শত্রু শত্রু খেলা পর্ব-৩৬+৩৭

0
678

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৬
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

প্রপোজের কথা শুনে সৌরভ ঈষৎ হাসলো। মেয়েটা তার প্রপোজাল চাইছে। এ আর এমন কি? নিজেকে স্থির করলো কিভাবে প্রপোজ করা যায়। সে প্রিয়ার চিবুক ধরে তার মোহময় দু’আঁখিতে নিজের পূর্ণদৃষ্টি রেখে নেশালো কণ্ঠে বলে উঠল,

ভালোবাসি বউ তোমার মায়াবিনী দু’আঁখি। ভালোবাসি তোমার সরু গলির পাতলা অধরখানি। যার হাসিতে আমি মুগ্ধ বারংবার। ভালোবাসি তোমার সেই ঢেউ খেলানো এলোকেশ। ভালোবাসি তোমার মনগহীনের অব্যক্ত ইচ্ছে সমারেশ। ভালোবাসি তোমাকে আর তোমার পুরো রাজ্যেকে। যেখানে সম্পূর্ণ আমার বসবাস। অনেক ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়ারানী। দয়া করে এই অধমের ভালোবাসা’টা গ্রহণ করো। তাহলে যে আমি ধন্য হয় ‘বেগমসাহেবা’।

সৌরভের নিতান্ত সাধারণ প্রপোজ দেখে প্রিয়ার মেজাজ রুক্ষমূর্তি ধারণ করলো। সে সৌরভকে নিজের থেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো। তারপর রুক্ষ ভাষায় দুটো বাক্য শুনালো,

আপনি স্কুলের প্রিন্সিপালকে পত্র দিচ্ছেন। এভাবে কেউ প্রপোজ করে। দু’হাটু গেড়ে বসবেন তারপর দু’হাতের মুঠিতে আংটি রেখে ঐ হাত উঁচিয়ে আমাকে প্রপোজ করবেন।

প্রপোজের ধরন শুনে সৌরভ প্রথমে চমকালো। পরে প্রিয়ার হাত টেনে বলল আরে বাহ! আমার প্রিয়ারানী দেখছি আজকাল অনেক রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে। তা কোথায় দেখেছো এইভাবে প্রপোজ করা। প্রিয়া সৌরভের কথার জবাব দিলো না। মুখে তার লাজুক হাসি। কিন্তু অন্তরণে দুষ্টুমি চেপেছে তার। আজকে সে এই সৌরবিদ্যুত এর ক্লাস নিবে। তাকে প্রনয়ের দংশনে দংশিত করার জন্য। তাকে এত অপেক্ষা করানোর জন্য। ভালোবেসেও ভালোবাসি না বলার জন্য। নিজের প্রিয় মানুষ হয়েও তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্য। দিনের পর দিন তাকে এড়িয়ে চলার জন্য। সবকিছুর প্রতিশোধ নিবে সে। চরম প্রতিশোধ।

সৌরভ ত্বরিত প্রিয়ার সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে। বাম পকেটে থাকা তার প্রিয়ারানীর জন্য সদ্য কিনে আনা আংটিটা বের করে দু’হাতের মাঝে রেখে তা উঁচিয়ে ধরে প্রিয়ার দিকে। মুখে প্রশস্ত হাসি তার।

কিছু ভুল কিছু শিহরণ।
বসন্তের এক সন্ধ্যোয়
মোহময়ীর উত্তোরণ।
মধুময় সেই সন্দিক্ষণে
স্বপ্নচারিণীর আগমন।

আমার শহরে থাকুক
তার পদচারণ।
সে হোক আমার একমাত্র
বেঁচে থাকার কারণ।

ভালোবাসি যে তোমাকে বড্ড প্রিয়। প্লিজ এবার তো গ্রহণ করো প্রিয়রানী।

প্রিয়া তো পুরাই ঘোরের মধ্যে ছিলো। এ কোন সৌরভকে দেখছে সে। সত্যিই অসাধারণ লেগেছে তার কাছে। কিন্তু তাতে কি? সে তো এত সহজে ধরা দিবে না। সে সৌরভের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর কোপিত কন্ঠে বললো,

ওহ, হ্যালো’ কখনো নিজেকে আয়নায় দেখেছো? কোথায় আমি আর কোথায় তুমি। কোন সাহসে তুমি আমাকে প্রপোজ করো। লজ্জা করে না তোমার। মেয়ে দেখলে তোমার হুঁশ থাকে না, ছ্যাচড়ামী শুরু হয়ে যায় তাই না? বাবা-মা কত কষ্ট করে পড়াশোনা করায় মানুষ হওয়ার জন্য ছ্যাচড়ামী করার জন্য নয়। যাও এখান থেকে।

এক দমে কথাগুলো বলে প্রিয়া টুপ করে বসে পড়ে লুকানোর জন্য। সৌরভ তো বাকরুদ্ধ প্রিয়ার মুখে এমন প্রত্যাখান দেখে। সে দ্রুতই প্রিয়ার কাছে যাই। তারপর দু’বাহু ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,

সত্যিই আমি দেখতে খারাপ। আর অনেক ছ্যাচড়া তাই না।

প্রিয়া আর মাথা উঠায় না লজ্জায়। সে তো ইচ্ছে করে বলেনি। তার তো সৌরভের উপর অনেক অভিমান জমে আছে। তাই মুখ ফসকে বলে ফেলেছে।

সৌরভ নির্বাক বসে আছে। তার তো মনটায় বিষিয়ে গেছে প্রিয়ার কথা শুনে। কতটা উচ্ছ্বসিত ছিল সে আজকের রাতের জন্য। কত কিছু ভেবে রেখেছে সে প্রিয়ার সাথে কি করবে না করবে? কিয়ৎক্ষন নিরাবতা বিরাজমান তাদের দু’জনের মধ্যে। সৌরভ দৈবাৎ মলিন মুখে বললো,

তুমি হয়তো অনেক কিছুই জানো না। আমিই বলে’নি তোমাকে। তোমার বাবাও বলতে চাইনি তোমার ভালোর জন্য। ছাদে যেদিন তোমার সাথে আমার ধস্তাধস্তি হয়েছিল তারপর আমরা দু’জন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে ছবিটা তোমাকে দেখিয়ে ছিলাম সেটা আসলে ঝুমুর চাচী তুলেছিল। এ ছবির কথা তোমার পরিবার আমার পরিবার সবাই জানে। আমার মা’ যেদিন এটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলো আমি সম্পূর্ণ মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এ ছবিটার রেশ অনেকদিন ছিল। আমি ঝুমুর চাচীকে গিয়ে ধমক দিয়ে আসি যাতে এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করে।

এরপর দীর্ঘদিন কেটে যায় সবাই অনেকটাই নিশ্চুপ। হঠাৎ একদিন ডাক পড়ে তোমার বাবা থেকে। তিনিও আমাকে এই ছবি নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমি সত্যিটাই বলি। কিন্তু তিনি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করলেন না। তখন তোমার বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে তোমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। আমি তখনও আমার অনূভুতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলাম। কিন্তু তোমার বিয়ে অন্যখানে কেনো যেনো মানতে পারছিলাম না। তাই তোমার বাবাকে সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে দেয়।

আমি যদি আপনাকে আঙ্কেল থেকে শ্বশুর হিসেবে বাবা ডাকি তাহলে কি খুব অন্যায় হয়ে যাবে? আমি আপনার মেয়ে জামাই হিসেবে খুব খারাপ নাকি আমাকে পাত্র হিসেবে চোখেই পড়ছে না আপনার।

তখন তোমার বাবা আমার দিকে বিস্ফোরিত নয়নে তাকালেন। তবে তার মুখে ছিল আত্মতুষ্টির হাসি। আমাকে পরখ করার জন্যই তোমার বিয়ের নাটক সাজিয়েছিল। ভাবা যায়। তবে কঠিন কতকগুলো শর্ত দিয়ে দিলেন মেয়ে জামাই হওয়ার জন্য। প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে তোমার ভালোর জন্যই আমি নিজেকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ প্রেমিক পুরুষে পরিণত করি। তোমার ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব তো আমার। সেই থেকে আমি হলাম তোমার অন্তরালের প্রেমিক।

হয়তো আজও তোমাকে ভালোবাসি বলা হতো না। সেদিন যদি ঝুমুর চাচী ছবিটা না তুলতো। তোমার বাবা-মাকে না দেখাতো। কত অদ্ভুত না ব্যাপার টা। মাঝে মাঝে কিছু খারাপের মধ্যেও আমাদের ভালো কিছু নিহিত থাকে।

প্রিয়ার দৃষ্টি জোড়ায় সৌরভের জন্য মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হলো। আরো একবার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলো তার প্রতি। অথচ সে এই লোকটাকে কত ভুল বুঝতো। তার ভালোবাসাকে সে কতটাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন তবুও থেকে যাই। সে ব্যগ্রকন্ঠে বলল,

আপনি কি পিউ আপুকে এখনো ভালোবাসেন?

সৌরভের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো প্রিয়ার কথা শুনে। এত লম্বা সময় ধরে এতক্ষণ সে কি বুঝালো তাকে। মনের মাঝে তীব্র দহনে দগ্ধ হলো সে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি সে রাখতে চাই না। তাই পুনরায় বললো,

ভালো যদি পিউকে বাসতাম তাহলে তুমি আমার বউ হতে না। আর না তোমার বাবার কাছে নিজে গিয়ে প্রস্তাব দিতাম।

প্রিয়ার উত্তর পছন্দ হলো না। সে জানে সৌরভ তাকে ভালোবাসে কিন্তু তাহলে আজকে সকালে কেনো তাকে আনতে যাইনি? কেনো পিউর সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো তাকে ভুলে? প্রিয়ার মনে হাজারো জমানো অভিমান। কিন্তু মুখ খুলে বলতে পারছে না। তার জিগ্যেসু নজর এলোমেলো হয়ে বার বার সৌরভের দিকে চাইছিলো।

সৌরভ কেনো যেনো প্রিয়ার মনোভাব চট করে বুঝে গেলো। সে প্রিয়ার সম্মুখে বসে তার দু’হাত নিজের হাতের মুষ্টিতে আবদ্ধ করলো। তারপর এক মায়াবী ছাউনিতে তার দিকে তাকালো। মৃদুস্বরে বলল,

তুমি কি সকালের সেই বিষয় নিয়ে রেগে আছো? তার জন্যই ভাবছো আমি পিউকে এখনো ভালোবাসি। তারপর কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে সৌরভ মিষ্টি করে হেসে উঠল। প্রিয়ার দু’হাতে নিজের অধর ছুঁয়ে বললো পিউর সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই দেখা হয়েছে। আমি কথা বলতে চাইছিলাম না। কিন্তু সে আমাকে অনুরোধ করলো আজকে শেষবারের জন্য আমার সাথে কথা বলতে চাই। হয়তো এটাই তার শেষ দেখা। আমি প্রথমে অবাক হলাম তার কথা শুনে। কি এমন কথা আছে যার জন্য সে আমাকে শেষবারের জন্য কথা বলতে চাই। তার বারবার অনুরোধে আমি ওর সাথে কথা বলতে রেষ্টুরেন্টে প্রবেশ করি। তবে তার আগে তোমাকে ফোনকল করি কিন্তু তুমি রিসিভ করনি তাই ছোট একটা ক্ষুদেবার্তা পাঠায় তোমাকে।

“আমার আসতে একটু দেরি হচ্ছে যদি পারও বাসায় চলে যাও। নয়তো আমার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি আসছি।”

আমি প্রবেশ করার দশমিনিটের মধ্যেই তুমিও রেষ্টুরেন্টে প্রবেশ করেছো। তাই তোমাকে সেভাবে কিছুই ভেঙে বলা হয়নি। কিন্তু তুমি নিজেই তো দেখলে পিউর হাতে বিয়ের কার্ড। এবার বলো এখনো রেগে আছো আমার উপর। আচ্ছা, সরি’ বউ আর কখনো এমন ভুল হবে না। অ্যাই প্রমিজড।

প্রিয়ার নেত্রকোণে অনুশোচনার জলে টইটম্বুর। সে দিগবিদিক ভুলে দৈবাৎ সৌরভকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সে তো মুঠোফোন চেকই করেনি। তারও তো ভুল ছিল।

সৌরভের অধরকোণে বিজয়ের হাসি। অবশেষে তার প্রিয়ারানী তার একান্ত নিকটে এসেছে। সৌরভও তার বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো। প্রিয়ার চোখের জল মুছে সেখানে তার অধর ছোঁয়ালো। মিট মিট করে হেসে প্রিয়াকে রাগানোর জন্যই বলে উঠল,

একটু আগে কে জেনো আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। এখন সে এসেই আবার আমার বক্ষস্থলে লুটিয়ে পড়লো। ছিঃ! কি নির্লজ্জ মেয়ে’রে বাবা। প্রিয়া লজ্জায় হেসে উঠল। কিন্তু মাথা তুলে আর তাকালো না। সৌরভ প্রিয়াকে উঠিয়ে দোলনার মাঝে বসালো। তারপর পাশে রাখা ঝুঁড়ি থেকে বেলীফুলের গাঁজরা তার মাথায় পরালো। আবার কানের মাঝে দুটো গোলাপ গুজে দিলো। গলায় গাঁদা ফুলের মালা আর হাতে শিউলিফুলের মালা পরিয়ে দিলো। মালা পরানো শেষে প্রিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

প্রিয়ারানী মনে আছে তোমার? আমি তোমাকে একদিন আমার ইচ্ছের কথা বলেছিলাম। আমার বউকে এভাবে বাগানের ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিবো। প্রিয়া লাজুক মুখে মাথা নাড়ালো। সৌরভ প্রিয়াকে পাছাকোলে করে ছাদের রেলিং-এ গিয়ে বসায়। প্রিয়া লজ্জায় আর ভয়ে সিটিয়ে আছে। সৌরভ তাকে কোনো রেলিং-এ বসালো। সৌরভ মিট মিট করে হেসেই যাচ্ছে প্রিয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে। সে প্রিয়াকে ক্ষীণস্বরে বলল,

একটা ম্যাজিক দেখবে?

প্রিয়া হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ালো।

সৌরভ হাতের মুঠোফোন নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো। প্রিয়া অবাক হয়ে শুধু দেখে যাচ্ছে। কিছু সময় পর ডায়ালকৃত নাম্বারটির ব্যক্তি কল রিসিভ করলো। সৌরভ সালাম দিলো প্রথমে। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

কেমন আছেন চাচী?

ঝুমুর যেনো আকাশ থেকে পড়লো সৌরভের কল দেখে। ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলো। তারপর ভালো আছি বললো। তার মনে দুশ্চিন্তার বহর বয়ে যাচ্ছে। সৌরভ তাকে আচমকাই কেনো কল দিলো। সে ইস্ততঃবোধ করছিল কিভাবে জিজ্ঞেস করবে। তার মধ্যেই সৌরভ বলে উঠল,

চাচী আপনি বারান্দায় একবার আসবেন?

ঝুমুর বিস্মিত হলো। ঘোর কাটতেই চাইছে না। কি এমন কারণ যার জন্য তাকে বারান্দায় ডাকছে। সে তড়িঘড়ি ছুটলো বারান্দার দিকে। কিন্তু এসে যা দেখলো তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। ঝুমুর ভীষণ লজ্জা পেলো। কিন্তু সেখান থেকে আসতেও পারলো না। সৌরভ ঝুমুরকে বলল,

চাচী ধন্যবাদ। আপনার অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য প্রিয়া আজকে আমার বউ। এর জন্য আপনি আমার কাছে অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। তারপর বলেন এই খুশিতে আপনাকে কি উপহার দেওয়া যায়?

ঝুমুর জীবনে প্রথমবার শুনলো তার দ্বারা কারো উপকার হলো। খুশি হবে নাকি রাগ করবে বুঝতে পারছিলো না। তবে কোথাও যেনো সৌরভের বলা কথায় তার ভালো লাগলো। সে তড়িৎ বলে উঠল,

মাশাআল্লাহ তোমাদের দু’জনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। দোয়া করি সামনের বছর যেনো তুমি ফুটফুটে বাচ্চার বাবা হয়ে যেতো পারো।

সৌরভ মুচকি হেসে ফোনকল কাটলো।
প্রিয়াকে আরো কাছে টেনে তার কানে কানে বললো,

প্রিয়ারানী রাজি হলে আমি তো আজকেই বাপ হতে এক পায়ে খাঁড়া।

বাচ্চার কথা শুনে প্রিয়া শুকনো ঢোক গিলল। লজ্জায় মূর্ছিত হলো তার কম্পিত বদন।

চলবে,,,,,,,,,,,

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৭
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গৌরব আলিশবার রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে। আলিশবার বাবা-মা গতকালই বাংলাদেশ এসে পৌঁছান। তাই মাসুদ পরেরদিনেই রিসিপশনের আয়োজন করে।

আলিশবা বউয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে চুপটি হয়ে বসে আছে। তার পাশে শোভা আর প্রিয়াকে বসিয়ে রেখেছে। চারপাশে মানুষে গিজগিজ করছে। প্রিয়ার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে এভাবে বসে থাকতে। সে উঠতে চাইলে শোভা তাকে ধরে রাখলো। শোভা প্রিয়ার কানে ফিসফিস করে বললো,

আমার ভাইকে বুঝি খুব মিস করছো। চিন্তা করো না, একটু পর এসে যাবে তোমার জামাই।

শোভার কথাতে বেশ লজ্জা পেলো প্রিয়া। উঠতে গিয়েও আর উঠলো না। চুপটি করে বসে পড়লো। কিন্তু সত্যিই তার হাঁসফাঁস লাগছে একজনকে দেখার জন্য। সকাল থেকেই তাকে দেখেনি। এভাবে প্রায় আধাঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর আচমকা প্রিয়ার দু’আঁখি কারো হাতের বলিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। অতর্কিতে এমন হওয়াতে প্রিয়া ভড়কে গেলো। লজ্জায় বলতেও পারছে না কে হতে পারে? প্রিয়ার এমন অসহায় অবস্থা থেকে শোভা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো। আলিশবাও মুখ টিপে হাসছে। আহ! বেচারি।

প্রিয়া অবশেষে না পেরে অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতখানা চেপে ধরে ছুটালো। কিন্তু চোখ খুলে যাকে দেখলো তাতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। মুখ খুলে কিছু অশ্রাব্য ভাষাও প্রয়োগ করলো তার উপর। প্রীতি সেই তখন থেকেই দাঁত কেলিয়ে হেসেই যাচ্ছে। প্রিয়ার মেজাজ তুঙ্গে এই মেয়ে সবার সামনে তাকে লজ্জায় না ফেললে চলে না। অসভ্য একটা। প্রীতি প্রিয়ার হাত ধরে আফসোসের সুরে বললো,

আহারে বেচারি মনে মনে জামাই ভাবছিলো।

প্রিয়া কপালের রগ ফুলিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। সবগুলাই একঘাটের মাঝি তার মজা উড়ানো ছাড়া আর কিছুই পারে না।

মাসুদ আরাভকে কোলে নিয়ে বসে আছে। নাজমা আত্নীয়-স্বজনের তদারকি করছেন। সৌরভের বন্ধুরা প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে। সবার মাঝে সানির অক্ষি জোড়া একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার দেখা পেলেই হলো আজ। রকি নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে পাশে। তাদের মধ্যে আসলজন এখনো মিসিং। সৌরভ গৌরব এখনো হলে এসে উপস্থিত হয়নি।

নীল, শ্রাবণ আর লুবনা এসেছে বন্ধুরা মিলে। সবগুলাই প্রিয়াকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রিয়া হলের এককোণে বসে থাকে চুপ হয়ে। নীল, শ্রাবণ আর লুবনা গিয়ে তাকে ডাক দেয়। প্রিয়া এদের দেখে আলতো করে হাসে। নীল সৌরভের কথা জিজ্ঞেস করে। প্রিয়া আনমনা হয়ে বলে জানি না। গাড়ি করে একসাথে হলে এসেছি কিন্তু এরপর কোথায় হাওয়া হয়েছে কে জানে। আর দেখিনি আমি।

শ্রাবণ অনেক আফসোস করলো প্রিয়ার জন্য। লুবনার মুখে হাসি হলেও মনের মাঝে এক সমুদ্র পরিমাণ কষ্ট। সৌরভ কেনো তাকে ভালোবাসলো না। খুব কি ক্ষতি হতো তাকে ভালোবাসলে? তাদের আলাপনের মাঝে রাঢ়ী উপস্থিত হয়। বেনারসি শাড়ি পড়ে একদম নববধূ সেজে পরশের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে। প্রিয়া, নীল, শ্রাবণ, লুবনা মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে দেখছে। দু’জনকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। রাঢ়ী লাজুক ভঙ্গিতে তাদের সামনে আসলো। প্রিয়া এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকে বললো,

আসসালামু আলাইকুম ভাবী। ভালো আছেন।

রাঢ়ী প্রিয়ার সালাম পেয়ে চমকে উঠলো। তার মনেও দুষ্টবুদ্ধি চাপলো। সে সালাম নিলো প্রিয়ার। তারপর উল্টো সেও বললো,

জ্বী, ভাবী ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ভাবী?

এদের দু’জনের কথোপকথনে বাকি’রা হতবাক। কিন্তু বেচারি লুবনা আবারও একরাশ হতাশায় ডুবে গেলো। ইশ! সেও যদি এরকম কাউকে বিয়ে করতে পারতো।

পরশ দু’বান্ধুবীর খুঁনসুটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। অবশ্যই রাঢ়ীকে বউ হিসেবে পেয়ে সে ধন্য। মেয়েটা অনেক বুঝদার। এত অল্প বয়সে খুব সহজে তাদের পরিবারকে গুছিয়ে নিয়েছে। সে রাঢ়ীকে একপাশে ডাকলো। রাঢ়ীও গুটি গুটি পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। পরশ তার দিকে মিষ্টি করে হেসে বললো,

তুমি এখানেই থাকো। দূরে কোথাও যেও না। আমি সৌরভের কাছে আছি। কেমন? কিছু প্রয়োজন হলে কল দিও। মনে থাকবে তো।

রাঢ়ীও মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়ালো। তাদের দু’জনের গোপন আলাপন দেখে প্রিয়া তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

রাঢ়ী তোরা এখানে এসেও রোমান্স করছিস? বাসায় কি করিস সারাদিন?

প্রিয়ার মুখে এমন কথা শুনে রাঢ়ী অবাক হয়ে গেলো। তবে মনে মনে পরশকে দুষলো। সব তার দোষ, কি দরকার ছিল সবার সামনে কথা বলার? পরশ কিছু বললো না। হাসতে হাসতে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

প্রিয়ার নির্লিপ্ত ছাউনি প্রধান ফটকের দিকে। তার সৌরভ কবে আসবে? তাকে দেখছে না অনেক্ষণ ধরে। তার ভাবনার মাঝেই চোখ পড়লো অতি সুদর্শন শ্যামবর্ণ বলিষ্ঠ এক যুবকের দিকে। গায়ে কালো স্যুটকোট পরা, গলায় মেরুন রঙের ট্রাই বাঁধা আর পায়ে কালো বুট। এই অত্যন্ত অপরুপ পুরুষটি তার নিজের একান্তই প্রিয় মানুষ। সে আরও একবার এই পুরুষটির প্রেমে পড়লো। সেই প্রথমদিনের মত। সেদিন তিন তলার বারান্দা থেকে সদ্য জগিং করে আসা এই যুবককে দেখে সে থমকে গিয়েছিলো। তার পরনে সেদিন শুধু টাউজার আর গায়ে টিশার্ট ছিলো। কত মুগ্ধতায় সে তাকিয়ে ছিল সেই অপরূপ যুবকের দিকে। তবে বেশিক্ষণ থাকাতেই পারিনি লজ্জায়। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে কতবার এই পুরুষকে দেখেছে। সে হিসেব কি এই পুরুষ জানে। সে মুচকি হাসলো নিজের কথা ভেবে। তার নিজেরই তো সাহস নেই বলার,

আমি যে আপনাকে ভালোবাসি সেই তখন থেকে। আমিও তো আপনার অন্তরালের প্রেমিকা।

প্রিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে এখনো। কিন্তু ততক্ষণে হৈচৈ লেগে গেছে। সৌরভ গৌরব দু’জন একরকম সাজ দিয়ে এসেছে। দু’জনেই আলিশবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আলিশবাকে পরীক্ষা করার জন্য। বলতে হবে এখানে গৌরব কে?

আলিশবা কেনো যেনো দ্বিধায় পড়ে গেলো। সত্যিই আজকে দু’জনকে একদমই আলাদা করা যাচ্ছে না। প্রিয়া এগিয়ে এলো সামনে। কিন্তু তাকে পরশ নিষেধ করলো। আজকে প্রিয়া ভাবী কোনো কিছু বলতে পারবে না। আলিশবা ভাবীর পরীক্ষা চলছে।

আলিশবা মনে মনে হাসলো। এই বদ দু’ভাইকে পিঠানো দরকার। এভাবে ভরা মজলিসে তার সম্মান নিয়ে টানাটানি। কিন্তু সে বিচক্ষণতার সাথে কিছু ভাবলো।

তারপর এগিয়ে এসে সে গৌরবের নাক টেনে ধরলো। গৌরব চিৎকার দিয়ে উঠল।

ওমাগো! কি বউরে তার।

উপস্থিত সবাই হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। গৌরব বউয়ের হাত ধরে স্টেজে গিয়ে উঠে। আলিশবার পাশে বসে ফিসফিস করে বললো,

বউ তুমি কিন্তু ইদানীং ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছো। এভাবে কেউ জামাইয়ের নাক ধরে টানে। ছিঃ! কি লজ্জার কথা। আমি এই মুখ কেমনে দেখাবো বলো।

আলিশবা রক্তিম চোখে তাকালো গৌরবের দিকে। তারপর ফিসফিস করে বললো,

তোমাদের দু’ভাইকে গণধোলাই দেওয়া উচিৎ। তোমরা আমাদেরকে কনফিউশানে রাখো শুধু। প্রথমে তো আমিও ভয় পেয়েছিলাম। যদি ভুল করি তো মান-সম্মান সব যাবে আজ। কিন্তু কথায় বলে না। একরকম দেখতে হলেও তোমাদের মাঝেও কিছু ভিন্নতা আছে। তাই তো আমিও তোমাকে ধরে ফেলেছি।

গৌরব আলিশবার কথা শুনে হেসে উঠল। কিন্তু পরক্ষণে আবার বলে উঠল,

জমজ হয়ে যদি মানুষকে একটু কনফিউশানে না রাখি কেমনে হবে। এটাই তো জমজ হওয়ার আসল ফায়দা।

খাওয়া দাওয়ার মাঝে চলছে জমজমাট আয়োজিত গৌরব আলিশবার রিসিপশানের অনুষ্ঠান। এত মানুষের ভীড়ে আকস্মিক এক ছেলে এসে প্রিয়াকে বলে,

হ্যাই, মিস আপনার নাম্বার পাওয়া যাবে।

প্রিয়া প্রথমে চমকালো অচেনা ছেলেটির কথা শুনে। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। কারণ তার থেকে অদূরে দাঁড়ানো তার একমাত্র ব্যক্তিগত পুরুষ আছে। সে মনে মনে হেসে কুটি কুটি। দেখা যাক তার জামাই কি করে? সৌরভ প্রিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো অচেনা ছেলেটি তার কাছে নাম্বার চাইছে। তার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে চাপ পড়লো। আরে তার বউ নিয়ে টানাটানি। ভাবা যায়। সে দৌঁড়ে আসে প্রিয়ার কাছে। তারপর তার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে প্রশ্ন করলো,

পছন্দ হয়েছে।

ছেলেটি সৌরভের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় প্রথমে। পরে লাজুক ভঙ্গিতে বলল হুম হয়েছে। সৌরভও সুযোগ বুঝে বললো,

তাহলে মেয়ের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাবে?

ছেলেটি এটা শুনে ভড়কে গেলো। সে তো মেয়েটির সাথে মজা করতে এসেছিল। বিয়ে নিয়ে তো কিছু ভাবে নি এখনো। আগে মেয়েটির সাথে আলাপ করবে তারপর না হয় অন্যচিন্তা ভাবনা করবে। সে সৌরভের জবাব দিতে ইস্ততঃবোধ করছিল। তাই দেখে সৌরভ বললো,

কি ব্যাপার! এত ছোট প্রশ্ন করলাম উত্তর দিতে পারছো না।

ছেলেটা আমতা আমতা করছিলো তখনো। কিন্তু সৌরভ প্রিয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,

সী ইজ ম্যাই ওয়াইফ। আর কিছু জানা লাগবে।

ছেলেটি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সৌরভের দিকে। তারপর দু’হাত জোড় করে তার কাছে ক্ষমা চাইলো।

ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন ভুল হবে না। তারপর প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল সর‍্যিই ভাবী ভুল হয়ে গেছে, আসি।

ছেলেটা যাওয়ার পর সৌরভ প্রিয়ার হাত শক্ত করে ধরলো। তারপর কপাল কুঁচকে বলল একদম আমার সাথে সাথে থাকবে। দূরে যাবে না। কখন অন্য কেউ এসে আমার বউ নিয়ে চলে যায় তার কোনো ঠিক নেই। আমার একটাই বউ শুধু।

চলবে,,,,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে