#শারদীয়ায়_শুভমিলন
#ঈপ্সিতা_মিত্র
আন্তরিক আজ খুব খুশি। দীর্ঘ্য পনেরো বছর পর আবার দেশে ফিরছে। সেই যখন ওর বয়স তেরো ছিল, সেই সময় ঠাম্মাকে ছেড়ে, নীলাকে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল আমেরিকা মা বাবার হাত ধরে। আন্তরিকের সেই সময় কষ্ট হতো খুব। বার বার বাবা মাকে জিজ্ঞেস করতো যে ঠাম্মা আর নীলাকে ফেলে কেন যাচ্ছে ওরা! নীলা তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। আর ঠাম্মার গায়ের গন্ধ না পেলে তো ওর ঘুমই আসে না। এই কথায় আন্তরিকের মা অন্তরা বেশ বিরক্ত হয়ে বলতো,
———” ঠাম্মা নিজের দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। আর ওনার জন্য কি আমরা এক জায়গায় আটকে থাকবো! আর নীলা এই বাড়ির কেউ না। ওর মা বাবা নেই বলে তোমার ঠাম্মা ওকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করছে। কি না তার মা না কি এক সময় এই বাড়িতে কাজ করতো! কতবার বলেছি মেয়েটাকে কোন অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিতে! কে শোনে কার কথা। যাইহোক, এই একই প্রশ্ন আমাকে হাজারবার করবে না তো! ”
কথাগুলো বেশ ঝাঁঝিয়ে বলতো অন্তরা। আর আন্তরিকের বাবা অমিতাভ এইসব প্রশ্নে চুপই করে থাকতো বেশিরভাগ সময়। উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করতো না। কিন্তু আন্তরিকের অবুঝ মন এই জটিল হিসেব বুঝতে চাইতো না কখনোই। তাই এই দেশে আসার পরও মন পড়ে থাকতো সেই শ্রীরামপুরে। ওই পুরনো বনেদি বাড়ি, দাবার ছক আঁকা মেঝে, ঠাম্মার শাড়ীর গন্ধ, নীলার সাথে এলোমেলো বকবক, শ্রীরামপুরের অলিগলি মেশানো দিনগুলোতে।
যাইহোক, এইবার পুজোয় দেশে ফিরতে পারবে ভেবে মনটা অস্থির হয়ে উঠছিল যেন। আন্তরিক তো ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে চাকরি পাওয়ার পরই ভেবেছিল নিজে টাকা জমিয়ে ইন্ডিয়া যাবে। তবে মা বাবা যে তার আগেই নিজে উদ্যোগ নিয়ে ইন্ডিয়া যাবে ঠিক করলো যখন, আন্তরিক বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল! আসলে এই পনেরো বছরে দুজনের কোন আগ্রহই দেখেনি নিজের দেশের বাড়ির প্রতি। যাইহোক, এই এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই নিজের ব্যাগ গুছিয়েছিল। অনলাইনে অর্ডার করে ঠাম্মা আর নীলার জন্য দুটো শাড়িও কিনেছে এইবার। যদিও জানে না নীলার পছন্দ হবে কি না! ঠাম্মার সাথে ভিডিও চ্যাট করার সময় নীলা বেশ কিছু বছর হলো আসে না আর সামনে একদম। কি জানি কি হয়েছে! জায়গার দূরত্ব আসলে মনের দূরত্বও বাড়িয়ে দেয়। তবে এইবার দেশে ফিরে সেই সব দূরত্ব শেষ করে দেবে আন্তরিক। ভেবেই শাড়ি দুটো রেখেছিল নিজের ব্যাগে। এরপর আঠেরো ঘণ্টার ফ্লাইট জার্নি অতিক্রম করে অবশেষে ওরা এসে পৌঁছেছিল নিজের দেশে, নিজের শহরে।
সেদিন অরুণা দেবীর চোখে জল চলে এসেছিল পনেরো বছর পর ছেলে বৌমা নাতিকে দেখে। যদিও ছেলে বেশি যোগাযোগ রাখে না। যা খোঁজখবর নেয়ার নাতিই নেয়। তাই উনি আন্তরিককেই জড়িয়ে ধরেছিলেন প্রথমে। তবে অন্তরা আজ শাশুড়ি মাকে দেখে বলে উঠেছিল বেশ উতলা হয়ে,
,———-” আপনাকে ভীষণ মিস করেছি মা এতগুলো বছর। রোজ আপনার কথা এত মনে পড়তো আমাদের!”
এই কথায় অরুণা দেবী তির্যক হেসেই বলে উঠেছিল,
———–” সে আমি সবই বুঝি মা, তোমার আর আমার ছেলের আমার কথা কত মনে পড়তো এতগুলো বছরে! যাইহোক, সেই আলোচনা বাদ দাও। এত দূর থেকে এসেছো। হাত মুখ ধুয়ে রেস্ট নাও। হরি তোমাদের ঘর দেখিয়ে দেবে। পনেরো বছরে নিজের পুরনো বাড়ি ঘরের ঠিকানা মনে না থাকাই স্বাভাবিক। ”
কথাগুলো যে উনি শুনিয়ে বলছিলেন সেটা বুঝতে অন্তরা আর অমিতাভর বাকি রইলো না। কিন্তু সব বুঝেও চুপ ছিল আজ দুজন। আসলে এই বাড়িটা যেভাবে হোক মায়ের কাছ থেকে নিজের নামে লেখাতে হবে। প্রোমোটারের সাথে কথা হয়ে গেছে। খুব ভালো ডিল আছে। অনেক টাকার ব্যাপার! তাই সব তেঁতো কথাই হজম করে নিয়ে আস্তে আস্তে মায়ের মনটা গলাতে হবে নিজেদের প্রতি। কথাগুলো ভেবেই আর কোন কথা না বাড়িয়ে নিজেদের ঘরে চলে গেছিল ওরা। তবে আন্তরিকের এলোমেলো মন শুধু নীলাকে খুঁজছিল। মেয়েটা গেটের বাইরেও আসেনি ওদের রিসিভ করতে। কে জানে কোথায়! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের সেই পুরনো ঘরে গেছিল ছেলেটা। সেই সময় দেখেছিল একটা মেয়ে টুলের ওপর উঠে খুব মন দিয়ে পর্দা লাগাচ্ছে ওর ঘরে। খোলা বড় চুল, নীল রঙের শাড়ির আঁচল খেয়াল করলেও মেয়েটার মুখটা উল্টো দিকে ঘোরানো ছিল বলে দেখতে পাচ্ছে না আন্তরিক। তবে এই মুহূর্তে মেয়েটার টুলটা হঠাৎ নড়তে শুরু করলো। একটু এদিক ওদিক হলেই তো মেয়েটা পড়ে যাবে নিচে। কথাটা ভেবেই আন্তরিক মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেল আর ধরে ফেললো ওকে নিজের মধ্যে। এই সময় প্রথম দেখলো আন্তরিক এই অচেনা মেয়েটাকে। বড় বড় চোখ, কপালে ছোট্ট টিপ, মিষ্টি শান্ত একটা মুখ। দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছিল যেন ও। তবে মেয়েটা এই মুহূর্তে নিজেকে ছাড়িয়ে বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করেছিল,
———” কে আপনি? এইভাবে ঘরে ঢুকে এলেন হঠাৎ! চেনা নেই জানা নেই। ”
কথাগুলো শুনে সেদিন আন্তরিক কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও হরি কাকা, এই বাড়ির রাত দিনের কাজের লোক আন্তরিকের লাগেজ নিয়ে ওর ঘরের দরজায় হাজির হয়ে বলেছিল,
———” সে কি নীলা দিদি। যার জন্য এই ঘরে পর্দা লাগাচ্ছিলে এতক্ষণ ধরে, তাকেই সামনে দেখে চিনতে পারলে না! এ ই তো আন্তরিক দাদাবাবু। ”
কথাটায় নীলা যেন কেমন ইতঃস্তত হয়ে গেছিল। আন্তরিক তবে সহজ হয়ে ওকে বলেছিল নিজের হাত বাড়িয়ে,
———” হাই। কেমন আছো? কতদিন বাদে দেখা আমাদের! ”
এই কথায় নীলা কিছুটা সময় নিয়ে বেশ গম্ভীর মুখে বলেছিল,
——–” ভালো আছি। সরি, আপনাকে দেখে চিনতে পারিনি। আপনার ঘর রেডি করে দিয়েছি। আপনি রেস্ট নিন। কোন দরকার লাগলে আমাকে অথবা হরি কাকাকে বলবেন। আসছি। ”
কথাগুলো বলে নীলা আর দাঁড়ালো না। চলে গেছিল ঘরটা খালি করে। কিন্তু আন্তরিক বুঝলো না নীলা এরকম অচেনা মানুষের মতন ব্যবহার করলো কেন ওর সাথে! যেন চেনেই না! এত বছরের দূরত্ব কি তাহলে খুব সহজে মিটবে না!
চলবে।