🔴শাপমোচন (পর্ব :৬)🔴
– ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
মাধুরী নিজের পড়াশুনা নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যেন। প্রতি শনিবার মহেন্দ্রের মেসে আসা আর হয়ে উঠে না, ফোন করে মহেন্দ্রকে অফিসেই জানিয়ে দেয় কোন। একটা নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করতে। মাধুরী সেখানে যায়। দু’জনায় কোনো ভাল রেষ্টুরেন্টে খায়, কিছুক্ষণ বেড়ায়, তারপর মহীনকে মেসের গলির মোড়ে নামিয়ে দিয়ে মাধুরী বাড়ি ফেরে। মেসের বাবুরা শনিবার তার অপেক্ষায় বসে হয়রান হয়ে এখন আশা ছেড়ে দিয়েছে। কেন যে মাধুরী মেসে আসে না মহীনও জানে না। এমন কি মাসখানে হতে মাধুরী দুটো শনিবার মহীনের সঙ্গে দেখাই করলো না। হল কি ওর? মহীন চিন্তিত হচ্ছে, কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করতে ওর কেমন যেন বাধে।
না আসাই ভাল মাধুরীর। মহেন্দ্র নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে ভাবলেও কিন্তু সান্ত্বনা এতে পাওয়া যায় না। মন তার অশান্ত হয়ে উঠেছে। যে একটি মাত্র আশ্রয়কে অবলম্বন করে মহেন্দ্র এই বিশাল নগরীর বুকে ভেসে বেড়ায় সে নৌকা বুঝি ঘাটে বাহির হয়ে গেল। যাক মাধুরী ভাল হোক, সে রাজরানী হোক মহেন্দ্র নিজেকে সংযম করতে চাইল, নিজের অন্তরকে তিরস্কার করলো নিজের আত্মাকে ধিক্কার দিল তারপর খোকনের কথা ভেবে আপনাকে। আত্মস্থ করলো।
একবার বাড়ি যাওয়া উচিত। অনেকদিন এসেছে বাড়ি থেকে। কিন্তু ছুটি পাওয়া কঠিন। কারণ চাকরীতে খুব বেশি দিন ঢোকেনি সে। সামনে চৈত্র সংক্রান্তি পয়লা বৈশাখে ছুটি আছে ক’দিন আর একটা রবিবার ঐ সঙ্গে। মহেন্দ্র বাড়ি ঘুরে আসবে। বড়বাবুকে বললো কথাটা আনন্দ সম্মতি দিলেন। অতঃপর একবার মাধুরীকে এবং তাদের বাড়ির লোককে বলা উচিত কিন্তু বলবে কি করে? অথচ ভেবে দেখলো ফোন করে, অথবা অফিসে ফিরতে ওখানে গিয়ে বলে আসতে কোনই বাধা নাই, তবুও মহেন্দ্র কিছু করতে পারল না। এই সঙ্কোচ এই শঙ্কা ওকে আরও সঙ্কুচিত করে তুলেছে? দূরে হোক? কিই বা দরকার ওদের জানাবার? বড়লোক বড়লোকের মতই থাকে মহেন্দ্রের সঙ্গে ওদের কতটুকু যোগ। যে মাধুরী প্রতি সপ্তাহে আসতো, এসে ঘর ঝাট দিত পর্যন্ত সে আজ কিনা বিশ পঁচিশ দিন আসেনি এতেই বুঝা যায়, কিছু একটা ঘটেছে। ওর এখানে আসার সম্বন্ধে হয়তো কোন কথা উঠেছে কিংবা কোন অপমান–কথাটা ভেবে শেষ করতে পারলো না মহেন্দ্র। ফোন করে আর ওদের বিড়ম্বিত করবে না সে, বিপন্ন করবে না মাধুরীকে। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে মাধুরী কাটতে চায় তার সংসর্গ। ভাতগুলো খেয়ে মহেন্দ্র অফিসে বেরুলো। ট্রামে সে যায় না পয়সা বাঁচায়–হেঁটেই চলছে। খাওয়ার পরই এই পরিশ্রম ওকে কাতর করে, কিন্তু পয়সা খরচ করতে ওর ইচ্ছে হয় না। মনে হয়, একটা পয়সার জন্য তার খোকন কেঁদেছে দু’পয়সার বাঁশি মহীন তাকে কিনে দিতে পারেনি।
অফিসে কাজ করছে অকস্মাৎ টেলিফোন ডাক। মহীন গিয়ে শুনলো বড়দা বলছে।
–আজ সন্ধ্যায় এখানে এসো মহীন মাধুরীকে দেখতে আসবেন রামপুরের জমিদার। বাবার চেনা বন্ধুর ছেলেটি ভাল। শুনলাম ডাক্তারী পড়বার জন্যে বিদেশে যাবে।
–বেশ তো যাব। মহেন্দ্র বললো সাতটা নাগাদ পৌঁছাব আমি। বড়দা ফোন ছেড়ে দেবার পর মহেন্দ্র ভাবলো, এই তো মাধুরীর যোগ্য বর জমিদার ছেলে সুন্দর, শিক্ষিত, অভিজাত খুব ভাল হবে। যাক বাঁচা গেল–মহেন্দ্র সম্বন্ধে কোন খারাপ কিছু ও বাড়িতে আলোচনা হয়নি তাহলে। মহেন্দ্র ওখানে তেমনি আপনজন হয়েই আছে প্রমাণ বড়দার আজকেই এই আহ্বান। আনন্দ হচ্ছে মহীনের, মাধুরীর বিয়ে হবে যেন তার ছোট বোনের বিয়ে। খুব ভাল। মনের আনাচে কানাচে কোথাও কোন মেঘ নাই তো, অন্তরে নিলাকাশ জুড়ে মাধুরীর জন্য আশিসধারা ঝরেছে। মহেন্দ্র আনন্দিত হল পরিতৃপ্ত হল। আবার ফোন, মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোন ধরে শুনলো, বড়বৌদি কথা বলছেন। শোন মহীন, তোমার বড়দার ভুলো মন। যে কথাটা বলার জন্যে তোমার ডাকা, সেইটিই উনি বলেননি। মাধুরীকে নিয়ে আসতে হবে তোমার।
কোত্থেকে? মহেন্দ্র অতি বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো সে কোথায় গেল বৌদি?
ওমা? তুমি জান না? সে পরীক্ষার পড়ার জন্যে হোষ্টেলে গিয়ে সিট নিয়েছে, আমহাষ্ট্রস্ট্রীটের ছাত্রী নিকেতন থাকে। পরীক্ষা হয়ে গেছে, তবু মেয়ের বাড়ি ফেরার নামটি নেই। বিয়ের কথা শুনলে আসবেই না তুমি ভাইটি কোনো কিছু বলে ভুলিয়ে বাড়ি নিয়ে এস ছটার মধ্যে বুঝলে। হ্যাঁ বৌদি আচ্ছা বলে মহেন্দ্র কথা শেষ করলো।
কিন্তু চিন্তার আকুল সমুদ্রে ভাসছে সে, একি ব্যাপার মাধুরীর কেন সে হোস্টেলে এল, আর মহেন্দ্রকে জানালো না কেন আমহাষ্ট্রস্ট্রীটের ছাত্রী নিকেতন মহেন্দ্রের মেস থেকে আট দশ মিনিটের পথ অথচ একদিনও মাধুরী এল না মহেন্দ্রের বাসায়। মেয়েটা সত্যিই অদ্ভুত।
কিন্তু ভেবে কিছু বোঝা যাবে না। মহেন্দ্র পাঁচটার সময় বড়বাবুকে বলে মেসে ফিরলো, কাপড় বদলে গেল, ছাত্রী নিকেতনে মাধুরীকে খবর পাঠাল।
ও, তুমি। কী খবর মহীনদা? মাধুরী এসে প্রশ্ন করলো হাসিমুখে।
তুমি এখানে কেন মাধুরী? কদিন এসছে? কেনই বা এসছো?
হোষ্টেল বাসে দুঃখের একটা বিশেষ আনন্দ আছে মহীনদা। সেটা ভোগ করতে চাইছি। হাসলো মাধুরী কথাটা বলে।
স্বেচ্ছায় দুঃখ বর্ণনা এক প্রকার বিলাসী মাধুরী, দুঃখের নির্মমতা ওতে থাকে না। ও যেন ধনীর রৌদ্রের হাতের সোনা বাঁধানো মোয়া, গহনার কাজ হয়। কঠিন তিরস্কারে মাধুরী নিভে গেল একেবারে। আধ মিনিট থেমে বললো, আর কারণ আছে মহীনদা। কিন্তু যাক সে কথা। কি খবর বল?
বাড়ি চল, বড়বৌদি কি সব রান্নাবান্না করেছেন, খেতে ডাকলেন।
অনেকদিন ভাল কিছু খাইনি, তুমি তো আর খাওয়াতে যাচ্ছা না? আচ্ছা আমি কাপড় বদলে আসি।
মিনিট কয়েক পর দু’জনে বেরুলো। মাধুরী পরেছে একখানা কালো পাড়ে সাদা শাড়ি তাতের। কানে দু’টি কুমারী মাকড়ী ছাড়া আর কোনো সোনার গহনা নাই গায়ে। হাতে কাঁচের চুড়ি। এ বেশে মাধুরীকে কোনদিন দেখিনি মহেন্দ্র। কিন্তু কিছু বললো না, ট্যাক্সি করে শ্যামবাজার পৌঁছাল।
দ্বার পালদের বেশভুষা বদলে গেছে আজ। ধোলাই কোটি পাজামা পরা বড় দারোয়ান ফেজু সিং সালাম জানালো ওদের। মাধুরী বললো–ব্যাপার কি ফৈজু। হঠাৎ বাবু হয়ে গেলি যে! দিদিরানীকে সাদি হোগি আওরহাম বাবু নাহি বনেগা? বলে হাসল ফৈজু।
মুহূর্তে ব্যাপারটা বুঝতে পারলে মাধুরী, মহেন্দ্রের পানে তাকালে অগ্নিময় দৃষ্টিতে, পর মুহূর্তেই শান্ত হাসি হেসে বললো আস্তে,
সব চক্রান্তকারীর দল, আচ্ছা। গেল ভেতরে একলাই।
মহেন্দ্র নেমে এল বসবার ঘরে। ওখানে উমেশবাবু, বড়দা, মেজদা এবং আরো কয়েকজন রয়েছেন। জমিদার মশাই এখানে আসেননি। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে পড়লেন। এসেই বললেন, সন্ধ্যালগ্নেই আমি মেয়ে দেখতে চাই, সময়টা ভাল আছে।
মেজদা গেল মাধুরীকে আনবার জন্য, কিন্তু আট দশ মিনিট অতীত হল মেজদা ফিরলো না, এদিকে জমিদার মশাই তাড়া দিচ্ছেন, সময় পার হয়ে যাবে। অতঃপর বড়দা গেল দেখতে কিন্তু আশ্চর্য বড়দাও ফিরছে না হোল কি? অবশেষে স্বয়ং উমেশবাবু মহীনকে গিয়ে দেখতে বললেন। মহীন গিয়ে দেখলো মাধুরী তার ঘরটায় খিল দিয়ে খাটে বসে আছে, চোখের জলে গড়াচ্ছে গণ্ড। বাইরে বাড়িশুদ্ধ লোক অনুনয় বিনয়, তর্জন, গর্জন করছে। মাধুরী নির্বাক। অবশেষে বললো আমি কি সং নাকি আমাকে দেখতে আসবে? আমি যাব না, যার যা ইচ্ছে করতে পারে। বলে শুয়ে পড়লো।
সং তুমি ছিলে না মাধুরী, এইবার সং সেজেছ! ভদ্রলোকদের এখানেই ডেকে আনি, দেখে যান বলে মহেন্দ্ৰ কঠিন কণ্ঠে আবার বললো, আমাদের বাড়ী শুদ্ধ সবাইকে অপমান করা বুঝলে।
আমি যদি বিয়ে না করতে চাই, মাধুরী উঠে বললো।
তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ বিয়ে দিচ্ছে না! দেখা দিলেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। তারা যখন এসেছে একবার গিয়ে দাঁড়াতে দোষ কি?
আচ্ছা চলো বলে খিল খুলে বেরিয়ে এলো মাধুরী।
কাপড় বদলে নে–বড়বৌদি বলল।
না, মাধুরী ধমক দিয়ে উঠলো শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি না।
গিয়ে প্রণাম করবি বুঝলি? মেজবৌদি বলল!
প্রণাম করার কথা তুমি শেখাবে, ভুতের মুখের রাম নাম।
বলে মাধুরী সটান চলে এল পিছনে বড়দা, মেজদা মহেন্দ্র এবং তার পিছনে বাড়ির মেয়েরা সব। মাধুরী ঘরে ঢুকে তিনজন অতিথিকেই প্রণাম করলো এবং তারপর বাবাকে। প্রণাম করে বসলো সামনে। বৃদ্ধ জমিদার দেখে বললেন।
বাঃ বেশ মেয়ে।
তোমার নাম কি মা?
মাধুরী ভট্টচার্য সহজ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, মাধুরী।
বৌদিরা অন্তরালে গুঞ্জন করলো মুখপুড়ী আর কি? মাধুরী লতা দেবী বলবি না, শুধু ভট্টাচার্য।
জমিদার মুচকি হাসছিলেন–ভাব দেখে বোঝা যায়, তার খুব পছন্দ হয়েছে মাধুরীকে। আর একবার তার আপাদমস্তক দেখে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মা, তুমি রান্না বান্না কিছু জান?
জানি।
কি জানো?
ডাল, ভা, তরকারী, শাক ভাজা, মাছ–মাংস ডিম–চা। কাটলেট, স্যাণ্ড উইচ, টোষ্ট, পান তামাক সাজা–
তামাক সাজাটাও কি তাহলে রান্নার মধ্যে পড়ে, বাঃ বেশ মা এমনি সপ্রতিভ মেয়েই চেয়েছিলাম, বলতে বলতে হাসতে লাগলেন। ঘরের সবাই হাসছে ও দিকে ভিতরেও হাসি, মাধুরী গম্ভীর মুখে। বৃদ্ধ জমিদারবাবু সস্নেহে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন—
তোমাকে আমার ঘরে যেতে হবে মা, আমার মা হতে হবে, কেমন?
না, কারুর মা বাপ হওয়া আমার চলবে না, আপনি মাপ করবেন, বলে উঠতে উঠতে আপনাকে দুঃখ দিলাম, তাই আবার মাপ চাইছি, প্রণাম হই। প্রণাম কথাটা উচ্চারণ করে উঠে পড়ুর মাধুরী এবং কোন দিকে না চেয়ে সটান ভেতরে চলে গেল।
আকস্মিকতার আঘাতে ঘরে যেন বজ্রপাত হয়ে গেছে। উমেশবাবু লজ্জিত নতমুখে বসে আছেন, এবং অন্যান্য সকলেই তদবস্থা। কিন্তু জমিদারবাবু বললেন ওরকম হয়েই থাকে আজকালকার মেয়েরা। বিয়ের নামে জ্বলে উঠে, আবার বিয়ে হলেই ঠিক হয়ে যায়। মেয়ে। আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। আপনি কবে ছেলে দেখতে যাবেন বলুন।
উমেশবাবু যেন বাচলেন, মেয়েদের স্বভাবের দোষ দিয়েই এ যাত্রা রক্ষা হলো, কিন্তু তার মেয়েকে তিনি তো জানেন, বললেন, ধীরে ধীরে, বড় মেয়ে ওর মতটা আমি নিজে একবার জেনে আপনাকে জানাবো
আমার ঐ একটি মাত্র বোন, ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা কিছু করতে পারব না কাকা বাবু মাপ করবেন, বললো বড়দা বিনীত ভাবে।
মেজদা বললো বিয়ের ভয়ে ও হোষ্টেলে পালিয়েছে, অথচ ঘরে ফিরে ওকে না দেখতে পেলে আমাদের মনে হয় সারা বাড়িটা খালি–
বিয়ে তো দিতে হবে বাবা, বললেন, জমিদারবাবু।
হ্যাঁ দিতে অনিচ্ছা নাই, কিন্তু ওর মত না হলে দিতে পারবো না, ওকে খুশি করতে আমরা তিন ভাই সর্বস্ব দিতে পারি। ওযে আমাদের কত স্নেহের ধন তা বলে বোঝানো যায় না কাকাবাবু বড়দা বললো। তা তো বটেই? মেয়েও খুব ভাল, আমার স্ত্রী ওকে দেখেছে ওদরে পিকনিক পার্টিতে তারই ইচ্ছে বৌ করে নিয়ে যাওয়া। বেশ ওর মত নাও তোমরা। জলযোগ সেরে তিনি উঠলেন। যাবার সময় আবার বললেন–
আমার ছেলেকে দেখলে ওর পছন্দ না হবার কারণ নেই। যদি মনে কর তো তার ব্যবস্থা হতে পারবে। মাকে আমার খুবই ভাল লেগেছে। ছেলের বাপ হয়েও তাই এতকথা বলছি। আমার বাড়িতে ও লক্ষীর আসন পাবে!
ওরা চলে গেলেন। এমন একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি এতটা নামলেন তিনি মাধুরীকে পুত্রবধু করবার জন্য অথচ মাধুরী যে ব্যবহারটা ওর সঙ্গে করলো, অন্য বাড়ি হলে এ রকম মেয়ের অদৃষ্টে কি যে লাঞ্ছনা হতো বলা যায় না। কিন্তু এখানে ওসব কিছু হবার যো নাই! বেরাি জানে, মাধুরীকে কিছু বললে দাদারা সহ্য করবে না। যদি কিছু বলে তো দাদারাই বলুক। মেজবৌ বড়বৌ ছোটবৌ সব বিরক্ত হয়ে গেল! দাদাও চলে গেল, বসে রইলেন উমেশবাবু একা। মহেন্দ্র ও কি করবে ভাবছে ও দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দেখতে। পেল মাধুরী এসে দাঁড়ালো তার বাবার কাছে উনি গড়গড়া টানছিলেন। মাধুরীর চোখে জল! আচলে মুছে বাবার পা তলে বসলো। পায়ে হাত দিয়ে বললো, তোমাকে বড় দুঃখ দিলাম। বাবা, কিন্তু কি করবো। কেন তোমরা আমাকে এমন অবস্থায় ফেল।
অপমানের কথা ভুলে গিয়ে উমেশবাবু ওকে কোলে নিলেন, বললেন তোকে যোগ্যপাত্র দিয়ে আমি নিশ্চিত হতে চাই মা–
আমার সম্বন্ধে চিন্তার কি আছে বাবা, আমাকে কেন এত দুর্বল মনে করছ? আমি নিজের ভার নিজেই সইতে যথেষ্ট সক্ষম। বিয়ে ছাড়া কি মানুষ বাঁচে না বাবা। পৃথিবীতে কুমারী মেয়ে বিস্তর রয়েছে–
আচ্ছা মা তোকে বিয়ে দেবার চেষ্টা আর করবো না থাক, তোর যেমন ইচ্ছে থাক। বলে মাধুরীর চোখ মুছে দিলেন তিনি।
তুমি খুব ভাল ছেলে বাবা বলে হাসলো মাধুরী। অম্লান হাসিয়া বললো আমার বিয়ের খরচের টাকা গুলো আমাকে দিয়ে দাও। আমি ঐ টাকায় দমদমার বাগানে একটা গোশালা করি
গোশালায় কি হবে রে, হাসলেন উমেশবাবু।
দুধ হবে, ঘি হবে, মাখন হবে, দেশের ছেলেরা খাবে আর আমিও পয়সা পাব। গরীবদের দুধ মাখন বিলাবো। মা যশোদা হয়ে যাব বাবা।
কিন্তু গরু পোশা বড় ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার মা, ওসব চাষ শিখতে হয়।
আচ্ছা বাবা তাহলে ফুলের চাষ করবো ওখানে, তাও যদি না চাও তো কচুর চাষ– কচু, বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠলো উমেশবাবুর।
হ্যাঁ বাবা, কচু খুব ভাল জিনিস, কালি কচু, ধলি কচু–সার মান কচু, জল কচু, কলম কচু।
ওতে কি রোজগার হবে–
রোজগারের জন্যে তো আমি যাচ্ছি না বাবা, আমি দেখিয়ে দিতে চাই যে মানুষ মেয়ে হোক বা ছেলে হোক, কীটপতঙ্গ নিয়ে তাদের খুঁটিনাটি খুঁজেও হাজার বছর কেটে যায় বাবা, নেশা খুব ভাল নেশা, যাকে বলে সাধনা। মাধুরী যেন তার বাবাকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে।
বাবা বললেন, আচ্ছা তোর যা ইচ্ছা করিস, বলে আবার হাসলেন তিনি। অতঃপর আর কোন কথা না বলে মাধুরী বেরিয়ে গেল ওখান থেকে। মহেন্দ্রও অন্য দরজা দিয়ে এল ভিতরে। বৌদিরা মাধুরীর উপর রেগে আছে, কিন্তু মাধুরী ওদের গ্রাহ্যই করে না। সটান এসে বললো বড়বৌদিকে, খেতে দাও কিছু, আর শোন, হোষ্টেল থেকে বাড়ি ফিরে আসবো কাল। পরশু থেকে দমদমার বাগানে তপস্যা আরম্ভ করবো।
তপস্যা! কিসের তপস্যা ছোটদি। বড়বৌদি হাসলো।
প্রজাপতিরা কেমন করে ঘর বাধে, কি খায়, কতদিন বাঁচে, তার হিসেব রাখার তপস্যা, বুঝলে?
ভাই, ও জেনে কি হবে? ওরা সৃষ্টির সুন্দর জীবন ওদের জানলে চিরসুন্দরকে জানা যায়, আর এক পিস পুডিং দাও, ব্যস, বড়দাকে বলো কাল এসে দেখা করবো। চলো মহীনদা আমার পৌঁছে দাও, বলে উঠলো মাধুরী।
আগে পতি, তারপর প্রজা হয়, জানিস। বড়বৌদি বললো।
ওটা তোমার জন্যে, আমার জন্যে শুধুই প্রজা, আমি স্বয়ং তাদের পত। চলো মহীনদা
মহেন্দ্র ওকে নিয়ে বাড়ির গাড়িতেই চললো। রাস্তায় কোন কথা হল না, নামবার সময় মাধুরী বললো, সোনায় বাঁধা মোয়া আমি পারলাম না মহীনদা।
লোহার শেকল বড্ড ভারী হয় মাধুরী।
হোক, আমি বইতে পারবো, চলে যাচ্ছে মাধুরী, মহেন্দ্র বললো আবার ঐ শেকল তোমার গলায় ফুলের মালা হয়ে উঠুক।
চণ্ডীপুরে মেলা হয় চৈত্র সংক্রান্তির সময়, খোকনের উৎসাহের অন্ত নাই, সবার বড় কথা কাকু আসবে।
কাকু আসবে আর সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গেল। মাকে বললো
আজ তো সোমবার মা কাকু তাহলে কবে আসবে?
পরশু বুধবারে সকালেই এসে যাবে তোর কাকু।
অতঃপর ভাতগুলো গিলে স্কুলে চলে গেল। পাঠ্য মুখস্ত করছে দিন রাত কোথাও যেন ভুল না হয়। বড় পাঠ বৃষকেতুর অভিনয়। খোকন দর্শকদের কাঁদিয়ে ছেড়ে দেবে। কাকু এলে আরও ভাল করে শিখে নিতে হবে।
কিন্তু পরশুর এখনো অনেক দেরি আর সেদিনই তো যাত্রা হবে, তাহলে শিখবে কখন? তারপর সং আছে, তাতেও খোকনের অংশটা আছে একটা। সং এ ওকে ‘বর’ করা হবে, কনের বয়স চল্লিস, খোকন তার কোলে চেপে বিয়ে করবে ইত্যাদির কথা ভাবছে খোকন।
পরশু এসে পড়লো, এবার কাকু এলেই হয়, অবশেষে কাকুও এল, কিন্তু খোকন এখানে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছে না। এই কয় মাসে খোকন যেন অনেকটা বড় হয়ে উঠেছে, কোলে চাপা কি আজ ঠিক হবে কিন্তু কাকু ধরেই কোলে নিল, এবং ঠিক তেমনি আদর করতে লাগলো, অতএব খোকন বড় হয়নি।
কলকাকলি ছুটিয়ে দিল কাকুর সঙ্গে। ঘন্টাখানেক বিরামহীন বাক্যশ্রোত, কত যে বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করলে তার লেখার যোগ্য নেই। অবশেষে অর্পণা বললো এবার ছাড় দেখি কাকুকে, জলটল খেতে দেই
হ্যাঁ মা দাও না তুমি জল খেতে–কোলে চড়েই বললো খোকন। খোকনকে সঙ্গে নিয়ে জলযোগ করলো মহীন, তারপর ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরুলো পাড়ায়। গ্রামের সকলেই খবর নিল ওর কাজকর্ম কেমন, মাইনে কত উন্নতির আশা কতখানি আছে ইত্যাদি। কয়েকমাস পরে গ্রামখানা যেন কেমন নতুন লাগছে, কিন্তু ঐ সঙ্গে একটা বিশেষ ব্যাপার মনে পড়ছে, যার নিরা করণ মহেন্দ্র করতে পারলো না। ব্যাপার এই–দিন চার পাঁচ আগে মহেন্দ্র শ্যামবাজারে গিয়ে বললো যে সে একেবারে বাড়ি যাবে। উমেশবাবু সপরিবারে বাইরে। যাবেন গ্রীষ্মটা কাটাতে মাধুরীও যাবে। অকস্মাৎ মাধুরী বললো–মহীনদার সঙ্গে ওদের বাড়ি ঘুরে আসি না বাবা।
তা কি করে হবে মা, ওতো কয়েক দিন পরেই ফিরবে, তুই থাকবি কোথায়। কলকাতায় তো কেউ থাকবে না?
ফেরার পথে মহীনদা আমায় পৌঁছে দিয়ে আসবে তোমার কাছে।
হ্যাঁ, তা হতে পারে উমেশবাবু বললেন। কিন্তু মহীনের আপত্তির যথেষ্ট কারণ ছিল। গরীবের বাড়িতে এই ধনীকন্যার সম্মান হয়তো ক্ষুণ্ণ হবে। পল্লীর আচার ব্যবস্থা সম্বন্ধে মাধুরীর কোন ধারণা নেই। তারপর এতবড় অবিবাহিতা মেয়ে দেখে লোকে হয়তো ওর সম্মুখেই কিছু খারাপ কথা বলে ফেলতে পারে–মহেন্দ্র এই সব কথা ভাবছে। মাধুরী ওর পানে চেয়ে বললো তোমার বোধহয় নিয়ে যাবার ইচ্ছা নেই, না মহীনদা? অনিচ্ছার কথা নয় তুমি সেখানে থাকতে পারবে কিনা ভাবছিলাম। আচ্ছা সে আমি বুঝবো বলে মাধুরী আবার বলল, বাড়িতে খবর দিও না। হঠাৎ গিয়ে পৌঁছাব বলে চলে গেল।
একই সঙ্গে হাওড়া এল সব। উমেশবাবু সাতটা দশের ট্রেনে উঠেছেন। আর আটটা ছত্রিশের ট্রেনে মহেন্দ্র মাধুরী ছাড়বে। উমেশবাবু এবং অন্য সবাই গাড়িতে উঠলেন মাধুরী ও উঠলো। মহেন্দ্র দেখে প্রশ্ন করলো
ও কি? তুমি উঠছ যে আমাদের বাড়ি যাবে না?
কৈ আর গেলাম–বাবাকে একলা ছেড়ে দিতে ভরসা হচ্ছে না।
একলা কোথায় মাধুরী–সবাই তো যাবেন ওর সঙ্গে?
তা হোক আমি না থাকলে বাবা বড় অসহায় হয়ে পড়েন, তাছাড়া তোমার বাড়ি দেখা : পালিয়ে যাচ্ছে না, পরে গেলেই হবে।
ট্রেন ছেড়ে দিল–যেন পশ্চিম দেশটাই পালিয়ে যাচ্ছে, এমনি ভাবে মাধুরীও। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে ভাবলো মহেন্দ্র, তারপর নিজেই ট্রেনে উঠলো এসে। মাধুরী না আসায় ওর অনেক চিন্তার অবসান ঘটেছে কিন্তু কেন মাধুরী আসবে বলে এল না এইটা মহাচিন্তার ব্যাপার। কিন্তু এ নিয়ে কারো সঙ্গে কিছু আলোচনা করা চলে না। আপনার অন্তরেই মাধুরীর কথা গোপন রেখে মহেন্দ্র হুল্লোড় করে কাটিয়ে দিল। চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব, খোকনের অভিনয় এবং মহেন্দ্রের সেতার বাদ্য সব মিলে বাড়িটা বেশ গমগম হয়ে রইল এই কটা দিন।
যথাকালে মহেন্দ্র আবার যাত্রা করলো কলকাতায়। মেসে এলে একটা ঘরে শুয়ে ভাবতে লাগলো, মাধুরী কলকাতায় নেই, শনিবার কেউ আর গাড়ি নিয়ে এসে ডাকবে না, চলো মহীনদা। পরদিন মহীন একখানা চিঠি পেল মাধুরী লিখেছে।
শ্রীচরণেষু মহীনদা, তুমি আমায় নেহাৎ দায়ে পড়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলে। এতবড় ধিঙ্গি মেয়েকে নিতে তোমার ইচ্ছে ছিল না। লোকে হয়তো খারাপ কিছু ভাবতে পারে এই কথা তুমি ভাবছিলে তাই গেলাম না। বড়লোকে প্রণাম করতে যদি সময় সুযোগ কখনো হয় তো যাব। প্রণাম জেনো, মাধুরী।
কথাগুলোতে একটা তীক্ষ্ণ সত্য রয়েছে। মহেন্দ্র চিটিখানা পড়ে জবাব লিখে দিল– মাধুরীর বুদ্ধি তাকে ঠিক পথেই চালিত করেছে।
মেসের লোক কিন্তু বড় নিরাশ হয় শনিবার দিন। বরাবর প্রশ্ন করে, এখনো তিনি কলকাতায় ফেরেন নি? না, দেরী আছে ফিরতে বলে মহেন্দ্র হেসে চলে যায়। মাধুরী না আসায় মহেন্দ্রের চেয়ে এদের দুঃখই যেন বেশি হয়ে উঠেছে, অমনি ভাব। মাধুরীর পরবর্তী পত্র এল। সে লিখেছে
দেশে ইনফেকশান চলছে, কিন্তু মানুষের এত দৈন্য যে, দেখা যায় না। ভাত নাই, কাপড় নাই, কচি ছেলের দুধ নাই, কি আছে মহীনদা জানো? আছে ভাষণ, আছে ভেজাল, আছে ভন্ডামী।
মহেন্দ্র পড়ে একটু হাসলো, তারপর বেরিয়ে গেল অফিসে। মাধুরীদের ফেরার সময় হয়েছে, এবার হঠাৎ একদিন সে এসে পড়বে মেসের দরজায় কিন্তু দিন পার হয়ে যাচ্ছে, মাধুরী ফিরছেই না। শুনলো সে নাকি মেজদার সঙ্গে বোম্বাই গেছে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে। তারপর শুনলো মালয়ে গেছে সে মেজবৌদির সঙ্গে–এরপর হয়তো শুনবে আমেরিকায় গেছে মাধুরী।
মহেন্দ্র গভীর নিশীথে সেতারটা কোলে নিয়ে বসে ভাবে কতদূর আজ সেতারের অধিকারিণী। বর্ষার আকাশ আর্দ্র করে মহেন্দ্র কণ্ঠ থেকে করুণ রাগিণী ঝঙ্কার তোলে সে। কথা কি গেছে ভুলে?
নিস্তব্ধ নিশীতে মহেন্দ্র সেদিন অনুভব করলো মাধুরীকে লাভ করবার যোগ্যতা তার থাকলেও ক্ষতি ছিল না, কিন্তু একটা অন্তরায় রয়েছে, যাকে অতিক্রম করা অসাধ্য। পাংশু মখে কথাটা চিন্তা করতে করতে মহেন্দ্রের চোখ ফেটে জল পড়তে লাগলো। কিন্তু মানুষের অন্তর চিরদিন আশাকে আশ্রয় করে। মহেন্দ্রও করলো।
সকালেই ডাকল দরজায়, মাধুরীর মধুর কণ্ঠ, মহীনদা। দরজা খুলে বেরিয়ে এল মহীন। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দরী সম্মুখে।
কত কথা তোমার সঙ্গে আছে আমার মহীনদা, বলতে বলতে ঘরে ঢুকে বসলো মাধুরী একটা চেয়ারে। মহেন্দ্র মুখ হাত ধুয়ে বাইরে গেল। ফিরে দেখলে মাধুরী গরম জলে চা ছেড়ে রুটিতে মাখন লাগাচ্ছে। মহেন্দ্র ঘরে ঢুকতেই ওর পানে চেয়ে মাধুরী প্রশ্ন করলো তোমায় যেন কিছু শুকনো দেখাচ্ছে মহীনদা, শরীর ভাল?
হ্যাঁ, যথাপূর্ব। বলো তোমার কি অনেক কথা–
মাধুরী চা তৈরী করতে আরম্ভ করলো, বোম্বাই, সিংহল এবং মালয় ভ্রমণ কাহিনী। খুব ধীরে বসিয়ে বলছে চা খেতে খেতে শুনছে মহীন। অকস্মাৎ মাধুরী কথা থামিয়ে বললো।
দেশ দেখার আনন্দ তোমাকে জানাতে আসিনি মহীনদা, নিজেকে খুঁজে বেড়াবার দুঃখটা জানতে চাইছি–
নিজেকে খুঁজেতে তো দেশে দেশে ঘুরতে হয় না মাধুরী, নিজের মধ্যেই খুঁজতে হয়।
না, নিজের মধ্যে নিজেকে খোজা অধ্যাত্মসাধনা, সেটা আত্মকেন্দ্রিক, আর বিশ্বের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করা বিশ্বকেন্দ্রিক, সেটা প্রেমের সাধনা মহীনদা।
মহীন কিছু বললো না, মাধুরীর মুখপানে তাকিয়ে রইল। মাধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে তার নিজের কথাটা ভাবলো তারপর বললো আবার
মানুষকে দেখলাম বহু দেশে বহু অবস্থায় থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীলতা সব ঐ একটা বস্তুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে আমার মনে হয়, বিশ্বে যা কিছু উপজীব্য একমাত্র প্রেম। তুমি একদিন বলেছিলে তোমার ক্ষেত্রে অনন্তের চারণভূমি তখন এটা বুঝিনি। মহেন্দ্র এবারও কিছু বললো না, চা খাওয়া শেষ করলো। মাধুরী বললো, আজ রবিবার তোমার ছুটি, বিকালে যাবে ওখানে। আজ বড়বৌদির খোকার জন্মদিন, একটা খেলনা নিয়ে যেও। উঠলো মাধুরী, তোমার হয়তো খেয়াল হবে না বলে খেলনার কথাটা জানিয়ে দিলাম। যাচ্ছি। চলে যাচ্ছে মাধুরী।
ওখানে বড় বড় লোক আসবেন, কত কি দেবেন, তার মাঝে আমার চার পয়সার ভেপু মানাবে মাধুরী। আমি খালি হাতেই যাব।
না, মাধুরী ধমক দিল চার পয়সাও খরচ করতে হবে না, একটা আর্শীবাদ ছড়া লিখে নিয়ে যেও চলে গেল মাধুরী।
মহেন্দ্র ভাবতে লাগলো। না, খালি হাতে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু কি সে নিয়ে যাবে? অবশেষে একটা ছড়াই লিখলো। ছেলেটার ডাক নাম বাদল। বর্ষার দিনে ওর জন্ম তাই এই নাম। মহেন্দ্র লিখলো–
বাদল যখন আসে লুটিয়ে পড়ে ভাসে
গাছের পাতায় গড়িয়ে পড়ে ফুলের বুকে হাসে।
বাদল এলে মাদল বাজে মেঘের আঙিনায়
খালের জলে, বিলের জলে, একটি হয়ে যায়,
আমার কাছে, তোমার কাছে কোথাও কিছু ফাঁকা না আছে
সকল জুড়ে থাকে বাদল সকল জানার পাশে।
এই দুনিয়ায় বাদলকে তাই সবাই ভালবাসে।
ছড়াটা লিখে ভাবতে লাগলো মহেন্দ্র, বেপথু মধুর মত অন্তরটা তার কে জানে কি বলবে এ ছড়া দেখে। হয়তো ভালো হলো না, হয়তো হাস্যকর হবে ব্যাপারটা! কিন্তু আর কোন উপায় নাই, একখানা লাল রং এর পুরু কাগজে মহেন্দ্র লিখলো শ্রীমান বাদল পঞ্চম জন্মদিন, তার পরিস্কার গোটা গোটা অক্ষরে ছড়াটা লিখে দিল, আর্শীবাদ মহীন কাকা। অতঃপর রওনা হোল সন্ধ্যার সময়। এই কাগজটাই সে উপহার দেবে বাদলকে। সামনেই মাধুরী। বললো দেখি কি এনেছ বাদলের জন্য।
মহেন্দ্র ভয়ে ভয়ে গোটানো কাগজটা দিল তার হাতে। মাধুরী ওটা নিয়েই চলে গেল, মহীন এল বসবার ঘরে। মাধুরী নিজের ঘরে গিয়ে কাগজটা খুলে পড়লো, বেশ বড় কাগজখানা ওর পাশে তুলে দিয়ে একটা পদ্মকুড়ি এঁকে দিল আর তার পাশে আঠা এঁটে দিল বাদলের একখানা ছোট ফটো। তারপর বড় একখানা ফটো ফ্রেমের মধ্যে ভাল খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ালো। এখন ওটা বাঁধানো হয়ে গেছে দেখার মত বস্তু হয়েছে।
এত বড় বাড়িতে ছেলে ঐ একটিই, কাজেই উৎসবটা খুব জোরালো হচ্ছে। বিস্তর অতিথি আসতে লাগলেন আশীর্বাদ করতে। তাদের উপহারের মধ্যে প্লাস্টিকের খেলনা থেকে প্যারাম্বুলেটার পর্যন্ত আছে, খেলনার শেয়াল কুকুর থেকে সোনার গয়না পর্যন্ত সব সাজিয়ে রাখা হচ্ছে একটা টেবিলে।
মহেন্দ্রের হাতে কোন ফাঁকে মাধুরী কাগজ জড়ানো ফটো ফ্রেমটা দিয়ে বলল, দাও এটা বাদলের হাতে–
কি এটা?
অত খবরে কাজ কি? দাও গিয়ে যাও–
মহেন্দ্র নিশ্চয় জানে মাধুরী তাকে বিপন্ন করবে না। এতখানি বিশ্বাস আর কাউকে করতে পারে না এখানে। নিঃশব্দে নিল জিনিসটা? গিন্নীর স্বয়ং কোলে নিয়েছিলেন বাদলকে। কাগজ খুলে দেখলেন ঝকঝকে একটা ফ্রেম আর তার মধ্যে কি যেন লেখা হাসিমুখে রেখে দিলেন। ধানদুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ সেরে মহেন্দ্র এসে বসলো একধারে।
কত রকমের কত উপহার এসেছে কিন্তু মহেন্দ্রের উপহারে অভিনবত্ব অবাক করে দিয়েছে সকলকে। বড়বৌদি স্বয়ং দেখে অত্যন্ত খুশী হোল বড়দাও আনন্দিত একবারে। সামনেই ওটা রেখে দেওয়া হয়েছে। বাদলের মামা বরুণবাবু ওটা তুলে নিয়ে পড়লো জোরে। বললো, তুমি চমৎকার লেখ তো মহীন?
কবিতা এমন একটা জিনিস যা বাজারে কেনা যায় না। এত লোকদের এত মূল্যবান উপহার মলিন হয়ে গেল, এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মহেন্দ্রকে। কিন্তু ভেবে লাভ নাই মহেন্দ্র তৃণখন্ডবৎ উড়ে চলে যাবে নিয়তির নিষ্ঠুর পান্থশালায়।
সুন্দর কবিতা হয়েছে ঠাকুরপো, বড়বৌদি বললো হেসে। খাওয়ার পর তোমাকে একটা কথা বলবো শুনে যেও। চলে গেল বড়বৌদি। নানা কাজে ব্যস্ত রয়েছে। কিন্তু কি বলবে কথা, যদি কিছু বলবার থাকে তো এক্ষুনি বললেই হোত। মহেন্দ্র মহা উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে গিয়ে ভাল করে খেতেই পারলো না। কিন্তু বড়বৌদি খারাপ কিছু বলবে না নিশ্চয়।
তবু মহেন্দ্র দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে রইল, শুধু দুশ্চিন্তা নয় একটু আতঙ্কিত খাওয়া হলো, অতিথিরা সব বিদায় গ্রহণ করেছেন, বড়বৌদি তখনও কাজে ব্যস্ত। অবশেষে এসে বললো–
এতক্ষণে ফুরসৎ পেলাম ভাই—
তাহলে কথাটা এবার বলুন বৌদি।
হ্যাঁ, মাধুরীকে তোমার কেমন লাগে মহীন? হাসছে বড়বৌদি।
কিন্তু মহেন্দ্র ভয় পেয়ে গেল রীতিমত। এ রকম প্রশ্ন করার অর্থ কি? মহীন কি কোন রকম অবিশ্বাস ভাজন হয়েছে। কিন্তু চুপ করে থাকা চলে না, বললো কেন, বৌদি, হঠাৎ এ প্রশ্ন করলেন।
করলাম, আমার মনে হয় ঠাকুরপো, মাধুরী তোমাকে ভালবাসে
ভালবাসে? আমায়?
হ্যাঁগো মশাই তোমায়, বলে আবার হাসলো বড়বৌদি, আর যতটা বুঝেছি তুমিও ভালবাস তাকে।
না, বৌদি একি আপনি বলছেন, আমি তার কোনো রকমে যোগ্য নই–যোগ্য কিনা সেটা আমরা বুঝবো, মাধুরীকে আমরা সুখী করতে চাই মহীন।
হ্যাঁ নিশ্চয় আমিও চাই সে রাণী হোক—
রাণী হলেও সুখী হয় না বোকারাম। তুমি কবি তোমাকে এর চেয়ে কি বোঝাব! ওকে আর আমরা সুতো ছেঁড়া লাটাইয়ের মত ঘুরতে দেব না। মহীন লাটাই এ বেঁধে দেবো।
সুতো ছেঁড়া ঘুড়ি–
না তো কি। বোম্বাই, সিংহল কোয়েম্বাটোরে, এত কি কাজ। তোমার বাড়ি না যেতে পারার অভিমান জানো। হাসলো বৌদি, বললো রাত হোল যাও। তোমার কবিতাটা আমার বড় ভাল লেগেছে। টাকা দিয়ে তুমি হাতি কিনে আনলেও আমরা খুশী হতাম না।
চলে গেল বড়বৌদি মহেন্দ্ৰ নতমুখে বসেছিল। কিন্তু আর বসে থাকা চলে না। ট্রাম বাস বন্ধ হয়ে যাবে তার।
উঠে রাস্তায় এসে মহেন্দ্র একখানা রিক্সা ভাড় করলো। নিশ্চুপ বসে যেতে পারবে– আপনার মনকে অনুভব করবে উপভোগ করবে। আনন্দ দেহের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে ওর অন্তরকে আরক্ত করে তুলেছে, কিন্তু মহেন্দ্র চিন্তাশীল ব্যক্তি। সে ভাবলো যে সহজ সত্যকে সে এতকাল স্বীকার করতে চায়নি অন্তস্থলে তলিয়ে দিয়েছে আজ যেন সেই সত্যটা অপরের দুঃখের ভাষা পেয়ে তাকে আদালতে দাঁড় করিয়ে শুধু স্বীকৃতির স্বাক্ষরই নিল না, টিপসই পর্যন্ত আদায় করে নিল কিন্তু মহীন সত্যকে অস্বীকার করে লাভ কি? চেয়ে চেয়ে দেখলো অন্তরের পরতে কখন মাধুরীর ছবি আঁকা হয়ে গেছে, এ ছাড়া কিছুই নাই আর দেখতে পাচ্ছে না মহেন্দ্র। মনটা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সারা অঙ্গ ওর একি অন্তঃসলিল। প্রেমবন্যা, একি আন্তর্দাহী প্রেমবহ্নি?
কখন যে গোলদীঘির মোড়ে এসে পৌঁছেছে মহীন, কোন পথে কেমন করে কিছুই খেয়াল নেই। রিক্সাওয়ালা ডাক দিল বললো–
বহুত শাস্তি হো গিয়া বাবু এত্যা মাৎ পিজিয়ে!
কিয়া মাৎ পিয়েগা? মহেন্দ্র বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো।
দারু আউর ক্যা। আর রাস্তা তো বাৎলাইয়ে, কিধার যায়েগা।
মহেন্দ্ৰ কিছুমাত্র প্রতিবাদ করলো না, ওকে মাতাল বলার জন্য ঐখানেই নেমে পয়সা ক গন্ডা দিয়ে বাকী পথটুকু হেঁটে এল ভাবতে ভাবতে, সে সত্যি যেন একটা অসাধারণ মদ খেয়েছে যার নেশা ওকে এজন্মে শুধু নয় বহু জন্ম মাতাল করে রাখবে।
মেসে এসে আলো না জ্বেলেই বিছানায় শুয়ে পড়লো মহীন। আশ্চর্য যে কথা নিজেই সে ভাল করে জানেনি সেই কথা বাইরেও প্রকাশ হয়ে গেল বিশ্বে আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। তার অন্তরের গোপন চাঁদ। কিন্তু মহেন্দ্র তা জানতে চায় না। কোথাও কাউকে সে বলেনি মাধুরীর কথা– বাড়িতে কে কে আছেন মহীন?
কর্তা গিন্নী তিন ছেলে বৌ আর কুমারী মেয়ে পড়ে কলেজে।
এর বেশী মহেন্দ্র আর কিছু বলেনি বৌদিকে! মাধুরীর নামটা পর্যন্ত নয় কারণ মাধুরীর স্নেহ সহানুভূতি মাখা অন্তরটা সে বৌদির অন্তরে সঞ্চারিত চায়নি। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখাতে চায় না কাউকে। কিন্তু একি সত্য হবার। একি সত্যি হবে। এই স্বপ্ন এই অলীক কল্পনা! না, সত্য কাজ নেই এ স্বপ্নেই থাক কারণ– মহেন্দ্র আর ভাবতে পারলো না।
সকালে স্নানাহার সেরে অফিসে গেলো মহেন্দ্র এবং এমনি সপ্তাহটা কেটে গেল, মাধুরী খোঁজ নিল না, বড়বৌদি ওকেও ফোন করে বললো না। কী এক অবস্বাদের হীনতা ওকে আচ্ছন্ন করে প্রতি মুহূর্তে।
কি সে? জানে না মহেন্দ্র! কি আতঙ্ক কি এক অবস্বাদ না না কি এক অনিবার্যতার ভয়াবহ পরিণাম ওকে শৃংখল, কিন্তু মহীন আর বেশী ভাবতে ভয় পেল নিদারুণ আতঙ্কে চমকে উঠলো মহীন।
ব্যাপার কি মহীনদা? আজ সাতদিন একেবারে ডুব দিয়েছ, মাধুরী বললো এসে।
লুকোবার ঐটা ভাল জায়গা মাধুরী।
পিছনে যদি মাছরাঙা থাকে তো ডুবেও নিস্তার নেই জানো? বসে পড়লো মাধুরী চেয়ারে!
মাছরাঙা আকাশের জীব বলে জলে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না। তার খাদ্যের জন্যে একটা মাছ পালালে আর একটা মাছ সে ধরতে চেষ্টা করবে জলে ডুবে মরবে কেন?
কেন এমন কথা বলছে মহীনদা–মাধুরীর চোখে সীমাহীন বেদনার পাবার উথলে উঠলো মাছরাঙাদের পেশা বুঝি একটা না পেলে আরেকটা ধরা। খেয়ে তাদের বাঁচতে হয়, মাধুরী মহেন্দ্র অতি অল্প কথায় উত্তর দিল।
মাধুরীর চোখের করুণা দেখে দু’জনেই চুপচাপ। তারপর মহেন্দ্র আবার বললো চা খাবে মাধুরী?
না, চলো বাইরে গিয়ে খাব, অকস্মাৎ বললো, তুমি কি আমাকে মাছরাঙা মনে কর মহীনদা?
তুমি নিজেই মাছরাঙার উপমা দিয়েছ মাধুরী আমি নই।
হ্যাঁ কিন্তু শোন।
থাক মাধুরী, কথার কথা গেঁথে লাভ কি।
লাভ, কাব্য হয়।
হ্যাঁ কিন্তু কাব্য জীবন নয়। জীবন থেকে কাব্য জন্মায়, কাব্য থেকে জীবন জন্মায় না। কবিতা জীবনে ভোজ্য জীবন তো কবিতার ভোজ্য নয় মাধুরী। জীবন তপন ক্লিষ্ট ঋষি দুঃখ দৈন্য স্বভাব উৎপীড়নে আনন্দে অবসাদে চলে তার তপস্যা কখনও আলোতে কখনও অন্ধকারে কখনও দীর্ঘায়ুতে, কখনো ক্ষীণায়ুতে কখনো ধনীর প্রসাদে কখনো দরিদ্রের কুটিরে আপনাকে পূর্ণ করে চলে, তারপর তপোবনে শুধু হরিণ শিশুই চরেনি শাদুলি সারমেরাও বিচরণ করে চলে। কোথায় যেতে হবে?
এ প্রশ্ন কেন করলে আজ আবার মহীনদা? আমি যেখানে নিয়ে যেতে চাই, তুমি কেন সেখানে যেতে ভরসা করছ না, কেন? মাধুরীর স্পষ্ট ক্রন্দন যেন।
মাছরাঙা মাছের শক্র মাধুরী, মহীন হাসলো কথাটা বলে। কিন্তু মাধুরীর মুখ তেমনি করুণ গম্ভীর। দুজনে একটা দোকানে ঢুকে গেল, মাঝে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালো গাড়ীতে চড়ে, কিন্তু প্রয়োজনীয় কয়েকটা কথা ছাড়া আর কোন কথা হল না ওদের? অবশেষে একটা সিনেমায় গিয়ে কিছুক্ষণ কাটাল সেখানে সেই নীরবতা। অবশেষে মাধুরী বললো জোর করে যেন।
পায়ে পড়ে ফুলকে মাড়িয়ে যেও না মহীনদা।
না মাধুরী, পাশ কেটে চলে যেতে চাই
না– মাধুরীর কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। অন্ধকার ঘরের মধ্যে, চোখের দীপ্তিও। সব ফুল সব পূজায় লাগে না মাধুরী, শাস্ত্রের নিষেধ আছে।
লাগলে কি হয়? মাধুরীর মুখখানা অত্যন্ত কাছে আনলো মহেন্দ্র। অন্ধকার ঘর সুরভিত মুখমল, মহেন্দ্র অতিকষ্টে নিজেকে সংবরণ করে আস্তে আস্তে বললো পূজা ব্যর্থ হয় না, কিন্তু কথাটা মাধুরীর গলায় আটকে গেল।
অকস্মাৎ আলো জ্বলে উঠলো, শেষ হলো ছবি, মাধুরী ত্বরিত আঁচল দিয়ে চোখ ঢাকলো? কিন্তু তবু দেখতে পেয়েছে মহেন্দ্র ওর চোখে জল। স্নেহের সুকোমল স্বরে বললো।
মানুষ বড় অসহায় মাধুরী তার জীবনে মধু থেকে জল বেশী, তার বিষ মধুর মধুকেই শুধু নষ্ট করে না মৌচাকেও শত ছিদ্র করে দেয়।
মধুটা তা বলে ফেলনা নয়।
না, কিন্তু তাকে ধরবার শক্তি মৌচাকের থাকা দরকার নইলে গড়িয়ে যাবে।
গোপাল মল্লিক লেন পর্যন্ত আর কোন কথা হয়নি। কিন্তু মহীন নামবার পর মাধুরী বলেছিল, তোমার মধু গড়িয়ে যাবে না, জমে মোমের পুতুল হয়ে থাকবে।
গাড়ী চলে গেল, কিন্তু মহীন দেখছে, গাড়ীর ভিতরে ঐ মানুষ পুতুলটার চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছু বললো না মহীন নিঃশব্দে ঘরে এসে দাঁড়াল।
চোখের জল যার পড়ে তার ভাগ্য ভালো, মহীনের চোখ দুটা জ্বালা করছে, সইতে পারছে না কিন্তু চোখ বুজেও ঐ রকম অবস্থা। আকাশের তারা যে স্নেহ সজল দুটি চোখ, বাতাসের শিহরে শিহরে যেন সেই উত্তপ্ত নিঃশ্বাস, জ্যোৎস্নার ধারায় যেন সেই ব্যথা করুণ, সমর্পণ, না মহীন ঘরে টিকতে পারবে না। কোথায় যাবে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে মহীন।
আঘাত, নিষ্ঠুর আঘাত করেছে সে মাধুরীকে, অতখানা না করলেও কি হোত না? আরো হয়ত করতে যাবে আঘাত, রক্তাক্ত করে দিতে হবে ওর অন্তর, আর সেই সঙ্গে মহীনেরও সর্বাঙ্গ রক্তাপ্লুত হয়ে যাবে। কিন্তু যে আঘাত আজ হয়েছে, তাই কি যথেষ্ট নয় তার। মাধুরীর শেষের ওই কথাগুলো। মোমের পুতুল হয়ে থাকবে সে। কেন সে বললো এক
যতখানি মাধুরী আজ এসেছিল, কোন মেয়ে এতটা আসে না, কিন্তু মহীনের প্রত্যাখান কি ফিরে তাকে নিয়ে যাবে না তার আপন স্বর্ণ সিংহাসনে? ফিরে যাক মাধুরী, আপন আসনে ফিরে যাক।
মহীন কি কোনদিন মাধুরীর অন্তর জয় করবার চেষ্টা করেছে। কৈ মনে তো পড়ে না, কিন্তু এতদিনের কত কথা কাকলী কে জানে দুর্বল মুহূর্তে কি বলে ফেলেছে মহেন্দ্র। হ্যাঁ একদিন বলেছিল মহীনকে খাওয়াবার অধিকার মাধুরীর আছে, উত্তরে মহীন বলেছিল তা আছে, কিন্তু খাওয়াবার অধিকার প্রতি নারীর আছে, এ অধিকার এদের বক্ষ পীযুষের স্বাক্ষর। হ্যাঁ আর একদিন মাধুরী বলেছিল, নিজেরটাই দাবী করে আনন্দ। মহীন বিশেষ কিছু বলে নাই উত্তরে। কেন বলে নাই? বললেই হোত যে যোগ্যপাত্রে দান করতে হয়। অনেক ভুল করেছে মহেন্দ্র, অনেক অন্যায় অকর্তব্য হয়ে গেছে তার। আরো সোনায় বাধানো নোয়া নিয়ে করা মাধুরী, প্রমাণ করেছিল ওকে ওই প্রণামটা ওর আত্মসমর্পণের প্রণাম নাকি। আরো কত কথা কি ঘটনা অঘটন সংঘাত। কে জানে মহীন তাকে আকর্ষণ করছে। সজ্ঞানে যেটা করতে চায়নি, অজ্ঞাত মন সেটা করিয়ে নিয়েছে ওকে দিয়ে।
একি হোল? এটা তো মহীন কোনদিন চায়নি, মাধুরীর প্রতি তার প্রেম সে নিজেই করতে চায়নি, এতই গোপন করে রেখেছিল যে তার স্বপ্নও তাকে সজাগ করতে পারেনি এ সম্বন্ধে, অথচ বাইরে সেটা প্রকাশ হয়ে গেছে আশ্চৰ্য্য
কিন্তু ভেবে লাভ নেই। ওকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিতে হবে। হবেই, এর জন্যে মহীনের যা কিছু ক্ষতি হয় হোক, যতখানা যাবার যাক, মাধুরীকে সে কোন রকম কেরাণী বন্ধুত্বের গহ্বরে নামাতে পারবেনা শুধু তাই নয় দারিদ্রের কঠোর আঘাত নয়, অশিক্ষার আর অন্ধ সংস্কারের কারাগারে অনভ্যস্ততার কন্টকাকীর্ণ পথ আর অপচয়ের অবজ্ঞা সহ্য করে মাধুরী দুদিনও টিকতে পারবে না ওখানে। বড় বৌদি বলেছেন যোগ্যতার কথা তারা ভাববেন। কিন্তু তারা ভাবলেই মহেন্দ্র যোগ্য হয়ে যাবেনা–যাওয়া সম্ভব নয়। অনেক কারণে নয়। অন্ধ দাদা অসহায় বৌদি আর আদরের খোকনকে ছেড়ে মহেন্দ্র মাধুরীকে নিয়ে কলকাতায় সুখস্বর্গ রচনা করবে অপরের সাহায্যে এও কল্পনাতীত। কিন্তু এসব কারণ নিতান্ত গৌণ, বাইরের লোক ভাববে এগুলো। ভিতরে আরো আরো গভীরতর কারণ আছে, কিন্তু কি সে কারণ? মহেন্দ্র শিউরে উঠলো। সচকিত হয়ে উঠলো কেউ কোথাও নেই তো? না মহেন্দ্র স্থির আরো কঠোর আঘাত করবে মাধুরীকে।
কিন্তু আজ এখন কি করা যায়? শয্যায় অঙ্গ দিতে ইচ্ছে করছে না। ও শয্যা ঐ পেলব হাতের স্পর্শে লাঞ্ছিত কিন্তু এখনো যা কিছু আছে সবই তো ওর। নিরুপায় মহেন্দ্র ছাদের কার্নিশের ধারে এসে দাঁড়ালো? কেমন যেন জ্বর জ্বর বোধ হচ্ছে, জ্বর নয় মাধুরীকে আঘাত করার উত্তাপ। হাতুড়ি দিয়ে কিছুতে আঘাত করলে হাতুড়িটাও গরম হয়ে যায়–এতো তাই। কিন্তু অসহায় বোধ হচ্ছে। একি জ্বর। একি জ্বালা যন্ত্রণার তীব্রতম বহিঃপ্রকাশ। মহেন্দ্র মাথার চুলগুলো দু’হাতে আংগুল দিয়ে টেনে ধরলো। না সহ্য করা যাচ্ছে না, শুতে হবে। ছাদে কেউ হয়তো সন্ধ্যাবেলা শুয়েছিল, ছেঁড়া মাদুরখানা পড়ে রয়েছে। মহেন্দ্র এসে ওরে পড়লো সেই মাদুরে–
খোকন খোকন। আয়? মহেন্দ্র দু’হাত দিয়ে নিজের বুকখানা চেপে ধরলো। যেন তাঁর শিশু দেবতাকে আলিঙ্গন করছে, বলছে মহেন্দ্র আকাশকে লক্ষ্য করে–
এক ছিল রাজকন্যা চাঁদের মত রূপ, মেঘের মত চুল, তারা মতন চোখ ওহো না এ কার কথা বলছে মহেন্দ্র উপুড় হয়ে পড়লো ছেঁড়া সেই মাদুরটায় স্তব্ধ রাত্রি জেগে পাহারা দিচ্ছে ওকে।
চায়ের জল নিয়ে চাকর রামচন্দ্র এসে ডাক দিল সকালে ও বাবু, ওঠো, ভিজে গেছো যে, ও মহীনবাবু।
ভোরের দিকে কখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হয়েছিল, সর্বাঙ্গ ছিজে গেছে মহেন্দ্রের। চোখের জলটা বৃষ্টির জলে এক হয়ে গেছে। না এ জল কি শুধু জল? মহেন্দ্রের হৃদয় শোণিত অশ্রু হয়ে নেমেছে দুটি গণ্ডে, তার রক্তাভা এখনো লেগে রয়েছে। তাড়াতাড়ি মুখ ধুতে গেলে মহেন্দ্র ট্যাঙ্কের জলে। তারপর চা তৈরি করতে লাগলো।
আজ রবিবার অফিস ছুটি, করবে কি মহেন্দ্র সারা দিনটা? কোথায় যাবে? যাবে না কোথাও, ঘরেই বসে থাকবে, কিন্তু মাধুরী যদি আসে? না মহেন্দ্র ঘরে থাকবে না। চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লো জামা গায়ে দিয়ে।
নতুন বাস লাইন খুলেছে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত। চড়ে বসলো মহেন্দ্র। পৌঁছালো এসে দক্ষিণেশ্বরে। পরম পুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের সাধনপীট। পঞ্চবটি এলে নতজানু হয়ে প্রণাম করলো মহেন্দ্র শাক্তি দাও হে গুরু শুনেছি বিবাহিতা পত্নীকে তুমি পূজা করেছিলে দেবী রূপে বিলাসের সঙ্গিনী করনি সে কাহিনী আজ বিশ্বের বিস্ময়, হে লোকোত্তর মহাজীবন, এই বৃক্ষ বটবৃক্ষ তলের প্রতি ধুলিকণায় তোমার সেই মহা তপস্যা চির জাগ্রত সেই শক্তির কিঞ্চিত আমার দান কর প্রভু। আমি যেন সইতে পারি, বইতে পারি এই দুঃসহ দুঃখের বহ্নি জ্বালা।
সারাদিন ঘুরে বেড়ালো মহেন্দ্র। গঙ্গায় কূলে কূলে নৌকায় চড়ে বেলুড় গেল। সেখান থেকে গেল আরো দূরে। কিন্তু সন্ধ্যানাগাদ ওর খেয়াল হোল সমস্ত দিন কিছু খাওয়া হয়নি। শরীর দুর্বল বোধ হচ্ছে। কাছাকাছি কোথাও খাবার পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে গিয়ে ও এসে পড়লো বলীখান নামক একটা জায়গায়? সেখান থেকে বাসে চড়ে ফিরলো। এসে ও প্রশ্ন করলো, দিদিমণি আসেনি রাম? আজ্ঞে না।
আচ্ছা যা দোকান থেকে কিছু খাবার নিয়ে আয়।
আপনার ভাত ঢাকা আছে বাবু—
ও থাক কাউকে দিয়ে দিস।
মহেন্দ্র উপরে উঠে এল, নিজের ঘরে। মাধুরী আসেনি, হয়তো আর আসবেন না। আনন্দ হচ্ছে ওর! হ্যাঁ আনন্দই তো। একে বলে আত্মঘাতী আনন্দ বিলাস–আত্মনাশা সমাধি যোগ।
ভর দুপুরবেলা আষাঢ় মাসের লম্বা দিন। মাধুরী আনমনা হয়ে ঘুরছিল? হোস্টেল ছেড়ে না এলেই ভাল হতো। ওখানে অনেক সঙ্গী ছিল–কথা কয়ে লুডু খেলে বা গান গেয়ে সময়। কাটানো যেতো, বাড়িতে তার বড্ড অভাব।
নিরুপায় হয়ে মাধুরী বাড়ির পশ্চিমদিকের সেই জানালায় গেল। দেখলো, জানালার কাছে মাদুর পেতে ঘুমুচ্ছে। ওর মেয়েটি ঘরে খেলা করছে নিজের মনে। জানালায় রয়েছে। একটা কুঁজোতে জল। অকস্মাৎ মেয়েটি মাধুরীকে দেখে জানালায় আনন্দে হাসছে কিন্তু তার কচি পা লেগে কুঁজোটা গেল উল্টে, পড়লো ওর ঘুমন্ত মার গায়ে, ছলছল কলকল জল সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বৌ উঠেই ব্যাপার দেখলো মেয়েটাকে ধরে দুই কিল তার পিঠে বসিয়ে দিল।
অ্যাঁকান্না জুড়ে দিল মেয়ে।
মাধুরী হাসি চাপতে পারছে না। বললো
মারলে কেন? কেন মারলে ওকে? নিজে অসাবধান আর ওকে পিটুনি। তাকিয়ে লজ্জায় হেসে ফেলল বৌটি। মেয়েটি কোলে নিয়ে বললো দেখ না ভাই সব ভিজিয়ে দিল–চুপ। চুপ বাপি আসছে–
বেশ করলো জলের কুজো রাখবার কি জায়গা ছিল না?
যেখানে রাখবো ও যাবে–ভয়ানক দামাল। ছাড় এখন ঝাট দিয়ে ঘর পরিস্কার করতে আরম্ভ করলো। মাধুরী দেখলো সীমাহীন আনন্দ অনুভূতিতে অন্তর ওর পূর্ণ হয়ে উঠেছে। কত দুঃখ তবু কত আনন্দ এই ছোট বধুটির বুকে? কি এক অপার্থিত প্রেম ওকে ঘিরে রেখেছে স্বামীর প্রতি সংসারের প্রতি। এ প্রেম আত্মকেন্দ্রিক কিন্তু আত্মাকে বাদ দিয়ে তো। বিশ্ব নয়। আমি আছি তাই বিশ্বে প্রেম রয়েছে প্রকাশ আমাকে ঘিরেই সব! কিন্তু এ সব দর্শনের কথা। মাধুরী হাসলো আপন মনে দার্শনিক হবার মতলব নেই ওর। কি তাহলে হবে। ও? কিছু না মাধুরী একটা না ফোঁটা কুড়িতেই যাকে পোকায় খেয়েছে–
আজ কলেজ নেই তোমার। বধুটি প্রশ্ন করলো।
না ছুটি আছে। আজ তো শনিবার।
তোমার উনি এখনো আসে নি?
কৈ আড়াইটে বেজেছে নাকি।
প্রায় বাজে।
তাহলে এক্ষুণি এসে পড়বে। আজ আবার সিনেমা দেখতে যাবে বলেছে। কে জানে কখন যাবে। হয়ত সন্ধ্যার শোতে।
তুমি যাবে তো?
হা–একা যায় না তো। সিনেমা দেখার পয়সা তো কম তবু যখন যাই দু’জনেই যাই, আমি বেশি যেতে চাই না ভাই। অভাবের সংসার ও কিন্তু বড় বেশি জেদ করে, বলে পৃথিবীতে বাঁচতে খাদ্যের মতন এও দরকার।
হাসলো মাধুরী মুখে কিছু বললো না, হয়তো বলতো কিন্তু ওর স্বামী এসে পড়লো। মাধুরী সরে এলো ওখান থেকে। ওই বধুটিকে দেখে হিংসা হচ্ছে মাধুরীর কত মান অভিমান আদর আবদার কত অভাব অনটনের মধ্যে আনন্দের অমৃতকুঞ্জ একে বলে নীড়। তুচ্ছ এক ফ্লাট বাড়ির ছোট এক কুঠুরীতে একজোড়া কবুতর আর তাদের একটা বাচ্ছা অন্ন নাই, আলো নাই, আয়ু ও হয়ত বেশি নাই, নাইবা থাকলে যতক্ষণ ওরা আছে ফুলের মত ফুঠে আছে। ফুলের আয়ু কম বলে তার ফোঁটার গৌরব কম হবে?
মাধুরী আপন ঘরে গিয়ে ভাবছে। চুল বাধলো গা ধুলো কাপড় বদলালো এবার কোথাও এবার কোথাও বেরুতে হয় কিম্বা মেজদার খেলায় যোগ দিতে হয়; অথবা না? যাবে না মাধুরী আর মহীনের বাসায়। কিন্তু অনুপ সিং এসে জানাল গাড়ি আনা হয়েছে। মাধুরী এসে। উঠলো গাড়িতে।
উঠলো মাধুরী অনুপ সিং গাড়ি চালিয়ে দিল। কোথায় যাচ্ছে কোন প্রশ্ন করলো না নির্দেশও দিল না মাধুরী। যেখানে যায় যাক খানিকটা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সিংজী সেন্ট্রাল এভিন্যর সোজা রাস্তা ধরে সটান এসে কুলুটোলায় মোড় ঘোরালো। তারপর গোলদীঘির কোনায় আসতেই দেখতে পেল ট্রাম থেকে মহীন নামছে। মাধুরীও দেখলো, বললো এসে উঠে পড় বাসায় আজ নাইবা গেলে।
হু কোথায় যেতে হবে। গাড়িতে চড়তে চড়তে মহীন প্রশ্ন করলো।
এ প্রশ্ন আর করো না মহীনদা যাবার পথ এক হলে ওকথা শুধাবার অধিকার থাকে।
মহেন্দ্র নিঃশব্দে বসে রইল কোন কথা বললো না। গাড়িটা গড়ের মাঠের দিকে নিয়ে যেতে বললো–কারো মুখে কোন কথা নাই! অবশেষে মাধুরীই বললো, তুমি হয়তো ভাবছো, আমি তোমার মেসে যাচ্ছিলাম। না আমি কোথাও যাচ্ছিলাম না।
আকস্মিক দেখা হয়ে গেল তোমার সঙ্গে। অবশ্য অনুপ সিংতো ওখানেই নিয়ে যেত গাড়ি।
মহেন্দ্র এখনও কোন জবাব দিল না। মাধুরী নিউ মার্কেটের সামনে গাড়ি থামালো। তারপর নেমে মহীনকে বললো, নামবে একবার।
হ্যাঁ চল। নামলো মহেন্দ্রও।
সারি সারি ফুলের দোকানগুলোতে অজস্র ফুল সাজানো রয়েছে। মাধুরী তাকাল না সটান চলেছে, কিন্তু মহেন্দ্র দেখছে শোকেস ভর্তি ফুল। বললো আস্তে, ফুল নেবে মাধুরী?
না, ওকি হবে? তোমার কাছেই গল্প শুনেছি, এক রাজকুমার এক দেশে বেড়াতে গিয়ে দেখল, সেখানকার নরনারী, পশু পক্ষী প্রজাপতি অতি সুন্দর, কিন্তু কার অভিশাপে প্রাণহীন পাথর হয়ে আছে, ওগুলো সেই পাথর, মাটির স্নেহ ওরা পায় না মহীনদা।
না, কিন্তু মানুষের স্নেহ–
না মহীনদা স্নেহ ওরা পায় না, ওরা মানুষের কামনার ইন্ধন, ওদের দিয়ে বিলাসকুঞ্জ সাজান যায়, বাইজীর গলায় মালা দেওয়া যায়, আর কিছু নয়।
মহেন্দ্র যেন গুছিয়ে বলতে পারছে না। কেমন হতভম্ব হয়ে আছে অথচ কথা তার আয়ত্তে কিন্তু মাধুরীকে কি আবার আঘাত করবে মহেন্দ্র? না, আঘাত না করে বললো
বিয়ের বাসরও সাজানো যায় মাধুরী।
সে বিয়ে বাইরের বিয়ে মহীনদা রেজিষ্টারী করা কন্ট্রাক্ট, অন্তরের বিয়েতে লাগে হলদে সুতোয় বাঁধা দুর্বাঘাস, আর কুন্দ, না হয়ে আকন্দ ফুলের মালা, ডালিয়া ভায়েস্থাস, কসমস ক্রিস্থিমাসের সেখান ঠাই নেই। এসো।
মাধুরীরের চোখে চকচক করছে জল কিন্তু মহেন্দ্ৰ যেন লক্ষ্য করে নাই এমনিভাবে বললো, ওদিকে কোথায় যাবে?
আবার কেন এ প্রশ্ন মহীনদা? কোন বন্দীশালায় তোমার নিয়ে যাচ্ছিনে নিরাপদে মেসে পৌঁছে দেব, এসো। এগুলো মাধুরী। রুমাল দিয়ে মুখটা মুছলো একবার মহেন্দ্র পিছনেই আছে। সটান চললো মাধুরী সাজান দোকানের মাঝ পথ দিয়ে। একটা ফটোর দোকান, মাধুরী ঢুকে বললো দোকানদারকে–
এর ছবি তুলতে হবে একটু তাড়াতাড়ি হবে কি?
হ্যাঁ এক্ষুনি। বলে দোকানদার আয়োজন করছে। মহেন্দ্র বিস্মিত হয়ে বললো
আমার ফটো তুলবে কেন মাধুরী? আমি তো মোটেই তৈরি নই।
তুমি যেমন আছ অমনটিই তুলব, ক্লান্ত, অভুক্ত অসুন্দর।
হঠাৎ যেমন আমি এসেছিলাম তোমার কাছে?
হ্যাঁ, অর্থাৎ তুমি যেখানে সত্যি তুমি।
মহেন্দ্রকে বসিয়ে দিল মাধুরী একটা টুলে। ফটো তোলা হলে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল দোকানে ওকে খাওয়ালো, তারপর গোলদীঘির পাড়ে নামিয়ে দিয়ে বললো তুমি যে এসেছিলে, এ ফটোটা তার সাক্ষী রইল।
সাক্ষী নাইবা থাকতো মাধুরী।
স্বাক্ষরটা মুছে ফেলা যাচ্ছে না মহীনদা, তোমার হাতের কালিটা দ্রাক্ষার জীবন রক্ত, হাজার বছর ওর দাগ থাকে। গাড়ি চলে গেল মাধুরীকে নিয়ে।
মহেন্দ্র নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ কে জানে?
সত্যি মোছা যাবে না দ্রাক্ষার কালি। পাঁচশো বছরের পুরোনো পুঁথি আছে মহেন্দ্রর বাড়িতে ঐ দ্রাক্ষার কালি দিয়ে লেখা আজও সে অক্ষর যেমন উজ্জ্বল একথা সেই একদিন মাধুরীকে বলেছিল। কিন্তু কালি মুছে না গেলেও পুঁথি পুরানো হয়ে যায়, অপাঠ্য না হোক দুপ্রাপ্য হয়ে ওঠে, তখন তাকে কুলঙ্গীর এক কোনায় ফেলে রাখা হয়। ঊই ইঁদুর তার ধ্বংস সাধন করে কেউ দেখে না কেউ দেখতে চায় না, মহেন্দ্র উঠে এলো ওর মেসের ঘরে বুকের ভেতরটা কেমন করছে কেমন অসস্তি–কেমন অব্যক্ত যন্ত্রণা। কিন্তু কিছুই করবার নেই। মাধুরীর অন্তরে মহেন্দ্রের স্বাক্ষর যতই উজ্জ্বল হয়ে হয়ে থাক, পুরানো পুঁথির মত তাকে অপাঠ্য হয়ে যেতে হবে, কিন্তু মহেন্দ্রের অন্তরে মাধুরীর স্বাক্ষর নয় ক্ষোদিত শিলামূর্তি যার মৃত্যু নাই, অমরত্বের অনির্বান অগ্নিতে সে দগ্ধ হচ্ছে। বুকখানা দু’হাতে চেপে মহেন্দ্র শুলো বিছানায়, সর্বাঙ্গে ওর আগুন, এই অগ্নিতে নির্বাপিত করবার শীতল সলীল সম্মুখে কিন্তু সেখানে যাবার পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ তার কাছে কেন? বহুবার ভাবা ভাবনাটা আবার ভাবতে লাগলো মহেন্দ্র। মাধুরীর অবাল্য পরিচিত সমাজ সংস্কার শিক্ষা, তার স্বাধীন চিত্তের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ বেদনার অভিব্যক্তি তার অসামন্যতা রাজপ্রসাদে করার যোগ্য, মহেন্দ্র। কেমন করে তাকে দারিদ্রের পঙ্ককুন্ডে নামিয়ে আনবে? মাধুরীর তরুন মনের উচ্ছাস আজ হয়তো উদ্বেল আকুল বর্ষাস্রোতে, বর্ষাস্রোত দুকূল প্লাবিত করে, সে হয়তো চন্ডীপুরের জীর্ণ কুটিরে গিয়ে ঢুকতে চায় কিন্তু শীতের শুকনো দিনে জীবন হয়ে যাবে শীর্ণ, বিবর্ণ, বিকৃত, ব্যাধিগ্রস্ত। হয়তো মাধুরীর মা বাবা ভাই বৌদি তাকে ঘর বাড়ি টাকা কড়ি দিয়ে কলকাতায় বিশাল নিকেতনেই রাখতে চাইবে, কিন্তু মহেন্দ্র তার অন্ধ দাদা আর একমাত্র ভ্রাতুস্পুত্র কে পরিত্যাগ করে স্বর্গেও যেতে সম্মত নয়। আর সে কথা একান্তই অবাস্তব, কারণ তার বংশ। গৌরবের পরিপন্থী! কিন্তু এ সব কোন কারণই নয়, কোন বাধাই নয় মাধুরীকে লাভ করার। পক্ষে। তার প্রেম যদি সত্য হয়, সব বাধাই অতিক্রম করতে পারা যায়। কিন্তু না, নিয়তির। নিষ্ঠুর বাধাটাকে অতিক্রম করতে পারে না মানুষ নিরুপায় অসহায় মহেন্দ্রও চিন্তা বন্ধ করে ভাবলো, মাধুরীর মনে যদি স্বাক্ষর সে দিয়েই থাকে নিজের অজ্ঞাতসারে, তবে সে স্বাক্ষর যতই স্থায়ী কালিতে লেখা হোক, পুরানো অপাঠ্য হয়ে যাবার সুযোগ দিতেই হবে। মহেন্দ্রের অন্তরে শিলা মূর্তি অক্ষয় মহেন্দ্র তাকে জীবনের পর জীবন বহন করবে, কিন্তু মাধুরীর অন্তর। আকাশের মত নির্মল হয়ে উঠুক মেঘ সরে যাক সেখানে দেখা দিক পূর্ণ চন্দ্রের উজ্জ্বলতা পূর্ণ। চন্দের অমিয় ধারা।
মহেন্দ্র ঘরের টালিগুলোর দিকে চেয়ে ছিল, অন্ধকার ঘর কিন্তু আকাশের জ্যোত্সা টালির ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ছোট বিন্দুর মত, দু’তিনটে ফাঁকে এমনি ঘরে নিবিড় অন্ধকার, অথচ বাইরে জ্যোৎস্নার প্লাবন ছুটছে। মহেন্দ্রের অন্তরটাও যেন তাই। ভেতরে অশ্রু সাগর, বাইরে আনন্দের তুফান। মহেন্দ্র চেয়েই রইল টালির একটা ফটোর পানে দূর।
অন্ধকূপ থেকে দেখছে যেন অসীম আলোর সমুদ্রকে। ও আলো ছোঁয়া যায় না। ও আলোতে সঞ্চারণ করবার জন্য যে চাঁদের সৃষ্টি, সেই ওখানে বিরাজ করুক, মহেন্দ্র নিঃশব্দে সরে যাবে আরো গভীর অন্ধকারে।
চলবে।