#শক্তিময়ী
পর্ব ২০
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
সমুদ্র তার বাবাকে জানিয়েছে, সে একজন মেয়েকে ভালোবাসে। অ্যামেরিকান। ওর সহপাঠী। ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট। খুব ভালো। দেখতে সুন্দর। চোখজোড়া সমুদ্রের মতো নীল। নাম পলিন। সমুদ্র আর পলিন পরস্পরকে খুব ভালোবাসে। পলিনকে দেখলে বা তার কথাবার্তা শুনলে তাকে ভালো লাগবেই। একটাই সমস্যা, পলিনের মা মার্থা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। তাঁর বাবা -মা যার যার নতুন সংসার নিয়ে সুখী, ব্যস্ত ছিলেন। ছোট্ট মার্থার জায়গা হয়নি কোথাও। দূর সম্পর্কের এক খালার কাছে বড় হয়েছেন এবং অল্প বয়স থেকেই তিনি অনেক পুরুষের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এটাই মূলত তাঁর পেশা। একটা সন্তানের শখ ছিলো, তাই তাঁর পৃথিবীতে পলিনের আগমন। পলিনকে তিনি বাবা-মা দু’জনের ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন। সমুদ্র পলিনকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। সমুদ্র আমেরিকাতেই খুব ভালো চাকরি পেয়েছে তীক্ষ্ণ মেধার জোরে। আনন্দ ভাইয়া -তিথি ভাবী মত না দিলে সে পলিনের সাথে লিভ টুগেদার করবে ভেবেছিলো, কিন্তু এতে পলিন-মার্থা রাজি না। পলিন ধর্ম ও আইন মেনে বিয়ে করতে চায়, সে আনন্দ আর তিথির সম্মতি ছাড়া বিয়ে করবে না। বিয়ের আগে সে সমুদ্রকে আঙুল ও স্পর্শ করতে দেবে না।
ফুপু অবিরাম কাঁদছেন। তিনি গোঁড়া নন কিন্তু খুবই পরহেজগার। একজন পতিতার সন্তান তাঁর নাত বৌ হবে, একজন খ্রিস্টান মেয়েকে সমুদ্র বিয়ে করবে,সবচেয়ে বড় কথা,সমুদ্র দেশে ফিরবে না,আমেরিকাতে সেটেল করবে,এতোগুলো বিষয় ফুপু-ফুপার পক্ষে মানা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফুপু রুদ্ধ গলায় ফোনে সমুদ্রকে বললেন,”আমরা যে কটা দিন দুনিয়ায় আছি,সে কটা দিন দেশে থাক দাদাভাই। কথা তো ছিলো লেখাপড়া শেষে চলে আসবি দেশে।”
“দেশে আছেটা কি দাদুমনি? এমন দেশে মানুষ থাকে?তোমরা বরং এখানে চলে এসো।”
“বেড়াতে যেতে পারি, কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। আর তুই কাকে পছন্দ করলি?একবার আমাদের কথা ভাবলি না?”
“লাইফ পার্টনার সিলেকশনের সময় একমাত্র নিজের পছন্দকেই ইমপরট্যান্স দিতে হয়। ”
“বাবা-মায়ের ইচ্ছারও কোনো দাম নেই? ”
“না। এই ক্ষেত্রে নেই। ”
ভাবীর আব্বা-আম্মা বাকরুদ্ধ। রুবী খালাম্মা ভাঙা গলায় বললেন,” বেয়ান,আপনার ফ্যামিলি তো বড্ড বিচিত্র হয়ে যাচ্ছে। আমার মেয়ে প্রথমে সংসারে একজনকে ঢুকালো, আনিলা এক অবৈধ বাচ্চাকে অ্যাডপ্ট করলো, এখন আপনার নাতি প্রস্টিটিউটের মেয়ে বিয়ে করতে চাচ্ছে? অন্য ধর্মের? সবদিক দিয়ে এতো ভালো আপনি, ম্যানেজমেন্টেও কতো স্কীল্ড,আর আপনার সংসারেই শুধু এসব ঘটে যাচ্ছে? ”
“অদ্বিতীয়া আর এমিলিকে নিয়ে কখনো কোনো খারাপ মন্তব্য করবেন না বেয়ান। দুজনেই আমার নাতনি,একজন ছেলের ঘরের,আরেকজন মেয়ের ঘরের। এই দু’জনকে নিয়ে কথা বলার এক্তিয়ার আপনার নেই। ”
“অবশ্য ই আছে। প্রথমে একটা বেওয়ারিশ বাচ্চাকে ঘরে ঢুকিয়েছেন দেখে আজ আমার সমুদ্র এমন করার সাহস পাচ্ছে। তাকে নিষেধ করলে সে সোজা বলে দিবে,তোমরা অবৈধ বাচ্চাকে পালতে পারো,আমি অবৈধ মেয়েকে বিয়ে করতে পারি না?”
“ব্যাস। এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াবেন না। ”
“আমি সমুদ্রের নানি।আমার শতভাগ অধিকার আছে ওর বিষয়ে ভাবার,কথা বলার।”
“আপনি সমুদ্রের সাথে কথা বলেন। তবে হ্যাঁ, অদিতি আর এমিলিকে নিয়ে টানা হেঁচড়া বাদ দিন।”
এদিকে আনন্দ ভাইয়া তিথি ভাবীকে বলছেন,”তুমি কি বলো?”
“দেখি পলিন আর ওর মায়ের সাথে কথা বলে। সমুদ্রের সাথেও কথা বলি। ওদের ভালোবাসার ডেফথ বোঝার চেষ্টা করি। সত্যি একে অন্যকে ভালোবাসলে ঠেকাই কোন যুক্তিতে?”
“মায়ের প্রফেশন?”
“এটা নিয়ে কি বলবো,বলো। উনি তো কোনো লুকোছাপা করেন নি। আর মেয়েকে শুধু মাত্র মায়ের প্রফেশনের জন্য রিজেক্ট করি কেমন করে?তাছাড়া তোমার ছেলে তো মনস্হির করেই আছে। দেখেছো তো,আলগা আহ্লাদের ফল। যা মনে করবে,সেটাই করবে। কারোর মতামতের তোয়াক্কা করে না।”
” আমেরিকান, অন্য ধর্মের, মায়ের প্রফেশন, তাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড। ”
“এতে তো পলিনের কোনো হাত নেই। সে -ই বরং আনফরচুনেট। ”
“তবু, মায়ের প্রফেশন মানতে পারছি না।কিছুতেই না। আর আমিওতো বাইরে লেখাপড়া করে এসেছি, পড়া কমপ্লিট করে দেশে চলে এসেছি।বাপ-মা-আত্মীয় -স্বজনের ভ্যালু নেই? দেশের প্রতি দায়িত্ব নেই? ”
ভাবী সামলে নিলেন। এমনি এমনি পরিবারে তার নাম দশভূজা হয় নি। টেলিফোনে দফায় দফায় সমুদ্র, পলিন আর মার্থার সাথে কথা বলা,তারপরে একসময় আনন্দ ভাইসহ আমেরিকায় যাওয়া।
ভাবী দুই সপ্তাহ পরে ফিরলেন। তাঁর দেওয়া তথ্যগুলো হলো, পলিন আসলেও খুব ভালো একজন মেয়ে। তার চিন্তাভাবনা, আচরণ রীতিমতো অনুকরণীয়। আর পলিনের মাও অসাধারণ একজন মহিলা। তাঁর কথাবার্তা, কাজকর্ম, চিন্তাভাবনা খুবই স্বচ্ছ। অনেক জনকল্যাণমূলক কাজও তিনি করেন। মানবিকতায় অনন্যা।
রুবী খালাম্মা তিক্ত হাসি হেসে বললেন, ” ছোটবেলায় আজানের শব্দ শুনলে ফ্রকের পিছনের কাপড় তুলে মাথা ঢাকতাম, প্যান্ট থাকুক আর না থাকুক, মার্থার গল্প হুবহু সেই রকম। প্রস্টিটিউট হচ্ছেন সোসাল ওয়ার্কার।”
“জামা তোলার উদাহরণ তোমার ক্ষেত্রেও খাটে আম্মু, সো কল্ড সোসাল ওয়ার্কার, কিন্তু মেয়ের দত্তক কন্যাকে আকন্ঠ ঘৃণা, তার সাথে সবসময় জঘন্য ব্যবহার। আল্লাহর অশেষ রহমতে যে মেয়ে তোমার বাঁচার উসিলা হলো, তার সাথে দুটা ভালো কথা দূরের কথা,তাকে নানান কায়দায় নাজেহাল করা।আম্মু,তোমরা অকৃতজ্ঞও না,কৃতঘ্ন। সমাজ সেবিকা হয়ে প্রস, আনওয়ান্টেড চাইল্ডে তোমার ভীষণ ঘৃণা। কখনো বাংলাদেশের পতিতালয়ে গিয়েছো?জেনেছো,কেমন করে তারা ট্র্যাপে পড়ে,তারপর হাজার ইচ্ছা আর চেষ্টাতেও বাইরে বের হতে পারে না? তাদের রুজি রোজগার দিয়ে পরিবার চলে,কিন্তু পরিবারে তাদের জায়গা নেই। বাপ, মা-ই বিক্রি করে দিয়েছে কতো মেয়েকে! ওরা শখ করে এই পেশায় নামেনি, পতিতাপল্লীতে এমন একটা মেয়েকে পাবে না যে স্বেচ্ছায় এখানে এসেছে। হাই বা মিডল ক্লাসের মেয়েদের কথা ভিন্ন। ”
“এদের কথা শুনতে চাই নি, শুনতে চাচ্ছি তোমার হাই ক্লাস প্রস্টিটিউট বেয়ানের কথা।”
“আমিও শুনতে চাচ্ছি, এই যে হাজার হাজার অসহায় মেয়েদের পক্ষে কি স্টেপ নিয়েছো তুমি এবং তোমার মতো সোসাল ওয়ার্কাররা?তোমাদের দায় নেই এতে?এতো বড় চাকরি করেছো, ঐ সময়ে সুযোগ ছিল তোমার ওদের জন্য কিছু করার।এখন যে অরগানাইজেশান চালাচ্ছো, অনেক রাজা মহারাজার সাথে তোমাদের খাতির, কি স্টেপ নিয়েছো ওদের জন্য? ওদের রক্ষা করার চেষ্টাও করবে না, আবার প্রাণ ভরে তাদের ঘেন্না করবে, এটা কেমন মেন্টালিটি,আম্মু? তোমরা ডোনেশন, অ্যাডভাইস এসবের জন্য যেসব হর্তাকর্তার কাছে যাও, মিটিং করো, সুনাম করো, সামনাসামনি স্তুতি করো,তারা অনেকেই কিন্তু টানবাজার,দৌলতদিয়ায় যায় আম্মু।”
” চুপ করো। তোমার লেকচার শুনতে আসি নি আমি। আর যাদের কথা বলছো তারা এমন নিচু রুচির না যে ঐসব জায়গায় যাবে, তারা যায়…..”
“থেমে গেলে কেন আম্মু?তারা যায় সমান স্ট্যাটাসের লোভী মহিলাগুলোর কাছে, তাদের মধ্যে তোমার অনেক বন্ধুও আছে, তারা যায় অভিজাত সব হোটেল -মোটেলে। তাদেরতো স্যার স্যার,ভাই ভাই করে মুখে ফেনা তুলে ফেলো! তাদের ঘেন্না লাগে না তোমার? ঘেন্না লাগে বাপ-মায়ের বদমায়েশির জন্য জন্মানো নিষ্পাপ অদিতিকে? যাই হোক মা,আপনাকে বলছি, মার্থা খুব সুন্দর মনের মহিলা। কিন্তু তিনি আয়ের জন্য যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, সেটা নিঃসন্দেহে খুব খারাপ। আসলে শিশু বয়স হতে বাবা-মায়ের অনাদর,অবহেলা পেয়েছিলেন শুধু, বাপ-মা কেউ তাঁকে নিজ সংসারে ঠাঁই দেয়নি,সব জায়গায় ছিলেন অবাঞ্ছিত, যে দূর সম্পর্কের আত্মীয়া আশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনি নিজেই ছিলেন পারভার্টেড। এই কারণেই এতো আদর করে আশ্রয় দেওয়া। কয়েকটা এক্সামপল শুনেছি তাঁর কাছে, মানুষ যে কতো বিকৃত মস্তিষ্ক, কতোটা অত্যাচারী হতে পারে,তাঁর উপরে হওয়া ভয়ংকর অত্যাচারের গল্প না শুনলে জানতাম না। এক পর্যায়ে তিনি পালালেন। ঐ স্টেট থেকে অনেক দূরে। বেঁচে থাকার তাগিদে ছোট খাটো অনেক কাজ করলেন। এই সময়ে তিনি তাঁরই মতো আরেক আনফরচুনেটকে পেয়ে যান, পলিন। পলিনের বাবা-মা দুজনেই দায়িত্ব জ্ঞান হীন,মদ্যপ, মাতাল। পলিনের দুই বছর বয়সের সময় পলিনের মা ওর বাবাকে ডিভোর্স দেন। এবং যথারীতি সন্তানের দায় কেউ নিতে চান না। পলিনের বায়োলজিকাল মা তাঁ বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘর বাঁধেন এবং মেয়েকে তার বাপের হাওলাতে রেখে আসেন। বাপের গার্লফ্রেন্ড আবার দুই বছরের পলিনকে সহ্য করতে পারতেন না।মোট কথা,ম্যাসাকার অবস্থা। মার্থা পলিনের মধ্যে নিজের তীব্র বেদনাময় ও অনিরাপদ শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্য দেখতে পেলেন। পলিনকে তিনি দত্তক নিলেন। সমস্ত অন্তর দিয়ে পলিনকে ভালোবেসে ফেললেন মার্থা। পলিনকে দেখাশোনা আর সংসারের খরচের কথা চিন্তা করে তিনি খারাপ পথে পা রাখেন। এতে প্রচুর পয়সা। পলিনের সামনে কখনো বেহায়াপনা করেন নি। প্রতি রোববারে চার্চে নিয়ে গেছেন। বেস্ট স্কুল,কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন। প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। একটা ওরফানেজ হোম আর একটা ওল্ড হোমে অনেক বছর যাবৎ ডোনেট করেন। পলিন পাশ করে গেছে,চাকরিতে ঢুকেছে।তিনি নিশ্চিন্ত। এখন বাজে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন অরফানেজ হোমে, বাচ্চাদের মায়ের মমতায় বড় করার জন্য। ”
গল্প শুনে ফুপা ফুপু দুর্বল হয়ে পড়েছেন অনেকটা। কিন্তু ধর্ম?বিশাল বাধা।
ফুপু ক্ষীণ গলায় বললেন,”মুসলিম -খ্রিষ্টান বিয়ের বিধান আছে। অবশ্য যে সব খ্রিস্টান মনে করেন হজরত ঈসা (আ) নিজেই প্রভু কিংবা তিনি আল্লাহর পুত্র,তাদের বিয়ে করা যাবে না।”
তিথি ভাবী বললেন,” পলিন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে, মা। আমরা আপনার কথাগুলোই বলেছিলাম ওদের, তখন মার্থা আর পলিন বললো, পলিন ধর্মান্তরিত হবে। ”
“তোর খারাপ লাগছে না তিথি,তোর দশটা না, পাঁচটা না,একটা মাত্র ছেলের বৌয়ের হিস্ট্রি এতো ডার্টি, এতো কমপ্লিকেটেড হবে?”
“খারাপ লাগছে না। পলিন আর মার্থাকে খুব পছন্দ হয়েছে আমার।”
ছয়মাস পরে আমেরিকায় সমুদ্র -পলিনের বিয়ে হয়ে গেলো। আনন্দ ভাইয়া,ভাবী,অদিতি,পরী,ফুপা,ফুপু, ফুপার দুই ভাই, আমার মেজ চাচা এই কয়েকজন দেশ থেকে গেলেন। ওখানে আমাদের অনেক নিকট আত্মীয় স্বজন ছিলেন। তিথি ভাবীর ভাই আমেরিকা থাকেন,তিনিও সপরিবারে বিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন।
মার্থা বা পলিন জানেও না, অদিতি এই পরিবারের দত্তক মেয়ে।সমুদ্র বরাবর তাদের বলে এসেছে তারা তিন ভাই বোন। পরীর থেকেও অদিতির গল্প বেশি করেছে। সমুদ্র এটাও সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে পলিনকে বলে এসেছে,তার যতো সিস্টার,কাজিন সিস্টার আছে, তার মধ্যে অদিতি সবচেয়ে ভালো, মায়াবতী, সমুদ্রের জন্য এই বোনের অসীম মায়া আর সমুদ্রেরও সবচেয়ে প্রিয় বোন অদ্বিতীয়া।
চলবে
#শক্তিময়ী
পর্ব ২১
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
” কি রে টুনটুনি, ভার্সিটিতে কাউকে পছন্দ টছন্দ হয়?পছন্দ থাকলে বল্। ”
“না দাদুমনি, ভার্সিটিতে যাই পড়তে।”
“শুধু পড়তেই যাস? ভার্সিটির ফাংশনগুলোতে গানও তো গাস।ইন্টার ভার্সিটি কম্পিটিশনে গান গেয়ে, ডিবেট করে প্রাইজতো নেহাৎ কম পাস নি। ভার্সিটির বন্ধুদের সাথে বন্যার সময় ত্রাণ দিতে গেছিস। ওদের নিয়ে কয়েক মাস পরপর ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প করিস, বৃক্ষ রোপন কর্মসূচিতে সবার আগে আগে থাকিস। সব করা যায়, আর কাউকে স্পেশাল বন্ধু বানানো যায় না?”
“যা যা করি, সেগুলো একজন স্টুডেন্টের ডিউটি। প্রেম করাও কি ডিউটির মধ্যে পড়ে দাদুমনি?তোমার সাথে দাদাভাইয়ের অ্যাফেয়ার করে বিয়ে?”
“ওরে,ওতো প্রাচীন যুগের কথা। তোর বাপ তো প্রায় কিডন্যাপ করে তিথিকে বিয়ে করেছিলো। ”
কথা হচ্ছিলো নাশতার টেবিলে।
আনন্দ ও তিথির প্রণয়-পরিণয় সম্পর্কে অদিতি জানে। অনেক,অনেক বার শুনেছে। বড়ই রোমাঞ্চকর।
আনন্দ ভাইয়া বললেন,” আহা মা,অতীতের কথা টানো শুধু। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো। অদিতি,দাদুমনি কিন্তু ঠিক কথা বলেছেন। না,মানে, কাউকে পছন্দ করতেই হবে, তা নয়।কিন্তু পছন্দ হলে জানাবি। লুকিয়ে রাখবি না।
নিজে পছন্দ না করতে পারলে সেটাও জানাবি।আমি তখন ফিল্ডে নামবো।”
অদিতি মাথা নীচু করে বললো,”আমি বিয়ে করবো না, আব্বু।”
” তোকে এখন বিয়ে করতে বলেছে কে? এম বি এ না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিয়ে শাদী না।”
“কি বলিস আনন্দ? তাহলে আমার কপালে আর নাতনির বিয়ে খাওয়া নাই।”
” কি যে বলো বাবা তুমি! কি এমন বয়স হয়েছে তোমার? আর আল্লাহ কাকে কখন নেবেন,তাতো কেউ জানে না।। এমবিএ শেষ হতে বেশি দেরীও নেই। পড়ালেখার মধ্যে মেয়ের বিয়ে শাদী না দেওয়া ই ভালো।”
“বিদেশে সেটল করবে এমন ছেলে বিয়ে করিস না দিদিভাই।অন্তত একটা নাতনি কাছে থাকুক। মরার সময় যেন তোর কোলে মাথা রেখে মরতে পারি।” ফুপু চোখ মুছলেন।
তিথি ভাবী বললেন,” আজকাল সারাক্ষণ বাবা-মা মরার কথা বলেন। কারণ কি, জানতে পারি? কারণ হলো কাজের অভাব। দাঁড়ান, কালকে থেকে দু’জনকেই কাজে লাগাবো। মায়ের কাছে পাঁচ জন অন্ততঃ গরীব মেয়েকে এনে দিবো, নকশী কাঁথা সেলাই করা শিখাবেন।”
“ওরে মা, আমি তো চোখে দেখি না।”
“খুব ভালো দেখেন। ওদের কাঁথা সেলাই শিখাবেন, সালোয়ার কামিজ,ব্লাউজ সায়ার কাটিং কুটিং শেখাবেন, ওদের সুখ দুঃখের কথা শুনবেন, পরামর্শ দিবেন। এক ব্যাচ শেষ হলে আরেক ব্যাচ। আর রাতে আনন্দ অফিস থেকে আসার পরে আমরা সবাই একসাথে হাঁটতে বের হবো। অদিতির বিয়ে খাবেন, অদিতির ছেলেমেয়েরও বিয়ে খেয়ে যাবেন,ইনশাআল্লাহ। ”
অদ্বিতীয়ার বিয়ে নিয়ে বাপ,মা,দাদা-দাদী আর মাজেদা খালার আনন্দময় কথোপকথন, কল্পনা,পরিকল্পনা, আশা,স্বপ্ন।
আর নয় মাস আছে অদিতির এমবিএ শেষ হতে। পরী কানাডায় চলে গেছে পড়তে। এ লেভেলে অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করেছিলো। অনেক পরিবর্তন হয়েছে পরীর।মায়ের নির্দেশ মতো চলে ও বড় বোনের তত্ত্বাবধানে থেকে তার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়েছে অনেক। এখন ছিপছিপে শরীর, অদিতির মতো না হলেও নম্র ভদ্র কথাবার্তা, শালীন পোশাক, দায়িত্ববোধও হয়েছে কিছুটা। দেশে থাকার শেষের কয়েক বছর সে অদিতিকে চোখে হারাতো।
” আপা, তোর অসুবিধা না হলে ওইদিনের মতো একটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিবি?”
” আপা,এই মুভিটা আয় না,দু’জন মিলে দেখি।একা দেখতে ভাল্লাগে না।”
“তুই একবার টি শার্ট আর জিন্স পর না আপা।দারুণ স্মার্ট লাগবে। আচ্ছা আচ্ছা, ফতুয়া -জিন্স-স্কার্ফও তো পরতে পারিস। কি সেই একই সালোয়ার কামিজ, সালোয়ার কামিজ। ”
“কি হয়েছে আপা তোর?চোখমুখ শুকনা লাগছে কেন?কেউ কিছু বলেছে তোকে?”
আপা ছাড়া পরীর চলতো ই না। বিদায়ের সময় দুই বোন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিলো। এখনো ভাই -বোনের কথা মনে করে প্রায়ই অদিতি চোখের পানি ফেলে। ভিডিও কলে কথা হয় রোজ।
সমুদ্র -পলিন -মার্থা বাংলাদেশে এসেছিলো। দেড় মাস ছিলো। মার্থা আর পলিন আসলেও খুব ভালো। একসাথে আমরা সবাই খুব মজা করেছি। বেড়াতে গেছি অনেক জায়গায়। সুন্দরবন,কক্সবাজার,সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা,সিলেট,জাফলং,সাজেক, কুমিল্লার ময়নামতি, সোনারগাঁ, পাহাড়পুর,চলনবিল,সুনামগঞ্জ আর কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকা কিছুই বাদ ছিলো না। ফুপার গাঁয়ের বাড়ি,ফুপুর গাঁয়ের বাড়িতো আছেই। তিথি ভাবীর মা একটু অসুস্থ থাকায় তিথি ভাবীর নানা ও দাদার বাড়ি যাওয়া হয় নি।
দু”জনেই ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেন। পলিন বেশি পারে কারণ ফার্স্ট ইয়ার থেকেই সে সমুদ্রের মাতৃভাষা রপ্ত করতে চাইতো।
আচার-আচরণে,মানসিকতায় সবার মন জয় করে ফেলেছে পলিন ও মার্থা।
সমুদ্র পালটে গেছে অনেক। তার মায়ের যা যা চাওয়া ছিলো ছেলেমেয়েদের ঘিরে, তার অনেকটাই সমুদ্র পূরণ করতে পেরেছে। মূল্যবোধ, ন্যায় নীতি,কর্তব্য বোধ মাথায় ঢুকেছে অনেকটা। স্বার্থপরতা এখন একদমই নেই।
পলিন সন্তান সম্ভবা। এটাও এ বাড়ির মহা আনন্দের কারণ।
খাওয়ার টেবিলে আবার একদিন ফুপু অদিতির বিয়ের কথা পাড়লেন।
“আনন্দ, তিথি, আমি অদিতির সাথে আলাদা করে অনেক কথা বলেছি।ওর পছন্দের কেউ নেই। আমার একজনকে খুব পছন্দ অদিতির জন্য। কয়েক মাস আগে আমরা কলেজের বন্ধুরা গেট টুগেদার করলাম না আসমার বাসায়? ওখানে আমার খুব প্রিয় এক বান্ধবীর সাথে দেখা। গ্র্যাজুয়েশনের পরপরই ও স্বামীর সাথে সুইডেনে চলে যায়। কিভাবে কিভাবে যেন যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু আমার না, বেশির ভাগ বন্ধু বান্ধবের সাথে। লাকিলি আসমা ফেসবুকে ওকে খুঁজে পায়। বহুকাল পরে লুবনার সাথে দেখা হলো। ওর হাসব্যান্ড রাষ্ট্রদূত হিসাবে রিটায়ার করেছেন। দুই ছেলে। বড় ছেলে এখন সেক্রেটারি, ফিন্যান্স মিনিস্ট্রির। সেই ছেলের ছেলে আদিব ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে ইলিনয় থেকে। এম এস ও করেছে। দেশে সেটল করেছে। খুব ভালো চাকরিও পেয়ে গেছে। দেখতে রাজপুত্র। আমার অদিতির সাথে মানাবে বেশ। আমি অনেক খোঁজ খবর করেছি তোদের না জানিয়ে। ছেলে আসলেই খুব ভালো। পুরো পরিবারটাই খুব ভালো।”
“দাদুমনি,আমি বিয়ে করবো না।”
“কি এক কথা বারবার বলিস,বিয়ে করবো না,বিয়ে করবো না। বিয়ে করবি না কেন?জীবনে সবকিছুর দরকার আছে। বিয়ের পরে যেন তোর কাজকর্মে কোনো বাধা না দেওয়া হয়, সেই ওয়াদাতো আমরা আদায় করেই ছাড়বো।”
” আমার কি পরিচয় দিবে দাদুমনি উনাদের কাছে?”
” কি পরিচয় দিবো মানে?যেটা সত্য, তাই বলবো। আমার নাতনি।”
“আসল পরিচয় জানাবে না?”
“তোর একটাই পরিচয়। আমাদের নাতনি,আনন্দ -তিথির মেয়ে, সমুদ্র -পরীর বোন। ”
” যাঁরা জন্ম দিয়েছেন, তাঁদের কথা কিছু বলবে না?”
“অদিতি! বাড়তি কোনো কথার দরকার নেই। ”
“কিন্তু ওঁরা ঠিকই জেনে যাবেন, আমি কোনো এক অশিক্ষিত, অভদ্র, গরীব মহিলার অবৈধ সন্তান। তখন তুমি লুবনা দাদু আর তাঁর পরিবারকে কি জবাব দেবে? এটা কি গোপন করার বিষয়, দাদুমনি?”
“ঠিক আছে,গোপন করবো না। সব জেনে যদি রাজি হয়,তখন না করতে পারবি না।”
“তখনও না করবো দাদুমনি। আমার জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে খুব কঠিন, কঠিন কথা শুনে,ঘৃণা আর অবহেলায়, অপমানে আর অবজ্ঞায়। এখনো অনেকে আমাকে নর্দমার কীট মনে করে। এখনো অনেকে আমাকে বেজাত, বেজন্মা, বিচ, অলক্ষুণে এসব বলে,আমাকে ঘেন্না করে,তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। ওগুলো এখন অতোটা গায়ে লাগে না তোমরা ভালোবাসা দিয়ে আমাকে মুড়ে রেখেছো বলে। বিয়ের পরে হাসব্যান্ড, শ্বশুর, শাশুড়ি, ফ্যামিলির লোকজন যদি কথায় কথায় স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমার বাপ-মায়ের ঠিক নেই, সেটা আমি সহ্য করতে পারবো না দাদুমনি। অতো কষ্ট সহ্য করার মানসিক শক্তি এখন আর আমার নেই। তোমরা যদি আমাকে এতো ভালো না বাসতে, তাহলে হয়তো মনের জোর থাকতো। কিন্তু তোমাদের এতো ভালোবাসা, আদর,যত্ন,সম্মান পেয়ে আমার স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে,দাদুমনি। এখন নতুন লোকজনের কটু কথা সহ্য করা আমার জন্য অসহ্য কষ্টকর হবে। আমি কি তোমাদের উপর অনেক বড় বোঝা হয়ে আছি দাদুমনি?”
ভাবী শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। ফুপা ফুপু লজ্জায় অধোবদন নিজেদের পূর্ব কর্মকাণ্ডের কথা চিন্তা করে। আনন্দ ভাইয়ার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। তাঁর একটা ছোট্ট অপাপবিদ্ধ মায়াভরা, কমলার রসে মাখামাখি মিষ্টি শিশুমুখের কথা মনে পড়লো, দেওয়ালে সজোরে বাড়ি খেয়ে নেতিয়ে পড়া এক শিশুর রক্তাক্ত মুখ আর ভয়ার্ত, কষ্টভরা চোখজোড়ার কথা মনে পড়লো। সারাদিন ঘুরেফিরে এই ছবিটাই তাঁর চোখে ও মনে ভাসতে লাগলো। বারবার শুনতে পেলেন,”বাবা,বাবা,অতিদি জন্য পুতুই আনো নি? ” নতুন করে অনুশোচনা আর কষ্টের আগুন আষ্টেপৃষ্টে জ্বালিয়ে দিলো তাঁকে।
চলবে।