শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-৩০

0
2007

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৩০

সময়টা রাত ১১ টা। মাথার উপরে ঘড়ঘড় শব্দে ফ্যান চলছে। জানালার পর্দা বাতাসে উড়ছে। বারান্দার দরজাটাও খোলা। সেদিক দিয়েই মৃদু আলো এসে অন্ধকার ঘরটাকে আলোকিত করেছে। ঈশা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে বিছানায়। ইভান এখনও বাইরে। তখন ইভান ঈশার কথোপকথনের এক পর্যায়ে একটা ফোন আসে। ইভান বেশ কিছুক্ষন কথা বলে জরুরী ভিত্তিতে বাইরে চলে গেছে। আর বলে গেছে কখন আসবে ঠিক জানে না। তবে এসে ঈশার সাথে জরুরী কথা বলবে। অনেক জরুরী কথা আছে। ঈশা ঠিক তখন থেকেই ভাবছে ইভান কি কথা বলবে। ঈশার কাছ থেকে আবার কোন ভুল হয়ে যায়নি তো। না বুঝেই কিছু না কিছু করেই ফেলে সে। আর যখন বুঝতে পারে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। মনটা কেমন যেন লাগছে। বুঝতে পারছে না কিছুই। ইভানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে হালকা চোখ লেগে এলো তার। কতক্ষন ওভাবে শুয়ে ছিল সেটা বলতে পারেনা। ঘুম ভাঙল ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিশ্বাস পড়ায়। চোখ মেলেই বুঝতে পারলো কেউ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। খানিকবাদেই বুঝতে পারলো মানুষটা কে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। একটু নড়তেই ইভান চোখ বন্ধ করেই বলল
–ঘুম ভেঙ্গে গেলো?

ঈশা ইভানের হাত সরিয়ে উঠে বসলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–তুমি কখন এসেছ? আমাকে ডাকো নি কেন?

ইভান সোজা হয়ে শুয়ে মাথার নিচে এক হাত রেখে বলল
–তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই ডাকি নি। তোমার ঘুম ভাঙ্গাব কেন?

ঈশা ঘুমু ঘুম চোখে ইভানের দিকে তাকাল। তখনই মনে পড়ে গেলো ইভান জরুরী কথা বলতে চেয়েছিল। মৃদু সরে বলল
–সরি। আমি ঘুমায়ে গেছিলাম। তুমি আমাকে জেগে থাকতে বলেছিলে।

ইভান উঠে বসলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসল। গালে হাত রেখে বলল
–এটা কেমন কথা। ঘুম পাইলে ঘুমাবে না? আমি জেগে থাকতে বলেছি বলে কি ঘুম পাইলেও জেগে থাকবে?

ঈশা উত্তর দিলো না। তাকিয়েই থাকলো। ইভান মুচকি হেসে বলল
–কি ভাবছ?

ঈশা উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলো
–তুমি খাবে না?

ইভান পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে হেলে ঈশাকে টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল
–আমি ইলহাম ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে খেয়ে এসেছি। তুমি খেয়েছ?

ঈশা মাথা নাড়ল। বাড়িতে কেউ নেই তাই ঈশা আর ইফতি একসাথে খেয়েছে। ইভান বলেই গিয়েছিলো তাকে খেয়ে নিতে। ইভান ঈশার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল
–ঈশা।

ঈশা ‘হুম’ বলতেই ইভান বলল
–আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে কেমন।

ঈশা মাথা নাড়ল। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–ইলহাম ভাইয়ার সাথে আমি তোমার বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। ভাইয়া বলেছে তোমার ট্রিটমেন্ট শুরু করতে। সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ততই ভালো।

ঈশা চুপচাপ শুনল। কোন উত্তর দিলো না। ইভান চুপ করে থাকা দেখে বলল
–আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

ঈশা মাথা তুলে তাকাল। একটু দূরে সরে চোখ নামিয়ে কাতর কণ্ঠে বলল
–কি হবে এসব করে?

ইভান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। স্বাভাবিক ভাবে বলল
–কিছু হওয়া না হওয়া কি আদৌ আমাদের হাতে আছে ঈশা? আমি তো তাই জানি যে এসব কিছুই আমাদের হাতে নেই। তাই বলে কি চুপ করে বসে থাকবো।

ঈশা উত্তর দিলো না। তার চোখ ছলছল করে উঠলো। আবারো সেই পুরনো ক্ষত দগদগে হওয়ার ভয়টা এবার তীব্র হল। সবাই জানলে কি হবে? ট্রিটমেন্ট শুরু হলে সবাই জেনে যাবে বিষয়টা। তখন কে কি ভাববে। মাথার মধ্যে সব চিন্তা কেমন অগোছালো হয়ে গেলো। চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠলো মাথার ভেতরে। ইভান ঈশার হাত আলতো করে ধরে কোলের উপরে রেখে বলল
–এভাবে না ভেবে অন্য ভাবেও তো ভাবা যায়। সব কিছু তো আর আমাদের হাতে থাকে না জান। কিছু কিছু বিষয় ভাগ্যের উপরে ছেড়ে দিতে হয়।

ঈশাকে চুপ করে থাকতে দেখে ইভান উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। জানালার কাছে গিয়ে বাইরে আকাশে তাকিয়ে বলল
–তোমাকে এভাবে দেখলে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। আমি বলেছিলাম তোমাকে কোনদিন কষ্ট পেতে দিবো না। জীবনের সব সুখ দিতে চাই। কিন্তু আমি ব্যর্থ। সব সুখ দিতে পারলেও জীবনের সব থেকে বড় সুখ থেকে তুমি বঞ্চিত থাকবে।

ইভানের কথা গুলো ঈশার কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিলো। সব থেকে বেশী কষ্ট হচ্ছে ইভানের গলার আওয়াজ শুনে। সে বুঝতে পারছে ইভান প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে কতটা অসহায়। ঈশা চোখের পানি ফেলে উঠে গেলো ইভানের কাছে। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা ঠেকাল। ইভান কোন কথা বলল না। ঘুরেও দাঁড়ালো না। ঈশা কাঁদছে। ইভান বুঝতে পারছে কিন্তু সে থামাতে চেষ্টা করছে না। বেশ কিছুক্ষন পর ঈশা অভিমানী কণ্ঠে বলল
–আমি কাদছি বুঝতে পারছ না?

ইভান সামনে তাকিয়েই মৃদু সরে বলল
–পারছি।

ঈশা আবারো বলল
–তাহলে থামাচ্ছ না কেন?

ইভান অভিমানী কণ্ঠে বলল
–থামাব কেন? তোমার সব কষ্ট তো দূর করার ক্ষমতা আমার নাই। তাই এই চোখের পানিটাও মুছে দেয়ার অধিকার আমার নাই। মাঝে মাঝে সৃষ্টি কর্তার উপরে খুব অভিমান হয়। কেন আমার পাখির সব কষ্ট দূর করে দেয়ার ক্ষমতা আমার হাতে দিলো না। কেন তাকে এমন কষ্ট দিলো যেটা আমার উপস্থিতিও নিঃশেষ করে দিতে পারেনা। নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এতো ভালবাসা দিয়ে কি হবে? সারাজীবন তোমার একটা কষ্ট থেকেই যাবে। তুমি ভিতরে ভিতরে জলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। আর আমি শুধু দেখবো। আমার কিছুই করার থাকবে না। আমি কতটা অসহায়!

ঈশা ইভান কে ছেড়ে দিলো। জোরে কেদে ফেলল। কাদতে কাদতে বলল
–এরকম বল না প্লিজ। তোমার তো কোন দোষ নেই। তাহলে তুমি কেন ব্যর্থ হবে? আর তোমার যদি সত্যিই কিছু করার থাকত তাহলে কি তুমি আমাকে এভাবে কষ্ট পাইতে দিতে?

ইভান ঘুরে দাঁড়ালো। পিছনে হেলানি দিয়ে দাঁড়ালো হাত গুজে। শান্ত কণ্ঠে বলল
–বোঝ? মানো না কেন?

ঈশা চোখ তুলে তাকাল। ইভান হাত বাড়িয়ে ঈশাকে বুকে টেনে নিলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
–কাদিও না প্লিজ। ট্রিটমেন্ট করার পর সব ঠিক হয়েও যেতে পারে। যদিও বা এখনই কিছু বলা সম্ভব না। তবুও আমরা তো আশা ছাড়তে পারিনা তাই না?

ঈশা মাথা নাড়ল। ইভান ঈশার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–সব সময় মনের মধ্যে আশা রাখবে। দেখবে জীবনটা অনেক সুন্দর। অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছা করবে।

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। ইভান একটু হেসে বলল
–সারা রাত কি আমাকে দেখেই পার করে দিবে? ঘুমাতে হবে না?

ঈশা হাসল। ইভান বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো। জানালা বন্ধ করে ঈশাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। ঈশা কিছু একটা ভেবে বলল
–ট্রিটমেন্টের কথা তো সবাইকে জানাতে হবে।

ইভান সময় না নিয়েই সহজ স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–জানাবো। প্রবলেম কোথায়?

ঈশা ভীত কণ্ঠে বলল
–যদি অন্যভাবে নেয় সবাই?

ইভান একটু বিরক্ত হল। বলল
–অন্য ভাবে নেয়ার কি আছে? এটা কি তোমার দোষ? তুমি কোন অপরাধ করেছ? নাকি আমি করেছি?

ঈশা একটু ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–কারো দোষ না। এখন ঘুমাও।

ইভান ঈশার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। সে ভাবছে কাল তার বাবা মা চলে আসলেই তাদেরকে সবটা খুলে বলবে। তারপর ট্রিটমেন্টের কথাও বলবে। তারা নিশ্চয় বুঝবে বিষয়টা।

—————
সবাই বেশ চিন্তিত মুখে বসে আছে। ঈশার কান্নার আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। প্রচণ্ড পেট ব্যথায় কাতর সে। কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। ব্যাথার বেগ বেড়েই চলেছে। ইভান হাত ধরে বসে আছে পাশে। সেও বিচলিত হয়ে পড়েছে। কি করবে মাথায় ঢুকছে না। এভাবে সহ্যও করতে পারছে না। নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগছে। সারাদিন ভালোই ছিল ঈশা। ইভানের বাবা মা সকালেই চলে এসেছে। একদম যোগ্য বউয়ের মতো সব দায়িত্ব পালন করে সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কাউকে কিছু না জানালেও ব্যথা ধিরে ধিরে বেড়ে যায়। আর তখন সহ্য করতে না পারায় চিৎকার শুরু করে। তখনই সবাই ছুটে যায় তার ঘরে। ব্যথা কমছে না বলে ইভান ইলহাম কে ফোন করে আসতে বলে।

কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ইভানের মা দরজা খুলে দিলো। ইলহাম কে দেখে বিচলিত কণ্ঠে বলল
–তুই এসেছিস বাবা। দেখ না মেয়েটার সন্ধ্যা থেকে কি হয়েছে। কেমন অস্থির হয়ে গেছে।

ইলহাম ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
–এটা খুব স্বাভাবিক বড় মামি। এরকম হবেই। এর জন্যই ট্রিটমেন্ট টা তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে।

ইভানের মা কিছু না বুঝেই জিজ্ঞেস করলো
–কিসের ট্রিটমেন্ট আর এরকমই বা কেন হবে?

ইলহাম উত্তর না দিয়েই ঈশার কাছে গেলো। ঈশাকে ভালো করে দেখে নিয়ে ইনজেকশন দিলো। ইভান কে উদেশ্য করে বলল
–কিছুক্ষনের মধ্যেই ব্যথা কমে যাবে। আর ও ঘুমিয়ে পড়বে। সারা রাত ঘুমাক। ডাকার প্রয়োজন নেই।

ইভান কোন কথা বলল না। ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইলহাম ইভান কে বাইরে আসতে বলল। দুজন বাইরে এসে সোফায় বসে পড়ল। ইলহাম বলল
–খুব তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট শুরু করা দরকার। এটা এখন প্রায় সময়ই হতে থাকবে। আর জতদিন যাবে ব্যথা আরও তীব্র হবে।

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–তুমি সব ব্যবস্থা করো ভাইয়া।

ইলহাম মাথা নাড়তেই ইভানের মা আবার প্রশ্ন করলো
–তোরা কি নিয়ে কথা বলছিস আমাকে বলবি?

ইলহাম ইভানের দিকে তাকাল। তার তাকানোর মানে ইভান বুঝতে পেরে বলল
–মা জানে না কিছু।

ইলহাম আর সময় নষ্ট না করে উঠে বলল
–আমার কাজ আছে। যেতে হবে। আর তুই কাল ঈশাকে নিয়ে আমার ক্লিনিকে আয়। সব টেস্ট আবার করাতে হবে।

ইভান মাথা নাড়ল। ইলহাম চলে গেলো। ঈশার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। ইভানের বাবা এসে সোফায় বসে বলল
–মেয়েটার এখন কি অবস্থা?

ইভান মৃদু সরে বলল
–ঠিক আছে এখন।

ইভানের মা চিন্তিত হয়ে বলল
–ইভান কি হয়েছে ঈশার? কোন বড় সমস্যা?

ইভান একটু সময় নিয়ে সবটা তার বাবা মাকে খুলে বলল। সবাই মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনল। ঘরটাতে পিন পতন নিরবতা চলল বেশ খানিকটা সময়। এর মাঝেই ইভানের মা বলে উঠলো
–এই কথাটা লুকানো উচিৎ হয়নি। ট্রিটমেন্ট করেও যদি কিছু না হয় তাহলে তখন কি করবি?

ইভান গম্ভীর গলায় বলল
–বাচ্চার বিষয়টা স্বামী স্ত্রীর একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার মা। এটা নিয়ে অন্য কারো কথা বলা শোভা পায় না।

ইভানের মা হতাশ গলায় বললেন
–অন্য কেউ? কাকে অন্য কেউ বলছিস তুই? আমি তোর মা ইভান। ভালো মন্দ এসব নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার আছে। সন্তানের ভালো মন্দ ভাবার দায়িত্ব প্রতিটা বাবা মায়ের।

–অবশ্যই আছে। আর আমি কোন অধিকার নিয়ে কথাও বলিনি। তুমি এসব নিয়ে ভাবতেই পারো। আমি তোমার ভাবনা আটকাতে পারবো না। কিন্তু আমার মনে হয় বিয়ের পরে কিছু বিষয় সন্তানদের উপরেই ছেড়ে দিতে হয়। তাদের ব্যক্তিগত জীবন বলে একটা কথা আছে। সেটার সিদ্ধান্ত একান্ত তাদের হওয়া উচিৎ মা।

ইভানের মা গম্ভির গলায় বললেন
–এটা কোন সিদ্ধান্ত নয় ইভান। তোরা বাচ্চা নিয়ে ভাবতে যদি সময় নিস তাহলে সেটা হতো সিদ্ধান্ত। তোদের যদি চিন্তা ভাবনা অন্য কিছু থাকতো তাহলে আমি ব্যাক্তিগত ভেবে সেটা নিয়ে কথা বলতাম না। কিন্তু এখানে পুরো বিষয়টা উলটা। ভাবার কোন অবকাশ নাই। সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো কিছুই নেই। আর যেটা একেবারেই নেই সেটা এখন আর কোন স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে ঘরের চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ থাকবে না। বাইরে বেরিয়ে আসবে।

কথাটা শুনে ইভান হাত গুটিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল
–আমি কারো কেয়ার করিনা। আমি আমার জীবনে সুখী থাকলে কার এতে কি যায় আসে সেটা দেখা আমার কাজ নয়।

ইভানের মা ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষন বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন। থম্থমে গলায় বললেন
–স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের সুতো হল বাচ্চা। সারাজীবন এই সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরে রাখে এই বাচ্চা। বাচ্চা ছাড়া সম্পর্ক আর সুতো ছাড়া ঘুড়ির মধ্যে কোন তফাত নেই। সুখ এতো সহজ নয়। মুখে হাজার বার সুখী শব্দটা উচ্চারণ করলেই আর নিজেকে সুখী দেখাবার চেষ্টা করলেই সুখী হওয়া যায়না। সেভাবে তুমি বাইরের মানুষকে দেখাতে পারবে সুখী। কিন্তু নিজে কি আসলেই সুখী হতে পারবে? বাচ্চা ছাড়া যে অপূর্ণতা তোমাদের জীবনে নেমে আসবে সেটা কিভাবে সামলাবে? তাছাড়াও বছরের পর বছর সংসার করার পর যখন বাচ্চার মুখ দেখতে পাবে না তখন সমাজ প্রশ্ন করবে। সেসবের উত্তর তোমরা দিতে পারবে? আজ আমার সাথে যুক্তি তর্কে টিকে গেলেও সমাজের যুক্তি তর্কে কিভাবে টিকবে সেটা কি ভেবেছ?

ইভানের মুখে কাঠিন্য ভাব চলে এলো। গম্ভির গলায় বলল
–আমি কোন সমাজের তোয়াক্কা করিনা। কে কি বলল সেসব নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। আর সব থেকে বড় কথা হল এই বিষয়টাতে আমাদের কোন হাত নেই। ঈশারও কোন দোষ নেই। তার যদি কিছু করার থাকত তাহলে কি ঈশা চুপ করে থাকত? কোন মেয়েই এই বিষয়টা সহজে মানতে পারেনা মা। ঈশাও পারেনি। ওকে মানাতে আমার কম কষ্ট করতে হয়নি। এখন আমি কোন ভাবেই চাইনা পুরনো ক্ষতটা আবার দগদগে হয়ে উঠুক।

–এসব আবেগের কথা ইভান। আমি বলছিনা ঈশার দোষ আছে। এটা তার দুর্ভাগ্য। তাকে মেনে নিতেই হবে। কিন্তু বিয়ের আগে তোমার এই বিষয়টা আমাদের জানানো উচিৎ ছিল। এতো বড় একটা বিষয় এভাবে চেপে গিয়ে তোমরা ঠিক করনি।

ইভান মায়ের দিকে গভির দৃষ্টিতে তাকাল। আজ তার মাকেই তার কাছে অচেনা লাগছে। কি অদ্ভুত! সমাজের ভয়ে আজ একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে এভাবে তার দুর্বলতা নিয়ে আঘাত করতেও ভাবছে না। ইভান বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–শুধু ঈশার দুর্ভাগ্য না মা। ঈশার ভাগ্য আমার সাথে জড়িয়ে আছে। তাই আমার ঠিক ততটাই দুর্ভাগ্য। আর যদি একান্তই বাচ্চা দরকার হয় তাহলে আমরা এডপ করবো। এতে তো কোন সমস্যা নেই।

ইভানের মা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন
–নিজের বাচ্চা আর অন্যের বাচ্চার মধ্যে পার্থক্য আছে ইভান। তোমার আগেই এই বিষয়টা ভাবা উচিৎ ছিল।

ইভানের মায়ের শেষের কথাটা ইভানকে পুরই ভেঙ্গে দিলো। তার মা যে আজ এমন কথা বলবে সেটা তার মাথাতেই আসেনি। ইভান উঠে দাঁড়ালো। কঠিন গলায় বলল
–ঈশা তোমার কাছে কোন অভাগি মেয়ে হতে পারে। তোমার কাছে তোমার ছেলের বউ হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে আমার সব কিছু। ঈশা আমার জীবন। ঈশাকে কিছু বলা মানে আমাকে বলা। ঈশাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলা মানে আমাকে কষ্ট দেয়া। আর আজ তুমি আমাকে অনেক বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছ মা। এখন তুমি বুঝবে না। কিন্তু যখন বুঝবে তখন আক্ষেপ ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।

ঈশার মা অসহায় কণ্ঠে বলল
–আমি কোন খারাপ কথা বলিনি ইভান। আমার কথাটা বুঝতে চেষ্টা করো। আমি তোমাদের ভালো চাই।

ইভান উঠে দাড়িয়ে বলল
–আমি জানি মা। কিন্তু সব ভালো সব সময় সবার জন্য ভালো হয়না। তোমার কাছে যেটা ভালো সেটা আমার কাছে ভালো হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তুমি এটা ভেবে থাকলে ভুল করবে। আর হ্যা যদি এতে ঈশার কোন দোষ থাকত তাহলে হয়তো আমি তোমার ভালো মন্দ বিচার করার কথা গুলো শুনতাম। কিন্তু যেখানে আমার ঈশা অসহায় সেখানে কারো ভালো মন্দ বিচার করার অধিকার নেই। শোনা তো দুরের কথা।

ইভান পা বাড়াতেই ইভানের বাবা বলল
–এখন এসব কথা থাক। আমরা এসব নিয়ে পরে কথা বলবো। এখন মেয়েটা কেমন আছে আপাতত সেটাই জানা জরুরী।

ইভান ধরা গলায় বলল
–এসব নিয়ে আর কোন কথা হবে না। এখানেই শেষ। আর যদি কোন কথা হয়েই থাকে তাহলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে যেই বাড়িতে ঈশার এই অক্ষমতাকে নিয়ে কথা বলার সুযোগ আছে সেই বাড়িতে আমি থাকতে পারবো না। কারন এটা নিয়ে কথা বলা মানে ঈশাকে অপমান করা। আর ঈশাকে অপমান করা মানে আমাকে অপমান করা।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে