শাপমোচন পর্ব-০৭

0
4

🔴শাপমোচন (পর্ব :৭)🔴
– ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

পরদিন রবিবার, অফিস নাই। মুখ হাত ধুয়ে মহেন্দ্র চা খেলো, দাড়ি কামালো, তারপর পরিস্কার জামা কাপড় পরে গেল ওদের অফিসার ইনচার্জের বাড়ি। মহেন্দ্র অল্পদিন চাকরি নিলেও কর্মদক্ষতায় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অফিসার বাড়িতে ওকে সস্নেহে আহ্বান করে প্রশ্ন করলেন, কি খবর মহীন? মাদ্রাজ অফিসের জন্য আমাদের কাকে পাঠাবেন ভাবছিলেন? অফিসে আমাকে যদি পাঠান তো আমিও যেতে প্রস্তুত আছি।

তুমি যেতে চাও? বেশ, কিন্তু অনেক দূর আর মাইনেতো বেশি বাড়াতে পারবো না, শুধু এই টাকার মধ্যে চলতে পারবে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, আর আজকালকার যুগে দূরত্ব বলে কিছুই নেই। আমি যেতে চাইছি, দেশ দেখা আর একটা চেঞ্জও হবে।

আচ্ছা, যাও আমি তোমার মত বিশ্বাসী একজন ইয়ংম্যান খুঁজছিলাম। তাহলে কালই অর্ডার করে দেব, তুমি মাদ্রাজ মেলে রওয়ানা হয়ে যাবে কেমন?

একেবারে মাদ্রাজ, কতদূর কে জানে? কিন্তু উত্তর মেরুতে যেতেও আজ সে প্রস্তুত। মাধুরীকে তার স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এর জন্যে কিনা করতে পারে। মহেন্দ্র আর দেরী করতে পারে না।

বাসায় এসে সব গুছিয়ে ফেললো, ভাঁজ করে ইজিচেয়ার শেকল প্যাক করে পাঠিয়ে দিল বাড়ির ঠিকানায়, সুটকেস আর বিছানা বালিশ মাত্র সঙ্গে নেবে কয়েক খানা বইও, ব্যাস।

কিন্তু নিজের উপর কেমন রুদ্ধ হয়ে উঠেছে মহেন্দ্র। এতটা বেলা হলো রবিবার মহেন্দ্র যখন খেতে এলো ভাত তখন শুকনো হয়ে গেছে। যাক, একদিন না খেলেও চলবে। কোকো, ওভালটিন মাল্টা বিস্তর রয়েছে মহেন্দ্ৰ সন্ধ্যাবেলা সব বাবুদের ডেকে খাইয়ে দিল যা ছিল। কিন্তু কাউকে বললো না সে কোথায় যাচ্ছে, শুধু বললো দিন কয়েকের জন্য বাইরে যাচ্ছি।

গভীর রাত, মাধুরীর দেওয়া সেতারটায় ঝঙ্কার তুলে মহেন্দ্র। সুপ্ত কলকাতার বুকের উপর এক অশরীরী যেন প্রিয়াদের স্কন্ধে নৃত্য করে চলেছেন, মৃত্যুর অমৃতময় পথে, গর, লর গরীয়ান ভূমিতে ত্যাগের অগ্নিময় তপস্যায়, সাধনা নির্বিকল্প সমাধিতে।

সকালের উদয়সূর্য ওকে দেখলো, বুকের রক্ত চোখের পাতায় চিকচিক করছে, কিন্তু গ্রীষ্মকালে বাবুদের কেউ কেউ ছাদে শুয়ে থাকবেন। তারা দেখবার পূর্বেই মহেন্দ্ৰ হাতমুখ ধুয়ে ফিটফাট হয়ে নিল। সারারাত ও ঘুমায়নি ঘুমাবে না আর কোন রাত। ওর রাতের ঘুম রইল এই কলকাতার দিনের জাগরণে সম্বল করে ও চলে যাবে দূর দক্ষিণ সমুদ্রের উপকূলে, কূলহারা এক জীর্ণ তরণী ডুবে যাবে।

মেসের বাবুদের চিঠি একটা কাঠের বাক্সে পিওন দিয়ে যা, মহেন্দ্র নামবার সময় দেখলো ওর নামে একখানা কার্ড রয়েছে, বাড়ির চিঠি বৌদি লিখেছে। পড়ে একটা ম্লান হাসলো মহেন্দ্র, চিঠিখানা আবার বাক্সে ফেলে দিয়ে গেল।

মাদ্রাজ মেল, উঠে পড়ল মহেন্দ্র। কোণার একদিকে নিঃশব্দে বসল গিয়ে বাক্স বিছানা সেতার সমেত, চোখ বুঝলো, লক্ষ স্মৃতিঘেরা কলকাতা ওর কাছে বিলুপ্ত হয়ে যাক, মুছে যাক, মুছে যাক কর্মের মন্দির থেকে।

সেদিন বাড়ি ফিরে মাধুরী কারো সঙ্গে কথা বলেনি, নিজের ঘরে শুয়েছিল গিয়ে কি পরদিন স্নান সেরে মার পূজার ঘরে গিয়ে নানা কাজ করলো, দুপুরে নিজের ঘরটা গোছালো। বিকালে প্রসাধন শেষ করে মেজদার খেলায় যোগদিল। ছোড়দিকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মেজবৌদি বললো হেসে।

কোন দিন কম সুন্দর দেখায়, প্রশ্ন করলো মাধুরী।

না, কম না, আজ যেন বেশ উজ্জ্বল তাহলে আর দেরী নাই, দীপ নিভার আগে জ্বলে উঠে।

ছিঃ মাধুরী, ওসব কি কথা। মেজদা ধমক দিল ওকে। কুমার ছিল আর বরুণ। মাধুরী একটুখানি চুপ থেকে হেসে বললো

খারাপ নয় মেজদা, বেশি জ্বললে প্রদীপের বুক জলে যায়, তার চেয়ে নিভে যাওয়া ভালো।

কেন এসব কথা বলছিস বোনটি, কি হলো? মেজদা ওর বেণীটা সস্নেহে আকর্ষণ করলো হাতে নিয়ে শেষে ফুলগুচ্ছটা দেখছে। মাধুরী বললো

নিভে আমি যাবো না মেজদা, আমি প্রদীপ নই, হাসছে মাধুরী অম্লান হাসি। আমি হলুম সাপের মাথার মনি গল্পে আর গরলে আমার বাসা।

গল্পে থাকতে চান থাকুন কিন্তু গরল কেন? বরুণ বললো চা খেতে খেতে।

গরলে না হলে গল্প হয় না। সমুদ্র মন্থনে আগে গরল উঠেছিল, তবে পুরানের গল্প জমলো। চলুন খেলা যাক, আমি আর মেজদা, ভাই বোন একদিকে।

অতঃপর খেলা আরম্ভ হলো। মাধুরী ভালো খেললো। হাসি মুখেই খেলছে কিন্তু কেমন যেন আনমনা। কুমার দেখে বললো।

আপনি বড্ড অন্যমনস্ক রয়েছেন–

আচ্ছা, মেজবৌ খেলুক এবার বলে চলে গেল মাধুরী বাবার কাছে। উমেশবাবু বসেছিলেন এক জায়গায়। মাধুরী এসে দাঁড়ালো।

বাবা দমদমার বাগানটার আমি কিছু করবো বলেছিলাম মনে আছে?

হ্যাঁ মা, কি করবে?

অনেক কিছু করা যাবে বাবা, আমার প্লান বড়দাকে জানাবো। অত ঝামেলার মধ্যে থেকে কাজ নেই, আর শোন বাবা

বল, উমেশবাবু তাকালেন কন্যার পানে মাধুরী

অল্পক্ষণ বাবার মাথায় হাত বুলালো, তারপর আস্তে বললো

আমার বিয়েতে তুমি তো অনেক টাকা খরচ করবে ভেবেছ বাবা।

হ্যাঁ কেন?

বিয়ে আমি করবো না বাবা। টাকাগুলো আমাকে দিয়ে দাও, আমি দমদমার বাগানে একটা আশ্রম করবো

আশ্রম?

হ্যাঁ যোগী সন্ন্যাসীর আশ্রম নয় বাবা, জীবনের আশ্রম, সেখানে মানুষ আশ্রয় পাবে। আমি অবশ্য ধর্মশালা করবো না, মঠ মন্দিরও করবো না আমি করবো মৌমাছির চাষ, গরুর গোহাল, খেলনার কারখানা আর গরীব ছেলেদের জন্য স্বাস্থ্যকর শিক্ষার ব্যবস্থা।

এসব আমি খুব বুঝি না মা, তোর বড়দাকেই বলিস, কিন্তু বিয়ে কি তুই করবি না?

বাবা, সে তো বলেছি, বন্ধন আমি সইতে পারবো না, আমি মুক্ত আছি মুক্তই থাকবো।

চলে গেল মাধুরী। মুক্ত আছে মুক্ত। মিথ্যা কথা। বাবার কাছে মিথ্যে কথা বলে এল মাধুরী। মুক্ত সে নাই, তার অন্তর বন্দী শুধু বেদনার সমুদ্রে মুহ্যমান তবু মাধুরী বলে এলো সে মুক্ত আছে মিথ্যা কথা।

কিন্তু মিথ্যা বলে মনকে আঁখি ঠারতে হয়। কিন্তু মাধুরী ভাবতে লাগলো, কয়েকদিন ধরে ভাবছে, একই ভাবনা বারবার ভাবে, প্রায় দশদিন ভাবছে, কেন মহেন্দ্র তাকে এভাবে প্রত্যাখান করলো। কি তার অভাব, কোথায় তার অযোগ্যতা। সব ছেড়ে সর্বস্ব দিয়ে মাধুরী তাকে ভালবাসলো, আর মহেন্দ্র তাকে মাছরাঙার সঙ্গে তুলনা করে বিদায় দিল।

বিতাড়িত করে দিল বললেও বেশি বলা হয় না। কেন কি এর কারণ? তবে কি মহেন্দ্র ভালোবাসেনি মাধুরীকে।

না না এ হতে পারে না, মহেন্দ্রের প্রেম শুধু তার চোখে নয়, সব অবয়বে প্রকাশ পেয়েছে মাধুরী ভুল দেখেনি, এতখানি ভুল হবার সম্ভাবনা নাই। মাধুরী এতো ছেলেমানুষ নয়। তবু মহেন্দ্র তাকে চাইলো না কেন? কেন?

প্রশ্নটা বুকের মধ্যে গুমড়ে মরছে, উত্তর নেই। তবে কি মহেন্দ্র তাকে সত্যিই ভালবাসেনি। মাধুরী কত দিন যে দেখেছে, মহেন্দ্রের সারা দেহ মনে মাধুরীর বিজয় নিকেতন উড়ছে, সে ভুল সে কি ছলনা তার? না মাধুরী দৃঢ়স্বরে বললো না। মহেন্দ্র তার গৌরবের ভূমি থেকে নামতে চায় নি এই ই কারণ মহেন্দ্র তাকে তার জীর্ণ পর্ণ কুটিরে নিয়ে যেতে চায়না, এই কারণ মহেন্দ্র তাকে সম্রাজ্ঞীর আসনে দেখতে চায় এই ই কারণ। কিন্তু মাধুরী ভুল ভেঙ্গে দেবে মহেন্দ্রের। মাধুরীর প্রেম যদি সত্যি হয়, যদি একনিষ্ঠ হয়, তবে কোথায় যাবে মহেন্দ্র তাকে ফিরে আসতেই হবে মাধুরীর কাছে সে মাছরাঙা নয়, মহাসতী। তার মৃতদেহ সম্বন্ধে নিয়ে মহেন্দ্র একদিন বিশ্বময় ঘুরে বেড়াবে। মাধুরীর প্রেম ব্যর্থ হবে না ব্যর্থ হতে দিবে না মাধুরী। বিলাসে কেলিকুঞ্জে সে প্রেম সার্থক না হোক বিরহের অগ্নিকুন্ডে তাকে গ্রহণ করতেই হবে। মাধুরীর অন্তর আজ অন্তরের চারণভূমি।

চোখের ঘন পদ্মে শিশির বিন্দুর অশ্রু জেগে উঠলো মার্কেট থেকে সদ্য আনা মহেন্দ্রের ছবিখানা অত্যন্ত গোপনে রেখে দিল মাধুরী দেরাজে। চোখ মুছলো, তারপর বেরুবে, আয়নায় মুখটা দেখে নিল, হাসি হাসি করলো মুখোনাকে জোর করে। অকস্মাৎ বড়বৌদি এসে প্রশ্ন করলো, মহীন কোথায় রে ছোড়দি। কদিন আসেনি কি ব্যাপার?

কি জানি, খুব ব্যস্ত আছে হয়তো।

যাওনি তুমি ওখানে?

না একটা নতুন নাটকের অভিনয় করবো, বড্ড ব্যস্ত আছি তাই বৌদি। কি নাটক রে? শকুন্তলা দুম্মন্ত যোগাড় হচ্ছে না ভাবছি আমাদের গনেশকে কেমন মানাবে?।

হাসলো মাধুরী বড়বৌদি হেসে ফেলল গনেশ বাড়ির চাকর, মোটা বেঁটে দাঁত উঁচু তাই ওকে গনেশ বলে। কিন্তু বৌদি হাসি থামিয়ে বললো কেন মহীন ঠাকুরপো।

দূর ও তো দুর্বাসা। ওর অভিশাপেই এত বড় নাটকখানা জন্মাল। রাগের ঋষি রাজা সাজার যোগ্যতা ওর নেই চলো বৌদি বড় ব্যস্ত আজ আমি।

আমরা তো ওকেই দুস্মস্ত করবো ঠিক করছি বড়বৌদি হেসে বললো। মাধুরী কথাটা শুনলো কিন্তু উত্তর না দিয়েই চলে গেল বাইরে।

মেসে মহেন্দ্রর অবস্থান সেখানকার মানুষগুলোকে যেন একটা অনাস্বাদিত আনন্দের আস্বাদ দিয়েছিল। এটা আর কিছুই নয়, মাধুরীর আবির্ভাব কিন্তু মহেন্দ্র চলে গেছে, মাধবী আর আসবে না। সবাই ওরা বিশেষ এরকম নিরাশ হয়ে পড়েছে। ভাঙ্গা বাক্সটায় পড়ে আছে মহেন্দ্রর ক’খানা চিঠি। সবাই নিজের চিঠি দেখতে গিয়ে এগুলো একবার করে দেখে নেয়। মহেন্দ্রের ঠিকানা জানা নেই নইলে রিডাইরেক্ট করে দিত। দু’একজন পড়েও রেখেছে পোস্টকার্ড দুটো, সেদিন এই নিয়ে ওদের কথা হচ্ছিল।

ওর বাড়ির চিঠি ওকে কোত্থেকে দেখতে আসবে তাই বাড়ি যেতে লিখেছে ওর বৌদি।

দেখতে আসবেন। বিয়ের জন্য।

হ্যাঁ তাইতে লিখেছে দেখলাম।

তাহলে এই শ্ৰীমতীর সঙ্গে বিয়ে নয়, বন্ধুত্ব অর্থাৎ পরকীয়া।

থাক থাক, আমাদের অতসব ভেবে কাজ কি। এ যুগে ওরকম ঢের হয়ে থাকে, বুঝলে।

ছোকরা কিন্তু খুব অন্যায় করলো। মেয়েটা সত্যি ওকে ভালোবাসে ব্যাচারা।

হঠাৎ এভাবে মহীনের চলে যাওয়াটা কিন্তু খুব রহস্যময় মনে হচ্ছে কি বলো জনুদা।

ওকে ক্ষমা করা যায়না পাড়া গাঁয়ের গাধা একটা বলে জনরঞ্জন বাবু মুখোনা বিকৃত করলো। ওদেরই যে মহা ক্ষতি হয়ে গেছে মহেন্দ্র চলে যাওয়াতে এমনি ভাব। আজ শনিবার খিচুড়ির আয়োজন হচ্ছে ওদের, কিন্তু মহীন থাকলে হয়ত মাধুরীও আসতো, নিরামিশ খিচুড়ির আস্বাদ হয়ত বহুগুণ বেড়ে যেত। ছোকরা করলো কি? কেন চলে গেল?

ও যেন ওদের কাছে একটা নিদারুণ রহস্য।

বর্ষার জল দাঁড়িয়েছে মেসের গলিতে। কলকাতার জনবহুল পথে পথে পথিকরা জুতো হাতে হাঁটছে, এ গলিতে ঠিক সেই অবস্থা। অকস্মাৎ ছড়িয়ে মেসের দরজায় এসে দাঁড়ালো প্রকান্ড গাড়িখানা, ভেতরে মাধুরী।

আসুন, আসুন এইমাত্র আপনার কথা হচ্ছিল, বহুদিন বাঁচবেন—

অভিশাপ দিচ্ছেন? মাধুরী গাড়িতে বসেই বললো হাসতে হাসতে।

সে কি? অভিশাপ কেন? মেম্বারগণ আকস্মিক আঘাতে থেমে গেল। বহুদিন বাঁচার অর্থ বহু দুঃখ ভোগ আবার হাসলো মাধুরী।

ওরা এবার বললো–

আপনি কেন দুঃখ পেতে যাবেন। দুঃখ পাব আমরা গরীব কেরানীর দল।

দুঃখহীন যে জীবন, সে জীবন নয়, সে অনুভূতিহীন জীবকোষ জীবন মাত্রেই দুঃখ ভোগ করে।

বলেই মাধুরী একটু হাসলো। ওর প্রতিটি কথার মধ্যে কেমন যেন দুঃখের সুর অভিব্যক্ত হচ্ছে। না না, এ চলতে দেওয়া হবে না, তাড়াতাড়ি বললো।

দীর্ঘ জীবন যদি কর্মে পরিপূর্ণ হয়, তবেই সার্থক, নইলে সে অভিশাপ।

আমরা নিশ্চয় আপনার সফল জীবন কামনা করবো।

মাধুরী কিছু না বলে নামবে কিনা ভাবছে। বড়বৌদির কথায় কেমন যেন সচকিত হয়েছে মাধুরী। মহেন্দ্র একেবারে ও বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেছে, এ ব্যাপারটা বড়ই দৃষ্টিকটু। জীবন সাথীরূপে মাধুরীকে না হয় গ্রহণ নাই করল মহেন্দ্র তাহলে পিতৃবন্ধুর বাড়ি যাওয়া বন্ধ করলো কেন? মাধুরীর সঙ্গে সম্বন্ধ কেটে দিয়ে সে মাধুরীকে অবকাশ দিতে চায় তাকে ভুলবার, কিন্তু এটা ভুল। বরং পরস্পরকে বোঝাবুঝির পর সান্নিধ্য আর স্নেহ সম্পর্কের মধ্যে দু’জনেই কিছু কিছু সহজ হতে পারবে। এই ভেবে মাধুরী এসেছে আজ কিন্তু নামবার পূর্বেই জনুবানু বললো–মহেন্দ্র কোন ঠিকানা দিয়ে যায়নি ওর একগাদা চিঠিপত্র পড়ে রয়েছে, আপনি নিয়ে যান, ওর ঠিকানায় ডাইরেক করে দেবেন। মাধুরী আসলে ভাল হয়ে বসলো বুঝলো, মহেন্দ্র মেসে নেই।

ওর বৌদি এই পোস্টকার্ডটিতে লিখেছে কোত্থেকে ওকে দেখতে আসবে বিয়ের জন্য, আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারটা আমরা ক্ষমা করতে পারছি না।

কেন? হাসলো মাধুরী বিয়ে তো করতে হবে তাকে।

হ্যাঁ আমাদের ধারণা সেটা আপনার সঙ্গেই

আপনাদের মাথায় দেখছি নির্মল গোবর, একটুও গাইদুধ নেই। আমি লক্ষপতির মেয়ে আর ও ষাট টাকার কেরানী, আমাদের বিয়ে হবে কি করে ভাবলেন?

নিশ্চয়ই, সে তো বটেই, মেম্বারগণ লজ্জিত হয়ে পড়লো। এর মধ্যে একজন একখানা মাসিক পত্র, দু’খানা সাপ্তাহিক, দুটো পোস্টকার্ড আর একখানা খাম এনে দিল মাধুরীর হাতে। বললো, আপনি নিশ্চয় তার ঠিকানা জানেন?

হ্যাঁ আমি সবই জানি আচ্ছা নমস্কার বলে চলে যাচ্ছে মাধুরী।

আর আসবেন না? করুণ কণ্ঠে প্রশ্ন করলো জনরঞ্জন।

আসবো, এই মেসের সঙ্গে সম্পর্ক অক্ষয় হয়ে রইল, চলে গেল গাড়িখানা। মেয়েটি সত্যি চমৎকার। বললো জনরঞ্জন।

হ্যাঁ, ওকি আর আসবে? মহীন ছোড়াটা কেমন বেআক্কেল জানতাম না।

গভীর বিষাদিত হৃদয়ে সবাই চলে গেল। সামনের রাস্তার তখনো গাড়ির চাকার আঘাত লেগে জলটা টলমল করছে অতটুকু জল কিন্তু কি তার তরঙ্গ। ছলাৎ ছল শব্দে যেন ক্রন্দন জুড়েছে মাধুরী আর কখনো আসবে না, আসবে না।

চিঠিগুলো নিয়ে নিশ্চুপ বসে রইল মাধুরী গাড়িতে। অনুপ সিং শুধালো কোথায় যাব দিদিমণি। বাড়ি

না, গঙ্গার ধারে চল, জল কতটা বেড়েছে দেখে আসি।

নিঃশব্দে চলেছে গাড়ি। মাধুরী বৌদির পোস্টকার্ডখানা পড়লো। অন্য পোস্টকার্ডটা একজন সম্পাদকের তিনি গল্প চেয়েছেন মহেন্দ্রের কাছে। খামের চিঠিও খুললো মাধুরী মহেন্দ্রর লেখা উপন্যাস, মরণ যমুনা, ছাপা হলো খবর জানিয়েছেন প্রকাশক। মাসিক সাপ্তাহিক মহেন্দ্রের গল্প বেরিয়েছে। সবই ভাল খবর কিন্তু কোথায় মহেন্দ্র এখানে নেই। বাড়িতেও যায়নি তবে গেল কোথায়? এত দীর্ঘদিন ছুটি পাবারও আশা কম তার। তাহলে চাকরি কি ছেড়েই দিয়ে গেল নাকি, কেন? বিস্ময়টা অত্যন্ত বেশি হয়ে উঠলো, কিন্তু বৌদির চিঠিখানা পড়ে মাধুরী আন্দাজ করে কোন খবর না দিয়ে অকস্মাৎ মহেন্দ্রের সরে পড়ার কারণ আর কিছু নয় লজ্জা। মাধুরীকে সে জীবন সঙ্গিনী করতে পারবে না, গ্রহণ করবে হয়তো বা কোন পল্লী দুলালীকে। এরই জন্য মহেন্দ্র আঘাত পর্যন্ত করে গেল মাধুরীকে। ধিক কাপুরুষ মুখ ফুটে কেন বলতে পারল না কথা।

ঠোঁট কামড়ালো মাধুরী, তৎক্ষণাৎ দুর্বল লাজুক মহেন্দ্রের মূর্তিটা এসে সামনে দাঁড়ালো বলা যায় না, সত্য ভালোবাসে মহেন্দ্র তাকে। তাই হয়তো মহেন্দ্র নিরুপায় হয়তো অসহায় হয়তো অন্ধদাদার সম্মান রক্ষার জন্যে বদ্ধপ্রতিজ্ঞ, অথবা, কি আর কারণ থাকতে পারে? মাধুরী তো দীনাতিদীনা হয়ে তার হাত ধরে সঙ্গে যেতে চেয়েছিল জীবনের পথে। মহেন্দ্র কি দরিদ্রর ঘর তুলতে ভয় পেলো?

থামাও সিংজী আদেশ করলো মাধুরী, স্বয়ং গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়লো। চিঠিগুলো পড়ে রয়েছে আসনে। মাধুরী নিঃশব্দে গঙ্গার কূলে দাঁড়ালো গিয়ে। দুকূল ভরা নদী সূর্য অস্ত যাচ্ছে ওপারে মাধুরী তাকিয়ে রইল?

নমস্কার, কি দেখছেন একা দাঁড়িয়ে? নমস্কার জানালো সুশীলবাবু হাতে র‍্যাকেট হয়তো মাঠে খেলছিল।

নমস্কার, মাধুরী আকস্মিকতা সামলে বলল দেখছিলাম সূর্য যখন ডোবে তখন পৃথিবী হাসে না কাঁদে, হাসলো মাধুরী সুন্দর করে।

কি দেখলেন? কাঁদে নিশ্চয়?

হাসে। পৃথিবীর প্রেম এমন সত্যি যে কাল আবার সূর্যকে আসতেই হবে।

হ্যাঁ, কিন্তু এই যে নৌকাটা যাচ্ছে ওপারে, ও নাও ফিরতে পারে।

তাহলে বোঝা যাবে এপারে ওর প্রেমের কোন বন্ধন নেই। মাধুরী আবার হাসলো।

হ্যাঁ, নিশ্চয় চলুন রেস্তোরাঁয় গিয়ে এককাপ চা খাই সুশীল আবেদন জানালো। আপনাদের শুধু খাই খাই মাধুরী ঝঙ্কার দিল জানেন চোখের আনন্দ ভোজে উদরের ভ্যোজ্য। বিরোধী।

উদর পূর্ণ থাকলে চোখের ভোজ্য বেশি আনন্দদায়ক–

অন্তর যার আছে, উদরকে সে অগ্রাহ্য করতে পারে।

তাহলে বাঁচে কি করে দেবী।

দেবী বাঁচবার কথা ভাবে না মৃত্যুতেই সে অমর হয় কথাটা আপনাকে বলে ভুল হলো।

কেন ভুল হোল কেন! সুশীল সবিনয়ে প্রশ্ন করলো আবার।

কারণ, আপনারা দেহকেই বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেন, তার প্রমাণ র‍্যাকেট আর রেস্তোরাঁ, আলো জ্বালা অন্ধকারে গিয়ে আমি গোধুলী লগ্নকে হারাতে চাইনে। চলে যাচ্ছে মাধুরী।

গোধুলী কিন্তু বিয়ের লগ্ন, সঙ্গে সাথী দরকার জানাল সুশীল।

না শুধু বিয়ের কথা ভেবেছেন দেখছি গোধুলী বিরহের ও লগ্ন, পৃথিবীর বিরহ আকাশে বিরহ, এই সন্ধ্যারাগ বিরহেরও মহাকাব্য।

চলে গেল মাধুরী অনেক দূর! সুশীল দাঁড়িয়ে রইল।

নির্জন নদী সৈকত অন্ধকার নেমে আসছে, বর্ষার সন্ধ্যা। এখানে এভাবে থাকা আর উচিত নয় মাধুরী ঘরে ফিরবে কিন্তু কোথায় ঘর। যে সুখনীড় সে রচনা করতে চেয়েছিল। আকস্মিক ঝড়ে তা ভেঙ্গে গেল গাছ থেকে পড়ে যাওয়া একটা পাখির বাসা হাতে তুলে মাধুরী ভাবছে চোখের জল টলমল করছে ওর! না সামলাতে হবে, মাধুরী বাসাটাকে স্রোতের জলে ছেড়ে দিল ভেসে যাচ্ছে বাসাটা ভেসে যায়, সবই ভেসে যায় ডুবে যায় নিষ্ঠুর আবর্তে।

উঠে আসছে উপরে, এক ভিখারিনী হাত পাতল কোলে একটা শিশু।

দাও না দুটো পয়সা।

তুমি বিয়ে করেছিলে?

হ্যাঁ, মা, দুর্ভিক্ষের বছরে চোখের জল গড়িয়ে গেল মেয়েটার।

থাক, আর বলতে হবে না। মাধুরী হাত ব্যাগ খুলে দুটো টাকা ফেলে দিল। রাণী হও মা রাজরাণী হও।

.

কাকু তো আসছে কাঁদছো কেন মা তুমি?

অর্পণা কোন জবাব দিতে পারলো না। নিঃশব্দে তাকালো ছেলের মুখপানে উপচে পড়ছে জল। শেষে হাহাকার করে উঠলো অর্পণা–

হারে হতভাগ্য ছেলে–

কিন্তু কিছুই বুঝলো না খোকন। বাইরের রোয়াকে গিয়ে দাঁড়ালো, পেঁপে গাছটায় চার পাঁচটা ফল পেকেছে কাকু এলে খাবে, কলার ফুলটাও পাড়তে হবে এবার কাকু চপ তৈরী করবে এ দিয়ে। গতবার দোপাটি ফুল অজস্র ফুটেছে আর নীল অপরাজিতা কাকু দেখবে এসে। হ্যাঁ ঐতো আসছে কাকু। গরুর গাড়ি এসে থামলো। একি কাকুই তো। চেনা যায় না, অমন কার্তিকের মতন কাকা খোকনের যেন মনে হলো ভুতের কঙ্গাল।

কাকু। খোকন দৌড়িয়ে গিয়ে কাকুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আয় বাপ আমার। বলে হাত বাড়াতে গিয়েই থেমে গেল মহেন্দ্র। আস্তে বলল, ছেলেটাকে সরাও বৌদি

হ্যাঁ এসো।

অর্পণা অশ্রুপ্লাবিত চোখে মহেন্দ্রকে ধরলো গিয়ে, ধীরে ধীরে নামালো গাড়ি থেকে, অতিসাবধানে নিয়ে এল তার শোবার ঘরে কিন্তু খোকনকে ওখান থেকে সরিয়ে দিল দয়াল, ঠেলে বের করে দিল। খোকনের কাকু আর ওকে যেতে দিবে না কাকুর কাছে। কেন? অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে চলে গেল খিড়কীর পুকুরে। গোটাকতক ঢিল ছুঁড়ে মারলো জলে বসা পান কৌড়িগুলোকে উড়ে যাচ্ছে পাখিগুলো।

যা, পালা সব, কেউ এখানে থাকতে পারবিনে দুই গালে জল খোকনের। মহেন্দ্র এসে শুয়ে পড়লো খাঠে ওর জিনিসগুলো সব দয়াল এনে রাখলো এই ঘরেই, সেতারটাও আনলো, মহীন হাত বাড়িয়ে নিল পাশেই রাখলো। দেবেন্দ্র নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘরের এক ধারে, এতক্ষণ মহেন্দ্রের খাটে এসে বসলেন তার সর্বাঙ্গ দু’হাত দিয়ে স্পর্শ করতে লাগলেন, বুক চিবুক, চোখ কিন্তু ওর চোখে অবিরল ধারা নামাছে।

এ কতদিন হচ্ছে মহীন। প্রশ্নটা আটকে যাচ্ছে গলায় বার বার।

কলকাতায় থাকতেই বুঝা গিয়েছিল দাদা

তাহলেও তক্ষুণি বাড়ি ফিরলে কেন?

লাভ নেই। ওর চিকিৎসা করার মত সামর্থ আমাদের নেই দাদা। আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার

তাহলেও আমি ভিটে মাটি বেঁচে দেখতাম। একি করলি মহীন। আমার অন্ধের চোখ অন্ধ করলি।

সান্ত্বনার ভাষা। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দয়াল অর্পণা ঘরের চৌকাঠ ধরে নিজেকে সামলাচ্ছেন, মহীন কিন্তু স্থির কণ্ঠে বললো–

ঐ বিঘে পাঁচ সাত জমি আর ভিটেটুকু থেকে খোকনকে বঞ্চিত করতে পারলাম না। দাদা। দূর দেশে গিয়ে হাওয়া বদলের চেষ্টা করছি যথাসাধ্য ওষুধ পথ্যও খেয়ে দেখলাম, এ মিনতি, কোন ফল হোল না। যা রইল তাই দিয়ে ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে খরচ আর করবে না আমার পিছনে।

মহীন? দেবেন্দ্র একবার আর্তকণ্ঠে ডাকলেন তুই যে আমার কাছে খোকনের থেকে বেশি মহীন কিন্তু বলা হলো না কথা। দেবেন্দ্র মহীনের মাথাটা কোলে নিয়ে নীরবে বসে রইল বহুক্ষণ।

ধীরে ধীরে মৃত্যু এগিয়ে আসছে নিঃশব্দে পদ সঞ্চারে মহেন্দ্র ভাবে নির্মম আঘাত সে করে এসেছে মাধুরীকে। কেন করেছে, তা জানলো না মাধুরী, জানবে না কোন দিন। দ্রাক্ষার কালিতে লেখা স্বাক্ষর অস্পষ্ট হয়ে যাবে মাধুরীর মনের পট থেকে মুছে যাবে হয়তো। যাক গভীর রাত্রে মহেন্দ্র সেতার খানা বাজাতে বাজাতে ভাবে এইসব।

আর রাত জেগো না মহীন। অর্পণা এসে বসে।

.

দূর বোকা মেয়ে। মাধুরী হেসে বলল রাণীরা থাকে রাজমহলে, তোদের দুঃখ কি তারা দেখতে আসে। চলে এল মাধুরী মোটরের কাছে। মুখটা মুছে নিল অনুপ সিং দেখার আগে। তারপর চড়ে বসতে বললো

বাড়ি চলো সিংজি কথাটায় এত বেশি ক্রন্দন যে নিজেই চমকে উঠলো মাধুরী।

কিন্তু অনুপ সিং অত লক্ষ্য করবে না। দীর্ঘদিনের পুরানো লোক সে। মাধুরীকে জন্ম থেকে দেখছে। স্নেহ করে নিজের কন্যার মত। নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মতলার মোড়ে ভিড় গাড়িটা থামাতে হলো।

কাগজের ঠোঙায় লজেন্স চিনাবাদাম বিক্রি করছে একটা লোক, অন্য একজন বেচছে বেলুন এগিয়ে আসছে মাধুরীর গাড়ির দিকে। মাধুরী বলল চালাও সিংজী এরা বড্ড বিরক্ত করে —

গরীব আদমী হু জ্বর বলে অনুপ সিং ধমক দিল হকারকে এই ভাগ গে।

ভাগবার লোক নয় ওরা বেলুনওয়ালা ঠিক এসে দাঁড়ালো এবং বললো বিরক্ত হলে চলবে কেন বলুন, আপনারা না কিনলে আমরা খাই কি? আমাদের তো ছেলেপেলে আছে। দেব দুটো

দিন–মাধুরী একটা আধুলী ফেলে দিল ওর হাতে–কটি ছেলেমেয়ে আপনারা?

গুণে বলতে হবে স্যার। গরীবের ঘরে ওরা অগুন্তি আসে। চারটা বেলুন ভেতরে দিয়ে সে চলে গেল। গাড়িও ছাড়ল! মাধুরী হাসছে ওর কথাটা শুনে। কিন্তু দেখতে পেল এক জোড়া বর বধু খাচ্ছে। বধুটিকে দেখলো মাধুরী দেখতেই লাগলো গলা বাড়িয়ে। মাধুরীর। গাড়ি ঐ ট্যাক্সির পাশাপাশি আসতেই খোলা গাড়িতে কনের কোলে অকস্মাৎ বেলুন চারটা ফেলে দিল? মাধুরীরে গাড়ি বেগে চলে যাচ্ছে। আপনার রসিকতায় হাসছে মাধুরী। ওদের ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্যই দিল। ভাঙ্গা বাসাটা স্রোতে ফেলে দিয়ে এসেছে, গাড়ি নীড়টাকে। কিছু তো দিল।

মুখের হাসিটা ওর মিলাচ্ছে না আর একবার গলা বাড়িয়ে দেখতে চাইলো অনেকে, মুখে হাসি কিন্তু চোখে জলটা যে রোধ করা যাচ্ছে না। হোল কি মাধুরীর? এত দুর্বল তো ও নয়। না মাধুরীর অন্তরের মৌচাককে কে যেন নিংড়ে দিচ্ছে। অসহায় মাধুরী শুয়ে পড়ল নরম কুশনের উপর।

সুদীর্ঘ পথ, মন বিষণ্ণ শরীর অবসন্ন, মাদ্রাজ শহরে এসে নামলো মহেন্দ্র। অর্ধমৃত মনে হচ্ছে ওকে। কিন্তু এই দূর বিদেশে, কোন আত্মীয় স্বজন নাই নিজেই নিজেকে দেখতে হবে।

আপনার অন্তর দিয়ে রচনা করে প্রেমস্বর্গ ও ত্যাগ করে এসেছে নিষ্ঠুর নিয়তি ওকে কোথায় নিয়ে যাবে, কে জানে।

মাদ্রাজ ব্যাঞ্চের ঠিকানা ছিল সেখানে পৌঁছাতে অসুবিধা হোল না বেলা নয়টায় পৌঁছাল মহেন্দ্র। ও কি রকম দেশ? ধনীর প্রসাদের পাশে দরিদ্রের কুটির বাংলাদেশের চেয়েও প্রকট বেশি ওখানে। কিন্তু ওসব ভাবলে চলবে না। মহেন্দ্র ওখানকার অফিসে দেখা করলো।

ওখানে যিনি আছেন, তিনি মাদ্রাজী হলেও অতিশয় আদরে মহেন্দ্রকে গ্রহণ করেন। কাছাকাছি একটা কম খরচের বাড়িতে তার থাকবার জায়গাও ঠিক করে দিলেন। একতলা একটি ঘর বড় গরম কিন্তু ভাড়া খুব কম কাজেই মহেন্দ্র এখানে আস্তানা গাড়লো। নিজেই। রান্না করে খাবে, আর যদি কোনদিন না রাঁধতে পারে হোটেলে খেয়ে নিবে। কুইক সার্ভিস বলে এক রকম খাদ্য পাওয়া যায় এখানে নানারকম আনার দিয়ে তৈরি হয় চাইবা মাত্র সার্ভ করে, তাই এর নাম কুইক সার্ভিস।

মাদ্রাজ শহরটা দেখতে দু’একদিন গেল মহেন্দ্রের। বাড়িতে দাদাকে লিখে জানালো তার এখানে আসার কথা এবং কলকাতার প্রকাশক আর পত্রিকার অফিসেও জানিয়ে দিল কিন্তু মাধুরীকে বা উমেশবাবুকে কিছুই জানালো না।

এই অকৃতজ্ঞতা ওকে পীড়িত করছে কিন্তু মহেন্দ্র নিরুপায় কেন? কেউ জানে না, জানে মহেন্দ্র স্বয়ং আর বিশ্বনিয়ন্তা বলে যদি কেউ থাকেন। ভীরু মহেন্দ্র পালিয়ে সে এল, প্রেমের অপমান করে এল মহেন্দ্র। মাধুরী ভাববে এবং এ কথাই ভাববে। মহেন্দ্র ভীরু মহেন্দ্র কাপুরুষ, মহেন্দ্র অশক্ত দুর্বল শুধু নয়, মহেন্দ্র অকৃতজ্ঞ, মহেন্দ্র অ–প্রেমিক। উপায় নাই, অন্য আর কিছু উপায় নাই। মাধুরীর ভাল হোক, সে রাজরাণী হোক মহেন্দ্র সর্বান্তকরণে কামনা করে। শিবের গলার মালা সে শিবের গলায় দিতে পারে না–না, না–

চোখে জল মহেন্দ্রের কিন্তু দুর্বল হলে চলবে না। আরও কঠিন হতে হবে। এখনো। অনেক বাকি আছে তার দুঃখের এরপর আছে নিবিড় অমাবস্যার নিবন্ধ অন্ধকার–নির্মম নিয়তি। মহেন্দ্র প্রথম দিন হোটেলে খেয়ে অফিসে গেল। এখানে যত গরম তত লঙ্কার ঝাল তেঁতুলের টক। আম সস্তা কিন্তু স্বাদ নেই, বাংলার বাগানের আম মনে পড়ছে তাদের খিরকী পুকুরের গাছের আম।

ওঃ কতদূর। কত দীর্ঘ দূরত্ব। কিন্তু মন এমন বস্তু যে মহেন্দ্র এই মুহূর্তে তাকে মাধুরীর কাছে পাঠাতে পারে, মাধুরী এই কয়মাস তার অনুক্ষণের সঙ্গিনী ছিল।

অফিসে কাজ করছে। মাত্র তিন জন লোক, একটা বেয়ারা, মহেন্দ্র একটা চিঠি টাইপ করছে প্রথমেই কলে কাগজ লাগিয়ে কলকাতা অফিসের ম্যানেজারের নাম লিখতে হবে। মহেন্দ্র খট খট করে টাইপ করে ফেলল মাধুরী ভট্টচার্জ। রবার দিয়ে মুছলো সেটাকে মহেন্দ্র লিখে ফেলল মাধু ম্যানেজার শব্দটাতে ভুল হলো।

দূর হোক কাগজখানা খারাপ হয়ে গেল। মহেন্দ্র ফেলে দিয়ে অন্য কাগজ নিয়ে আবার টাইপ আরম্ভ করলো। দারুণ গরম পাখা চলছে, তবুও অস্বস্তি লাগে মহেন্দ্র কষ্টে শেষ করলো চিঠিখানা।

কাজ খুব কম কিন্তু চুপচাপ বসে থাকা এক মহা বিড়ম্বনা। মহেন্দ্র দু’চার দিনের মধ্যে অফিসের অবস্থা বুঝে খাতা নিয়ে ওখানেই লেখা আরম্ভ করছে। বাংলা ওরা কেউ বুঝে না। মহেন্দ্র দেখে শুনে খাতিরও করলো এবং এদিকে মহেন্দ্রের যথেষ্ট সুবিধাও হলো।

গভীর রাতে মহেন্দ্র সেতারখানা তুলে নেয়, মাধুরীর আঙ্গুল বুড়ালো সেতার মনে পড়ে মাধুরী বলেছিল আমার হাতেরর বীণা তোমার হাতে বাজাবে ঘেরাটোপ খুলে যন্ত্রটায় হাত বুলিয়ে আদর করে মহিন চুম্বন করে তারপর বাজাতে আরম্ভ করল চোখ বুজে। সেতারটা যেন স্বয়ং মাধুরী। একলা ঘরে হেসে হেসে শুধায় সেতারখানাকে শুনছো মাধুরী বিরহের ব্যথা ভরা স্বর, শোন–

মাদ্রাজ নৃত্য গীতের দেশ ঐ আবর্জনাময় একতলা বাড়ির কুঠুরী থেকে সুরের পরী নত করতে করতে বের হয়ে আসে শহরের গলিতে তার অনির্বাণ আকর্ষণ অনুভব করলো ৯ পাড়ার কয়েকজন অনতিবিলম্বে। একদিন এসে তারা ধরলো মহীনকে।

কতো সুন্দর বাজান আপনি? চলুন, আমাদের শ্রীমন্দিরে আপনাকে যেতে হবে।

এ সেতার তো অন্য কোথাও বাজে না ভাই? মহেন্দ্র সবিনয়ে জবাব দিল।

কেন? বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে তাকালেন ওঁরা।

এটা ভূতে পাওয়া সেতার এই ঘরে দরজা বন্ধ করে ওকে বাজাতে হয় হাসল মহীন।

বেশ ওটা থাক হেসে বললেন, আমাদের শ্রীমন্দিরে বিস্তর যন্ত্র আপনি যেটা ইচ্ছে। বাজাবেন আজ আপনাকে যেতে হবে আমরা নিয়ে যাব সন্ধ্যাবেলা।

বাংলা এঁরা জানে কিন্তু ইংরেজীতে কথা প্রায় সকলেই বলতে পারেন বলল–

আমি সুরের সাধনা করি, তারজন্য দরকার নির্জনতার। শ্রীমন্দিরে সেটা হবার যো নাই। আমাকে মাফ করলে খুশি হবো, আমার সুরে আমি সমাধিস্থ থাকতে চাই

সে কি? আপনার মতন অসধারণ শিল্পীকে চিনবো না আমরা। না না কাল আপনাকে একবার যেতেই হবে, সাধনা আপনি করুন। মধ্যে মধ্যে আমরা না শুনে ছাড়ছি না।

যাবার সম্মতি না দিয়ে উপায় নাই। পরদিন সকালে ওরা এসে পড়লেন মহেন্দ্রকে নিয়ে যেতে। মাধুরীর সেতারখানা মহেন্দ্র একবার তুললো নিয়ে যাবার জন্য, না যদি হারিয়ে যায়, যদি ভেঙ্গে যায়, অতি যত্নে মহেন্দ্র ওটা রেখে দিল। আবার এরা প্রশ্ন করলেন–

ঐ সেতারটি খুব প্রিয় বুঝি আপনার?

