#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৯
ল্যাম্পপোষ্টের হলদে আলোয় একদল পোকা ঝাক বেঁধে উড়ছে। তার ঠিক নিচেই দুটো কুকুর বসে একে অপরের দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনুভুতির আদান প্রদান করছে। আশেপাশে কি হচ্ছে সেটা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই তাদের। নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত তারা। ঐ দূর নীল আকাশের বুকে মস্ত চাঁদটা ঝলমল করে উঠছে। সেই শুভ্র আলোয় ধরণীর রুপ যেন চকচক করছে। আজ পূর্ণিমা। ভরা জোছনায় প্রেম নিবেদনের রাত। গরমটাও ছাপিয়ে প্রকৃতি যেন শীতল হতে চাইছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। সেই হাওয়া ভেসে এসে গায়ে শীতল অনুভুতির উদ্রেক ঘটাচ্ছে। আবহাওয়াটা বেশ লাগছে। এই আবহাওয়া প্রিয় মানুষটার অনুপস্থিতি বিশেষ ভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে ইভানকে। রিক্সায় বসেই একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়ল সে। জ্যামে আটকে আছে। আশেপাশে রিক্সার বহর। বড় বড় গাড়ির ভেতরে থাকা লোকগুলো অনবরত হর্ন বাজিয়েই যাচ্ছে। বেশ বিরক্ত লাগছে তার। এর মাঝেই পকেটে ফোনটা কেঁপে উঠলো। বের করে দেখল ইশান ফোন করেছে। কানে লাগিয়ে বলল
–ইশান কাছাকাছি চলে এসেছি।
–আর কতক্ষন ভাইয়া?
অধৈর্য কণ্ঠে বলল ইশান। ইভান তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–জ্যামে। ছাড়লেই পৌঁছে যাবো।
ইশান বলল
–তাড়াতাড়ি আসো। তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
ইভান ফোন রেখে সামনের দিকে তাকাল। যতদূর চোখ পড়ছে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। কখন যে জ্যাম ছাড়বে। আজ সবাই এসেছে বাসায়। তাই ইভানের অফিস থেকে তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটা জরুরী মিটিং এ দেরি হয়ে গেলো। সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। রিক্সা চলতে শুরু করেছে তার গন্তব্যে। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলো সে। রিক্সা থেকে নেমে বাড়ির মেইন গেটের ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো দোতলায়। কলিং বেল বাজানোর জন্য সুইচ বোর্ডে হাত দিতেই কারেন্ট চলে গেলো। অন্ধকার হয়ে গেলো চারদিক। নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় ভেতর থেকে সোরগোল কানে আসছে। তাদের বাড়িতেই বসেছে আড্ডার পসরা। ইভান বিরক্তিকর একটা শ্বাস ছাড়ল। দরজায় জোরে জোরে শব্দ করলো। কেউ একজন এগিয়ে আসলো দরজা খুলতে। ইভান জুতা খুলে এক পাশে রেখে দিলো। ইরিনা দরজা খুলেই এক গাল হেসে বলল
–ভাইয়া কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। এতো দেরি করলে যে?
ইভান মুচকি হেসে বলল
–সরি রে। একটু কাজ ছিল। তাই দেরি হয়ে গেলো।
ইরিনা দরজা থেকে সরে দাড়িয়ে বলল
–যাক এসে পড়েছ অবশেষে।
ইভান হেসে ভেতরে ঢুকল। সায়ান হেসে বলল
–আরে ইভান তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
ইভান হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে হেসে এক ধাপ এগুতেই ঈশা মোমবাতি হাতে সামনে এসে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলো ইভান। হার্ট বিট মিস করে ফেললো বোধহয় কয়েকটা। পলকহীন চোখে চেয়ে রইল। নীল জামদানি সাথে সাদা ব্লাউজ। কাজলে আকা চোখ দুটো মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঘন পাপড়ি ঝাপটে ঈশা পলক ফেললো কয়েকবার। ছেয়ে গেলো মায়া সর্বত্র। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য! কপালের নীল টিপ আর ঠোঁটের হালকা গোলাপি আভা ইভানের চোখের ভেতর দিয়ে সোজা বুকে এসে বিধল। তীব্র আঘাতে বেসামাল হয়ে উঠলো সে। মৃদু বাতাসে খোলা চূলগুলো উড়ছে। মোমবাতির হলদেটে আলোয় ঈশার মুখটা অবুঝ চঞ্চল কিশোরীর মতো লাগছে। যার রুপের তেজে হাজারও প্রেমিকের মৃত্যু অনিবার্য। এ যেন সদ্য এক মায়াপুরি থেকে মায়াবতী নেমে এসেছে ধরনির বুকে। যার রুপের আঘাতে এই প্রেমিক হাজার বার নিহত হতে রাজি আছে। আশেপাশে থেকে কেউ কিছু একটা বলল যা ইভানের কান ভেদ করে ঘোর কাটাতে অক্ষম। তাদের কথার রেশে ঈশার হালকা গোলাপি ঠোট দুটো কেঁপে উঠলো। লাজুক ভাবে হাসল সে। ইভানের তৃষ্ণা যেন আরও বেড়ে গেলো। এলোমেলো হয়ে গেলো ভেতরটা। ইরিনা ইভানের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল
–এটা তোমার বউ ভাইয়া।
সম্ভিত ফিরে পেলো ইভান। কয়েকবার অস্থির পলক ফেললো। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে ইরিনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
–ধন্যবাদ পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। নাহলে আমি তো চিনতেই পারতাম না।
ইরিনা বোকা চোখে তাকাল। সবাই হেসে ফেললো তার কথা শুনে। ইভান আরও একবার ঈশাকে ভালো করে দেখে নিয়ে এগিয়ে গেলো। বেসিনের সামনে দাড়িয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিতেই ইফতি বলল
–তোমাদেরকে আমি আমার স্পেশাল মসলা চা খাওয়াবো। কিন্তু আমাকে একটু হেল্প করতে হবে। ভাবী আপু তুমি আমাকে হেল্প করবে?
ঈশা হেসে মাথা নাড়ল। ইভান আয়নার ভেতরে ঈশার সেই মুগ্ধ হাসি দেখছে। ঈশা সেদিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো। ইভানের চোখে মুগ্ধতা। ঈশা ঠোট এলিয়ে হাসল। ইভান মুচকি হেসে নিজের এলোমেলো চুল আঙ্গুল দিয়ে গুছিয়ে নিলো। ঈশা ইফতিকে বলল
–আয়।
ইফতি ঈশার পেছনে পেছনে রান্না ঘরে চলে গেলো। ঈশা চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে ইফতিকে বলল
–আর কি কি লাগবে?
ইফতি বেশ অভিজ্ঞের ভঙ্গিতে একটা বয়াম নিয়ে ঢাকনা খুলে সেটার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাল। এক চামুচ তুলে নিয়ে বলল
–চিনি দিতে হবে।
ঈশা হাত ধরে ফেললো। বড় চোখে তাকিয়ে বলল
–ওটা লবন গাধা।
ইফতি মাথা বাড়িয়ে তাকাল। একটু মুখে দিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল
–ওহ! চিনির জমজ ভাই তাই তো বুঝতে পারিনি।
–তোর মতো গাধার বোঝার কথাও না।
ইভানের গম্ভীর আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকাল দুজনেই। ইভান ইফতির পেছনে এসে দাঁড়ালো। বলল
–কি কি লাগবে সেটা বলে দে ঈশাকে। তুই বানাতে যাস না। সেটা আর খাওয়ার যোগ্য থাকবে না।
ইফতি ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
–কোনভাবে তুমি কি আমাকে অপমান করলে? করতেই পারো আই ডোন্ট মাইন্ড। ভাবী আপু তোমাকে আমি হাত লাগাতে দেবো না। আজ আমি নিজেই রান্না করবো। নাহলে সব ক্রেডিট তুমি নিয়ে নেবে। এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না।
বলেই আবারো একটা বয়াম খুলে সেখান থেকে চামুচে তুলে পানিতে দিতে গেলো। ঈশা আবারো আটকে দিয়ে জোরে হেসে ফেললো। বলল
–ওটা সুজি।
ইফতি ভ্রু কুচকে আবারো তাকাল। বয়ামের ঢাকনা লাগিয়ে দিয়ে বলল
–বুঝেছি। ভাইয়া তুমি ঠিক বলেছ। আমি যাচ্ছি। নাহলে অঘটন ঘটে যাবে। ভাবী আপু তুমিই বানাও তোমার মতো করে।
বলেই ইফতি বাইরে চলে গেলো। ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকাল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। ইভান ঈশার পেছনে গিয়ে দুই পাশে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। চুলে নাক ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে নিলো। ঈশা পেছনে ঘুরতেই ইভানের নাকে নাক স্পর্শ করলো। ইভান কপালে কপাল ঠেকিয়ে দিলো। মাদকময় একটা সুঘ্রান এসে ঠেকল ঈশার নাকে। গভীরভাবে শ্বাস টানতেই ইভান দুই হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে আরও কাছে টেনে নিলো। ঈশা এলোমেলো অনুভুতির ছোবলে জর্জরিত হয়ে লাজুক কণ্ঠে বলল
–বাইরে সবাই আছে।
–তাতে কি?
ইভানের গা ছাড়া উত্তরে ঈশা মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হল না। এক বিন্দুও ইভান কে সরাতে পারল না। উল্টা ইভান হাতের বাধন আরও দৃঢ় করলো। ঈশা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে বলল
–প্লিজ আমাকে ছাড়ো।
ইভান নেশাল কণ্ঠে বলল
–এভাবে সেজে গুঁজে সামনে ঘুরে বেড়ালে কি ছাড়া যায়? এভাবে মানসিক অত্যাচার করার অপরাধে একটা শাস্তি তো পাওয়াই উচিৎ।
ইভানের কথা শেষ হতেই চারিদিকে আলোতে ঝলমল করে উঠলো। বাইরে থেকে ইলুর আওয়াজ এলো।
–ঈশা একবার এদিকে আয় তো।
ইভান ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল
–আর সময় পেলো না। অসহ্য!
ঈশা ঠোট চেপে হাসল। ইভান সরু চোখে তাকাল। দুষ্টু হেসে বলল
–হেসে কোন লাভ নেই। যত সময় পার হবে শাস্তি ততই বেড়ে যাবে। গেট রেডি জান।
————
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নিয়ে সকালের আগমন। জানালার স্বচ্ছ কাচের গা বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা বাড়ি খেয়ে পড়ছে। অদ্ভুত এক তরঙ্গ ধ্বনির সৃষ্টি হয়েছে। মৃদুমন্দ শীতল হাওয়ায় গাছাপালা কুঁকড়ে গেছে। এমন বৃষ্টি স্নাত সকাল ঘুমের জন্য বেশ উত্তম। গায়ের কাঁথাটা আরও ভালো করে টেনে নিয়ে নড়েচড়ে ঘুমিয়ে গেলো ঈশা। ইভান আয়নার ভেতরে সেই দৃশ্য দেখে মুচকি হাসল। অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল সে। ঈশা এখনো ঘুমে বিভোর। মেয়েটার এমন মায়াভরা ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে আর ডেকে দিতে ইচ্ছা করলো না। তাই আর ডাকে নি ইভান। নিজেই উঠে নাস্তা করে রেডি হচ্ছে। ঈশার পাশে গিয়ে বসল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কপালে আলতো করে চুমু দিলো। ঈশা কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। ইভান বলল
–জান আমি অফিসে যাচ্ছি।
ঈশা কি শুনল কে জানে। চোখ বন্ধ করেই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–কেন?
ইভান হেসে ফেললো। সেই হাসির শব্দ শুনে ঈশার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ মেলে তাকাল। সবুজ রঙের শার্টের হাতা ভাঁজ করছে ইভান। উঠে বসতে যেতেই ইভান আবার চেপে ধরে শুয়ে দিয়ে বলল
–উঠতে হবে না। আর একটু ঘুমাও। পরে উঠবে।
ঈশা কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–কোথায় যাচ্ছ?
–অফিসে।
ঈশা পিটপিট করে তাকাল। বলল
–দেরি হয়ে গেছে তাই না?
ইভান মৃদু হাসল। বলল
–হয়নি। এখনো অনেক সময় আছে।
ঈশার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। ইভান বুঝতে পেরেই বলল
–এতদিক সামলাতে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। নিজের খেয়ালটাও তো রাখতে হবে তাই না? রেস্ট নিতে হবে তো।
ঈশা অভিমানী কণ্ঠে বলল
–আমাকে ডাকো নি কেন?
ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–ডাকার প্রয়োজন হয়নি তাই ডাকি নি। নাজমা সব রেডি করেছে। তোমাকে কোন কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না। মাকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। আমিও খেয়েছি। এখন অফিসে যাচ্ছি। তুমি আর একটু রেস্ট নাও। একটু পর উঠে খেয়ে নেবে। ঠিক আছে?
ঈশা হাসল। বলল
–ঠিক আছে।
ইভান কপালে গভীর চুমু দিয়ে উঠে গেলো। ইভান অফিসে চলে যাওয়ার প্রায় ১ ঘণ্টা পর ঈশা ঘুম থেকে উঠলো। ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। নাজমা তখন রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঈশাকে দেখে বলল
–আপনি নাস্তা খান। ভাইয়া বলে গেছে ঘুম থেকে উঠলে আপনারে খাওয়ায় দিতে।
ঈশা হাসল। টেবিলে বসতেই নাজমা সব রেডি করে দিলো। নাস্তা শেষ করে চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। নাজমা দরজা খুলে দিলো। ঈশা টেবিলে বসেই সেদিকে তাকিয়ে বলল
–কে এসেছে?
নাজমা কোন কথা বলল না। ঈশা ব্যক্তিটাকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
চলবে……