#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৮
মধ্য রজনীর নিস্তব্ধ প্রহর। দূরে কোথাও দুই একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। থেমে থেমে রাস্তায় গাড়ি চলছে। উষ্ণ আবহাওয়াটা হঠাৎ করেই শীতল হয়ে গেলো। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। আর সেই বৃষ্টির শীতল হাওয়াই বয়ে আসছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোর কাছে কয়েক ঝাক পোকা থেমে থেমে উড়ছে। ঠিক তার পাশের বারান্দাতেই দুই জন মানুষ নিজের অনুভুতি প্রকাশে ব্যস্ত। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরে দুরু দুরু কাপন। মস্তিষ্কে এলোমেলো চিন্তা ধারা। ভয়ে হাত কাপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। ইভান এক হাতের মুঠোয় ঈশার দুই হাত ধরে রেখেছে। কাপতে দেখে দুই হাতে ঈশার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলল
–ভয় পাচ্ছ কেন জান? রিলাক্স!
ইভানের কথা শুনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও মস্তিষ্ক সায় দিলো না। গোলমেলে চিন্তা বেড়ে গেলো আরও। ইভান এক হাতে কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলল
–আমাকে কি বিশ্বাস করা যায় না?
ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–যায় তো। কেন যাবে না?
ইভান মৃদু হাসল। হাসিটা একেবারেই অন্য রকম। হাসির কারণটা না বুঝলেও অর্থটা বুঝতে অসুবিধা হল না ঈশার। এবার ভয়টা আরও গাড় হল। কি এমন বলবে ইভান যার কারনে এতো আয়োজন। ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে তাকিয়ে বলল
–তাহলে এই নাটকের কারন কি?
ঈশার বুকের দুরু দুরু কাপন আরও বেড়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে ফেলল। ইভান নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। ইভান চোখ তুলে ঈশার চোখে চোখ রাখল শান্ত ভাবে। শান্ত গলায় বলল
–কেন এতো কিছু?
ঈশা জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিতে লাগলো। কাপা কাপা গলায় বলল
–ম…মানে?
ইভান ঈশার চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল
–মানেটা স্পষ্ট। আমি কারণটা জানতে চাই।
ঈশা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল
–কি…কিসের কারন?
ইভান এবার নিজের রাগটাকে আর কন্ট্রোল করতে পারলো না। এক হাতে ঈশার গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল
–তোর এই বিয়ে নাটকের কারন। কেন এরকম একটা নাটক করলি? সবটা জানতে চাই। সত্যিটা বল।
ইভানের কথা শুনে ঈশার মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম। ইভান এতো জোরে তার মুখ চেপে ধরেছে যে ঈশা ব্যথায় কথা বলতে পারছে না। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। ইভান চোখের পানি দেখে ছেড়ে দিলো। ঈশা চোখ নামাতেই ইভান থুতনিতে দুই আঙ্গুলে ধরে মুখ তুলে বলল
–আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল। আর যা বলবি একদম সত্যি।
ঈশা ইভানের চোখের দিকে তাকাল। প্রচণ্ড রাগ তার চোখে। ঈশা ভয়ে আবার কেপে উঠতেই ইভান বলল
–চিঠির উপরে লেখাটা কার ছিল?
ঈশা চুপ করে থাকলো। এই মুহূর্তে ইভান কে কোন কথা সে বলতে চায় না। কারন ইভান এখন প্রচণ্ড রেগে আছে। ঠাণ্ডা মাথায় সবটা বলবে। বুঝিয়ে বলবে কারণটা। কিন্তু ঈশাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে ইভানের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো। দাতে দাত চেপে বলল
–স্পিক আউট ঈশা।
ঈশা ভয়ে ভয়ে বলল
–এখন তুমি অনেক রেগে আছো। আমি তোমাকে পরে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলবো প্লিজ! আমার কথা শুনো।
ইভান প্রচণ্ড রেগে গেলো। উঠে দাড়িয়ে টুলটাতে একটা জোরে লাথি মেরে চিৎকার করে বলল
–অনেক অপেক্ষা করেছি। আর না। আমি এখনি শুনতে চাই। কি এমন হয়েছিলো যে এতো বড় একটা নাটক করতে হল তোকে। এর পেছনে যত ঘটনা আছে সবটা শুনতে চাই আমি। আর সেটা এখনই।
ইভানের জোরে বলা কথা গুলো মাঝরাতে হুঙ্কারের মতো শোনালো। ঈশা ভয়ে কেদে ফেলল। কাদতে কাদতে বলল
–বিয়ের আগে একদিন আমাদের সবার এক সাথে বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। আমরা সবাই রেডি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তুমি প্রথমে আমাদের চলে যেতে বললে পরে যাবে বলে। কিন্তু আমরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই আবার ফোন করে বললে যাবে না। তোমার ভালো লাগছে না। আমরা সেদিন তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম। আমি বাসায় না গিয়ে ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে আসি। আবার অসুস্থ হলে কিনা একবার দেখে আসি। আমি বাড়িতে ঢুকার মুহূর্তেই ইফতিকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলে বলল যে স্নেহা আপু এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে। আমি ভিতরে গেলাম। ঢুকে দেখলাম বাসায় কেউ নেই। একটু এগিয়ে যেতেই তোমার আর স্নেহা আপুর আওয়াজ পেলাম। তোমার ঘরের দরজায় গিয়ে দাড়াতেই স্নেহা আপুর কথা আমার কানে এলো। বলছিল সে তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে। কান্নাকাটি করছিল। আর এটাও বলেছিল যে তোমাকে ছাড়া থাকার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারছে না। আমাদের বিয়ের কথা শুনে তার কষ্ট আরও বেড়ে গেছে। আমি একটু এগিয়ে দরজার ফাক দিয়ে দেখতে গেলেই চোখে পড়ে তোমরা দুজন দুজন কে জড়িয়ে ধরে আছো। আমি প্রথমে খুব কষ্ট পেলেও পরে তোমার কথা শুনে বুঝতে পারি আসলে আমি যা ভেবেছিলাম বিষয়টা সেরকম কিছু ছিল না। মেঝেতে পানি ছিল আর তাতেই স্নেহা আপুর পা পিছলে যায়। কিন্তু মেঝেতে না পড়ে তোমার গায়ে পড়ে যায়। আর তুমি তাকে ধরে ফেল। ঠিক তখনই আমার চোখে পড়ে যায়।
ঈশা থেমে গেলো। ইভান সামনে তাকিয়ে শান্ত সরে বলল
–চিঠির উপরে লেখাটা কার?
ঈশা মাথা নামিয়ে কাদ কাদ সরে বলল
–ঈশান ভাইয়ার। আমি ঈশান ভাইয়া কে সবটা খুলে বলি। ভাইয়া আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে বলে। কিন্তু আমি আব্বুর কাছে শুনেছি তুমি এখনই বিয়ে করতে চাও না। তাই আর তোমার সাথে কথা বলতে চাইনি। নিজে নিজে সব প্ল্যান করে ভাইয়াকে জানাই। ভাইয়া প্রথমে না করলেও আমার জেদের কাছে হার মেনে রাজি হয়।
ঈশা মাথা নিচু করে ফেলল। চোখ বন্ধ করে বলল
–ভাইয়ার কোন দোষ নাই। পরেও আমাকে অনেকবার সবটা বলে দিতে বলেছিল। আমিই তোমাকে বলিনি।
ইভান গ্রিলের সাথে হেলানি দিয়ে দাঁড়ালো। শান্ত দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাল। গম্ভীর গলায় বলল
–কাজটা কি ঠিক হয়েছে?
ঈশা উঠে দাড়িয়ে গেলো। ইভানের সামনে দাড়িয়ে বলল
–সরি। আমি আসলে না ভেবেই করে ফেলেছি।
ইভান নিজের রাগ সামলাতে না পেরে ঈশার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরল। দাতে দাত চেপে বলল
–যতটা অসহায় তুই সাজিস ততটাও নয়। বারবার না ভেবে কোন না কোন কাজ করেই ফেলিস। আর আমি যখন জানতে পারি তখন বলিস না ভেবেই করে ফেলেছিস। আমি প্রথমবারই বলেছি আমার কাছ থেকে তুই কোনদিনও কিছু লুকাতে পারবি না। আজ হোক কাল হোক আমি সব জেনে যাব। তখন কিন্তু আমি তোকে মাফ করবো না।
ঈশা কেদে ফেলল। ইভান তাকে ছেড়ে দিলো। উলটা দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। সামনে দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই কি বুঝতে পারছিস ঠিক কি করেছিস?
থেমে তাচ্ছিল্য ভরা হেসে বলল
–আমার অনুভুতিকে অপমান করেছিস। আমাকে নিজের কাছে ছোট করেছিস। এমন একটা অপবাদ আমার উপরে দিয়েছিস যেটা আমি করা তো দুরের কথা ভেবেও দেখিনি কোনদিন। অদ্ভুত তুই ঈশা। অদ্ভুত তোর ভালবাসা। ঐ চিঠিতে যা লেখা ছিল সব কিছু তোকে উদ্দেশ্য করে লেখা। ওগুলো শুধু লেখা না আমার মনের সব অপ্রকাশিত অনুভুতি। তুই জানিস আমি বরাবর আমার রাগ ভালবাসা সব কিছু প্রকাশ করতেই ব্যর্থ। এই জন্যই আমি কখনও তোকে আমার মনের কথা বলতে পারিনি। কিন্তু তোকে হারাতেও চাইনি। সব সময় আগলে রেখেছি। ভালো রাখার চেষ্টা করেছি। আমি চেয়েছি তুইও আমাকে ঠিক ততটাই ভালবাসতে বাধ্য হ যতটা আমি তোকে ভালবাসি। আমি তোর মনে জায়গা তৈরি করে নিতে চেয়েছি। আর আমি সেটা করতেও পেরেছি। কিন্তু তুই তোর জীবনের সব থেকে বড় সত্যিটা আমার কাছে থেকে লুকিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছিস। আরও বেশী কষ্ট পেয়েছি যখন তুই নিজের জীবন শেষ করে দেয়ার চিন্তা করেছিস। কিন্তু আমি যে তোকে ছাড়া বাচব না। তাই সেই সময় তোর উপরে অধিকার পাওয়াটা আমার কাছে সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেটার কারনেই আমি সেদিন প্রথমবার তোর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে সাইন নিয়েছিলাম। কিন্তু পরের বার তুই যখন আমাকে বিয়ে করার বললি তখন আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আর এভাবে তোর জোর করার কারণটা আমার জানা ছিলনা তাই না করে দিয়েছিলাম। কারন আমি ভেবেছিলাম আমি না করে দিলেই তুই আমাকে সবটা খুলে বলবি। কিন্তু তুই কিছুই বলিস নি। আমিও শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু তোর জেদের কারনে আমি আর কথা বাড়াই নি। ভেবেছিলাম পরে হয়তো তুই আমাকে বলবি। কিন্তু এতদিনেও যখন কিছুই বলিস নি। তখন নিজে নিজেই সবটা জানতে চেষ্টা করলাম। এটা আমার মাথায় খুব ভালভাবে ছিল যে আমার এসব জিনিস তুই ছাড়া আর কেউ খুজে পাবে না। আর পেলেও এরকম ঘটনা ঘটানোর সাহস পাবে না। তার থেকেও বেশী আমাকে ভাবিয়েছিল যে বিষয়টা সেটা হল তোর এতো সহজ ভাবে মেনে নেয়া। তোকে আমি খুব ভালো ভাবে চিনি। এসব বিষয় তুই এতো সহজে মেনে নেয়ার মতো মেয়েই না।
ইভান থেমে গেলো। ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–আমি বুঝতে পারছি আমি কি করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমাকে হারানোর ভয়টা আমার অনেক তীব্র ছিল। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার তোমাকে সবটা বলে উচিৎ ছিল। আমি তোমাকে বলবো না আমাকে মাফ করে দাও। তোমার যা শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে দাও। আমি মেনে নিবো।
ইভান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
–শাস্তি দেয়ার অধিকার কি আমার আছে? শাস্তি তো তুই আমাকে দিয়েছিস। তাও আবার এমন কিছুর যা আমি করিই নি। সেদিন স্নেহা বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর আমি তোকে সব বলেছি। তবুও তুই আমাকে অবিশ্বাস করে আমাকে এমন একটা পরিস্থিতিতে ফেলেছিস যা আমি কল্পনাতেও আনিনি। এটা আমার জন্য খুব কষ্টের বিষয় ঈশা। নিজের উপরে করুনা হচ্ছে আজ খুব।
ঈশা চোখের পানি ছেড়ে দিলো। বলল
–এভাবে বল না প্লিজ। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। যা করেছি তা অন্যায় ছিল কিন্তু তোমাকে হারাতে চাইনি।
ইভান কোন কথা বলল না। সামনেই তাকিয়ে থাকলো। ঈশা তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। অনেকটা সময় পর মৃদু কণ্ঠে বলল
–শুয়ে পড় ঈশা। অনেক রাত হয়েছে।
ঈশা একবার চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাল। আগের অবস্থাতেই দাড়িয়ে আছে। ঈশার নিজের মনেও অপরাধ বোধ তৈরি হয়েছে। সে বুঝতে পারছে ইভান কে চরম ভাবে অপমান করেছে। তার ছেলে মানুষী এবার ইভানের ভালবাসা অনুভুতিকে অপমান করেছে। কিন্তু সে যখন এরকম কিছু ভেবেছিল তখন তার মাথাতেই আসেনি যে বিষয়টা এরকম কিছু হতে পারে। বিয়ের পরে নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেও ইভান কে বলার সাহস হয়ে উঠেনি। এখন মনে হচ্ছে সাহস করে বলে ফেললে হয়তো আজ ইভান তার অবস্থাটা বুঝতে পারতো। ভুল তো ভুলই! এই ভুলের কি কোন ক্ষমা হয় আদৌ?
চলবে…………