#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২১
বিদঘুটে শব্দে ফোনটা নিচে পড়ে সব কিছু আলাদা হয়ে গেলো। ঈশার এতে কোন আক্ষেপ নেই। কারন সে ইচ্ছা করে করেছে। কারন সে চায়না ইভান ফোনটা ধরুক। আর ইভান অসহায়ের মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
–‘এলোমেলো জীবনে গোছালো ভালবাসার উৎস’, ‘অন্ধকার সময়ের আলোর দিশারী’, ‘রংহীন জীবনের রঙ্গিন স্বপ্ন’!
কথা গুলো কানে আসতেই ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশার দিকে। ঈশা হাত গুজে দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে। গাড় গোলাপি রঙের একটা সুতির শাড়ি গায়ে জড়ানো। হালকা সাজ এলোমেলো হয়ে গেছে। চোখে মুখে বউ বউ কোন ভাব নেই। একদম অগোছালো। মুখের ভাব দেখেই বোঝা সম্ভব যে তিক্ত মন নিয়ে বাসর রাতে অপেক্ষমাণ বউ। ইভানের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেলো আবারো ঈশার তিক্ত কথার সরে
–আরও শুনতে বাকি আছে নাকি তাই এতো রাতে ফোন করেছে?
ইভান কোন কথা বলল না। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা আবারো বলল
–কেন ফোন করেছে তোমাকে? কথা না বলে থাকতে পারছিল না?
ইভান দাতে দাত চেপে বলল
–একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছে না?
ঈশা এগিয়ে আসলো ইভানের কাছে। দুই হাতে শার্টের কলার চেপে ধরে বলল
–কোনটা বেশী? জোর করে বিয়ে করাটা নাকি ফোনটা ভেঙ্গে ফেলাটা।
ইভান কোন কথা বলল না। কলার থেকে ঈশার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলো। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হনহন করে ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেলো। দুম করে ওয়াশ রুমের দরজা লাগাতেই ঈশা সস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। এতক্ষনের ভয়টা কেটে গেছে। ঈশা যে প্রচুর ভয় পাচ্ছিল সেটা ইভান বুঝতে পারেনি। আর ঈশাও সেটা লুকাতে চরম বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। এভাবে যে ইভানের সাথে কথা বলতে পারবে সেটা সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যাই হোক এতোটুকু বুঝতে পারলো যে ইভান কে জব্দ করতে হলে এভাবেই আচরন করতে হবে।
ওয়াশ রুমে ঢুকে ইভান আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে। নতুন করে ঈশাকে দেখছে সে। এরকম আচরন মনে হয় স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। ইভান বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। ঈশার কথা শুনে এতক্ষনের এই বিয়ে নাটকের সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো ইভানের কাছে। স্নেহার বিষয়টাকে ঈশা যে এভাবে নিবে সেটা সে ভাবেইনি। যতটুকু বললে ভুল টাকে ঠিক মনে হবে না ইভান সেটাই তাকে বলেছে। সবটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েও দিয়েছে। ইভানের কোন দোষ নেই সেটাও তাকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাহলে কি ঈশা তার কথা বিশ্বাস করেনি? একটা শ্বাস ছেড়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসলো। এসেই দেখে ঈশা একদম নতুন বউয়ের মতো বিছানার মাঝখানে গোল হয়ে বসে আছে। এক পলক দেখে হাত মুখ মুছে বিছানায় বসে পড়ল। ঠিক তখনই ইফতি দরজায় নক করলো। ইভান উঠতেই ঈশা গলা তুলে বলল
–খোলা আছে।
ইভান ঈশার দিকে সরু চোখে ঘুরে তাকাল। ঠিক কি কারনে সেটা ঈশা বুঝতে না পারলেও এমন ভাব করলো যে সেটাকে পাত্তা দিচ্ছে না। ইফতি এসে বলল
–ভাবি আপু মা তোমাদেরকে খেতে ডাকছে।
ইভান হালকা সরে বলল
–যা আসছি।
ইফতি চলে যেতেই ইভান ঈশার দিকে ঘুরে বলল
–চল খাবি।
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমি খাবো না।
ইভান বিরক্ত নিয়ে বসে পড়ল ঈশার সামনে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অসহায় কণ্ঠে বলল
–তুই ঠিক কি চাইছিস ঈশা? কেন এরকম করছিস?
ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–চল আগে খাবি। খেয়ে এসে তারপর নাটক করিস। সারা রাত পড়ে আছে।
ঈশা কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
–আমার ইমোশন এখন তো তোমার কাছে নাটক মনে হবে।
ইভান অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। আবার বসে পড়ল। ঈশার হাত ধরতে গেলেই সরিয়ে নিলো। ইভান অসহায়ের মতো বলল
–তুই আমাকে একটুও বিশ্বাস করিস না। কেন ঈশা? আমি এমন কি করেছি?
ঈশা ছলছল চোখে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল
–বিশ্বাস না করলে আজকে তোমার বউ হয়ে তোমার ঘরে থাকতাম না। বিশ্বাস করি বলেই এসব করেছি।
–তাহলে এই ব্যাবহারের মানে কি?
