গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
টপিক : কষ্টের গল্প
শিরোনাম: আক্ষেপ
রচনায় : আইনুন রাফিয়া
রাত ১১:৩০ বাজে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। মাঝেমধ্যে খানিকটা মৃদুল হাওয়া এসে গুমোট পরিবেশ হালকা করছে। মনোযোগ দিয়ে কান পাতলে ঝিঝি পোকার আওয়াজ শোনা যায়। দূরে কোথায় যেন রোড লাইট জ্বলজ্বল করছে তবুও এই নিস্তব্ধ আধার যেন প্রতি মুহুর্তে গহীন অন্ধকারে পরিণত হচ্ছে। বাসার দেয়াল ঘড়িগুলো প্রহর গুনছে কখন ১২ টা বাজবে আর ঢংঢং আওয়াজ করে সময় জানিয়ে দেবে। গ্রাম এলাকা হওয়ার দরূণ অম্রপাড়ার লোকজন রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। আজকেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। শুধু একজন ব্যক্তির চোখে ঘুম নেই। আর কোনোদিন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে কিনা সন্দেহ! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছা হচ্ছে তার। কিন্তু এক অজানা ভয় তাকে চিৎকার দিতে বাধা দিচ্ছে।
ক্রিং ক্রিং। একটু পর পর ঘড়িতে এলার্ম বাজছে আর ইশমাম বন্ধ করছে। হঠাৎ মুঠোফোনের রিংটোন বেজে উঠল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে কল রিসিভ করল ইশমাম।
“হুম , কে?”
“কে মানে? আমি রাফসান।”
“ওহ সরি, আসলে ঘুমাচ্ছিলাম। খেয়াল করিনি। শুনছি বল কি বলবি।”
“কি বলবো মানে? ৮:৫০ বাজে, আর ১০ মিনিট পর প্রেজেনটেশান শুরু হবে। স্যার একবার এসে দেখে গেছেন।”
“ওহ নো, আমার একদম মনে ছিল না। সারারাত প্র্যাকটিস করে ভোর ৪ টায় ঘুমাতে আসলাম। আচ্ছা আসছি আমি এখুনি,” এই বলেই এক লাফে বিছানা থেকে উঠে পড়ল ইশমাম। দ্রুত সব কাগজপত্র গুছিয়ে তৈরী হয়ে গেল। যেই বাসা থেকে বের হল অমনি মনে পড়ল ঘড়ি নিতে মনে নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার বাসায় ঢুকবে অমনি দেখল আম্মু ওর পেছনেই ঘড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছেন।
“এই নে ঘড়ি আর না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস? ভেতরে আয়, খেয়ে তারপর যাবি।”
“আরে এখন খাওয়ার সময় আছে নাকি? ৯ টা থেকে প্রেজেন্টেশন শুরু হবে আমার। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।”
“সকালবেলা না খেয়ে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়বি। দুপুরে তো বাইরে খাবি ওই হাবিজাবি ফাস্টফুড। তোর ভালর জন্যই বলছি। একটু খেয়ে যা। আর দেরী হলে সমস্যা নেই। স্যারের ফোন নাম্বারটা দিবি । আমি কথা বলব ওনার সাথে।”
“এতোই যখন আমার ভালোর চিন্তা করো তাহলে সকালে ডাক দিলেই পারতে। তাহলে আর দেরী হতো না আমার। আর কী বললে? স্যারের সাথে কথা বলবে? স্যারের সাথে কথা বলার মতো যোগ্যতা আছে তোমার?” তাচ্ছিল্যের সুরে অনর্গল কথাগুলো বলে গেল ইশমাম। প্রতিটি কথা তীরের মতো গিয়ে বিধল আম্মুর মনে। তাৎক্ষণিকভাবে সামলে নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন,
“না আমি আসলে ভোরবেলা ডাকতে গেলাম। তুই বললি আজ ক্লাস নেই। তাই ভাবলাম একটু আরাম করে ঘুমিয়ে,” কথা শেষ হওয়ার আগেই হনহন করে চলে গেল ইশমাম। ছেলের চলে যাওয়া দেখে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আম্মু। মনে মনে দোয়া করতে থাকলেন সাবধানভাবে পৌছে যেন প্রেজেন্টেশান ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারে।
বিকেলের শেষভাগে সূর্য আস্তে আস্তে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়তে আরম্ভ করল। পাখিরা যার যার নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত। সন্ধ্যাতারার আগমন ঘটবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। ইশমাম ক্লান্ত শরীরে দরজায় কড়া নাড়ার আগেই আম্মু দরজা খুলে দিলেন যেন অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন কখন ছেলে বাসায় ফিরবে।
“কেমন হল প্রজেন্টেশন?”
“ভালো। ”
“তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।”
“আমি খেয়ে এসেছি।”
“ওহ্,” ছোট্ট একটা শব্দে যেন অনেক আক্ষেপ ঝড়ে পড়ল আম্মুর কন্ঠে। এই আক্ষেপ ছেলেকে নিজের হাতের রান্না না খাওয়াতে পারার।
“আমি ভাবলাম তুই আজকে বাসায় খাবি। এতোকিছু আয়োজন করলাম।”
“আম্মু বুঝতে পারছো না কেন আজকে শেষ প্রেজেন্টেশন ছিল। তাই সবাই মিলে একসাথে খেলাম হামিমদের বাসায়।”
“তাই নাকি? যাক ভালো, বাসার খাবার তো খেয়েছিস। বাইরের খাবার বেশি খেলে অসুস্থ হয়ে যাবি। তোর বন্ধুদের একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে আসিস।”
“কিভাবে আনবো বলো আমাদের এই ছোট্ট বাসায়? হামিমের আম্মু অফিসে চাকরি করেন। আমাদের সাথে কত সুন্দর করে ইংরেজিতে কথা বললেন। আর তোমার কি পরিচয় করাবো ওদের সামনে? বলব যে আমার মা একজন নগণ্য প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক? আমি টিউশন করিয়ে নিজের খরচ চালাই কারণ আমার মায়ের সামান্য বেতনে বাসা ভাড়াটাই ঠিকমতো দেয়া যায় না।ওদেরকে আমি বাসায় আনিনা শুধুমাত্র তোমার কারণে। একটু গুছিয়ে কথাটাও বলতে পারবে না তুমি।” ঝাঝালো কন্ঠে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে গেল ইশমাম। শূন্য দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়া দেখলেন আম্মু। চোখ ছলছল করে উঠল। “ঠিকই তো বলেছে। আমার কোনো যোগ্যতাই নেই ওর আম্মু হওয়ার”, বিড়বিড় করে আপন মনে বললেন তৌহিদা হক।
পরদিন সকালে নিয়ম মতো ক্যাম্পাসে গেল ইশমাম। অনেকদূর আসার পর মনে পড়ল হাতঘড়িটা বাসায় ফেলে এসেছে। ক্লাসে যেতে দেরী হয়ে যাবে তাই আর ঘড়ি নিতে বাসায় গেল না। প্রতিদিনের মতো ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে লাগল। হঠাৎ মনে পড়ল আজকে সারাদিন আম্মু কল দেয়নি। সবসময় ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়ে বারবার ফোন দিয়ে খোজ নেয় আম্মু। আরো কিছু চিন্তাভাবনা করতে করতে কখন যে বাসার সামনে চলে আসল খেয়ালই করল না। কলিংবেল বাজাবে এমন সময় দেখল দরজা খোলা আর ভেতর থেকে অনেক হইহুল্লোড় শোনা যাচ্ছে।
ভেতরে যেতেই দেখল বাসায় অনেক মানুষ। অনেক মানুষের আগমনের কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না ইশমাম। তখনই ফাতেমা আন্টিকে দেখতে পেল। ফাতেমা আন্টি পাশের কলোনিতে থাকেন। “আন্টি এতো ভিড় কেন বাসায়?” “এখন আসার সময় হল তোমার? কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন ফাতেমা আন্টি। “কেন,কি হয়েছে?” “তোমাকে কিভাবে বলব সাহস পাচ্ছি নাহ। আসলে তোমার আম্মু মানে তৌহিদা আপা,” কথা শেষ করার আগেই ডুকড়ে কেদে উঠলেন আন্টি। “আমার আম্মুর কি হয়েছে?” বুকের ভেতরটা মোচড় দিল ইশমামের। “আজ সকালে তার আম্মুর সাথে দেখা হয়েছিল আমার নতুন রোডের শেষ প্রান্তে। হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসা করতেই বললেন তুমি হাতঘড়ি নিতে ভুলে গেছ। তাই ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন ওনার স্কুলের ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই। এর কিছুক্ষণ পরই রাস্তায় মানুষের চিৎকার শুনে আমি দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি আপা রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা বাসের ধাক্কায়,” আর কিছু শুনতে পারল না ইশমাম। স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ল সোফায়। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।মনে হল পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। “তোমাকে অনেকবার ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ আসছিল। মনে হয় চার্জ শেষ।” আন্টির কথায় আবার যেন অনুভূতি ফিরে আসল ইশমামের। চারদিকে মানুষের ভিড় থাকা সত্ত্বেও পুরো পৃথিবীটা ফাকা মনে হচ্ছে। কে যেন মাথায় প্রচন্ড জোরে হাতুড়ি দিয়ে দুমদুম করে পিটাচ্ছে। আক্ষরিক অর্থেই এখন আর কোন আপনজন নেই তার। আব্বুর পর আম্মুও তাকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে গেল। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
রাত ১২ টা বাজল। ঘড়ির পেন্ডুলামটা ঢংঢং আওয়াজে সময় জানিয়ে দিল। এই নিস্তব্ধ পরিবেশে একাকী একজন দাড়িয়ে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার বৃথা চেষ্টা করছে। সেই অসহায় মানুষটি আর কেউ নয়। সদ্য মাতৃহারা ইশমাম! কোন অপরাধ তাকে এতো রাতে তাড়া করে বেড়াচ্ছে? অপরাধের তাড়না তাকে নিজের বাসস্থানের শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে আসতে বাধ্য করেছে। কিছু অপরাধ সবসময় লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। মানুষের বিবেক তার প্রায়শ্চিত্ত করতে বাধ্য করে। এই তো সতের বছর আগের কথা যখন আব্বু মারা গেলেন। চার বছর বয়সী ইশমামকে এক হাতে বড় করলেন আম্মু। নিজের শখ আহ্লাদকে মাটি দিয়ে তার সমস্ত আবদার পূরণ করেছেন। কোনোদিন কৈফিয়ত দাবি করেননি। বন্ধু শিবলীর আব্বু মারা যাওয়ার পর তার আম্মু নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নতুন সংসার গড়ে তুলেন। অনাদর অত্যাচারে বড় হয়েছে শিবলী। আম্মু তো তাকে একা ফেলে চলে যাননি। বিনিময়ে আম্মুর সাথে ভালো ব্যবহারটাও করেনি কোনোদিন। সবসময় নিজের চাহিদা পূরণে ব্যস্ত ছিল। তার হাতঘড়ি দিতে গিয়েই এক্সিডেন্ট হল আম্মুর। গতকাল আম্মু মারা যাওয়ার পর বাসাটা একদম খালি হয়ে গেছে। তার ঘরের সব জিনিস এলোমেলো হয়ে আছে। আম্মু জীবিত থাকতে কখনো ঘরটা অগোছালো ছিল না।
ভোরবেলা রওনা হয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসল। আম্মুর কবরের সামনে দাড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছে। চিৎকার করে কাদতে পারছে না। বেচে থাকতে আম্মুকে গুরুত্ব দেয়নি কখনো। এখন শত চেষ্টা করলেও আম্মুর সাথে কথা বলতে পারবে না। বাসায় ফিরে আম্মুর হাসিমাখা মুখটা দেখতে পারবে না। আম্মু বলে ডাকলে কোনো সাড়া পাবে না। আর ভাবতে পারছে না ইশমাম। মাথার ভেতর কে যেন আবারো হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। অসহ্যকর যন্ত্রণায় ছটফট করছে। “আম্মু তুমি ফিরে এসো। আর কখনো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করব না। তোমাকে অবহেলা করব না”, গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলল ইশমাম। অঝোরে কাদতে লাগল। সেই চিৎকারে নীরবতা ভাঙিয়ে পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠল। চারপাশের গাছগাছালিও যেন কেপে উঠল। কিন্তু আফসোস আম্মু কোনো সাড়া দিলেন না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গভীর কবরে চিরদিনের জন্য শায়িত আছেন আম্মু। আর কখনো মাতৃস্নেহ পাবে না ইশমাম। আম্মু নামক এই অমূল্য রত্ন একবার হারিয়ে গেলে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, কোনোদিনই না।