#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_২৬
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
গৌরব মায়ের মনোভাব বুঝতে পেরে মনে মনে হেসে উঠল। সে মায়ের শিয়রে গিয়ে বসল। কিন্তু মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।
নাজমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন গৌরবের দিকে কিন্তু মুখে কোনো বাক্য বিনিময় করলেন না। তার মন ভীষণ ব্যথিত, ছেলে এত বড়ো ধোঁকা কিভাবে দিলো? ভাবতেই তার তনুমন বিষাদে পরিপূর্ণ হলো। নৈশব্দে তার চাপা আর্তনাদ ভরা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
গৌরব মায়ের সামনে বসে ক্ষীণ স্বরে বলে উঠল,
আম্মা’ তুমি প্রিয়ারে কি ট্রেনিং দিচ্ছো বউ হবার?
নাজমা কথার জবাব দিলেন না। এই ছেলের সাথে তার কথা নাই। চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলেন।
গৌরব মুচকি হাসলেন। তার মা’ বড্ড অভিমান করে আছে তার উপর। সেটাই স্বাভাবিক। তবে তাকে যে অভিমান ভাঙাতে হবে তার মায়ের। সে রগড় গলায় বলল,
আম্মা’ তুমি সৌরভকে কিচেনে পাঠালে কেনো? দুইজন তো সেখানে গিয়েও ঝগড়া করবে।
“ঝগড়া করতে করতে দুইজন বিয়ে করে বাপ-মা হয়ে যাবে একদিন। তারপর বউ-বাচ্চা নিয়ে আসবে তোর মতো। সমস্যা কি ঝগড়া করুক?”
“ওরা তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে করবে কেনো? তোমরা তো আছই ওদের বিয়ে দেয়ার জন্য।”
“যেখানে বড়ো ভাই বিয়ে করে বাপ হয়েও এতবছরে বলে নাই সেখানে ছোট ভাই কি আর ধোয়া তুলসীপাতা হবে। দু’জনেই এক ঘাটের মাঝি।
“আমি না হয় অন্যায় করেছি। কিন্তু সৌরভকে তো তোমরা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছো। তাহলে ওদের বিয়েটা দিয়ে দাও।”
“সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। সৌরভের বিয়ের জন্য ভেবে রেখেছি। এক সপ্তাহের মধ্যে আমার ছেলেকে বিয়ে দেবো। তোমার মত ধোঁকা যাতে না দিতে পারে।”
“প্রিয়াকে এজন্যই ট্রেনিং দিচ্ছো বুঝি।”
“তোমাকে কে বললো মেয়েটা প্রিয়াই হবে?”
গৌরব অবিশ্বাস্য নজরে মায়ের দিকে তাকালো। ব্যগ্র কন্ঠে বলল, “মানে?”
নাজমা জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চোয়াল শক্ত করে বলল সময় হলেই দেখবে। এখন যাও আমার কাজ আছে।
গৌরব দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো। তার মা’ কি বললো তার বোধগম্য হলো না।
____________________
প্রিয়া অস্বস্তিতে ঘামছে। কেউ যদি ষাঁড়ের মত পেছনে দাঁড়িয়ে অন্যের কাজের গতিবিধি দেখে তখন কি আর কাজে মনোযোগ থাকে। এজন্য তার হাত কাঁপছে। না চাইতেও আঁড়চোখে কয়েকবার সৌরভকে দেখেছে। এই বে*য়াদব সেই কখন থেকে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করছে এই ছেলের কানের নিচে দুই-তিনটা বাজাইতে। ব*জ্জাতের ব*জ্জাত একটা। আম কাটতে গিয়ে প্রিয়ার হাত প্রচন্ড কাঁপছিল।
সৌরভ প্রিয়ার কাঁপা-কাঁপি দেখে নিজেই হেঁচকা টান দিয়ে তার হাত থেকে ছুরি নিয়ে নিল। প্রিয়া মনে মনে ভেংচি কাটলো। গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল। সেও ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো সৌরভ কেমন ফল কাটে। সৌরভ প্রিয়ার উপর জেদ দেখিয়ে ফল কাটতে লাগলো।
দু’জনের মধ্যে কোনো টুঁশব্দও নেই।
সৌরভ আমের উপর মাত্রই ছুরির কোপ বসালো আর অমনিই আমের বিচি গিয়ে পড়ল মাজেদার মাথার উপর। মাজেদা মাত্রই নিচে ঝুঁকিছিলো সবজি নেয়ার জন্যই। সে সময় এসে এই অঘটন ঘটলো। মাজেদা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। সৌরভের দিকে তাকিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে সে। কি বলবে নিজেই বুঝতে পারছে না।
প্রিয়া নিজের হাসি আটকাতে পারলো না। খিল খিল করে হেসে উঠল। সৌরভ মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেলো। তারপরও চুপচাপ প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য হতাশ হলেও একদিক থেকে তার লাভ হয়েছে। এক রণচণ্ডীর হাসি তো দেখলো। কি অপূর্ব হাসির দৃশ্য!
হাসির শব্দ শুনে নাজমা ছুটে এলো। কি এমন হলো তা দেখতে। কিন্তু যা দেখলো তাতে সে ভীষণ আহত হলো। সৌরভকে কর্কশ গলায় বলল,
তোকে কিচেনে ফল কাটতে পাঠিয়েছি নাকি নাস্তা আনতে পাঠিয়েছি।
সৌরভ মায়ের কথা শুনে আৎকে উঠলো। প্রিয়ার সামনে তার মান-সম্মানের এভাবে দফারফা হবে সে ভাবতেও পারলো না। মায়ের দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিয়ে বলল,
মা’ আমার কি দোষ? প্রিয়াই তো আমাকে অনুরোধ করলো ফল কেটে দিতে। তাই তো ফল কাটছিলাম।
প্রিয়া বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো সৌরভের দিকে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই সৌরভ কিচেন থেকে পগারপার। সে তো বিপাকে পড়লো এবার। নাজমা প্রিয়াকে কিছুই বললেন না শুধু একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখলেন।
_______________________
সবাই খেতে বসেছে। নাজমা আলিশবা আর প্রিয়াকে একসাথে বসতে বলেছে। বাকি টেবিলে অন্যান্য অতিথি বসেছে। আলিশবা ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলো। এত মানুষ তার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। সবাই তার দিকেই হা’ করেই তাকিয়ে আছে। এটাই তার অস্বস্তির প্রধান কারণ। কিন্তু প্রিয়া তার পাশে বসায় সে কিছুটা স্বস্তি পেলো।
গৌরব সারাক্ষণ বউয়ের আসেপাশে থাকছে। সে জানে মেয়েটা কতটা অস্বস্তিতে আছে। কিন্তু তারপরও এগুলো আজকের জন্য ফেইস করতে হবে। সৌরভ ভাইয়ের রিজন বুঝতে পেরেও তাকে টিপ্পনী মারলো।
ভাই তুই অন্য রুমে যা’তো। এখানে সব মহিলা বসেছে তোর কি কাজ এখানে? শোভাও তার ভাইকে টিপ্পনী মারলো।
আমার ভাই বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরতে ঘুরতে বোনের কথা একদম ভুলে গেছে।
গৌরব পড়লো মহাবিপদে। তার ভাই-বোনও তাকে নিয়ে মজা উড়াচ্ছে। কিন্তু সেও কম কিসে? সবার মজার উত্তর সেও দিয়ে দিলো,
একটাই বউ, তাকেও যদি আগলে না রাখি কেমনে হবে? সবাই তো আর আমার মত নিজের প্রেমিকাকে বিয়ে করার সুযোগ পায় না। এ কথা বলে সৌরভকে এক চোখ মারলো সে।
উপস্থিত সবাই গৌরবের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল।
এদিকে আলিশবা লজ্জায় শেষ। তার জামাই এত নির্লজ্জ কেনো? মনে মনে হা হুতাশ করলো। সৌরভ ভাইয়ের টিপ্পনী বুঝতে পেরে বললো,
ভাই তোকে কে বলেছে সবসময় প্রেমিকাকে বিয়ে করলে মহান হওয়া যায়। না হওয়া প্রেমিকাকেও বিয়ে করে মহান হওয়া যায়।
প্রিয়া অবাক হলো সৌরভের কথায়। কিন্তু কথার মুন্ডুমাথা কিছুই বুঝেনি। কে তার না হওয়া প্রেমিকা সে তো জানে না।
_________________________
বসার ঘরে অনেকেই অনুপস্থিত আছেন দেখে নাজমা নিজের পরিবারের সবাই কে ডাকলেন। আত্নীয়-স্বজনরা অনেকেই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু নাজমা গুটি কয়েকজনকে জরুরি কথা বলার জন্যই বসার ঘরে আসতে বললেন।
প্রিয়া মাত্রই কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলো। নাজমা তাকে পিছন থেকে ডাকলো কোথায় যাচ্ছিস? প্রিয়া আমতা আমতা করছিলো। আজকে তাকে কলুর বলদের মতো খাঁটিয়েছে নাজমা আন্টি। তার আলিশবার জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। তার সাথে যে কি করবে নাজমা আন্টি একমাত্র আল্লাহ্ই জানে। প্রিয়া ভয়ে ভয়ে দাঁড়ালো।
নাজমা প্রিয়াকে বললেন যা’তো সৌরভকে ডেকে নিয়ে আয়।
প্রিয়া হা’ হয়ে গেলো নাজমার কথা শুনে। সে সৌরবিদ্যুৎ এর রুমে যাবে? ওহ নো! এখন কি করবে সে? হাঁসফাস করছিল সে। নাজমার ধমক খেলো সে এবার।
জলদি যা, দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
প্রিয়া দুরুদুরু বুকে সৌরভের রুমে গেলো। কিন্তু তাকে রুমে ফেলো না। সে সৌরভকে খুঁজতে বারান্দায় গেলো। বারান্দায় গিয়ে চমকে উঠলো। কি দারুণ সৌরবিদ্যুত এর বারান্দা। সে এই প্রথমবার আসল। বারান্দা দেখা শেষে সে ঘুরে দাঁড়াতে দেখলো সৌরভ তার পিছনে দাঁড়ানো। সে আৎকে উঠলো। আচমকা সৌরভ তার এত কাছে সে ভয় পেয়ে গেলো। লজ্জায় আর অস্বস্তিতে কাঁচুমাচু করছিল।
সৌরভ তীক্ষ্ণ নজরে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে কুটিল হাসলো। প্রিয়াকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললো,
কোন মতলবে এসেছো আমার রুমে? নিশ্চয়ই কোনো বড়ো কিছু চুরি করার ধান্দায়? তাই নাই প্রিয়ারানী?
প্রিয়ার তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সে কোন দুঃখে এই ব*জ্জাতের রুমে আসলো কে জানে? সব দোষ ঐ নাজমা আন্টির। কটমট দৃষ্টিতে তাকালো সৌরভের দিকে।
আপনার কি আমাকে চোর মনে হয়?
“নাহ।”
“তাহলে।”
“চোর না চোরনি হবে। পুরুষ না তো মহিলা চোর তাই।”
“আপনি আমাকে চুরি করতে দেখছেন?”
“কেউ কখনো দেখিয়ে চুরি করে।”
“আপনি আসলেই একটা অসভ্য বেয়াদব।”
প্রিয়া আর দাঁড়ালো না। গটগট করে বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু বাইরে এসে মনে পড়লো নাজমা তাকে সৌরভকে ডাকতে বলেছিলো। সে পিছু ফিরে সৌরভকে ডেকে বললো আপনার মা আপনাকে ডাকছে।
সৌরভ এখনো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছে। এই মেয়ে একদমই মজা বুঝে না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।
______________
ড্রয়িংরুমে নাজমা পুরো পরিবার নিয়ে বসেছে। আলিশবা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। নাজমা প্রথমেই আলিশবাকে বলল তোমার পরিবারের সাথে আমরা কথা বলতেই চাই। এক সপ্তাহ পর তোমার আর গৌরবের রিসেপশন হবে। তাই তাদেরকে ইনবাইট করবো যেনো তারা আমাদের দেশে এসে তোমাদের দোয়া করে যাই। তবে এটা ভেবো না গৌরবকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তবে শা*স্তি তোমারও কিছু প্রাপ্য আছে আলিশবা। ভেবো না মাফ করছি। সব জমা আছে। এখন আমার দাদুভাইয়ের জন্য ছাড় দিয়েছি মাত্র। যাই হোক তোমার পরিবারের সাথে দ্রুতই যোগাযোগ কর।
তবে আজকে আরো একটা ঘোষণা জানাতে সবাইকে ডেকেছি। সৌরভের বিয়েটাও আমি দ্রুত দিতে চাই। মেয়ে আমার ঠিক করাই আছে। সৌরভের বড় মামীর পরিচিত মেয়ে।
সৌরভ মায়ের কথা শুনে বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো একবার মা’কে আর একবার প্রিয়াকে দেখলো। প্রিয়া তখন নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নাজমা পুনরায় বলতে লাগলো তবে সৌরভ তোমার যদি কোনো পছন্দ থাকে বলতে পারো।
সৌরভ পুনশ্চঃ প্রিয়াকে দেখলো। এই মেয়ের মধ্যে কোনো ভাবাবেগ নাই। সে নিশ্চুপে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
আম্মা’ আমার কোনো পছন্দ নেই। তোমরা যেখানে বলবে সেখানেই বিয়ে করবো।
সৌরভের কথা শুনে প্রিয়া চকিতে মুখ তুলে তাকালো সৌরভের দিকে। অশ্রুসিক্ত আঁখি দু’টি তার অপলক তাকিয়ে আছে সৌরভের দিকে।
সত্যিই সৌরবিদ্যুত এর কোনো পছন্দ নেই।
গৌরব, আলিশবা, শোভা সবাই বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে সৌরভের দিকে। সৌরভ নিজের কথা ব্যক্ত করে উঠে দাঁড়ালো নিজ রুমের উদ্দেশ্য।
চলবে,,,,,,,,,,,,
#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_২৭
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
ফুল সজ্জিত রুমে বসে আছে আলিশবা। তার চারপাশে বাহারী ফুলের সমাহার। বাগানের সতেজ ফুল হওয়ায় পুরো রুম জুড়ে গন্ধে মৌঁ মৌঁ করছে। সে হাত দিয়ে একবার পরখ করে যা দেখছে তা সত্যিই! তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। সে শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেছে। বিবাহিত জীবনের তিনটি বছর কেটেছে তাদের। কিন্তু গৌরব তাকে ভালোবেসে বিয়ে করলেও রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে বেড়াতো। তার নিজেরও কষ্ট হতো গৌরবের জন্য। তাই তো সে কখনোই জোর করে বলেনি তোমার পরিবারের কাছে আমাকে নিয়ে চলো। তবে গৌরব তাকে পেলেও পরিবার হারানোর নিঃসঙ্গতায় ভুগতো সবসময়। আজকে নিজের থেকেও গৌরবের জন্য তার ভীষণ ভালো লাগছে। অবশেষে তার স্বামী মন খুলে হাসতে পারবে। যেখানে থাকবে না চাপা আর্তনাদ।
গৌরবকে সৌরভ নিজের রুমে বন্ধি করে রেখেছে। সে পালাতেই পারছে না সৌরভ থেকে। সৌরভ সরাসরি হুমকি দিয়েছে। এতদিন আমার রুম তোর ছিল, আমার কাপড় তোর ছিল, আমার বাথরুমও তোর ছিল, এমনকি আমার বিছানার অর্ধেকও তোর ছিল। তাহলে আজকে অন্যরুমে যাবি কেনো? আজকেও এই রুমে থাকবি কোথাও যাবি না।
গৌরব ভাইয়ের সাথে না পেরে পরে হার মানলো। তবে সুযোগ খুঁজলো বেরুনোর। সে আর কম কিসের? মুখ ফোঁসকে বলে ফেললো,
আমি আজকে না গেলেও কিছু হবে না। বাসর করে বাচ্চাও পয়দা করে ফেলেছি। কিন্তু জনাব সৌরব ফায়াজ আপনি বিয়ের সময় বউ তো দূরে থাক বউয়ের ঠিকি টাও পাবেন না। তো ভেবে দেখেন যেতে দিবেন না’কি বন্ধি রাখবেন।
সৌরভ ভাইয়ের কথার প্রতিত্তোর করলো না। সে চুপচাপ ভাইয়ের বকবক শুনছিলো। মনে মনে চাইছিলো গৌরব নিজ থেকে চলে যাক। তার এখন ভীষণ ঘুম আসছে। সে শান্তিতে ঘুমাতেই চাই। কিন্তু ভাইয়ের বকবক শুনে অবশেষে মুখ খুলে,
স্ত্রীর কাছে যাওয়া একজন স্বামীর স্বামীগত অধিকার। সেই অধিকার থেকে তুই কেনো আমিও বঞ্চিত করতে পারবো না। যা এবার তুই তোর রুমে যা। আমার কান খাস না।
গৌরব ভাইয়ের কথা শুনে হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বাহ্! এতক্ষণ তাকে আটকে রেখেছিল আর যখনি ওর নিজের বউয়ের সাথে দেখাও করতে দিবো না বললাম অমনি মুহূর্তেই বোল চেইঞ্জ। বাহ্! কি ধুরন্দর ভাই তার। মনে মনে আফসোসের সুর তুললেন।
রুমের সামনে আসতেই গৌরবকে শোভা আটকালো। গৌরব যারপরনাই অবাক। তার ভাই বোন আজকে তার ভালোই মজা নিচ্ছে। গৌরব নিভৃতে হাসলো। এমন একটা দিন তার জন্য সত্যিই আনন্দের। সে বোনের সাথে টুঁশব্দও করলো না। বোনের দাবির থেকেও বেশি দিলেন। হাতে একটা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দিলো।
শুভি তোর যা খুশি নিয়ে নিস।
আরাভ দাদা-দাদুর সাথে আরামে ঘুমে তলিয়ে আছে। নাজমা আর মাসুদ দুইজনেই কাড়াকাড়ি নাতিকে নিয়ে। মাসুদ একবার নিজের দিকে টানে আর একবার নাজমা নাতিকে নিজের দিকে টানে। পরে মাসুদ বিরক্ত হয়ে নিজের বিছানা ছেড়ে চেয়ারে গিয়ে বসে আছে।
_____________
প্রিয়ার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো নাজমার কথা শুনে। সারাদিন এত কাজ করার পরও তাকে আবার সৌরভের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে আসার সময়। বিয়ের একসপ্তাহ আগে যেতে বলেছে। এ কেমন কথা সে কেনো তাদের কাজ করবে? ছেলের বিয়ে করাবে কাজের লোক নিবে তা’ না, তাকে দিয়ে কাজ করাবে। এসব ভাবতে ভাবতে বিছানায় গড়াগড়ি করে অবশেষে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় সে।
সকালে ঘুম ভাঙে হকারের চেঁচামেচিতে। বাজার, বাজার, এই শব্দ শুনে তার কান পঁচে গেছে। ইচ্ছে করে এই ব্যাটার দুই কানে নিজের করা চেঁচামেচির একটা রেকর্ড লাগিয়ে দিতে। তারপর বুঝতো শব্দদূষণ কাকে বলে?
কলেজ এসে প্রিয়া বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তার সামনে এক সদ্য বিবাহিত হওয়া নববধূ দাঁড়িয়ে আছে। তার রাগের চেয়েও বড্ড অভিমান জমলো। তার প্রাণপ্রিয় বান্ধুবী আচমকাই বিয়ে করে নিলো। তাকে জানানোর প্রয়োজনবোধও মনে করেনি। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
রাঢ়ী নিজেও জানতো না। আচমকাই তার বিয়ে সম্পন্ন হলো রাত্রিবেলা। তার ভাইয়েরা সন্ধ্যোরদিকে এসে বললো ছেলের মায়ের শরীর অবস্থা ভালো নয়। তাই তড়িঘড়ি বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। সে তো বরের মুখটাও ভালো করে দেখেনি রাতে। ছেলের মা’ হাসপাতালে তাই রাতে বিয়ে সম্পন্ন করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে দেখার জন্য। কিন্তু গাড়িতে উঠে সে বর হিসেবে যাকে দেখলো কস্মিনকালেও তার চিন্তা মাথায় আসেনি। এসব ভাবতে গিয়ে লজ্জায় সে মাথা নুয়ে ফেলেছে।
প্রিয়ার একেতে অভিমান হচ্ছে তার উপর বান্ধুবীর এমন নিশ্চুপতা তাকে আরও রাগিয়ে দিচ্ছে। সে রাঢ়ীকে এক ধমক দিলো। এ্যাই তুই এই দেশে আছিস না’কি জামাইয়ের কাছে গিয়ে বসে আছিস?
রাঢ়ী চমকে উঠলো জামাইয়ের নাম শুনে। ঐ লোকটার নাম শুনলে তার বুকটা দুরুদুরু করে। ভীষণ লজ্জা লাগে তার। বার বার গাড়িতে একসাথে বসার দৃশ্যটা মনে পড়ে। তার সদ্য বিবাহিত জামাই তার দুই হাত দিয়ে তাকে কিভাবে জড়িয়ে নিয়ে ছিলো ভাবতেই তার গা শিউরে উঠলো।
প্রিয়া জহুরি চোখ দিয়ে প্রাণপ্রিয় বান্ধুবীকে দেখছে এই মেয়ে বিয়ে হতে না হতেই কেমন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে? বাপ্রে! এত জলদি জামাই পাগলি হয়ে গেলো।
নীল, শ্রাবণ আসলো রাঢ়ীকে দেখতে। মেয়েটা অ্যাপ্রোন গায়ে জড়ালেও হাতে বালা, কানে দুল, নাকে নাকফুল পরে এসেছে। এতেই স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে সদ্য বিবাহিত ছাত্রী কলেজ এসেছে। নীল রাঢ়ীকে পর্যবেক্ষণ শেষে বলে উঠল,
তোর জামাই কোথায় রে রাঢ়ী? বিয়ে করার এতই তাড়া, মাত্র কিছুদিন ধৈর্য্য ধরতে পারলো না। পরীক্ষার পর তোদের বিয়ের কথা ছিলো কিন্তু এত তাড়াহুড়ো কেনো করলো? রাতে কি তোর জামাইয়ের ঘুম আসে না?
প্রিয়াসহ বাকিরা হো হো করে হেসে উঠল নীলের কথা শুনে।
রাঢ়ী তো লজ্জায় শেষ। একবার যদি জানতে পারে ওর জামাই কে তখন এরা তাকে আরো বেশি পঁচাবে। তাদের কথার মাঝেই লুবনার আগমন ঘটলো হাসিমুখ নিয়েই। তার হাসিমুখ দেখেই শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো।
তুই এমন পকপকা দাঁত দেখরে কিল্লাই? কিছে তোর জামাই চাইতো আইছেনি?
লুবনা বিস্মিত নয়নে তাকালো শ্রাবণের দিকে। হা’ হয়ে বলল তুই কিভাবে জানিস? শ্রাবণ তো পুরাই বেকুব বনে গেলো। সে তো মজা করে বলেছে। এই মেয়ে কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে না’কি সত্যি বলছে। সে কিছু বলবে তার আগে লুবনায় বললো,
সত্যি আজকে আমাকে দেখতে আসবে। কে দেখতে আসবে জানিস?
নীল খিল খিল করে হেসে উঠল। তুই না বললে আমরা কি করে জানবো? লুবনা লাজুক হেসে বলে উঠল,
“সৌরভের মা আসবে আমাকে দেখতে। ”
নীল, শ্রাবন, রাঢ়ীসহ প্রিয়াও চমকে উঠলো লুবনার কথা শুনে।
_______________________
প্রিয়া মাত্রই কলেজ থেকে ফিরেছে। বাড়িতে প্রবেশ করার সময় দেখলো নাজমা নিচে নামছে। তার চোখে মুখে কেমন রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে। তাকে দেখেও তাকালো না। এটার হেতু সে বুঝলো না। নাজমার পিছু পিছু গৌরবও নামলো। তার চোখে মুখে কেমন হতাশার ছাপ। দুইজনের কি হয়েছে বোধগম্য হলো না। সে নিজের উপর তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিল।
সে’তো বসন্তের সদ্য ফোটা ফুল, রৌদ্রজ্বল দিনের দাবদাহে যেকোনো সময় ঝরে যাবে।
না সে কারো বাগানের প্রস্ফুটিত ফুল, সে ‘তো’ ক্ষণিকের একটা আগাছা মাত্র। কি লাভ আধিপত্য খাটানোর।
বাসায় প্রবেশ করে বাবা-মায়ের থমথমে মুখ নজরে এলো প্রিয়ার। মারিয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আনোয়ার হেসে উঠল প্রিয়াকে দেখে। যাও মা’ ফ্রেশ হয়ে এসো একসাথে খাবার খাবো।
প্রিয়া ফ্রেশ হয়ে আসলো। কিন্তু বাবা-মায়ের সেই গম্ভীর মুখ তার নজরে এলো বেশ ভালোভাবেই। খাবার খেতে খেতে আনোয়ার বলে উঠলেন। আমরা আজকে গ্রামের বাড়ি যাব। প্রিয়া তুমি তৈরি হয়ে থেকো।
প্রিয়া চমকালো। হঠাৎ গ্রামের বাড়ি কেনো? তার তো পাঁচদিন পর পরীক্ষা। সে কীভাবে যাবে? আনোয়ারের উদ্দেশ্য বললো,
আব্বু আমার তো পরীক্ষা। আমি কীভাবে যাবো?
আনোয়ার মেয়ের কথার পাত্তা দিলেন না। আগের মতই বলে উঠলো পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। পরীক্ষার আগেই ফিরে আসব?
প্রিয়া নৈশব্দে খেয়ে উঠলো। তার মনটা আজ বিক্ষিপ্ত। কারণটা তার অজানা নয়। বারান্দার চেয়ারে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। কিন্তু বেশিক্ষণ বসার সু্যোগ পেলো না। আনোয়ার তাড়া দিলেন তৈরি হওয়ার জন্য।
প্রিয়া, মারিয়া, প্রত্যুষ গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য নিচে নামলো। তাদের গাড়িও সদর দরজায় দাঁড়ানো। তারা সবাই উঠে বসলো বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য।
___________________
সৌরভ মায়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নাজমা তার তোয়াক্কা করলো না। সে নিজের কার্যসিদ্ধি করেই ছাড়বেই। সৌরভ গর্জে উঠলো,
আম্মা তুমি কথা বলছো না কেনো?
নাজমা ছেলের দিকে তাকালেন না। দোকান থেকে একটা ডায়মন্ডের আংটি নিলেন। দোকানির সাথে কথা বলছেন দরদাম নিয়ে। সৌরভ আবারো জিজ্ঞেস করলো।
আম্মা তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে তুমি ঐ লুবনা মেয়েটা’কে কেনো দেখতে যাচ্ছো?
“তো কি করবো?”
“আমি ঐ মেয়ে কে বিয়ে করবো না।”
“কেনো করবে না? ঐ মেয়ে খারাপ কোথায়? তোমার সাথে ভালোই মানাবেই।”
সৌরভ কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,
“আমি প্রিয়াকে ভালোবাসি। বিয়ে করার হলে তাকেই করবো।”
চলবে,,,,,,,,,,,