#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩০
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
গৌরব পুরাই ‘থ’ হয়ে বসে আছে। সে প্রিয়ার দিকে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল তুমি কি করে চিনলে আমাকে?
প্রিয়া লাজুক হাসলো। মনে মনে বলল না চিনার কি আছে? একি রকম দুটি মানুষ যেমন হয়, তেমনি অনূভুতিও আলাদা হয়। কিন্তু মুখে হাত দিয়ে সে তার লজ্জা ঢাকছে। গৌরব মাথায় হাত দিয়ে হায় হায় করতে করতে নিচে নামলো। সৌরভ তার ভাইকে দেখে লাজুক হাসছে। কিন্তু মনে মনে ভীষণ খুশি তার প্রিয়ারানী তো তাকে খুব ভালো ভাবেই চিনে তাহলে।
সৌরভ নিজ থেকে উঠে স্টেজে প্রিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এদিকে পুরো বিয়ে বাড়ির লোকজন অবাক হয়ে দু’ভাইয়ের কান্ড দেখছে। কেউ অবাক আবার কেউ হতবাক। আসল বর কে? এই নিয়ে এখনো দো’টানায় আছে সবাই।
গৌরব এবার সবার উদ্দেশ্য বলল,
দেখুন আঙ্কেল-আন্টি, ভাই-বোনেরা আপনারা বর কে না চিনলেও যার বর সে কিন্তু ঠিকই চিনে ফেলেছে। আর এই যে আমাকে দেখছেন আমি আপনাদের বরের থেকে গুণে গুণে নয় মিনিট ৫৮ সেকেন্ড আগে পৃথিবীতে আসছি। সেদিক থেকে আমি আপনাদের বরের বড়ো ভাই। তাই আমিই প্রিয়ার একমাত্র ভাসুর। আর আমার পাশে যে একটা পরী দেখছেন ঐটা আমার একমাত্র বউ। তার পাশে যে ছোট্ট দুষ্ট মিষ্টি একটা বাচ্চা দেখছেন সেটা আমারই ছেলে। গৌরবের কথায় আলিশবা ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলো। এ লোকটা এত ঠোঁটকাটা কেনো?
গৌরবের কথা শুনে উপস্থিত সবার মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেলো।
প্রীতি, সামান্তা আর প্রিয়ার কাজিনগুষ্টি মিলে হৈ চৈ করা শুরু করলো। তারা গৌরবের সামনে গিয়ে বলল সত্যি করে বলেন তো মালা কি আমরা আপনাকে পরিয়েছি। গৌরব দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বলল হুম। এবার তো এদের চোখ কপালে উঠলো। এভাবে ধোঁকা দিলো। গৌরব এদেরকে বলল দেখো আমার কোনো দোষ নাই। সব দোষ তোমাদের দুলাভাইয়ের সেই বলছে আমাকে মালা পরতে। তো আমি কি করবো?
প্রীতি ভ্রু কুঁচকালো। এই দুই ভাই বদের হাড্ডি।
সে যেতে নিলে সানি বলে উঠল বেয়াইন আপনি ভ্রু কুঁচকালে রাক্ষুসি রানী কটকটির মত লাগে। প্রীতি আলতো করে হাসলো। তাই না’কি! আর আপনাকে সাদা ভূত ডংকারের মত লাগে। প্রীতির কথা শুনে পরশ আর রকি হো হো করে হেসে উঠে।
সানি বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছে। এই মেয়ে তার একটা কথাও মাটিতে পড়তে দেয় না। সব কথার পিঠে উত্তর দিয়ে দেয়।
প্রিয়ার হাতে মালা সে এখনো চেপে ধরে আছে। সৌরভ নিজের মালা প্রিয়ার সামনে এগিয়ে গিয়ে পরিয়ে দিয়েছে। প্রিয়াকে মালা পরাতে বলছে সবাই। সে তো লজ্জায় মুখই তুলতেই পারছে না। মালা পরাবে কিভাবে? মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। সৌরভ বুঝলো এই মেয়ে তাকে সারাদিনেও মালা পরাবে না। তাকেই কিছু করতে হবে। সে মাথা নিচু করে প্রিয়ার একদম মুখের সামনে গিয়ে বলল এই যে রানী সাহেবা এবার পরান। দেখতি পাচ্ছি আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে।
প্রিয়া তো সৌরভকে তার এত কাছে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলো। লজ্জায় কাচুমাচু করছিলো। শেষে সৌরভ নিজেই প্রিয়ার দু’হাত ধরে মালা পরে নিলো।
প্রীতি প্রিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো হাও রোমান্টিক! প্রিয়া আরো অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। প্রিয়ার সামনে আচমকা পরশ এসে দাঁড়ায়। কিন্তু সে অবাক হয় পরশের সাথে রাঢ়ীকে দেখে। সে বেনারসী শাড়ি পরে নববধূ সেজে পরশের সাথে এসেছে। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পরশ বলল,
মিট মাই ওয়াইফ।
প্রিয়া বিস্মিত নয়নে তাকালো রাঢ়ীর দিকে। সে তো তখন লজ্জা ঢাকতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু প্রিয়ার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে রাঢ়ীর উপর। রাঢ়ী তখন আমতা আমতা করছিল। কিন্তু সেও প্রিয়াকে লজ্জা দিতে ভুললো না। তুই সৌরবিদ্যুৎ কে বিয়ে করলি কিভাবে? প্রিয়া অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। সুযোগ পেলে এই মেয়েকে সে নালার পানিতে চুবাবে।
মালাবদল শেষে প্রিয়ার চাচা-চাচীরা সবাই এসে তাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে যাই। আনোয়ার, মারিয়া এসে প্রিয়ার হাত সৌরভের হাতে তুলে দেয়। প্রিয়া নিশব্দে কেঁদে উঠে। আনোয়ার মেয়েকে বুকে চেপে ধরেন। প্রিয়াকে এভাবে কাঁদতে দেখে গৌরব মাঝখান থেকে বলে উঠে,
আরে থাকবে তো বাবার বাড়ি। মাঝে মধ্যে জামাইয়ের কথা মনে পড়লে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যেতে পারো। তাও কাঁদছো কেনো?
গৌরবের কথায় প্রিয়া লজ্জায় কাঁদতেও পারে না।
প্রিয়া আর সৌরভকে তার দাদার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তার দাদা দু’জনের সাথে একান্তে কিছু কথা বলেন। সৌরভকে কাছে নিয়ে ডেকে বলেন আমার পাগলিটাকে দেখো। সৌরভ মৃদুহেসে জবাব দিলো। খুব ভালো যত্ন নিবো তার, একদম চিন্তা করবেন না। সৌরভের হাতে প্রিয়ার হাত রাখে ওর দাদা। বিড়বিড় করে বলে উঠল সুখী হও তোমরা।
রাত ১০টা।
সৌরভের পরিবারের কাউকে বাড়িতে যেতে দেননি। সবাই রাতে এ বাড়িতেই থাকবে। গৌরব আর আলিশবাকে আলাদা রুম দেওয়া হয়েছে। গৌরব রুমে যাওয়ার আগে সৌরভের মজা উড়াচ্ছে। ভাই তুই তো হলরুমে থাকবি তাই না। সৌরভ ভাইয়ের উত্তর দিলো না। সানি বলল না সে তো আমাদের সাথেই থাকবে। রাতে তারা গুনবে। সৌরভ নিশ্চুপ এদের কথা শুনে যাচ্ছে। আজকে কিছু বলা মানে বিপদ।
আনোয়ার এসে সৌরভের সাথে আলাদা কিছু কথা বললেন। আমি বাবা হিসেবে তোমাকে অনেক শর্ত দিলেও পুরুষ হিসেবে বলতে পারি তুমি সেই শর্তগুলো পূরণ করতে পারবে না। সৌরভ কপাল কুঁচকে শ্বশুরকে দেখলেন। শ্বশুর তার ক্লাশ নিচ্ছে। বউয়ের সাথে সে কি করবে না করবে সব কি এখন অন্যেরা ঠিক করবে নাকি? অবশ্যই না। এটা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবুও শ্বশুরের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো।
আনোয়ার বললেন তুমি আজকের জন্য অনুমতি পেতে পারো। সৌরভ কুটিল হাসলো মনে মনে। সেও শ্বশুরের পালটা জবাব দিলো অনুমতি দিতে হবে কেনো? আমি নিজেই এখন যেতে পারি। আনোয়ারও হাসলেন সৌরভের কথায়। মাথায় আলতো হাত রেখে বললেন তাও আজকের জন্য। সৌরভ মৃদু হাসলেন মুখে কিছু বললো না।
সৌরভ আর প্রিয়াকে রুমে নিয়ে আসা হলো। প্রিয়াকে ভিতরে বসিয়ে সৌরভকে দরজার সামনে সবাই ঘিরে ধরলো। সৌরভ তাদের দাবি অনুযায়ী দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদেয় করলো। রকি সৌরভকে টিপ্পনী মেরে বললো কিরে তোর দেখি আজ বড্ড তাড়া ভিতরে যাওয়ার। আস্তে ধীরে গেলেই তো পারতি। সৌরভও ফিস ফিস করে বললো বউয়ের সাথে অনেক পুরনো হিসেব বাকি আছে তাই এত তাড়াহুড়ো করছি বুঝলি। সানিও অবাক হয়ে বললো কিসের পুরনো হিসেব তোর? সৌরভ হাসলো শুধু উত্তর দিলো না।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে সৌরভ বউয়ের কাছে এসে পৌঁছেছে। দরজায় সামনে দাঁড়ানো সে। ঘরের মৃদু আলোয় স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে। সে বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। সৌরভ ধীরে ধীরে আগালো। তারপর তার সামনে গিয়ে বললো,
কি ব্যাপার জামাইকে সালাম করবে না।
প্রিয়া লজ্জায় অস্থির হয়ে উঠলো। নিশব্দে তার প্রতিটি শ্বাস নিচ্ছিলো। সৌরভকে সামনে দেখে তার দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। আর কথা তো অনেক দূরে।
সৌরভ আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। জামাইকে পা ধরে সালাম করতে হয় আগে। মুখে আমি সালাম নিবো না। প্রিয়া এখনো মাথা নিচু করে আছে। তার হৃদস্পন্দন এত দ্রুতই কম্পিত হচ্ছে যে সে হার্ট এট্যাক করেই আজ মারা যাবেই। কণ্ঠনালী দিয়ে একটা কথাও উচ্চারণ হচ্ছে না তার। সৌরভ হতাশ হলো প্রিয়ার আচরণে। সে ফের বলল সালাম তো চোখ বন্ধ করেও করা যায়। ঠিক আছে সালাম না করলে আর কি করা। কাউকে তো জোর করে সালাম করানো যায় না। এমনিতেও আমি জানি তুমি আমাকে দু’পয়সার সম্মানও দাও না। সৌরভ দুই হাত বগলদাবা করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো। প্রিয়া কি করে দেখার জন্য।
প্রিয়া অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চার করে কম্পিত হাতে সৌরভকে সালাম করলো। সৌরভ প্রিয়ার মাথায় হাত রেখে বললো,
বেঁচে থাকো বউ। জামাই-সন্তানকে নিয়ে সুখী হও।
প্রিয়াকে দাঁড় করালো সৌরভ। তারপর কুঠিল হাসলো মনে মনে। প্রিয়ার উদ্দেশ্য বলে উঠল,
তুমি কি জানো না জামাইকে সালাম করার পর কোলাকুলিও করতে হয়।
প্রিয়ার এবার হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই বজ্জাত আজ তাকে লজ্জা দিয়ে দিয়েই মারবে। সে হাত দিয়ে নখ খুঁড়ছিল বার বার। তা দেখে সৌরভ বললো ঠিক আছে যাও কোলাকুলি মাফ করে দিলাম। এবার জলদি পোশাক চেইঞ্জ করে এসো। তোমার সাথে কথা আছে। আসার সময় ওযু করে আসবে। সময় কিন্তু খুব কম আমার কাছে। দশমিনিটে ফ্রেশ হয়ে আসবে কিন্তু।
প্রিয়া চলে গেলে সে নিজেও গায়ের কাপড় খুলে রাখে। তাকেও ফ্রেশ হতে হবে।
সৌরভের কথামত সে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসে। গাড় লাল পাড়ের মধ্যে কালো রঙের জামদানী শাড়ি জড়ানো প্রিয়া। সৌরভ অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে প্রিয়ার দিকে। এই অপূর্ব রমণী তার বউ তার হৃদয়শ্বেরী। তার একান্ত প্রিয় ব্যক্তি।
এবার সে নিজেও দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসে।
দু’জনে জায়নামাজ বিছিয়ে দু’রাকাত শোকরানার নামাজ পড়ে নতুন জীবনের জন্য দোয়া করে।
সৌরভ প্রিয়াকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড় করালো। মাথার ঘোমটা সরিয়ে তার পকেট থেকে SP লিখা একটা হার পরিয়ে দেয়। প্রিয়া আয়নায় আঁড়চোখে দেখছিলো সৌরভ কি করছে? সৌরভ প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল চাইলে সরাসরি দেখতে পারো। কেউ কিছু বলবে না। প্রিয়া লজ্জায় আর তাকালো না।
সৌরভ প্রিয়ার হাতে একটা চেকবই আর ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দিলো। এটাতে তোমার মোহরানার সম্পূর্ণ টাকায় আছে। আমার ইনকামের টাকায় তোমাকে মোহরানার টাকা দিয়েছি। তবে বিয়ের পোশাক থেকে শুরু করে সব কেনাকাটা গৌরব করেছে আর বিয়ের গহনা বাবা দিয়েছে। কিন্তু মোহরানা সম্পূর্ণ আমার টাকায়। আর তোমার গলার এই হার উপহার হিসেবে আমিই কিনেছি।
প্রিয়া চুপচাপ সৌরভের কথা শুনছিলো।
সৌরভ প্রিয়াকে তার মুখোমুখি দাঁড় করালো। তার থুতনি ধরে বলল মাশা আল্লাহ আমার বউটাকে কি সুন্দর লাগছে। এবার কিন্তু আমার উপহার পাওয়ার পালা। জলদি করে আমার উপহারটা দিয়ে দাও তো বউ। প্রিয়ার কোনো নড়চড় নেই সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সৌরভ প্রিয়াকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে বলল একটা উষ্ণ আলিঙ্গন তো আমি তোমার কাছে পেতেই পারি তাই না বউ। প্রিয়াকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল তবে তুমি কিন্তু একটা রিটার্ন গ্রিফট পাও। মনে আছে সেই কামড়টা।
প্রিয়া কেঁপে উঠলো সৌরভের কথায়। লজ্জায় তার বুকেই মুখ লুকিয়ে রাখলো। কিন্ত পরক্ষণেই অনুভব করলো তার গ্রীবাদেশে সৌরভের উষ্ণ ছোঁয়া। জায়গাটা ভীষণ জ্বলছে।
প্রিয়া বিড়ালছানার মত সৌরভের বুকের মাঝে লেপ্টে আছে। সৌরভের কাছে আজকের রাতটা অনেক স্পেশাল ও অনেক কষ্টের। কারণ আগামী এক বছর এই একরাতের স্মৃতি নিয়েই তাকে বউ ছাড়া থাকতে হবে।
চলবে,,,,,,,,,,,
#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩১
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
একটা বছর দীর্ঘ সময় তাই না? জানো তো, ৩৬৫ দিন হয় কিন্তু। ততদিন আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো বউ? সৌরভের এহেন প্রশ্নে হতচকিত হয়ে গেলো প্রিয়া। সে অপেক্ষা করবে না কেনো? সৌরভ তো তার স্বামী হয়। আর স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবে না এটা কেমন অদ্ভুত প্রশ্ন করছে সৌরবিদ্যুত। তার মনে এত উৎকন্ঠা সৃষ্টি করছে কেনো? সে এসবে ভীষণ ভয় পায়? তার বক্ষস্থল ভীষণভাবে কাঁপছে। উত্তর দেবার শক্তিও যেনো ক্ষয় হয়ে গিয়েছে।
সৌরভ পুনশ্চঃ প্রিয়াকে বলল, যদি আমি হারিয়ে যাই তখন কিংবা আমাদের মিলন যদি আধুরা থেকে যাই?
ত্বরিত ঘুম ভেঙে যাই প্রিয়ার। বুক ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে। তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। এমন স্বপ্ন কেনো সে দেখলো? দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলো রাত দু’টো বাজে। কালকে রাতেও সৌরভ তার পাশে ছিল। কিন্তু আজকে তার বিছানাটা একদম শূন্য পড়ে আছে। সত্যি জীবনটা কত অদ্ভুত! এক রাতের ব্যবধানে তার জীবন কত পরিবর্তন হয়ে গেলো। কালও সে সৌরভকে স্বামী মানতে নারাজ ছিল অথচ আজ সে স্বামী সোহাগী হয়ে গেছে।
কাল রাতে স্বামীর বুকে তার নিদ্রা যাপন হলেও ভোর সকালে উঠেই সে হাওয়া হয়ে গেছিলো। এমনকি সৌরভ যাওয়ার সময়ও সে আর সামনে আসে নি। সৌরভ যে যাওয়ার সময় তাকে মনে মনে খুঁজেছিলো সে বেশ বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু সে কি করবে লজ্জায় তো তার সামনে দাঁড়াতেই পারছেনা। তাই তো সে ছাদে লুকিয়েছিল সারা সময়।
কিন্তু সেই যে সৌরভ গিয়েছে তাকে কোনো কলই দেয়নি না তার কোনো খোঁজ নিয়েছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। আর এখন নিস্তব্ধ নিশুতি রাত। তার কোনো খোঁজই রাখেনি সৌরভ। কত নিষ্টুর এই লোকটা। তাকে এক রাতেই বিরহের অনলে দগ্ধ করে ফেলেছে।
প্রিয়া জানালার পাশে আনমনা হয়ে বসে আছে। হাতের মাঝে তার মুঠোফোন। নিজের লজ্জাকে জলাঞ্জলি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির নাম্বারে ডায়াল করলো। কিন্তু বার কয়েক ডায়াল করেও সে তার নাগাল পেলো না। যতবারই ডায়াল করেছে ফলাফল একি। আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। আর কাউকে লজ্জায় কলও করতে পারছে না। তার হৃদয়টা খুব পুড়ছে সৌরবিদ্যুতকে দেখার জন্য। কবে দেখতে পাবে তাকে?
সৌরভ-প্রিয়ার বিয়ের দু’দিন পেরিয়ে গেছে।
প্রিয়ার দাদার অবস্থা আগের মতই আছে। আনোয়ারকে আজকে বাসায় ফিরতে হবে। পরশু প্রিয়ার পরীক্ষা শুরু। মারিয়া কাপড় গোছাচ্ছেন। প্রিয়া তো তড়িঘড়ি করছে কবে তারা ফিরবে। সৌরভকে দেখার জন্য সে উতলা হয়ে পড়েছে। এই লোকটা গত দু’দিনে তাকে একটা ফোনকলও করেনি। কেমন পাষাণ স্বামী তার। সে ফিরে গিয়ে এই সৌরবিদ্যুত এর মজা নেবে।
____________________
প্রিয়াদের গাড়ি সৌরভদের বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রিয়া দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। তার তো গাড়ি থেকে বের হতে ভীষণ লজ্জা করছে। আনোয়ার তাড়া দিলেন মেয়েকে নামার জন্য। প্রিয়া অগত্যা গাড়ি থেকে বের হলো। লম্বা করে দম ফেলে চারপাশে চোখ বুলানো কেউ তাকে দেখছে কিনা? না’হ তেমন কেউ নেই। তিন তলার বারান্দায় একবার চোখ বুলালো। কিন্তু নাহ ঐ বজ্জাতটাও নাই। মনে মনে নারাজ হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। চুপচাপ নিজের বাসায় ঢুকলো।
বিছানায় বসে কিছুক্ষণ ছটপট করলো। সৌরবিদ্যুত কোথায়? এখন তো তার বাসায় থাকার কথা। সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি মারলো সৌরভের বারান্দার দিকে। কিন্তু তার ঐ ভদ্র বজ্জাত স্বামীটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো? তাকে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে সে রুমে ফিরে আসে।
ঘড়ির কাটায় দুপুর বার’টা।
প্রিয়া আর কি করবে ফ্রেশ হওয়ার জন্য সে বাথরুমে চলে যায়। প্রবেশ করতেই আচমকা তার বাথরুমের দরজাতে খটাখট আওয়াজ হতে লাগলো। অর্ধভেজা তার শরীর। এই সময় এলো’টা কে? আতংকিত হয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সৌরভ তার রুমে আসে নি তো। ভয়ে কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলল সে। জিজ্ঞেসও করতে পারছে না লজ্জায়। হঠাৎ মারিয়ার গলা শুনে নিজেকে স্থির করলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দ্রুত কাপড় চেইঞ্জ করে।
দরজা খুলে দেখলো আলিশবা, শোভা, আরাদ দাঁড়িয়ে আছে। কিঞ্চিৎ হাসলো। সে শুধু শুধু আরেকজনকে ভেবেছে।
শোভা প্রিয়ার সামনে এসে বললো,
ছোট ভাবীজান কেমন আছেন? দুইদিন পর তোমাকে দেখলাম। জানো কত কষ্ট হয়েছে?
শোভার মুখে ভাবী ডাক শুনে প্রিয়ার ভীমড়ি খাওয়ার উপক্রম। লজ্জায় ইচ্ছে করছে মাটি ফুঁড়ে তার ভিতরে প্রবেশ করতে। কাঁচুমাচু করে সে কোনো রকম সামনে দাঁড়ালো। আলিশবা এসে তাকে বিছানায় বসালো। তারপর দু’ জা মিলে গল্প জুড়িয়ে দিলো।
আরাদ প্রিয়ার কোলে গিয়ে বসলো। প্রিয়াও কাছে টেনে নিলো। আরাদ প্রিয়ার গালে হামি দিয়ে বললো,
মা,,মা।
প্রিয়া হাসলো আরাদের কথা শুনে। আলিশবা প্রিয়ার কানে কানে বললো চাইলে আগামী বছর এরকম একটা মিষ্টি বাবু তোমরাও নিতে পারবে। আলিশবার কথা শুনে প্রিয়া ভীষণ লজ্জা পেলো। মুখে লাজুক হাসি তার। শোভাও টিপ্পনী মারলো,
ছোট ভাবি ভাইয়াকে বলবে আরাদের মত তোমারও একটা মিষ্টি বেবি চাই। তাহলে তো হয়ে গেলো।
প্রিয়া এদের দিকে তাকালো না আর। এরা নিশ্চয়ই প্লান করে এসেছে দু’জন একসাথে লজ্জা দেওয়ার জন্য। আলিশবা প্রিয়াকে ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করে বললো,
তা ফার্স্ট নাইটে কি উপহার পেলে জামাইর কাছ থেকে। প্রিয়া বলার আগেই শোভা প্রিয়ার গলার দিকে তাকিয়ে বললো,
ছোট ভাইয়া তোমাকে গলার ঐ লকেট গ্রিফট করেছে।
প্রিয়া ছোট্ট করে বলল হুম। শোভা হাত দিয়ে লকেট টা ধরে বললো,
আমার ভাইয়ের পছন্দ সত্যিই দারুণ! তা ছোট ভাবি তোমার পছন্দ হয়েছে?
প্রিয়া আবারও ছোট্ট করে বলল হুম।
আলিশবা আরও অনেক কিছুই বলতে চাইলো। কিন্তু তার আগে মারিয়া তাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসলো। দু’জনকে খেতে বলল। প্রিয়াও তাদের হাতে নাস্তা উঠিয়ে দিলো।
তারা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বাসায় চলে গেলো।
প্রিয়া দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙলো বিকেল পাঁচটায়। কিয়ৎক্ষণ গড়িমসি করলো সে। পরে মনে পড়লো বিকেলে তো সৌরভ তাকে পড়াতে আসবে। তার আগে সে ছাদে গেলো। এখন তো সৌরভ ছাদে যাবে। তড়িঘড়ি সে বিছানা ছেড়ে উঠলো।
হাঁফাতে হাঁফাতে ছাদে আসলো। কিন্তু সৌরভের নাগাল সে পেলো না। উল্টো পড়লো ফ্যাসাদে। গৌরব সেখানে বসে আছে। সে গৌরবকে দেখে সালাম দিলো। গৌরবও হাসি-মুখে সালাম নিলো। জিজ্ঞেস করলো কেমন আছো কিউটিপাই?
প্রিয়া মৃদুহেসে বললো জ্বী ভাইয়া ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?
গৌরব আফসোস করলো প্রিয়ার জন্য। আহা! বেচারি জামাইকে খুঁজতে এসে ভাসুরের খপ্পরে পড়েছে। মনে মনে কুটিল হাসলো। প্রিয়াকে আচমকা বলে উঠল,
তোমার সৌরভের সাথে দেখা হয়েছে?
প্রিয়া এহেন প্রশ্নে কি বলবে এখন? সে চুপ থেকে কিছুক্ষণ পর ডানে বামে মাথা নেড়ে না বললো।
গৌরব হা-হুতাশ করলো প্রিয়ার জন্য কিয়ৎক্ষন। তারপর মুখ মলিন করে প্রিয়াকে বললো,
জানো প্রিয়া, সৌরভ তো বাসায় নেই। আজ সকালেই ঢাকা গেলো বন্ধুদের সাথে। পরশ বউকে নিয়ে হানিমুনে যাবে শুনলাম। সেই সাথে তোমার জামাইও যাবে। তোমাকে কিছু বলেনি।
সৌরভের উপর বড্ড অভিমান জমলো প্রিয়ার। এই লোকটা তাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো। বিয়ে করে এখন তাকে চেনেই না। একদম দূরে সরে গেছে তার। অশ্রুসিক্ত আঁখিদুটি তার কিন্তু গৌরবের কথায় মৃদু হাসলো। তারপর আবারো ছোট্ট করে বললো,
ওহ।
গৌরব আবারও বলে উঠল,
তোমাকে একবারও বলেনি সে। দেখেছো কেমন স্বামী তোমার? বিয়ে করে বউকে একটুও পাত্তা দেয় না। সত্যিই! তোমার জন্য আমার খারাপ লাগছে। আমার ভাই হলে কি হবে সে একটুও বউকে ভালোবাসে না। বউয়ের প্রতি তার কোনো দায়িত্ব নেই দেখেছো? আহারে! আমার তোমার জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। তুমি সত্যি সৌরভকে বিয়ে করে ঠকে গেছো।
প্রিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সে কি বলবে গৌরবের কথার জবাবে। সৌরভ সত্যি তাকে ভালোবাসে না। তাহলে সেদিন যে বলেছে তাকে সেসব কি ছিল? প্রিয়া যখন নিজ ভাবনায় নিমজ্জিত আচমকা কারো রামধমকে সে কেঁপে উঠলো।
প্রিয়া, তুমি এখানে কি করছো? তোমার না এখন টিউশন টাইম। আর তুমি এখানে এসে আড্ডা দিচ্ছো। তোমার বিবেকবোধ দেখে আমি অভিভূত। যাও টেবিলে গিয়ে বসো। আমি আসছি।
সৌরভের রামধমক খেয়ে প্রিয়া আর দাঁড়ালো না ছাদে। দ্রতই নিচে নেমে এলো।
সৌরভ এবার গৌরবকেও শাসালো। ভাই তোর কি মাথা গেছে। প্রিয়া কিন্তু এগুলো সত্যি মনে করে বসে থাকবে।
গৌরব ভাইয়ের কথায় কর্ণপাত করলো না। সে গা দুলিয়ে হেসে উঠল। যাও এবার বউয়ের অভিমান ভাঙাও।
চলবে,,,,,,,,,,