প্রিয়। না না প্রিয় বললে সবটা বুঝায় না, ওকে আমার প্রিয়া বলা চলে। হাসলেন সবাই কিন্তু একজন ওরইমধ্যে রসিক আছেন, বললেন–

ভূতে পেয়েছে বলেছিলেন যে।

হ্যাঁ, সুরের ভূত। একলা ঘরে রোজ ওকে বাজান হয়, নইলে আমার ঘুম জাগরণ জীবন মরণ একাকার করে দেবে, হাসলো মহেন্দ্র। দীর্ঘায়িত চোখ ওর চিকচিক করছে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ওদের সঙ্গে।

এক পূজামন্দির সংলগ্ন মুণ্ডপ এই শ্রীমন্দির, বড় ক্লাব, বহু ব্যক্তি শুনলেন মহেন্দ্রের যন্ত্রালাপ কিন্তু কণ্ঠ সংগীত সে গাইল না এখানে। অথচ ওপাড়ার সবাই শুনেছে কণ্ঠও তার অপরূপ। একজন বললো–

বাংলা গানই হোক না একটা।

মাফ করবেন। মহেন্দ্র কাটিয়ে দিল অনুরোধটা।

উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেল সে। কত যে আনন্দ ওর হবার কথা। কিন্তু না বিষাদের বিষণ্ণতা ওকে মুহূর্তের জন্য ত্যাগ করলো না। ফেরার পথে একজন বললেন–

নিজেকে প্রকাশ করুন। সত্যি আপনি অসাধারণ শিল্পী।

সব ফুল প্রকাশ পায় না বন্ধু অনেক গোপনে ঝরে যায়, মৃদু হাসলো মহেন্দ্র। আপন আবাসে ফিরে গভীর রাত্রিতে মাধুরীর দেওয়া সেতারটা বাজাতে লাগলো মাধুরী শোন–

অন্তরের ব্যথা অশ্রুর আকারে ঝরে পড়ছে–

অশ্রুর অক্ষরে কিছু সৃষ্টি করে যেতে হবে মহেন্দ্রকে। এখানে কাঁদলে তো চলবে না। মহেন্দ্র অকস্মাৎ সেতারখানা ঘেরাটোপে মুড়ে রেখে দিল তারপর কাগজ কলম নিয়ে বসল। অত্যন্ত অসুস্থবোধ করছে, তবু লিখলো খানিকটা।

জীবন মহাসাগরে সীমাহীনতার কয়েকটা ক্ষুদ্র দ্বীপ জলে গেছে। উঠেছে ওরই উপর কখনো বা বসে এসে সমুদ্রচর পাখি। রঙিন পাখার হাওয়া বুলিয়ে যায় সাথীর সঙ্গে কুজন করে যায় এই তো জীবনের অবলম্বন। কত ক্ষুদ্র, কত অসহায় সে। তবু জীবন কত মহৎ কত বিরাট কত উদার। কী বিস্তীর্ণ ওর পরিধি। তবু জীবন একা, একান্তই একা জীবনে সে সত্য না প্রকাশ পাক, কারণ তার অনিবার্যতা কেউ ঠেকাতে পারবে না, লিখে চলছে মহেন্দ্র। দীর্ঘক্ষণ লিখলো, ক্লান্ত হাত আর চলছে না। কখনো এক সময় কলম হাতেই ঘুমিয়ে পড়লো মহেন্দ্র।

অফিসে কাজ কর্ম এবং উপরে কৈফিয়ৎ নেবার কেউ নেই বলে মহেন্দ্র যথেচ্ছা অফিসে যায়, কুকারে রান্নার করে খায় না হয়তো দোকানে কুইক সার্ভিস চালিয়ে দেয়। নিজের উপর তিলমাত্র দরদ ওর নেই যেন। কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টি বিরামহীন গতিতে চলেছে, সঙ্গীতও চলে গভীর রাত্রে, একবার অন্ততঃ সেতারখানা না বাজিয়ে মহেন্দ্র ঘুমাতে পারে না এক অশরীরী আকর্ষণ যেন হাতছানি দেয় বাজাও একবার বাজাও।

কলকাতায় থাকাকালীন মহেন্দ্র যে উপন্যাসখানা লিখেছিল তা ছাপা হয়ে এসেছে এবং দুটো বাজনা আর দু’খানা রেকর্ড দিয়েছিল, খবর পেল চিঠিতে যে, সেগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ওরা লিখেছে মহেন্দ্র বাবু আরো কিছু রেকর্ড দিলে কোম্পানি খুশি হয়ে গ্রহণ করবে?

সব সম্ভাবনা সম্মুখের। সম্পদ, সম্মান এবং সুন্দরী মাধুরী, না মহেন্দ্র যেন চীৎকার করে উঠলো না শব্দটা সঙ্গে সঙ্গে। সর্বাঙ্গ কাঁপছে ওর। কী এত অন্তর্ভেদী দীর্ঘশ্বাস যেন বুকখানা ফাটিয়ে যাচ্ছে। সামলাতে হোল চোখে জল আসা দরকার, কিন্তু কৈ মহেন্দ্র আজ কাঁদতে। পারছে না। কম্পিত হাতে মহেন্দ্র ঘেরাটোপে ঘেরা সেতারখানা আনতে হাত বাড়ালো, অবসাদে হাতখানা জড়িয়ে আছে।

দু’মাসে কিন্তু মন্দিরটা দেখা হয়নি, চললো। ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে, নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো মহেন্দ্র দেওয়ালের সামনে, সোপানাবলী পার হয়ে তবে ভেতরে যেতে হবে, কিন্তু মহেন্দ্র অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আর উঠে উপরে যাওয়া অসম্ভব। মহেন্দ্র ঐ সোপানের এক ধারে শুয়ে পড়লো।

দীর্ঘক্ষণ শুয়ে রইল মহেন্দ্র অকস্মাৎ মনে হলো মাধুরীকে আজ ছোঁয়া হয়নি আজ তার পূজা হয়নি যেন, মাধুরী অভিমান করে বসে আছে বাড়িতে। উঠেই ফিরলো বাড়ির পানে। রাত্র অনেক, একা পথ হেঁটে বাসায় এসে অদ্ভুত মহেন্দ্র সেতার নিয়ে বসলো, স্তব্ধ কক্ষের ঘুমন্ত কন্যা যেন জাগ্রত হয়ে উঠল মুহূর্তে কিন্তু যে রাজকুমার তাকে জাগালো তার রক্তাক্ত রসনা লেলহী হয়ে উঠলো সেতারের তন্ত্রীতে।

ঘরের ক্ষীণ আলোতে দেখলো মহেন্দ্র আবার আঃ। মহেন্দ্র নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো সেতারটা কোলে নিয়েই।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে