#শিমুল_ফুল
#৪০
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
রাত দুইটা।মাঝেমধ্যে গাড়ির হর্ণ,যাত্রীদের আসা যাওয়া গভীর রাতেও পথচারীর আনাগোনা জানান দিচ্ছে ঢাকার ব্যস্ততার রেশ।কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে আশেপাশে ঘুরছে।পুষ্প আর শিমুল কাউন্টারে একটা বেঞ্চে বসে আছে।পুষ্পর ছোট ব্যাগটা একহাতে ধরে আরেক হাতে শিমুলের কনুই শক্ত করে ধরে রেখেছে।পুষ্পর এই প্রথম ঢাকায় আসা।রাতের ঢাকা দেখতে খুব সুন্দর কিন্তু এই মূহুর্তে লাল নীল বাতি জ্বালানো ঢাকা পুষ্পর কাছে ভালো লাগছে না,মাথায় গিজগিজ করছে একগাদা চিন্তা।সে কিছুক্ষণ পরপর চোখ ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকানো শিমুলকে দেখছে।মাথায় একটা কথাই ঘুরছে কোথায় যাবে?
আর শিমুলের মাথায় একটা কথাই ঘুরছে সে নাকি বউ পালতে পারবে না!পেলে দেখাবে যে শিমুল পারে কি না।ঢাকা এসেছে কিন্তু এতো রাতে একটা মেয়ে নিয়ে বেশীক্ষণ তো এই কাউন্টারে বসে থাকা যাবে না কি করা যায় ভাবতেই হাতের মোবাইল দিয়ে ভার্সিটির বন্ধু আলভিকে ফোন দেয়।ভার্সিটির অনেক বন্ধুই আছে তার মধ্যে আলভি বেশী ঘনিষ্ঠ ছিলো।কয়েকবার রিং হওয়ার পরে ফোন রিসিভ হয়।আলভি জেগেই ছিলো।ফোন রিসিভ করে উৎফুল্ল গলায় বললো,
“কিরে মাম্মাহ এতোদিনে মনে পড়লো?”
শিমুল হেসে দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ।কেমন আছিস বল?”
“ভালো।তুই?”
“এইতো ঠিকঠাক।”
“এতোরাতে কি মনে করে?”
“মামা একটা সমস্যায় পরে তোকে ফোন করলাম?”
“কি সমস্যা?”
শিমুল ক্ষানিকটা ইতস্তত করে বললো,
“ঢাকায় এসেছি সাথে তোর ভাবিও আছে।এতো রাতে কই যাবো?তোর বাসা কাছে ভাবলাম রাতটা যদি থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারতি।”
আলভি চুপ করে থেকে বললো,
“আসলে আমাদের বাসায় তো আজকে অনেক গেস্ট আছে।এতো মানুষ যে সবাই ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাচ্ছে।তোরা আসলে কই জায়গা দিবো?ঢাকার বাসা বুঝিসই তো।”
শিমুল আলভির এই কথার অন্তরালে সুপ্ত কথাটাও বুঝে নেয়।সম্মানে ঘা লাগে তারপরেও বেহায়া হয়ে ধরা গলায় বললো,
“আমার বউয়ের একটু জায়গা দিলেই হবে।আমি আশেপাশে ঘুরে-ফিরেই রাত পার করে দেবো।”
আলভি বোধহয় বিরক্ত হয়।মুখে চ কারান্ত শব্দ করে বললো,
“আরে মামা বুঝছ না কেন আম্মায় শুনলে রাগ করবো।বাসায় মানুষে ভরা তারমাঝে আবার তোরা আসলে কেমনে কি?”
শিমুল দমে যায়।পুষ্পর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললো,
“দেখছ না ভাই একটু ব্যবস্থা করতে পারলে……”
শিমুলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন কেটে যায়।শিমুল আবার ফোন দেয় অপরপাশ থেকে নারী গলায় কেউ বলে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না।আলভির এই কাজে শিমুল বেশ অবাক হয় এই আলভিকেই সব পরিক্ষায় তার খাতা দেখিয়ে পাস করিয়েছে,কতোবার ভার্সিটির ফিস দিয়ে সাহায্য করেছে আর এখন!আরো কয়েকজনের কাছে ফোন দিয়েও এই হ্যানত্যান বাহানা শুনে।বন্ধুদের কথার আড়ালে থাকা ক্ষ/ত/বি/ক্ষ/ত কথাগুলো বুঝে শিমুলের গলা শুকিয়ে যায়।মানুষ এতো বেইমান হয়?চেহারার রঙ এতো জলদি বদলায়?বিপদে না পড়লে এমন বন্ধু নামের মানুষগুলোকে চিনাই হতো না।শিমুলের টেনশনে ঠোঁট শুকালে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।পুষ্প পাশে বসে সবটা পর্যবেক্ষণ করে।ধরে রাখা হাতে হালকা চাপ দিলে শিমুল তার দিকে তাকায়।পুষ্প ছোট মানুষ কিন্তু এই ছোট মেয়েটাই শিমুলের স্ত্রী-তার শক্তি।শিমুল কিছু না বললেও তার মুখ দেখে পুষ্প পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারছে।এখন রাত চারটার বেশী বাজে আর কিছুক্ষণ পরেই সকালের আলো ফুটবে।সে আশ্বাস দিয়ে বললো,
“আমরা রাতটা এখানে বসে থাকলে কি কেউ কিছু বলবে?যদি না বলে তাহলে রাতটা এখানেই বসে থাকি?সকালে না হয় একটা ব্যবস্থা করবো।”
শিমুল পুষ্পর কথায় মাথা ঘুরিয়ে কাউন্টারে বসা মুরুব্বী দেখতে লোকটার দিকে তাকায়।ঘন্টা দুয়েক ধরে দুজনে এখানে বসে আছে বিধায় আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে।শিমুল আস্তে গলায় বললো,
“দেখছি।”
তার মধ্যেই কাউন্টারে বসা লোকটা শিমুলকে ডাকে।সে ধীর পায়ে উঠে লোকটার সামনে দাঁড়ায়।শিমুলকে দেখেই লোকটা চশমার উপর দিয়ে দেখে আঙুলের ডগায় লেগে থাকা চুন মুখে দিয়ে বললো,
“কতোক্ষন ধরে বসে আছেন কই জাইবেন?কয়ডা টিকেট লাগবো?”
শিমুল মাথা নেড়ে বললো,
“কোথাও যাবোনা ভাই।আসলে আমরা গ্রাম থেকে এসেছি রাতে থাকার মতো জায়গা ম্যানেজ করতে পারিনি তাই এখানে বসে আছি।”
লোকটা সুচালো চোখে পুষ্পর দিকে তাকায়।কালো বোরকার আড়ালে মুখটা খোলা।পদ্মপাতার মতো জ্বলজ্বল করা মুখটা দেখে লোকটা বললো,
“ভাইগা আইছেন নি?”
উনার চোখের দৃষ্টি শিমুলের পছন্দ হয় না।পুষ্পকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বললো,
“ওইটা আমার বউ।”
লোকটা তখনো শুকনের মতো পুষ্পকে দেখছে যেনো হাজার বছরের কোনো নাম না জানা লোভনীয় ফুল।শিমুলের থেকে আশানুরূপ জবাব না পেয়ে লোকটা মিহিয়ে যাওয়া গলায় বললো,
“অহ!আচ্ছা।”
এক পুরুষ হয়ে আরেক পুরুষের চোখের লোলুভ দৃষ্টির আকাঙ্খা বুঝতে পেরে শিমুল তার মুখের বাকি কথা টোপ করে গিলে নেয়।ব্যস্ত পায়ে পুষ্পর কাছে এসে পুষ্পকে সাথে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে।দুপুরে খাওয়ার পরে দুজনের আর কিছুই খাওয়া হয়নি।বাসে চিকেন রোল,চিকেন চাপ কিনেছিলো তা পুষ্পকে খেতে বললেও ব/মির ভয়ে কিছু খেতে রাজি হয়নি।শিমুল রাস্তার পাশে এক চায়ের দোকান থেকে দু-কাপ চা নিয়ে আসে,অনেক জোড় করে পুষ্পকে একটা রোল খাওয়ায়।জীবনের প্রথম এতো লম্বাপথ জার্নি করে আবার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে পুষ্পর আসলেই ক্লান্ত লাগছে।
শিমুল খাচ্ছে না তার টেনশন হচ্ছে।বাড়ি থেকে মাত্র বিশ হাজার টাকা নিয়ে এসেছে।নামে ছাত্রনেতা হলেও শিমুল ধা/ন্ধাবা/জি করে কখনো কারো থেকে টাকা আদায় করেনি।হালকা যা টাকা পয়সা পেতো আর তার আব্বা প্রতি মাসের শুরুতে কিছু টাকা দিতো।পড়ালেখা শেষ হবার পরে চাকরী করতে বললে শওকত হাওলাদার না করে।নিজ উদ্যোগে শিমুলকে রাজ/নীতির সাথে জড়িয়ে দেয়।বলেছিলো এই রাজনী/তির পথ ধরেই তার ভবিষ্যত হয়ে যাবে কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এটা কতো বড়ো ভুল ছিলো।বিশ হাজার টাকা তার হাতে ছিলো আসার সময় এটাই সাথে করে নিয়ে এসেছে।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এক পা নাড়িয়ে অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখে পুষ্প শিমুলের হাতে ধরে শিমুল তাকালে পুষ্প তার মিষ্টি হাসিটা দিয়ে বললো,
“তুমি এতো টেনশন করো না তো।চলো আমার আপার বাসায় যাই।”
শিমুল মাথা নেড়ে না করে।এমন ফকিরের বেশে পুষ্পর বোনের বাসায় যাওয়ার মানে হয় না।পুষ্প হাল ছেড়ে শিমুলের কাধে মাথা রাখে।
শিমুল চুপচাপ খায়।বিশ হাজার টাকা দিয়ে কিভাবে কি করবে তা মনে মনে ছক কষে।বাসা নিতে হবে,পুরো সংসার সাজাতে হবে।ভাবনার এক পর্যায়ে খেয়াল করে পুষ্প তার কাধ জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে গেছে।প্রিয়তমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে শিমুলের বুকটা চিনচিন করে উঠে।তার ফুলকে ফুলের রাজ্যেই মানায় এমন রাস্তায় না।শিমুল তাকে ফুলের রাজ্যে নিবেই।ফজরের আজান দিয়ে শিমুলের নতুন পথচলার সূচনা করে।সে ঘুমন্ত পুষ্পর কপালে হৃদয়ের বিশুদ্ধতম চুমু দেয়।এই পথচলায় তাকে জিততেই হবে।এই মুখে রাজ্যের হাসি ফুটাতেই হবে।এ শিমুলের প্রতিজ্ঞা।
নয়টা পর্যন্ত শিমুল আর পুষ্প বাসা খুঁজে।কয়েকটা বাসা পেয়েছিলো কিন্তু ভাড়া খুব বেশী।একটায় ভাড়া আট হাজার।কিন্তু দুই মাসের এডভান্স দিতে হবে।শেষমেষ কোনো উপায় না পেয়ে গলির মাঝে টিনসেট একটা বাসা পায়।টিনের চালা দেয়া লম্বা বিল্ডিং তার মধ্যে সারি সারি রুম।কিছুটা অপরিচ্ছন্ন,স্যাতস্যাতে তাও শিমুল একরুম নেয়।তিন হাজার টাকা এডভান্স দিয়ে রুমে উঠে।সারা রুম খালি।পুষ্প চোখ ভুলিয়ে চারপাশে দেখে।শিমুল হাতের ব্যাগটা এক কোণায় রেখে পুষ্পর হাত টেনে ধরে।
“পুষ্প এই বাসায় থাকতে পারবি তো?”
ওই আলিশান বাড়ি থেকে পুষ্পর মনে হলো এই এক রুমের বাসাটাই সুখকর।শিমুলের বুকে মাথা রেখে বললো,
“পারবো।তুমি ভালোবাসলে আমি সব পারবো সব।”
শিমুল বললো,
“কোনো একটা কাজ পেলেই ভালো বাসা নিয়ে নিবো।কিছুদিন একটু কষ্ট করতে হবে।আমার জন্য এটুকু সয়ে নে জান।”
“আচ্ছা।”
পুষ্প আর শিমুল সংসারের খুবই দরকারী যা এগুলো কিনতে বের হয়।শিমুলের হাতে আর সতেরো হাজার টাকা আছে।প্রথমে একটা পাতলা তোষক আর দুইটা বালিশ কিনলো দুই হাজার টাকা দিয়ে।হাড়ি পাতিল টুকটাক যা লাগে এগুলো সব মিলিয়ে দুই হাজার হাজার।চাল-ডাল আর খাদ্য সামগ্রী প্রয়োজনীয় যা লাগে সব একটু একটু করে কিনলো চার হাজার টাকার।সব নিয়ে বাসায় আসতে আসতে দুপুর হয়ে যায়।দুজনে সেদিন দুপুরের খাবার হোটেলে খায়।
পুষ্পর বুকটা পু/ড়ছে।না না তার বাবা মায়ের জন্য না বাবা মাকে তো সেই কবেই ছেড়ে এসেছে এখন তার শাশুড়ীর জন্য মন পু/ড়ছে।চেয়ারম্যান বাড়ির এই একটা মানুষের জন্য পুষ্পর বুকে অসীম মায়া।উনি যে মায়ের স্নেহ দিয়েছেন তা অন্য শাশুড়ীরা দেয় কিনা এটা পুষ্পর জানা নেই কিন্তু ভাগ্যের ফেরে পরে সেই স্নেহ মাথা পেতে নেবার মতো সৌভাগ্য তার নেই।একফাকে ফোন করে রাবেয়ার সাথে কথা বলে নেয়।রাবেয়ার কান্নাজড়িত গলা শুনে পুষ্পও কেঁদে দেয়।আহা আরেকটা মা পেয়েও হারাতে হলো।জীবনের খেয়া তাদের কোথায় নিয়ে যায় এটাই দেখার বিষয়।
এই বাসার নিয়ম এখানে চার সংসার একচুলায় রান্না করে।ভাড়াটিয়ারা বেশীরভাগ চাকরী করে।সবাই কাজ করে এসে রাতে রান্না বসায়।লাইন ধরে চুলার ভাগ পেতে হয়।এতোজনের মাঝে পুষ্প অসস্থিবোধ করে শিমুল এটা বুঝতে পেরে নিজেই এগিয়ে যায়। পুষ্প আর শিমুল দুজনে মিলে ডাল ভাত আর ডিম ভাজি করে।পুষ্প তার আনাড়ি হাতে শিমুলের সাহায্য নিয়ে রান্না শেষ করে।রাতের খাওয়া দাওয়ার পরে দুজনে শুয়ে পড়ে।সারাদিন যা ধকল গেলো,এই কঠিন দু/র্গম পথে তারা দুজনেই নতুন।বিছানায় পাতা পাতলা তোষকে শুয়ে শিমুল তার ফুলকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।শিমুলের সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই পালায়।এই মেয়েটাই তার শান্তি,প্রিয় মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরার মাঝে যে শান্তি আছে এটা বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই।এই শান্তির তুলনা চলে না।এই শান্তির প্রখরতা কেবল তারাই বুঝতে পারে যারা প্রিয় মানুষকে জড়িয়ে ধরে শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারে।এটা বুঝি আল্লাহ প্রদত্ত শান্তি নাহলে এতো সুখ কেন সামান্য এই জড়িয়ে ধরার মাঝে?পুষ্প বললো,
“আমাকে বিয়ে করেই তোমার যতো স/মস্যা।বিয়ে না করলেই পারতে।”
অন্ধকারেই শিমুল হাসে।
“ভালোবাসি যে সম/স্যার মোকাবেলা তো করতেই হবে।”
“আমিই মূল সম/স্যার কারণ।”
“এসব বলোনা তো।ভালোবেসেছি বিয়ে করেছি।এখন তোমাকে নিয়ে জীবন যু/দ্ধেও নেমে গেছি।আমি চাই বাকিটা পথ আমার হাতটা ধরে তুমি আমার শক্তি হও।”
পুষ্প সুখে হাসে।শিমুলের বুকে মাথা রেখে বললো,
“আচ্ছা।”
“দোয়া করো যেনো একটা চাকরী খুঁজে পাই।”
“দেখো ভালো কিছু হবে।”
ভালো কিছু বললেই তো আর হয় না।শিমুল তিনদিন ঘুরেও কোনো ব্যবস্থা করতে পারে না।সে তো আর সিনেমার জসিম,আলমগীর না যে হুট করে জীবনের চাকা বদলে যাবে।কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না কিন্তু না খেয়েও তো থাকা যাচ্ছে না হাতের টাকা আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে।রাস্তায় হাটার সময় ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হয়।লজ্জা-সরম ভুলে উনাকে একটা কাজের জন্য অনুরোধ করাতে উনি এক বন্ধুর মাধ্যমে গার্মেন্টসে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে শিমুলকে জয়েন করিয়ে দেয়।সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা।গার্মেন্টসে দিনের বেলায় কয় লট মাল আসে যায় সব হিসাব রাখতে হবে,বেতন সাড়ে সাত হাজার।শিমুলের হাত কাঁপে যু/দ্ধটা খুব কঠিন।গার্মেন্টসে কাজ করার মতো ছেলে তো শিমুল নয়!তুখোড় মেধাবী ছেলেটা কিনা গার্মেন্টসে চাকরি করবে?পুষ্পর মলিন মুখ ভেসে উঠতেই এসব চিন্তা দূরে ঠেলে দেয়।হোক গার্মেন্টস তাতে কি?পুষ্পকে সুখী রাখতে হবে।ফুটপাতের রাস্তা ধরে বাসায় ফিরতে ফিরতে শিমুলের বুক ভে/ঙে হাহাকার আসে।কাল থেকে সে গার্মেন্টসে চাকরি করবে।গার্মেন্টস!
চলবে……
#শিমুল_ফুল
#৪১
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
পুকুরের কিনারে দাঁড়িয়ে পানির মাছটা দেখে মনে হয় ধরা খুব সহজ কিন্তু পানিতে নামলে বুঝা যায় মাছটা আয়ত্বে আনা কতোটা ক/ঠিন।ঠিক তেমনি জীবন যু/দ্ধে না নেমে রঙিন স্বপ্ন দেখা খুব সহজ কিন্তু মাঠে নামলেই টের পাওয়া যায় স্বপ্নের পথে হাটা এতো সহজ না।একবেলার ভাত যোগার করা যে কতোটা ক*ঠিন যে এক বেলা উপোস থেকেছে সেই এর মূল্য জানে।শিমুল চাইলেই পলাশ কিংবা তিয়াশের কাছে সাহায্য চাইতে পারে কিন্তু সে এটা করবেনা।শওকত হাওলাদার যদি শুনতে পায় তাহলে উপহাস করবে।বলবে যে”ঠিক তো জেদ দেখিয়ে চলে গেলো এখন চলতে পারেনা কেন?বাপের কামাই ছাড়া চলতে পারেনা?ফুটানী শেষ?আমি জানতাম এমনটাই হবে,দুইদিন পরে সুড়সুড় করে বাড়িতে ফিরে আসবে।”হোক একটু কষ্ট তারপরেও শিমুল এসব কথা শুনতে রাজি না।পলাশ আর তিয়াস কয়েকবার ফোন দিয়েছে কিছু লাগবে কিনা জানিয়েছে,শিমুল তাদের সুন্দর করে বুঝিয়ে না করে দিয়েছে।লড়াইটা যেহেতু তার সে একাই লড়ুক অন্যদের কাছে কিছু বলে সান্ত্বনা নেয়ার মানে হয় না।দেড় মাস ধরে শিমুল গার্মেন্টসে চাকরি করছে।গার্মেন্টসের ম্যানেজার, সুপারভাইজারদের মুখের ভাষা এতো খা/রাপ,প্রকাশ করার মতো না,কি বি/শ্রী টোনে কথা বলে,জ/ঘন্য।শিমুল এসব কথার সাথে অভ্যস্থ না,অকথ্য কথা শুনলে মাথার রগ দপদপ করে জ্ব/লে উঠে।এই তো আজকের ঘটনা,চাকরিতে ঢুকেছে দেড় মাস।মাসের বেতন হাতে পেতে আরো দেরী।তার হাতে যা অল্প টাকা আছে এগুলো দিয়ে কোন রকম টানাটানি করে চলতে হচ্ছে।পনেরো বিশ দিন ধরে সবজি,সবজি ভাজি,করল্লা ভাজি,ডাল,ডিম ভাজি,আলু ভর্তা খেয়ে দুজনে দিন কাটাচ্ছে।আজকে সকালে পুষ্প ডাল রান্নার সময় হাতে ডাল ফেলে বেশ কিছুটা জায়গা পু/ড়ে ফেলেছে।অতী আহ্লাদী মেয়েটা একটুও শব্দ করেনি নিঃশব্দে তপ্তশ্বাস ছেড়ে হাতে পানি দিয়ে আবার রান্নায় মনোযোগ দেয়, শিমুল যে কাজে যাবে খেয়ে যেতে হবে দেরী করলে চলবে না।কিন্তু ফর্সা হাতে লালের ছোঁয়া শিমুলের নজর এড়ায় না।ব্যস্ত হয়ে বা/র্ণ ক্রীম এনে হাতে লাগিয়ে দেয়।শিমুল হাতের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে ডান হাতেই অনেকটা পু/ড়েছে কিন্তু পুষ্প নির্বিকার।প্লেটে বেশী করে ভাত নিয়ে নিজে খায় সাথে পুষ্পকেও খাইয়ে দেয়।সে জানে পরে পুষ্প খাবেনা আর শিমুলকেও কিছু বলবেনা।এই কারণেই শিমুলের অফিসে যেতে একটু লেট হয়ে যায়।ততক্ষণে গার্মেন্টসের চার লট মাল চলে গেছে।শিমুলকে দেখে ম্যানেজার এগিয়ে আসে।
“খান**র পোলা বা** ছিড়তে আসোছ?”
শিমুলের চোখ লাল হয়ে যায়।মাথা নেড়ে বললো,
“স্যার একটু সমস্যা হয়েছিলো তাই..”
শিমুলের কথা শেষ হওয়ার আগে ম্যানেজার দাঁত কিড়মিড়িয়ে জোড়ে জোড়ে বললো,
“সমস্যা থাকলে কাজ করিছনা নাকি গার্মেন্টসের মাইয়াগো পা/ছা না দেখলে মন ভরে না।হা/লা/রপো।”
শিমুল হাত দিয়ে প্যান্ট খাবলে ধরে।এমন করে কথা বলার সাহস কারো নেই কিন্তু পরিস্থিতিতে পরে এসব নিম্নমানের কথাগুলোই শুনতে হচ্ছে।কাজ শেষ করে শিমুল একটা অফিসে যায়।তিয়াসকে দিয়ে তার সার্টিফিকেট আর পুষ্পর বইখাতা আনিয়েছে।এক বন্ধু এই অফিসে চাকরী করে ও বলেছে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিবে।সে প্রায় এক ঘন্টা ধরে বসে আছে কিন্তু তার বন্ধু আসে না।পিয়নকে দিয়ে কয়েকবার খবর পাঠিয়েছে কিন্তু প্রতিবারই উত্তর এসেছে ব্যস্ত।এবার পিয়ন এসে বললো,কাল দেখা করতে আজকে বেশী ব্যস্ত।শিমুল মুচকি হেসে বেরিয়ে আসে।সে বেশ বুঝতে পারছে এসব ব্যস্ত ট্যস্ত কিছু না আসল কথা হচ্ছে শিমুলের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না তাইতো এই বাহানা।ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতে শিমুলের চোখে পুষ্পর মুখটা ভেসে উঠে।এই কয়দিনে পুষ্প তার কাছে কোনো আবদার করেনি কিছু খেতে চায়নি শিমুলকে কখনো বুঝতেই দেয় না পুষ্প যে ক/ষ্টে আছে।কিন্তু শিমুল যে সব বুঝে,সান্ত্বনা হিসেবে পুষ্পকে শক্ত করে বুকে নিয়ে রাখে।এসব আবল তাবল ভাবতে ভাবতে তার বুক চিরে বেরিয়ে আসে হতাশার নিঃশ্বাস।অন্ধকারের ভিড়ে হারিয়ে যায় একটা পুরুষের হা/হা/কার মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস।যে কিনা প্রিয় নারীকে সুখে রাখতে নিজের সর্বস্ব দিয়ে লড়ছে।
পুষ্পর মোবাইলে তার মা রোকসানা ফোন দিয়েছে।পুষ্প কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোনটা রিসিভ করে।
রোকসানা ধরে বলে,
“কেমন আছিস?ফোন না দিলে তো বাঁচ-ম//রার খবরও জানতে পারবো না।”
পুষ্প কথা বলেনা।এই পরিস্থিতিতে মোবাইলে বিশ টাকা রিচার্জ করার চেয়ে আধা কেজী আলু কিনাই পুষ্পর কাছে বেশি আনন্দের।মুচকি হেসে বললো,
“এইতো আম্মা ভালো আছি।তুমি আর আব্বা কেমন আছো?”
“ভালো।”
পুষ্প কি বলবে ভেবে পায় না।কিছু কিছু সময় অতী আপনজনের সাথেও কথোপকথন সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়,কথা ফুরিয়ে যায় আর অপর পক্ষের মানুষটা যদি খুঁচা দিয়ে কথা বলে তাহলে আরো খা/রাপ লাগে।সে জানে রোকসানা এখন শিমুল,সাফিন,মুন্নীকে নিয়ে কথা শুনাবে।
“শিমুল কই?”
“কাজে।”
রোকসানা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“কি কাজ করে বলিসনা কেনো?রিক্সা টিক্সা চালায় নাকি?সত্যি করে বল।”
পুষ্পর বুকটা ব্যা/থায় চিরবিড়িয়ে উঠে।শিমুলের নামে কোনো অ/পমান তার সহ্য হয় না।নিভু গলায় বলে,
“তোমাকে না বললাম একটা কম্পানিতে চাকরি করে।”
“কম্পানি না কি কে জানে!কতো বললাম এই নেতা ফেতা ছেড়ে সাফিনকে বিয়ে কর তুই ঘ্যাড় তেড়্যামি করে বিয়ে করলিনা এখন মজা বুঝ!মা বাপের কথা না শুনলে ছাড়াকালে যায়।তুইও গিয়েছিস।”
পুষ্পর বি/রক্ত লাগে।এটা ঠিক তার আব্বা আম্মার এই পরিস্থিতি ভালো লাগছে না হয়তো মনে মনে কষ্টও পাচ্ছে কিন্তু সবসময় এভাবে কথা বলার মানে কি?যা হবার তা তো হয়েই গেছে।শিমুলও কি ফেলনা নাকি?হোক টাকা কম কিন্তু সে পুষ্পর রাজা।সে বিরক্ত গলায় বললো,
“এগুলো বাদ দাও না আম্মা।”
রোকসানা দিগুণ তেজ নিয়ে বলে,
“কেনো বাদ দিবো শুনতে মজা লাগেনা?মজা লাগবে কিভাবে?তোর বোনের ঢাকায় ফ্লাট আছে আর তুই কিনা বস্তিতে থাকিস।নিজের কপাল নিজে বেছে নিয়েছিস।এখন আমাদের কিছু বলতে পারবিনা।”
“আমি তোমাদের কিছু বলি নাই আম্মা।আর বলবও না।”
“এই প্রেম কয়দিন পরে জানালা দিয়ে পালাবে।তুই কি মনে করছিস আমি কিচ্ছু বুঝি না?”
পুষ্প চোখ বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।তর্ক করতে একদম ইচ্ছা করেনা।আস্তে করে বললো,
“আচ্ছা।”
“সাফিনদের দুই দুইটা ফ্লাট আছে।বিয়ে হলে রাজরানীর মতো থাকতি।বুঝলি না পরে বুঝবি। নিজের কপাল নিজে পুড়লি।বিয়ে হলে সাফিনের ভালবাসা পেলে দেখতি এসব শিমুল টিমুল সব ভুলে গেছিস।”
পুষ্প কি করে বুঝাবে সাফিন না তার যে শিমুলকেই চাই।সাফিনও তাকে ভালোবাসতো আদরে ভরিয়ে দিতো কিন্তু তার যে শিমুলের ভালোবাসা চাই শিমুলের পাগল করা ছোঁয়া চাই।সবচেয়ে বড়ো কথা শিমুলের কাছে এলে যে শান্তি মিলে তা তো কোথাও মিলবে না!তাহলে এই ফ্লাট,সাফিন এগুলো দিয়ে কি করবে?
“আম্মা এগুলো বাদ দাও না।আমার কপালে যা আছে তাই হবে।”
পুষ্পর মন খারা/পের আঁচ হয়তো কিছুটা রোকসানার গায়ে লাগে।গলার স্বর নরম হয়ে আসে।
“কি রান্না করছিস আজকে?”
মায়ের একটু নরম কথায় পুষ্পর চোখে পানি জমে যায়।সে কিভাবে বলবে যে আজকে পনেরো বিশ দিন ধরে ঘরে মাছ আসে না।মাছ কিনার টাকা নেই আসবে কিভাবে!সবজি, ভাজি,ডিম,ভর্তা,ডাল এসব দিয়েই দিন যাচ্ছে।কিন্তু মাকে এসব বলার মানে হয় না।মিথ্যা করেই বললো,
“টমেটো দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছি আর মশুরির ডাল।”
“ভালো আছিস তো পুষ্প?আমাকে বল।টাকা লাগবে?”
মা-রা কিভাবে যেনো না বলা কথাই বুঝে যায়।পুষ্প গলা ধরে আসে।
“টাকা আছে আম্মা।আর লাগলে তোমাকে বলবো।”
“মুন্নী তোকে ফোন দেয় না?কতোবার যেতে বলছে যাচ্ছিস না কেনো?”
পুষ্প শুকনো ঢোক গিলে।বোনের বাসায় যেতে হলে টাকার দরকার।খালি হাতে তো আর বোনের বাসায় যাওয়া যাবে না।তার উপর মুন্নী ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট।কিছু না নিলেও তো হাজার খানেক টাকার লাগবেই জিনিসপত্রের দাম যা চড়া!
“যাবো আম্মা।আসলে ও নতুন চাকরি নিয়েছে তো ছুটি নেই।দেখি সময় পেলেই যাবো।”
“আচ্ছা।মুন্নী তোর আব্বার জন্য কতো কি কিনে পাঠিয়েছে।মেয়েটা আমাদের কথা কতো ভাবে।”
পুষ্প কথা বলতে পারেনা।তার বোন কতো কি দিতে পারে আর সে পারেনা।নিজের কাছে তো নিজেকেই ছোট লাগে।এসব শুনে কি বলা যায় সেটাই খুঁজে পায় না।
“আচ্ছা আম্মা রাখি।শিমুল আসছে।”
রোকসানা কিছু বলার আগেই পুষ্প ফোনটা কেটে দেয়।চোখ দিয়ে পানি পড়ে।নিজেকে সামলে মোবাইলে টাইম দেখে,শিমুলের আসার সময় হয়ে গেছে জলদি বই নিয়ে বসে।রাতে দু’জনে একসাথে খেতে বসে।একটা ডিম পেয়াজ দিয়ে ভাজি করে দু’ভাগ করে দুজনে খায়।পুষ্প খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শিমুলকে দেখে বিয়ের পরে একমাস পুষ্প দেখেছে শিমুল ভোরসকালে এক্সারসাইজ করে একসাথে ছয়টা সিদ্ধ ডিম খেতো আর ওই ছেলেই কিনা অর্ধেক ডিম দিয়ে ভাত খাচ্ছে,আসলেই পরিস্থিতি মানুষকে সহজ বানিয়েই ছাড়ে।পুষ্পর মন খারাপ হয় শিমুলের চেহারা ন/ষ্ট হয়ে যাচ্ছে এসব হাবিজাবি পুষ্প খেতে পারলেও শিমুল খেতে পারেনা ওই যে অভ্যাস নেই।তারপরেও জোড় করে খায়,বলিষ্ঠ শরীর কিছুটা ভে/ঙে গেছে।শিমুল পুষ্পর করুণ চাহনি খেয়াল করে বললো,
“কি দেখো?”
“তোমাকে।”
শিমুল প্লেটে হাত ধুয়ে বললো,
“আবার প্রেমে পড়ার ধা/ন্ধা করছো নাকি?”
পুষ্প হাসে।
“চুল দাড়ির কি অবস্থা দেখেছো?এই অবস্থায় প্রেমে পড়া বারণ।”
শিমুল মুচকি হেসে দাড়িতে হাত বুলায়।কিছুদিন না কা/টার ফলে দাড়িগোঁফ বেশ বড়ো হয়ে গেছে।গতোকাল এক সেলুনে গিয়েছিলো চুল দাড়ি কা/টলে নাকি দুইশো টাকা লাগবে।শিমুলের পকেটে ছয়শ টাকা আছে এই টাকা দিয়ে বাকিটা মাস চলতে হবে এখন দুশো টাকা নিয়ে চুল দাড়ি কা/টা তার কাছে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুনা।উপায় হিসেবে বিশ টাকা দিয়ে একটা ছোট কেচি কিনে নিয়ে এসেছে যেটা এখন তার পকেটে আছে।উদ্যেশ্য আয়না দেখে নিজেই কাটছাট করে নিজেকে কিছুটা চলনসই করা।বাজারের সবচেয়ে ভালো সার্ভিস নেয়া ছেলেটা কিনা নিজেই দাড়ি কা/টবে তাও টাকার ভয়ে!শিমুলের হু হা করে হাসি আসে।সাপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে গায়ে দেয়ার সাবান নেই।পুষ্প না করেছে সে বলেছে একটা সাবান কিনতে ষাট টাকা লাগবে তা দিয়ে এক কেজী চাল চলে আসবে।কিভাবে খরচ কমানো যায় মেয়েটা শুধু এটাই ভাবে।আজকে শিমুল সাবান নিয়ে এসেছে।এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো শুনতে হাস্যকর লাগলেও এগুলো সত্যি।
শিমুল পাতলা তোষকে ক্লান্ত শরীরটা ছেড়ে দেয়।পুষ্প লাইট নিভিয়ে সুরসুর করে শিমুলের কাছে চলে আসে।শিমুল মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে পুষ্পকে দেখে, শিমুলকে কাছে পেলেই মেয়েটা বিড়ালের মতো কাছে ঘেষে থাকতে চায়।পুষ্পর কপালে পড়ে থাকা চুল পিছনে ঠেলে বলে,
“আজকে পড়া কতোদূর?”
পুষ্প শিমুলের হাতটা নিজের হাতে পুড়ে নেয়।আরেকহাত গালে ঘষে বললো,
“পড়েছি।”
“পড়েছি বললে তো হবেনা।আমার ভালো রেজাল্ট চাই।কেউ যেনো না বলতে পারে বিয়ে করে পরিক্ষায় ডাব্বা পেয়েছো।”
“আচ্ছা।”
শিমুল গম্ভীর গলায় বললো,
“আচ্ছা বললে হবে না অফিসার হতে হবে।”
পুষ্প শিমুলের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকায়।কি হবে লেখাপড়া করে?তার শিমুল এমন পরিশ্রম করছে আর সে কিনা কোনো সাহায্যই করতে পারছেনা।শিমুলের ক্লান্ত,শুকনো মুখটা দেখলে পুষ্পর চিৎ/কার করে কা/ন্না করতে ইচ্ছে হয়।
“কতো মেয়েই তো চাকরি করে।আমিও করি?তোমার গার্মেন্টসে ঢুকা যাবে না?”
পুষ্পর কথা শুনে শিমুল স্তব্ধ হয়ে যায়।মোবাইলের ফ্লাশ পুষ্পর দিকে করে।তার কথা গলায় আটকে আসে।রয়েসয়ে বলে,
“মাথা ঠিক আছে?”
পুষ্প শিমুলের বলিষ্ঠ বুকে মাথাটা গুজে বললো,
“সহ্য হয় না।তোমার এই ক/ষ্ট একদম সহ্য হয় না।”
পুষ্প নিঃশব্দে কাঁ/দে।শিমুল মোবাইলের ফ্লাস অফ করে তার কা/ন্নারত পাখিকে খাঁচায় স্থান দেয়।পুষ্প জানতেও পারল না তাকে বুকে ধরে শক্ত মনের পুরুষের চোখেও যে পানির আনাগোনা।পুরুষদের নাকি কাঁ/দতে মানা অথচ কেউ জানেনা অধিকাংশ পুরুষ কাঁ/দে তবে লুকিয়ে।শিমুল দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কাঁ/দে।মনে মনে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে আল্লাহগো একটা ব্যবস্থা করে দাওনা।আমার পাখিটাকে একটু সুখে রাখি।
পলাশ খাতা দেখায় ব্যস্ত।নিধি পাশে বসে পলাশকে দেখে।এই মানুষটা তার জীবনে না এলে জীবনের মানেটাই অজানা থেকে যেতো।সুখের ম//রণ যে কাকে বলে এটা কখনো জানাই হতো না।এই শান্ত স্বভাবের পলাশ যে এমন উন্মাদ প্রেমিক তা কে কল্পনা করেছে?নিধির মনে হয় স্বামী হিসেবে শান্ত পুরুষই মানানসই।পলাশের চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
“শিমুল ভাইয়ের খবর নিয়েছেন?”
“হ্যাঁ।”
“কিভাবে চলে?কিছু বলে না?”
“না।টাকা পাঠাতে বললে বলে টাকা আছে লাগবেনা।”
“কি জানি করে আল্লাহ’ই জানে।”
পলাশ মুচকি হাসে।তার ভাই তো! ছোটবেলা থেকে একসাথে বড়ো হয়েছে।হাড়েহাড়ে চেনা।শিমুলের আত্মসম্মানবোধ প্রখর।তার আব্বা খাওয়া,পরার খোটা দিয়েছে এবার শিমুল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেখাবে।পলাশের দৃঢ় বিশ্বাস শিমুল ভালো কিছু করবে।তার মতোই শিমুলও ইংরেজীতে ভালো ভার্সিটির ক্লাস টপার ছিলো কিন্তু শওকত হাওলাদার সেটা প্রকাশ করার সময় দেয়নি এখন যেহেতু ঢাকা গিয়েছে অবশ্যই ভালো চাকরি হবে।এমন তুখোড় মেধাবী ছাত্রের চাকরি না হয়ে পারেইনা।নিধি পলাশের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুঞ্চন করে বললো,
“হাসেন কেনো?”
“এমনি।”
“শিমুল ভাইয়ের কথা ভাবলে আমার চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসে।আর আপনি হাসেন?”
“নিধি।আমার ভাইটার প্রবল আত্মসম্মানবোধ।সম্মানে আ/ঘাত করে এমন কিছু হলে সে কাজ করে দেখায়।দেখবে শিমুল আর পুষ্প এমন কিছু করবে যে সবাই চমকে যাবে। ”
নিধি আনমনে বলে,
“তাই যেনো হয়।”
শওকত হাওলাদারের চেয়ারম্যান অফিসে বিরোধী দলের লোক আ/ক্রম/ণ করেছে।এতোদিন শিমুল ছিলো বিধায় কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি।যেই না শিমুলের চলে যাওয়ার খবর শুনেছে এমনি তী/র্যক কথা,হা/তাহা/তি আজ শেষ পর্যায়ে অফিস ভাং/চু/র থেকে মা/রা/মা/রিতে গিয়ে ঠেকেছে।শিমুল নেই বিধায় তিয়াসও আসে না।শিমুল আর তিয়াসই সব বিষয় সামলেছে।শওকত হাওলাদারের মাথায় ইটের বাড়ি লেগে ফে/টে গিয়েছে।সেখান থেকে গলগলিয়ে র//ক্ত বেরোচ্ছে।মজিব হাওলাদার তাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে।পেশকারা দৌড়ে এসে এসব দেখে হা/হা/কার করে বললো,
“শিমুইল্লাই এই প্যাচ লাগাই গেছে।ওরে শিমুইল্লা রে কি স/র্বনা/শ করে গেলি।”
শওকত হাওলাদার বিরক্ত হয়।শিমুল এসব করবে কেনো?বরং শিমুল নেই তাই তো বি/রো/ধী দলের লোক এতো ঝা/মেলা করার সা/হস পেলো।শিমুল থাকলে এসব হবার কোনো চান্সই ছিলো না।শওকত হাওলাদার চোখ বন্ধ করে ভীষণভাবে শিমুলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।পেশকারাকে ধমকে বলে,
“এতো ঘ্যা/নঘ্যা/ন করো না তো।যাও।”
শওকত হাওলাদারের এই অবস্থা রাবেয়া কাছেও আসে না।দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে আর হাসে,শিমুলের অভাব বুঝা মাত্র শুরু!সামনে যে আরো কী কী হবে তা দেখার বিষয়।তার শিমুল এই অ/হং/কারীদের ছোঁয়া থেকে বেরিয়ে গেছে তাতেই তিনি খুশী।হোক একটু ক/ষ্ট তারপরেও শিমুল ভালো থাক সুখে থাক।
শিমুল আজকে দুইটা টিউশনি পেয়েছে,গার্মেন্টসে এর কর্মীর সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে উনি ব্যবস্থা করে দিয়েছে।দুইটা টিউশনি থেকে তিন হাজার টাকা আসবে।সেই খবরে তার মনটা খুবই খুশী তার উপর আজকে বেতন পেয়েছে।অভারটাইম সহ মোট নয় হাজার টাকা।বেতনটা পাওয়ার পরে সারা মাসের ক/ষ্ট,গা/লি/গা/লা/জ সব ভুলে গিয়েছে।ফুরফুরে মেজাজে বাসার বাজার করেছে।খুশীতে বউয়ের জন্য একটা কালো সুতির শাড়ি কিনে ফেলেছে।বাজার থেকে বাসায় আসার পথে শপিং ব্যাগ ফাঁক করে অনেকবার শাড়ীটা দেখেছে আর হাসছে এই দুমাসে বউটাকে কিছুই দেয়া হয়নি এই শাড়িটা দেখলে নিশ্চয়ই খুশী হবে!পুষ্প বাজার খুলে সাথে শাড়ি দেখে ঠিকই খুশী হয় কিন্তু অভাবের কথা মনে হতেই শাসিয়ে বলে,
“কি দরকার শাড়ি আনার।আমার কি কাপড় নেই?কতোগুলো কাপড়।”
শিমুল গামছা হাতে উঠে দাঁড়ায়।
বাথরুমে যেতে যেতে বললো,
“আমার ইচ্ছা করলো তাই।”
শিমুল চলে গেলে পুষ্প বন্ধ দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে শাড়িটা কাধে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।শিমুলের কালো পছন্দ।আর পুষ্পকেও কালোতে বেশী মানায়।পুষ্প মিটিমিটি হাসে।
শিমুল দরজা ফাঁক করে এই দৃশ্য দেখে আবার দরজা লাগিয়ে দেয়।এই মেয়েটার মুখে হাসি ফুটলেই তার কষ্ট সফল।
রাতে পুষ্প শাড়িটা পড়ে।শিমুল শুয়ে শুয়ে দেখে।পুষ্পর শরীরটা কি হালকা ন/ষ্ট হয়ে যাচ্ছে না!হচ্ছে হয়তো।ভালো মন্দ খাওয়াতে পারে না বিধায় শরীর খা/রাপ হচ্ছে।পুষ্প শাড়ি পরে শিমুলের বুকে লুটিয়ে পড়ে।শিমুল দু’হাতে পুষ্পকে বুকে জড়িয়ে নেয়।পুষ্প আহ্লাদী গলায় বললো,
“সোনা পাখি!”
শিমুল পুষ্পর জুলুজুলু চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি চাই?দাবীটা কি?”
“ভ/য়ং/কর প্রেমিক পুরুষের দেখা চাই।”
শিমুল মাথা নাড়িয়ে হাসে।
“প্রেমিক পুরুষ তো প্রস্তুত।এখন ইশারা দিলেই হলো!”
পুষ্প মাথা ঝুকিয়ে বললো,
“কেমন লাগছে বললেনা যে!”
শিমুল তার গলার ভাজে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বললো,
“বলতে হবে কেনো!তুমি বরাবরই সুন্দর।আমার রানী।শিমুল ফুলের রানী!”
পুষ্প মাথা সরিয়ে বললো,
“তাও প্রশংসা করবে।প্রিয় মানুষের মুখে প্রশংসা শুনলে ভালো লাগে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা।সুন্দরী রাজকন্যা আপনাকে এতো এতো সুন্দর লাগছে যে নিজেকে আপনার কাছে সপে দিতে ইচ্ছে করছে।আপনি কি এই অধম প্রজার পাগ/লামীগুলো সহ্য করতে প্রস্তুত?”
শিমুলের বলার ধরন দেখে পুষ্প খিলখিল করে হেসে উঠে।
“প্রস্তুত।কিন্তু আজকে মনে হয় প্রজা নয় তার রানী স্বয়ং তাকে জ্বা/লাবে।”
“রাজকন্যা এতো আমার পরম সৌভাগ্য।”
পুষ্প শিমুলের লোমশ বুকে তার নরম ঠোঁট দিয়ে থেমে থেমে চুমু খায়।শিমুল আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়।পুষ্প নাক ঘষে আস্তে আস্তে কা/মড়ে দেয়।কুট কুট করে কা/মড়ে শিমুলের শরীরে শিহরণ বয়িয়ে দেয়।শিমুল আস্তে গলায় বললো,
“ব্যা/থা পাই তো জান।”
পুষ্প বুজে আসা গলায় বললো,
“আমার ভালো লাগে।”
শিমুল পুষ্পর কানে ফিসফিস করে বললো,
“আমারো তো ভালো লাগে।”
পুষ্প চোখ খুলে তাকিয়ে বললো,
“কি?”
পুষ্পর কোমল কবুতরসম বুকে নিজের দন্ত হালকা ছুঁয়িয়ে বললো,
“এভাবে আদর করতে।”
শিমুলের আ/ক্রম/ণের পরিমাণ কম হলেও পুষ্প আদুরী গলায় আ/র্তনাদ করে উঠে।শিমুল তার ফুলে মাঝে মজে যায়।পুষ্প আবেশে চোখ বুঝে।ছোট একটা রুমে আদুরে উল্লাসে মুখরিত হয়।চারদিকের ঘুটঘুটে অন্ধকারকে জানান দেয় শিমুল পুষ্পর টাকা কম কিন্তু ভালোবাসা বেশী।এতো ভালোবাসা যেখানে সেখানে একটু কম খেলেও শান্তি।একটু টাকার অভাবে থেকে নাহয় সুখে থাকুক তাতে ক্ষ/তি কি!শিমুল ফিসফিস করে বললো,
“খুব ভালোবাসি জান।ইচ্ছে করে বুকটার ভেতরে পুরে রাখি।”
পুষ্প আহ্লাদে ঘুঙ্গিয়ে উঠে।এমন কাতরভাবে কয়টা পুরুষ নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে?পুষ্পর শিমুল পারে।নিজেকে উজার করে দিতে তার একটুও সংকোচ নেই।রাতটা কেটে যায় ভ/য়ং/কর ভালোবাসায়,কিছু অপ্রকাশিত কথায়,কিছু অলিখিতো অনুভূতির ছোঁয়ায়।আহা জীবন এতো সুখের কেনো?চারিপাশে এতো সুখের বাতাস কেনো?
চলবে,,,,