শিক্ষা

0
690
আমি বিয়ে করেছি ১৯৭৫ সালে। এক অদ্ভুত মেয়েকে। যেমন সুন্দরী তেমনি তাঁর গুন। সে হাসলে আমি আবার তাঁর প্রেমে নতুন করে অসুস্থ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পেতাম না। তাঁর রান্নার হাত এতোই ভালো ছিলো। বিনা আমন্ত্রণে বাড়িতে মেহমান আসতেই থাকতো। আর যেতে চাইতো না। শুধুই তাঁর হাতের রান্নার জন্য। বিয়ের পরে যতবার জড়িয়ে ধরেছে, আমি এতোই কাঁপতাম যার ভয়ে সে জড়িয়ে ধরার সাহস পেতো না! কোনো রোগ না হয়ে যায় আমার! নতুন বিয়ে। ভোরে জাহাজ থেকে আসো, আবার দুপুরের সময় যাও। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তো সারাজীবন পার করে দিতে পারি। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য টাকাও তো দরকার। মেয়েটা এতো অল্পতে খুশি হয়ে যেতো। সে কথা আর কী বলবো। তাঁর ব্যাপারে আরেকটা ব্যাপার না বললেই নয়, তা হলো দয়া। যে কোনো জিনিস। খাওয়ার হোক বা পড়ার। নিজে ভোগ না করে অন্যকে দিয়েই সে শান্তি পেতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে। যেদিন রানু বলেছিলো আজকে পারলে জাহাজ থেকে একটু তাড়াতাড়ি আসবেন। একটা খুশির খবর আছে। সেদিন আর আমি বাড়ি ফিরতে পারিনি। যার অধীনে কাজ করতাম। সে বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেছিলো, “ তোদের সবার কপাল খুলে গিয়েছে রে। কালই আমরা কাতারের উদ্দেশ্য রওনা দিবো। কাতার সরকার তোদের চেয়েছে! ” পুরো বিষয়টা কী আমি তখন জানি না। সবাই বেশ খুশি হয়েছিলো, আবার মনও খারাপ হয়েছিলো। এই সবুজের নীর ছেড়ে যেতে হবে অন্য কোনো দেশে! তবুও সবাই রাজি হয়েছিলো। এর কারণ আছে। তখন আমাদের এক দিনের পারিশ্রমিক ছিলো মনে হয় পনেরো টাকা৷ আর কাতারে আসলে আমাদের মাসিক বেতন দুই হাজার রিয়াল! সরকারী চাকুরী হবে। অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তো আছেই। শেষবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো মায়ের কোলে মাথাটা রাখি। রানুর কপালে একটা চুমু খাই। সেটা আর হয়নি। হাতে সময় ছিলো না বিধায় পরেরদিনই কাতারের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। এইযে এখন কাতারে এতো কিছু, এতো সুন্দর রাস্তা, বড় বড় বিল্ডিং, এখন তো খেলার স্টেডিয়ামও হচ্ছে, কিছুদিন পরে বিশ্বকাপ হবে। তখন কিছুই ছিলো না এসব। মাত্র তেরোটা পরিবার ছিলো কাতারী! আর আমরা বাংলাদেশি এসেছিলাম চৌদ্দ জন। কিছু ভারতীয়ও ছিলো তখন। আমাদের থাকা খাওয়ার এতো সুব্যবস্থা করে দিয়েছিলো যা বলার বাহিরে। বিলাসবহুল জীবন তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কাজ শুধু বাহির থেকে জাহাজ আসলে তা পরীক্ষা করা। আর জাহাজের যান্ত্রিক ত্রুটি হলে সেটা দেখা৷ কিন্তু এসব আমার ভালো লাগে না। রানুর কথা মনে পড়ে। কিছু খেতে পারি না। আমি খাওয়ার সময় রানু হাতে হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতো। যদি বলতাম মজা হয়নি। সে ঠোঁটে চুমু দিয়ে দিতো। এখানে মজা হয়নি বললে, মুরগীর বদলে গরুর মাংস দিবে। গরুর মাংসের বদলে খাসির মাংস দিবে। কিন্তু