#শুক্লাদ্বাদশী
Part–2
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
— তোদের বাসায় এই অপরিচিত যুবকটা কে রে? তোর প্রেমিক?
অচেনা এক কন্ঠস্বরে যখনি একজন নারী এই কথাগুলো বললো, আরোশ তড়িৎ গতিতে মেয়েটার কাছ থেকে নিজের বাঁধন ছিন্ন করে দূরে সরে এসে দাঁড়ায়।
সে অপরিচিত মেয়েটার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলো। তারই বয়সী বোধহয় মেয়েটা!
লম্বা শ্যামলা পরনে কমলা শাড়ি, চুল খোপা করা।
মেয়েটা আবারো বলে উঠে, কি রে দুর্গা কথা বলছিস না কেন? কে হয় এই ছেলে তোর? কাকা কোথায়?
আরোশের বুকে কম্পন বয়ে গেল। মেয়েটার নাম কি দুর্গা?
আরোশ খেয়াল করলো, কমবয়সী মেয়েটা বলে উঠে, বাবা বাসায় নেই।
মধ্যবয়সী মেয়ে চটজলদি বলল, সর্বনাশ! ফাঁকা বাসায় একটা ছেলেকে ঢুকতে দিয়েছিস কেন? আমি না এসে অন্য কেউ চলে এসে এই দৃশ্য দেখলে কি হত ভাবতে পারছিস তুই? যা নিজের ঘরে যা! আর এই ছেলেকে বিদাই কর৷
আরোশ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। এ তো দেখি বিরাট মসিবত! তাকে নাকি বের করে দিবে? বের করে দিলে সে যাবে কোথায়? এই দুটো মেয়ের কথোপকথন শুনে মনে হচ্ছে, সুদীপ সাহেব বাড়ি নেই। আরোশ আসবে এই খবর কেবল তিনি জানেন। আর এখন উনার অনুপস্থিতিতে সে কি করবে? সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো।
কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিলো। ঠিক সেই সময় বাড়ির কর্তা সুদীপ মল্লিক এক ডজন সাগর কলা হাতে বাড়ি ফিরে এলেন। মুখটা তার কালো হয়ে আছে।
বাবার কালো মুখ দেখে দুর্গা চমকে উঠে। বাবার কি কিছু হয়েছে?
সে এগিয়ে যায় বাবার দিকে। সুদীপ মল্লিক দুর্গাকে দেখে মেকি হেসে বলে, মা! কলপাড় থেকে পানি এনে দে তো। পায়ে কাদা লেগেছে। পরিষ্কার করব৷
দুর্গা ছুট লাগায় কলপাড়ের দিকে।
আরোশ বড় বড় পা ফেলে সুদীপ মল্লিকের কাছে গিয়ে কথা বলতে লাগে। সে পেছনে না তাকিয়েই বুঝে ফেললো, মধ্যবয়সী মেয়েটা আড়ি পেতে তার কথা শোনার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এজন্য সে আওয়াজ নিচু করে বলে, সুদীপ সাহেব! কেমন আছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন?
সুদীপ মল্লিক চশমার ফাঁক দিয়ে লম্বা ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। গায়ের রং ময়লাটে ধরনের। চেহারা রোদে জ্বলে গেছে।
ছেলেটা যে একসময় ফর্সা ছিলো তা সে দিব্যি টের পেয়ে গেল। কেমন শীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুক্ষ্ম ত্বকের অধিকারী ছেলেটাকে সে চিনলো না। তাই বলে উঠে, তুমি কি মোড়ল বাড়ির ছেলে?
— না।
ছেলেটার জবাব এতোটাই শক্ত ছিল যে সে পুনরায় ছেলেটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো যেন সে ভুল বলায় ঘোর অপরাধ হয়েছে। সে মস্তিষ্কে জোর দিচ্ছে কিন্তু নাহ কিছুতেই মনে করতে পারছে না যে ছেলেটা কে? তিনি কৌশলে বললেন, তাহলে নিশ্চয়ই রায় বাড়ির ছেলে?
আরোশ মুখ শক্ত রেখে বলে উঠে, কাওছার ভাইয়ের সঙ্গে আপনার কথা হয়নি?
সুদীপ মল্লিক কাওছারের কথা শুনে চমকে উঠে। চোখে মুখে একধরনের প্রফুল্লতা গ্রাস করে ফেলে।
সে তাড়াহুড়ো করে বলে, তুমি আরোশ?
— জি।
— আমার বিশ্বাস-ই হচ্ছে না তুমি আমার বাড়িতে এসেছো বাবাজান।
— আসার তো কথা ছিল।
— তবুও। আসো ভেতরে আসো।
আরোশ লক্ষ্য করলো, বয়স্ক এই লোকটার চেহারায় আনন্দ ভাব ফুটে উঠেছে। কাউকে আনন্দিত হতে দেখলে আরোশের ও আনন্দ লাগে৷
তখনি দুর্গা একটা কলসিতে করে পানি এনে ধাম করে মাটিতে ফেলে বলে, বাবা, এই যে পানি। পা ধুয়ে ঘরে আসো। বাইরে প্রচন্ড গরম৷
সুদীপ মল্লিক কলসি থেকে পানি ঢেলে পায়ে লেগে থাকা কাদা ধুয়ে ফেলে দুর্গার উদ্দেশ্য বলে উঠে, ভাত বেড়ে ফেল।
— এখন?
— হ্যা।
দুর্গা অবাক না হয়ে পারলো না। পাত্রপক্ষের বাসা থেকে বাবা না খেয়ে ফিরেছে? বিকেল পাচটা তো বাজেই। এক বেলায় বাবা ভাত খেতে চাচ্ছেন কি জন্য?
তিনি আবারো বলে উঠে, দুইজনের জন্য খাবার বেড়ে দে।
— আচ্ছা।– কথা শেষ করে দুর্গা বাসার ভেতরে ঢুকতে গেলেই রোজিনা আপার তীক্ষ্ম নজরের ভাগীদার হলো।
দুর্গা মৃদ্যু হেসে বলে, আপা ভাত খাবি?
রোজিনা মুখ বাকিয়ে বলে উঠে, রাখ তোর ভাতের কথা। এই ছেলেটা কে রে? আমার একে কেমন যেন উদ্ভট লাগছে?
দুর্গা বলে উঠে, তোমার উদ্ভট লাগছে? আমার তো বানরের মতো লেগেছে।
রোজিনা আপা মুখ বাকিয়েই বলতে লাগে, গ্রামের কোন খরব রাখিস তুই?
দুর্গা বলে উঠে, কেন কি হলো আবার?
— দুই গ্রাম পর রাখাল পাড়ায় পাকিস্তানী বাহিনী ক্যাম্প বানাচ্ছে। সাত দিন পর নাকি চৌদ্দ জন পাক সেনা টহলে আসবে।
দুর্গা আতকে উঠে বলে, বলো কি আপা! দুই গ্রাম মানে আমাদের খুব কাছাকাছি তো।
— হ্যা রে।
— এখন কি হবে আপা আমাদের?
— জানি না রে। শুনলাম আমাদের গ্রাম থেকে নাকি পাকিস্তানি বাহিনীদের সাহায্য করছে৷
— কে?
— জানি না। শোন তুই সাবধানে থাকবি৷ ঘর থেকে বেরুবি না এক্কেবারে। বুঝেছিস?
— তুমিও বের হবে না আপা।
রোজিনা স্মিত হেসে বলে, আমার চিন্তা করতে হবে না। জানিস?
— কি?
— শফিক নাকি যুদ্ধে যাবে৷
কথাটা খুব ধীর গলায় বলে রোজিনা আপা।
দুর্গা চোখ গোল গোল করে অবিশ্বাসের সুরে বলে, আমাদের শফিক ভাই?
— তো আর কে? এই গ্রামে ওর মতো পাগলাটে আর কেউ আছে?
দুর্গা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো রোজিনার কথায়৷
রোজিনাকে দেখে মনে হচ্ছে, শফিক যুদ্ধে নাম দিবে শুনে সে খুব খুশি।
দুর্গা বলে উঠে, আপা যুদ্ধ কিভাবে করে?
রোজিনা ভ্রু কুচকে বলে, তোর এসব জেনে কি লাভ? শোন! ভুলেও বাসার বাইরে যাবি না। ঘরে থাকবি। অপরিচিত কারো ডাকে সাড়া দিবি না।
— আচ্ছা।
রোজিনা আবারো কি যেন ভাবলো, তারপর বলে উঠে, জানিস! শফিক বললো, মুক্তিযোদ্ধারাও নাকি আসবে আমাদের গ্রামে।
দুর্গার চোখ মুখ ঝিলিক মেরে উঠলো। মূহুর্তে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে। সে কম্পিত গলায় বলে, মুক্তিযোদ্ধারা আসবে?
— শুধু কি আসবে নাকি! পাকিস্তানি দের নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে দেখে নিস! খেলা তো মাত্র শুরু রে!
দুর্গার ছোট্ট সহজ-সরল মনে গেঁথে গেল “মুক্তিযোদ্ধা” শব্দটা। আচ্ছা এই শব্দটা এতোটা পবিত্র কেন? কেন মুক্তিযোদ্ধা দের কথা ভাবলে তার চোখে পানি চলে আসে। দুর্গা মনের ক্যানভাসে মুক্তিযোদ্ধার ছবি আঁকার চেষ্টা চালানো। তার মনের মুক্তিযোদ্ধাটার পরনে প্যান্ট-শার্ট। মাথায় গামছা বাধা। রোদে মুখ, হাত পুড়ে গেছে। বেশ লম্বা। রাইফেল হাতে তাড়া করছে দুষ্টু পাকিস্তানি দেরকে।
তার ভাবনার সুতো ছিন্ন হলো বাবার ডাকে। বাবা বলে উঠে, দুর্গা মা! কই হাওয়া হলি! ছেলেটা অপেক্ষা করছে। ভাত নিয়ে আয়।
দুর্গা সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে দুপুরের ভাত আর কাঁচা কাঠালের তরকারি নিয়ে উঠানের দিকে হাঁটা দিলো৷
সুদীপ মল্লিক অতিরিক্ত উত্তেজনা নিয়ে আরোশকে বলে উঠে, বাবাজি, নাও চারটে ভাত খাও।
আরোশের প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। সকালে একটা কলা খেয়েছে। এরপর এখন বেলা ডুবলো বললেই চলে কিন্তু পেটে একটা দানা ও জোটেনি। খাবারের ঘ্রাণ নাকে আসতেই ক্ষুধা মশাই যেন পেটের ভেতর হরতাল শুরু করে দিলো।
দুর্গা প্লেট এগিয়ে দিতেই সে কোন দিকে না তাকিয়ে গোগ্রাসে ভাত গিলতে লাগলো। কাঠালের তরকারি ও যে এতো অমৃত হয় তা জানা ছিল না আরোশের।
দুর্গা ছেলেটাকে এভাবে খেতে দেখে বেশ বিরক্ত হলো। সে বলল, আস্তে ধীরে খান। আপনার ভাত কেউ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে না।
বাচ্চা মেয়েটার মুখে এমন কথা শুনে আরোশ বেশ লজ্জা পেল৷ অপমানিত বোধ করল। এই জন্য খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
সুদীপ মল্লিক দুর্গাকে ধমক দিয়ে বলে, বড়দের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে নেই৷ সম্মান দিয়ে কথা বলবে।
দুর্গা বিড়বিড়িয়ে বলে।,সম্মান না ছাই! হুহ, উনি হলো গিয়ে একটা লম্পট ধরনের দুষ্টু লোক। ওনার তো মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না।
সুদীপ মল্লিক বলে উঠে, কিছু বললে নাকি?
দুর্গা মেকি হেসে বলে, বাবা পাত্রপক্ষরা ক বললো?
সুদীপ মল্লিক উদাসিতা ভরা কন্ঠে বলে, নাকজ করে দিয়েছি এই প্রস্তাব।
দুর্গা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। স্বপ্ন লাগছে সবকিছু। মূহুর্তের মধ্যে সকল দুঃখ, কষ্ট কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। ভগবান নিশ্চয়ই তার প্রার্থনা শুনেছে৷
চলবে।