শাপমোচন পর্ব-০৮

0
8

🔴শাপমোচন (পর্ব :৮)🔴
-ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়

আশ্চর্য। আমাদের একবার জানালো না পর্যন্ত। একেই বলে নিমকহারাম। বিয়ের নেমতন্ন পাবেন মেজদি বললো ছোট বৌ, মেজবৌ এর কথার উপর।

ব্যাপারটা অন্য কিছু নয়, মাধুরী যে চিঠিখানা মেস থেকে এনেছে সেটা বড়বৌদি দেখেছে এবং বাড়ির সকলে জানতে পেরেছ যে, মহেন্দ্র কোলকাতায় নেই, অকস্মাৎ চলে গেল। এখানে কোন কিছু বলে না যাবার কারণ কেউ ওরা খুঁজে পাচ্ছে না। অতঃপর ঠিক করলো যে মহেন্দ্রর বৌদি তার বিয়ের সম্বন্ধে কথা, লিখেছেন, সে খবর এখানে প্রকাশ করতে মহীন লজ্জা বোধ করেছে, শুধু লজ্জা নয় ভয়ও করেছে কারণ মাধুরীর সঙ্গে তাকে অবাধ মেশার সুযোগ এরা দিয়েছিল। মহেন্দ্র সে সুযোগের অসম্মান করেছে, অতএব না বলে পালিয়েছে। কথাটা মনের মত হোল, কিন্তু মাধুরী স্বয়ং এই আলোচনায় উপস্থিত নাই। অতএব আর কে কি ভাবলো দেখে লাভ নাই। শুধু বড়বৌ বললো সকলকে আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার

থেমে যা ভাইসব মাধুরীর মনটা আগে জানি তারপর কথা হবে।

এর আর জানা জানি কি দিদি, মেজদা বললো মহীন কোন নোলক পড়া কনে বৌকে বিয়ে করবে, তাতে মাধুরীর কি? ওকি মাধুরীর যোগ্য নাকি? ছোঃ। থাম মেজবৌ, ধমক দিল। ভালবাসার ব্যাপারে যোগ্য অযোগ্য তোরা কে কত দেখিস, আমার জানা আছে। খেলার মাঠে মেঝঠাকুরপোকে দেখে তুই কি রকম ঘায়েল হয়েছিলি মনে আছে। তোর কানা দেখে মা তোকে এ বাড়িতে আনলেন নইলে হাসলো বড়বৌ। মেজবৌ হেসে বললো।

তুমি কি মনে কর দিদি, মাধুরী ওকে ভালবাসে?। ভাল তো বাসেই–তবে ভালবাসার নানা রূপ আছে গোপা! সেটা বোনের ভালবাসা হতে পারে। দু’চারদিনের অপেক্ষা করলেই বোঝা যাবে।

এত ভালবাসা নিয়ে তিন জায় কি পরামর্শ তোমাদের? বলে মাধুরী এসে উপস্থিত হলো অকস্মাৎ! ছোটবৌ ওর বন্ধু হতে চায় বলে বসলো। আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার

আমাদের ছোটদি কাকে ভালবাসবে তাই নিয়ে বাজি ধরা হচ্ছে।

তাই নাকি!!

বেশ বেশ কার কি মত শুনতে পারি কি?

না, তোকে শোনালে চলবে কেন?

তুই আগে ভালবাস, তারপর আমাদের কার জিৎ হলো বোঝা যাবে বড়বৌ বললো।

যদি কাউকে না ভালবাসি তাহলে তো আমারই জিৎ হবে।

তা কি হয় রে ছোটদি, হাসলো সবাই ওরা, ভালবাসতেই হবে। বিয়েও করতে হবে। খামাকা সময় নষ্ট করছিস বললো মেজবৌ।

একেবারে সময়ই নষ্ট করে ফেললাম। আচ্ছা, তোমরা সকলেই আশ্বস্ত হও হে আমার পরম শুভাকাঙ্খিণী বৌদিগণ আমি অবিলম্বে ভালবাসব, প্রেমে পড়ব, এমনভাবে পড়ব তোমরা গলায় দড়ি দিয়াও টানিয়া তুলতে পারবে না। সবাই হাসলো ওর কথায়।

বাড়িতে কিন্তু ব্যাপারটা ঘোরালো হয়ে দাঁড়ালো গোপনে গোপনে। বৌদিদের এবং দাদাদের বদ্ধমূল ধারণা যে মাধুরী বেশি আকৃষ্ট হয়েছে মহেন্দ্রের প্রতি। ওদের চোখে মহেন্দ্রের যোগ্যতা কম, তবু ওরা স্নেহের বোনটিকে সুখী করতে মহেন্দ্রের হাতেই তাকে দিতে আরজি হতো না, সেই মহেন্দ্র অকস্মাৎ যে কোন কারণে হোক গেছে কোথাও। সংবাদটা একদিক দিয়ে খারাপ হলেও অন্যদিক দিয়ে খুব ভাল সংবাদ ওদের কাছে। মহেন্দ্র গেছে, ভালই হয়েছে, তার আর কোন সংবাদ নিয়ে দরকার নাই। তার প্রসঙ্গই বাদ দেওয়া হোক এ বাড়িতে এবং মাধুরী যাতে অপর কোন যোগ্য পাত্রকে অবিলম্বে ভালবাসতে পারে। তার ব্যবস্থা করা হোক।

অতএব সকাল থেকে রাত্রি বারোটা পর্যন্ত গান গল্প খেলা চলতে আরম্ভ করলো রতনি। এবং তার বন্ধুর দল গানের আসর জমায়, গল্পেরও। মেজদা চালায় খেলার ব্যাপারটা এবং বড়বৌ নিতান্ত নিরীহ হলেও তার ভাই বরুণকেও প্রায় আসতে দেখা যায় এ বাড়িতে। কুমার এবং তার সঙ্গিনী ডেইজী তো প্রতিদিনের অতিথি সব ব্যাপারটাই মাধুকে নিয়ে, সরে পড়বার সময় পায় না মাধুরী। অবিরাম আহ্বান আসছে, হয় সেজদা না হয় ছোটদার কাছ থেকে বড়দাও ডাকে সময় সময়, কিন্তু বড়দা অন্য কথা কয় না, বলে স্নেহের সুরে তোকে শুকনো লাগছে কেন রে দিদি।

না দাদা খুবই তো ভাল আছি? মাধুরী হেসে জবাব দেয়।

খান তিনেক যুদ্ধ জাহাজ এসেছে আমেরিকা থেকে, চল, দেখে আসবি।

মাধুরী দাদার সঙ্গে বেরুতে বাধ্য হয়, না গেলেও দাদা ভাববে মাধুরীর অন্তর অসুস্থ। জোর করে হেসে, গল্প করে, কত কি বায়না ধরে, কিন্তু স্নেহের সত্য দুরবীনটা বড় জোরালো বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। বলে–

মার্কেটে চল, ফুল কিনে দিই–

ও বাসি ফুল দিয়ে কি হবে বড়দা?

বাসি ফুল ওরা কেমন সুন্দর টাটকা রাখে চেয়ে দেখো–

হ্যাঁ, ওগুলো মিসরের মমী, কাঠামোটা আছে, আসল বস্তুটাই না। কি? মধু আর গন্ধ। বলে মৃদু হাসে মাধুরী।

একটা দোকানে নানা রকম জীবন্ত মাছ সাজানো রয়েছে শোকেসে, শৈবালের ভেতরে ভেতরে তারা সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে, বড়দা দেখে বললো, নিবি মাধু? সাজিয়ে রাখবি তোর ঘরে।

বড়দা, এই বন্দী জীবন দেখলে আমার কান্না পায়, কতটুকু জায়গায় ওরা ঘুরছে?

নিরুপায় বড়দা আর কি করবে? ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে, নিজেও ব্যবসাদার অসংখ্য লোক চেনে তাকে। পথে কত ব্যক্তি নমস্কার জানায় তার ইয়ত্তা নেই। পাশে মাধুরী বসে থাকে, তাকেও নমস্কার জানায় সকলে। মাধুরী বলে

তোমার সঙ্গে বেড়াতে বেরুলে বিস্তর সেলাম পাওয়া যায় বড়দা।

হ্যাঁ, কেন? তোর খারাপ লাগে নাকি?

না, শিবের কাছে যে সব ভূত থাকে, মানুষ কেন তাদের পূজা করে তা বোঝা যায়, হাসে মাধুরী কথা বলতে বলতে

বড়দা এবং আর সবাই জানে ওর কথা কইবার ধরন চুপ করে থাকে। বাড়ি ফিরে মাধুরী দেখে ছোটদার আসর গরম এবং সে আসা মাত্রই ডাক আসে। শেষে মাধুরী অতিষ্ঠ হয়ে বৌদিকে বলে।

বাড়িটা একেবারে গড়ের মাঠ হয়ে উঠলো পালাতে হবে দেখছি।

অত কষ্ট করে কাজ কি? কারো সঙ্গে গেথে যা বড়বৌদি বললো।

গেঁথে যাবো। আমি কি পুঁতির মালা নাকি। মাধুরীর চোখ মুখ গম্ভীর।

পুঁথির মালা কে বলেছে। মুক্তার মালাই হবি—

মোটেই না, আমি হারের মালা গাঁথবোই কাকে, পরাবোই বা কাকে বলে।

কিন্তু সেদিন কথা হয়েছে, তুই অবিলম্বে কাউকে ভালবাসবি, কথা রক্ষা কর। ভালো তো বেসেছি ঐ গাছ পাতা পাথর কাক কোকিল চিল গাংচিল, তারপর মাধুরী দিল হেসে, আরো কত কি

ও ভালবাসাকে প্রেম বলে না তুই বলেছিলি প্রেম পত্নবি—পড় শ্রীঘ্র।

ওহো, প্রেমে কিন্তু পড়তে পারছিনে বৌদি, কণ্ঠ এমন করুণ করলো মাধুরী যে বৌদি আর হাসি চাপাতে পারলো না, কিন্তু মাধুরী বলে চলেছে–

আমি তোমার গলায় দড়ি বেঁধে প্রেম সাগরে ডুবতে যাবো

মাধুরী বৌদির গলায় আঁচলটা জড়িয়ে টানছে। বৌদি অতিষ্ট হয়ে বললো, থাম রে পড়ে যাবি ভাই, কিন্তু ছোটদি শোন, বড়বৌ অকস্মাৎ গম্ভীর হলো।

বলো, আদেশ করো না পালন করতে পারবো না..

না, আদেশ তোকে যে করবে তারই কথা বলছি

হেন জন জন্মে এই নাই এ ত্রিভুবনে থিয়েটারী ঢং এ বললো মাধুরী।

ঠিক জন্মেছে, আজ কথাটা আমি পরিষ্কার করে নিতে চাই, তোর বড়দার আদেশ বিয়ে করতে চাইবার কি তোর কারণ? আমাদের দেশী প্রথা মতন কেউ তোকে দেখতে আসবে, এ তুই চাসনে আর আবার বিলেতী ঢং–এ কাউকে পছন্দ করবি তাও হচ্ছে না, এতো সুযোগ সুবিধে আমরা করে দিচ্ছি তবু তোর মতলবটা কি খুলে বল।

দেশী প্রথায় আমার শ্রদ্ধা নেই। আমাকে দু’মিনিট দেখে কেউ অপর কারো জন্য নির্বাচন করবে এ আমি মেনে নিতে পারি না, আর বিলাতি প্রথার তোমরা বাধা

আমরা? বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠলো বৌদির।

হ্যাঁ তোমরা, কতগুলি শিংওয়ালা ভেড়া ঘরে এনে তোমরা লড়াই দেখছো, এদিকে ওদের শিং এর ঠোকাঠুকিতে আমি বেচারা যাই যাই অবস্থা। তোমাদের মায়া মমতা কিছু নেই আমার উপর! নাকি স্বয়ম্বরের দিন যে ওদের মধ্যে লড়াই এ যে জিতবে, তাকে আমি মালা দিব। ওদের বিদেয় কর দোহাই তোমার। আচ্ছা, কিন্তু তারপর তোর মালাটা পাবে

মালা এখনো আমার গাঁথা হয়নি, বলে গেল মাধুরী?

উনিশ বছরে মেয়ে। ফুটন্ত যৌবন ওকে ঘিরে ধরেছে। বড়বৌদি দেখলো বাড়ি সকলের স্নেহের পুতুল ওকে কি করে সুখী করা যায়। নিঃশ্বাস ফেলে বড়বৌদি স্বামীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

কি ব্যাপার? অমনকরুণ দেখাচ্ছে তোমায়?

মাধু সম্বন্ধে আমি খুব ভাল বুঝছি না। মহীনকে ও ভুলতে পারছে না! আর তোমাদের এ সব বন্ধু বান্ধব কেউ ওর মন জয় করতে পারবে বলে মনে হয় না। ওদের বিদেয় কর মেয়েটা খামোখা মনঃকষ্ট পাচ্ছে। এভাবে চললে ওর শরীর ভেঙ্গে যাবে….

কি তাহলে করা যায়, বলে বড়দা উঠে বসল ভাল হয়ে। তুমি কি মহীনের কথাও তুলেছিলে ওর কাছে।

না, ওর কথা আমরা মোটেই আলোচনা করতে চাই না মাধুরীর সঙ্গে। সে গেছে যাক—

কিন্তু মাধুরী যে ওকে ভুলতেই পারছে না বলছে?

হ্যাঁ, ভুলবার অবসর কে দিচ্ছ তোমরা? এই ভেড়ার গোয়ালের আওয়াজ ওকে মহীনের শান্ত গম্ভীর চরিত্রটা স্মরণ করিয়ে দেয় বার বার। মাধুরী নদীর মতন মহীন ছিল গম্ভীর সমুদ্রের মতন, ওদের মিলন হলে–বড়বৌদি কেঁদে ফেললো–

মহীনকে কি আবার খুজবো তাহলে? বড়দা প্রশ্ন করলো।

না, খোজা ঠিক হবে না। মহীনকে আমি যতখানি জেনেছি, তাতে মনে হয় কোন কারণ ছাড়া সে চলে যায়নি, কারণ সেই মাধুরীকে গভীর ভাবে ভালবাসে?

তাহলে চলে সে গেল কেন? আমি তো খুঁজেই পাচ্ছিনে কি এর কারণ? ওদিক দিয়ে ভেবে লাভ নেই। যে ভাবে সে গেছে, তাতে মনে হয়, না গিয়ে তার উপায় ছিল না। মাধুরীকে ভুলবার জন্য পথ দেখাতে হবে।

কি বল।

ও দমদমার বাগানে কি সব করতে চায়, করে দাও। দিন কতক কাটাক ক্লান্ত হয়ে পড় ক ঐ সব ব্যাপারে–মন সঙ্গীর অভাবটা অনুভব করুক তখন নিজেই বেরিয়ে আসবে ওসব ছেড়ে।

কিন্তু যদি ঐ কাজ নিয়ে মেতে যায়?

যায় তো যাবে। আমরা চাই ও সুখী হোক–ওতেই যদি সুখ থাকে তো থাকবে।

এ পর্যন্ত কথা কয়ে বড়বৌদি নিজের কাছে চলে গেল। বড়দা কিছুক্ষণ ভাবলো মাধুরী সম্বন্ধ্যে। দমদমার বাগানে কি করবে তার প্ল্যান মাধুরী আগে দিয়েছে বড়দাকে সেইটা আবার দেখলো। সুন্দর সুবিস্তৃত পরিকল্পনা মাধুরীর মন্দ কি? তাই করুক কিছুদিন। নইলে। অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে সারা বাড়িটায় ওই হোল বেশি আতঙ্ক।

পরদিন সকালে বড়দা মাধুরীকে নিয়ে বেরুলো দমদমার বাগান দেখতে। প্ল্যান মত কোথায় কি করা হবে তার জন্যই তাদের ফার্মের দুইজন ইঞ্জিনিয়ারও অন্য গাড়িতে গেলেন। কয়েকখানা ঘর তৈয়ার করতে হবে এবং আরো নানান কিছুর দরকার ফেরা পথে মাধুরী চুপচাপ বসে আগের গাড়িতে।

খেয়াল তোর কতদিন থাকবে ছোটদি? বড়দা প্রশ্ন করলো।

খেলাল নয় দাদা প্রয়োজন। আমার জন্যে, তোমার জন্যে এবং আরো অনেকের জন্য।

কিন্তু বিয়ে করে স্বামী সংসার নিয়ে এগুলো করা চলে বোনটি।

হয়তো যেমন তেমন ভাবে চালানো যায় কিন্তু তাতে তো একনিষ্ঠ আসে না দাদা, নিষ্ঠা ভাগ হয়ে যায় যে কোন তপস্যার পেছনে একনিষ্ঠতা থাকা দরকার।

তাহলে কি বুঝবো, তোর এটা তপস্যা। বড়দার প্রশ্নটা কেমন যেন ক্রন্দন ভরা।

তপস্যা কিছু খারাপ নয় দাদা, মাধুরী হাসলো, বাবার তপস্যায় আমাদের এত বড়লোক করেছে, মোটরে চড়ে বেড়াচ্ছি, তোমার তপস্যায়ই আমরা নির্ভয়ে খাই, দাই, ঘুমোই, আমার তপস্যায় যদি কারো কিছু ভাল হয় তো হোক গাড়িটা গেটে ঢুকলো।

হোক বড়দা যেন ক্লান্ত কণ্ঠে বললো, টাকার আমাদের অভাব নাই দিদি, বাবা যথেষ্ট রোজগার করেছে, তার সিকি অংশ তোর আর আমাদের গোটা পরিবারের সব স্নেহ তোর উপর রইল, যা তুই চাইবি, যাতে তুই সুখী হবি, তাই করে দেব।

আমি জানি, বড়দা এই মূলধন নিয়ে আমি তপস্যায় বেরুলাম।

মাধুরীর গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকলো। বড়বৌদি শেষের কথাগুলো শুনল বড়দার সঙ্গে। মাধুরীকে পেছনে ফেলে প্রশ্ন করলো–

তাহলে বাগানই করবি বিয়ে করবি নে।

বিয়ের ব্যাপারটা আমার কাছে একটা পুরুষের সঙ্গে একটা মেয়ের জীবন বেঁধে দেবার চুক্তিপত্র নয় বৌদি, আমার কাছে ওর অর্থ আত্মার সঙ্গ আত্মার অখণ্ড মিলন, শোলার টোপর আর শাঁখের বাদ্যি না হলেও সেটা হতে পারে, চলে যাচ্ছে মাধুরী।

মাধুরী। জড়িয়ে ধরলো বড়বৌদী ওকে, চোখে জল আসছে, বললো, তোকে মাঝখানে রেখে তোর দাদার খাটে শুয়ে থাকতাম, কত স্নেহের ধন তুই আমাদের। এ অভিশাপ কেন তুই মেনে নিবি, বাগান করে আর গরু পুষে কি মেয়েদের জীবন কাটেরে দিদি

মাধুরী বিব্রত এবং বিপন্ন হয়ে পড়ল। তাই মাতৃসীমা স্নেহশালী বড়বৌদিকে অন্তরে , প্রগাঢ় শ্রদ্ধা করে মাধুরী আর কেউ হলে দু’কথায় উড়িয়ে চলে যেত, কিন্তু ওখানে ওকে ভাবতে হয়। কষ্টে হাসি এনে বললো–

বুড়িয়ে যাইনি বৌদি এই তো উনিশে পড়লাম, বিয়ে এরপর করতেও পারি কাউকে।

এমন দিন কি হবে রে ছোটদি।

কি জানি শাখে তো জল দিয়ে রাখ, ঠিক সময়ে যেন বাজে।

বলে আর দাঁড়ালো না সটান উপরে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে খিল দিল আর সে অভিনয় করতে পারছে নির্দয় অভিশাপে ওকে জড়িয়ে ধরেছে নাগপাশের মত। দরজা বন্ধ করে মাধুরী হাত ফুলগাছে রাখলো, সেই না জানা ফুল, দেরাজ থেকে মহেন্দ্রের ফটোখানা বের করে ওর পাশে রেখে বললো–

শোন এর নাম রাখলাম স্বাক্ষী ফুল, তোমার আমার মিলনের স্বাক্ষী, চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে।

মহেন্দ্র যাওয়ার পর, কেন গেল, এবং কোথায় গেল, এ আলোচনা যে না হয়েছে তা নয়, কিন্তু সবই মাধুরীর অসাক্ষাতে, অনেকের ধারণা মহেন্দ্র নিজেকে একান্তভাবে মাধুরীর অযোগ্য ভেবে চলে গেছে, মেজবৌদির এই মতটা প্রবল। ছোটদা এবং বৌদির মত হচ্ছে, ওদের দু’জনার কোন রকম ঝগড়া বা মান অভিমান হয়েছে, মহেন্দ্র তাই আত্মগোপন করলো। মেজদা বলে, মাধুরী যে ভুল করতে যাচ্ছিল, মহীন এটা তাকে বুঝিয়ে দেবার জন্য চলে গেছে। বড়দার কোন মত নাই, মহেন্দ্র চলে যাওয়ায় মাধুরী যাচ্ছে ভেঙে পড়ে এই তার ভয়। আর বড়বৌদির মত হচ্ছে মহেন্দ্রের যাবার পিছনে এমন কিছু আছে, যা অগ্রাহ্য করা কারো সাধ্য নয়। সে কারণটাও বড়বৌদি যেন আন্দাজ করতে পারে। কিন্তু মুখ ফুটে সেটা বলা চলে না সহজে, অন্ততঃ বলতে সে চায় না।

উমেশবাবু এবং গিন্নীমা মহেন্দ্রের এই ভাবে চলে যাওয়াটাই কিভাবে গ্রহণ করলেন, জানা যায় না। ইচ্ছে করলে তাঁরা দেবেন্দ্রকে পত্র লিখে খবর নিতে পারতেন, কিন্তু মেজবৌমা বাধা দিল, বললো যে পিতৃবন্ধুর পুত্র হিসাবে মহীনকে যথা সাধ্য স্নেহমমতা। দেখানো হয়েছে এবং তার প্রতি কোন অকর্তব্য হয় নাই। এরপর সে যখন অকস্মাৎ নিরুদ্দেশের পথে চলে গেছে তখন তাকে যেতেই দেওয়া উচিত সে সংসারী হবে কি সন্ন্যাসী হবে, গরীব হবে কি ধনী হবে, কিছু এদের এসে যায় না।

অতঃপর বন্ধুদের কথা আসে, মাধুরী যেভাবে মহীনকে নিয়ে মেতে ছিল। এই কমাস তাতে সোসাইটির সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, মহেন্দ্র চলে যাওয়ায় যেন চাঁদ রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়েছে, এমন ভাব সকলের। কুমার বললো–

রাহুরমুখ থেকে মুক্ত মুখ চাঁদ যে দাগ হয়ে উঠে বৌদি, তখন তার আলো সুন্দর হয়।

হ্যাঁ–বড়বৌদি বললো, কিন্তু রাহু না হয়ে যদি সাপের ছোবল হয় তো বিরাট ভেতরে কাজ করে সে বড় যন্ত্রণা কুমার বাহাদুর।

না, না, চাঁদ এত উঁচুতে যেখানে সাপ পৌঁছাতে পারে না হাসলো সবাই কুমারের। কথায়!

কি জানি, বড়বৌদির কণ্ঠ বিষণ্ণ বাবার কাছে শুনেছিলাম কেতুর চেহারা নাকি সাপের মতন

কিছু ভাবলেন না, ঐ গরুর গোবর ও বিষ নেমে যাবে। সবাই হাসতে লাগল কুমারের কথায়! হাসিকে আরো উস্কে দেবার জন্য কুমার বললো ঐ দমদমায় দু’মাস থাকলেই ওর দম আটকে আসবে, তখন সোসাইটিতে ফিরবার জন্যে হাসুপাকু করবে দেখবেন।

আর একচোট হাসি কিন্তু বড়বৌদি অনুভব করলো কুমারের কণ্ঠে মহীনের ভাষা। এ কি অনুকরণ?

এ সব আলোচ্য কথাবার্তা সবই মাধুরীর অসাক্ষাতে। ওকে কেউ শুধোয় না মহেন্দ্রের কথা, তার প্রসঙ্গই তোলে না, মাধুরীর সমুখে। যে মানুষটা তিনমাসে এ বাড়িতে একটি বিশেষ মানুষ থেকেছে সে সরে যাওয়ার পর তার অস্তিত্বকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এমন কি যে ঘরটায় মহেন্দ্র থাকত তাকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করিয়ে মেজদার অফিস ঘর বানিয়ে দিয়েছে, চেয়ার টেবিল, টেলিফোনে আকীর্ণ সে ঘর এখন। মহেন্দ্রের ছেঁড়া পুথি। দু’খানি ফেলে দিয়েছে কোথায় কে জানে মহেন্দ্রের অস্তিত্ব এরা সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত করে দিতে চায় এখানে। কারণ নিজের ঘরে খাল কেটে কুমীর ডেকে আনে না।

কিন্তু এতটা করা যে কত বড় ভুল হলো, ওরা ভাবলো না। যার জন্য ওদের এই আপ্রাণ প্রচেষ্টা, সে কিন্তু তীক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ্য করেছে এটা। সঙ্গীতের আসর, সাহিত্যের আসর সবই ঠিক আছে, শুধু মহেন্দ্রের কথাই উচ্চারিত হয় না কোথাও। এখানে বাড়িতে একটা কুকুর বিড়াল দু’দিন থেকে চলে গেলেও মানুষ বলে, আহা কুকুরটা আজ নাই, অথবা বিড়ালটা বড় জ্বালাতন করতো। মহেন্দ্র সম্বন্ধে এতটুকু কথাও শোনা যায় না এখানে। এই নীরবতা মাধুরীর অন্তরের কোন অতল তলে গিয়ে সরব হচ্ছে, ওরা কেউ খোঁজ নিল না। ওরা ইংরেজি প্রবচন ভাবলো, আউট অব সাইট, আউট অব মাইও। মহেন্দ্রকে ওরা তাই মুছে দিল ওদের সর্বাঙ্গীন স্মৃতি থেকে। এদিকে মাধুরী একা তাকে ধরে রাখবে তার মানস মন্দিরে। কিন্তু মহেন্দ্র সম্বন্ধে অন্য সকলের একটা নীরবতা ওর কেমন অসহ্য বোধ হয় অন্তর বিদীর্ণ হয়ে যেতে চায় এতখানি অগ্রাহ্য করলো তারা মহেন্দ্রকে এই বেদনা ও সইতে পারে না।

মাঝে মাঝে মাধুরীর মনে হয় চীৎকার করে সকলকে জানিয়ে দেবে মহেন্দ্রকে সে ভুলবে না সে ভুলতে পারে না। মাধুরীর অন্তরে একটা লোক বাসা বেধেছে সে মহেন্দ্র জীবনে তাকে না পায় ক্ষতি হবে না, মৃত্যু অতিক্রম করে চলবে সে মহেন্দ্রর কাছে ওদের নীরবতা মাধুরীর অন্তরকে আরো সরব শক্তিময় করছে সতী করে দিচ্ছে, কিন্তু কিছু করবার নাই, কিছু বলার নাই, নিজের অন্তরকে সম্পূর্ণভাবে সংগুপ্ত করে মাধুরী দমদমার নীরবতা মাধুরীর অন্তরকে আরো সরব শক্তিময় করছে সতী করে দিচ্ছে, আহার ন্দ্রিা পর্যন্ত হয় না সময়মত অবিশ্রাম অনুধ্যান করে ঐ কাজটার তদারক কতটা করে এতগুলো কাজ।

পরিকল্পনা নেহাত মন্দ করেনি, বাগানটার নাম ব্রজধাম, ঐ নামই রইলো। ওতে তিনটি বিভাগ থাকবে ফলের খেলনা এবং কাঠের শিল্প কাজের আর গরুর দুধের। গরু এবং ছাগল তো থাকবেই, হাঁস মুরগীও থাকবে ওখানেই। তিনটি নাম মাঝে ফুল অফিস ঘর এবং পাশে গোশালা আর কর্মীদের থাকবার ঘর তৈরি হচ্ছে। বড়দা নিজে কন্ট্রাকটর এবং লোকজন মালমশলা সবই হাতে, কাজেই অতি দ্রুত কাজ হয়ে গেল। এখন উদ্ধোধন করা হবে। গাই গরু কেনা হয়েছে ষোলটা, ছাগল বিশটা, শ’খানেক হাঁসমুরগী তাদের জন্য যথাপযুক্ত লোকও রাখা হলো। ফুলের জন্য মালী তো ছিলোই, কাষ্ঠ শিল্পের জন্য আটকালো না, কারণ উমেশবাবু নিজেই বড় ব্যবসায়ী অতএব পূজার কিছু পূর্বেই সব এরকম হয়ে গেল যাতে উদ্ধোধন করা চলে।

অতঃপর উদ্বোধনের দিন ঠিক করে মাধুরী ছাপানো চিঠি দিয়ে নিমন্ত্রণ করলো দমদমার ঐ পাড়ার সমস্ত অদিভাসীকে এবং নিতান্ত জানাশোনা তার সহপাঠিনী মেনকা, গীতা, বিপাশা ইত্যাদি কয়েকজনকে। কে উদ্ধোধন করবেন কিছুই জানল না। একটা কিছু সে করছে, এইটুকু জানিয়ে দিল নির্দিষ্ট দিনে বাগানের সামনে প্রকাণ্ড প্যাণ্ডেলটা ভর্তি হয়ে। বেশির ভাগই ওখানকার দরিদ্র মধ্যবিত্ত আর তাদের গৃহিনীগণ, বালক বালিকা এবং কুলি ম জ্বর। লাউডস্পীকার আছে, কিন্তু ডায়েসে কোন লোক নাই, ফুলের মালাও নাই এমনকি চেয়ারও নাই একখানা। এ কি রকম উদ্ধোধন, কেউ বুঝতে পারছে না, কিন্তু যথাসময়ে মাধুরী তার বাবার হাত ধরে এসে উঠলো ডায়াসে। অতি সাধারণ একখানা মিলের শাড়ি পরনে, হাতে গলায় কোন গহনা নাই, উমেশবাবুও দাঁড়ালেন। মাধুরী তার বাবার হাত ধরে। এসে উঠলো মাধুরী বক্তৃতা আরম্ভ করলো

সমবেত ভদ্রমহিলা, মহোদয়গণ এবং বালক বালিকারা।

ব্রজধাম এর দ্বার উদ্ঘাটন করতে আমি কোন লাটবেলাট রাজা মহারাজাকে ও ডাকিনি কারণ, এটা আপনাদের জন্য করেছি, তাই এখানকার সব ব্যাপারে আমি সাধারণ হতে চাই। এখানে কোন রকম ধনপূর্ব বা আভিজাত্য কোনদিন ঠাই পাবে না, এটা হবে। সহজ, সরল সত্যের ধাম স্বাস্থ্য আর আনন্দ বিতরণের জন্য এর প্রতিষ্ঠা আশীর্বাদ করুন, এই কাজ যেন সফল হয়।

এখানে আমি একটা বক্তৃতাবাগীশ আর আপনারা সব হলেন শ্রুতি তীর্থ। অতএব শুনুন প্রথমত এখানে কাষ্ঠ শিল্প এবং দেশীয় খেলনা তৈরি হবে। এর নাম দিলাম হিন্দোল বিভাগ, পায়ের খড়ম থেকে রুটি করা চাকী বেলুন এবং নানারকম খেলনা আর কাঠের পুতুল থেকে ছবি বাঁধা ফ্রেম পর্যন্ত পাবেন আপনারা এখানে ন্যায্য মূল্যে। এর উদ্ধোধন করবেন আমার বাবা। এবং এই কারখানায় তৈরি প্রথম খড়ম জোড়াটি উনি খরিদ করবেন।

হাততালি পড়লো এবং উমেশ বাবু প্রথম দরজাটি খুলে ভেতরে ঢুকলেন, মাধুরী তাঁর পায়ে খড়ম জোড়া পরিয়ে দিল।

দ্বিতীয় বিভাগে গোশালা। মাধুরী বললো, এতে দুধ হবে এবং আপনরার খাঁটি দুধ কিনে নিতে পারবেন, বারো বছর ছেলেমেয়েদের জন্য জনপ্রতি এক পোয়া পাবেন, দাম চার আনা, রোগীর জন্য ডাক্তার যতটা বলতে পারবেন, ঐ দামেই কিন্তু আমি কয়েকজন গুপ্তচর নিযুক্ত করেছি কেউ কোন রকম আমাকে ঠকাবার চেষ্টা করলে তবে তার বাড়িতে দুধ দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এর উদ্বোধন করবে আমার ভ্রাতুস্পুত্র শ্রীমান বাদল বলে রাখাল বেশ পরিহিত বাদলকে হাত ধরে টেনে আনলো মাধুরী। তার হাতে একটা বড় বাঁশের ডাণ্ডা হাসছে খুব। ঠেলে দরজা খুলতেই একপাল গরু ছাগল দেখা গেল

বাদল তার মাঝখানে গিয়ে একটা ছাগলের পিঠে দুই ডাণ্ডা লাগিয়ে দিল।

বাঃ বাঃ আচ্ছা গোপালোকী বলে উঠলো দর্শক দল। সবাই হাসছে মাধুরীও হেসে ওকে কোলে তুলে আবার আরম্ভ করলো–

এই বিভাগটার নাম গোষ্টি বিভাগ–এর পর ফুলের বিভাগটা দ্বারা খুলবেন আমার বান্ধবী শ্রীমতি মলিনার দেড় বছরের কন্যা কল্যাণীয়া মালতী বলে সে বাড়ির পশ্চিম দিকের সেই বৌটির কোল থেকে সাজানো মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেল তৃতীয় দরজায়। ছেড়ে দিল। মেয়েটাকে। দরজাটা ফুলের মালা দিয়ে আটকানো আছে মালতী অর্থাৎ দেড় বছরের মেয়েটা ওখানে দাঁড়িয়ে কি করবে ভেবে না পেয়ে মালাটায় কামড় লাগালো দর্শকরা হেসে খুন কিন্তু ভড়কে গিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। আচ্ছা লোক ঠিক করেছে মাধুরী দ্বার উদঘাটন করবার জন্য। কিন্তু সত্যি সবাই খুশি হলো–বক্তৃতা নাই বাগ্মিতা নাই মাধুরী শুধু বললো শুনুন, বক্তৃতা এখানে হলো না হবেও না। এখানে কাজ। সমস্তটার নাম বজ্রধাম—আর তিন ভাগের তিনটি নাম হিন্দোল বিভাগ, গোষ্ঠ বিভাগ আর ফুলদোল বিভাগ। দুধ কিনতে যারা একান্ত অসমর্থ হবেন ছেলে বা রোগীর জন্য এবং প্রসূতির জন্যও তারা আবেদন করলে অনুসন্ধান করে বিনামূল্যে কিছু দুধ দেবার ব্যবস্থা হবে এখান থেকে। বাড়তি দুধে খাঁটি ঘি হবে, আপনারা কিনতে পারবেন কিন্তু তাও রোগী বা প্রসূতি ছাড়া কাউকে বেচা হবে না। আপাততঃ এই আইন রইল দরকার হলে অন্য আইন করা হবে। টাকাকড়ি, চিঠিপত্র এইসব অফিসের ঠিকানায় পাঠাবেন এই সমাজ সেবায় কোন কর্মী ফাঁকি দিচ্ছে বা ঘুষ খাচ্ছে, কিম্বা কোন লোক ঠকিয়ে দুধ নিচ্ছে, ধরিয়ে দিতে পারলে নগদ একশো টাকা পুরস্কার পাবেন। আর যার দরকার ছাপানো ফর্মে আবেদন করবেন, অনুসন্ধান করে সেই মত টিকিট দেওয়া হবে এবং তদানুযায়ী সকাল আটটার মধ্যে দুধ পাবেন। ফুল ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এবং কাঠের শিল্পের বিভাগ বেলা দশটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকবে।

অতঃপর মাধুরী সকলকে গোশালা, কারখানা এবং ফুলবাগান দেখালো। তার বান্ধবী মেনকা, গীতা এসেছে, বললো তোর মহীনদা কৈ রে মাধু? আসেনি?

এটা তারই কাজ কিনা আমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন। না, আসেননি তিনি নিজে কি কাজ করছেন?

আমার বাঁশীটা তিনি বাজাচ্ছেন বলে চলে গেল মাধুরী অন্যত্র। গীতা আর মেনকা হাসলো। ওরা জানে, মাধুরীর মা বাবা দাদা এত নির্বোধ নয় যে ঐ ষাট টাকার কেরানীর হাতে মেয়ে ছেড়ে দেবে। গীতা বললো ওকে হয়তো তাড়িয়ে দিয়েছেন ওরা। মাধুরীকে খুব বশ করেছিল ভাই ছেলেটা।

কি জানি বেশ গাইতে পারে কিন্তু গান শুনলে ওকে সত্যি ভালবাসতে ইচ্ছে হয়। ওর গান নাকি রেকর্ড হয়েছে রে মেনকা? দাদা বলেছিল, রেকর্ড খুব জনপ্রিয় হয়েছে।

হতে পারে। দোকানে খোঁজ নেব বলে মেনকা গাড়িতে চড়লো।

মাধুরী রয়ে গেল ওখানে, বিস্তর কাজ তার রয়েছে, অফিস গোছানো, খাতা পত্র ঠিক করা, গরু ছাগলের দেখা, ফিরতে রাত হয় ওর। কিন্তু সবাই চলে গেল। উমেশবাবু গেলেন মাধুরী একা একান্ত একা। নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো সেই মা ছেলের মূর্তিটার কাছে দেখতে লাগলো। মূর্তিটা যেন সজীব হাসছে মাধুরীকে দেখে না না, হাসবার তো কিছু হয়নি–যার সঙ্গে মাধুরী সেদিন এসেছিল, সে আজ সাথে নেই, হাসবার তো কথা নয়, কিন্তু ওটা মূর্তি শিল্পীর খুশি মত হাসে কাঁদে সন্তানকে বুকে নিয়ে স্বগর্বে হাসছে, সার্থক নারীত্ব–ও মা! ওর পরে কিছু হবার নেই। ওর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে কেন হাসবে না।

কিন্তু মাধুরী–না, মাধুরী ওখানে দাঁড়াতে পারলো না আর দল ছাড়া একটা বাচ্চা হাঁস এদিকে এসে পড়েছিল তাকেই কোলে তুলে নিল। জলের ধারে দাঁড়ালো গিয়ে। হাস কোলে ওর প্রতিবিম্ব পড়েছে জলে। হাসটাকে ছেড়ে দিল সে চলে যাচ্ছে। মাধুরী তাকিয়ে রইল তার পানে অনেকক্ষণ।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, ফিরতে হবে নিঃশব্দে উঠলো মাধুরী। পাখিরা সব কুলায় ফিরছে কয়েকটা বক উড়ে চলে গেল। শরতের প্রসন্ন আকাশে সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড। মাধুরী হেঁটে আসছে বাগানের পথ দিয়ে একা কত ফুল কত সুন্দর পাতা কত প্রজাপতি উড়েছে সীমা সংখ্যা নাই শাড়ির গেরুয়া আঁচল ভর্তি করে ফুল তুলতে পারে তুলবে নাকি? তুললো কতকগুলো, রাস্তার মোড়ে যেখান থেকে মহেন্দ্র কার্ড দিয়েছিল ওকে, সেখানে এসে থামলো অনেক গুলোফুল আঁচলে আরো তুলবে? কিন্তু কি হবে? মাধুরী অকস্মাৎ আঁচলটা উজাড় করে ফুল গুলো ঐ খানেই ঢেলে দিল।

অফিস ঘরে এসে বসলো মাধুরী, লোকজন কাজ করছে। খানিক তদারক করলো গল্প ছাগলকে খাবার দেওয়ালো অতঃপর আর কি করা যায়? অফিস ঘরটা দোতলা উপরে উt গেল মাধুরী। এখানে ওর নিজের থাকার মত ব্যবস্থাও করে রেখেছে তবে আজই থাকবে না দরকার মত থাকবে। ঘরটা দেখলো একবার চোখ বুলিয়ে সুন্দর নীড় একটি। বড়দা মাধরীর যোগ্য করেই তৈরি করিয়েছে। সংলগ্ন স্নানাগার দু’পাশে বারান্দা ফুলের টব আর নীচে থেকে উঠে আশালতা দিয়ে ঘেরা একটি কুঞ্জ ঝিলের জলটা চমৎকার দেখায় দক্ষিণের বারান্দা থেকে। টাকা মানুষকে সম্পদ দান করে কত সৌভাগ্য কিন্তু সুখ শান্তি তৃপ্তি টাকা দিতে পারে। সেগুলো? না মাধুরীর সারা মন প্রাণ ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো।

নেমে এসে দেখতে পেল, কোণের দিকে একটি বুদ্ধমূর্তি। এই বাগানেই বড়দা ওকে এনে বসিয়ে দিয়েছে সুন্দর মূর্তি। মাধুরী এগিয়ে এসে দেখলো পদ্মের উপরে পদ্মাসনে। আসীন ভগবান বোধিস্বত্ব। মনে পড়লো মানুষের কল্যানের জন্যে পত্নী পরিত্যাগ করে ওর মহা তপস্যা বন্ধুত্ব লাভ কিন্তু রাজবধু যশোরা। অভাগী গোপা। মাধুরী নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো মূর্তিটার কাছে কথাগুলো ভাবলো অকস্মাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মূর্তিটাকে দুহাতে জড়িয়ে, মাথাটা লুটিয়ে পড়লো ওর পায়ের উপর। সাদা মার্বেল ছোখের জলে চকচকে হয়ে যাচ্ছে চমকে উঠছে যেন। নিজেকে বিশ্লেষণ করার আর সময় নাই, যে সত্য পৃথিবীর কাউকে জানাতে চায়নি মহেন্দ্র তাকে আর আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়, নিষ্ঠুর রাক্ষসী ওকে চর্বণ করেছে এবার গ্রাস করবে। দরিদ্র মহেন্দ্র কি করতে পারে ওর বিরুদ্ধে। ওর সঙ্গে লড়াই করবার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার অর্থ মাধুরী যদি জানতে পারতো ঘূর্ণাক্ষরে তাহলে হয়তো মহেন্দ্রকে সুইজারল্যাণ্ড পাঠাবার ব্যবস্থা করতো কিন্তু মাধুরীর সে দান নেওয়া সম্ভব ছিল না মহেন্দ্রের পক্ষে।

পলায়নের গূঢ়তম কারণ এই মাধুরী। এ খবর জানাবে না, জানাবে না মহেন্দ্র তাকে। নিঃশব্দে মুছে যাবে মহেন্দ্র পৃথিবীর বুক থেকে মাধুরী নিরাপদে কোন যোগ্য ভাগ্যবানের গলায় মালা দিল, তাই দূর দূরতম দেশে চলে এল মহেন্দ্র। কিন্তু এই নির্বান্ধব পূরীতে তো সম্ভব নয়। অন্তরের অব্যক্ত প্রেম বহ্নিবুকে নিয়ে মহেন্দ্র কি আবার কলকাতায় ফিরবেনা সেখানে ফিরে মাধুরীর বিপদ আর ঘটাবে না সে। সেখানে গেলে তার বিষয় মাধুরীর সব কিছু জানবার বিশেষ সম্ভাবনা আর জানতে পারলে মাধুরী চেষ্টার ত্রুটি করবে না, মহেন্দ্রকে বাঁচিয়ে তুলতে, কিন্তু মহেন্দ্র নিজে জানে বাঁচা সম্ভব না। এখানে আসার আগে কলকাতায় শ্রেষ্ঠ চিকিৎসককে সে দেখিয়েছেন গোপনে তিনি বলেছিলেন, প্রচুর অর্থ আর প্রচুর বিশ্রাম দরকার এর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। ওর কোনটাই ছিল না মহেন্দ্রের, এখানে মৃত্যুটা ত্বরান্বিত হলো ভালোই। ওর জন্যে ভাবছে না মহেন্দ্র ভাবছে তার খোকনের জন্য। কিন্তু মহেন্দ্র আজন্ম ঈশ্বর বিশ্বাসী ভাবল এই অনন্ত বিশ্ব যিনি চালান, তিনি খোকনকে দেখবেন।

কিন্তু মহেন্দ্রর নিজের দেখতে ইচ্ছে করছে একবার খোকনকে। কতদূর বাংলাদেশের সেই ক্ষুদ্র পল্লী। কিন্তু যেতে হবে খোকনকে একবার দেখতে হবে তার পর মহেন্দ্র যাবে। জীবনের পারে, যেখানে মাধুরীর জন্যে অপেক্ষা করার অন্তরায় নাই, মহেন্দ্ৰ দাদাকে চাই লিখে দিল বাড়ি যাবার দিন ঠিক করে।

অফিসের কাজে ইস্তফা দিয়ে মহেন্দ্ৰ সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরল অতি কষ্টে। জ্বর হয়েছে। ওখানকার যে ডাক্তারটি ওকে দেখেছিলেন, তিনি বলেছেন বাড়ি চলে যান ওখানে আর কেন? অর্থ আত্মীয় স্বজনের কাছে গিয়ে মরুনগে। মহেন্দ্র হাসলো কথাটা শুনে। সেও জানে সে সত্য। তিনি চলে গেলে মহেন্দ্র নিঃশব্দে শুয়ে ভাবতে লাগলো পৃথিবীতে কেন সে এসেছিল। সর্বত্র সে শুধু পরাজিত হয়েছে, শৈশবে মা বাপের স্নেহ পেল না দাদাবৌদি সে অভাব পূরন করলেন, কিন্তু দাদাও অন্ধ হলেন। অতিশয় মেধাবী ছাত্র হয়েও মহেন্দ্র পড়তে পারল না। একটা চাকরি যোগাড় করে করে দাদাকে সাহায্য করতে পারেনি সে শত চেষ্টা করেও। অবশেষে চাকরি যখন মিললো, সাফল্য যখন সম্মুখে সাহিত্য, সঙ্গীতে যখন সে নাম কিনছে তখন দূরস্ত ব্যাধি যাকে ঠেকিয়ে রাখা অসাধ্য মহেন্দ্রের পক্ষে। সর্বত্র তাই বিফলতা, আবার যেটা সে কল্পনাও করতে পারে নি, সেই প্রেম এল তার জীবনে, এমন নিবিড় হয়ে এলো যেন শ্রাবণের বর্ষণে কিন্তু হায়রে অদৃষ্ট। জীবন পাত্র যখন দ্রাক্ষারসে টলমল করছে, তখনই সে স্বর্গ সুধাকে পদদলিত করে আসতে হলো। মহেন্দ্র এ অভিশাপ তার জীবনে। সর্বশেষ অবলম্বন খোকনকেও ছেড়ে যেতে হবে, বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠেছে।

জল খেল মহেন্দ্র এক ঢোক, মনে পড়লো দমদমার বাগান ওষ্কার ধ্বনি করতে গিয়ে মহেন্দ্র এই ব্যথাটা অনুভব করেছিল, তখন ও জানেনি কিসের এ ব্যথা কিন্তু তার পরিণাম আজ পরিস্ফুট।

ভাবছে মহেন্দ্র মাধুরী কিছুই জানতে পারবে না তার সম্বন্ধে। অকৃজ্ঞতা এবং প্রেমের অবমাননাকারী ভেবে মহেন্দ্রকে মন থেকে মুছে দেবে, তার সুযোগ ও করে দিয়ে এসেছে। মহেন্দ্র ডাকবাক্সে বৌদির চিঠিখানা ফেলে রেখে।

আহা বৌদি, সে ভাবছে, মহেন্দ্রের, বিয়ে দিয়ে ঘরে একটা সঙ্গিনী আনবে হায়রে অদৃষ্ট। চিঠিখানা পেয়ে হয়তো চমকে উঠবে ওরা, কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে খোকন। না খোকনের এখানে অত জ্ঞান হয়নি, কিন্তু দাদা বৌদি?

একখানা উপন্যাস বেরিয়েছে মহেন্দ্রের, আরেকখানা দিয়েছে পাবলিশারকে, তৃতীয় খানাও শেষ করে যেতে পারবে হয়তো। রেকর্ডখান কয়েক ওর গানের সকলের মালিক করে দিল ওর খোকনকে এবং সবাইকে জানিয়ে দিল তার ঠিকানা যেন কাউকে জানানো না হয়। অতঃপর সেতারখানা আর বিছানা বালিশ বেধে মহেন্দ্র ট্রেনে চড়ে বসল একদিন।

পূজার বেশি দেরি নাই, মহেন্দ্র ততদিন টিকতেও পারে কিন্তু হাসি পেল ওর। ভেবে কি লাভ। তাকে যেতে হবেই আজ হোক আর দিন কয়েক পরে থোক তবে খোকনের পূজাটা ভালভাবে কাটবে মহেন্দ্র এই ক’দিন থাকলে।

গভীর রাত্রি, রেলগাড়ি ঝমঝম শব্দে দৌড়াচ্ছে, মহেন্দ্র এক কোণায় সেতারের অবগুণ্ঠন। উন্মোচন করলো। ঝলঝল করেছে যন্ত্রটা যেন স্বাস্থ্যোজ্জ্বলা অপরূপা মাধুরী বধু বেশী বাসর সঙ্গিনী মাধুরী। আস্তে আস্তে হাত বুলালো মহেন্দ্র ওর গায়ে একবার, তারপর আঙ্গুল চালালো, রাত্রির অন্ধকার বিদীর্ণ করে সে সুর ঝঙ্কার হয়তো মাধুরীর মনে পৌঁছাবে। মুখে অমলিন হাসি ফুটে উঠলো মহেন্দ্রের।

কাকু আসবে তবু মা এতা কাঁদছে কেন? ভেবে পাচ্ছে না ছেলেটা। কী হলো। বাবাই কেন দাঁড়িয়ে ওখানে। কিন্তু বাবার চোখে তো জল নেই? তানপুরা সেতার মৃদঙ্গ বাঁশীর মাঝে বাবা চুপ করে দাঁড়িয়ে। খোকন আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে হলো কি? অকস্মাৎ দেখতে পেল বাবা বলছে–

এবার ঘুমাও হে ক্রুদ্ধ শিল্পী এবার এই হতভাগ্য বংশকে মার্জনা কর আমার শেষ সম্বল কেড়ে নিও না, বাবার মাথাটা লুটিয়ে পড়লো মৃতঙ্গের উপর। কিন্তু কিছুই বুঝলো না। খোকন। কাকুর ঘর পরিষ্কার করছে মা, কাকু থাকবে। পরিষ্কার তো করাই উচিত। খোকন। নিজেও গেল, কিন্তু মা অবিরত কাঁদছে। বললো খোকন না বৌদি এই সেতারটি ওকে ভোলবার জন্য।

খুব দামী সেতার না?

হ্যাঁ বৌদি, আমার জীবনটার দাম বলে হাসে মহীন নিঃশব্দে। থাক ভাই বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

আর কদিন বাঁচবো। বৌদি হাসে মহেন্দ্র সকরুণ হাসি আবার। অর্পণা নির্বিঘ্নে কেঁদে চলে যায় অন্যত্র।

তৃতীয় উপন্যাসখানও শেষ করে পাঠিয়ে দিল মহেন্দ্র প্রকাশককে। বিশ্বাসী প্রকাশক ওর নাম করেছে, তাই দ্বিতীয় তৃতীয় খানার জন্য ভালই রয়েলটি পাবে মহেন্দ্র।

খোকনকে কিন্তু কেই ঢুকতে দেয় না এ ঘরটায়। কাকুর অসুখ খোকন কাছে এসে দেখতে পায় না কাকুই বারণ করে। কেন? কাকু তো অমন ছিলো না। বাইরে বাইরে ঘোরে আর কাঁদে খোকন। নিশ্চুপ বসে থাকে পুকুর পাড়ে নয়তো শিউলী গাছটার তলায়।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে