শিরোনামহীন
সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ৩
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একজন মহিলা ডাক্তার কে ডেকে আনা হয়েছে আনতারা কে দেখার জন্য।
বাহিরের এক গাদা লোকজন সরিয়ে দিয়ে পথ বানিয়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে আসছে সাবেতের ছোট ভাই সাব্বির। পঁচিশ বছর বয়সী সাব্বিরের চোখে মুখে স্থিরতা।এমন একটা ভাবভঙ্গি প্রকাশ পাচ্ছে তার ব্যবহারে যেনো এমন কিছুই হয়নি উত্তেজিত হওয়ার মতন।
আনতারাকে বিছানায় শুয়িয়ে রাখা হয়েছে। হাত পায়ে মালিশ করে দেওয়া হচ্ছে রসুন দিয়ে গরম করা সরষে তেল। চার হাত-পায়ে মালিস করছে চারজন। বাকী দুজনের একজন কিছুক্ষণ পর পর মুখে পানি দিচ্ছে অপরজন বাতাস করছে।
ইতিমধ্যে দুই একজন এসে তো হাত পায়ে দড়ি বেঁধে দেওয়া কথা বলল।তাদের ধারণা সাপে কেটেছে। আবার কয়েকজন বলল,
“বিষ খাইছে বিষ।সাবেতের এমন কামের পরেও বাইচ্যা থাইক্যা কি করবো লো? মুখ ক্যামনে দেহাবো গ্রামের মাইনষেরে। তাই বিষ খাইছে।”
তাদের কারো কথায় কান দেয়নি সাবেতের মা।ভদ্রমহিলা জানেন আনতারা সহজে হার মেনে নেওয়ার মেয়ে না।কাল সারা দিন না খাওয়া, তাই হয়তো দুশ্চিন্তায়, দুর্বলতায় জ্ঞান হারিয়েছে। কাল রাতের বৃষ্টির পানি জানালা দিয়ে রুমে এসেছে যার পানি জ্ঞানহীন আনতারার হাত পায়ে লেগে হাত পায়ের চামড়া কুঁচকে নীল হয়ে আছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আসা ডাক্তার আপা আনতারা কে দেখলেন। জ্ঞান ফিরিছে তার ।ইতিমধ্যে আনতারার সাথে কি হয়েছে এসব লোকমুখে শুনেছে।মেয়েটার মুখ দেখে বড্ড মায়া লাগলো ডাক্তার আপার। হাতে এক গাছা চুড়ি,নাকফুলের পাথর চকচক করে জানা দিচ্ছে অস্তিত্ব তবে এক রাতেই মেয়ের চোখ দেবে গেছে,পেলব চামড়া খসখসে লাগছে। চোখের নিচে কালীর আস্তরণ।
উঠে বসেছে আনতারা। কিছু সমস্যা আরো রয়েছে। সব খুলে বলতেই ডাক্তার আপা বেশ ভালো ভাবে পরীক্ষা করলেন। তারপর সাব্বিরকে ডেকে কিছু একটা আনার জন্য পাঠিয়ে দিলেন ফার্মেসীতে।
গ্রামের মানুষের সকালের বিনোদনের বিষয়বস্তু নষ্ট হয়ে গেলো এক মূহুর্তে। ছেলে-বুড়ো সকল বয়সের মেয়ে ভীড় জমিয়েছিলো সাবেতের বাড়ি। আনতারা বুঝি আত্নহত্যা করলো! আহারে! আহারে! শব্দে মুখরিত ছিল চারিধার। তবে যখন ডাক্তার আপা বললেন,
“দুর্বলতা থেকে এমন হয়েছে।”
তখন এদের উত্তেজনায় কিছুটা ভাটা পড়লো।অনেকে তো বাড়ি ফিরেও চলে গিয়েছে।
স্থানীয় সময় রাত আটটা বেজে সাত মিনিট।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের অন্যতম একটি সী বিচে নিজ রেস্টুরেন্টে বসে আছে সাবেত।
সামনে ধোয়া উঠানো কফির পেয়ালা। দৃষ্টি তখন উঠন্ত ধোঁয়ায়। ধোঁয়ার আকুলিবিকুলি কুন্ডলীটা বারবার যেনো আনতারার চেহারায় রুপ নিচ্ছে।
এখানে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা বেশ জমজমাট। মানুষের আনাগোনা সব সময় লেগেই থাকে। সবে মাত্র ফরেইনার কাস্টমার সামলে হাসি মুখে সাবেতের দিকে এগিয়ে এলো মারিয়া। মারিয়া মুনতাসীর। ধর্মে ইসলাম হলেও চালচলন, পোশাক সব এদেশীয়।বাবা ছিলেন ইরানী দেশের মানুষ মা এদেশীয় খ্রিস্টান। জন্মের পর মা ছেড়ে চলে গেলে বাবা নিজ হাতে মারিয়া এবং এই রেস্টুরেন্ট নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন। বছর দুয়েক হলো ভদ্রলোক পরলোক গমন করেছেন। তারপর থেকেই সব দায়িত্ব এসেছে মারিয়ার কাঁধে। বর্তমানে মারিয়ার একমাত্র লিগ্যাল অভিভাবক সাবেত। বেশ ভালোই কাটছে তাদের দাম্পত্য জীবন।বেশ থাকার মাঝেও কিছু একটা মারিয়ার নেই।মাঝেমধ্যে নয় সবসময় তার মনে হয় সাবেত শুধু দায়িত্বের জন্যই তার সাথে আছে।
যখন তখন ছেড়ে দিয়ে সে চলে যেতে পারে বাংলাদেশে। যেতে পারে নয়,চলেই তো গিয়েছিলো। তখন কত কান্নাকাটি করে ফিরত আনতে হয়েছে শুধুমাত্র সে জানে।
তার মতে বাঙালি মানুষের মুখে যেমন মায়াভাব মনে তেমন কুটিল বুদ্ধি। সে জানে সাবেত তার প্রথম স্ত্রী আনতারা কে কতটা ভালোবাসে। সব সময় ফোনে লেগে থাকে। যদি মেয়েটা জোর দেয় তো ও এখনি চলে যাবে। কিন্তু এমন হলে মারিয়া নিজেও মরে যাবে।
হয়তো অন্যের মতন সে অনুভূতি দেখাতে পারে না তাই বলে ভালোবাসার কোন কমতি রাখেনি।
মুচকি হেসে মারিয়া সাবেতের ঘাড়ে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড ডিয়ার? তোমার কি শরীর খারাপ?”
মারিয়ার বাংলা এতটা শুদ্ধ না হলেও বুঝে নেওয়ার মতন। সাবেতের জন্য সে বাংলা শিখছে। কয়েকদিন পর সে নিজ থেকে সাবেতের মায়ের সাথে যোগাযোগ করবে ভেবেছে। আফটার অল তার একটা অধিকার আছে।
সাবেতের দৃষ্টি তখনো ধোঁয়ার আকুলিবিকুলি কুন্ডলীর দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল,
“আনতারা আমাদের বিষয়ে সব জেনেছে আজ।আমি।ভয়ে আছি ও নিজের কোন ক্ষতি না করে বসে। ”
কথাটা শুনে মারিয়া বেশ চমকে উঠেছে। কারণ সাবেতকে যদি আনতারা একবার ফিরে যেতে বলে সে এক দিন অপেক্ষা করবে না। মারিয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। কাঁপানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলেছে তোমাকে? তুমি ওর সাথে কথা বলেছো?”
“কেনো করেছি কারণ জিজ্ঞেস করেছে মাত্র।”
“আর কিছুই নয়? ”
“আমাদের ঝগড়া হয়েছে।”
মারিয়া এবার কেঁদেই দিলো।ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদছে সে। অসহ্য লাগে এমন কান্না। নিজেকে সামলে কোন ভাবে বলল,
“তুমি কি চলে যাবে? আমি যে মরে যাবো। প্লিজ আমাকে রেখে যেও না।”
কথা বলার সময় মারিয়া নিজের ডান হাত দিয়ে সাবেতের ডান হাত ধরে নিজের পেটের উপর রাখলো।হঠাৎ চমকে উঠেছে সাবেত।
মারিয়া যে সাত মাসের গর্ভবতী!
ওকে এই অবস্থায় রেখে কিভাবে যাবে সে? এই বাচ্চার জন্যই তো ফিরে এসেছে আবার। তাহলে কেনো সে চলে যেতে চাইছিলো?
এতে আনতারা দোষ বা কোথায়? সে তো কষ্ট পাচ্ছে। এসব ভাবনায় নিজের মাথার চুল একটা একটা করে ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে সাবেতের।
সেসময় খেয়াল হলো মারিয়া কেঁদেই চলেছে।
সাবেত হাত ধরে টেনে মারিয়ার মাথা খুব শক্ত করে নিজের বুকের বা পাশে জড়িয়ে রাখলো। খুব শক্ত করে।
“কোথায়? আনতারা মাথা রাখলে যেমন শান্তি লাগে তেমন শান্তি তো লাগছে না? বরং ভীষণ ফাকা ফাকা লাগছে। ”
রাত আজ গভীর। গভীর রাতের সময় এখনো হয়নি। তবে আকাশে মেঘের আস্তরণে রাতকে গভীর বানিয়ে তুলেছে।
মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিনিট দশেকের রাস্তা হাটতে হয় আনতারার। তার বাবার বাড়ির অনেকটা কাছে চলে এসেছে। দুই গ্রামের মাঝের জায়গাটা সাবেতদের।এখানে নানান জাতীয় ফল,ফুলের গাছ লাগানো।প্যাচপ্যাচে কাঁদায় হেটে আনতারা এসে দাঁড়ালো বকুল গাছের নিচে। হাতে থাকা মোবাইলের টর্চ জ্বেলে কাঁদা থেকে কুড়িয়ে নিলো কিছু বকুল ফুল।অন্ধকারে এক পাশে ঘাসের উপরে বসে সাথে নিয়ে আসা সুইসুতোয় ভেজা ফুলে মালা গাথে আনতারা।
তারপর ঝুলিয়ে দেয় গাছের একটা ডালে।
এ কাজ বিগত ছয় বছরে এক রাতেও বাদ দেয়নি সে। যেদিন তাদের এক সাথে পথ চলা শুরু হলো, সে রাত থেকে প্রতি রাতেই এই গাছে স্থান পায় একটা করে বকুলের মালা।ফুল না থাকলে ঝুলে শুধু সুতো। তবুও যেনো এ কাজ না করার কোন বাহানা মন শুনতে চায় না। গতকাল রাতে বৃষ্টি ভিজে এসেছিলো সে। ফুল কুড়িয়ে মালা গেথে ঝুলিয়েছে।যখন সাবেত দেশে ছিলো তখন দুজনে মিলে করতো আজ সে নেই তো কি? আনতারা নিজের দায়িত্ব বা অভ্যেস ছাড়তে পারেনি।
মালা ঝুলিয়ে আনতারা নিজের শাড়ির আঁচলেত গিট খুলে কিছু একটা বের করলো।
দুটো দাগ স্পষ্ট। হ্যাঁ আনতারার হাতে প্রেগ্ন্যাসি কীট।মা হতে চলেছে সে। খুব দ্রুত আনতারা এবং সাবেতের সন্তান পৃথিবীতে আসতে চলেছে।
চলবে