#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_২৩
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
গৌরব নিজের খাবার খেয়ে মায়ের পাশে বসে সান্ত্বনা দিল। ‘আম্মা’ রাগ করো না, তুমি তো জানোই তোমার ছোট ছেলেটা একটু রগচটা। তাই হুটহাট রাগ করে বসে। অথচো মনের কথা সে বলতে পারে না। আসলে কি জানো তো ‘আম্মা’, মানুষ সব দিতে পারলেও নিজের একান্ত প্রিয় জিনিসটা কাউকে দান করতে পারে না। সেই রোগটা তোমার ছোট ছেলের মধ্যেও আছে।
নাজমার কৌতুহলী দৃষ্টি। গৌরবের কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সে বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলো। তার ছেলে কি বুঝাতে চাই। ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
কি বলবি সোজাসুজি বল না। এত ঘুরানো পেছানো কথা আমি বুঝি না তোদের।
গৌরব মিটমিট করে হাসলো। মা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আম্মা’ তোমার বয়স হয়ছে ঠিকই কিন্তু তুমি বড্ড বোকাই রয়ে গেলে। যদি চালাক হইতা না আমাদের সৌরভ প্রিয়ারে বিয়ে করে এতদিনে দুই বাচ্ছার বাপ হইত আর তুমি হতে দুই নাতিপুতির দাদী।
নাজমা কর্কশ গলায় চেঁচালো,
কি বলিস এগুলো? দুইজন তো সাপে নেউলে সম্পর্ক। এদের প্রেম হইলো কখন?
পাশ থেকে শোভা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো। তার বড় ভাই সিরিয়াস মোমেন্টেও হাসাতে পারে।
গৌরব আফসোসের সুরে বললো,
আহারে! ‘আম্মা’। তোমার সব চুল বাতাসে পাকছে, বয়সে একটাও পাকে নাই। এজন্য তুমি এত অবুঝ। ওরা দুইজন কি তোমারে দেখিয়ে দেখিয়ে প্রেম করবে? তুমি না মুরব্বি মানুষ! ওরা মনে মনে প্রেম করে। তুমি বুঝে নিবে না।
নাজমা খুশি হবে নাকি রাগ করবে বুঝতেই পারছে না। সে তো প্রথমেই সৌরভের জন্য ভেবে রেখেছিল কিন্তু তার প্রিয়ার প্রতি তুমুল বিদ্বেষমূলক ভাব দেখে গৌরবের কথা ভেবেছে। নাজমা এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। এই সাপে-নেউলের দুইজনের প্রেম হইলো কেমনে?
______________________
গৌরব ভাইয়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে করাঘাত করেই যাচ্ছে। কিন্তু সৌরভ দরজা খুলছে না। গৌরব টিপ্পনী মেরে বললো,
এই তুই ছেলে হয়ে মেয়েদের মত দরজা খিল দিয়েছিস কেনো? নিশ্চয়ই বালিশে মুখ রেখে মেয়েদের মত ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদছিস তাই তো। না’কি প্রেমিকার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে দেবদাস হয়ে গেছিস। আর কিছু বলার আগেই সৌরভ দরজা খুলে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সম্মুখে।
গৌরব কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,
প্রিয়াকে ভালোবাসিস? না’কি একটু আধটু ভালো লাগে। কোনটা?
সৌরভ কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়াই সরে দাঁড়ালো। তার ভাইকে উত্তর দেয়া মানে নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনা। তাই প্রতিত্তোর না করাই উত্তম। চুপচাপ নিজের বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো।
গৌরব চমকালো না। সে জানে তার ভাইয়ের চাপা স্বভাব সম্পর্কে। ভাঙ্গবে তবু মচকাবে না। সে মনে মনে কুটিল হাসলো। রগড় গলায় বলল,
তুই পছন্দ করিস না। ওহহ, তাহলে ঠিক আছে। আমি আম্মাকে বলে আসি আমাদের বিয়ে যেনো দ্রুতই দেয়া হয়।
ভাইয়ের কথা শুনে সৌরভ উঠে দাঁড়ালো। রক্তবর্ণ মুখস্রীতে যেনো আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। ফোঁস ফোঁস করে বলল,
কেনো, মেয়ের অভাব পড়ছে। আমি অন্য মেয়ে খুঁজে দেবো তোমাকে। প্রিয়াকে বাদ দাও এই লিষ্ট থেকে।
গৌরব এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল প্রিয়া থাকলে কি সমস্যা। কথা বলিস না কেনো? ভয় পাচ্ছিস আমাকে। আবার যদি চ্যালেঞ্জ ধরে পিউর মত প্রিয়াকেও পরীক্ষা করি। সেজন্য ভয় পাচ্ছিস। কিন্তু তুই আমাকে বোকা ভাবিস না’কি নিজের ওপর বিশ্বাস নেই। দেখ পিউ কখনো প্রিয়া হবে না আর না প্রিয়া কখনো পিউ হবে।
পিউকে তুই ছয়মাসেও চিনতে পারিস নি। আর আমি তিন ঘন্টায় চিনে ফেলেছি। মেয়েটা লোভী স্বভাবের। শপিং, ঘোরাঘুরি, রেষ্টুরেন্টে খাওয়া, দামী গ্রিফট আর চাইতো তার পিছনে যেনো সময় দিস। তার জন্যই তুই মাতলামী করিস সারাক্ষণ। কিন্তু তুই যখন তাকে এইগুলো দিচ্ছিস না। তখন মেয়েটা তোর থেকে সরে গেলো। অথচ তুই বুঝতেই পারিস নি মেয়েটা তোকে ব্যবহার করেছে। আমি মেয়েটাকে দেখেই তোকে বলে দিয়েছিলাম। মেয়েটা তোর জন্য সুবিধার নয়। কিন্তু তুই আমাকে তখন বিশ্বাস করিস নি। মুখে যা নয় তাই বলে সেদিন অপমান করলি। আর পিউকে প্রাধান্য দিলি। কিন্তু কি হলো শেষে পিউ তোকে ধোঁকা দিয়ে আরেকজনের হাত ধরে চলে গেলো। সে তোর ভালোবাসার গভীরতাই বুঝতে পারলো না। তার কাছে প্রেম মানে পার্কের কোণে জড়াজড়ি করে বসা, ঘন্টায় ঘন্টায় মুঠোফোনে আলাপ করা, বিলাসবহুল রেষ্টুরেন্টে বসে খাবার খাওয়া। বয়ফেন্ডের হাত ধরে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো।
গৌরব এইটুকু বলে থামলো। তারপর আবার লম্বা এক দম নিয়ে বললো।,
কিন্তু প্রিয়া সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ। ও তোর মনের মত না হলেও ওর মনটা ভীষণ সুন্দর। মনের থেকে একদম কাঁদামাটি কিন্তু বাইরে থেকে ভীষণ শক্ত। মেয়েটাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে ছোটো ভাইয়ের বউ হিসেবে। বাকীটা তোর মর্জি।
সৌরভ গম্ভীর হয়ে বসে আছে। ভাইয়ের কথা শুনে মাথা তুলে তাকালো। ধরা গলায় বললো,
‘ভাইয়া’।
গৌরব মিট মিট করে হেসে উঠল। ভাইয়ের এমন দৈন্যদশা দেখে টিপ্পনী মেরে বললো,
থাক আর ধন্যবাদ দিতে হবে না। হয়তো বলবি আমি কি করে বুঝলাম, তাই তো? আরে আমি তোর থেকে গুণে গুণে ৯ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের বড়ো। তাই তো আমার তোর থেকে অভিজ্ঞতা বেশি। আর যাই হোক, ভাই’ তুই যে ক্লাসে পড়িস ঐ ক্লাসের প্রিন্সিপাল আমি। বুঝলি!
সৌরভ লজ্জা পেলো মনে মনে। তার ভাই এত চতুর তার পুরো মন পড়ে ফেলেছে। অথচ সেই ভয় পাচ্ছিলো। যদি প্রিয়াকে নিয়ে কোনো বাজে ধারণা করে। কিন্তু এখন তার কাছে খুব শান্তি লাগছে। সে মুচকি হেসে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।
গৌরব আৎকে উঠলো। এই ছাড় খবিশ। আমার কাতুকুতু লাগের। সৌরভ ছাড়লো না আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো ভাইকে।
___________________
নিস্তব্ধ নিশুতি রাত। সবাই এখন ঘুমে কাঁদা। কিন্তু গৌরবের চোখে ঘুম নেই। সে বারান্দার এক কোণে বসে আছে চেয়ারে। সারাদিন সবাইকে হাসি-খুশিতে মাতিয়ে রাখা ছেলেটার মনেও বিষাদের ছায়া। সে কি করে নিজের পরিবারকে বলবে তার মনের চাপা কথাটা। যেই বাক্যটুকু বলার জন্য সে সূদুর কানাডা ছেড়ে এসেছে। আধো তার পরিবার কি এই ভুলের ক্ষমা করবে? সে কি পারবে সবাইকে মানাতে?
দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠে তার তনুমন। কি করবে সে এখন? বিক্ষিপ্ত মনে সে আকাশ পানে চেয়ে আছে। পাশ থেকে মেয়েলী এক শব্দে চমকালো।
গৌরব ভাইয়া তুমি ঘুমাওনি এখনো?
গৌরব মেকি হাসলো। তার চোখ ঘুম চাইলেও তার মস্তিষ্ক অন্যকিছু খুঁজছে। সে কিভাবে ঘুমাবে।
গৌরবের অশ্রুসিক্ত আঁখি দেখে প্রিয়া ভীষণ অবাক হলো। যে ছেলেটার মুখে সারাদিন হাসি লেগে থাকে সেই ছেলের চোখ অশ্রুসিক্ত। কিন্তু কেনো? সে কৌতুহলী হয়ে বলল,
ভাইয়া তুমি কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে?
“শুনবে আমার কথা?”
হুমম, বলো ভাইয়া তোমার কি হয়েছে?
গৌরব ঝর ঝর করে কেঁদে দিল। কান্নারত হা’ করে নিশ্বাস ছাড়লো। প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি যদি তোমাকে কালকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই আমার সাথে যাবে।”
প্রিয়া সময়ক্ষেপণ না করেই বললো। যাবো ‘তো। কিন্তু তার আগে বলো তোমার কি সমস্যা হয়েছে যার জন্য তুমি নিশীথে নিরিবিলি বসে কাঁদছো?
গৌরবের দৃষ্টি তখনো অন্তঃরীক্ষে। সে বিষন্নমনে বলে উঠল কালকে নিজ চক্ষে দেখে এসো। তারপর তুমিই বলো আমার কি করা উচিৎ?
__________________
সকালে গৌরবের কথামত প্রিয়া তৈরি হয়ে নিয়েছে। সে গৌরবের সাথে এক জায়গায় যাবে। সে যতটুকু বুঝতে পেরেছে গৌরব বড়ো কোনো ঝামেলায় ফেঁসে গেছে। যা নিজের পক্ষে মিটানো সম্ভব নয়। প্রিয়ারও কৌতুহলী মন সে জানতে চাই কি সমস্যা?
নিচে গৌরব বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়া নিচে নেমে গৌরবের সম্মুখে দাঁড়ায়। গৌরব প্রিয়াকে পিছনে বসতে বলল। প্রিয়াও দ্রুতই উঠে পড়লো বাইকের পিছনের সিটে।
প্রিয়ার উঠে পড়ার সাথে সাথে গৌরব বাইক নিয়ে ছুটলো তার গন্তব্যে।
তিনতলার বারান্দা থেকে নিচের পুরো দৃশ্যই দেখলো সৌরভ। তার রাগে মাথার মধ্যে দপ দপ করতে লাগলো। কালকে তার ভাই যা বলেছে তা’ কি মিথ্যা অযুহাত ছিল তার জন্য। আর প্রিয়া কি সত্যিই তার ভাইয়ের প্রেমে পড়ে গেছে?
সে কিছুই ভাবতে পারছিলো না। দ্রুতই একজনকে কল দিলো তার ভাইকে ফলো করতে। নিজেও তৈরি হলো দ্রুতই। তার ভাই আর প্রিয়া সে কাউকে ছাড়বে না।
প্রায় আধাঘন্টা পর সৌরভের কাছে কল আসলো। তার ভাই প্রিয়াকে নিয়ে হোটেলে গেছে। সৌরভের ঘৃণায় শরীর রি রি করলো। ছিঃ এত বড় ধোঁকা দিলো তাকে। আর প্রিয়াও রাজি হয়ে গেলো? সেও ছুটলো বাইক নিয়ে।
চলবে,,,,,,,,,,,,,
#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_২৪ (সত্য উন্মোচন)
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
প্রিয়া বিমূর্ত দাঁড়িয়ে আছে। গল্প সিনেমায় মেয়েদের সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনেছে বা দেখেছে। কিন্তু বাস্তবতায় এত রূপবতী মেয়ে সে কখনো দেখেনি। সেই মেয়ে হয়েও বিমোহিত মেয়েটার রূপ দেখে। রূপে অপূর্ব অপ্সরী যেনো ডানা কাটা পরী। যদিও কবিরা মেয়েদের সৌন্দর্যের বর্ণনা খুব সুন্দর করে দিয়েছেন। কিন্তু তার কাছে এই মেয়ের সৌন্দর্য সেই বর্ণনা থেকে হাজার গুণ বেশি মনে হয়। হরিণীর মতো টানা টানা অক্ষিযুগল, দাগহীন লম্বাটে মুখস্রী, গোলাপের পাঁপড়ির মতো ওষ্ঠদ্বয়, গায়ের রঙ চাঁদের আলোর মতই শুভ্র কোমল, ছিপছিপে লতার মতই গাত্র। তার চেয়ে মেয়েটা আরো কয়েক ইঞ্চি লম্বা হবে। চোখ ধাঁধানো সুন্দরীই বলা যায়। সত্যিই অসাধারণ!
প্রিয়া হা’ হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। তার কোনো হুঁশজ্ঞান নেই সে কি করছে? তার সামনে এসে মেয়েটাই প্রথমে কথা বললো,
তুমিই প্রিয়া। তোমার কথা অনেকবার গৌরবের কাছে শুনেছি? কেমন আছো তুমি?
প্রিয়ার মুখ নিঃসৃত একটা কথায় উচ্চারিত হলো, ‘মাশাল্লাহ’ আপু তুমি কি সুন্দর!
মেয়েটা মিট মিট করে হাসলো। প্রিয়ার চিবুক ধরে হালকা উঁচিয়ে বলল কিন্তু তুমি অনেক কিউট। ঠিক গৌরব যেমন তোমার বর্ণনা করেছে। প্রিয়া তাচ্ছিল্য হাসলো। কি যে বলো না আপু? কোথায় তুমি আর কোথায় আমি?
মেয়েটা আবারো হাসলো। প্রিয়া এবার ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
আচ্ছা, আপু তোমার বাড়ি কোথায়?
“পাকিস্তান”
প্রিয়া বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো। কিহ! তোমার বাড়ি পাকিস্তান। তাহলে এত শুদ্ধ বাংলা কিভাবে বলছো?
“গৌরব শিখিয়েছে। আমার দাদু কিন্তু বাংলাদেশী ছিল। আমাদের পুরো পরিবার অনেক আগে থেকেই কানাডায় থাকে। সেখানে প্রচুর বাঙালি ছিল আমাদের সাথে। এমনকি আমাদের ভার্সিটির অনেক স্টুডেন্টও বাঙালি ছিল। তাই বাংলা শিখতে খুব একটা কষ্ট হয়নি।”
গৌরব ভাইয়ার সাথে তোমার পরিচয় হয়েছে কিভাবে?
“ভার্সিটিতে এক সাথে পড়তাম। তোমার গৌরব ভাইয়া সারাক্ষণই আমার পিছনে ঘুরঘুর করতো। পুরো দুইবছর ঘোরানোর পর মনে হলো এই ছেলেটাই আমার বাচ্চার বাপ হওয়ায় উপযুক্ত। তারপর আর কি হ্যাঁ’ বললাম। তবে শর্ত ছিল বিয়ে করতে হবে আগে তারপর প্রেম।
প্রিয়া যারপরনাই অবাক। ইশ! ঐ সৌরবিদ্যুৎ যদি তার পিছনে ঘুরঘুর করতো তাহলে সেও পাক্কা দুইবছর ঘুরাই তো। কিন্তু ব*জ্জাত ছেলে ঘুরঘুর তো দূরে থাক একটু ভালো করে তাকায়ও না। প্রিয়া মনে মনে আফসোস করলো। কিন্তু মুখে মেকি হাসি দিয়ে বলল,
আপু তোমার নাম কি?
‘আলিশবা জান্নাত’
কি দারুণ নাম তোমার? তোমাদের বিয়ে হয়েছে কত বছর?
‘তিন বছর’
প্রিয়ার বিস্ময়ের ঘোর যেনো কাটছেই না। এত বছর বিয়ে হয়েছে গৌরব ভাইয়ার। কিন্তু পরিবারকে কেনো জানাইনি। এখন কি যে হবে কে জানে?
আলিশবা মৃদু হেসে বলল,
তুমি বসো আমি ভিতর থেকে আসছি।
আচমকা গৌরবও প্রিয়ার সামনের সোফায় এসে বসলো। দুইজনে কথা বলছিল। হঠাৎ দরজার করাঘাতে দুইজনে চমকে উঠলো। প্রিয়া দরজা থেকে যৎসামান্য দূরে ছিল। তাই সে উঠে দাঁড়ালো দরজা খোলার জন্য। গৌরবও অত মাথা ঘামাইনি ভেবেছিল হোটেলের কোনো স্টাফ হবে হয়তো?
দরজা খুলে প্রিয়া বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে সৌরভের দিকে। কিন্তু সৌরভের দৃষ্টিতে কোন বিস্ময় নেই তার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করে রেখেছে। পুরো মুখশ্রী জুড়ে রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে। প্রিয়া মাত্রই মুখ খুলেছে কিছু বলার জন্য। তার আগেই সৌরভের পুরুষালী বলিষ্ঠ হাতের সপাটে এক চ*ড় গিয়ে পড়েছে প্রিয়ার মুখে। সাথে সাথে হাতের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে প্রিয়ার মুখে। সৌরভ ফোঁস ফোঁস করে দুই শব্দ আওড়ালো,
বেহায়া, নির্লজ্জ মেয়ে।
প্রিয়া কয়েক সেকেন্ডের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। তার মাথা ঝিম ঝিম করছে। মস্তিষ্কও পুরো ফাঁকা হয়ে আছে। সৌরভ তাকে কেনো চড় দিলো বোধগম্য হলো না। তবে শরীরের আঘাতের চেয়েও তার অন্তঃকরণে বেশ আঘাত লেগেছে। সে বলিষ্ঠ হাতের থা*প্পড়ের ভার সইতে না পেরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। দুই হাঁটু গেড়ে বসলো।
সৌরভের এমন উগ্রতা দেখে গৌরব বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তার ভাইয়ের আচমকা হলো ‘টা কি? সে প্রতিবাদ করার জন্য মনস্থির করলো। তার আগেই সৌরভ ভাইয়ের কলার চেপে ধরলো। গৌরব কিছু বলার আগেই সৌরভ গর্জে উঠলো,
বেই*মান, নিম*কহারাম তোকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি। তুই তো ঘরের শত্রু বিভীষণ। হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো গৌরবকে ঘু*ষি দেয়ার জন্য। সেই মূহুর্তে আলিশবা এসে চিৎকার দিলো,
সৌরভ ভাই প্লিজ, ওকে মা*রবেন না।
সৌরভ আচমকা মুখ ঘুরে তাকালো। অন্য আরেকটা মেয়ে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলো। সে কিছু ভাবতে পারলো না। গৌরবের প্রতি তার রাগ যেনো আরো থরথর করে বাড়লো। ফোঁস করে প্রশ্ন ছুঁড়লো গৌরবকে,
তুই হোটেলে মেয়ে নিয়ে রাত কাটাস। ছিঃ! ভাই ছিঃ! তোকে ভাই বলতেও ঘেন্না হচ্ছে।
গৌরব নিজের মাথায় নিজেই কয়েক ঘা’ লাগালো। তারপর ভাইকে বললো,
বউয়ের সামনে অন্তত মানসম্মান তো একটু রাখ ভাই।
সৌরভ চেপে রাখা কলার একটু ঢিলে করলো। মস্তিষ্কে বার বার এক কথা উচ্চারিত হল ‘বউ’।
তড়িৎ প্রশ্ন করলো। মেয়েটা কি হয় তোর?
গৌরব গম্ভীরস্বরে বলে উঠল তোর ভাবী।
সৌরভ কপাল কুঁচকে আছে। এই মূহুর্তে তার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি চাইলো। আলিশবা পানি এনে দিলো। সৌরভ দ্রুতই পানি পান করছিলো।
আচমকা গুটি গুটি পায়ে এসে দেড়বছরের শিশুর ছোট্ট দু’হাত সৌরবের পিছনের জামায় টান দিলো। আধো আধো বুলিতে আওড়ালো,
পা,,পা।
সৌরভ চকিতে পিছনে তাকালো। বিস্ময়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। ভাবনার জগৎ তার শূন্য। দৈবাৎ প্রশ্ন করলো,
ভাই এটা তোর ছেলে?
গৌরব ভয়ে ইতিউতি করছিলো। তারপর মুখে শুষ্ক হাসি ঝুলিয়ে মাথা নাড়ালো। ব্যস, সৌরভ আর দেরি করলো না। এক ঘুষি মারলো গৌরবের মুখে। গৌরবও তাল সামলাতে না পেরে সোজা সোফার নিচে গিয়ে পড়লো। সৌরভ আবারও ভাইকে চেপে ধরলো। সত্যি করে বল বিয়ে করেছিস কবে?
গৌরব হা করে নিশ্বাস ছাড়লো। ভয়ে তার হাত-পা কেঁপে উঠলো। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছিলো না। তবুও কম্পিত স্বরে বলল,
তিন বছর দুই মাস।
বাড়িতে কাউকে জানাসনি কেনো?
ভয়ে বলিনি যদি আলিশবাকে কেউ মেনে না নেয়। আমি বাংলাদেশী হয়ে বিদেশী মেয়ে বিয়ে করি যদি মা-বাবা কেউ রাজি না হয়। তাই বলিনি আর।
তুই মহান কাজ করেছিস নিজের বউ-বাচ্চাকে হোটেলে লুকিয়ে রেখে। সবাইকে এত জ্ঞান দিস অথচ নিজের বেলায় এটা কি করলি? চোরের মত বউয়ের সাথে দেখা করিস? ছিঃ!
তুই বাসায় গিয়েছিস পাঁচদিন। এই পাঁচদিন এরা হোটেল রুমেই ছিল।
গৌরব ছোট্ট করেই বলল, ‘হু’
আমি তোকে কি আর বলবো বল? বাকি যা বলার মা-বাবাই বলুক। সৌরভ ভাইকে আর কিছু না বলে মোবাইল বের করে ডায়াল করলো কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে। তাদের কে বললো গাড়ি সাজাতে ফুল দিয়ে। এরপর শোভাকে কল দিলো। শোভা কল রিসিভ করা মাত্রই বলল আমার বাগান থেকে ফুল নিয়ে বাসা সুন্দর করে সাজাবি ভাইয়ের রুমসহ। শোভা হা’ হয়ে আছে ভাইয়ের কথা শুনে। প্রশ্ন ছুঁড়লো কেনো ভাই? সৌরভ শুধু ছোট্ট করে দু’শব্দ উচ্চারণ করলো আমাদের নতুন উত্তরাধিকারী আসবে। আম্মাকে ফোন দেয়।
নাজমা কথা বলতেই সৌরভ মা’কে বললো, আম্মা তোমার ঘর গোছানো আর অগোছালো করার মানুষ আসতেছে। তৈরি থাকো। স্পেশাল অতিথির জন্য স্পেশাল রান্না করো জলদি। নাজমা সৌরভের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। শুধু হু হা বাক্য বিনিময় করলো।
তারপর আলিশবাকে বললো, ভাবি আমাদের পিচ্চির নাম কি?
আলিশবা কম্পিত কন্ঠস্বরে বলল, ‘আরাভ মাহমুদ’
সৌরভ আরাভকে কোলে তুলে মুখের মধ্যে ছোট্ট করে হামি দিয়ে দেয়। আরাভ খিল খিল করে হেসে উঠে। মুখ দিয়ে একটা বুলিই আওড়াই, পা,,পা। সৌরভও নিসংকোচে বলে উঠল হ্যাঁ পাপাই।
গৌরব চাচা-ভাতিজাকে দেখে অবাক হলো। কিন্তু মনে মনে আৎকে উঠলো। আজকে কি হবে কে জানে?
সৌরভ এতকিছুর ভীড়ে অনেকক্ষণ পরে খেয়াল করলো প্রিয়া রুমে নেই। সে আলিশবাকে জিজ্ঞেস করল,
ভাবী প্রিয়া কোথায়?
আলিশবা গৌরব দুইজনে অবাক হলো। প্রিয়া তো এখানেই ছিলো। গেলো কোথায়? তারা দুইজনে মাথা নাড়ালো তারা জানে না। সৌরভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তার ভাইয়ের চক্করে সে প্রিয়াকেও ভুল বুঝলো। মেয়েটা এখন গেলো কোথায়? সে আরাভকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে ভাইয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে শাসালো,
তোকে তো পরে দেখছি, আগে প্রিয়াকে ঠিক করে নিই। আমি আবার আসব ভাবী আর আরাভকে নিতে। কিন্তু তুই আমাদের বাড়ীর আশেপাশেও যাবি না। তোকে যদি দেখি আমাদের বাসায় গিয়েছিস। তোকে মেরে তারপর আমি জেলে যাব।
কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে সে নেমে পড়ে। নিচে নেমেও সে প্রিয়াকে দেখতে পাই না। মাত্র দশমিনিটে মেয়েটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো? তার কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠল। আশেপাশে সবকিছু খুঁজলো। বাইকে উঠে রাস্তার চারপাশটা ভালো করে দেখলো।
আচমকা একটা লোক বলল মেয়ে একটা অ্যাকসিডেন্ট করছে। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অবস্থা খুব আশংকাজনক।
এই কথা শুনে সৌরভের কলিজায় ধ্বক করে উঠলো। বাইক নিয়ে ছুটলো হাসপাতালের দিকে। মনে মনে বললো প্রিয়া আমি সত্যিই অনুতপ্ত তোমাকে এভাবে ভুল বোঝা উচিৎ হয়নি। আর কখনো এমন কিছু হবে না।
সর্যি প্রিয়া। তোমার যেনো কিছু না হয়।
চলবে,,,,,,,,,,,