#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৪
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
প্রিয়ারানী তাহলে সত্যিই আমার সাথে ডেটে যেতে যান, ঠিক আছে চলেন। কিন্তু একটা শর্ত আছে। আমি যদি উল্টা পালটা কিছু করি তখন কিন্তু বেহায়া, অসভ্য বলে গালি দেওয়া যাবে না।
এদিকে প্রিয়ার কোনো হেলদোল নেই। সৌরভের কথা সে নিশ্চুপ শুনে যাচ্ছে। তার মনে এই মূহুর্তে অভিমানের বড্ড পাহাড় জমে আছে। সেইটা হয়তো সৌরভের সম্পূর্ণ অজানা। প্রিয়া সৌরভ থেকে সরে বসতে চাইলো। কিন্তু সৌরভ তার বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে আরও শক্ত করে প্রিয়াকে আঁকড়ে ধরে আছে। সৌরভ প্রিয়ার কানে ফিসফিস করে বললো,
কি ব্যাপার ছুটতে চাইছো কেনো? নিজ থেকেই তো কাছে এলে। তাহলে আবার পালাতে চাইছো কেনো?
প্রিয়ার মুখে মলিন হাসি। সে সৌরভের দৃষ্টিতে নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,
আপনার লুবনাকে বিয়ে করা উচিৎ ছিল। মেয়েটা আপনাকে বড্ড ভালোবাসে।
আচম্বিত প্রিয়ার মুখে এহেন বাক্য শুনে সৌরভ স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে ভেবে পায় না এই মেয়ে আচমকা এমন কথা কেনো বলছে? তার মাথা ঠিক আছে তো? সে কেনো লুবনাকে বিয়ে করতে যাবে? সেও সম্পূর্ণ দৃষ্টি স্থির রেখেছে প্রিয়ার দৃষ্টিতে। তার জিগ্যেসু দৃষ্টি অনেক প্রশ্ন করতে চাইলেও সে করলো না। রগড় গলায় বলল,
তাহলে তোমার সতীনের সংসার করার ইচ্ছে আছে দেখছি। আগেই বললে পারতে। এই যে পিউ সেও আমাকে বড্ড ভালোবাসে। আমাকে বড্ড ভালোবাসে এরকম আরও অনেকজন আছে সবার লিষ্ট করে নিও একদিন। তারপর সবাইকে একসাথে বিয়ে করে নেবো। কেমন!
প্রিয়ার মুখটা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। সৌরভ কেনো তাকে বুঝে না। সে তো এখন বললেই পারত আমি তো আমার প্রিয়ারানীকে ভালোবাসি। অন্য কাউকে কিভাবে বিয়ে করবো। প্রিয়ার অভিমানের পারদ থরথর করে বাড়তে লাগলো। একে তো তাকে কলেজ থেকে আনতে যাইনি। তার উপর পিউর সাথে বসে রেষ্টুরেন্টে ডেট করছে। সে যে কলেজ ফটকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো সেই হুঁশও তার নেই। থাকবে কেনো? প্রাক্তনকে পেয়ে তার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। নাজমা আন্টি তো লুবনার সাথে বিয়ের কথা অনেকটাই পাকা করে ফেলেছিল তাহলে তাকেই বিয়ে করতো। তাকে কেনো শুধু শুধু বিয়ে করল? প্রিয়া সৌরভের কথার জবাব দিলো না। তার বক্ষস্থলে তো চাপা অভিমান জমে আছে।
সৌরভ প্রিয়ার কোনো জবাব না পেয়ে পুনরায় রগড় গলায় বললো,
তা কবে বিয়ে করতে হবে এদেরকে?
প্রিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো সে সৌরভ থেকে ছুটতে চাইলো। ধস্তাধস্তি করছিল বেশ। সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
আমি বাসায় যাবো। ছাড়ুন।
“তুমি বাসায় যাবে। কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম আমার সাথে তুমি ডেটে যাবে।”
“আপনি ঐ পিউর সাথেই ডেট করেন। কেমন! আমি চলে যাবো। ছাড়ুন আমাকে।”
“যদি না ছাড়ি কি করবে?”
প্রিয়ার মুখে বক্র হাসি। সে আলগোছে সৌরভের গেঞ্চির ফাঁক গলিয়ে তার হাত ঢুকিয়ে দিলো। তারপর খুব জোরে সৌরভের উদরে চিমটি কাটলো। সৌরভ আহ্! করে চিৎকার দিয়ে উঠল। আর এই সু্যোগে প্রিয়া পগারপার। তাকে আর কে পায়?
সৌরভ হতভম্ব হয়ে বসে আছে। তার বউ তাকে বেশ বড়োসড়োই চিমকি কেটেছে। কিন্তু মুখে তার প্রশান্তির হাসি। তার চিৎকার শুনে পাশের কেবিন থেকে এক ভদ্রলোক উঠে এলেন। বয়স সম্ভবত ত্রিশের কোঠায় হবে। ভদ্রলোক কাছে এসে সৌরভের সামনে মুখ প্রশস্ত করে হাসলেন। সৌরভকে ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,
ভাই টিনেজার বিয়ে করেছেন।
সৌরভ ভদ্রলোকের কথা শুনে হাসলেন।
ভদ্রলোক সৌরভের হাসি দেখেই যা বুঝার বেশ ভালোভাবে বুঝে ফেলেছেন। নিজ থেকেই আবারও বললেন,
টিনেজার বউ কিন্তু বেশ মারমুখী হয়। এরা কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে। আপনার নতুন বিয়ে হয়েছে বুঝাই যাচ্ছে। দু’এক বছর কিন্তু বেশ ভোগাবে আপনাকে। পরে অবশ্যই,,, বাকি কথা বলার আগেই তাদের সামনে এক নারী ছায়ামূর্তি এসে দাড়ায়। ভদ্রলোক আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। সেই নারী ছায়ামূর্তিই বললো,
আর তোমরা ছেলেরা ধোয়া তুলসীপাতা। তোমরা কিছুই করো না। সব বউয়ের দোষ।
সৌরভ এদের কান্ড দেখে হাসলো। কিন্তু আর বেশিক্ষণ বসলো না। ভদ্রলোক আর তার বউকে বিদায় বলে দ্রুতই বের হয়ে গেলো। তার যে রণচণ্ডী বউকে সামলাতে হবে।
রেষ্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই তার রণচণ্ডী বউকে খুঁজতে লাগলো। খুঁজে খুঁজে অবশেষে দেখলো সে রিকশা করে চলে যাচ্ছে। সৌরভ আর দেরি করলো না সেও প্রিয়ার পিছু পিছু বাইক নিয়ে ছুটলো।
কিঞ্চিৎ ব্যবধানে প্রিয়ার রিকশা আর সৌরভের বাইক পাশাপাশি চলছে। সৌরভ বাইকের গতি কমিয়ে রেখেছে। প্রিয়া লজ্জায় আর তাকাচ্ছে না। কিন্তু সৌরভ মিট মিট করে হেসে যাচ্ছে। সৌরভ আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
ম্যাডাম, আপনি আমার সাথে ডেট করবেন বলে এখন রিকশাই কেনো যাচ্ছেন। রিকশা থেকে নামুন।
প্রিয়া সৌরভের দিকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাকালো। সত্যিই যদি এখন তাকে কোথাও নিয়ে যাই। সে নামতে চাইলো না। কিন্তু সৌরভ রিকশার সামনে গিয়ে তার বাইক দাঁড় করালো। প্রিয়া ভয়ে ভয়ে রিকশা থেকে নামলো। তাকে বাইকে উঠতে বললো। সে অগত্যা বাইকে উঠলো। সৌরভ পিছনে তাকালো অগ্নিদৃষ্টিতে। কিন্তু মুচকি হেসে বললো রেষ্টুরেন্টে যেভাবে শক্ত করে ধরেছিলে ঠিক সেইভাবে এখন আমাকে জড়িয়ে ধরবে।
প্রিয়া ভালোই ফ্যাসাদে পড়েছে। সে এক হাত সৌরভের কাঁধে রাখলো। সৌরভ মিট মিট করে হাসছে। তারপর প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
আমরা এখন ডেটে যাবো অনেক দূরে কোনো এক অজানা শহরে। যেখানে থাকবো শুধু তুমি আর আমি। একটা নির্জন খোলামেলা মাঠ থাকবে। সেখানে তুমি আমার কাঁধে চুপটি হয়ে বিড়ালছানার মত গুটিশুটি হয়ে মাথা রাখবে। কিন্তু আমি দু’হাতে তোমাকে জড়িয়ে নেবো আমার বক্ষস্থলে। তখন তোমার উষ্ণ নিশ্বাসের প্রতিটি শ্বাস আমি মুগ্ধ হয়ে দেখবো অপলক। তোমার তির তির করে কাঁপা ওষ্ঠদ্বয়ও আমাকে ভীষণভাবে টানবে তখন। হয়তো তখন নেশাকাতুর হয়ে সেখানে ডুবে যেতে পারি অনিমেষ। হয়তো আরও কত নিষিদ্ধ চাওয়াও জাগ্রত হতে পারে। তারপর নিজেদের ভুবনে হারাবো আমরা, যেখানে অন্যদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমাদের ডেট কেমন হবে প্রিয়ারানী?
প্রিয়ার তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। সে এখন কোথাও যাবে না। সে সৌরভকে অনুরোধ করলো তাকে এখন কোথাও না নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে তো এমনিই মজা করেছে ডেটের কথা বলে।
কিন্তু সৌরভের মুখে কুটিল হাসি। সে প্রিয়ার অনুরোধ শুনলো না। বাইক ঘুরিয়ে অন্য রাস্তার দিকে ছুটলো। প্রিয়া ভয়ে হাঁসফাস করতে লাগলো। কিন্তু দীর্ঘভ্রমণের পর সৌরভের বাইক তাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালে সে পুরাই হতবাক হয়ে গেলো। প্রিয়া দ্রুত নামলো বাইক থেকে কিন্তু সৌরভ পিছন থেকে তার হাত খপ করে ধরে ফেললো। প্রিয়াকে তার সামনে নিয়ে এসে ক্ষীণস্বরে বললো,
রেষ্টুরেন্টে যা করেছো তার জন্য কিন্তু তোমাকে আমি মাফ করবো না। মহা অন্যায় করেছে তুমি আমার সাথে। কেউ নিজের স্বামীর সাথে এরূপ ব্যবহার করে। তুমি আমার কাছে এখন মাফ চাইবে। আমি যতক্ষণ না ক্ষমা করছি তার আগে বাসায় প্রবেশ করতে পারবে না।
প্রিয়ার এবার ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। সে সৌরভকে আমতা আমতা করে বললো,
সর্যিই, আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিন।
সৌরভ প্রিয়ার সরি একসেপ্ট করলো না। সে প্রিয়ার হাত আরও শক্ত করে ধরলো। তারপর আবারো ক্ষীণস্বরে বললো,
প্রথমে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। তারপর রেষ্টুরেন্টে যেভাবে হাসি-খুশি মুখে বলেছো। ঠিক সেইভাবে বলবে জামাইটা সরি ভুল হয়ে গিয়েছে। আর কখনো করবো না।
প্রিয়া বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো সৌরভের দিকে। শুকনো ঢোক গিলল সে। এভাবে বলা তার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। সে ভয়ে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। পুরো শরীর হিম হয়ে গেছে তার সৌরভের কথা শুনে। লজ্জায় যখন কাঁচুমাচু করছিলো। আচমকাই কারো রগড় গলায় বলা কথা শুনে সে থমকালো।
তিন তলার বারান্দা থেকে গৌরব প্রিয়া আর সৌরভকে দেখতে পায়। তারপর সে মুচকি হেসে বলে উঠল,
এ্যাই যে নিউ কাপল, রোমান্স করার হলে রুমের দরজা বন্ধ করে করুন। কেউ দেখবে না। কিন্তু দয়া করে এভাবে খোলামেলা রোমান্স করতে যাবেন না। এতে আপনাদের ভবিষ্যৎ বাচ্চারা নির্লজ্জ হবে কিন্তু।
সৌরভ ভাইয়ের ইশারা বুঝলো। সে দ্রুতই প্রিয়ার হাত ছেড়ে দিলো। কিন্তু যাওয়ার আগে প্রিয়াকে বলল,
রাতে ছাদে আসবে কিন্তু। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। বিয়ের রাতের সেই শাড়িটা পরে এসো কিন্তু। তোমাকে শাড়িতে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। যদি না আসো তবু্ও সারারাত অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।
প্রিয়া সৌরভের প্রতিত্তোর করলো না। সে নিশব্দে নিজের কদম বাড়ালো। সৌরভ পিছন থেকে ডাকলো,
আসবে তো প্রিয়া?
চলবে,,,,,,,,,,,,,,
#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৫
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
সন্ধ্যায় পড়তে বসার পর থেকে প্রিয়া অস্বস্তিতে ডুবে আছে। অস্থির চিত্তে বার বার আয়নায় নিজের মুখশ্রী দেখে যাচ্ছে সে। সৌরভের প্রস্তাব মত কি সে ছাদে যাবে? একচিত্ত তার না বোধক উচ্চারিত হলেও অন্যচিত্ত তার চিৎকার করছে। কেনো যাবো না। আনমনে সে লজ্জায় হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। পড়ার থেকে সৌরভের বলা সেই বাক্যেই বার বার তার মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনি হচ্ছে।
বিয়ের রাতের শাড়িটি বের করে বিছানায় রাখে। আলতো হাতে শাড়িতে হাত রেখে আপনমনে সে বিড়বিড় করে,
কি আছে এই শাড়িতে? যার জন্য সৌরবিদ্যুত তাকে পরতে বলেছে। অবচেতন মনে যখন সে নিজ কল্পজগতে ভ্রমণ করছে প্রত্যুষ এসে তার ভাবনা থেকে তাকে জাগ্রত করে।
আপু তোমাকে শোভা আপু ডাকছে।
আচম্বিত ভাইয়ের গলা শুনে প্রিয়া রাগে গজগজ করতে লাগলো। রুষ্ট হয়ে বললো,
কি ব্যাপার! ছাগলের মত ম্যা ম্যা করছিস কেনো? প্রত্যুষ বোনের কথা শুনেই মেজাজ চটে গেলো। বোনকে মুখ বাঁকিয়ে বলল আমি ছাগলের মত ম্যা ম্যা করছিনা তোর ননদ ছাগলের মত ম্যা ম্যা করে তোকে ডাকছে। প্রিয়া প্রথমে ভাইয়ের কথা বুঝতে পারেনি। পরে যখন শোভার কথা শুনলো সে চমকে উঠলো। শোভা তাকে এই সময় কেনো ডাকছে? দ্রুতই সে বের হয়ে গেলো শোভার কথা শোনার জন্য।
শোভা দরজার সামনে ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁসফাস করছে প্রিয়া কখন আসবে?
প্রিয়া দরজার অভিমুখে শোভাকে দেখে প্রথমে ইস্ততঃবোধ করছিল। পরে শোভার ভীতিত্রস্ত মুখশ্রী দেখে থমকালো। আচমকা শোভা তাকে কেনো ডাকলো। কি কারণ হতে পারে তার বোধগম্য হলো না। সে পায়ের কদম বাড়িয়ে শোভার দিকে এগিয়ে যায়।
শোভা প্রিয়াকে দেখে প্রসন্ন হলো। তার হাত টেনে করিডোরের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেলো। প্রিয়া হতচকিত হয়ে গেলো শোভার আকস্মিক হেঁচকা টানে। প্রিয়া ভালো করে লক্ষ্য করলো শোভার মুখে কেমন দুশ্চিন্তার বলিরেখা উদীয়মান। ভয়ার্ত অক্ষিযুগল আর অস্থির বদনে এলোমেলো কদমে মেয়েটাকে বড্ড অশান্ত দেখাচ্ছে। প্রিয়া ব্যগ্রকন্ঠে বললো,
কি হয়েছে আপু? তোমাকে এত অস্থির লাগছে কেনো?
শোভার নিষ্প্রভ ছাউনি সে ইতিউতি করছিলো। লম্বা দীর্ঘশ্বাস টেনে ক্ষীণ স্বরে বলল,
সাফিন এসেছে।
প্রিয়ার কৌতুহলী জবাব, কোন সাফিন?
আমার বয়ফেন্ড সাফিন।
প্রিয়া কিয়ৎক্ষন ভাবলো। সে আধো সাফিন নামে কাউকে চিনে কিনা? পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
সাফিন, কোন সাফিন?
শোভার মলিন মুখে তখন বিষাদের ছায়া। সে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলল,
একদিন তুমি আমাকে যে ছেলের সাথে দিঘির পাড়ে দেখেছো, সেই ছেলের নাম সাফিন। সে আমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রিয়া হতবিহ্বল শোভার কথায়। সে কি উত্তর দিবে সেটাই বুঝতে পারছে না। সাফিন তাদের বাসার নিচে আসলে সে কি করবে? তার করণীয় কি এখানে? তার সন্ধিহান দৃষ্টি এবার শোভার দিকে।
এখন আমাকে কেনো ডেকেছো সেটা বলো?
শোভার মুখে করুণ অসহায়ত্বের সুর। সে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
সাফিনের সাথে আমার ব্রেকাপ হয়ে গেছে। কিন্তু সে এখন আমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে? তার সাথে আমি কথা বলি না আজ এক মাস। আমার ভয় করছে প্রিয়া। সাফিন এখানে কি চাইতে এসেছে। আম্মু-আব্বু যদি জানে আমাকে মেরে ফেলবে। আমার প্রচন্ড ভয় করছে। প্রিয়া আমি কি করবো এখন বলো?
প্রিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে লম্বা করে শ্বাস টানলো। সে কিছুক্ষণ ভাবলো শোভার বলা কথায়। তারপর বিচক্ষণতার সাথে বলে উঠলো,
চলো আপু, দেখে আসি কেনো আসছে তোমার এই সাফিন। চিন্তা করো না, আমি আছি তো। যদি কোনো কু-মতলব থাকে তো ব্যাটাকে ঝাটা পিঠা করবো?
প্রিয়ার মজাচ্ছলে বলা কথায় শোভা হেসে উঠলো।
দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। কিন্তু এদিক ওদিক খুঁজেও আর সাফিনকে পাওয়া গেলো না। প্রিয়া হতাশ হলো সাফিনকে না পেয়ে। শোভা তখনো ভয়ার্ত নজরে এদিক ওদিক তাকালো। যদি আবার সাফিন ফিরে আসে। প্রিয়া আলগোছে শোভার একহাত ধরলো। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি তার কিন্তু মুখে কাঠিন্যে ভাব,
আপু একদম ভয় পেয়ো না। আমি আছি তো। তোমার কিছু হবে না। ঐ সাফিন-টাফিন তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না।
প্রিয়ার এমন আশস্ততায়ও শোভার মুখে মলিন হাসি। সে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠল,
বিয়ে করে তুই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস। তবে ভাবী হিসেবে তোকে পেয়ে আমি অনেক ধন্য। আমার ভাই সত্যিই জিতে গেছে’রে তোকে পেয়ে।
শোভার এহেন বাক্য শুনে প্রিয়া লজ্জায় বিগলিত হলো। কিন্তু তার মুখেও আত্মতুষ্টির হাসি। সেও তো জিতেছে তার সৌরবিদ্যুৎকে পেয়ে।
রুমে এসে আবার বই নিয়ে বসলো প্রিয়া। কিন্তু পড়ায় আর মনোযোগ দিতে পারলো না। মন তার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। এক সৌরভের জন্য দুই শোভার সেই উদ্বিগ্ন মুখশ্রীর জন্য। তবে সাফিনের সাথে তার ব্রেকাপের ব্যাপার টা ভাবাচ্ছে বেশ। তাদের মধ্যে ব্রেকাপ কি নিয়ে হয়েছে?
_______________________
সৌরভ চেয়ারে হেলান দিয়ে দুই চোখ মুদে আছে। তার কল্পনার রাজ্যে আজ হাজারো প্রজাপতির মেলা। বদ্ধ আঁখিতে সে তার প্রিয়তমার আদুরে মুখখানি খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার চঞ্চলতা, চপলতা আর লাজুকতায় আজকাল ভীষণ নেশা ধরে গেছে। মেয়েটা দিন দিন তার মস্তিষ্কে ঘাঁটি গড়ে তুলছে। সময়গুলো কিভাবে কাটবে তার, সেই দুশ্চিন্তায় সে অস্থির। ইচ্ছে করে মেয়েটার মাঝে ডুবে থাকতে। কি এক মায়াময়ী মুখশ্রী তার প্রিয়ার। মেয়েটার হাসি যেনো নেশাময় সরোবর। যা দেখতে দেখতে তার সময় ফুরিয়ে যায় কিন্তু দেখার শেষ হয় না। আনমনে প্রিয়ার কথা ভেবে সে মিট মিট করে হেসে উঠে।
আহারে! তোর বিরহে আমার কলিজা ফেটে যায়। আয় ভাই আয়, আমার বাম কাঁধ তোকে পুরাই দান করলাম। তুই সেখানে মন চাইলে ইচ্ছেমত ঠুকরে ঠুকরে কাঁদতে পারিস। আমার কোনো সমস্যা নেই’রে ভাই।
গৌরবের রসিকতার স্বরে বলা কথায় চমকে উঠে সৌরভ। যদিও তার ভাই তার মজা উড়ানোর জন্য বলেছে। কিন্তু সত্যিই তার ইচ্ছে করছে তার ভাইয়ের কাঁধে গিয়ে ঠুকরে ঠুকরে কাঁদতে। তার বেহায়া মনটা বড্ড বউ বউ করে আজকাল। সত্যিই তার মনটা নিলর্জ্জ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
ঘড়ির কাটায় রাত ১১টা ৩০।
প্রিয়ার গায়ে লাল পাড়ের কালো শাড়ি জড়ানো। সিঁথিহীন বাঁকানো চুলগুলোকে অর্ধবেণী করে পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়েছে। মুখে হালকা প্রসাধনী মেখেছে সে। অধরযুগলও সাজিয়েছে হালকা গোলাপি লিপজেলের আবরণে। তার সাজ একদম শেষ। কিন্তু বক্ষস্থলে ঢিপঢিপ শব্দের গতি বেড়েই চলেছে। দুরুদুরু বুকে সে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। বাবা-মায়ের রুম অন্ধকারের অপেক্ষা করছিলো এতক্ষণ। তাদের ঘুমানোর পরেই সে এতক্ষণে বেরিয়েছে।
ধীরে ধীরে দরজার হাতল খুলে সে বেরিয়ে পড়ে।
মারিয়া মেয়ের কান্ড দেখে নিঃশব্দে হেসে উঠে। আনোয়ার মারিয়াকে হাসতে দেখে অবাক হয়ে গেলো। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
এত রাতে তোমাকে ভূতে ধরলো নাকি?
মারিয়া জামাইর দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে আছে। রসকষহীন কাঠখোট্টা জামাই একটা পেয়েছে সে। পুরাই খচ্চরের খচ্চর।
সিঁড়ি বেয়ে প্রিয়া যতই ছাদের নিকটে যাচ্ছে ততই তার হৃদকম্পনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আর দু’কদম বাড়ালেই তার পা ছাদ স্পর্শ করবে। উষ্ণ নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে তার মুখের চারপাশে। চোখ বন্ধ করে সে লম্বা শ্বাস ছাড়লো। তারপর সাহস সঞ্চার করে ছাদের দরজায় প্রবেশ করলো। মুহুর্তে কি হলো তার কিছুই সে বুঝলো না। অতর্কিত তার মাথায় ফুলের বর্ষণ হলো। এই ফুলের উৎপত্তি খুঁজতে মাথার উপরে তাকালো। সেখানে কোনো মানবের ছায়া খুঁজে পেলো না। সে যারপরনাই অবাক হলো। তাহলে তাকে ফুল বর্ষণ কে করছে। আরও দু’কদম পা বাড়াতেই এক অনন্য সৌন্দর্যের সাথে সে পরিচিত হলো।
দু’পাশে ক্যান্ডেল, মাঝে গোলাপের পাঁপড়ির প্রশস্ত রাস্তা তার জন্য। কিছুদূর যেতেই চমকে উঠলো গাছে ঝুলন্ত এক প্লাকার্ড দেখে।
Welcome to you into My Life.
My Queen.
লাজুকতায় মূর্ছিত হলো বার বার সে। কিন্তু মুখে তার তৃপ্তিময় এক প্রজ্জ্বলিত হাসি। চারপাশে চোখ বুলালো কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দর্শন করতে। কিন্তু তার দৃষ্টি ফেরানোর আগেই অনাকাঙ্ক্ষিত এক কন্ঠস্বরে সে থমকালো।
এসো প্রিয়ারানী তোমার আপন ঠিকানায়। সৌরভ তার এক হাত মেলে দিয়েছে প্রিয়ার দিকে। প্রিয়ার বিস্ময়কর দৃষ্টি তখন সৌরভের দিকে। সে ভেবেই পাই না সত্যিই সৌরভ তার জন্য এগুলো করেছে। বিশ্বাসই করতে পারছে না।
সৌরভ নিজ থেকেই প্রিয়ার কম্পিত হাতখানা ধরে নিলো। তারপর তাকে বাগানের মাঝে ফুল সজ্জিত দোলনায় নিয়ে বসালো। প্রিয়া বিস্মিত নয়নে সৌরভের কান্ড দেখেই যাচ্ছে। সৌরভ দৈবাৎ প্রিয়াকে তার বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে জড়িয়ে নিল। প্রিয়ার ললাটে আচমকা একটা চুমু খেয়ে নিলো। তারপর তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
সেই প্রথম দিনের মত অনূভুতি হচ্ছে আমার।
প্রিয়া কিঞ্চিৎ অবাক হলো। কম্পিত গলায় বললো, মানে।
সৌরভ মিট মিট করে হাসলো। তারপর প্রিয়ার মুখে নিজের দু’হাত আঁকড়ে ধরে বললো,
জানো, প্রথম যেদিন তুমি আমাকে কামড় দিয়েছিলে। সেদিন ঠিক এমন একটাই অনূভুতি হয়েছিলো আমার। সারারাত আমি দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। তোমার ছোঁয়ায় যে শিহরণ আমি অনুভব করেছি তা আর কখনো কারো ছোঁয়াতে পায়নি। তাই তো তোমাকে খুব করে চেয়েছি। তোমার দু’আঁখিতে আমি নিজের সর্বনাশ দেখিছিলাম সেদিন। সত্যিই আমার জীবনের মহা সর্বনাশ করে দিয়েছো প্রিয়ারানী।
প্রিয়া লাজুকতায় আরও একবার মূর্ছিত হলো। কিন্তু তার মন ছিল ব্যকুলতায় পরিপূর্ণ। কিছু না পাওয়ার হতাশা। সে আক্ষেপের সুরে বললো,
তাহলে কখনো প্রপোজ করেন নি কেনো?
সৌরভ বিস্মিত হলো প্রিয়ার কথায়। এই মেয়েকে প্রপোজ করলে আধতে কি সে গ্রহণ করতো। কিন্তু তার শ্বশুর যে তাকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কোনো প্রেম-টেম করা যাবে না। তাই তো সে বাধ্য হয়ে প্রিয়ার থেকে দূরে থাকতো। তার মুখেও হতাশার সুর। সে প্রিয়াকে কোমল গলায় বললো,
আমার শ্বশুর মশায়ের কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল আমার উপর। মেয়ের সাথে কথা বলা যাবে না। তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া যাবে না। তার থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। তবে মেয়েকে নজরবন্ধি রাখা যাবে। তাই তো তোমাকে প্রপোজ করেনি।
প্রিয়ার মনে দুষ্টবুদ্ধি চাপলো। সে শান্ত আর গম্ভীর গলায় বললো,
ঠিক আছে। আপনার কথা মানলাম। কিন্তু এখন আমাকে প্রপোজ করেন।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,