#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৪
কলিং বেল বেজে উঠতেই ঈশা দাড়িয়ে গেলো। ঠোঁটে এক তৃপ্তির হাসি নিয়ে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ দুটো থমকে গেলো। চার চোখ এক হল। কিছু সময় আদান প্রদান হল নীরব অনুভূতি। অনুভুতির ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। ইভানের চোখ ঝলমল করে উঠলো। সেও যেন মনে প্রাণে অপেক্ষা করছিলো এই মুহূর্তটার। বাসায় আসবে শুনেই তার প্রথম চোখে ভেসে উঠেছিল তার পথ চেয়ে বসে থাকা ঈশার দৃশ্য। দরজা খুলে তাকে দেখেই ঈশার মাঝে খেলে যাবে এক অনাবিল প্রশান্তি। সেই প্রশান্তির ছটা প্রকাশিত হবে তার চোখে মুখে। এই মুহূর্তে সেই কল্পনাটাই সত্যি হতে দেখছে ইভান। তার চোখে মুখেও ছড়িয়ে পড়লো আনন্দ।
–ভাইয়া ভেতরে আসো।
ইলুর কথা কানে আসতেই ঘোর কাটল। ইভান চোখ সরিয়ে ইলুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ঈশা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। একে একে সবাই ভেতরে ঢুকল। ইভান সোফায় বসে পড়লো। এখন সে ভালই আছে। শারীরিক দুর্বলতাটা একটু বেশীই। এখনো কেটে উঠতে পারেনি। একটু সময় লাগবে। ঈশা ইভানের পেছনে এসে দাঁড়ালো। চাপা একটা অভিমান খেলে গেলো মনে। ভেবেছিল ইভান তাকে দেখেই অস্থির হয়ে পড়বে। জড়িয়ে ধরে রাখবে কিছু সময়। তারপর আদুরে কণ্ঠে বলবে “ভীষণ মিস করেছি। কেন যাও নি হাসপাতালে আমাকে নিতে?”। কিন্তু এসবের কিছুই হল না। এমন কি কোন কথাই বলল না। এর মাঝেই ইরা হন্তদন্ত করে ভেতরে ঢুকে ইভানের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। টলমলে চোখে জিজ্ঞেস করলো
–ভাইয়া কেমন আছো?
ইভান ক্লান্ত হাসল। মাথায় হাত দিয়ে বলল
–ভালো আছি টুনটুনি। তুই কেমন আছিস?
ইরা কথা বলতে পারল না। গলা ধরে আসছে তার। যে কোন সময় চোখের পানি গড়িয়ে পড়বে। কিন্তু সে এটাও জানে যে ইভানের সামনে কান্নাকাটি করা যাবে না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোট কামড়ে মাথা নাড়ল। খুব দ্রুত উঠে গেলো সেখান থেকে। ইভান পুরো ব্যাপারটাই ধরতে পারল। কিন্তু কিছুই বলল না। সায়ান বলল
–তুই ফ্রেশ হবি নাকি?
ইভান মাথা নাড়ল। সায়ান বলল
–তাহলে তুই ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। দুপুরে ঔষধ খেতে হবে। আমি ঈশাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।
ইভান উঠে দাঁড়ালো। মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল
–মার সাথে দেখা করে আসি।
বলেই সেদিকে চলে গেলো দ্রুত পায়ে। সায়ান ঈশাকে অনেকটা সময় নিয়ে তার প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে দিলো। আর বলল ইলহামের সাথে ফোনে কথা বলে নিতে। কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা সেটা জানাতে বলেছে। ঈশা সবটা বুঝে মাথা নাড়ল। ঈশা সবার উদ্দেশ্যে বলল
–তোমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে এসো। একসাথে খাব। আমি এগুলো ঘরে রেখে আসি।
সবাই যে যার মতো চলে গেলো। ঈশা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো। দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো। লক করা নেই বোধহয়। কারন ঈশা যখন সায়ানের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তখন ইভানের মা ঘুমাচ্ছিল বলে সে একবার দেখেই চলে এসেছে ঘরে। ঈশা দরজার হাতলটা ধরতেই খেয়াল করলো তার বুকের ভেতরটা দুরদুর করে কাঁপছে। ভেতরে ঢুকে কি হবে সেই দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুই ভাবতে পারছে না। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে দরজা খুলে ফেললো। ভেতরটা অন্ধকার। দরজা জানালা কিছুই খোলা নেই। এমনকি লাইটও জালানো নেই। ঈশা সুইচ চেপে আলো জ্বালাতেই কানে আসলো ওয়াশ রুম থেকে পানির আওয়াজ। ইভান ওয়াশ রুমে। সম্ভবত শাওয়ার নিচ্ছে। ঈশা ঔষধ গুলো টেবিলে রেখে বারান্দার দরজাটা খুলল। একটু পা বাড়াতেই চোখে পড়লো তার বারান্দার সেই অল্কানন্দা। হলুদ রঙের ফুলটা এখনো অভিমান করেই আছে। তাড়াহুড়োতে তার জত্ন নিতেই বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছে। হতাশ শ্বাস ছেড়ে পেছনে তাকাতেই চমকে গেলো। দুটো চোখ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভীষণ তৃষ্ণা ঐ চোখ জোড়াতে। তাকে দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ। ঈশা কয়েকবার পলক ফেলে ইভানের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল
–তুমি ভেতরে বস। আমি তোয়ালেটা মেলে দিচ্ছি।
ইভান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে তোয়ালে মেলে দিতে দিতে ভীষণ অভিমানী কণ্ঠে বলল
–আমি পারব।
ঈশা ক্ষণিক সময়ের জন্য থমকাল। অভিমানটা বুঝতে পারলেও কারণটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো। এইসব কিছু এখনই ধরা যাবে না। ইভান এখনো সুস্থ নয়। ইলহাম বলে দিয়েছে কিছুদিন অনেক ধরনের সাইড এফেক্ট হতে পারে। তাই ওর সব ব্যাবহার সহজ ভাবে নিতে হবে। ঈশা ঘরের ভেতরে ঢুকল। আবার পেছন ফিরে তাকাল। ইভান তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ঈশা নরম গলায় বলল
–কেমন আছো?
ইভানের অভিমান গাড় হল। ক্ষণিকের জন্য ৫ বছর আগের সেই দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। এতো বছরে ঈশার মনে হয়নি সে কেমন আছে? কখনো জানতে চায়নি। সে নাহয় বাদ দিলো। গত ছয় মাস হল দেশে ফিরেছে। এই ছয় মাসে কয়দিন দেখা হয়েছে সেটা আঙ্গুলের ডগায় গুনে বলতে পারবে ইভান। সেও আবার অপ্রত্যশিত ভাবে। আর কথা তো হয়ই না। সামনা সামনি আসলে ঈশা এমন আচরন করে যেন তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। সামনে আসলেই পাপ হয়ে জাবে। মন থেকেই কেমন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি বেরিয়ে এলো আপনা আপনি। ঈশা তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে উত্তরের। ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–আমি কি কখনো খারাপ থাকি? দেখেছো কখনো আমাকে খারাপ থাকতে? বরং আমার আশে পাশে থাকলেই মানুষ খারাপ থাকে। তাই পালিয়ে বেড়ায়।
কথাটা ঠিকঠাক ধরতে পারল ঈশা। আহত চোখে তাকাল। ইভান ঠোট ফুলিয়ে একটা শ্বাস ছাড়ল। অসম্ভব কষ্ট জমে আছে তার ভেতরে। দ্রুত পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে। ঈশা বুঝতে পারল ইভান এতো বছরের দূরত্বটা বাইরে থেকে সহজ ভাবে মেনে নিয়েছে বোঝালেও ভেতরে ঠিকই একটা অভিমান পুষে রেখেছে। আজ যখন ঈশা সমস্ত দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে চায় তখন ইভানের সেই জমানো অভিমান ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ইভানের এখানে কোন দোষ নেই। সব দোষ ঈশার। তার ভুলের মাশুল তাকেই দিতে হবে। সেও বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। এসে দেখে সবাই টেবিলে বসে গেছে। মোটামুটি খাবার মুখেও তুলেছে কিন্তু ইভান এখনো খায়নি। সে মনে মনে ঈশার জন্য অপেক্ষা করছে। ঈশার আসতে দেরি হচ্ছে জন্য বিরক্ত মুখে বসে আছে। ইরিনা দেখেই বলল
–ঈশা তুইও বস।
ঈশা মাথা নেড়ে এগিয়ে আসলো। ইভানের পাশের চেয়ারটা ফাঁকা আছে। সেখানেই বসে পড়লো। ইভান মনে মনে খুশী হল। সেও চেয়েছিল ঈশা তার পাশেই বসুক। এতো বছর পর আবার একসাথে বসে খাওয়ার অনুভূতিটা দারুন। খেতে শুরু করলো ইভান। খাওয়ার মাঝে আড় চোখে কয়েকবার ঈশাকে দেখে নিলো। সেটা ঈশার চোখে পড়লো না। সে মন খারাপ করে বসে খাওয়া শেষ করলো। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারল না। ইভান সেটাও খেয়াল করলো। কিন্তু কিছু বলল না। খাওয়া শেষ করে ইভান বলল
–আমার ক্লান্ত লাগছে। রেস্ট নেবো কিছুক্ষন। বিকেলে দেখা হবে।
বলেই চলে গেলো ঘরে। ঈশা পানিটা খেয়ে গ্লাসটা রেখে ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল
–আমি ঔষধ খাইয়ে দিয়ে আসি।
বলেই ইভানের পেছনে পেছনে সেও দৌড় দিলো। ইভান ঘরে ঢুকেই আবারো পুরো ঘর অন্ধকার করে দিয়েছে। ঈশা ভেতরে ঢুকেই আলো জ্বালিয়ে দিলো। ইভান পেছনে ঘুরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
–ঔষধ খেতে হবে। তাই আলো জ্বালালাম।
ইভান মৃদু ধমক দিয়ে বলল
–আমি কি অশিক্ষিত? কি ঔষধ খেতে হবে সেটা তো প্রেসক্রিপশনেই লেখা আছে। নিজে পড়ে খেয়ে নিতে পারতাম না?
এমন ধমক খেয়ে ঈশার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বড় সড় একটা ধমক দিয়ে বলল
–অন্ধকার করে তো ঘুমিয়ে পড়ছিলে। কখন ঔষধ খেতে? বিকেলে না সন্ধ্যায়?
ইভান ভড়কে গেলো। সে আশা করেনি ঈশা তাকে এভাবে ধমক দেবে। একটু দমে গিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। ঈশা ঔষধ আর পানি এনে ইভানের হাতে ধরিয়ে দিলো। ইভান নিশব্দে খেয়ে ফেললো। তারপর শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে বলল
–লাইট অফ করে দাও। আমি ঘুমাব।
ঈশা লাইট অফ করে দিলো ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারল না সে কি করবে। থাকবে নাকি বাইরে যাবে। কিছুক্ষন ভেবে ধির পায়ে ইভানের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভারী সমস্যায় পড়ে গেলো সে থেকে তো গেলো কিন্তু এখন কি ইভানের পাশে শুয়ে পড়বে? ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষন কেটে গেলো। চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসছে তার। সময় নষ্ট না করে শুয়ে পড়লো ইভানের পাশে। ইভান তখন ঘুমে বিভোর। সে বুঝতেও পারল না ঈশা তার পাশেই শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
————-
শেষ বিকেলে ফোনটা কয়েকবার কেঁপে উঠতেই ঈশা ধড়ফড় করে উঠে বসল। ফোনটা ধরে ফেললো তড়িঘড়ি করে। ঈশার মা ফোন করেছে। ফোন ধরতেই তার মা বলল
–ঈশা কি করছিস?
মায়ের গলা বেশ ক্লান্ত শোনাল। ঈশা উঠে বাইরে গিয়ে বলল
–কিছু না মা। কেন? কি হয়েছে?
ঈশার মা জড়ানো গলায় বলল
–আমার প্রেশারটা বেড়েছে। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। একবার আসবি বাসায়? কাল ইরার পরীক্ষা তো। ও পড়ছে।
ঈশা ছোট্ট করে বলল
–আসছি মা।
বলেই দরজা খুলে ইভানের কাছে গেলো। সে গভীর ঘুমে। একবার মুখটাতে হাত ছুঁয়ে দিতেই ইভান নড়েচড়ে উঠলো কিন্তু চোখ খুলল না। আবার উল্টা ঘুরে ঘুমিয়ে গেলো। ঈশা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির বুয়াকে সবটা বুঝিয়ে বলে দিলো। ইভানের মায়ের সাথে একবার দেখা করে চলে গেলো নিজের বাড়িতে।
ইভানের ঘুম যখন ভাংল তখন বাজে ৭ টা। এতক্ষন সে ঘুমাল অথচ কেউ তাকে ডাকল না। ঈশা তো একবার এসে ডাকতে পারতো। ফ্রেশ হয়ে বের হল ঘর থেকে। টেবিলে এসে গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে খেতে চারিদিকে অস্থির দৃষ্টি ফেললো কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না। তখনই বুয়া রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ইভান তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো
–ঈশা কোথায়?
–আপু তো বাড়ি চলে গেছে বিকেলেই।
ইভানের মনটা আবার বিষণ্ণতায় ভরে গেলো। তাকে না বলেই চলে গেলো মেয়েটা। এতো কিসের তাড়া ছিল বাড়ি যাওয়ার। তার ঘুম ভাঙ্গা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কি এমন ক্ষতি হতো? অযথাই নাটক করতে এসেছিলো। ক্ষণিকের জন্য আশা তৈরি করে আবার চলে গেলো। এই মেয়েটা এমনই। ইভানের অনুভুতির কোন দাম নেই তার কাছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল
–অভিমান তার উপরেই করা উচিৎ যার উপরে করলে শুধু অভিমান টুকুর সম্মান বাঁচে। কিন্তু যেখানে অনুভুতির কোন মুল্য নাই সেখানে অভিমানটা নিছক বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। তুমি আমার অভিমানেরও যোগ্য নয়। আর কোন প্রত্যাশা থাকলো না তোমার কাছে।
চলবে……