ইভান নিচের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। ঈশা কেদে ফেলল। চোখের পানি মুছে বলল
–আজ পর্যন্ত কখনও আমাকে বলেছ ভালোবাসো? কেন বলনি? বিয়ে পর্যন্ত গড়াল অথচ ভালবাসি বলতে পারলে না।
ইভান অগোছালো দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা এসব কথা কেন বলছে সেটা বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করে নিলো। ঈশার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলো। নরম কণ্ঠে বলল
–সব সময় কি বলেই বোঝাতে হয়? আমার অনুভুতি গুলো তো তোর বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না। না বলে ভালবাসা যায়না?
ঈশা চোখের পানি ছেড়ে দিলো। ভাঙ্গা মন নিয়ে বলল
–আমি জানি তুমি ঐ চিঠি গুলো স্নেহা আপুকে লিখনি। কিন্তু আমি ওগুলো দেখার পর থেকে নিজেকে কোনভাবেই বোঝাতে পারছি না। খুব এলোমেলো লাগছে নিজেকে। কেমন অস্থিরতা কাজ করছে।
ইভান ঈশার হাত ছেড়ে দিলো। ঈশার অবস্থাটা সে ভালই বুঝতে পারছে। যত কিছুই হোক। ইভান কে তো সে ভালবাসে। আর ভালবাসার মানুষকে নিয়ে অন্য কারো সাথে ভাবার বিষয়টা ভয়ংকর কষ্টের। উঠে দাড়িয়ে বলল
–পুরো হাতের লেখা আমার হলেও শুরুতেই ‘প্রিয় স্নেহা’ লেখাটা কিন্তু অন্য কারো। অবশ্য প্রথম অবস্থায় যে কেউ দেখলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য যে আমি ঐ চিঠি গুলো স্নেহাকেই লিখেছি। আমি যদি তোকেই বিষয়টা ক্লিয়ার করে না দিতাম তাহলে তুই নিজেও বুঝতে পারতিস না। ভাগ্যিস নিজে নিজে বেশী না বুঝে আমার কাছে এনেছিলি। আমি হ্যান্ড রাইটিং ম্যাচ করে না দেখালে তুই কোনদিনও বিশ্বাস করতিস না আমাকে।
ঈশার দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বলল
–চিঠি গুলো তুই কই পেয়েছিলি?
ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–তোমার আলমারিতে একটা খাম ছিল। ঐ খামের মধ্যে অনেক চিঠি আর আমার ছবি ছিল। আমি ওটা বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো দেখার জন্য। কিন্তু আমি পুরটা দেখার আগেই আম্মুর হাতে সেটা পড়ে যায়। আর আম্মুই ঐ চিঠি গুলো আমাকে দেয়।
ইভান বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। ঠোট কামড়ে কিছুক্ষন শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ঈশার দিকে। তারপর ধির কণ্ঠে বলল
–না জানি আমার শাশুড়ি মা কি ভেবে বসেছে? নিশ্চয় ভেবেছে জামাই আমার মেয়েকে রেখে বাইরে আর একটা প্রেম করছে। উফ! তুই কেন ওগুলো বাসায় নিয়ে গেলি ঈশা? আমার মান সম্মান বলে কিছু থাকলো না। আমার ঘরে বসে পড়তিস সব। তাহলেই এতো কিছু হতোনা।
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসলো
–কার জন্য লিখেছিলে ঐ চিঠি গুলো?
ইভান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
–আমার জীবনে শুধু একজনই আছে। এটা সবাই জানে। আমার সব কিছু তাকে ঘিরেই। আমার অনুভুতি, আমার ভালবাসা, চাওয়া, পাওয়া সব কিছু তাকে নিয়েই। এটা নিয়ে এতো সন্দেহ প্রকাশের কিছু নেই। ঐ চিঠি গুলতে কোন নাম লেখা ছিল না। আমি ভেবেছিলাম বিয়ের দিন তোকে পুরো খামটা দিবো। কিন্তু দূর ভাগ্য আমার। আগেই তুই পেয়ে গেলি।
ঈশা আবারো বলল
–স্নেহা আপু তোমাকে পছন্দ করতো তুমি জানতে না?
–স্নেহা আমাকে পছন্দ করে কিনা আমি এসবের কিছুই জানতাম না। এমন কি এসব নিয়ে কখনও মাথাও ঘামাইনি। আমাদের মধ্যে শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিল। আর বন্ধুদের মাঝে ফান হয়েই থাকে। সেদিন রেস্টুরেন্টে তোর সামনেও স্নেহা আর মিলা ফান করেছিলো এটা নিয়ে। আমি সেদিন রেস্টুরেন্টে ওদেরকে ডেকেছিলাম শুধু তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। যাতে সবাই এই বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যায় যে তুই আমার বউ।
এক নিশ্বাসে কঠিন গলায় কথা শেষ করে ইভান একটু চিন্তিত হয়ে গেলো। এবার নরম কণ্ঠে বলল
–আমি ভাবছি তোকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠি গুলো স্নেহা কোথায় পেলো? আর ঐ চিঠির শুরুতে কেই বা ওর নামটা লিখল?
ঈশা বিচক্ষনের মতো বলল
–স্নেহা আপুই যে লিখেছে সেটা তো নাও হতে পারে। অন্য কেউ তোমার ঘরে এসে সেগুলো দেখে তার নাম চিঠির মধ্যে লিখে দিতে পারে। তোমার বন্ধুদের মধ্যেই হয়তো কেউ এমন করেছে। আর সে হয়তো জানতো যে স্নেহা আপু তোমাকে পছন্দ করে।
ঈশার কথা ইভানের কানে গেলেও তার কাছে বিষয়টা সহজ মনে হল না। কারন তার ঘরে বাইরের কেউ সেরকম আসেনা। আর বন্ধুরা তো হাতে গোনা কয়বার এসেছিলো। ঐ চিঠি গুলো ঈশাকে উদ্দেশ্য করে কবে ইভান লিখেছিল সেটাই তার ঠিক মনে পড়ছে না। আর লিখলেও সব সময় সেগুলো ইভান অনেক যত্ন করে লুকিয়ে রাখত। কারন সে কখনই চায়নি এসব অনুভুতি অন্য কেউ জানুক। এভাবে তার আলমারি থেকে চিঠি খুজে বের করে তার লেখা নামহীন চিঠির শুরুতে অন্য কারো নাম লিখে রাখাটা সহজ কথা না। একটা জিনিস খুব ভালো হয়েছে যে চিঠির মুল লেখা গুলো পুরাতন হলেও স্নেহার নামটা খুব রিসেন্ট লেখা। যেটা কলমের কালির ধরন দেখেই বোঝা সম্ভব। আর হাতের লেখাটাও একদম আলাদা। ইভানের সাথে কোন ভাবেই মিলেনা। তাই তো ঈশাকে বিষয়টা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে সে। নাহলে ঈশা বিষয়টা একদম অন্য দিকে নিয়ে যেত। এই ছোট একটা বিষয়েই জেদ করে বিয়ে করে ফেলল। তবে এটা ভেবেই ইভানের অসস্তি বোধ হচ্ছে যে ঈশার মা চিঠি গুলো আগে নিজে দেখে তারপর মেয়েকে দেখিয়েছে। এতদিন ওনার কাছে তৈরি হওয়া সমস্ত ইমেজ এক নিমেশেই মাটিতে মিশে গেলো। ইভানের ভাবনার মাঝেই তার মা আবার ডাকল। ঈশা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে গেলো। ভাজ হওয়া শাড়ীটা ঠিক করে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ইভান একটু দাড়িয়ে থেকে বের হয়ে গেলো। সোজা টেবিলে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ঈশা দাড়িয়ে থাকলো। ইভানের মাও দাড়িয়ে আছে। ঈশা লাজুক সরে বলল
–বড় মা তুমি বস আমি বেড়ে দিচ্ছি।
ইভানের মা কঠিন গলায় বললেন
–তোমাকে এতো পাকনামি করতে হবে না। তুমি বস। আমি দিচ্ছি। সব কাজ তো তোমাকে দিয়েই করাবো। তবে আজই না। একটু সময় দেবো। সবে এসেছ। আগে একটু গুছিয়ে নাও।
ইভানের মায়ের এমন কথা ঈশার কাছে বিরক্তিকর মনে হল। শেষ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলে ফেলল
–তুমি এভাবে কেন কথা বলছ বড় মা? আগে তো এভাবে বলতে না? আর এরকম তুমি তুমি করে কি বলছ? তোমাকে এভাবে কথা বলে মোটেও মানাচ্ছে না।
সবাই হেসে ফেলল। ইভানের মা ভ্রু কুচকে বললেন
–এখন থেকে এরকমি চলবে। ভালো না লাগলেও সহ্য করতে হবে। শাশুড়ি হওয়ার প্রাকটিস করছি।
আরেকদফা হাসির পর সবাই একসাথে খেতে বসলো। খাওয়া শেষ করে সব গোছানোর সময় ঈশা সেখানে দাড়ালেই ইভানের মা ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেয়। তিনি নতুন বউকে আজ কোন কাজেই হাত দিতে দিবেন না। ঈশাও আর উপায় না দেখে ঘরে চলে এলো। এসে দেখে ইভান বিছানায় হেলানি দিয়ে টিভি দেখছে। ইভানের বেডের সামনের দেয়ালে বড় একটা টেলিভিশন রাখা আছে। ইভান সেদিকেই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। ঈশা ঘরে ঢুকে দাড়িয়ে গেলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষন পর ইভান চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ধির পায়ে ঈশার দিকে এগিয়ে গেলো। ঈশা শুকনো ঢোক গিলে পেছাতে লাগলো। দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো। ইভান দু পাশে হাত রেখে একটু ঝুকে বলল
–বলেছিলাম আমি নিরুপায়, সময় প্রয়োজন। কিন্তু দাওনি। আমি এখনও নিরুপায়, কিন্তু এখন আর সময় প্রয়োজন নেই। তোমাকে প্রয়োজন।
চলবে………