শত্রু শত্রু খেলা পর্ব-৩৮+৩৯

0
680

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৮
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

কোচিং শেষ করে মাত্রই বেরিয়েছে সৌরভ। বাইকে দু’পা তুলে যেই চাবি ঘুরাতে যাবে আচমকা অপরিচিত এক পুরুষালি যুবকের কন্ঠস্বর শুনে থমকালো।

ভাই, আমি কি আপনার সাথে দু’মিনিট কথা বলতে পারি। খুব জরুরি ছিল।

সৌরভ বাইক থেকে নেমে পড়লো ছেলেটা কি বলতে চাই তাকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার ভালো করে পরখ করে তাকে। শুভ্রবর্ণ গায়ে আধা পুরানো ঢিলেঢালা ছাই রঙা শার্ট আর পরনে কালচে বর্ণের জিন্সপ্যান্ট। বলিষ্ঠ সুঠাম দেহ আর প্রশস্ত চওড়া কাঁধ। উচ্চতা তার সমান কিন্তু মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর উষ্কখুষ্ক চুল। চক্ষুদ্বয় কেমন ঘোলাটে আর লালচে হয়ে আছে দেখে মনে হচ্ছে এই ছেলের চোখ বিষাদের সরোবর। দেখতে অনেকটাই উদ্বাস্তুর মতই লাগছে। সে একধ্যানে তাকিয়ে আছে অচেনা এই যুবকের দিকে। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না, কখনো দেখেছি বলেও মনে হচ্ছে না। কে আপনি?

অচেনা ছেলেটি দীর্ঘ এক শ্বাস ছাড়ে। মুখে তার মলিনতার ছাপ। সে সৌরভের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের এক হাসি দিয়ে বলল,

আপনি আমাকে চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। খুব ভালো করেই চিনি। আমি কি আপনার সাথে কোথাও বসে কথা বলতে পারি। খুব বেশি সময় নেবো কিন্তু। বলবেন তো ভাই।

সৌরভ কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বলল ঠিক আছে চলুন।

দু’জন একটা রেষ্টুরেন্টে এসে বসে। সৌরভ কিছু অর্ডার করার আগেই সেই ছেলেটাই অর্ডার করে। সৌরভ নিষেধ করতে গিয়েও থেমে যায়। চুপচাপ ছেলেটার কার্যক্রম দেখে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ নিরাবতার পর ছেলেটি বলে উঠল,

আমার নাম আর্দ্র সায়মন। আমি প্রিয়ার কাজিন হয়। তবে এর পরে অনেক কিছুই বলবো। তার জন্য আপনার কাছে বিশেষ অনুমতি চাইছি যাতে আপনি উত্তেজিত না হোন আমার পুরো কথা শুনেন।

সৌরভের ভ্রু আপনা আপনি কুঞ্চিত হয়ে গেলো আর্দ্রের কথা শুনে। কি এমন কথা বলবে যার জন্য সে উত্তেজিত হবে। সে উদ্বিগ্ন হলেও মুখে প্রকাশ করলো না। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।

আর্দ্র কিছুক্ষণ ইতিউতি করছিলো পরে নিজের চাপ দাঁড়িতে হাত দিয়ে বললো,

আমি প্রিয়াকে ভালোবাসি গত চার বছর ধরে। দু’বছর আগে আমি প্রিয়াকে প্রপোজ করি। প্রিয়াও আমার প্রপোজ একসেপ্ট করে। আমাদের মাঝে ধীরে ধীরে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু এর মাঝে বাঁধ সাধে আমার বাবা। তিনি আমাদের সম্পর্কের তীব্র বিরোধিতা করেন। কারণ আমি প্রিয়াকে বিয়ে করার জন্যই প্রিয়ার বাবাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমার বাবা শুধু বিরোধিতা করে ক্ষান্ত হননি বরং রীতিমতো প্রিয়ার বাবাকে অপমান শুরু করেন। যার রেশ ধরে পরিবারে ভাঙ্গনের শুরু হয়। আমি বাবার এসব তিক্ততার সম্পর্কের জন্য রেগে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। নিজেকে নষ্ট করে দেয় বাবার উপর রাগ করে। কিন্তু আমি ভুলেই গেছিলাম সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। আমার মন মস্তিষ্ক তখন এতটাই বিষিয়ে গিয়েছিল কোনটা খারাপ আর কোনটা ভালো বুঝতে পারছিলাম না। বাবার উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমি আমার নিজসত্তাকেই হারিয়ে ফেললাম। কখন যে অপরাধের অতলে ডুবে গেলাম টেরই পায়নি। নেশা থেকে শুরু করে নারী কেলেংকারীতেও জড়িয়ে গেলাম। যতক্ষণে আমার হুঁশ হলো তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পুলিশ হাজতে ছিলাম দীর্ঘ তিন মাস। আমার মা প্রচুর কাঁদলেন। গ্রামের আশেপাশের মানুষ আমার বাবাকে ছিঃ ছিঃ করে ধিক্কার করলেন। আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠলো চর্তুদিকে। মনে মনে তৃপ্তির হাসি দিলাম। কথায় বলে না নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করা। ঠিক তেমনটাই আমার মনে হলো। নিজের চরিত্রকে কলুষিত করে বাবাকে শিক্ষা দিলাম। কিন্তু কি হলো দিনশেষে? আমার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেললাম চিরতরে। জানেন আমি যখন জেল হাজত থেকে বাড়ি আসলাম প্রিয়া একবারের জন্যও আমাকে দেখতে আসেনি। আমার হৃদয় রক্তক্ষরণ হলো এটা ভেবে। প্রিয়া আমাকে দেখলে মুখ লুকিয়ে রাখতো। অথচ এই মেয়েটাকে দেখার জন্য আমি সারাদিন মুখিয়ে থাকতাম। আমি আবার নিজেকে আগের রূপে ফিরে পেতে চাইলাম। নিজেকে সংশোধন করতে চাইলাম। নেশার কালো গ্রাস থেকে ফিরতে চাইলাম। তার আগে প্রিয়ার বাবার কাছে সময় চাইলাম। তার পা’ ধরে সেদিন প্রিয়াকে ভিক্ষে চাইলাম। তিনি আমাকে আশস্ত করলেন আমি যেদিন একদম আগের মত সেই আর্দ্র সায়মন হয়ে ফিরে আসতে পারবো সেদিন তিনি আমাকে প্রিয়াকে আমার হাতে তুলে দিবেন। আমিও তার কথা পাগলের মত বিশ্বাস করলাম। চলে গেলাম সংশোধন হতে। আগের সেই আর্দ্র সায়মন হতে। কিন্তু কি হলো সংশোধন হয়ে। যার জন্য নিজেকে নষ্ট করলাম আবার যার জন্য নিজেকে সংশোধন করে ফিরে এলাম সেই তাকেই আমি হারিয়ে ফেললাম। আপনি আমাকে বলবেন আমি ভালোবেসে খুব অন্যায় করেছিলাম। আমি কেনো প্রিয়াকে পেলাম না। সে কেনো আমার হয়েও হলো না।

আর্দ্র দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। ঝরঝর করে তার দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে সৌরভের দু’হাত আঁকড়ে ধরে বলে উঠল,

আপনি কত ভাগ্যবান। এই দু’হাত দিয়ে প্রিয়াকে ছুঁতে পারেন। চাইলে নিজের বাহুবন্ধি করতে পারেন। কিন্তু অথচ আমার তার দিকে তাকানোর অধিকারও নেই। এত বড়ো শাস্তি কেনো পেলাম আমি। জানেন এই হৃদয়টা খুব পুড়ছে তাকে একবার দেখার জন্য। কিন্তু চাইলেও তাকে আমি দেখতে পারি না। এই জীবনে আমি তাকে পায়নি সেই জীবন রেখেই কি লাভ বলেন।

সৌরভ নির্বাক হয়ে আর্দ্রের কথা শুনছিলো। সান্ত্বনার ভাষা সে কিভাবে দিবে। আর কি বলেই দিবে। প্রিয়া তার স্ত্রী হয়। তবুও সে আর্দ্রকে সান্ত্বনা স্বরূপ বললো,

দেখুন আমি আপনার ভালোবাসাকে সম্মান করি। কিন্তু সে হয়তো আপনার ভাগ্যেই ছিলো না। তার জুটি আমার সাথেই ছিল। তাই আমিই তাকে পেয়েছি দিনশেষে। আপনার জন্যই হয়তো এমন কেউ আসবে যে আপনাকে ভালোবাসবে।

সৌরভের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে আর্দ্র মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। সে আনমনা হয়ে সৌরভকে অপলক দেখেই যাচ্ছে। আচমকা একটা প্রশ্ন করে বসলো,

প্রিয়া আপনাকে ভালোবাসে?

সৌরভ ইস্ততঃবোধ করছিল কি উত্তর দিবে। প্রিয়া তাকে ভালোবাসি না বললেও সে জানে তার প্রিয়ারানী তাকে ভালোবাসে। সে কিছুটা সময় নিয়ে বললো,

প্রিয়া শুধু আমার স্ত্রী নয়, আমার প্রেমিকাও বটে। হ্যাঁ তাকে ভালোবাসে।

আর্দ্র তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। সে আবার পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,

আপনাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আছে।

সৌরভ কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লো এমন প্রশ্নে। তবে তাকে যে এর মোক্ষম জবাবও দিতে হবে। তাই নিজেকে ধাতস্থ করলো উত্তর দিতে।সেও বিচক্ষণতার সাথে বললো,

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মানে বুঝেন। স্বামী স্ত্রী একে অপরের পোশাক স্বরূপ। আমি যেমন প্রিয়ার পোশাক ঠিক তেমনি ও আমারও পোশাক। আর কিছু জানতে চান।

আর্দ্র মলিন হাসলো। তারপর উঠে দাঁড়ালো তার দু’চোখ লুকাতে। খুব কাঁদবে সে। তার জীবনটাই বিষিয়ে গেছে। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে তার। এলোমেলো কদমে সে হেঁটে চলেছে ব্যস্ত রাস্তার মাঝে। পেছনে সৌরভের বেদানার্ত দু’চোখ। আজকে ছেলেটা কাঁদছে বলে প্রিয়া তার। কিন্তু ছেলেটার চোখে হাসি থাকলে হয়তো তার জীবনে কখনো প্রিয়ার আগমন ঘটতো না। কত অদ্ভুত তাই না!

সৌরভও উঠে দাঁড়ালো বাড়ির উদ্দেশ্য। বাইক ছুটে চলছে দ্রুত গতিতে। তার মনেও আজ বিষাদের ছায়া। আচমকা তার বাইকের সামনে প্রচন্ড গতিতে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মারলো তাকে। সে কিছু বুঝার আগেই ছিটকে পড়লো বাইক থেকে রাস্তার পাশে।
______________________

প্রিয়ার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আপাতত সে বাড়িতেই অবকাশ যাপন করছে। সারাদিন এটা সেটা করে তার কাটছে। মারিয়া আজকাল প্রিয়াকে রান্না করতে বলেন যাতে সে রান্নার কাজে কিছুটা পটু হয়। অবশ্য সে নিজ থেকেও রান্না করে। সৌরভকে লুকিয়ে লুকিয়ে সে রান্না করে খাওয়ায়। পড়ন্ত বিকেলের গোধূলী লগ্ন এখন। একটু পর সৌরভ ফিরে আসবে বাসায় তাই সে তার জন্য পাস্তা বানাচ্ছে।

প্রিয়া আনমনে পাস্তা বানাচ্ছে আর মুচকি হাসছে। তাদের বিয়ের একমাস হয়ে গেছে কিভাবে সে টেরই পায়নি। সময়গুলো কি দ্রুতই চলে যাই। তার পূর্ণ মনোযোগ যখন রান্নার দিকে। তখন আনোয়ার হন্তদন্ত হয়ে বাসায় আসেন। দ্রুতই মারিয়াকে ডাক দেন। প্রিয়া কিচেন থেকে এসে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে আব্বু?

আনোয়ার আমতা আমতা করছিল তখন। কিন্তু মুখ ফসকে বলে ফেলেন হাসপাতালে যেতে হবে আমাদের জলদি। তাদের কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ নাজমার চিৎকার ভেসে আসে প্রিয়ার কানে। সবাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাচ্ছে নিচে। প্রিয়া দিগবিদিক হয়ে সেও ছুটে যায়। সবাইকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? কেউ তাকে উত্তর দিতে পারে না। আলিশবা বলে তুমি যাবে আমাদের সাথে তাহলে দ্রুতই গাড়িতে উঠো।

গাড়ি মাঝ রাস্তায় যাওয়ার পর আচমকাই ফোনকল আসে হাসপাতাল থেকে। রোগীর অবস্থা খুবই সিরিয়াস। তাকে ঢাকা নিয়ে যেতে হবে। এর পর আধা ঘন্টা না পেরুতেই আবার ফোনকল আসে রোগী মারা গেছে। গাড়ির মাঝে পিনপতন নীরবতা। নাজমা বেহঁশ হয়ে আছে।

প্রিয়া এখনো স্তব্ধ হয়ে গেছে কে রোগী তাকে কেউ কিছু বলছে না কেনো?

চলবে,,,,,,,,,,,,

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৯
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

শোভা ঘুমে ছিল বিধায় শুনতে পায়নি তাদের বাসায় এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে। তাদের উপরের ফ্ল্যাটের রিমি এসে শোভাকে বলে গেছে তার ভাইয়ের এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। এখন অবস্থা কেমন কেউ জানে না। তাদের বাসার সবাই ছুটে গেছে হাসপাতালে। সেই খবর শোনার পর থেকে শোভাও দিগবিদিক ভুলে ছুটছে রাস্তার মাঝে। তার হুঁশজ্ঞান নেই সে কি করবে? রাস্তায় গাড়িও খুঁজে পাচ্ছে না সে। কিন্তু সে দাঁড়ানোর অবস্থায়ও নেই। তার পায়ের জোর কদম বাড়িয়ে দিশাহীন হয়ে ছুটছে। আচমকা কারো ধাক্কায় তার সম্বিত ফিরে। কিন্তু সামনে যাকে দেখলো তাতে তার মেজাজ যেনো তিক্ততাই পরিপূর্ণ হলো। মুখে কিছু অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করতে গিয়েও করলো না। তবে সে আবার আগের মত ছুটার জন্য উদ্বত হতেই তার পেছন থেকে এক বেদানার্ত পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

দাঁড়াও শোভা’ তোমার সাথে কিছু কথা আছে। প্লিজ আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও।

শোভা কদম বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো। পিছনে থাকিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে একবার সাফিনকে দেখে নিলো। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

আমি সিরাজদ্দৌলার মত অতোটাও মহান নয়, মীরজাফরদের ক্ষমা করে দেবো। আসি।

“আমি জানি আমি ভুল করেছি। কিন্তু একবার কি ক্ষমা পেতে পারি না। আমি আর কোনো মেয়ের সাথে কথা বলবো না তোমাকে ছাড়া। তুমি শুরু তোমাতেই শেষ। বিশ্বাস করো আমি তোমাকেই আমার জীবনসাথী হিসেবে সারাজীবন চাই। প্লিজ শোভা মাফ করে দাও। আমি তোমাকে ভালোবাসি শুধু। ওদের সাথে শুধু মজা করেছি মাত্র। প্লিজ শোভা।

শোভা উদ্বিগ্ন মুখে আচমকাই হো হো করে হেসে উঠল। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস টেনে বলল,

কিন্তু ন্যাড়া একবার বেলতলায় যায়, বার বার নয় মিঃ সাফিন মাহমুদ। আসছি। ভালো থাকবেন। আর হ্যাঁ’ ডোন্ট ডিষ্টার্ব মি। নেক্স টাইম আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন তাতেই আপনার মঙ্গল। শোভা কথাগুলো বলে আর দাঁড়ায় না। হনহনিয়ে ছুটে যায় তার নিজ গন্তব্যে।

সাফিনের চোখমুখে একরাশ হতাশা হলেও মনে মনে আক্রোশে ফেটে পড়ছে।
______________________

হাসপাতালের করিডোরে পা রাখতেই গৌরবকে একজন নার্স ডাক দিলেন। রোগীর বাড়ির লোকজন কারা সামনে আসুন। গৌরব ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায় ভাইকে দেখতে। অজানা আশংকায় নিজেকে স্থির রাখতে বড্ড হিমশিম খাচ্ছিলো সে। নাজমা এখনো হুঁশ জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে করিডোরের বেঞ্চিতে। কম্পিত শরীরে কথা বলার জোর নেই। নিষ্প্রভ ছাউনি তার আদরের কলিজাকে খুঁজে যাচ্ছে। চোখের জল তার উপচে পড়ছে বাঁধভাঙা নদীর মত। আলিশবা শাশুড়িকে নিজ বক্ষস্থলে শক্ত করে ধরে রেখেছে। মাথায় আলতো করে হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে সে। সান্ত্বনার বাণী সে নিজেও খুঁজে পাচ্ছে না।

প্রিয়া বিমূর্ত দাঁড়িয়ে আছে বেঞ্চির একপাশে। তার কাছে সবকিছুই দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। তার বিরস চিত্তে ঘুমের ঘোরে দেখা এক অদ্ভুত বাজে দুঃস্বপ্ন এটা। এক্ষুনি ঘুম ভেঙে যাবে তার। সবকিছুই আগের মতই হয়ে যাবে। নিষ্করুণ দৃষ্টি তার হাসপাতালের ওটি রুমের দিকে। তার দৃষ্টি ক্রমশই ঝাপসা আর নিশ্বাসের তীব্রতা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাচ্ছে। তার চক্ষুদ্বয় আপনা আপনি বন্ধ হয়ে ঘুমের অতলে ডুবে যাচ্ছে। সে ঢলে পড়েছে বেঞ্চিতে।

ডাক্তার গৌরবকে কিছু ডকুমেন্টস দিলেন পূরণ করতে। পুলিশকে খবর দিয়েছেন। অ্যাকসিডেন্ট কেইস সাধারণত পুলিশে ডায়রি করতে হবে। ডাক্তার গৌরবকে প্রশ্ন করলেন আপনার ভাই কি কোনো কারণে ডিপ্রেশড ছিল? গৌরব অবিশ্বাস্য নজরে তাকালো ডাক্তারের দিকে। কি বলছেন কি? এরকম কিছুই ছিল না।

“কিন্তু আপনার ভাই অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তিনি নেশা করেছিলেন। তার নিজের হুঁশজ্ঞান ছিলই না।”

গৌরব উৎকন্ঠিত হয়ে গেলো ডাক্তারের কথা শুনে। মোটেও তার ভাই নেশা করে না। সে তো কখনো সিগারেটও হাত লাগায়নি সেখানে নেশা করবে। অসম্ভব হতেই পারে না। সে ডাক্তারের সাথে দ্বিমত পোষণ করলো। সে দৃঢ়কণ্ঠে বলল,

হতেই পারে না। আমার ভাই কখনোই নেশা করে না। আপনি কিসব ভুলভাল বলছেন? কথাগুলো বলেই সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

ডাক্তার তাকে প্রমাণ স্বরূপ কম্পিউটার থেকে সদ্য বের হওয়া একটা কাগজ দেখালো।

যা দেখে গৌরবের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। সে ডাক্তারকে অনুরোধ করলো তার ভাইকে দেখতে চাই সে। ডাক্তার আশস্ত করলেন পুলিশি ঝামেলা শেষ হলেই আপনারা দেখা করতে পারবেন। আপনার ভাই এখনো ওটিতে আছে। তার মাথায় নিচের দিকে একটা ছিদ্র আছে। যেটার কারণে রক্তক্ষরণ অতিমাত্রায় হয়েছে। আমরা কিছু করার সুযোগই পায়নি। সর‍্যি ফর এগেইন আপনার ভাইকে বাঁচাতে পারিনি।

গৌরব নিথর হয়ে বসে পড়লো। মুখ ফুটে কিছু বলার সাধ্য নেই। উদ্বাস্তুর মত ডাক্তারের কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। বাইরে বেঞ্চিতে তার মা আর বউ দু’জনে বিমূর্ত বসে আছে। আশেপাশে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে আছে। প্রিয়া বেহুঁশ পড়ে আছে মারিয়ার কোলে। নাজমা ক্ষণে ক্ষণে গগন বিদারক চিৎকার দেয় আবার শান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে।

মাসুদ শহরের বাইরে ছিলেন মাত্রই তিনি শুনলেন তার ছেলের কথা। হন্তদন্ত হয়ে সে ছুটে এলেন। পাগলের মত প্রলাপ করতে করতে সে মেঝে দপ করে বসে পড়লেন। আনোয়ার তাকে শক্ত করে ধরলেন। সান্ত্বনার বাণী তার কাছে নেই। সে নিজেও আজ হারানোর শোকে স্তব্ধ হয়ে আছে।

ডাক্তার আবার তাদের ডাকলেন। ডেটবডি মর্গে পাঠানো হবে। আপনাদেরকে কাল সকালে হস্তান্তর করা হবে। গৌরব এই কথা শুনে নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারেনি। ডাক্তারের কলার চেপে ধরলো সে। বজ্রকন্ঠে বলে উঠল,

কার অনুমতি নিয়ে আমার ভাইয়ের নিথর দেহ আপনারা মর্গে পাঠাবেন। এখনো আমরা ভাইয়ের মুখটা পর্যন্ত দেখিনি। আপনারা আমাদের দেখতেই দেন নি। আবার এখন তাকে মর্গে পাঠাবেন কাকে জিজ্ঞেস করে?

ডাক্তারসহ নার্সেরা মিলে গৌরবকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। ডাক্তার তো ক্রোধে ফেটে পড়লো গৌরবের উপর। ক্রোধান্বিত হয়ে বলল,

এই ডেডবডির সব পার্টস খুলে নিয়ে নিবি। গৌরব কর্কশ গলায় চেঁচালো। হাত লাগালেই ঐ হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিবো।

দীর্ঘক্ষন ধস্তাধস্তির মাঝে পুলিশের আগমন ঘটলো। তারা ডেডবডি দেখতে চাইলো। গৌরবও তাদের পিছু পিছু গেলো। একজন কনষ্টেবল ওটি রুমে সাদা কাপড়ে মোড়ানো নিথর দেহের মুখ থেকে কাপড় সরালো। গৌরব পড়ে থাকা প্রাণহীন শরীরের দিকে তাকিয়ে এক গগনবিদারী চিৎকার দিল। সে সহ্য করতে পারলো না তার ভাইয়ের করুণ অবস্থা দেখে। পুরো মুখ থেতলে গেছে। রক্তে পুরোই মাখামাখি। কত কষ্ট পেয়েছে তার ভাই। সে ভাবতেই আৎকে উঠলো। দু’চোখ বন্ধ করে দফ করে মেঝে বসে পড়লো।

দু’জন সিষ্টার আর স্টাফ মিলে ডেডবডি নিয়ে ওটির বাইরে আসলো। ততক্ষণে বাইরে সবার আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গেছে। নাজমা মেঝে গড়াগড়ি খাচ্ছে। প্রিয়া বিমূর্ত বেহুঁশ এখনো বসে আছে। মাসুদ ছুটে গিয়ে মুখের কাপড় সরালো। তার চক্ষুদ্বয় আৎকে উঠলো।

তোমরা এভাবে মেঝে বসে কাঁদছো কেনো?

আচমকা চিরচেনা পরিচিত গম্ভীরস্বর শুনে সবাই অবিশ্বাস্য নজরে তাকালো। চোখের সামনে যা দেখছে তা’কি সত্যিই না’কি কোনো কল্পনা। বাকিরা তখনো ঘোরের মাঝে আছে। কিন্তু প্রিয়া দিগবিদিক ভুলে সবার আগে ছুটে জড়িয়ে ধরলো সৌরভকে। এতক্ষণ যাবত বিমূর্ত বসে থাকা সে এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। নাজমা মেঝে থেকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে সৌরভকে জড়িয়ে ধরলো। বাকিরা কিছু ভাবার সময়ই পেলো না। যে যেভাবে পারলো দৌড়ে ছুটে এলো। সবার চাপাতলে পড়ে সৌরভের জান যায় যায় অবস্থা। সে সবাইকে ছাড়তে বলল। কিন্ত সবাই ছাড়লেও প্রিয়া আর নাজমা এখনো তাকে ধরে আছে। সৌরভ সবার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর বললো,

এরকম মরা কান্না কেনো করছিলো বল তো? আমার সাধারণ বাইক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। বেশি কিছু হয়নি। পায়ে একটু আঘাত লেগেছে এই যা। ডাক্তার বলেছে কয়েকদিন রেষ্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তোমাদেরকে কে বললো আমার অ্যাকসিডেন্টের কথা? আমি তো জানায়নি।

সৌরভের মুখে এমন কথা শুনে গৌরব নিজে এগিয়ে আসে। তারপর জিজ্ঞেস করে তোর মোবাইল কোথায় সৌরভ?

সৌরভ নিজেও হকচকিয়ে যায় মোবাইলের কথা শুনে। তারপর তার সারা পকেট খুঁজেও মোবাইল পেলো না। তারপর যা সন্দেহ করলো তাই ঠিক হলো। সে সবার মুখের অবস্থা দেখে বললো,

আসলে দুঃখিত মোবাইলটা বোধহয় অ্যাকসিডেন্ট স্পটে হারিয়ে গেছে। কেউ পেয়ে তোমাদেরকে হয়তো ফোনকল দিয়েছে। ভেবেছিল গুরুতর আহত ব্যক্তিটি আমি। আমি হাঁটতে পারছিলাম না দেখে লোকজন ধরাধরি করে ঐ ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমি এতক্ষণ ফার্মেসীতে ছিলাম। তাই আসতে লেইট হয়েছে।

গৌরব আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া আদায় করলো। তারপর ভাইয়ের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

ডেডবডি টা কার ভাই?

‘ডেডবডি’ ভাইয়ের মুখে এ শব্দ শুনে সৌরভ স্তব্ধ হয়ে গেলো। চিৎকার দিয়ে বলল,

আদ্র বেঁচে নেই। ও শুধু আমাকে বাঁচাতেই আজ এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো। আমাকে বড্ড ঋণী করে দিল ভাই। কি করে ওর এত ঋণ নিয়ে বেঁচে থাকব আমি। এত মরণ যন্ত্রণা নিয়ে কিভাবে বাঁচবো।

সৌরভের মুখে আদ্রের কথা শুনে প্রিয়াসহ বাকিরাও চমকে উঠলো।

চলবে,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে