শিমুল ফুল পর্ব-২৮+২৯

0
661

#শিমুল_ফুল
#২৮
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

পুষ্পকে কোলে নিয়ে শিমুল আলতো গলায় গেয়ে উঠে,
“তুমি আমার কাছে যুদ্ধে জয়ী সাত রাজার ধন,শত বাধা ডিঙ্গায় পাইছো তোমায় মনের মতো মন।
আমার মনের জ্যোৎস্না আমি কাউকে দেবো না।তোমায় গাইথা রাখছি মনের মাঝে নিজেও জানো না।”

পুষ্প মুগ্ধ হয়ে শিমুলের গলার গান শুনে।শিমুলের বুকে মাথা রেখে শিমুলের বুকের উথাল-পাতাল ঠিক টের পাচ্ছে।পুষ্প মাথা নিচু করে শিমুলের বুকের কাছের গেঞ্জি আঁকড়ে ধরে।শিমুল হেটে পুষ্পকে বিছানায় নিয়ে যায়।পুষ্পকে লজ্জা পেতে দেখে তার খুব ভালো লাগছে।পুষ্পর নরম মনের ভয়ানক তাপে শিমুল তখন ছন্নছাড়া।আদুরে চোখ দিয়ে পুষ্পকে দেখে।যে চোখের দৃষ্টি পুষ্পর শরীরে শিহরণ জাগাতে সক্ষম।

শিমুল পুষ্পর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।পুষ্প তাকাতে পারে না।হাত দিয়ে শিমুলের মুখ অন্যদিকে ফিরাতে চাইলে শিমুল হাত ধরে বললো,
“কি?”

পুষ্প মাথা নেড়ে বললো,
“না।”

শিমুল পুষ্পর নরম গালে তার দাড়িযুক্ত গাল ঘসে জড়ানো গলায় বললো,
“কি না?”

“না।”

শিমুল মুচকি হাসে।পুষ্পর গালে হাত ভুলিয়ে দিলে পুষ্প চোখ বন্ধ করে নেয়।শিমুলের এতোদিনের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়,না না ভাঙ্গে না শিমুল নিজেই ভেঙে দেয়।নিষিদ্ধ ইচ্ছাদের পাখা মেলে উড়তে দেয়।নিজে ডুবে যায় পুষ্পতে।পুষ্প শিমুলের পাগলকরা ছোঁয়ায় দিশা হারায়।শিমুল তখন পুষ্পকে নতুন রূপে আবিষ্কার করতে ব্যস্ত।নিজের সবটা ভালোবাসা উজার করে পুষ্পকে নতুন রূপে রাঙ্গিয়ে তুলতে সেকি চেষ্টা!নিজেকে নতুন রূপে পুষ্পর সামনে নিয়েই এলো,পুষ্প অবাক হয়ে শিমুলের পাগলামি দেখে।শিমুল আজ সত্যিই পাগল।পাগলামি আজ সীমাহীন।পুষ্পর কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলতে চেয়েও বলা হয় না।শিমুলের আধো আধো পাগলের প্রলাপ শুনে পুষ্প লজ্জায় মুখ লুকায়।ফিসফিস করে শিমুলকে বলে,
“না প্লিজ না।”

শিমুল পুষ্পর কথা শুনেনা,সে নিজের অধিপত্য প্রসার ঘটাতেই ব্যস্ত।তার নিঃশ্বাস তখন রুমের পরিবেশ অশান্ত করে দিচ্ছে।শুধু নিঃশ্বাসই রুম অশান্ত করে না শিমুলের মুখের জড়ানো গলায় পাগল করা কথাগুলো পুষ্পকে অশান্ত করে দেয়।পুষ্পর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।শিমুল শান্ত বাচ্চার মতো শুয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ পরে শিমুল নিভু নিভু গলায় পুষ্পকে বলে,
“কি খবর পুষ্পরানী?”

শিমুলের এমন কথায় পুষ্প চোখ খুলে তাকায়।শিমুলের চুলে হাত রেখে বলে,
“আপনি ভীষণ খারাপ মানুষ।”

“তাই নাকি?”

“ভীষন খারাপ।”

“আচ্ছা।”

“আসলেই খারাপ।”

“প্রতিটা পুরুষই তার ব্যাক্তিগত নারীর সানিধ্যে আসলে খারাপ হয়ে যায়।”

“এতো খারাপ হতে হয় না।”

“হয় তো।চৈত্রের খরায় মরে যাওয়া গাছে ফুল ফুটেছে।শিমুল ফুল।”

শিমুলের কথা শুনে পুষ্প ঠোঁট উল্টে বললো,
“আর একটাও বাজে কথা বলবেন না।”

“আরে বাজে কথা কি?আর এভাবে আপনি আপনি করছো কেন?প্রমোশন থেকে ডিমোশন করে দিলে ব্যাপার কি?”

পুষ্প কথা বলেনা।হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়।এই মুখ আর শিমুলকে দেখানো যাবে না।শুধু শিমুল কেন অন্য কাউকেই দেখানো যাবে না।সারা অঙ্গে শিমুল লেপ্টে গেছে যেন অন্য কেউ দেখলেই বুঝে যাবে।শিমুল কিছুক্ষন পুষ্পকে দেখে বললো,
“এই জন্যই বলি তোমার নাম পুষ্প না রেখে লাজুকলতা রাখার দরকার ছিলো।”

পুষ্পর নিজেকে কেমন পূর্ণ পূর্ণ লাগে।সুখে চোখে পানি চলে আসে।সে টলমল চোখে শিমুলকে দেখে।
শিমুল সেদিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো,
“আমি খুব সরি ফুলরানী।”

পুষ্প শিমুলের বুকে হাত রাখে।শিমুলের মুখে হাসি দেখে পুষ্পর মনটা ভরে যায়।শিমুলের কানে নিজের ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলে,
“তুমি এতো পাগল কেন?”

“তোমার বর যে এইজন্য।”

“হুম।”

“তুমি যে আমার সুখের রানী তা জানো?”

পুষ্প শিমুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আগে জানতাম না এখন তোমার সুখী চেহারা দেখে কিছুটা উপলব্ধি হচ্ছে।”

“কিছুটা না আমার সব সুখ আল্লাহ তোমার মাঝেই দিয়েছে।তোমাকে পেয়ে আমি পূর্ণ।তোমাকে আমার করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।”

পুষ্প কিছু বলেনা।শিমুলের আদুল বুকে চুপচাপ শুয়ে থাকে।আল্লাহ স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই দুজনের পরিপূরক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।একজন আরেকজনের সুখের খোরাক।পুষ্প তার ফুসফুস ভরে শিমুলের ঘ্রাণ নেয়।

ভোর সকালে পুষ্প উঠে যায়।বিছানায় শিমুল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে,শিমুলের দিকে তাকিয়ে পুষ্পর রাতের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে।লাজুক হেসে বাথরুমে ছুটে।ফ্রেস হয়ে নামায পড়ে।মোনাজাতে সবার আগে শিমুলের জন্য দোয়া আসে।এমন স্বামী দেয়ার জন্য বারবার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে।নামায শেষ করে আবার বিছানায় শুয়ে থাকে।ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।কিন্তু শুয়ে থাকলে তো চলবেনা।যেকোনো সময় শিমুল জেগে যাবে।পুষ্প এই লোকের সামনে পড়তে চায় না।ধীর পায়ে হেটে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।ফুলি তখন রান্নাঘরে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত।পুষ্পকে দেখে হাসে।এই ফুলি মেয়েটাকে পুষ্পর পছন্দ হয়েছে,খুবই দিলখোলা।দুজনে এটা সেটা বলতে বলতে নাস্তা রেডি করে।রাবেয়া এসে পুষ্পকে দেখে খুশী হয়,পুষ্পর মাথায় হাত ভুলিয়ে বলে,
“তোমার এতো সকালে উঠতে হবে না,প্রথম প্রথম একটু দেরী করে উঠলেও আমি বকা দিবো না।”

পেশকারা এসে এই কথাটা শুনে নেয়।
“কোন নবাবজাদি বিয়ে করিয়ে এনেছো যে দেরী করে উঠবে?”

“আম্মা…”

“তুমি চুপ থাকো।এই মেয়ে তোমার আম্মা কি কোন তাবিজ টাবিজ দিয়েছে নাকি?সকালে নাস্তার সাথে মিলিয়ে দেয়ার ধান্ধায় আছো?”

পুষ্প অবাক হয়ে বললো,
“তাবিজ?”

“কেনো তাবিজ চিনো না?তাবিজ করে শিমুলকে যেভাবে পাগল করেছো।”

পুষ্প অবাক হয়ে তার শাশুড়ীর দিকে তাকায়।রাবেয়া তার শাশুড়ীকে এটা সেটা বলে থামায়। পেশাকারা গিজগিজ করতে করতে চলে যায়।

পলাশ কলেজে যাওয়ার পথে দেখে নিধি রেস্টরুমে বসে আছে।উঁকি দিয়ে দেখলো আর কেউ আছে কিনা কাউকে দেখতে না পেয়ে টুপ করে ঢুকে দড়জা আটকে দেয়।হঠাৎ করে পলাশ আসাতে নিধি চমকে তাকায়।পলাশ এসে সোজা নিধির দু’পা আঁকড়ে ধরে।
“নিধি আমি জানি আমি তোমার অযোগ্য।কিন্তু এভাবে কথা না বলে কষ্ট দিও না।আমার সহ্য হয়না।প্লিজ।”

নিধির বুকের তোলপাড় পলাশ দেখে না।তার বুকের রক্তক্ষরণ কারো চোখে পড়ে না।অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পলাশের এমন ভেঙে পরা দেখে নিধি অবাক হয়।হাত দিয়ে জোড় করে পলাশের বাধন থেকে মুক্ত হয়।
“কি করছেন মাথা ঠিক আছে?”

“কথা বলো।যা ইচ্ছা তাই বলো কিন্তু এভাবে চুপ থেকো না।”

“কথা বললে কি হবে?সব কি আগের মতো হবে?আমার নিষ্পাপ ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারবেন?”

পলাশ চুপ করে নিধিকে দেখে।নিধি আবার বলে,
“কিছুই আর আগের মতো হবে না।আর আপনিও আমার সামনে এভাবে আসবেন না।চলে যান।আর বিরক্ত করলে আমি কলেজ থেকে চলে যাবো।”

পলাশ ছলছল চোখে নিধিকে দেখে।তার জন্য চলে যাবে?উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আর কথা বলতে আসবো না।বেশী সমস্যা হলে বলো চাকরী ছেড়ে দেবো।”

সে আস্তে করে বেরিয়ে আসতে গেলে নিধি হাত ধরে আটকায়।পলাশ কিছু বুঝে উঠার আগেই নিধি পলাশের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ফিসফিস করে বললো,
“আমি আর সইতে পারছি না পলাশ।বুকে প্রচন্ড ব্যাথা করে,এই।যন্ত্রনায় মরে যাচ্ছি।আমাকে প্লিজ মুক্তি দাও।বাঁচতে দাও।”

পলাশ নিধিকে শক্ত করে নিজের বুকে মিশিয়ে নিতে চায়।অন্যের বউ বুকে নেওয়া পাপ সেটা পলাশ জানে তবুও আজকে সে পাপ করতেই রাজি।অনেক বছর ধরে যার ছোঁয়া পেতে মন উচাটন তার ছোঁয়া পেয়ে পলাশের নাকের পাটাতন ফুলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে।নিধির ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে নিধির মতো করেই ফিসফিস করে বললো,
“আর জ্বালাব না।জীবনের তরে মুক্তি দিলাম।”

শিমুল সকালে ঘুম থেকে উঠে পুষ্পকে পায় না।মনে মনে হাসে,পুষ্প যে লজ্জায় কাছে আসছে না এটা বেশ বুঝতে পারছে।তারপর গলা উঁচিয়ে পুষ্পর নাম ধরে ডাকে।পুষ্প তখন সোফায় বসে তার শাশুড়ীর মাথায় তেল দিচ্ছিলো।ফুলিকে বললো,
“ফুলি তোমার ভাইয়া কেন ডাকে দেখে আসো তো?”

ফুলি দৌড়ে যায়।পায়ের শব্দ শুনে শিমুল ভাবে পুষ্প এসেছে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে দেখে ফুলি দাঁড়িয়ে আছে।
“ভাইজান কিছু লাগবো?”

শিমুল হাসিহাসি মুখ নিমিষেই গম্ভীর করে বললো,
“চা লাগবে।”

“আচ্ছা।”

শিমুল দরজা থেকে উঁকি দিয়ে দেখে পুষ্প তার মায়ের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে।ফুলি চা নিয়ে আসে।
“তোর ভাবীকে গিয়ে বল আমি ডাকছি।”

ফুলি গিয়ে বললো,
“ভাবী ভাইয়া ডাকে।জলদি যান।”

রাবেয়া মুচকি হেসে উঠে যায়।মাথার চুল হাতখোপা করতে করতে বলে,
“আমি রুমে যাই একটু কাজ আছে।শিমুল কেনো ডাকে দেখো গিয়ে।”

শাশুড়ী যে বুজতে পেরেই চলে গেছে এটা দেখে পুষ্প লজ্জা পায়।আস্তে আস্তে রুমের দিকে এগিয়ে যায়।শিমুল পুষ্পকে দেখে হাসে।এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়ায়।
“কই ছিলেন ম্যাম?”

“এই এখানেই।”

শিমুল পুষ্পর মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বললো,
“সব ঠিকঠাক?”

পুষ্প মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়।
“সত্যিই?”

পুষ্প আস্তে করে বললো,
“জ্বী।”

শিমুল পুষ্পকে নিয়ে বিছানার এক কোনায় বসে,
“তুমি ভালো আছো?”

পুষ্প শিমুলের দিকে তাকায়।মাথা নেড়ে বললো,
“ভালো।”

শিমুল বিছানায় হেলান দিয়ে বসে।পুষ্পর লজ্জালজ্জা চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকে আরো লজ্জা দিতে বললো,
“পুষ্প কাল রাতে কি হয়েছিলো?” আমার ঠিক মনে পড়ছেনা।তোমার মনে আছে?”

শিমুলের এমন কথা শুনে পুষ্প চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়।
“রাতে কিছু হয়নি।আমরা ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

শিমুল হাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরে বললো,
“ওই শিমুল ফুল টুল নাকি…..”

পুষ্প শিমুলের মুখের কথা না শুনেই রুম থেকে চলে যায়।এই ছেলে তাকে মেরেই ফেলবে।

চলবে…..।

#শিমুল_ফুল
#২৯
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

নিধি পলাশের বুক থেকে মাথা তুলে পলাশের দিকে তাকায়।পলাশের চোখ ভিজা।মাথা নিচু করে বললো,
“আর জ্বালাব না নিধি।তুমি তোমার মতই থেকো।”

নিধি হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে।বুকটা এতো পু/ড়ছে যে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ম/রে যাবে।নিধি আস্তে করে ডাকে,
“পলাশ…”

পলাশ নিধির চোখে চোখ রাখে।কাজলকালো চোখ ভিজা,নিধির কান্না পলাশের সহ্য হয় না।নিধি পলাশের ঠোঁটের কাঁপন,চোখের কাতরতায় স্পষ্ট দেখতে পায় শুদ্ধ ভালোবাসার ছাপ।পলাশের চোখের পানি মুছে বললো,
“তুমি এতো ভালো কেন?”

পলাশ শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বললো,
“আমি ভালো না নিধি ভালো হলে তুমাকে নিজের করে রাখতে পারতাম,আমি তা পারিনি।আমি ব্যর্থ প্রেমিক,খা/রাপ প্রেমিক।”

নিধি পলাশের ক/ষ্টে ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মু/ক্তি দিয়ে দিচ্ছো?”

পলাশ নাক টেনে বললো,
“তুমি তো তাই চাইলে?”

“আমি কি চাই তুমি সেটাই কখনো বুঝনি।”

পলাশ নিধির হাত ধরে বললো,
“মু/ক্তি চাও না?”

নিধির আবারও ইচ্ছে করে পলাশের বুকে যেতে কিন্তু নিধি মায়া বাড়াতে চায় না।মাথা নিচু করে ব্যাগ হাতে নেয়।নিধি চলে যেতে নিলে পলাশ হাত আঁকড়ে ধরে।
“উত্তর দিয়ে যাও।”

নিধি উত্তর দেয় না।পলাশের মুখে হাত ভুলিয়ে বললো,
“বিয়ে করোনি কেন?”

পলাশ ঠোঁট এলিয়ে হালকা হাসে,
“নিধির মতো কাউকে পাইনি।”

“পেলে বিয়ে করতে?”

“পাবো কিভাবে?নিধি তো একজনই।”

নিধির ভেতরটা সুখ সুখ ব্যথায় কেঁদে উঠে।মাথা নিচু করে বললো,
“সারাজীবন কি একাই কাটাবে?”

পলাশ নিভু গলায় বলে,
“জানিনা।”

নিধি আর কিছু বলেনা।পলাশই বলে,
“তোমার বর কই থাকে?এখানেই নাকি?”

পলাশের প্রশ্নে নিধি পলাশের চোখে তাকায়।
“বোকা ছেলেটাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মানা সম্ভব না।তাই কাউকে বর বানানো হয়ে উঠেনি।”

নিধি দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায়।পলাশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথাটার অর্থ বুঝে নেয়।বুঝতে পেরে বুকের কাঁপন বাড়ে মুখে খেলে যায় এক আকাশ পরিমাণ খুশীর ঝিলিক।সম্ভাবনার পথের সুক্ষ্ম ছিদ্র দেখে চোখের তারা চিকচিক করে উঠে।দ্রুত পায়ে নিধির পিছু যায়।নিধি ততক্ষণে ক্লাসে চলে গেছে।পলাশের বুক শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে যায়।নিধি কি বিয়ে করেনি?কিন্তু নিধির তো বিয়ে হয়েছিলো।

সারাটা সকাল পুষ্প তার শাশুড়ীর সাথে রান্নায় সাহায্য করেছে।শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসছিলো।বারবার বিছানায় যেতে ইচ্ছে করলেও লজ্জায় শিমুলের সামনে যায়নি।শিমুল অনেক বার এসে ঘুরে গেছে।কয়েকবার পুষ্পর চোখে চোখ পড়াতে রুমে যাওয়ার জন্য ইশারা করেছে,পুষ্প যায়নি।শিমুল বারবার এসেছে পুষ্প ভুল করেও শিমুলের দিকে তাকায়নি।দুপুরে সবাই খাওয়ার পরেও পুষ্প রান্নাঘরে টুকটাক এটা সেটা ধুয়ার বাহানায় রান্নাঘরেই থাকে।রাবেয়া সকাল থেকেই ব্যাপারটা খেয়াল করেছে পুষ্প সেই সকালে রান্নাঘরে এসেছে এখনো ঘরে যাচ্ছে না।শিমুল যে বারবার এটা সেটার বাহানায় পুষ্পর কাছেই আসছে এটা রাবেয়ার চোখে পড়ছে।রাবেয়ার একটা অভ্যাস হলো দুপুরে একটু না ঘুমালে শরীর খারাপ লাগে উনি রুমে যাওয়ার আগে পুষ্পকে বললেন,
“পুষ্প রুমে যাও।শিমুলের কিছু লাগে কিনা দেখো।”

পুষ্প আস্তে-ধীরে রুমে যায়।দরজা বন্ধ করে বিছানার দিকে তাকায়।শিমুল অন্যপাশে ফিরে শুয়ে আছে।পুষ্প চুপচাপ বিছানার অন্যপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে।বিছানায় অন্যকারো উপস্থিতি টের পেয়ে শিমুল ফিরে তাকায় পুষ্পকে দেখে আবার আগের মতো করে শুয়ে পরে।পুষ্প অবাক হয়ে লক্ষ করে শিমুলের মুখে অভিমানের গাঢ় আস্তরনের প্রলেপ।ছেলেটা কি অভিমান করেছে?কেন?পুষ্প আর কাছে আসেনি বলে?পুষ্প কিছুক্ষণ শিমুলের পিঠের দিকে তাকিয়ে থাকে।কিন্তু শিমুলের নড়চড় নেই।পুষ্প হাত দিয়ে শিমুলের পিঠে চিমটি দেয়,খোঁচা দেয় শিমুল শক্ত হয়ে পড়ে থাকে।পুষ্প পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
“আমার পাগলটা কি রাগ করেছে?”

শিমুল কথা বলেনা।পুষ্পই আবার বলে,
“সরি।এইযে চলে এসেছি।”

শিমুল এমনভাবে শুয়ে আছে যে পুষ্পর পক্ষে নড়ানো সম্ভব না।কোনভাবেই পুষ্প শিমুলকে তার দিকে ফিরাতে পারে না।অগত্যা শিমুলের সামনে দিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ে।শিমুলের শক্ত করে রাখা হাত সরিয়ে শিমুলের বুকে যায়।এতেও কোন হেলদোল নেই।পুষ্প শিমুলের মুখের দিকে তাকায়।ছেলেরা অভিমান করলে যে এতো সুন্দর লাগে তা আগে কখনো দেখেনি।দেখবে কি করে কোন ছেলে তো তার সাথে অভিমান করেনি।পুষ্প হাত বাড়িয়ে শিমুলের গাল,ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
“কথা বলবেনা?”

শিমুলকে রাগাতে বললো,
“শিমুল ভাই!অ শিমুল ভাই!”

পুষ্প আশা নিয়ে শিমুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।নিশ্চুপতা দেখে পুষ্পর ইদুরের মতো চিকন দাঁত দিয়ে শিমুলের ফর্সা গলায় কামড়ে দেয়।শিমুল এবার নড়েচড়ে আক্রমণকারীর দিকে তাকায় কিন্তু কথা বলেনা।পুষ্পর এবার রাগ হয়।রুমে আসেনি বলেই এতো অভিমান?কেন আসেনি একটু বুঝা দরকার ছিলো না?পুষ্পর যে লজ্জা লেগেছে সেটা বুঝলো না?কেমন তকতক করে অভিমানের বহর নিয়ে ঘুরছে।অকারনেই পুষ্পর চোখে পানি এসে জমে।শিমুলের বাহু থেকে উঠে নিতে চাইলে শিমুল আটকায়।টেনে আবার আগের জায়গায় শুয়িয়ে বললো,
“কই যাও?”

পুষ্প মুখ নামিয়ে বললো,
“যেখানে ইচ্ছা।”

“আমি রাগ করেছি,আমার রাগ ভাঙ্গাও।”

পুষ্প আবার উঠতে চায়।শিমুলের বলিষ্ঠ হাত থেকে নিজের হাত জোড়াজুড়ি করে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
“পারবোনা।”

“আমার অভিমান ভাঙ্গাতে এসে নিজেই অভিমান করে ফেলেছো।”

পুষ্প কথা বলেনা।শিমুল পুষ্পকে পিছন থেকে জড়িয়ে ঘাড়ে সুরসুরি দেয়।রাগ ভুলে পুষ্প খিলখিল করে হেসে উঠে।শিমুল আদর আদর গলায় বললো,
“কতো কষ্ট করে বউকে কাছে নিয়ে আসলাম।আর বউ কিনা আমাকে একা রেখে পালিয়ে বেড়ায়।এটা কি ঠিক কাজ?”

“ঠিক কাজ।”

“ঠিক কাজ না সুন্দরী।এই বুকের জ্বলন যদি দেখতে তাহলে পালাতে না বুকেই লুকাতে।”

“হুম।”

শিমুল হাতের তালুতে মাথা রেখে বললো,
“সারাদিন আসলে না কেন?”

পুষ্প শিমুলের দিকে তাকিয়ে হাসে। শিমুলের কোকড়া চুল গুছিয়ে দেয়।
“সারাদিন কাজ করছিলাম।”

“কাজ নাকি আমার থেকে লুকিয়ে থাকার ধান্ধা?”

“তুমি বেশী বুঝো।”

“তা বুঝি।আর বেশী না বুঝলে এই সুন্দরীকে আটকাবো কি করে?”

পুষ্প শিমুলের বুকে মাথা লুকায়।শিমুল ফিসফিস করে বললো,
“এতো জ্বালাও কেন?”

পুষ্প কথা বলেনা।শিমুল চাতক পাখির মতো পুষ্পকে দেখে।খোচাখোচা দাড়ি দিয়ে পুষ্পকে ছুঁয়ে দেয়,নরম গালে বৃদ্ধাজ্ঞুলি দিয়ে ঘসে দেয়।শিমুল যখন পুষ্পর নরম ঠোঁটে স্বর্গীয় সুখের অতলে ডুবে যাচ্ছে তখনি দরজায় ধাক্কিয়ে কেউ ডাকে।পুষ্প ছটফট করে উঠে নিতে চাইলে শিমুল উঠতে দেয় না।শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো,
“এখন না পরে প্লিজ।”

পুষ্প এই বাড়ির সবাইকে যমের মতো ভয় পায়।দরজা খুলতে দেরী হলে যদি আবার কিছু বলে।শিমুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“না গেলে খারাপ বলবে।শুনে আসি?”

শিমুল বাচ্চাদের মতো জেদ করে বললো,
“না।”

পুষ্প জোড় করে উঠে দরজা খুলতে যায়।দরজা খুলে দেখে পেশকারা আর সুইটি দাঁড়িয়ে।পুষ্পকে দেখে পেশকারা বললো,
“আমার মাথায় তেল দিয়ে উকুন খুলে দিবা।আসো।”

পুষ্প পিছনে ফিরে দেখে শিমুল অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে।পুষ্প না করেনা নতুন বউ হয়ে কথা অমান্য করা ঠিক না।পেশকারার সাথে বেরিয়ে যায়।পেশকারা প্রথমে মাথায় তেল দেওয়ায়।সুইটি এসে বললো,তার হাতে নেলপালিশ দিয়ে দিতে।পুষ্প চুপচাপ দিয়ে দেয়।তারপর পেশকারা মাথায় উকুন দেখতে বলে।পুষ্প সারা মাথা ঘেটে একটাও উকুন পায় না।ভয়ে ভয়ে বললো,
“বুবু মাথায় তো উকুন নেই।”

পেশকারা তেতে উঠে বললো,
“মন দিয়া দেখো।উকুনের চুলকানিতে জীবন যায়যায় অবস্থা।”

পুষ্প আসরের আজান পর্যন্ত পেশকারার মাথায় উকুন খুঁজে,কিন্তু একটাও উকুন পায় না।তখনি শিমুল রুম থেকে বেরিয়ে আসে।কালো ট্রাউজার,কালো গেঞ্জি পরে থমথমে মুখে ধুপধাপ পা ফেলে পুষ্পর সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়।শিমুলের এমন চেহারা দেখে পুষ্পর মন খারাপ হয়,বেচারী সারাদিন পুষ্পর সানিধ্য পাওয়ার জন্য ছটফট করেছে এখন যাও একটু পেয়েছিলো বুবুর জন্য তাও হলো না।শিমুল বাইক স্ট্রাট দেয়ার সাথে সাথে পেশকারা আর সুইটি উঠে দাঁড়ায়।পেশকারা মাথার চুল হাত দিয়ে ঝেড়ে বলে,
“অনেক উকুন খুলেছো যাও রুমে যাও।”
তারপর দুজনে মুচকি হাসতে হাসতে চলে যায়।পুষ্প রুমে এসে দরজা আটকে বিছানায় পা তুলে বসে।পেশকারা আর সুইটি যে তাকে শিমুলের থেকে দূরে রাখতে এতক্ষণ আটকে রেখেছিলো এটা বেশ বুঝতে পারছে।শিমুলের অসহায় চাহনির কথা মনে হয়ে পুষ্প ডুকড়ে কেঁদে উঠে।

পলাশ নিধির ভাড়া বাসায় এসেছে।দুই রুম নিয়ে নিধি কলেজ পাড়ায় ভাড়া থাকে।আজকে একটা ক্লাস করেই বাসায় চলে এসেছে। পলাশ প্রিন্সিপাল স্যারকে নিধির কথা জিজ্ঞাসা করাতে উনি জানালেন নিধি অসুস্থতা বোধ করাতে বাসায় চলে গেছে।নিধির তখনের বলা কথাটা পলাশের গলায় কাটার মতো আটকে আছে।সাহস করে প্রিন্সিপাল স্যারকে জিজ্ঞাস করে,
“নিধি কি ফ্যামিলি নিয়ে থাকে?”

প্রিন্সিপাল হেসে বলে,
“নিধি তো বিয়ে করেনি।আর বাবা মা নেই।কলেজ পাড়ায় ভাড়া বাসায় একাই থাকে।”

পলাশ চমকে যায়।সত্যিই নিধি বিয়ে করেনি?প্রিন্সিপালের থেকে বিদায় নিয়ে তখনি চলে আসে।তার বুকটা শুকনো মরুভূমির মতো খা খা করে,নিধিরও কি এমন মনে হয়?পলাশ দরজায় নক করে দাঁড়িয়ে থাকে।

নিধির আজকে এতো কান্না পাচ্ছে যে কোনভাবেও নিজেকে আটকাতে পারছে না।বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কাঁদছে,ছেলেটা তাকে এতো ভালোবাসে কিন্তু দুজনের মাঝে কতো বাধা।নিধির ইচ্ছা করে পলাশের বুকে একটা রাত শান্তি মতো ঘুমাতে।কতোদিন হয়ে যাচ্ছে নিধি ঘুমায় না।দরজায় নক করার শব্দ শুনে নিধি মাথা তুলে তাকায় কান্নার কারনে নিধির মুখের অবস্থা খারাপ।বেসিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ভরে মুখে পানি দেয়।তার কাছে কেউ আসার কথা না ভাবলো বাড়িওয়ালা এসেছে নিধি ওরনা গায়ে দিয়ে দরজা খুলে।দরজা খুলার সাথে সাথেই পলাশ ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।পলাশ চোখ ভরে সাদা থ্রীপিছ পড়া উজ্জল শ্যামলা গড়নের মেয়েটাকে দেখে।মুখের দিকে তাকিয়ে পলাশের কপাল কুচকে যায়।বুঝতে পারে এই ডাগর চোখ থেকে পানি ঝড়েছে।
“কেঁদেছো কেন?”

হঠাৎ পলাশের আগমন নিধির হজম হয় না।পলাশের হাত ধরে টেনে দরজার কাছে নিয়ে বলে,
“চোখ আছে তাই কেঁদেছি।তুমি এসেছো কেন?”

পলাশ গম্ভীর গলায় বললো,
“পা আছে তাই এসেছি।”

“ভালো করেছো।এখন চলে যাও।”

নিধি পলাশকে বের করতে চাইলে পলাশ নিধিকে দরজায় চেপে ধরে।
“বিয়ে করোনি কেন?”

“ইচ্ছে করেনি তাই।”

নিধি ছাড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করে।পলাশ নিধির কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“সত্যি করে বলবে,আমার জন্য কি বুকটা একটুও পুড়ে না?”

নিধি কিছু বলেনা।কাজলকালো ডাগর ডাগর চোখ মেলে পলাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।পলাশ আবার বলে,
“আমি কতো রাত ঘুমাই না নিধি।কতো রাত বুকে শান্তির বাতাস বয় না।আমাকে একটু শান্তি দাও না নিধি।”

নিধির চোখ বেয়ে আবার পানি পড়া শুরু হয়।পলাশের বুকে হাত রেখে পলাশকে দূরে সরাতে চায়।
“চলে যাও প্লিজ।”

পলাশ দূরে সরে না।নিধির চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে।দুজনে অনেকক্ষন দুনিয়া ভুলে দুজনকে দেখে,বন্য বতাসের রেশ গায়ে লাগে।হঠাৎ করেই দুজনে দুজনের ভেজা ঠোঁট আঁকড়ে ধরে।স্থান,কাল,সময় সব ভুলে নিধি দু’হাত দিয়ে পলাশকে নিজের দিকে টেনে নেয়।পলাশ নিধির ভালোবাসা মাথা পেতে নেয়।অধরে অধর মিশিয়ে ভালোবাসার সুধা পান করে।
পলাশ আলতো গলায় বলে,
“চলো।”

নিধি তখন পলাশের বুকে মুখ গুজে কাঁদছে।পলাশের কথা শুনে বললো,
“কোথায়?”

পলাশ নিধির কপালে ভালোবাসার শুদ্ধতম চুমু দিয়ে বললো,
“বিয়ে করবো।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে