শত্রু শত্রু খেলা পর্ব-০৫

0
646

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৫
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

প্রিয়া হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে আছে পরশের দিকে। পরশের বত্রিশ পাটি দাঁত বের করা হাসি দেখে সে সৌরভের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। সে বুঝতে পারে না সার্কাস এই চামচিকাকে কোত্থেকে আমদানি করলো? ব*জ্জাত সার্কাস এভাবে চুপ করে আছে কেনো তার বোধগম্য হলো না।

প্রিয়া কিছু অকাট্য ভাষা সৌরভের উদ্দেশ্য বলতে যাবে সে মূহুর্তে সৌরভ মিষ্টি এক হাসি দিলো সবার দিকে তাকিয়ে। তারপর লাজুক ভঙ্গিতে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো আসলে আমি চাইলেও প্রিয়ার প্রাইভেসির কথা ভেবে আমাদের সম্পর্কের কথা কারো সামনে আনতে চাইনি। তাছাড়া আমরা নিজেদের মধ্যে একটা পরিকল্পনা করে রেখেছি প্রিয়ার এইচএসসি পরীক্ষা আর আমার মাষ্টার্স শেষ হলে পরিবারকে জানাবো। এর আগে আমরা সাধারণ ভাবে একে অপরের সাথে কথা বলবো যাতে অন্যরা বুঝতে না পারে। তাই সবার সামনে সেইভাবে কথা বলা হয় না অপরিচিতদের মত থাকতে হয়। তবে রাতভর ফোনালাপ হয়। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও ঘুরে আসি যাতে পরিচিত কেউ না দেখে। তাই না প্রিয়া! বলো তোমার বন্ধুদেরকে আমাদের সম্পর্কের কথা। আর কত বন্ধুদের কাছে লুকিয়ে রাখবে বলো তো? এর আগেও তোমাকে কতবার বলেছি কিন্তু তুমি বলোনি।

প্রিয়ার মাথায় আকাশ ভে*ঙে পড়লো। এই সার্কাস আষাঢ়ে গল্প কোত্থেকে বলছে? প্রচন্ড রাগে তার মাথার শিরাগুলো দপ দপ করে জ্বলে উঠলো। রক্তিম চোখে মাত্রই মুখ খুললো প্রিয়া। আপনার মাথায় কোনো সমস্যা আছে? এসব কি বলছেন? বাকি কথা প্রিয়া শেষ করার আগে সৌরভ ছোঁ মেরে প্রিয়ার হাত ধরে রেষ্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলো।

সেখানে বসে বাকি’রা বিস্ময়ে হা’ হয়ে দেখতে লাগলো এক কপোত-কপোতীর প্রেমময় মূহুর্ত।

পরশ তো বেকুব বনে গেছে। সে তো একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলো বন্ধুকে। ভেবেছিলে প্রিয়ার সাথে সে লাইন মারবে। কিন্তু বন্ধু যে সত্যিই সত্যিই এই মেয়ের সাথে সম্পর্কে আছে সে ঘুণাক্ষরেও জানতো না। কত ধড়িবাজ বন্ধু তার। এরকম বন্ধু থাকার থেকে না থাকায় ভালো।

প্রিয়া সৌরভের সাথে ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। কিন্তু সৌরভ রেষ্টুরেন্টের বাইরে এনে হাত ছেড়ে দিলো। প্রিয়ার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। সে ফোঁস ফোঁস করে বললো এসব কি?

সৌরভ প্রিয়ার দিকে তাকালো না। অতিদ্রুত বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। বাইকে বসে প্রিয়ার দিকে পিছনে একবার তাকালো। কুটিল হাসি দিয়ে বললো এসব কর্মের ফল তোমার প্রিয়ারাণী। আর কিছু না বলে সে বাইক নিয়ে ছুটে গেলো তার গন্তব্য।

প্রিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। মস্তিষ্কে আর বেশি চাপ দিলে র*ক্তক্ষরণ হবে তার। সব ঘোলাটে অদ্ভুত লাগছে। এই সার্কাসকে তার বড্ড অচেনা। তবে এই ব*জ্জাতকে ছাড়বে না এভাবে অপদস্ত করা।

রাঢ়ী, নীল, শ্রাবণও রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। প্রিয়াকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। ভেবেছিলো সে সৌরভের সাথে চলে গেছে। রাঢ়ী প্রিয়ার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে প্রিয়ার উদ্দেশ্য বলে উঠলো,

প্রিয়া তুই আমাদের এভাবে বোকা বানালি? আমাদের বললে কি আমরা তোর সৌরভকে কেড়ে নিতাম। বাই দ্যা রাস্তা এখন আমাদের ট্রিট দিতে হবে।

প্রিয়া ক্রোধান্বিত হয়ে রাঢ়ীকে ক*ষে এক থা*প্পড় বসিয়ে দিলো। দেখ কিছু না জেনে এভাবে কথা বলবি না। প্রথমত আমি ঐ সৌরবের ছায়াও মাড়ায় না আবার প্রেম ভালোবাসা। দ্বিতীয়ত মিথ্যা বলা আমার একদম পছন্দ নয়। বাইরের মানুষ কি বললো সেটা শুনেই বিশ্বাস করে ফেললি। আমাকে তোদের বিশ্বাস হয় না। এই তোদের বন্ধুত্ব। থাক তোরা তোদের মত। তোদের মত বন্ধুর আমার প্রয়োজন নেই।

প্রিয়া কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালো না। রিকশা ডেকে নেয় বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য।

রাঢ়ী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নীল, শ্রাবণ মুখে হাত দিয়ে বসে আছে।

______________

বাসায় এসেও অস্থির লাগছে প্রিয়ার কাছে। হাঁসফাস করতে লাগলো। সার্কাস সবার সামনে মিথ্যা কেনো বললো সেটা তাকে জানতে হবে। আবার কি বলল তাকে সেটা নাকি তার কর্মের ফল। বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলো আর আপনমনে বিড়বিড় করছিল। প্রত্যুষ এসে তার শিয়রে দাঁড়ানো কিন্তু প্রিয়ার কোনো হুঁশ নেই। সে তখনো তার ভাবনায় ডুবে আছে।

প্রত্যুষ বোনকে বিড়বিড় করতে দেখে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। আপু তোমার কি হয়েছে কার সাথে কথা বলছো? প্রিয়া আচমকা ভাইকে দেখে আৎকে উঠলো। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ভাইয়ের দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো কি ব্যাপার? কিছু বলবি আমাকে? প্রত্যুষ নিজের পকেট থেকে প্রিয়ার মোবাইল বের করে তার হাতে দিলো। প্রিয়া মোবাইল দেখে মনে মনে খুশি হলেও মুখে কৃত্রিম রাগ দেখালো। ভাইকে বললো যা মোবাইল নিয়ে যা আমার লাগবে না। আম্মুকে বল আলমিরায় তালাবদ্ধ করে রেখে দিতে।

প্রত্যুষ মুখে কিছু না বলে মোবাইল রেখে এক ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। প্রিয়া নিশব্দে হেসে উঠল ভাইয়ের কান্ড দেখে।

দেয়াল ঘড়িতে সময় বিকেল ৫টা। প্রিয়া এক ছুটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তার অস্থির দৃষ্টি এখন সৌরভকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার কোচিং শেষ এই সময় সে বাসায় ফিরে আসে। আর বিকেলে ছাদে তার বাগানে গিয়ে বসবে।

বাসা থেকে কিঞ্চিৎ অদূরে সৌরভের বাইক দেখে প্রিয়ার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। বিড়বিড় করে উঠলো,

আসো বাছাধন, তোমার জন্য বিশেষ সেবা রেখেছি আজকে।

___________

ঘামার্ক্ত শরীরে বাসায় প্রবেশ করে সৌরভ। তার আজকে অনেক ধকল গেছে। গায়ের জামা খুলে বারান্দা মেলে দিলো। তার চক্ষুদ্বয় একবার পাশের বারান্দায় চোখ বুলালো। মুখের কোণে সূক্ষ্ম হাসি দেখা দিলো তার। মেয়েটাকে সে আচ্ছা ভাবে আজকে জব্দ করেছে। তখনকার প্রিয়ার মুখটা মনে পড়তেই হাসির ছোটে তার দমবন্ধ হয়ে আসে।

ফ্রেস হয়ে গায়ের কাপড় চেইঞ্জ করে ছাদে ছুটে চলে। প্রতিদিন তার বিকেলে একবার ছাদে যেতে হয়। বাগানে গেলেই তার মনে প্রশান্তি ছেয়ে যায়। তাই যতই ব্যস্ত হোক বিকেল হলেই ছুটে যায় তার বানানো প্রকৃতির রাজ্যে।

সে আপনমনে হেলেদুলে ছাদের দরজা খুলে। কিন্তু কিছু ঠাহর করার আগেই তার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত কারো হাতের কাপড় দ্বারা আবৃত হয়ে যায়। সে বুঝতেও পারে না তার সাথে হচ্ছেটা কি? তার আগেই এলোপাতাড়ি কি*ল, ঘু*ষি পড়তে থাকে তার পিঠের মধ্যে।

সৌরভ চিৎকার করতেও পারছে না আবার চোখেও কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তারপরও আন্দাজে হাতড়ে হাতড়ে সেই অদৃশ্য দু’হাত ধরে ফেললো। তারপর নিজের চোখ থেকে কাপড় সরিয়ে যাকে দেখলো তার চক্ষুদ্বয় কোটর থেকে বের হবার উপক্রম।

কি সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার! এই মেয়ে ঘরে বাহিরে যেখানে সেখানে তার গায়ে হাত তোলে। মুখ থাকতে এই মেয়ে সবসময় হাত দিয়ে কথা বলে।

সৌরভ প্রিয়ার দু’হাত উল্টো করে তার পিঠের দিকে চেপে ধরলো। সৌরভের বলিষ্ঠ হাতের বন্ধনে প্রিয়া আটকে আছে। সে ছোটার চেষ্টা করেও হাত ছুটাতে পারছে না। দুজন দুজনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দুজন দুজনের নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে। কারো চোখে জিজ্ঞাস্য আর কারো চোখে ভয়।

সৌরভ চোয়াল শক্ত করে বলল কি ব্যাপার! তুমি যখন তখন আমার গায়ে হাত তুলছো। ন্যূনতম ভয়ডর কি নেই তোমার মধ্যে।

প্রিয়াও চেতে গেলো সৌরভের কথা শুনে। আপনি রেষ্টুরেন্টে এসব কেনো বলেছেন?
আপনার সাথে আমার কিসের সম্পর্ক আছে। সবার সামনে এভাবে মিথ্যা বললেন কেনো?

ওহহ, এই কথা। এটাতো ট্রিট ফর ট্যাট। তুমিও তো আমাকে কম জ্বালাও নি। তার জন্য ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ গ্রিফট তোমাকে দিলাম।

আমি কি করেছি আপনাকে?

ওমা! ভুলে গেলে। সকালে মারিয়া আন্টির কাঁচামরিচের কৌঠা খালি করে আমাকে মরিচের নুডলস খাইয়েছো। কাল রাত দেড়টাই ভূতের মত গিয়ে আমার বাইককে নালার পানি দিয়ে গোসল করিয়েছো। ব্যাই দ্যা ওয়ে আমার রুমে ব্যাঙগুলোও তুমি ছেড়েছো। ঐদিন সিঁড়িতে তেল ছিটিয়ে দিয়েছো যাতে আমার হা-পা ভে*ঙে ল্যাংড়া হয়ে যায়। অবশ্য তুমি সফলও হয়েছে। আর কি কি করেছো? আচ্ছা আমার আন্ডাওয়্যারেও কাঁটাগুলো তুমি দিয়েছো।

প্রিয়া আমতা আমতা করতে লাগলো ভয়ের ছোটে। আমি আসলে কখন করেছি?

সৌরভ বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বললো কি ভেবেছে আমি কিছুই জানতে পারবো না। সিসি ক্যামেরা নামে একটা মেশিন আছে সেই কথা তুমি বেমালুম ভুলে গেছো তাই না?

প্রিয়া মাথা নত করে আছে। সে কি বলবে কথায় খুঁজে পাচ্ছে না। ভয়ে সারা শরীর হিম হয়ে গেছে। সে সৌরভের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে আছে। বের হওয়ার জন্য হাঁসফাস করছে।

সৌরভ এবার রক্তিম চোখে তাকালো প্রিয়ার দিকে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল বার বার তুমি আমার গায়ে হাত তুলছো। এত কাছে আসতেছো। আমি যে পুরুষ মানুষ সেটা ভুলে গেছো। তারওপর অবিবাহিত পুরুষ। আমি ভদ্র হলেও অতটাও ভদ্র নয় একটা মেয়েকে কাছে পেলে বার বার ছেড়ে দেবো? পরে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেললে তখন দোষ দিতে পারবে না।

প্রিয়া ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল। সারা শরীর শির শির করছে সৌরভের কথা শুনে। কিন্তু মুখে তেজ বিদ্যমান রেখেই বললো অঘটন ঘটানোর বাকি কি রেখেছেন? আমাকে পিছু করা, আম্মুকে আমার নামে যা নয় তা বলা আমি চরিত্র-হীন মেয়ে। আজকে আবার আমার বন্ধুদের সামনে এত বড়ো মিথ্যা বলে এসেছেন। আপনার জন্য আমার বন্ধুরা আমাকে বিশ্বাস করছে না। কেনো করেছেন এসব? আমি আপনার কোন পাঁকা ধানে মই দিয়েছি?

সৌরভ বিস্ময়ে হা’ হয়ে আছে। এতকিছু কখন হলো সে তো এসবের কিছুই জানতো না। সেদিন ভিডিওটা প্রিয়ার সেফটির জন্য করেছে। এই বয়সে মেয়েদের আবেগ বেশি থাকে। তাই মারিয়াকে শুধু বলেছে আন্টি প্রিয়া ছোটো মানুষ হয়তো আবেগে কোনো ভুল করতে পারে। কিন্তু আপনি ওকে বুঝাবেন যাতে ভুল না করে। তাই বলে সে মারিয়ার কাছে কখনো প্রিয়াকে চরিত্রহীন বলে নি।

সৌরভ চোখমুখ কুঁচকে বললো আমি চরিত্র-হীন কখনো বলেনি মারিয়া আন্টিকে।

না বললে আম্মু আর আমাকে এত কিছু বলতো না। আপনার নিজেরই চরিত্রের ঠিক নেই আবার আমাকে চরিত্র-হীন বলেন।

আমার চরিত্রের ঠিক না থাকলে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে তুমি আর কথা বলতে পারতে না বেয়া*দব অনেক কিছু হয়ে যেতো।

আপনি কতো চরিত্রবান তা তো দেখতেই পাচ্ছি। একটা মেয়ের হাত ধরে রেখে দিয়েছেন। আগে আমার হাত ছাড়ুন তারপর কথা বলুন।

সৌরভ ক্রোধান্বিত হয়ে বলল যদি না ছাড়ি কি করবে আমার?

প্রিয়া কুটিল হাসি দিলো সৌরভের উদ্দেশ্য। তারপর এমন একটা কাজ করলো যা সৌরভের ভাবনার অতীত। সে প্রিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে ব্যথায় ককিয়ে উঠলো। থুতনিতে হাত চেপে বললো কি রাক্ষুসি মেয়ে রে বাবা!

প্রিয়া হাত ছাড়া পেয়ে দৌড়ে পালালো। একবারের জন্যও পিছনে তাকালো না। সে আজকে ভয়ংকর এক কাজ করে ফেলেছে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে