#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগীতা_নভেম্বর_২০২০
শিরোনাম_শিবেন_বাবুর_বাগানে_ভূত
কলমে_নির্মলেন্দু_মাইতি
#তাং_২_১১_২০২০
:প্রথম অধ্যায়:
সুনীল সুন্দর বনের রায়দীঘির নন্দ কুমার পুরে থাকে। দুটি ছেলে মেয়ে আর স্ত্রী সন্ধ্যা কে নিয়ে দুঃখ কষ্টে বেশ দিন কাটে। নদীর বাঁধের ধারে স্বপ্নের কুঁড়ে ঘরে। বিঘে দুয়েক জমিতে সবজি চাষ করে। মঙ্গলবারে সূর্য্য পুরে হাট বসে। বাড়ি থেকে হাট প্রায় আট ক্রোশ দূরে। আকাশে বেশ মেঘ করেছে। সকাল আটটার দিকে সুনীল সবজি ঝুড়িতে করে মাথায় নিয়ে হাটে যায়।হাট বসে দুপুর একটার দিকে। ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। লোকজন বেশী না থাকায় সস্তায় সব কিছু বিক্রি করে । প্রায় সন্ধ্যা নামবে এমন সময় সুনীল বাড়ির দিকে রওনা দেয়। একটু পরে বৃষ্টি থামলে ও ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে। দূরের গ্রাম গুলিতে টিম টিমে লম্ফ আর হ্যারিকেনের আলো জ্বলে উঠে। বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে এসেছে। একটা ফাঁকা মাঠে হঠাৎ দূরে দেখতে পায় একটি আলো জ্বলছে আর নিভছে। আগে সুনীল এমনটা কখোনো দেখেনি।ভয় পেয়ে ও ঘামতে থাকে। একেই পিছল রাস্তা । চারদিকে ভয়ংকর শব্দের সমাহার।শন শন করে বাতাস বইছে।জোনাকির আলো কেমন যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সুনীল অনেক বার পা পিছলে পড়েছে। কর্দমাক্ত শরীর। না চাইলে ও ঐ আলোর দিকে ওর বার বার নজর যায়। দেখে মনে হয় কোন ছায়া নৃত্য করছে। কিছু দূর যাওযার পর ওর পায়খানা পায়। ভাটার টানে নদীর জল অনেকটা নিচে নেমে গেছে। ছাটুয়ার গ্রাম পেরিয়েছে। হঠাৎ ওর মনে হয় কেউ যেন পিছনে আসছে। ভয় পেয়ে সুনীল মনের জোর বাড়ায়।এখনো ওকে চার ক্রোশ পথ যেতে হবে। আকাশে অষ্টমীর চাঁদ, কালো মেঘের ফাঁকে উঁকি দেয় মাঝে মাঝে।সুনীল পায়খানার বেগ সামলাতে না পেরে মাথার ঝুঁড়ি বাঁধের উপর রাখে। নিচে নেমে পায়খানা করার পর কাদায় হেঁটে অনেকটা নিচে নদীর জলে শৌচ করে। সামনে তাকিয়ে দেখে নদী থেকে কেউ যেন দুহাত দুলিয়ে ওর দিকে আসছে।এবার উপরে আসতে গিয়ে আবাক হয় । কেউ যেন ওকে টেনে ধরেছে। প্রান পণ চেষ্টা করে এগিয়ে যাওযার। বহু চেষ্টায় কাদা হাতড়ে অবশেষে খেজুর গাছ ধরে উপরে উঠে। এবার ছুট লাগায় প্রানপণে। পড়ে যায় বার বার। মনে হয় কেউ যেন ওর সঙ্গে ছুটছে। ওকে ধরবে বলে। যেতে যেতে মনে পড়ে সামনে শিবেন বাবুর বাগানে ভূত থাকে। অনেক মানুষকে মেরে ফেলেছে। সুনীল ভয় পেয়ে ছুটতে থাকে জোরে আরো জোরে। কোন অশরীরী আত্মা বলে উঠে , তোকে আমি খাব আজ রাতে। জীবনের পণ রেখে সুনীল আরো জোরে ছুটতে থাকে। গ্রামের আলো নিভে যায়। সুনীল বুঝতে পারে ও পথ হারিয়েছে। দিশেহারা সুনীলের তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়। ঠোঁট শুকিয়ে যেন আমচুর হয়ে গেছে। হঠাৎ ও বাঁধের উপর বসে পড়ে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। হঠাৎ এক আলো দেখে মনে হয় কেউ যেন ওর দিকে ছুটে আসছে। উঠে আবার ছুটতে থাকে। সামনে একটি সাঁকো। দুটো বাঁশ খুঁটি দিয়ে বাঁধা । নদী পারাপারের জন্য। বাড়ির কাছে সাঁকোর কথা মনে পড়ে। সুশীলের মন আনন্দে মেতে উঠে। এবার সাঁকো দিয়ে যেতে গিয়ে সুনীল পড়ে যায় নদীতে। বাড়ির লোকজন ভাবে সুনীল হাটের ওখানে রাতে থেকে গেছে। সকাল বেলায় লোকে দেখে সুনীল নদীর জলে পড়ে আছে। নিম্নাঙ্গে কোন পোশাক নেই। গ্রামের লোকেরা কাপড় ঢাকা দিয়ে দেয়। পুলিশ মৃত দেহ নিয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা বলে শিবেন বাবুর বাগানের ভূত ওকে খেয়েছে। সুনীলের স্ত্রী আর ছেলে মেয়েরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। গ্রামের ছেলে মেয়েরা সাঁকো পেরিয়ে আর স্কুলে যায় না। পোষ্টমর্টেমের রিপোর্ট থেকে জানা যায় সুনীল হৃদরোগে মারা গেছে।মাথায় আঘাতের চিহ্ন ও আছে।
:দ্বিতীয় অধ্যায়:
গ্রামের লোকেরা আলোচনা সভা ডাকে।ভূতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। শিবেন বাবু গলায় দড়ি দিয়ে মরেছেন। তাঁর আত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায়। আত্মার শান্তি না করলে গ্রামের কেউ বাঁচবে না। সিন্ধান্ত হয় শিবপুর গ্রামের তান্ত্রিকের পরামর্শ নেওয়া হবে। কিন্তু কে যাবে? উনি রাত্রি ছাড়া কারোর সঙ্গে কথা বলেন না। গগন বাবু রাজি হন। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। ফোকলা দাঁত। টাক মাথা। গাল ভর্তি দাড়ি। হাতে লাঠি। উনি বললেন, একজন কে সঙ্গে যেতে হবে। কেউ রাত্রে জীবনের বাজি রেখে যেতে রাজি হচ্ছে না। অবশেষে বুধো পাগলা কে টাকা দিয়ে রাজি করানো হল।
পরের দিন সন্ধ্যা পাঁচ টার দিকে গগন বাবু ,বুধো রওনা হলেন। বুধোর হাতে টর্চ। লাঠি ঠুকে গগন বাবু সামনে চলছেন। প্রায় দু ক্রোশ পথ পেরিয়ে যেতে হবে। ফাঁকা মাঠে তান্ত্রিকের ডেরায় পৌঁছুলেন। ঘুটঘুটে অন্ধ কার। কুকুর শেয়ালেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে ওখানে হাড় গোড় ছড়িয়ে। বট গাছের নিচে হোগলার ছাউনি। ভেতরে সীতেশ্বর তান্ত্রিক সাধু বসে রয়েছেন ধ্যানে। কপালে লাল তিলক। পরনে কৌপিণ। মাথায় জটা। দাড়ি ঝুলে পড়েছে অনেক টা। ভুঁড়ি খানা কোলের উপর। সামনে অগ্নিকুন্ড। ত্রিশুলের উপর হাত। মাথার খুলি সামনে রাখা। মশাল দাউ দাউ করে জ্বলছে। বুধো ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। গগন বাবু ও বেশ ভয় পেয়েছেন। হঠাৎ তান্ত্রিক বলে , –
বোম কালী! মা! মা ! গো।
গগন বাবু কিছু বলার আগে তান্ত্রিক বলে, – -বুঝেছি , তোরা কেন এসেছিস।
গগন বাবু বলেন, বলছিলাম কি!
ধমক দিয়ে তান্ত্রিক বলে,
– তুই কি বলবি? জয় মা কালী।
শিবেন বাবুর আত্মার শান্তির জন্য সন্তুষ্ঠি যজ্ঞের ব্যবস্হা কর। রক্তের প্রয়োজন। আগামী কৌশিকী অমাবস্যায় এই যজ্ঞ করতে হবে। তোদের শ্মশানে আমি রাত্রে পৌঁছে যবো। গগন বাবুকে কাছে ডেকে কানে কানে তান্ত্রিক কিছু বললো। তারপর সাবধান করলো। খবরদার কোন কথা যেন পাঁচ কান না হয়।
তিন জন শ্মশানে রাত্রে চলে যাবি। গগন বাবু বাড়ি ফেরেন ভোর রাত্রে। তিনি কাউকে কিছু না বলে যজ্ঞের ব্যবস্থা করেন। সাত দিন পর কৌশিকী অমাবস্যার দিন রাত্রি আট টার দিকে গগন বাবু, বুধো আর এক নাপিত যজ্ঞের উপাচার নিয়ে শ্মশানে যান।
রাত্রি দশটা নাগাদ তান্ত্রিক শ্মশানে আসে। মড়ার খুলি তিনটে, যজ্ঞ কুন্ডের সামনে রাখা । চার দিকে ঝোপ ঝাড়, নানা নিশাচর জন্তু ছুটে যায় এদিক ওদিক। তিনটে মশাল জ্বলছে দাউ দাউ করে। সামনে বলির জন্য যূপকাষ্ঠ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তান্ত্রিক আধ পোড়া মড়ার উপর বসে । যজ্ঞ শুরু হয়েছে। ওঁ!হিং!ক্রিং !ছট !! জয় মা কালী!! দরাজ গলা । চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
এমন সময় দূর থেকে তীব্র আলো দেখা যায়। তান্ত্রিক বলে সাবধান শিবেনের আত্মা আসছে। সবাই ভয় পায়। তান্ত্রিক বলে, -ব্যাটা ভয় নেই আমি আছি।
দেখতে দেখতে আলো নিকট হয়। জোরে তান্ত্রিক মন্ত্র পড়তে থাকে। জনা দশেক পুলিশ ওদের ঘিরে ফেলে। তান্ত্রিক পালিয়ে যায়। পুলিশ গগন বাবু কে জেরা করে। গগন বাবু বলে এখানে নর বলী হত না। ছাগ বলী হত। যারা নর বলীর কথা বলেছে তা গুজব। পুলিশ ওদের নিয়ে গ্রামে আসে। গ্রামের কেউ ঘরের বাইরে বেরোয় না । পরে পুলিশ ওদের ভূতের গুজবে কান দিতে বারন করে।
:তৃতীয় অধ্যায়:
গ্রামের ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছেনা । পুলিশ প্রশাসন গ্রামবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করে । ভূত নয় ভয়ে হৃদরোগে সুনীলের মৃত্যু হয়েছে। এতে কাজের কাজ কিছুই হয়না।
বিজ্ঞান মঞ্চের লোকজন এসে গ্রামের লোকেদের বোঝায়। সুনীল রাত্রে যে ভূতের নৃত্য দেখেছিল । আসলে শ্রাদ্ধের সময় একটা আলো জ্বালিয়ে মৃত প্রিয়জনের জন্য খাবার উৎসর্গ করার নিয়ম আছে। ফাঁকা মাঠে এই খাবার দেওয়া হয়। সেই খাবার কুকুর শেয়ালে খায়। তারা লড়াই করে। তার পর বাতাসে আলোর শিখা দোলে।তাই আলো ছায়া থেকে মনে হয় কেউ নাচছে। এটা মনের ভ্রম। ভয়ে সুনীলের মাথা কাজ করেনি। তাই পথ ভুলে এদিক ওদিক ছুটছিল। আকাশে চাঁদের আলোয় খেজুর গাছের ছায়া পড়ে ছিল নদীর জলে। খেজুর গাছ বাতাসে দুলছিল। তাই মনে হয়ে ছিল জল থেকে কেউ যেন হাত দোলাচ্ছে। শৌচের সময় সুনীলের পা লুঙ্গির সঙ্গে বেঁধে গিয়ে ছিল। তাই ওর মনে হয়ে ছিল ওকে কেউ টানছে। লুঙ্গি ছাড়াই সুনীল ছুটে ছিল। ভয়ে সাঁকো দিয়ে যেতে গিয়ে সুনীল পা পিছলে পড়ে যায়। মাথায় আঘাত লাগে। ভয় ,জলের অভাব ও আঘাতের জন্য ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
তান্ত্রিক, গুনিণ এসব বুজরুকি। এসবে কান দেওয়া উচিত নয়।
নন্দ কুমার পুরের ছেলে মেয়েরা এখন স্কুলে যাচ্ছে। সুনীলের স্ত্রী স্কুলে মিড ডে মিল রান্না করছে।