কেউ ভালোবেসে দিতে পারে না! চিঠি লিখতাম, চিঠি লিখার সময় দুচোখের পানি একাকার হয়ে যেতো। যেদিন চিঠির উত্তর পেতাম। ঈদ ঈদ লাগতো। সে কী খুশি। সে কী উত্তেজনা! এক বছর পরে দেশে গিয়েছিলাম। যেয়ে দেখি আমার আমার ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে৷ এর আগে কোনোদিন চিঠিতে বলেনি! সে হয়েছে পুরো আমার মতো। সেদিনই মনে হয় আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন ছিলো। কিন্তু যখন জানতে পারলাম এর মাঝে আমার মা জননী মারা গিয়েছে! আমাকে বলতে পারেনি। তখন আমার দুনিয়া যেন কেয়ামত হয়ে গিয়েছিলো! এতোই দুঃখ পেয়েছিলাম যে, আমার পক্ষে দুনিয়ার কোনো ভাষায় তা বুঝাতে পারবো না কাউকে। আবার কাতারে ফিরে আসলাম। সেই একই কাজ। খাও, ঘুমাও, গোসল করো তারপর জাহাজের দেখাশোনা করো আবার খাও, ঘুমাও গোসল করো। তারপর দুবছর পরপর দুমাসের জন্য ছুটি দিতো। টাকা পয়সার কোনো কষ্ট তো নেই। কারণ প্রতি বছর বেতন বাড়তেই আছে। তবুও সময় যায় না। ঘুমুতে গেলে রানুর চেহারাটা যখন চোখে ভাসতো! ঘুম আকাশে উড়ে যেতো। এভাবেই জীবন চলছিলো। রানু নামের অদ্ভুত মেয়েটার এরপরে আরো তিনটা মেয়ে হয়েছে। সবাই দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। লেখাপড়া করেছে। সবার বিয়েও হয়ে গিয়েছে। ছোট দুই মেয়ে লন্ডনে আছে, মেঝটা নিউইয়র্কে আর সবার বড়টা দেশেই৷ এরপর বাড়ি গেলে খুবই খারাপ লাগতো। শান্ত বাড়ি। কোনো হৈচৈ নেই! মেয়েরাও তো হুট করেই আসতে পারে না অন্য দেশ থেকে! আমার এতো টাকা পয়সা! কিন্তু একটা ছেলে নেই। এমন সময় আমাদের মনে হলো যে আমাদের একটা ছেলে দরকার। তখন আমাদের দুজনেরই উত্তেজনা নেই বললেই চলে! তবুও তো একটা ছেলে দরকার। এই ডাক্তার, ঐ ডাক্তার, সেরা ডাক্তার সব ডাক্তারই দেখানো শেষ। কেউই কোনো উপায় বের করতে পারছেন না। অবশেষে একজন হায়দ্রাবাদের ডাক্তার বললো। আপনার সন্তান হবে। ছেলেই হবে। কিন্তু হওয়ার পরে যে কোনো একজন মারা যাবে। হয় ছেলে নাহয় মা! আমার ছেলের তো একটা দরকার ছিলো কিন্তু আমি রানুর মতো একটা চমৎকার নারীকেও হারাতে চাই না। এই মহিলাটাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। কিন্তু রানু সাক্ষর করে দিলো। আমাকেও জোর করিয়ে সাক্ষর করিয়ে নিলো সে। এই মহিলার অনুরোধ আমি না রেখে পারি না! সে বলেছিলো আল্লাহ্ এর উপর বিশ্বাস রাখেন। আমারও কিছু হবে না। ছেলে হলে তাঁরও কিছু হবে না! আমরা সাক্ষর করলাম। খাটি বাংলায় যাকে বলে বন সই। আল্লাহ্ মনে হয় রানুর কথাটা শুনেছিলো। উনার দয়া হয়েছিলো, আর রানুরও কিছু হয়নি! সে কী আনন্দ। পুরো গ্রামে মিষ্টি বিতরন এই খুশিতে। ছেলে বড় হচ্ছে। প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলো, হাইস্কুলে ভর্তি হলো। কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে গেলো। ছেলেটার যখন তেইশ বছর বয়স। তাঁর মা মারা গেলো! এই দুনিয়ায় আমি একা হয়ে গেলাম! তারপর আর বাড়ি যেতে মন চায় না। ছেলেকে দেখতে দুবার গিয়েছিলাম মনে হয়। রানু থাকলে আবিরের বিয়েটা আমরা অনেক ধুমধাম করেই দিতাম। কিন্তু সে তো নেই! আবিরকে বলে দিয়েছি তোর জীবনে যে মেয়েকেই সঠিক মনে হবে সারাজীবন পার করার জন্য। তাঁকেই বিয়ে করে ফেলবি। ছেলের একটা মেয়েকে পছন্দ হলো। আমাকে খুব করে বললো কিন্তু আমি গেলাম না। সে বিয়ে করে নিলো। চারটে মেয়ে একটা ছেলে সবাই স্বামী-বৌ সন্তান নিয়ে ভালোই আছে। আমি শুধু একা! এই বুড়ো বয়সে আমার পকেটে হাজার হাজার কাতারী রিয়াল থাকে! বুকে একটু শান্তি থাকে না। নামাজ পড়ে এতো যে আল্লাকে বলি। আল্লাহ্ আমাকে ফকির বানিয়ে দাও। আমার এতো টাকা পয়সা চাই না। আমাকে মা জননীকে ফিরিয়ে দাও। রানুকে ফিরিয়ে দাও! আল্লাহ্ নাকি গুনাহগার বান্দার কথা শুনে! আমার কথা কেনো শুনে না? তার কিছুদিন পর এই বিলাসবহুল জীবন নিয়ে তিক্ত হয়ে গেলাম। দেশে গেলাম বেড়িয়ে আসতে। আমার ছেলে আর মেয়েরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলো একটা বিয়ে করিয়ে দিবে! আমি একদম রাজি না! এই বুড়ো বয়সে বিয়ে! হ্যাঁ আমাকে দেখাশোনা করার জন্য কেউ একজনকে দরকার, কেউই যেহেতু আমার সাথে থাকে না! কিন্তু বিয়ে করলে লোকজন কী বলবে? ছেলে মেয়েরা আমার কথা শুনলো না। তাঁরা জোর করে একটা মেয়েকে বিয়ে করিয়ে দিয়ে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো! আর কোনোদিন দেশে এসে বলবো না, মেহরিমা একটু আয়, ঝুমুর একটু আয় তোকে দেখি। আবির আয় না তোকে নিয়ে একটু পাড়ায় বের হই! যে মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে দিলো। সে আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটারও ছোট! বাসর রাতের কথা আর কী বলবো। মেয়েটা কান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলো সে রাতে! আমি মেয়েটাকে ছোঁবার দুঃসাহস করিনি। আমি তাঁর বাবা না, দাদার বয়সী! একটা আঠারো বয়সী মেয়ে কীভাবে এতো বয়স্ক বুড়োকে স্বামী হিসেবে মেনে নিবে? মেনে নিবে দূরের কথা। ভাবতেও তো পারে না! কিন্তু কিছুদিন পর সে গর্ভবতী! অথচ আমি একদিনও তাঁর হাতটা পর্যন্ত ধরিনি! এই বয়সে কোনো সন্তান জন্ম দেয়ার শক্তি আমার এমনিতেই নেই! আমি জানতাম বাচ্চাটা আমার না। কিন্তু মেয়েটাকে কিছুই বলতাম না। কারণ তাঁরও তো মা হওয়ার অধিকার আছে। ছেলের মেয়ের মুখে আম্মু আম্মু শুনতে তাঁরও ইচ্ছে হয়। সে যা চাইতো আমি তাই দিতাম। এই জীবনে আমার আর আছেই কী? আমার সব ছেলে মেয়েরাও মেহজাবীনের ছেলের জন্য অনেক কিছু দিতো। ছেলেটা যখন নয় বছর বয়স সে নিখোঁজ! আমি তখন ছুটি কাটাতে দেশে। নিখোঁজ হওয়ার পরেরদিনই আমার ফ্লাইট! আমি ফ্লাইট ধরিনি। এই মেয়েটার কথা আমাকে ভাবতে হবে। ছেলেটাকে খুঁজতে হবে। কিন্তু যখন জানলাম ছেলে নিখোঁজের অভিযোগে আমার নামেই মামলা করে দিয়েছে।মেহজাবীন, তাঁর মা আর পরিবার মিলিয়ে! তখন জরুরী টিকিটে কাতার আসা ছাড়া আমি কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। এই বুড়ো বয়সে জেলে পঁচে মরতে চাই না। আবার বিনা অপরাধে! তারপর কী হলো, মেহজাবীনকে অন্য জায়গায় বিয়েও দিয়ে দিলো। ছেলেটাকে খুঁজে পেয়েছে কী না আমি জানি না। কিন্তু আমার নামে মামলা চলছেই। দেশে গেলেই জেল!
তাঁরা এখন আমার কাছে এতো টাকা চাচ্ছে যে বলার বাহিরে! মামলাটা তুলে নিতে। সব মেয়েকে আমার সব সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে। ছেলেকে দিয়ে এখন এই মুহূর্তে এতো টাকা নেই যত টাকা তাঁরা চাচ্ছে! ২০১০ এর পরে আমি আর দেশে যাইনি। খুব ইচ্ছে হয় ধানক্ষেত দেখতে। একটু যানজটে পড়ি! ঈদ এলে একটা গরু জবাই করি। রাত হলে বাজারে চায়ের দোকানে বসে একটু গল্প করি! কিন্তু আমি পারছি না! ভেবেছিলাম দূর কোথাও চলে যাবো। এক নেপালীকে বললাম পাহাড়ে কোথাও নির্জন জায়গায় আমাকে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। সে আমার পাঁচ হাজার রিয়াল নিয়ে চম্পট! অথচ তাঁকে কাতারের রাস্তাঘাট আমি চিনিয়েছিলাম। জাহাজে আমিই নিয়ে এসেছিলাম! তারপর এক ভারতীয় টাকা নিলো। আমাকে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে বলে। সেও চম্পট! এখন চোখে স্পষ্ট দেখি না। জাহাজে উঠে পরিদর্শন করবো দূরের কথা। এক কদম উঁচুতে উঠলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। বয়স একশো পেরিয়েছে! আমার আর এসির হাওয়া ভালো লাগে না। এসি ছেড়ে রৌদ্রতে গেলে, শরীর সহ্য করতে পারে না! এক নির্মম যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছি। আল্লাহ্ এর কাছে হাতজোড় করছি রানুর কাছে নিয়ে যেতে। উনি তাও করছেন না। আমাকে এতোই অপছন্দ তাঁর। কালকে ছেলেকে ফোন করে বললাম,
“ বাবা আমি আর এখানে থাকতে পারছি না। আমি তো দেশে নেই। তুই ভালো কোনো উকিলের সাথে দেখা করে আমার মামলাটার ব্যাপারে কিছু করতে পারিস কী না দেখ! ” ছেলে আমার উত্তর দিলো, “ এতো বুড়ো বয়সেও বিয়ে করার করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছেন? ” ছেলের নামের পাশে এতো টাইটেল! জানতে ইচ্ছে হয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠান আর বিদেশে পড়িয়ে আমার কী এই কথাটাই শোনার কথা?
২০১৯ শেষ হতে চললো, আল্লাহ্ এর কাছে দিনরাত প্রার্থনা করছি, ২০২০ এর আগেই যেন আমাকে রানুর কাছে পাঠিয়ে দেন! টাকা পয়সার হিসাব আমি আর করতে পারছি না। বিধাতা বড় দয়াময়, যদি একটু দয়া করেন। | শিক্ষা | সিয়াম আহমের জয়

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে