#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২
“আমার ভালবাসার মতো অভিমানটাও তীব্র। তুমি ভুল করেছো। আমি নিরুপায়। এই শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। দূরে যেতে চেয়েছিলে না? তাহলে দূরত্বটাই থাক।“
“নাহ!” চিৎকার করে উঠলো ঈশা। বুকের ভেতরের ধুকধুকানিটা তীব্র শব্দে বেড়ে গেলো। কপালে গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেলো। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঈশার চিৎকার শুনেই ইরিনা তাকে ধরে ফেললো। সে এতক্ষন তার পাশেই বসে ছিল। হুট করে ঈশা এমন চিৎকার করে উঠলে সে ভ্যবাচ্যকা খেয়ে বসে। ঈশার দিকে গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–ঈশা কি হয়েছে?
ইরিনার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল সে। কোথায় আছে সবটা বুঝতেই আশে পাশে অস্থির দৃষ্টি ফেললো। মাথায় ঢুকতেই বুঝতে পারল পুরোটা স্বপ্ন ছিল। সারাদিনের ক্লান্তিতে চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিতেই চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। কিছুটা গভীর ঘুমেই ঢলে পড়েছিলো ঈশা। কিন্তু তখনই তার অবচেতন মন ইভানকে দেখতে পায়। তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে। মলিন মুখটায় কষ্টের ছাপ। ভীষণ অভিমানী কণ্ঠস্বর। উপরোক্ত কথাগুলো আওড়াতেই ঈশার ভেতরটা কষ্টে ফেটে গেলো। আর শুনতে পারল না। ইরিনা একটা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল
–পানি খা।
ঈশা বিনা বাক্য ব্যয়ে পানির বোতল নিয়ে পানি খেয়ে নিলো। ইরিনা বোতলটা পাশে রেখে বলল
–খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?
ঈশার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। চাপা কান্নাটা আচমকাই হুড়হুড় করে বেরিয়ে এলো। ইরিনাকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললো সে। ইরিনা তাকে সামলানোর সুযোগ পেলো না। সেও নিজের কান্নাটা চেপে রাখতে পারল না। ফুপিয়ে কেদে উঠলো। কারন ইভানের অবস্থা এখনো অপরিবর্তিত। তীব্র শব্দে ফোনটা বেজে উঠলো ঈশার। কোনরকমে কান্না থামিয়ে ফোনটা ধরল। ইফতি ফোন করেছে। তাকে এভাবে কাদতে শুনলে অস্থির হয়ে পড়বে। বাসায় গিয়ে নিশ্চয় সেও সস্তি পাচ্ছে না। না পাবারই কথা। ঈশা নাক টেনে নরম কণ্ঠে বলল
–ইফতি? কি করছিস?
ইফতি হতাশ গলায় বলল
–মাকে ঔষধ খাইয়ে ঘুমিয়ে দিলাম। বারবার ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করছিলো।
থেমে গেলো ইফতি। কণ্ঠস্বর নিষ্প্রাণ। কথাটা ভেতরেই আটকে গেলো। গলায় দলা পেকে গেলো কান্না। ঈশা নরম কণ্ঠে বলল
–তুই কি বলেছিস?
কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো সে। ঠোট গোল করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–বলেছি ভাইয়া অফিসের কাজে বাইরে গেছে। আসতে কয়েকদিন দেরি হবে।
ইফতির কথা শুনে ঈশার চোখে পানি চলে এলো। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো। নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বলল
–তুই খেয়েছিস?
ইফতি তার কথার উত্তর দিলো না। পাল্টা প্রশ্ন করলো। বলল
–এখনো জ্ঞান ফেরেনি তাই না?
ইফতির করুন কণ্ঠ শুনে ঈশা কথা বলতে পারল না। গলা ধরে এলো তার। কষ্ট করে ধরা গলায় বলল
–ফিরবে। চিন্তা করিস না।
ইফতি কোন কথা বলল না। ঈশা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো। তার মনে হল সে কাঁদছে। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
–খেয়ে নে ইফতি। আমি তোকে পরে আবার ফোন দেবো।
ইফতি ফোনটা কেটে দিলো। ঈশা ফোন রেখেই চোখ বন্ধ করতেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে বলল। ইরিনা ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–ঠিক হয়ে যাবে ঈশা। ভাবিস না।
ঈশা উত্তেজিত হয়ে গেলো। কণ্ঠে গাম্ভীর্যতা এনে বলল
–কিচ্ছু ঠিক হবে না। এইসব কিছু তোমার ভাইয়ের নাটক। আমার উপরে প্রতিশোধ নিতে চায়।
ইরিনা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। কণ্ঠে অবাকের রেশ টেনে বলল
–কিসের প্রতিশোধ?
–আমি তাকে রেখে চলে গিয়েছিলাম বিদেশে সেটার প্রতিশোধ। তুমি কি ভেবেছ সে এতটাই উদার যে আমাকে সহজেই মাফ করে দেবে? দেবে না। আমাকে কষ্ট দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তারপর ক্ষমা করবে। তার আগে নয়।
ইরিনা ঈশাকে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত দিয়ে বলল
–শান্ত হ ঈশা। এরকম কিছুই না। এক্সিডেন্ট কেউ ইচ্ছা করে করেনা। আর ইভান ভাইয়া এমন ভাবে না ঈশা। তোকে অনেক ভালবাসে। আর যা কিছু করে তোর কথা ভেবেই করে। তুই নিজেও জানিস ইভান ভাইয়া সাধারণত কোন ভুল করে না। তুই ভুল ভাবছিস।
ইরিনার কথা গুলো ঈশার কানে গেলই না। তার মস্তিস্ক নিজের মতো ভাবতেই ব্যস্ত। এলোমেলো অনুভূতির চাপে অতিস্ট সে। সে কিছু একটা অনবরত বিড়বিড় করছে। সেটা ইরিনার কানে যাচ্ছে না। শুনতে হলে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। ইরিনা শোনার চেষ্টাও করলো না। ইরিনার মনে ভয় তৈরি হল। ঈশার আচরন তার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না। ঈশা মানসিকভাবে কতটুকু সুস্থ সেটা নিয়েই এখন তার চিন্তা হচ্ছে। ক্ষনে ক্ষনে তার আচরনের পরিবর্তন ইরিনাকে ভাবতে বাধ্য করছে। আসার পর থেকে ঈশাকে দেখছে কখনো খুব স্বাভাবিক আচরন করছে। আবার কখনো বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। এটা নিয়ে ইলহামের সাথে কথা বলতেই হবে।
————
মধ্যরাতে আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। দূর আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানিটা চোখে পড়ছে মাঝে মাঝে। বাইরে বেশ ঝড় হাওয়া। এই মেঘের গর্জনটা ঈশা ভীষণ ভয় পেতো এক সময়। ৫ বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। একা থাকতে গিয়ে পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এখন আর মেঘের গর্জনে মনে ভয় আসে না। কারন ভয় পেয়ে কারো বুকে লুকানোর মতো সুযোগটা তার কাছে নেই। বৃষ্টিটাও এখন আর ভালো লাগেনা। ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠে সে। কারন যার হাত ধরে জীবনের এতটা সময় বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে সেই হাতটা এখন আর ধরার সুযোগ হয়না। বুকের ভেতরের শূন্যতাটা ভয়াবহ রকমের হানা দিলো। অস্থিরতা কিঞ্চিৎ বেড়ে গেলো তার। নিজের জীবনের চরম সত্যটা থেকে পালাতে গিয়েই একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা ছিল তার জীবনের সব থেকে বড় ভুল। হয়তো পরিস্থিতি বদলে গেছে। নিজের অক্ষমতার কথাটা তাকে আর শুনতে হয়নি। কিন্তু শেষ বেলায় হিসাবের খাতায় প্রাপ্তিটা আজ শুন্য। ভালো থাকার লোভটা তাকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছিল যে সেই লোভে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছে সেটাই খেয়াল করেনি। কিন্তু আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। তার হারানর মধ্যে সব থেকে মুল্যবান যেটা ছিল সেটা হল প্রিয় মানুষটার ভুবন ভুলানো হাসি আর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা। যে চাহুনি তাকে প্রতিটা ক্ষনে ক্ষনে জানিয়ে দিত ভালবাসার গভীরতা। বুক চিরে বের হওয়া দীর্ঘশ্বাসটা হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ঈশা। জানালার কাছে গিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে পড়ছে। কিন্তু ঈশার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। উদাসীন দৃষ্টিতে সে বৃষ্টি দেখছে। মোটামুটি সবাই বাড়ি চলে গেছে। কেউই যেতে চায়নি। ইলহাম মোটামুটি এক রকম জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছে। কারন হাসপাতালে এতজনের ভিড় করার কোন মানেই হয়না। ভালো খারাপ যেটাই খবর আসুক সে তো আছেই। জানিয়ে দেবে। কিন্তু ঈশাকে এক চুলও নড়াতে পারেনি। সে এক গুয়ের মতো জেদ ধরে বসে আছে ইভান জতদিন হাসপাতালে থাকবে সে এখান থেকে কোথাও যাবে না। হাজার বুঝিয়েও লাভ হয়নি তাই আর ইলহাম বাধ্য হয়ে কোন কথাই বলেনি। কিন্তু তাকে তো আর একা রাখা সম্ভব না। তাই তার সাথে ইলু আর সায়ান থেকে গেছে হাসপাতালে। তার মেয়েকে মায়ের সাথে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ইলু এসে ঈশার হাত টেনে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। ঝাঁঝালো গলায় বলল
–কিছুই খাস নি তুই। এখন খেয়ে নিবি। নে হা কর।
ঈশা হাত সরিয়ে দিলো। যার অর্থ সে খাবে না। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে দৃষ্টি জানালার বাইরে স্থির করলো। ইলু এবার ভীষণ বিরক্ত হল। বলল
–দেখ ঈশা তুই কি বুঝতে পারছিস কি করছিস? তুই এভাবে না খেয়ে থাকলে কি ইভান ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে? আর তুই নিজেও এভাবে অসুস্থ হয়ে যাবি। আমি জানি তোর খেতে ইচ্ছা করছে না। আমাদের সবারই একই অবস্থা। কিন্তু তাই বলে কি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিতে হবে? তুই যদি অসুস্থ হয়ে যাস তাহলে কি এখানে থাকতে পারবি?
ঈশা হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমাকে জোর করনা। ভালো লাগছে না।
ইলু হতাশ হয়ে গেলো। তার মানে এতক্ষন সে যা যা বলল তার কিছুই ঈশার মাথায় ঢোকেনি। অজথা বাক্য ব্যয় করেছে সে। এই অবস্থা দেখে সায়ান এগিয়ে আসলো। ঈশার সামনে দাড়িয়ে বলল
–জ্ঞান ফিরে যখন ইভান প্রথম কথাটা জিজ্ঞেস করবে ঈশা কেমন আছে তখন যদি শোনে তুমি না খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছো কি হবে বুঝতে পারছ? ওর জেদ সম্পর্কে সবার থেকে তোমার ধারনা ভালো আছে তাই না?
ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। গম্ভীর গলায় বলল
–কে বলে দেবে এসব কথা? আপনি বলবেন?
সায়ান মলিন হাসল। বলল
–বোকার মতো কথা বলছ কেন ঈশা? আজ পর্যন্ত কি ইভান কে কোন কথা বলে দিতে হয়েছে যে এখন বলতে হবে? সে নিজে থেকেই সব কিছু বুঝে যায়।
শেষের কথাটা আনমনেই বলল সায়ান। ঈশা কিছু একটা ভেবে মৃদু হাসল। তারপর ইলুর হাত থেকে খাবার নিয়ে খেয়ে ফেললো।
————
দুইদিন হল ঈশা হাসপাতালে। সারাদিন ওখানেই বসে থাকে। সারাদিনে একবার বাসায় গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। সকালে ইরিনা এসেছিলো হাসপাতালে। তার সাথেই বাসায় চলে গেছে সে। কয়েকদিন থেকে ঘুম না হওয়ার দরুন মাথাটা ভীষণ ভার ভার লাগছে তার। লম্বা সময় ধরে গোসল করে নিলে বোধহয় ভালো লাগতো। ঈশা ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লো। বেশ অনেকটা সময় ধরেই গোসল শেষ করে বেরিয়ে এলো। এসেই দেখল ইরা বসে আছে বিছানায়। ঈশা কিছু বলার আগেই সে বলে উঠলো
–আপু তুমি এখন আবার হাসপাতালে যাবে?
ঈশা মাথা নাড়াল। ইরা আবারো বলল
–আমাকে নিয়ে যাবে?
ঈশা কিছুক্ষন ভেবে বলল
–তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।
ইরা আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। নিজের ঘরে চলে গেলো রেডি হতে। ঈশার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মনে হল এক কাপ কফি খাওয়া দরকার। ইরা রেডি হতে যে সময় লাগবে তাতে সে এক কাপ কফি খেয়েই ফেলতে পারে। রান্না ঘরে চলে গেলো কফি বানাতে। কিছুটা সময় লাগলো তার। কারন তার মা ততক্ষনে জোর করে একটু ভাত খাইয়ে দিয়েছেন। ঈশা খেয়ে ঘরে এসে দেখে ইরা রেডি। বিছানায় চোখ পড়তেই দেখল ফোনটা জ্বলে উঠেছে। ঈশা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল ইফতি কল দিয়েছিলো সেটা কেটে গেছে। চেক করতে গিয়ে দেখে ৭ বার কল দিয়েছে ইফতি। ঈশার বুক ধড়ফড় করে উঠলো। অজানা ভয় জেকে বসল মনে। কপালে ঘাম জমে গেলো বিন্দু বিন্দু। গলা শুকিয়ে গেলো তার। খারাপ কোন খবর দিতে ফোন করেনি তো?
চলবে……