শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১৮ + বোনাস পর্ব

0
1901

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৮

হঠাৎ ঘটে যাওয়া কিছু কিছু ঘটনা জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকে। কিছু কিছু মুহূর্ত বিশেষ হয়ে জীবনের ডাইরিতে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। সেসব ঘটনা এক সময় হয়ে যায় সুখময় স্মৃতি। দুইদিন যাবত ভ্যাপসা গরমে জন জীবন বিপর্যস্ত। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে তাল পাকা গরম। দিন ছোট হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে। সেই বিশ্রী গরমে একদল তরুন তরুণী সন্ধ্যে বেলায় ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে। নিজেদের মতো ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের। কাজিনদের আড্ডার মাঝেই হঠাৎ করেই আকাশে বিজলির ঝলকানি চোখে পড়ল। গরম কেটে গিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করা হিম বাতাস বইতে লাগলো। উপরের দিকে তাকিয়ে ইফতি বলল
–বৃষ্টি হবে মনে হয়।

ইলু আর ইরিনা এক সাথে বলে উঠলো
–বৃষ্টি হলে ভিজব। কতদিন বৃষ্টিতে ভিজিনা।

সবাই সম্মতি দিলো। এমন কি ছোট্ট ইরা ইভানের কোলে বসে ছিল। গলা জড়িয়ে বলল
–ইভান ভাইয়া আমিও ভিজব।

ইভান গাল টেনে বলল
–ঠিক আছে। বৃষ্টি আসুক তখন ভিজব আমরা।

খানিকবাদেই অনেক জোরে মেঘ ডেকে উঠলো। ঈশান ঈশাকে বলল
–তুই এক পাশে গিয়ে দাড়া ঈশা। তোর মাথায় বৃষ্টির পানি পড়লে অসুবিধা হবে।

ঈশা নরম কণ্ঠে বলল
–বৃষ্টি আসুক আমি নিচে চলে যাব।

ইভান ঈশার দিকে তাকাল। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কোন কথা বলল না। কিছুক্ষন পরেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। সবাই খুশি হল। ঈশা নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাতে টান পড়ল। পিছনে ঘুরে তাকাল। ইভান তার হাত ধরে আছে। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইভানের দিকে। ঈশা ততক্ষনে কাক ভেজা হয়ে গেছে। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–একটু ভিজলে তেমন কিছু হয়না।

হাত ছেড়ে দিয়ে সবার দিকে তাকাল। সবাই ইভানের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কারন ঈশার বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে ইভানের সব থেকে আগে আপত্তি করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সেই ভিজতে বলছে। ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে ভিজলে মন শরীর দুইটাই ভালো থাকে। তাছাড়াও সায়েন্টিফিক্যালি প্রুভড যে বৃষ্টির পানি ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু বেশী সময় নিয়ে ভিজলে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–জাস্ট ১০ মিনিট কিন্তু!

ঈশা মাথা নাড়ল। ঠোটের কোনে চাপা হাসি। সবাই নিরবতা ভেঙ্গে ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ইরা ইভানের কোল থেকে নেমে গেলো। ইভান রেলিঙ্গে বসে ইরাকে বলল
–টুনটুনি জোরে দৌড়াস না। পড়ে যাবি।

ঈশা ইভানের পাশে গিয়ে বসলো। ইভান হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো ঠিক করছে। ঈশা ইভানের দিকে একবার তাকাল। তারপর তার ঘাড়ে মাথা রাখল। ইভান ঈশার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। মাথাটা ঈশার অনেকটা কাছে নিয়ে গেলো। ইভানের চুল বেয়ে ঈশার মুখে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। বেশ কিছুটা সময় ওভাবেই দুজনের নিরব অনুভুতির আদান প্রদান হল। কিছু সময় পরে ইভান মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল
–আর ভিজতে হবে না। নিচে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে নে। ঠাণ্ডা লাগবে পাখি।

ঈশা কোন কথা বলল না। উঠে ইভানের দিকে একবার তাকিয়ে নিচে চলে গেলো। বাসায় ঢুকতেই ঈশার মা তাকে এভাবে ভিজতে দেখে চেচামেচি শুরু করে দিলো। কিন্তু সেসব কথা ঈশার কানেই গেলনা। তার কানে শুধু ইভানের কথাই বাজছে। সেই সময় ইভান ছাদ নেমে এলো ইরাকে নিয়ে। এভাবে সবাইকে অসময়ে ভিজতে দেখে ঈশার মা আরও রেগে গেলো। ইভান বিচক্ষণতার সাথে পুরো বিষয়টা সামলে নিলো। ঈশার মা আর কিছু বলল না। ইরাকে নিয়ে গেলো ভিতরে। ঈশা দরজার দিকে ঘুরতেই ইভান মৃদু সরে ডাকল।
–ঈশা।

ঈশা ঘুরে তাকাল। ইভান কাছে এসে দাঁড়ালো। আলতো করে কপালে লেপটে থাকা ভেজা চুলগুলো এক আঙ্গুলে সরিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–এত সুন্দর একটা উপহারের জন্য ধন্যবাদ।

কথা শেষ করে ছেড়ে দিয়ে দূরে গেলো। ঈশা দাড়িয়ে থাকল। ইভান সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। কিছুদুর গিয়ে নামতে নামতেই বলল
–আমাকে দেখা হয়ে গেলে দয়া করে চেঞ্জ করে নেন ম্যাডাম।

ঈশা হেসে ভিতরে চলে গেলো। এটা সত্যিই জীবনের সুখময় স্মৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। জীবনের ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখার মতো কিছু ভালবাসার মুহূর্ত।

————
বারান্দার গ্রিলের ফাক দিয়ে মাথা বের করে দেয়া হলুদ অল্কানন্দা ফুলটার গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি লেপটে আছে। কি সতেজ লাগছে। ঈশা চুল গুলো মুছতে মুছতে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির তেজটা কমে এসেছে। মেঘ জমে থাকলেও আগের মতো আর তেমন অন্ধকার নেই। তবে এখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে এই বৃষ্টি থাম বার নয়। একটু এগিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখল ইভান কার সাথে যেন হেসে হেসে গল্প করছে। এখনও ভেজা কাপড়েই আছে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। ঈশা সেই কখন চেঞ্জ করে বেরিয়েছে। এর মাঝে এক কাপ চাও খেয়েছে। চুলের পানি পড়ছিল তাই শুকনো তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইভান এখনও এখানে দাড়িয়ে কি করছে? আর কার সাথেই বা কথা বলছে? এতক্ষন ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠাণ্ডা লাগবে জেনেও সে এখানে দাড়িয়ে গল্প করছে। ঈশা দাড়িয়েই দেখছে। জোরে কথা বলতেও পারবে না। নিষেধ আছে। তাই চুপচাপ দেখছে শুধু। বেশ কিছুক্ষন পর ইভান কথা শেষ করে বাসার ভেতরে চলে গেলো। ঈশা বারান্দায় দাড়িয়েই অপেক্ষা করছে। দৃষ্টি ইভানের বারান্দায় স্থির। ইভান তোয়ালে মেলে দিতে বারান্দায় আসল। ঈশার বারান্দার দিকে খেয়াল করেনি। ঈশা এগিয়ে গিয়ে ক্ষুব্ধ সরে বলল
–কার সাথে এতো গল্প করছিলে?

ইভান ঈশার দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক ভাবে বলল
–বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম। কেন?

ঈশা ঝাঝাল গলায় বলল
–এতক্ষন ধরে কি কথা বলছিলে?

ইভান বিস্ময়কর চোখে তাকাল। ঈশার এভাবে কথা বলার কারণটা বুঝতে পারলো না। নরম কণ্ঠে বলল
–এভাবে রিয়াক্ট করার কিছু নাই। ছেলে বন্ধু ছিল মেয়ে নয়। নাকি ছেলে বন্ধুর সাথেও কথা বলা যাবে না?

ইভানের কথা শুনে ঈশা প্রচণ্ড রেগে গেলো। সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–ছেলে ছিল না মেয়ে সেটা কি আমি জানতে চেয়েছি? আমার চোখ নাই? আমি দেখিনি?

ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–তাহলে? সমস্যাটা কোথায়?

ঈশা ঝাঝাল গলায় একটু জোরেই বলল
–ভেজা কাপড়ে এতক্ষন বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে গল্প করার কি দরকার ছিল? বন্ধু কি হারিয়ে যাচ্ছিলো। পরে কথা বলা জেতনা? বন্ধুকে বাসায় নিয়ে আসতে। চেঞ্জ করে তারপর কথা বলতে।

ইভান কোন কথা বলল না। নিরব দৃষ্টিতে ঈশাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–এরকম ভেজা খোলা চুলে আবেদনময়ী রুপ নিয়ে বারান্দায় আসার কি দরকার ছিল? এরকম হুটহাট বারান্দায় আসা যাওয়া চলতে থাকলে কিন্তু একদিন বারান্দায় আসা বন্ধ করে দেবো। মাথায় থাকে যেন।

ইভানের এরকম ত্যাড়া কথায় চরম রাগ নিয়ে তাকাল ঈশা। সে যা বলতে চেয়েছিল সেটা তো শুনলই না উলটা তাকেই জব্দ করার চেষ্টা করছে। কারন ইভান ভালো করেই বুঝতে পেরেছে ঈশা এখন অযথাই বিষয়টাকে অন্যদিকে নিয়ে যাবে আর ঝগড়া করবে। কিন্তু ইভানের এখন কোনভাবেই ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না। তাই যাতে আর কথা না বাড়ায় সেই জন্যই তাকে একটু রাগিয়ে দিলো। রাগে ফুসতে ফুসতে উলটা দিকে ঘুরে বলল
–অসহ্য একটা!

কথাটা স্পষ্ট রুপে ইভানের কান পর্যন্ত পৌছালো। মুচকি হেসে গলা তুলে বলল
–আমি অসহ্য হই বা অসভ্য! সবটা কিন্তু একজনের জন্যই। আর এই সব কিছু সহ্য করতে সে বাধ্য।

ঈশা থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভানের ঠোটে সেই জ্বালাময়ী হাসি। রাগটা কমার বদলে বেড়ে আরো দিগুন হয়ে গেলো। দ্রুত পায়ে হেটে ঘরে গিয়ে প্রচণ্ড শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাগ কমানর জন্য যা যা করার দরকার সব করলো ঈশা। কিন্তু খুব একটা লাভ হল না। এক সময় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়ল। কোন এক গল্পের বইয়ে পড়েছিল যে রাগ হলে নাকি রবিন্দ্র সঙ্গীত শুনতে হয়। তাহলে রাগটা কমে যায়। তাই ফোনে রবিন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে দিলো। বসে বসে মনোযোগ দিয়ে গান শোনার চেষ্টা করছে। রাগটা কতটুকু কমলো সেটা বোঝার আগেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো চোখে। এতোটুকু ভালো করে বুঝতে পারলো গান শুনলে রাগ না কমলেও ঘুমটা বেশ হয়। উপায় না দেখে বালিশটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়েছিল ঈশা। কতক্ষন ঘুমিয়েছে সেটা বুঝতে পারলো না। কানের কাছে চাপা আওয়াজ শুনে চোখ খুলে ফেলল। ইলু ইরিনা আর ইফতিকে দেখে হুরমুরিয়ে উঠে বসলো। অবাক হল না মোটেই। কারন এরা কখন আসে আর কখন যায় সেটার কোন ঠিক নেই। ক্লান্ত সরে বলল
–তোমরা কখন এলে?

ইলু বলল
–অনেকক্ষণ এসেছি। তুই ঘুমাচ্ছিস তাই ডাকি নি।

ঈশা উঠে ওয়াশ রুমে গেলো। মুখে চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে বের হয়ে এলো। বিছানায় বসে বলল
–কয়টা বাজে?

ইফতি ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল
–৮.৩০ বাজে।

ঈশা চমকে উঠলো। সেই সন্ধ্যা বেলা ঘুমিয়েছে। এখন অব্দি ঘুমাচ্ছিল? আজ নির্ঘাত সারা রাত জেগে থাকতে হবে। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–চা খাবে তো? বানাবো?

ইরিনা বলল
–চা পরে খাবো। আগে ফুচকা, চটপটি এসব খাই।

ঈশা অবাক হয়ে বলল
–এসব কই পেলে?

এর মাঝেই ইলু সব কিছু প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এলো। ঈশা খুব খুশি হল এসব দেখে। সবার সাথে মেঝেতে বসে পড়ল। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে আর খাচ্ছে। খাওয়ার এক পর্যায়ে ঈশা বলল
–কে এনেছে এগুলা?

ইলু একটা ফুচকা মুখে পুরে অস্পষ্ট সরে বলল
–ইফতি এনেছে।

ঈশা ইফতিকে উদ্দেশ্য করে বলল
–অনেক ধন্যবাদ ভাই। খুব মিস করছিলাম। কতদিন খাইনা এসব।

ইফতি মুখের ফুচকাটা শেষ করে বলল
–আমি আনিনি তো। ইভান ভাইয়া এনেছে। আমাকে দিয়ে বলল এখানে নিয়ে আসতে। আর সাথে ইলু আপু আর ইরিনা আপুকেও ডাকতে। তাই আমি সবাইকে ডেকে নিয়ে আসলাম।

ঈশা ফুচকা টা মুখে ঢুকাতে গিয়েও থেমে গেলো। একটু সময় ভাবল। তার মানে তখনের রাগ ভাঙ্গানোর জন্য এই ব্যবস্থা। একটু হেসে বলল
–তোর ভাইয়া কোথায়?

ইফতি খেতে খেতে বলল
–জানিনা তো। আমাকে দিয়েই চলে গেলো।

ঈশা খাবারটা মুখে পুরে দিলো। ফোনটা হাতে নিয়ে ইভানকে একটা এস এম এস পাঠিয়ে দিলো।

“প্রিয় জিনিস গুলোর জন্য পছন্দের মানুষটাকে অনেক ধন্যবাদ। যদি এসব রাগ ভাঙ্গানোর জন্য হয়ে থাকে তাহলে ‘আই এম ইম্প্রেসড’ ! এখন আর রাগ নেই।”

মেসেজটা ডেলিভারড হতেই একটু হেসে আবার নিজের খাবারে মনোযোগ দিলো। খানিকবাদেই আবার ফোন বেজে উঠলো। ইভানের মেসেজ দেখেই মনটা খুশি হয়ে গেলো। ওপেন করে দেখল

“এতো প্রিয় জিনিস গুলোর জন্য শুধু শুকনো মুখে ধন্যবাদ? পছন্দের মানুষ আমাকে কোন উপহার দিলে আমি ধন্যবাদের সাথে যে আরও বিশেষ কিছু দেই। সেই বিশেষ কিছুর অপেক্ষায় থাকলাম। আর হ্যা কেউ দিতে না চাইলেও কোন সমস্যা নেই। আমার যা দরকার সেটা আমি সময় মতো নিজে থেকে নিয়ে নেই। সো! গেট রেডি টু গিভ সাম্থিং স্পেশাল।”

মেসেজটা পড়ে ঈশার গলায় খাবার আটকে গেলো। সবাই তার দিকে তাকাল। ইফতি পানি এগিয়ে দিলো। পানি খেয়ে ঈশা বোতলটা চেপে ধরে ভাবতে লাগলো। ইভান ঠিক কি বোঝাতে চাইল?

চলবে…………।

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
বোনাস পর্ব

সকাল সকাল কারো চাপা গলায় নিজের নামটা উচ্চারণ করতে শুনে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় বসে পড়ল ঈশা। কোথা থেকে এই আওয়াজ আসছে সেটাই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে গভির ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় এলোমেলো লাগছে সব কিছু। কিছুক্ষন বসে থেকে মস্তিষ্ককে ঠিক করে নিতেই আবার কানে এলো নিজের নামটা। ভ্রু কুচকে নিজে নিজে আওড়াল
–এটা তো বড় মার গলা।

পাশের বারান্দা থেকে ডাকছে। দরজা খুলে দেখল গ্রিল ধরে অস্থির ভঙ্গিতে ইভানের মা তার বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। ঈশা তাকে এভাবে দেখে চিন্তিত হয়ে বলল
–কি হয়েছে বড় মা?

ইভানের মা এক প্রকার হাপাতে হাপাতে বলল
–তাড়াতাড়ি একটু বাসায় আয় না মা।

কথাটা শুনে ঈশার বুকের ভিতরে ছ্যত করে উঠলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিপদের আভাষ জানিয়ে দিলো। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কোন সমস্যা হয়েছে? কারো কিছু হয়েছে?

ইভানের মা কাদ কাদ কণ্ঠে বললেন
–ইভানের খুব জ্বর। তুই একটু আয় না।

ঈশা থেমে গেলো। ভয় জড়ানো কণ্ঠে বলল
–আমি আসছি বড় মা। এখনি আসছি।

ইভানের মা ভিতরে চলে গেলো। ঈশা কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে মাথায় ওড়না টেনে বাড়ি থেকে বের হতে গেলেই তার মা জিজ্ঞেস করলো
–এতো সকালে কই যাস?

ঈশা একটু ভাবল। তারপর চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–ইভান অসুস্থ মা। ঐ বাড়িতে যাচ্ছি।

ঈশার মাও আর দেরি না করে মেয়ের সাথে বেরিয়ে গেলেন। বাসায় ঢুকে দেখে সবাই ইভানের ঘরে। প্রচণ্ড জ্বরে কাতর ইভান। কোন হুশ নেই। চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। কাউকে এই মুহূর্তে চিনতে পারছে কিনা কে জানে। মুখ চোখ সব রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। কিছুক্ষন পরেই ডক্টর আসলো। ইভান কে দেখে বলল
–সারা রাত তীব্র জ্বর থাকায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। আমি ইনজেকশন দিচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়বে এখন। নিজে থেকে না উঠা পর্যন্ত ঘুম ভাঙ্গাবেন না। আর জ্বর জতক্ষন নামেনি ততক্ষণ পর্যন্ত মাথায় জলপটি দিতেই থাকবেন। আশা করা যায় কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্বর কমে যাবে।

প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে ডক্টর চলে গেলো। ইভানের মা মুখে আচল চেপে কাদছেন। ঈশার মা তাকে শান্তনা দিতে দিতে বলল
–রাত থেকে ছেলেটার এমন অবস্থা একবার ডাকবেন না ভাবি?

ইভানের মা মৃদু গলায় বলল
–আমিও তো জানতাম না। কখন জ্বর এসেছে কাউকে বলেনি। কিছুক্ষন আগেই আমি ঘরে এসে দেখি কাপছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি প্রচণ্ড জ্বর।

ঈশার মা একটু রুষ্ট কণ্ঠে বলল
–হবেই না বা কেন? কাল অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে সব কয়টা। বকতে গেলাম আমাকেই আরও উলটা বুঝিয়ে দিলো।

ইভানের মা কিছু বলল না। কাদতে লাগলো। ঈশার মা ইভানের মাকে বললেন
–কিছু খেয়েছেন আপনারা?

ইভানের মা না সুচক মাথা নাড়ল। ঈশার মা বলল
–আমি নাস্তা বানাই।

বলেই পা বাড়াতেই ইভানের মা ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তুই এখানে থাক মা। আমি তোর মায়ের সাথে রান্না ঘরে যাই।

ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–যাও। আমি আছি।

সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ঈশা ইভানের মাথার কাছে বসে জলপটি দিতে লাগলো। তীব্র জ্বরের ঘোরে ইভান ঈশার হাত শক্ত করে ধরে বিড়বিড় কি যেন বলল। ঈশার কানে আসলো না। কিন্তু বুঝতে পারলো ইভান খুব করে ঈশাকে কাছে চাইছে। ঈশা একটু ঝুকে মাথাটা বুকে নিয়ে আলতো করে বলল
–আমি তোমার কাছেই আছি। একদম কাছে। চোখ মেলেই আমাকে দেখতে পাবে।

ইভান ঠিক কতটা তার কথা বুঝল সেটা জানা সম্ভব হল না। কিন্তু ঈশার মনে হল তার কথা শোনার পরে ইভানের অস্থিরতা কমে গেলো। গভির ঘুমে তলিয়ে গেলো সে। অনেক সময় পর ইভানের জ্বর নেমে গেলো। সে এখন গভির ঘুমে আচ্ছন্ন। ইভানের মা কয়েকবার এসে দেখে গেছে। এবার এসেছে ঈশার জন্য খাবার নিয়ে। ঈশাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিলো। ঈশা আলতো হাতে ইভানের মাথা টিপে দিচ্ছে। খাওয়া শেষ করে তিনি মৃদু সরে বলল
–আমি চা এনে দিচ্ছি।

ঈশা ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। ইভানের মা চলে গেলো।

————-
কপালে কচি হাতের নরম ছোঁয়ায় ইভানের ঘুম হালকা হয়ে গেলো। প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা করছে। চোখ খুলতেই পারছে না কিছুতেই। এমন হওয়ার কারন বুঝতে না পেরে কষ্ট করে চোখ খুলে ফেলল। সাদা আলো এসে সোজা চোখের মনিতে আঘাত করতেই আবার বন্ধ করে ফেলল। চোখ খিচে বন্ধ করে কিছুক্ষন পর খুলে তাকাল। পাশেই ইরাকে বসে থাকতে দেখল। তার মাথায় হাত দিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–তুই কি করছিস টুনটুনি?

ইরা একটু চমকে গেলো। ইভান যে চোখ খুলেছে সে এতক্ষন বুঝতে পারেনি। চট করে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল
–তুমি উঠলে কেন? আবার ঘুমাও।

ইভান হাসল। উঠে পিছনে হেলানি দিয়ে বসে বলল
–আবার কেন ঘুমাব?

ইরা হাঁটুর উপরে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। ইভানের কপালে হাত রেখে বলল
–তোমার যে জ্বর হয়েছে।

ইভানে ভ্রু কুচকে ফেলল। কাল রাতে শোয়ার সময় শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিল। কিন্তু এখন এরকম টায়ার্ড লাগছে আর মাথা ব্যাথা করছে কেন সেটা ইরার কথায় বেশ ভালভাবে বুঝতে পারলো। ভাবনার মাঝেই ইরা আবার বলল
–মাথা ব্যাথা হইছে। দাও টিপে দেই।

ইভান হেসে ফেলল। ইরাকে কোলে বসিয়ে বলল
–কে বলেছে আমার মাথা ব্যাথা?

–আপু যে টিপছিল এতক্ষন।

ইভান ভ্রু কুচকে নিলো। একটু ভেবে অবাক সরে জিজ্ঞেস করলো
–তোর আপু কোথায়?

ইরা হাস্যজ্জল কণ্ঠে বলল
–ঐ যে।

ইরার কথা শুনে ইভান দরজার দিকে তাকাল। ঈশা অসহায়ের মতো ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান খেয়াল করলো ঈশার সেই অসহায় দৃষ্টি। ঈশা ইরার দিকে তাকিয়ে হতাশ সরে বলল
–বাইরে গিয়ে খেল ইরু। ভাইয়াকে রেস্ট নিতে দে।

ইরা উঠতে নিলেই ইভান থামিয়ে দিয়ে বলল
–থাক না। বিরক্ত করছে না তো।

ঈশা কোন কথা বলল না। বের হয়ে গেলো ইভানের জন্য খাবার আনতে। ইরা কোল থেকে নেমে পাশে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। কিছুক্ষন পরেই ঈশা খাবার নিয়ে আসলো। ইভান চোখ তুলে তাকাল। মুখটা কেমন বিস্বাদ হয়ে আছে। খাবারের গন্ধটাই অরুচি ধরিয়ে দিচ্ছে। বিরক্ত নিয়ে বলল
–খেতে ইচ্ছা করছে না। খাবো না।

ঈশা নরম সরে বলল
–কি খাবে? বল। বানিয়ে দিচ্ছি।

ইভান অবাক চোখে তাকাল। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–থাক কিছু বানাতে হবে না। এগুলাই খাবো। কিন্তু অল্প।

ঈশা বসে পড়ল। ভাত মেখে মুখের সামনে ধরল। ইভান তাকিয়ে আছে। এসব কিছু এক সময় তার কাছে স্বপ্ন মনে হতো। কিন্তু এখন বাস্তবে হচ্ছে। ইভান মুখে খাবার নিলো। ঠোটে প্রশান্তির চাপা হাসি। কয়েকবার মুখে নিয়ে বলল
–আর খাবো না।

ঈশা জোর করলো না। পানি এগিয়ে দিলো। প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসে ইভানের হাতে ঔষধ ধরিয়ে দিলো। ইভান ঔষধ খেয়ে পানির গ্লাস ঈশাকে দিলো। সে গ্লাসটা নিয়ে টেবিলে রেখে ওখানেই দাড়িয়ে থাকল। ইভান ঈশার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–মুড অফ কেন?

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। কোন ভঙ্গিমা ছাড়াই সোজা সাপটা জিজ্ঞেস করলো
–তুমি সিগারেট খাও?

ঈশার মুখে এমন কথা শুনে ইভান চরম বিস্ময়ে তাকাল। তার এই অভ্যাসের কথা বন্ধু মহলের বাইরে কেউ জানে না। বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝেই সখের বসে খাওয়া হয়ে উঠে। কিন্তু ঈশা জানল কিভাবে? ভীষণ রকমের অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা কোনভাবেই প্রকাশ করতে চাইছে না সে। পিছনে মাথাটা ঠেকিয়ে নরম সরে বলল
–মাঝে মাঝে।

ঈশা আবারো কঠিন কণ্ঠে বলল
–আমি জতদুর জানি যারা সিগারেট খায় তাদের জীবনে ডিপ্রেশন থাকে। তোমার জীবনের ডিপ্রেশন কি? আমি?

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল
–এটা কি ধরনের প্রশ্ন ঈশা? সিগারেট খাওয়ার জন্য যে ডিপ্রেশন থাকতেই হবে এমন কোন কথা নাই। আর আমি বলেছি মাঝে মাঝে খাই। সখের বসে। আমি এডিক্টেড না।

ঈশা হাত গুজে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঝাঝাল কণ্ঠে বলল
–আচ্ছা? সিগারেটের প্যাকেট পকেটে রাখার মানে মাঝে মাঝে খাওয়ার অভ্যাস বলে তো মনে হয়না।

ইভান হতবিহবল চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। ঈশা বিষয়টা কিভাবে জানল সেটা এখন স্পষ্ট তার কাছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঈশার মনের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করলো। কিছুক্ষন পরে হাত বাড়িয়ে নরম কণ্ঠে বলল
–আসো।

ঈশা বিস্ময় মাখা দৃষ্টিতে তাকাল। একটা দুইটা নয় হাজারটা ময়ুর পেখম মেলে নেচে উঠলো মনের মাঝে। ভোতা অনুভুতি গুলো ধারালো ফলার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো উচ্চারিত এই একটা শব্দে। ইভান আবার বলল
–নিজে থেকেই আসবা নাকি আমি কাছে যাব। আমি গেলে কিন্তু……

কথা শেষ করার আগেই ঈশা এগিয়ে এসে ইভানের হাত ধরল। কারন ইভান এরপর কি বলবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে সে। ইভান আলতো করে পাশে বসিয়ে দিলো। এক হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল
–মন খারাপের কারন কি শুধু এটাই?

ঈশা নিচে তাকিয়ে আছে। কোন উত্তর দিলো না। ইভান কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো উত্তরের জন্য। তারপর গম্ভির গলায় বলল
–ঠিক আছে। আর কখনও সিগারেট খাবো না। খুশি?

ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–অন্য কারণটা বল এবার।

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–কেন অত সময় বৃষ্টিতে ভিজলে? আমি বললাম সেটা কানেই নিলেনা। আবার রাতে জ্বর এসেছিলো সেটাও কাউকে জানাওনি।

ইভান অপরাধীর মতো বলল
–আমি যখন ঘুমাতে যাই তখন একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু সেটা যে জ্বরের কারনে বুঝতে পারিনি। পারলে ঔষধ খেয়েই ঘুমাতাম। পরে কি হয়েছে সেটা তো আর বলতে পারিনা।

ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা গলায় বলল
–কি অবস্থা হয়েছে সেটা যদি বুঝতে তাহলে এরকম বলতে না।

ইভান অসহায়ের মতো বলল
–আচ্ছা সরি।

ঈশা নিচেই তাকিয়ে থাকল। কোন কথা বলছে না দেখে ইভান ঈশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একটু কাছে টেনে বলল
–এভাবে সরি বলে লাভ না হলে আর কিভাবে বলতে হয় সেটা কিন্তু আমি জানি।

ঈশা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে ফিসফিস করে বলল
–কি করছ? ইরা আছে।

ইভান ঈশাকে ওভাবেই ধরে ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–টুনটুনি ইফতি ভাইয়ার কাছে গিয়ে বল ইভান ভাইয়া চকলেট দিতে বলেছে।

ইরা ইভানের কথা শুনে আর দেরি করলো না। এক দৌড়ে চলে গেলো। ইরা ঘর থেক বের হয়ে যেতেই ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বাকা হাসল। তারপর দুই হাতে ঈশাকে জড়িয়ে কাছে টেনে দুষ্টুমির সুরে বলল
–কোনটা দিয়ে শুরু করবো? আগে রাগ ভাঙ্গাব নাকি অভিমান।

ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান হাতের বাধন আরও শক্ত করে বলল
–এতো সহজ না। তোমার উপরে সবটা ছেড়ে দিয়েছি। তাড়াতাড়ি ডিসাইড করো। যত দেরি করবা তোমার বিপদ তত বাড়বে ঈশা পাখি। আজ তো আমি কোন ভাবেই ছাড়বো না। এতো অভিযোগ আমি আর নিতে পারছি না।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে