্ষণ পর্ব-০৬

0
1505

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৬

শোভা মিটিমিটি হাসছে এবং গুনগুন করে গান গেয়ে মিহার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। মিহা তীক্ষ্ণ চোখে ওকে পরখ করছে। সব এই মেয়েটার জন্য। নাহলে সকাল সকাল এমন লজ্জায় পড়তে হয়!
মিহার কাছে শোভার রাতের বেলা ঘুমাতে যাওয়া, মাঝ রাতে তার যায়গায় নিশান্তকে পাওয়া সব যে পূর্বপরিকল্পিত সেটা বুঝতে আর বাকি নেই। বাড়ির লোক যখন সকালবেলা বুঝলো নিশান্ত রাতে এসেছে তখন কি লজ্জাটাই না করছিলো মিহার। ইচ্ছে করছিলো মাটি ফাক করে ঢুকে যেতে। তার মধ্যে আবার শোভার গা জ্বালানো হাসি। সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা মিহার।
আনোয়ার সাহেবের গলা পাওয়া যাচ্ছে দরজার বাহিরে।

“মিহা মনি? শোভা মামনি কই তোমরা?”

মামার গলা পেয়ে মিহা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। পেছন পেছন এলো শোভা। আনোয়ার সাহেব ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আজ বেশ বড় সাইজের একটা ইলিশ মাছ পাওয়া গেছে। ইলিশ মিহা এবং শোভা দুজনেরই প্রিয় মাছ। তাই মাঝে মাঝেই বেশি টাকা খরচ করে সবথেকে বড় ইলিশ আনোয়ার সাহেবের আনা চাই ই চাই। মিহা এবং শোভা উভয়েই মাছ দেখে খুশি হয়ে গেলো। দুপুরের খাবারটা মন্দ হবে না। হালিমা মাছ নিয়ে যখন রান্নাঘরে ঢুকবে এমন সময় নিশান্ত রুম থেকে বের হলো। হালিমার হাতের ইলিশ দেখে সবাইকে ঘোষণা দিলো মাছটা সে রান্না করবে। নিশান্তের কথা শুনে সকলে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলো। বাড়ির নতুন জামাই রান্না করবে?

সুমা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
“এসব কি বলছো বাবা? আমরা থাকতে তুমি কেনো রান্না করবে? তুমি ব্যস্ত মানুষ, ছুটির দিনটা একটু আরাম করো।”

নিশান্ত কোনো কথাই শুনলো না। বরং রান্না করাটা ওর একটা ভালোলাগা। সবার অনেক জোড়াজোড়িতে সে শুধু ইলিশ মাছটাই রাধবে বলে জানালো। বাকি রান্না অন্যেরা করবে। সুমা বেগম নিশান্তের মাকে ফোন দিলো। জানালো তার ছেলের পাগলামির কথা। রাহেলা বেগম সব শুনে হেসে বললো,

“নিশান্ত এমনই। যখন ওর হাতে সময় থাকে এবং মন মেজাজ ফুরফুরে থাকে তখন ওকে রান্না ঘরেই পাওয়া যায়। আমার বড় ছেলে যখন প্রথম প্রথম ডিফেন্সে যায় তার কিছুদিন পরই অসুস্থ হয়ে পড়ি। জানতে পারি পেটে টিউমার। সেটা অপারেশন করার পরেও অনেকদিন অসুস্থ ছিলাম। হাত পুড়িয়ে দুই বাবা ছেলে তখন রান্না করতো। কাজের লোকের রান্না নাকি ভালো লাগে না। সেই থেকে নিশান্ত রান্না করতে ভালোবাসে। এখনো মাঝে মাঝে আমাকে আর ওর ভাবীকে রান্না ঘর থেকে ছুটি দিয়ে নিজে বসে যায়।”

সুমা বেগমের আনন্দে বুকটা ভরে ওঠে। ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ হয় এতো ভালো একটা ছেলে এবং পরিবারের কাছে মেয়েকে সমর্পণ করার জন্য।

মিহা রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। লজ্জাও করছে ভীষণ। সে এখনো পর্যন্ত নিশান্তকে কিছুই রেধে খাওয়াতে পারেনি। অথচ নিশান্ত রান্নায় লেগে পড়েছে। হালিমা মাছ কাটা এবং ধোয়ার কাজ করে দিয়েছে। বাড়ির জামাই রান্না করবে। এই দৃশ্য সে আজ প্রথম দেখবে। টিভিতে ছাড়া আর কোথাও দেখেনি এমন দৃশ্য। হালিমা নিশান্তকে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনে কি কোনোকালে বাবুর্চি আছিলেননি দুলাভাই?”

নিশান্ত হেসে বললো,
“আমি এখনো বাবুর্চি। বলতে গেলে বিল্ডিংয়ের বাবুর্চি।”

হালিমা বুঝতে না পেরে বললো,
“হেইডা আবার কিরকম বাবুর্চি?”

“উমম.. ওটাও হচ্ছে এক ধরনের রান্না। তার জন্য বিভিন্ন উপাদান দরকার পড়ে, মশলা লাগে, রান্নার সরঞ্জাম লাগে। শুধু সেখানে আগুন লাগে না। আর সেই রান্না খাওয়া যায় না। এটাকে বলে ইঞ্জিনিয়ারিং বাবুর্চিয়ানা। বুঝলে?”

হালিমা প্রকৃতপক্ষে কিছুই বুঝলো না। কিন্তু নতুন দুলাভাইয়ের কাছে সেটা প্রকাশ করলো না। ভেবে নিলো হয়তো কোনো উচ্চ শিক্ষিত কথাবার্তা বলেছে সে। তাই বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে প্রস্থান করলো।

রান্নার কাজে হাত দিয়েছে নিশান্ত। মিহা একবার উঁকি দিলো। নিশান্ত মশলা কষাচ্ছে। মিহা দৌড়ে রুমে চলে গেলো। আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো ঠিক লাগছে কিনা। মুখে তেলতেলে ভাব। ওয়াশরুমে গিয়ে পানির ঝাপটা দিলো কয়েকবার। মুখ মুছে একটু পাউডার ছোয়ালো। চুলগুলো একটু এলোমেলো হয়ে আছে। সেগুলোতে চিরুনি চালিয়ে ঘোমটা দিলো অল্প করে।
আজকাল বড্ড সাজতে ভালো লাগে মিহার। স্বামীর সামনে নিজেকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে কার না ভালো লাগে। মিহা পুনরায় রান্নাঘরে এলো। নিশান্ত ঘেমে উঠেছে কিছুটা। কপালে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাকালো। মিহা দাঁড়িয়ে।

“আমি কি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি?”

“করবেন?”

নিশান্তের প্রশ্নে মিহা মাথা নাড়ালো। নিশান্ত হালকা ঝুকে এসে বললো,
“নিজের আঁচল টা দিয়ে যদি এই অধমের ঘর্মাক্ত কপাল টুকু মুছে দিতেন তাহলে বোধকরি প্রফুল্লচিত্তে রান্নাটা আরো মনের মাধুরী মিশিয়ে রাধতে পারবো।”

মিহা আরক্তনয়নে দরজার দিকে তাকায়। নাহ, কেউ দেখেনি। লোকটা কেনো যে এমন কথা বলে? তাও আবার রান্নাঘরে। জেনেশুনেই ওকে লজ্জায় ফেলতে চায় শুধু। মিহাকে চুপ থাকতে দেখে নিশান্ত আবার বললো,

“দেবে না? নাকি এখনো অভিমানের পর্ব চলছে?”

মিহার বলতে ইচ্ছে করলো, ‘এই উৎফুল্ল মানুষটার প্রতি অভিমান পুষে রাখা যায় বুঝি?’
কিন্তু মুখে সেই কথা বললো না। বললো,

“আর কোনো সাহায্য লাগবে না?”

