#শিমুল_ফুল
#৪৬
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শিমুল বাড়িতে যায়।গ্রামে এসে তার মাকে না দেখে চলে যাবে?কখনোই না।সেই কতোমাস ধরে মায়ের মুখটা দেখে শান্তি নেওয়া হয় না।রাবেয়া প্রায়ই ফোন করে কান্নাকাটি করে।তাই শিমুল সকালে ঘুম থেকে উঠে পুষ্পর থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে গেলো।তার মনের ভাব মায়ের কাছে ঘন্টাদুয়েক থেকে ঢাকা চলে যাবে।শিমুল বাড়িতে ঢুকছে।যেই বাড়িতে শৈশব থেকে যুবক হয়েছে আজকে সেই বাড়িতে ঢুকতেই শিমুলের কেমন অসস্তি লাগছে।হয়তো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো বলেই এমন লাগছে।রাবেয়া ছেলেকে দেখে আবার কান্নাকাটি শুরু করেন।দুজনে সোফায় বসে কথা বলার এক পর্যায়ে শওকত হাওলাদার আর মজিব হাওলাদার বাড়িতে আসে।তারা কেউই ড্রয়িংরুমে শিমুলকে আশা করেনি।শওকত হাওলাদার গলা ছেড়ে ফুলিকে ডেকে পানি দিতে বলে ড্রয়িংরুমে আসে।শিমুলকে দেখে কিছুটা চমকে যায়।শিমুল অপ্রস্তুত হয়ে নড়েচড়ে বসে।তারপর কাঠকাঠ গলায় বললো,
“কেমন আছেন?”
শওকত হাওলাদার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো কিন্তু শিমুলের কথা শুনে দাঁড়ায়।আস্তে করে সোফায় বসে।পূর্ণদৃষ্টি মেলে শিমুলের দিকে তাকায়।ছেলেটা কি একটু শুকিয়ে গিয়েছে?হয়তো!শওকত হাওলাদার ইদানীং বেশ শূন্যতা অনুভব করেন।শিমুল ছাড়া যে তিনি কতোটা অচল তা হাড়ে হাড়ে টের পান।আস্তে করে বললো,
“ভালো।তোমার কি অবস্থা?”
শিমুল তার আম্মার দিকে তাকায়।রাবেয়া অবাক হয়ে স্বামীকে দেখছে।শিমুল বললো,
“আলুহামদুলিল্লাহ।”
মজিব হাওলাদার ঠেস দিয়ে বললো,
“কি করোছ ঢাকা?গার্মেন্টস টার্মেনস কাজ করোছ নাকি?”
বাবার কথায় শওকত হাওলাদার বিরক্ত।ছেলেটাকে এসব না বললে হচ্ছে না?মজিব হাওলাদারকে কিছু বলার আগে শিমুল জবাব দেয়।শিমুল মুচকি হেসে মজিব হাওলাদারের দিকে তাকায়।
“গার্মেন্টসে কি মানুষ কাজ করেনা?গরু ছাগল কাজ করে নাকি?তাহলে গার্মেন্টস নিয়ে এতো অবহেলা কেনো?অনেক মানুষ আছে গার্মেন্টসে কাজ করে সংসার চালায়।”
শিমুল থামার পরে রাবেয়া গর্বের সাথে বললো,
“আমার শিমুল ভার্সিটির প্রফেসর।”
শওকত হাওলাদার চমকে শিমুলের দিকে তাকায়।প্রফেসর!উনার চমকে তাকানোটা শিমুলের চোখে পড়ে।ভেবেছিলো কিছুক্ষণ থাকবে কিন্তু তা আর সম্ভব না।
পেশকারা শুনে হতভম্ব।শিমুল ভার্সিটিতে পড়ায়?বেতন কতো?গলা বাড়িয়ে বললো,
“ভাই তোর বেতন কতো রে?”
পেশকারার কথা শুনে শিমুল হাসে।ভাই!কতো য/ন্ত্রণা যে এই মহিলা তাদের দিয়েছে তা তারাই জানে।সে দাম্ভিকতার সাথে বললো,
“বউ পালতে পারছি।”
শিমুল কোন কথার পিঠে এই কথাটা বলেছে শওকত হাওলাদার ঠিক বুঝতে পারছে।আজকে তার মনে হচ্ছে এতো ছোট একটা মেয়ের সাথে তারা একটু বেশীই অন্যায় করে ফেলেছেন এতোটা না করলেও হতো।আর পুষ্পর সাথে এমন না করলে হয়তো শিমুলও ঢাকামুখী হতো না আর তার এই দুর্দশার দিনও আসতো না।শিমুল উঠে দাঁড়ায়।হাতের ছাইরঙা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে।
“মা।আসি তাহলে?”
রাবেয়া বাধ সাধে।
“আব্বা দুপুরে খেয়ে যা।”
“না আম্মা।রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকে।আসি।”
শিমুল চলে যাচ্ছে!শওকত হাওলাদারের বলতে ইচ্ছা করে শিমুল আর ঢাকায় যাওয়ার কি দরকার!বাড়িতেই থেকে যা না!তুই না থাকলে বাড়িটা খালি খালি লাগে।আবার আমার হয়ে কাজ কর,তোকে ছাড়া আমি অসহায়।কিন্তু দাম্ভিকতার জোড়ে হেরে যাওয়ার জেদে নিজেকে আর মেলে দেয়া হয় না।মায়াটা মনের গহীনে চলে যায়।পেশকারা কিছু বলতে চাইলে শওকত হাওলাদার চোখ রাঙায়।উনারা আজকেও এতো কথা কিভাবে বলে?উনারাই যতো নষ্টের মূল।শিমুল চলে যায়।
সময় তার গতিতে ছন্দ করে চলছিলো।পুষ্পর আর মাত্র দুইটা পরিক্ষা বাকি।মিজান শেখের আসতে একটু দেরী হয় বিধায় দুপুরে ভাত খেতে তিনটা বেজে যায়।টেবিলে গিয়ে পুষ্প দেখে গরুর মাংস রান্না হয়েছে।গরুর মাংস দেখেই কিনা শিমুলের হাসোজ্জল মুখটা চোখে ভেসে উঠে।তার শিমুল যে গরুর মাংস পছন্দ করে।রোকসানা পুষ্পর প্লেটে মাংস তুলে দেয়।পুষ্প খায় না চুপচাপ মাংসের দিকে তাকিয়ে আছে।টাকার অভাবে ঢাকা যাওয়ার পরে আর মাংস কিনা হয়নি খাওয়াও হয়নি।এই দুইমাস ধার-দেনা,ফ্লাট এডভান্স ভাড়া,আর টুকটাক কেনাকাটা দিয়েই টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে।এই মাংস তরকারী পেলে শিমুল অনেকটা ভাত খেতে পারতো।কি জানে আজকে দুপুরে কি খাবে!এই তরকারি কি পুষ্পর গলা দিয়ে নামবে?বুকটায় জ্বালাপোড়া হয়।সামান্য একটা তরকারীই তো তাও কেন জানি পুষ্পর চোখ ভরে পানি আসে?মা বাবার সামনে পানি দেখাতে চায় না বিধায় উঠে বলে বাথরুম থেকে আসছি।রুমে গিয়ে মায়ের মোবাইল দিয়ে শিমুলকে ফোন দেয়।শিমুল তখন ভাত খাচ্ছিলো।ফোন ধরে অস্পষ্ট গলায় বললো,
“পাখি ভাত খাচ্ছি।”
“এতো দেরী কেনো?”
“মাত্র ভার্সিটি থেকে আসলাম।”
পুষ্প জবাবে বলে,
“কি দিয়ে খাচ্ছো?”
“সকালে তাড়াহুড়োয় রান্নার সময় পাইনি।তাই আজকের স্পেশাল মেনো ছিলো মসুর ডাল আর ডিম ভাজি।মাত্র এসেছি রান্নার সময়ই পাইনি সকালের যা ছিলো তাই খাচ্ছি।”
পুষ্পর গলা ধরে আসে।কোনোমতে বললো,
“তোমার খাওয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
“না রে বউ।কোনো কষ্ট হচ্ছে না।পা/গলি তুমি কি এসব নিয়ে টেনশন করছো?”
“আমি জানি কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তুমি বলবে না।”
শিমুল কাধ বাকিয়ে মোবাইল কানে ঠেকিয়ে বেসিংয়ে প্লেট ধুয়ে রাখে।আসলেই তার খাবারে একটু সমস্যা হচ্ছে কিন্তু পুষ্পকে এসব বলা যাবেনা।সে জানে মেয়েটা তাকে নিয়ে কতোটা টেনশন করছে।পুষ্পর কথা পাত্তা না দিয়ে বললো,
“আরে না।”
পুষ্প কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।তারপর হঠাৎ ফুপিয়ে উঠে বললো,
“মিস করছি।কবে আসবে?”
শিমুল হাসে।পুষ্পবিহীন ফ্লাটটা তার কাছে খুব অসহ্য লাগছে,পুষ্পর শূন্যতা বুকের গভীরে ঘুচিয়ে বুকটা র/ক্তা/ক্ত করছে।সেও তো রাজ্যের মিস করছে তার পুষ্পরানীকে।আদুরে গলায় বললো,
“এখন তো আসতে পারবো না সোনা।”
পুষ্প অভিমানে টলমল করে বলে,
“না কেনো?তুমি কি আমাকে মিস করছো না?আমাকে বুকে না নিয়ে ঘুমাতে পারছো?আমি তো পারছিনা।এমন কেনো তুমি?”
শিমুল হাসে।এটা ঠিক প্রথম কয়দিন পুষ্পকে ছাড়া ঘুমাতে কি যে খারাপ লাগতো।কতোদিন ধরে মেয়েটা বুকে ঘুমায় হঠাৎ করেই শূন্যতায় শিমুলের চোখের ঘুম চলে গিয়েছিলো।কিন্তু কয়দিন যাওয়ার পরে আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।কথায় আছে না মানুষ অভ্যাসের দাস!বউকে মানাতে বললো,
“ঢাকা আসলে সারাক্ষণ বুকে নিয়ে রাখবো।হলো?”
“না হলো না।আমার আজকেই চাই।চাই মানে চাই।”
“পরিক্ষাটা শেষ হোক গিয়ে নিয়ে আসবো।এর মাঝে আর যাবো না আমি গেলেই দেখেছি তোমার পড়া হয় না।”
“আমি পড়বো।প্রমিস।আসো প্লিজ।”
“ওরে আল্লাহ।বউটা কি খুব মিস করছে?”
পুষ্প আহ্লাদে গলে যায়।
“হুম।”
“কিন্তু ভার্সিটিতে ক্লাস পরিক্ষা আছে।খাতা টাতা দেখতে হবে।খুব ঝা/মেলাই আছি।”
পুষ্প বুঝলো শিমুল আসবে না।মন খা/রাপ করেই ফোন কাটে।কালকে শুক্রবার কিন্তু শিমুল আসবে না।চুপচাপ ভাত খেতে যায়।অল্প একটু ভাত খেয়ে উঠে পড়ে।
রাত তখন কয়টা জানা নেই।পুষ্প অনুভব করে তাকে আষ্টেপৃষ্টে কেউ জড়িয়ে আছে।ছোঁয়াটা,গায়ের গব্ধটা,বুকের হৃদস্পন্দটা পুষ্পর খুব পরিচিত।আধো ঘুমের মধ্যেই বুঝলো এটা শিমুল।হুট করে চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়।শিমুল হাসছে।পুষ্প অবাক হয়।শিমুল যে!তার কি আসার কথা ছিলো?সে তাহলে পুষ্পর ডাকে সাড়া দিতেই এসেছে!মস্তিষ্কটা ঘুম থেকে জেগে খুশীতে ভরে গেলো।বিড়ালের মতো শিমুলকে জড়িয়ে ধরে।
“সত্যি এসেছো?”
শিমুল হাসে।আহ্লাদীর আহ্লাদে সামিল হতে তার কোনোকালেই আপত্তি ছিলো না।ফোনেই বুঝেছিলো আজ রানীর মন খারাপের দিন।এতো দূর থেকেও ঠিক প্রেয়সীর মিন খারাপের আঁচ টের পাচ্ছিলো।শিমুল থাকতে তার শিমুলরানীর মন খারাপ থাকবে?অসম্ভব!তাইতো ছুটে আসা।পুষ্পকে ঘুমোতে দেখে আর জাগাতে ইচ্ছে করেনি।ফ্রেস হয়ে শাশুড়ির আপ্যায়নে খাবার খেয়ে এসেছে।রুমে এসে এলোমেলো বউটাকে দেখে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি।পিছন থেকে আদুরে স্পর্শে জড়িয়ে নিয়েছে।শিমুল জানে পুষ্প জেগে যাবে।হলোও তাই।
“জ্বী।রানী হুকুম করলো না আসলে যে গ/র্দান যাবে।আমি এতো তাড়াতাড়ি গ/র্দান হারাতে চাই না।”
পুষ্প খিলখিল করে হেসে উঠে।এই পুরুষটা তাকে এতো বুঝে।তার।ছোট ছোট ইচ্ছাগুলোকে এতো প্রাধান্য দেয়।তার মনের রাজ্যে সুখের বন্যা বয়িয়ে দিতে একটুও কিপটামো করে না।
“গ/র্দান চাই না।আমি খুব খুশী হয়েছি।”
“আচ্ছা!তাহলে খুশীর প্রতিদান কি দিবে?”
পুষ্প চোখ পিটপিট করে তাকায়।দুষ্টুমির গলায় বললো,
“চকলেট।”
“আমাকে বাচ্চাদের খাবার দিচ্ছো কেনো?আমি কি বাচ্চা!অন্য কিছু দাও।বড়োদের কিছু।”
“বড়োদের কিছু মানে?”
শিমুল বাম চোখটিপে বললো,
“থাকেনা কিছুমিছু।”
পুষ্প কথার সুর ধরতে পেরে বললো,
“ওরে দুষ্ট!”
শিমুল ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“ওরে বাটপার!আমি দুষ্টু?আরেকজন যে আমার দহনে জ্ব/লেপু/ড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে।তার মতলব কি?”
পুষ্প মুচকি হেসে শিমুলের আদুল বুকে নাক ঘষে।
“কোনো মতলব নেই শিমুল ভাই।”
শিমুল শক্ত হাতে পুষ্পকে ধরে নিজের বুকের উপরে উঠিয়ে নেয়।ফিসফিস করে বললো,
“আপনি কি মনে করেছেন আমি আপনার মতলব বুঝি না?”
উপুর হওয়াতে পুষ্পর বেনীচুল সামনে লুটিয়ে পড়ে।
“দূর।এসব না।”
“তাহলে।কোনসব?”
“বরকে মিস করতে পারিনা নাকি?”
শিমুল পুষ্পর বেনী পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
“আমি তো বুঝি গো সুন্দরী।”
পুষ্প শিমুলের গালে হাত রাখে।
“তোমাকে ভিষণ মনে পড়ছিলো।মনে হচ্ছিলো তোমার বুকে গেলেই শান্তি লাগবে।”
শিমুল তার হাত দিয়ে পুষ্পকে বুকে নিয়ে বললো,
“শান্তি লাগছে?”
“ভিষণ।তোমার বুকে আমার এতো শান্তি লাগে।”
শিমুল চোখ বন্ধ করে পুষ্পর বুকের ধুকপুকানি অনুভব করে।পুষ্প এই মূহুর্তে উপলব্ধি করে শিমুল ভ/য়ংকর প্রেমিক ভ/য়ংকর স্বামী।সঠিক মানুষটা যদি পাওয়া যায় তাহলেই সুখের প্রহর শুরু।একজীবনে প্রেমিককে স্বামী হিসেবে পাওয়া বড়ো সৌভাগ্য এমন সৌভাগ্য সবার হয় না।যার হয় সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী।
পলাশ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তার হাতে প্রেগ্ন্যাসি কিট।তাতে স্পষ্ট দুটো লাল দাগ জ্বলজ্বল করছে।নিধি পাশে দাঁড়িয়ে আছে।উত্তেজনায়,খুশীতে পলাশের গলা শুকিয়ে যায়।শুকনো ঢোক গিলে বলে,
“আমার কান্না আসছে কেনো নিধি?”
নিধি মুখে হাত চেপে কেঁদে দেয়।ইশ তার পেটে অন্য কেউ ভাবতেই শরীর শিরশির করে উঠে।শিমুল বিছানা থেকে ফ্লোরে বসে নিধিকে টেনে কাছে নেয়।পেটে মাথা ঠেকিয়ে বলে,
“আম্মু আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?আমি আজকেই জানলাম তুমি আসছো।আমার না কাঁদতে ইচ্ছে করছে।আম্মু তুমার পাপা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।লাভিউ আম্মু।”
পলাশের পাগলামি দেখে নিধি হাপুস নয়নে কাঁদে।পলাশ নিধিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
“তোমাকে কি দেবো নিধি?আমাকে এতো ভালো একটা খবর শোনালে।”
মা-বাবা হীন এতিম মেয়েটা নিজের একান্ত কেউ আসবে শুনে খুশীতে আর্তহারা।পলাশের কথা শুনে বললো,
“কিছু লাগবে না।”
পলাশ নিধির কপালে চুমু দিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ নিধি।আমাকে এতো সুখ অনুভব করানোর জন্য।”
বাবা মা হওয়া এতো সুখের কেনো।খবরটা পাওয়ার পর থেকেই কেমন সুখের পর্দা দুজনকে ঘিরে রেখেছে।একটা সংবাদ যে এতো মিষ্টি হতে পারে জানা ছিলো না।এই সুখের রেশ তাড়াই অনুভব করতে পারবে যারা মা বাবা হয়েছে।কি বুক ধুকপুকানি অনুভূতি।পলাশ বারবার নিধির পেটে হাত ভুলাচ্ছে।নিধি হেসে বললো,
“এখনো কিছুই হয়নি।”
“তাতে কি?আস্তেধীরে হবে।আমি তো অপেক্ষা করবো।তাইনা আম্মু?”
পলাশ নিধির পেটে চুমু খায়।এতো যত্নে চুমু খাচ্ছে মনে হচ্ছে এটা নিধির পেট না এটা সদ্যজন্মানো কোনো বাচ্চা।পলাশ ভাবে এতো খুশীর সংবাদ তার আম্মাকে বলা অতি আবশ্যক।পলাশ রাবেয়াকে ফোন দেয়।
“আম্মা।রানী না রাজা চাই তোমার?”
চলবে…..
#শিমুল_ফুল
#৪৭
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
ফুটফুটে মেয়েটা ছোট হাতে তার বাবার বৃদ্ধাঙ্গুলী চেপে ধরে রেখেছে সে হয়তো জানেও না এটা তার বাবা।পিটপিট করে সে আশেপাশে তাকাচ্ছে।পলাশ মুগ্ধ চোখে তার সদ্য জন্মানো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে।তার চোখে যে কখন পানি জমলো সে বুঝতে পারলোনা,বাবা হওয়া এতো সুখের কেনো?বুকটা কেমন ভারী ভারী লাগছে।আল্লাহর দেয়া বড়ো নিয়ামত পেয়ে পলাশ মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে।তারপর সে আস্তে করে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আম্মু।আব্বুর রাজ্যে আপনাকে স্বাগতম।”
নিধি পলাশের হাজারো খুশীর ফোয়ারা বয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবুর কানে আজান দাও।”
পলাশ আজান দেয়।প্রথম নাতনী বলেই কিনা আনন্দে রাবেয়ার চোখ ভারী হয়ে আসে।ছোট মুখটাতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়।নিধি মুগ্ধ হয়ে বাবুটাকে দেখে।ষোল ঘন্টার ক/ষ্ট নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো।এই বাবুটাই এতোদিন তার পেটে ছিলো, সারাক্ষণ খেলা করে জানান দিতো মা আমি সুস্থ আছি।পলাশ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আম্মা!আমার কোলে দাও না।”
রাবেয়া নকশি কাঁথায় পেচানো মেয়েটাকে পলাশের কোলে তুলে দেয়।পলাশ সোনার হার দিয়ে মেয়েকে কুলে নেয়।বলিষ্ঠ হাতে বাচ্চাটা খুবই ছোট।পলাশ এই প্রথম কোনো ছোট বাবু কোলে নেয় তার মনে হচ্ছে যে কোনো মূহুর্তে পড়ে যেতে পারে।বাবুটার গালে আস্তে করে একটা চুমু খেয়ে বলে,
“আম্মা নাও।আর একটু থাকলে পরে যাবে।”
রাবেয়া কোলে নিয়ে বলে নাতনীর নামটা সেই রাখতে চায়।সোহা রাখবে বলে ঠিক করে।পলাশ বা নিধি কেউই আপত্তি করেনা।রাবেয়া সোহাকে নিধির পাশে শুয়িয়ে দিয়ে বাহিরে চলে যায়।পলাশ শুয়ে থাকা নিধির কপালে,গালে চুমুতে ভরিয়ে দেয়।
“আমাকে আরেকটা মা এনে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ নিধি।বাবা হওয়ার মতো সুন্দর অনুভূতি অনুভব করানোর জন্যও ধন্যবাদ।”
নিধি মিষ্টি করে হাসে।দুর্বল হাতে পলাশের গালে হাত রাখে।পলাশ নিধির হাতে চুমু দেয়।সে আস্তে করে বললো,
“আমাকে মা হবার স্বাধ অনুভব করানোর জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ।আমার যে কি অনুভূতি হচ্ছে বুঝাতে পারবো না।”
পলাশ আর নিধি বাবুর দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যত ভাবে।নিধির চোখে ভেসে উঠে তাদের ছোট ফ্লাটে বাচ্চার হইচই।আহা!নিধি আর পলাশ বুঝি পরিপূর্ণ।ভালোবাসার সাক্ষী দুনিয়াতে চলে এসেছে।
শওকত হাওলাদার খবরটা শুনে খুব খুশী হয় কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না।চুপিচুপি মসজিদে গিয়ে পাঁচহাজার টাকা দানবক্সে ফেলে দেয়।আর মনে মনে প্রার্থনা করে সব যেনো ভালো হয়,হাসপাতালে যাবেনা যাবেনা করেও নিজেকে আটকাতে পারে না সন্ধার দিকে হাসপাতালে চলে যায়।উনাকে হাসপাতালে কেউই আশা করেনি তাই উনাকে দেখে সবাই চমকে যায় কিন্তু সবাই খুশী হয়।রাবেয়া বাবুকে শওকত হাওলাদারের কোলে দেয়।শওকত হাওলাদার খেয়াল করে দেখে বাবুটা পলাশের মতোই দেখতে।ছোট ছোট হাত পা নেড়ে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে।শওকত হাওলাদার রাবেয়াকে আস্তে করে বললো,
“পলাশের মতোই হয়েছে।তাইনা?”
রাবেয়াও ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলো।স্বামীর কথা শুনে বললো,
“হ্যাঁ।”
শওকত হাওলাদার পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা নাতনীর হাতে দেয়।শওকত হাওলাদার আসাতে উনারা সব অপরাধের কথা সবাই ভুলে যায় বিশেষ করে নিধি।উনার চোখে কেমন বাবার ছায়া খুঁজে বেড়ায়।সে হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।তার আব্বা আম্মা বেঁচে থাকলে কতো খুশী যে হতো।রাবেয়া ব্যাকুল হয়ে জানতে চায় কি হয়েছে নিধি মা বাবার কথা বলে।পলাশ আর রাবেয়া নিধিকে সান্ত্বনা দেয় কিন্তু নিধি কেঁদেই যাচ্ছে।এমন সুখের মুহূর্তে মা বাবাকে ভুলে থাকা যায়?শওকত হাওলাদারের কেনো জানি নিধির কান্না ভালো লাগে না।আস্তে করে বললো,
“কেঁদো না নিধি।”
উনার এতোটুকু কথায়ই নিধির কা/ন্না থেমে যায়।যেনো মা-বাবাহীন মেয়েটা বাবার আশ্রয় খুঁজছে।শওকত হাওলাদার কি বাবার আশ্রয় দেয়ার মতো মানুষ?
–
পুষ্প আর শিমুল বাবু হওয়ার খবরটা শুনে অনেক খুশী হয়।পুষ্প অবশ্য গাল ফুলিয়ে বলেছিলো,
“দেখেছো!আমার বিয়ের পরে ভাবীর বিয়ে হয়েছে তারপরেও তাদের বাবু হয়ে গেলো।”
পুষ্পর মনোভাব বুঝতে পেরে শিমুল হাসে।
“তো?”
“মানে আমরা বাবু নিবোনা?”
“ভাবীর বয়স আর তোমার বয়স দেখেছো?”
“আরে বয়স কোনো ব্যাপার না।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।তাছাড়া এতো দেরীতে বাবু নিলে বাবু বড়ো হতে হতে আমি আর তুমিই তো বুড়ো হয়ে যাবো।”
“বেশী পেঁকে গেছেন মনে হয়?এখন এসব মাথা থেকে সরিয়ে ভার্সিটির পড়াগুলো সম্পূর্ণ করো।”
পুষ্প মুখ বাকিয়ে পড়ায় মনোযোগ দেয়।শিমুল কতো বই যে কিনে আনে।পড়তে পড়তে পুষ্পর অবস্থা করুন।তবে শিমুলের সানিধ্যে এসেই কিনা পুষ্পর এইচএসসি রেজাল্ট খুব ভালো এসেছে।হয়তো প্লাস আসেনি কিন্তু মানানসই এসেছে।পুষ্প আর শিমুল যে পরিস্থিতিতে দিন কাটিয়েছে সেই পরিস্থিতেতে পড়ালেখা করেই এই রেজাল্ট আসলেই ভালো।পুষ্প আজকাল পড়তে চায় না তখনি অতীতে করা অপমানের দাগটা শিমুল খুচিয়ে দেয়।মনে করিয়ে দেয় পুষ্পর বড়ো কিছু করতে হবে।নিজের অবস্থান সবাইকে বুঝিয়ে দিতে হবে।পুষ্প রাতদিন পড়ে।
সুইটির বিয়ে হয়েছে।তার হাজবেন্ড ডাক্তার।স্বামী নিয়ে তার মা নানীর কাছে প্রশংসার শেষ নেই।তার স্বামী তার কথায় উঠে বসে।বউকে কেউ কিছু বলতে পারে না,সুইটি সবার উপরে ছুড়ি ঘুরিয়ে চলে।হুটহাট বেড়াতে চলে যায়,যা ইচ্ছা তাই খায়।শশুড় শাশুড়ীকে দুই পয়সার দামও দেয় না।পেশকারা আর আসমা রাবেয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
“আমার সুইটি কপালগুনে একটা বর পেয়েছে।সুইটিকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা।”
রাবেয়া মুচকি হেসে বললো,
“ভালো তো।”
আসমা সুখীমুখে বললো,
“সুইটি যা বলে তাই শুনে।সেদিন কক্সবাজার থেকে ঘুরে এলো।”
রাবেয়া বললো,
“হ্যাঁ আম্মা বলেছিলো।কয়দিন পরে পরেই শুনি এখানে ওখানে বেড়াতে যায় ওর শশুড় শাশুড়ী কিছু বলেনা?”
রাবেয়া মুখ বাকিয়ে বললো,
“কি বলবে আবার?আমার মেয়ের নতুন বিয়ে হয়েছে।এখনি তো সময় জীবন উপভোগ করার,এখন শখ আহ্লাদ পুরুণ না করলে কবে করবে?তাছাড়া আমার মেয়ে জামাইটা খুব ভালো সুইটিকে কেউ কিছু বললে সাথে সাথে মুখে গরম শি/শা ঢেলে দেয়।”
পুষ্পর সাথে করা অন্যা/য়ের কথা রাবেয়ার মনে পড়ে।উনারা যা ক/ষ্ট দিয়েছে তা তো রাবেয়ার চোখের সামনেই।আর এখন একি কাজ নিজের মেয়ে করছে বলে কি খুশী।সে বললো,
“তারপরেও শশুড় বাড়িতে শুশুড় শাশুড়ির মতামতের দরকার আছেনা?”
পেশকারা খেকিয়ে বললো,
“বা*লের দরকার।বুড়া-বুড়ি বললেই শুনতে হবে নাকি?জামাই কথায় থাকলে দুনিয়া জাহান্নামে যাক।তাছাড়া আজকাল-কার মেয়ে এতো কথা শুনতে বসে নেই।”
রাবেয়া মুচকি হেসে বললো,
“তা ঠিক।”
আসলা পেশকারার দিলে তাকিয়ে বললো,
“আম্মা সুইটির শরীরটা কি সুন্দর হয়েছে।মন যা চায় সব খায়।বললো জামাই নাকি পছন্দের খাবার রুমেও এনে রাখে সুইটির যখন ইচ্ছা খায়।”
পেশকারা এসব শুনে খুব খুশী হয়।
“কয়দিনের মাইয়া রাত-বিরাতে ক্ষিধা তো লাগবেই।আমার বোনটার খুশীর কথাগুলো শুনলে পরানটা ভরে যায়।”
রাবেয়া কাঠকাঠ গলায় বললো,
“নিজের মেয়ের বেলায় এসব সুখের কথা অন্যের মেয়ের বেলায় জ্বালাপোড়া।কেনো বলুন তো?”
আসমা আর পেশকারা শক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।আসমা বলে,
“এসব কী কথা ভাবী?”
“কি কথা আবার?সুইটির জায়গায় আমাকে কিংবা পুষ্পকে ভেবে দেখেন আপনাদের এমন সুখী লাগে কিনা,মুখে এমন হাসি ফুটে কিনা।আমি জানি লাগবে না।কারন আমরা তো পরের মেয়ে।নিজের মেয়ের সাথে কি পরের মেয়ের তুলনা সাজে?”
পেশকারা মুখ ভেঙচিয়ে বলে,
“আমার সুইটির সাথে তোমাদের তুলনা করবো কোন দুঃ/খে?তোমার কই আর আমার সুইটি কই?রানী আর দাসীয়ে কখনো তুলনা সাজে না।”
“সুইটি যেমন রানী আমরাও আমাদের বাবার বাড়িতে রানীই ছিলাম।কিন্তু বিয়ের পরে আপনারা ভুলে যান যে আমরাও কারো মেয়ে আপনারা আমাদের কাজের মেয়ে ছাড়া কিছুই ভাবেন না,মনে হয় বউ না কাজের মেয়ে এনেছেন।”
পেশকারা মুখ তেতো করে বললো,
“চুপ যাও।এতো বয়স হলো মুখে মুখে তর্ক করা গেলো না।”
“একবার ভাবেন তো আপনার ছেলে যদি সুইটির জামাই হতো তাহলে কি আপনি এমন করতে পারতেন?এতো খুশী কি হতেন?”
“আমার শওকত এমন না।”
“সেটাই তো!আমার আর পুষ্পর উপর আপনারা যে অন্যা/য়টা করেছেন তা কখনো ভুলে থাকার না।এতোটুকুন একটা বাচ্চার সাথে কি ব্যবহার করেছেন।মেয়েটাকে একটা দিনও শান্তিতে থাকতে দেননি।আপনাদের জ্বালায় আমার ছেলেরা আমার চোখের সামনে নেই।আপনার ম/রার সময় হয়ে আসছে তাও শয়তানী কমেনি।সারাজীবন আমাকে জ্বা/লিয়েছেন এখন আমার ছেলের বউকে।”
শওকত সোফায় বসে ছিলো।পেশকারা রাবেয়ার কথা শুনে চোখ পাকিয়ে তাকায়।তারপর শওকতকে বললো,
“এমনে খামুস খাইয়া কি দেখোস?আমাকে কি বলে তোর বউ?কিছু বলবি না?”
শওকত হাওলাদার ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে।তার আম্মা যে রা/গী এটা তার জানা।রাবেয়া আসার আগে থেকেই সে তার মাকে চিনে সুতরাং রাবেয়ার থেকে তার আম্মাকে তারই বেশী চিনা।এতোদিন মায়ের কথামতোই সব করেছে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে ভুল ছিলো।সংসারে এই ঝামেলা আর ভালো লাগে না।পেশকারার কথায় উনি বি/রক্ত হয় চোখ থেকে চশমা খুলে রুমে চলে যায়।পেশকারা হাহাকার করে বলে,
“আরে আমার পুলা তো এমন ছিলো না!এই কাল/না/গিনী আমার পুলারে তা/বিজ করছে।আল্লাহ গো আল্লাহ।”
“হ্যাঁ আপনার ছেলে পরের মেয়ের পক্ষ নিলেই তা/বিজ করছে আর অন্যের ছেলে নিজের মেয়ের পা চাটলে জামাই লক্ষী,ভালো জামাই।স্বার্থপর মহিলা।”
এটা বলে রাবেয়া রান্নাঘরে চলে যায়।সুইটির মতো অ/সভ্য,বে/হায়া, খা/রাপ মেয়ের ভাগ্য কেনো এতো ভালো হবে?কেনো এতো সুখে থাকবে?আসলে খা/রাপ মানুষেরা এই দুনিয়াই ভালো থাকে,সুখে থাকে।সুইটিও তাই।এরা অন্যের উপর যন্ত্রণা চাপিয়ে নিজে সেই যন্ত্রনা পায় না আসলে আল্লাহ এদের যন্ত্রণা দেয় না।সুখে থাকতে দেয়।রাবেয়া রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।চিন্তাভাবনা কয়দিন পলাশের কাছে থাকবে এই ঘরটা তার বি/ষের মতো লাগে।শওকত হাওলাদার বিছানায় আধশোয়া হয়ে সব দেখে।রাবেয়া একবারও বলার প্রয়োজনবোধ করেনা।আসলে মানুষ নিজের সম্মান নিজেই হারায়।যে মন থেকে একবার উঠে যায় পরে শতো চেষ্টা করেও আর মনে জায়গা পাওয়া যায় না।
রাবেয়া চলে যাওয়ার পরে সন্ধ্যায় শওকত হাওলাদার নিজেও পলাশের বাসায় চলে যায়।আজকে নিয়ে তৃতীয় বার যাওয়া।প্রতিবারই নাতনীর টানে।নাতনীর নাম সুহা।এই নামটা তার ঠিক করা।অনেকবছর আগে তার স্ত্রীকে বলেছিলো তাদের মেয়ে হলে নাম সোহা রাখবে মেয়ে তো আর হয়নি কিন্তু সেই কথাটা মনে রেখে রাবেয়া এই নামটাই রেখেছে।সুহার দুইটা দাত উঠেছে।দুই দাত নিয়ে কেমন খিলখিল করে হাসে।শওকত হাওলাদারের ইচ্ছে করে সারাক্ষণ খেলতে কিন্তু নিজের আত্মসম্মানের দোহাই দিয়ে কাছে যাওয়া হয় না আর না নিজেদের বাড়িতে আনা হয়।আজকে গিয়ে সুহাকে কোলে নেয়ার পরে সুহা দাদা দাদা বলতে বলতে মুখে লালা ছুটিয়ে ফেলে।সোহার মুখে দাদা ডাক শুনে শওকত হাওলাদার নিজের আত্মসম্মান ভুলে নাতনীর সাথে তাল মিলিয়ে আহ্লাদী গলায় কয়েকবার দাদা দাদা বলে খিলখিল করে হেসে উঠে।সবাই উনার উচ্ছ্বাস দেখে অবাক হয়।রাবেয়া মুগ্ধ চোখে স্বামীকে দেখে শেষ কবে এভাবে হাসতে দেখেছে মনে নেই।আজকে দেখে খুব ভালো লাগছে।শওকত হাওলাদার গম্ভীর মুখে নিধি আর পলাশকে বলে,
“আমি সোহাকে তার দাদার বাড়িতে নিয়ে যাবো।তোমাদের ইচ্ছে হলে তোমরা আসতে পারো কিন্তু আমি সোহাকে এখানে রেখে যাবো না।”
–
পুষ্প অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে সবে ভর্তি হয়েছে।সে খেয়াল করে আজকাল সারাক্ষণ গায়ে গায়ে জ্বর থাকে।নাপা খেলে জ্বর থেমে যায় কিছুক্ষণ পরে শীত অনুভব করে আবার জ্বর আসে।সে এটাকে তেমন গুরুত্ব দিলো না।শিমুলও রাতে খেয়াল করে পুষ্পর রাতে থেমে থেমে জ্ব/র আসে।ফার্মেসী থেকে জ্ব/রের ওষুধ এনে খাইয়েছে।এভাবে দশ পনেরো দিন যাওয়ার পরে জ্ব/র প্রচন্ড আকার ধারন করে।কাপুনি দিয়ে জ্ব/র এসে পুষ্পকে বেহুশ করে যায়।শিমুল দিশেহারা হয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটে।র/ক্ত পরিক্ষা করে জানা যায় পুষ্পর টা/ইফয়েড জ্ব/র হয়েছে।পনেরোটা ইঞ্জেকশন দেয়া হলো সাথে তো ওষুধ আছেই।পুষ্পর হাতে ক্যানোলা ফিট করে দেয়া হয়।শিমুল ভার্সিটি থেকে ছুটি নেয়।পুষ্পর খেয়াল রাখার কেউ নেই।রোকসানা ফোন করে গ্রামে চলে যেতে বলেছে কিন্তু পুষ্প যেতে রাজি না।তার ভাষ্যমতে শিমুলের পাশে থাকলেই যে তাড়তাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।শিমুলের কাছে থাকলেও নাকি তার শান্তি লাগে।রান্নাবান্না পুষ্পর যত্ন নেয়া সব মিলিয়ে শিমুল বেশ ব্যস্ত।পুষ্পকে খাবার খাওয়ানোর,ঠিকমতো ওষুধ খাওয়ানো,ই/ঞ্জেকশন দেয়া সব ঠিকঠাক করে।শিমুলের যত্ন দেখে পুষ্প নিজেকে খুব সুখী ভাবে।এই ছেলেটাকে বিয়ে করাতে সবাই কতো কি বলেছে কিন্তু পুষ্প জানে এই পাগল ছেলেটা তাকে কতো ভালোবাসে।আজকাল তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে শুনছো পৃথিবী আমি ঠ/কিনি আমি খুব বেশীই জিতে গেছি।এই ছেলেটা আমার সুখের জন্য আমার সামনে পুরো পৃথিবী দাঁড় করাতেও দ্বীধা করেনা।শুনছো পৃথিবী মানুষ শিমুল আমাকে তার রানী করেই রাখে।পুষ্প জ্ব/রের পরিমান বাড়ে।আচ্ছা সে যদি ম/রে যায় তাহলে?শিমুল কি আবার বিয়ে করবে?এসব উল্টাপাল্টা ভেবে পুষ্প ঝরঝর করে কেঁ/দে দেয়।শিমুল ব্যস্ত হয়ে জানতে চায় কি হয়েছে,বেশী খারাপ লাগছে কিনা।
“এই জ্ব/রে আমি বোধহয় ম/রে যাবো।”
শিমুল পুষ্পর মাথায় জলপট্টি দিয়ে বলে,
“কিছু হবেনা পুষ্প।তুমি এসব কেনো ভাবছো বলতো?জ্ব/র হলে কেউ ম//রে না।”
পুষ্প শিমুলের কথা বুঝতে চায় না।জ্বরে ঠোঁট কাঁপে।সে বলে,
“আমার মনে হয় আমি ম/রে যাবো।”
পুষ্প আসলেই বেশী অ/সুস্থ।প্রিয়তমার মুখে এসব কথা শুনে তার বুকেও অজানা আ/তংক ঝলকে উঠে।পাত্তা না দেয়ার ভংঙিতে বলে,
“আরে কিছু হবেনা।”
“আমি ম/রে গেলে কি তুমি আবার বিয়ে করবে?”
“তোমার কিছু হবেনা।আর বিয়ের কথা আসছে কেনো?”
“বলনা।”
“না বিয়ে করবোনা।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
পুষ্প মানে না।কেঁদে কেঁদে বললো,
“তোমার আর কতো বয়স?মাত্র তো একত্রিশ।এই বয়সে একা থাকবে কি করে?সবাই মিলে বিয়ে করিয়ে দিবে।”
পুষ্প অ-সুস্থ বলেই কিনা এসব ভাবছে।শিমুল কথা বলেনা।পুষ্প ম/রে যাবে আর যে আবার অন্য নারীতে মজে যাবে এসব ভাবতেই মাথা ঘুরে উঠে।
পুষ্প আবার বলে,
“শোন।যাকে বিয়ে করবে তাকে একটু কম ভালোবাসবে।বুকে কম নিবে।বুকের পশমে নাক ডুবাতে দিবে না।মনে থাকবে?”
পুষ্পর উল্টাপাল্টা কথায় শিমুলের চোখেও পানি জমে যায়।পুষ্পকে বুকে জড়িয়ে বলে,
“এমন কিছু হবেনা পুষ্প।”
“আমি যখন ভাবি আমি ম/রার পরে তুমি আবারো বিয়ে করে অন্য কাউকে ভালোবাসছো তখন আমার দম আটকে যায়।শরীর জ্বা/লা পো/ড়া করে।”
“তুমি ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা সম্ভব না।আল্লাহ যদি তোমার কিছু করেও দেয় আমি সারাজীবন একা কাটিয়ে দেবো।”
“আমার কষ্ট হচ্ছে।”
শিমুল শক্ত করে পুষ্পকে বুকে ধরে রাখে।মেয়েরা এমন কেনো?সব কিছু ছাড়তে পারলেও যাকে একবার মনের গহীনে জায়গা দেয় তাকে ছাড়তে পারে না।স্বামীর ভাগ কেনো কাউকে দেয়া যায় না?
পুষ্প জ্ব/র ভালো হয় কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে সে কোনো কিছুর গন্ধ শুনতে পারছে না,কিছু খেতে গেলেই নাক কুচকে ফেলছে।সারাদিন শুয়ে থাকে চোখ খুললেই বলে সব কিছু নাকি ঘুরছে,সারাক্ষণ রুম অন্ধকার করে রাখে।শিমুল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।আবারো র/ক্ত পরিক্ষা,ইউরিন পরিক্ষা করা হয়।তারপর যা বললো তা তাদের দুজনের ভাবনার বাহিরে ছিলো।পুষ্প ছয় সাপ্তাহের গর্ভবতী।শিমুল স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।পুষ্পর জ্ব/রের ঘোরে হয়তো ঠিকঠাক জন্ম-নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুসরন করা হয়নি।তাই এর ফলাফল এখন সামনে দাঁড়িয়ে।শিমুল এতোটা বেখেয়ালি কি করে হলো?জ্ব/রের কারনেই কিনা পিরিয়ডের কথা পুষ্প ভুলেই বসেছে।মান্থলি ডেট যে পেরিয়ে এসেছে সে খেয়াল নেই।এখন বাচ্চা কোনোভাবেই সম্ভব না।পুষ্প খুশী নাকি বেজার তা বলা যাচ্ছে না।সে একটু পরে পরে শিমুলের দিকে তাকাচ্ছে।হয়তো শিমুলের মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছে।হাসপাতালের করিডোরে বসে শিমুল জীবনের বড়ো সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেয়।পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই বাচ্চাটা পৃথিবীতে আনা সম্ভব না।একটা নার্স বললো এমআই কিট নামে একটা মেডিসিন আছে।চলো নেডিসিনটা নিয়ে বাসায় যাই।খেলে এমনিতেই ব্লি/ডিং হয়ে ন/ষ্ট হয়ে যাবে।”
পুষ্পর বুকটা মুচরে উঠে।অবিশ্বাস্য চোখে শিমুলের দিকে তাকায়।বাবুটাকে মে/রে ফেলতে বলছে!এটা কি তার শিমুল!
“আমি পারবো…..”
পুষ্পর কথা শেষ হওয়ার আগে শিমুল চোখ রা/ঙিয়ে বলে,
“না করেছি সুতরাং বাচ্চা চাই না।বুঝেছো?”
চলবে….