“লাগবে না। আমার শ্বাশুড়িমায়েরা আগে থেকেই সব যোগাড় করে হাতের কাছে রেখে দিয়েছে।”

নিশান্ত পুনরায় কড়াইতে খুন্তি চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মিহার মনে হলো লোকটা বুঝি মন খারাপ করেছে। আরেকবার দরজার দিকে চোখ বুলিয়ে নিশান্তকে কনুই ধরে নিজের দিকে ফেরালো। দ্রুত হাতে আঁচলের শেষ অংশটুকু আলতো করে চালালো নিশান্তের কপালে ও গলায়। তারপর চঞ্চল পায়ে রান্নাঘর ত্যাগ করলো। আজ লজ্জায় জ্ঞান হারাবে ও। নিশান্ত তার চঞ্চল হরিণীর ছুটে যাওয়া দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো।

শোভা নাক টেনে শ্বাস নেয়। রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“আহ! ভাইয়া আমারতো এখনি খিদে পেয়ে যাচ্ছে। এতো সুন্দর স্মেল আহা!”

“শালি সাহেবা ঘ্রানেই কাবু হলে চলে? স্বাদ নেওয়া তো এখনো বাকি।”

“আমার দুলাভাই রাধছে বলে কথা। বেস্ট হবেই হবে।”

মাছ রান্না শেষ করে হাত না ধুয়েই নিশান্ত রুমে এলো। বাকি রান্নাগুলো শ্বাশুড়ি মায়েরা করবে। ওর হাতে তেল মশলা লেগে আছে। সেই হাত মিহার গালে ছুইয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মিহার জামাতে সব তেল মশলা মুছলো।
মিহা ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
“এটা কি হলো?”

নিশান্ত হেসে বললো,
“তোমার গায়েও মশলা মাখিয়ে দিলাম। চলো এবার দুজনে একসাথে গোসল করে ফেলি।”

মিহা দুই হাতে মুখ ঢেকে বললো,
“আপনি একটা নির্লজ্জ।”

নিশান্ত মিহার কানে ফিসফিস করে বললো,
“প্রতিটি স্বামীর ভেতরই একজন নির্লজ্জ পুরুষ লুকায়িত। যে নিজের প্রিয়তমার নিকট তীব্রভাবে প্রকাশিত।”

__________

দুপুরে খাওয়ার সময় ঝামেলায় পড়লো মিহা। তার প্রিয় মাছ ইলিশ হলেও সেটা খেতে ঝামেলা পোহাতে হয় খুব। একটা একটা করে কাটা বেছে তারপর মুখে দেয়। বাবা বেঁচে থাকতে মিহাকে কাটা বেছে দেওয়ার দায়িত্বটা তারই ছিলো। মারা যাওয়ার পর যখন মামাবাড়ি চলে এলো তখন সেকি ঝামেলা। মামা জানতেন মিহা ইলিশ পছন্দ করে। কিন্তু কাটা বেছে খেতে পারেনা সেটা জানতেন না।

একদিন দুপুরে ইলিশের তিনটা আইটেম রান্না করা হলো। মিহা শুধু একটা পিস মাছই নিলো। মাকে আস্তে করে বলেছিলো কাটা বেছে দিতে। তিনি ব্যস্ত থাকায় পারেননি। বলেছিলেন এবার নিজে নিজে শেখা উচিৎ। মিহা মামার সাথে খেতে বসলেও সবার খাওয়া শেষেও ওর খাওয়া হলো না। মাছের মধ্যে চিরুনি তল্লাশি করে একটা একটা করে কাটা বেছে খাওয়া খুবই কষ্টকর। শোভা ওর খাওয়া দেখে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। আনোয়ার সাহেবের কাপড়ের পাইকারি দোকান। সেইদিন ছিলো খুব ব্যস্ততা। তাই খেয়েই কোনোমতে বেড়িয়ে গেলেন।

খাবারের শেষের দিকে মিহার গলায় কাটা আটকে গেলো। একটা নয়। দু’দুটো কাটা। মা শুকনো ভাত খাওয়ালেন, পাউরুটি খাওয়ালেন কাজ হলো না। মামি কলা এনে দিলেন তাতেও কোনো কাজ হলো না। কাটা বেশ অনেকটাই গেথে ছিলো। হালিমা বললো,

“বিলাইর পাও ধরেন আফামনি। বিলাই হইলো মাছ খাওনে এসপাট(এক্সপার্ট)। কাটাকুটা শুদ্ধা খায়। হের পাও ধরলে কাটা নাইমা যায়।”

শিরীন বেগম ধমকে বললো,
“বোকার মতো কথা বলিসনাতো হালিমা। বিড়াল গলার কাটা বের করবে কিভাবে?”

হালিমা নাকমুখ কুচকে বলে,
“আমগো গেরামে কারো গলায় কাটা আটকাইলে বিলাইর পাও ধরে। তাইলে কাটা চইলা যায়। আপনেরা বিশ্বাস করেন না দেইখা কাম হয় না।”

শোভা প্রথমে হালিমার কথা শুনে হাসলেও পড়ে গিয়ে রাস্তা থেকে একটা বিড়াল ধরে আনে। পরিক্ষা করতে যে সত্যিই এমন কিছু হয় কিনা। শিরীন বেগম মেয়ের বাদরামো দেখে তেড়ে হেলেন মারতে।
আনোয়ার সাহেব হিসেবের খাতাটা বাড়িতেই ফেলে গেছিলেন। অগত্যা আবার ফিরে এসে দেখলেন মিহাকে ঘিরে সবাই নিজেদের এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে। পুরো ঘটনা বুঝে দিলেন এক রাম ধমক। তারপর মিহাকে নিয়ে ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। এরপর থেকে মিহার ইলিশ মাছ বেছে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন আনোয়ার সাহেব নিজেই।

শোভার মুখে মিহার মাছ খাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনার গল্প শুনে নিশান্ত হেসে টেবিলে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শোভাও তাতে তাল মেলাচ্ছে। মিহার অপমানে গাল ফুলে উঠলো। ওর ওই সামান্য দুর্বলতা নিয়ে এভাবে মজা করার কি আছে? আজ মাছ খেয়ে দেখিয়ে দেবে সেও পাড়ে।

টেবিলে একপাশে বসেছে আনোয়ার সাহেব এবং শোভা। অপরপাশে নিশান্ত এবং মিহা। শিরীন বেগম এবং সুমা বেগম বসতে রাজি হলো না। হাজার হোক জামাইতো। তাকে কে আগে মন দিয়ে আপ্যায়ন করতে হবে।
মিহা প্লেটে মাছ তুলে নিতে গেলে নিশান্ত বাধা দিলো। নিজের পাতে মাছ নিয়ে যত্ন করে সেটার কাটা বেছে তারপর মিহার পাতে দিতে লাগলো। সেই একই কাজ এখন আনোয়ার সাহেব করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই নিশান্ত করে ফেললো। আনোয়াত সাহেবের বুকে শীতলতায় ছেয়ে গেলো। ঠিক মানুষটার কাছেই মেয়েটাকে দিতে পেরেছে। কিন্তু তবুও একটা হাহাকার ধরা দেয় মনে। এই মাছ বেছে দেওয়া থেকে তিনি অব্যাহতি পেতে চলেছেন। তার মিহা মনিটা বুঝি পর হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

নিশান্তের রান্না নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ফাইজা ভাবী ঠিকই বলেছিলো। ওনার রান্নাকে টপকানো সহজ নয়। মিহা রান্না করে তার মন পেলে হয়।
মিহার বেশ লজ্জাও লাগলো নিশান্তের মাছ বেছে দেওয়া নিয়ে৷ চোখ তুলে কারো দিকে তাকাতে পারলো না পুরোটা সময়। কিন্তু ভালোলাগা ছুয়ে রইলো পুরোটা সময়। প্রতিটা মেয়েই নিজের স্বামীর মধ্যে বাবার ছায়া খোজে। মিহা নিজেও খোজে। এবং সে প্রত্যাশার থেকে বেশিই পেয়েছে যেন। ওকে মাথা নিচু করে খেতে দেখে নিশান্ত মৃদু স্বরে বললো,

“অর্ধাঙ্গিনীর অপারগতা পুরন করলেই না আমি তার পরিপূরক হবো।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে