Monday, October 6, 2025







শক্তিময়ী পর্ব-১২+১৩

#শক্তিময়ী
দ্বাদশ পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

আনিলা আপার এক্স স্বামীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কার্যকর কবে হবে,তার ঠিক নেই। তিন ননদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। শাশুড়ির সাত বছরের কারাদণ্ড। অস্ট্রেলিয়া থেকে আনিলা আপা এসেছেন। সাথে দত্তক কন্যা এমিলি। এক বছরের মেয়ে। জ্যান্ত পুতুল। আনিলা আপা আসার সাথে সাথে ফুপু,ফুপা, আনন্দ ভাইয়া, ভাবী সবাই পরীর ছানাটাকে কোলে নিয়েছেন। পরীও ঝাঁপিয়ে পড়েছে এমন লিভিং ডল পেয়ে। এমিলির আদরের সীমা নেই। এমনকি ভাবীর আব্বা-আম্মাও বিকালে আনিলা আপাকে দেখতে এসে তাঁর মেয়েকে কোলে নিয়ে চটকাচটকি করেছেন। ভাবীর বোন -দুলাভাই -ছেলেমেয়েরা এসেছেন। অস্ট্রেলিয়ান পুতুলকে নিয়ে তাঁদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে।

আনিলা আপা সবাইকে আগে খাওয়াদাওয়া , আড্ডার সুযোগ দিলেন। তারপরে ভরা মজলিসে ভাবীর আম্মাকে আগে ধরলেন,” আন্টি তো আমাদের সবার খুব প্রিয়। ভাইয়ার বিয়ের পরে ভাবীকে পেয়ে আমরা যেমন খুশি,তেমন খুশি ভাবীর ফ্যামিলিকে পেয়ে। এতো ওয়েল এডুকেটেড,ওয়েল ম্যানারড ফ্যামিলি। আর আন্টি তো চাকরির পাশাপাশি এতো নামকরা সোস্যাল ওয়ার্কার। প্রাউড অফ ইউ,আন্টি।”

“কি যে বলো মামনি। তোমাদের দেখার চোখ সুন্দর। আমরাও কম খুশি নাকি তোমাদের আত্মীয় হিসাবে পেয়ে? তিথির অনেক ভাগ্য, এমন শ্বশুর বাড়ি পেয়েছে।”

“আমাদেরও অনেক ভাগ্য আন্টি, তিথি ভাবীকে আমরা বৌ হিসাবে পেয়েছি।”

মধুর কথাবার্তা। মধুর পরিবেশ। সমুদ্র চলে গেছে চৌদ্দ দিন হলো। আনন্দ ভাইয়া ওকে সেট করে রেখে এসেছেন। বাড়িতে শোকের পরিবেশ ছিলো। ফুপু সারাক্ষণই কাঁদেন, ভাবী কাঁদেন, অদ্বিতীয়া কাঁদে। ফুপা আর আনন্দ ভাইয়া মন খারাপ করে থাকেন।আনিলা আপা আসায় শোকাচ্ছন্ন পরিবারটি প্রাণ খুঁজে পেয়েছে।

আনন্দময় পরিবেশে হঠাৎ ছন্দপতন।

” এমিলিকে ওর প্যারেন্টস চায়নি আন্টি,জানেন তো। আনম্যারিড কাপল ছিলো। ব্রেক আপ হয়ে গেলো।বাপও বাচ্চা নিজের কাছে রাখবে না,মা ও না। অস্ট্রেলিয়াতে এসব হয় জানতাম না। ভাবতাম, এগুলো আমেরিকান কালচার। জন্মের পরমুহূর্ত হতেই এমিলি ওরফানেজে। আমি ওকে অ্যডপ্ট করেছি ছয়মাস হলো। এরমধ্যে ওর বাপ-মায়ের কতোবার যে গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ হলো! বাপ-মা দুটাই একদম স্পয়েল্ট।”

“ওদের কথা বাদ দে। ওদের খোঁজ রাখার দরকার কি তোর?এমিলি এখন তোর মেয়ে,ব্যাস। আসোতো সোনামনি,নানুমনির কোলে আসোতো। ওরে আমার সোনার চাঁদ। ছয় মাস বয়স হতেই ভিডিও কলে দেখিতো বেয়ান,কি যে মায়া পড়ে গেছে।”

“ছয়মাস অস্ট্রেলিয়ান বেবিকে দেখে এতো মায়া পড়ে গেলো মা,আর প্রায় ১৪ বছর ধরে এক বাঙালি বেবিকে এখনো ভালোবাসতে পারলে না? ”

ফুপু বেচারির মুখে সহসা কথা যোগালো না।

“আর আন্টি-আংকেল, আমার মেয়েকে এতো আদর করছেন,আর নিজের মেয়ের বাচ্চাকে ভালোবাসতে পারলেন না?”

“ও তো তিথির মেয়ে না, মা।”

“তাহলেতো এমিলিও আমার মেয়ে না। অদিতির সাথে আমাদের সবার একটা বৈশিষ্ট্য কমন,আমরা বাংলাদেশী। এই বাচ্চা তো তাও না।”

“এ তোর বাচ্চা না যদি মনে করিস,তাহলে ওকে দত্তক নিলি কেন?আমরা তো নিষেধ করেছিলাম। দত্তক নিয়ে ফেলে এখন একথা বললে হবে কেন?” ফুপু খরখরে গলায় বললেন।

“আমি তো এমিলির মা-ই। জানি না,গর্ভজাত সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা কেমন হয়? আমি এমিলিকে যতোটা ভালোবাসি,ততোটা হয় কি? মনে হয়, না। আমার মেয়েকে পিঁপড়া কামড় দিলে মনে হয় আমাকে সাপে কামড়েছে। ভাবীর মনেও অদিতির জন্য এরকমই ভালোবাসা। কিন্তু ভাবীর এই নিখাদ ভালোবাসাকে আমরা সবাই পদদলিত করেছি।কেউ কম,কেউ বেশি। সবচেয়ে অবাক লেগেছে আংকেল-আন্টি আর স্নিগ্ধা আপার ব্যাপারটা। একবারও আপনারা আপনাদের মেয়ের মনটা বুঝতে পারলেন না?”

“দেখো মামনি,তোমার আর তিথির মধ্যে পার্থক্য আছে। দত্তক আনার আগে তিথির নিজের ছেলে ছিলো। তার আরও বাচ্চা কাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। তার স্বামী একজন খুব ভালো মানুষ, ভালো স্বামী, তার শ্বশুর বাড়ির কপাল এতো ভালো, সে কেন দত্তক নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করবে?”

“ভাবী কিংবা অদিতি কোনো অশান্তি করে নি। অশান্তি সৃষ্টি করেছি আমরা। আচ্ছা আন্টি,পুরো প্রক্রিয়ায় অদিতির কি দোষ? কেন তাকে আপন করতে পারলেন না? আপনি না মানবাধিকার কর্মী? ”

“ওকে তো ওরফানেজে রাখার ব্যবস্থা আমি করেই ফেলেছিলাম। সেখানে থাকতো।তিথি তো কথা শুনলো না?”

“আমাদের দেশের শিশু আশ্রয় কেন্দ্রে শিশুরা কেমন থাকে,আন্টি আমার থেকে অনেক বেশি জানেন। আর ভাবীর নিজের ইচ্ছা, অনিচ্ছা নেই? ”

“উদ্ভট ইচ্ছা করবে কেন?”

ফুপু বললেন,”আনিলা, এই অ্যাডপ্ট করার সাথে অনেক কিছু জড়িত। আবেগে ভেসে দুনিয়া চলে না। আনন্দের সম্পত্তি পাওয়ার হক দু’জনের,সমুদ্র আর পরীর। আর তিথির। ওদের হকে ভাগ বসানো হলো না?”

আনন্দ ভাইয়া আর তিথি ভাবী চুপ করে এতোক্ষণ বসে ছিলেন। ভাবী শান্ত গলায় বললেন,”আজ খুব পরিস্কার করে একটা কথা বলতে চাই। যদি বলেন, লিখে ফেলি আর সিগনেচার দিয়ে দিই। দরকার হয়, পারিবারিক উকিলের সামনে আমি আবার স্টেটমেন্ট দিবো।

প্রথম কথা, আমার তিন সন্তান। সমুদ্র, অদিতি,পরী। এই সত্য কখনো পাল্টাবে না। দ্বিতীয়ত, মা, আপনার ছেলের সম্পত্তিতে আমি আর অদিতি কোনো ভাগ বসাবো না। শতভাগ নিশ্চিত থাকেন। আমার অদিতির কারোর সম্পত্তির দরকার নেই। ওর জন্য উপরে আল্লাহ,নিচে আমি আছি। আর এমন ভাবে আমি ওকে গড়ে তুলবো,কারোর সাহায্য ছাড়াই ও সুন্দর জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। আর ইনশাআল্লাহ, এই বাসায় সে যে অপমানের ভাত খাচ্ছে, থাকছে, তার প্রতিটি ঋণ সে পাইপাই করে আনন্দ, বাবা আর আপনাকে শোধ করে দেবে। তৃতীয়ত, যাঁরা এই প্রায় চৌদ্দ বছরে আমার মেয়ের দিকে ফিরেও তাকান নি, প্রতি মুহূর্তে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন, ভয়াবহ মানসিক অত্যাচার করেছেন আমার মেয়ের উপরে, আমার নিজের বাবা-মা-ভাই বোনদের কথা বলছি, তাঁদের সম্পত্তি আমি গ্রহণ করবো না। তাঁদের অনেক আছে,থাকুক, কিন্তু আমার নামে কিছু লিখে দিলেও আমি সেটা নিবো না,সুতরাং আমার নামে না লেখাই ভালো। যাঁরা আমার মেয়েকে,আমার মাতৃত্বকে মূল্যায়ন করেন নি, তাঁদের কারোর সম্পত্তির আমি ধারও ধারি না। ”

অস্বাভাবিক,অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকে তরল করতে ভাবীর আব্বা বললেন,”পাগল মেয়ে আমার,পাগলই থেকে গেলো। ”

কয়েকদিন কেটে গেলো। আনিলা আপা জেলে তাঁর প্রাক্তন ননদ আর শাশুড়ির সাথে দেখা করতে গেলেন। আপা এমনিতেই খুবই সুন্দর, আজ সাজলেন দারুণ করে। মনে হলো, আকাশ থেকে ডানাকাটা পরী পথ ভুল করে চলে এসেছে মর্ত্যে।

আনিলা আপা ননদদের বললেন,” তোমাদের স্বামীরা তো সবাই পুণর্বিবাহ করেছে। খবর নিয়েছি। তোমাদের থেকে রেহাই পেয়ে নতুন বৌদের সাথে বড়ই সুখে দিন কাটছে তাদের। সমস্যা হয়েছে তোমাদের ছানাপোণাগুলোর। কেউটের ছানা যদিও, তবু খারাপ লাগে। বাপ-সৎ মা, বাপের আত্মীয়রা,সৎ মায়ের আত্মীয়রা ভীষণ অত্যাচার করে। আর তোমাদের আত্মীয়রা তো সম্পর্কচ্ছেদই করেছে। এমন আত্মীয়দের সাথে কেইবা সম্পর্ক রাখতে চায়? তোমাদের বাচ্চাকাচ্চার ভবিষ্যৎ শেষ। ছেলেপুলেদের জন্য খারাপ লাগা উচিৎ, কিন্তু আমার তেমন লাগছে না। অমানুষদের রক্ত যাদের গায়ে, তারা ও অমানুষ হয়েই বড় হবে। আরও চৌদ্দটা জীবন জ্বালিয়ে ছারখার করবে।তোমরা তো জানতে, মানুষ হিসাবে তোমরা খুবই নোংরা, একেবারে পচা-গলা, বাচ্চা আমদানি করে তাদের আতান্তরে ফেলার কি দরকার ছিলো? ”

“ভাবী,আমাদের বাচ্চাগুলোকে বাঁচাও প্লিজ,তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকবো।”

“আমার গোলামী করবে কি ভাবে জেলে বসে? তাছাড়া তোমরা গোলাম হিসেবেও ভয়ংকর হবে। জেলে বসে পচো। তোমার ভাইয়ের ফাঁসির দিন কল্পনা কোরো,কেমন?এই তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তার শেষ কি খাওয়ার ইচ্ছা, এই তাকে তওবা করানোর জন্য মৌলভি আসছেন, অবশ্য বৃথাই তওবা করানো, এই তার মাথায় যমটুপি পরানো হলে, সে হাত-পা ছুঁড়ছে, তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এই গলায় দড়িটা লাগালো…..”

“চুপ করো,চুপ করো, প্লিজ।” তিন বোন কাঁদতে লাগলো চিৎকার করে।

“আচ্ছা, চুপ করলাম। তবে যতদিন বেঁচে থাকবে,অসহনীয় কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকবে। মরার পরে তো আরোই।”

আপা তাঁর প্রাক্তন শাশুড়িকে আরও ভয়ংকর কথা শুনালেন। ছেলে কিভাবে ফাঁসিতে ঝুলবে,বর্ণনা দিলেন রসিয়ে রসিয়ে। চলে আসার সময় বললেন,”ডাইনি বললেও তোমাকে কম বলা হয়।আমি অভিশাপ দিলাম,তুমি একটু একটু করে পচে গলে মরবে। গায়ে পোকা কিলবিল করবে তোমার।”

এই সেই আনিলা আপা যাকে ডিভোর্সের কথা বলায় স্বামী, শাশুড়ির পা ধরে কেঁদেছিলেন, দয়া ভিক্ষা করেছিলেন। মানুষ কতো বিচিত্র স্বভাবের হয়!

“আপা,একটা কথা বলি? ”

“বল্।”

“তুমি এতো শিক্ষিত, আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, কি করে তুমি ঐ লোকটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলে?তার কদর্য রূপ সামনে আসার পরেও? তারা তোমাকে এতো নির্যাতন করার পরেও? ”

“কি জানি! আমিও এখন অবাক হয়ে ভাবি।”

আনিলা আপা আসা উপলক্ষে আমরা অনেকে মিলে আমার দাদার বাড়ি মানে ফুপুর বাপের বাড়ি গেলাম। বিশাল বাড়ি। অনেক,অনেক জায়গা নিয়ে। আমার বাবা-চাচা-ফুপুরা মিলে বারবার সংস্কার করেছেন। কাজেই গ্রামের বাড়ি হলেও সব রকম অত্যাধুনিক সুযোগ, সুবিধা আছে।

খুবই আনন্দ , হৈ হুল্লোড় চলছে। বিশেষ করে বাচ্চাদের বাঁধ ভাঙা আনন্দ। এরমধ্যে এক দুপুরে চিৎকার, কান্না, অনেক মানুষের চিৎকার। “পরী ডুবে গেছে,পরী ডুবে গেছে।”

তিথি ভাবী উন্মাদের মতো দৌড়ালেন। বাড়ির সবাই। আমরা যখন পৌছালাম, তখন সঞ্জু ভাই পরীকে কোলে করে কেবল পুকুরের পাড়ে উঠেছেন। আনন্দ ভাইয়া -ভাবী মেয়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। নাহ্,পরীর বেশি কিছু হয়নি, তবে ভয় পেয়েছে সাংঘাতিক। ফুপু তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,”ও ডুবে যাচ্ছিলো,তুমি কোথায় ছিলে তখন? তোমাকে ওর দিকে খেয়াল রাখতে বলিনি আমি?”

অদিতি ঝুমুর আপাকে ধরে টলছিলো। ওর শরীর সপসপে ভেজা। ও বমি করে ফেললো আচমকা। সবাই ছিটকে গেলো। ঝুমুর আপা আর আমি অদিতিকে ধরলাম। ও এক জায়গায় বসে বমি করতে লাগলো।

সঞ্জু ভাই বললেন,”অদিতির জন্য ই পরী রক্ষা পেয়েছে, ফুপু। পরীকে নিষেধ করার পরও ও বেশি দূরে চলে গিয়েছিল। তারপরে আর তাল সামলাতে পারে নি। ও হাবুডুবু খাচ্ছিলো যখন, তখন অদিতি দেখতে পায়। ও তো পানিতে নামে নি,পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। পরীর ঐ অবস্থা দেখে ও লাফ দেয়। চিৎকার করে আমাদের ডাকে। পরীকে জাপটে ধরে আমাদের দিকে ঠেলে দেয় আর নিজে যায় ডুবে। খুকি টেনে তোলে।”

খুকি আমাদের দূর সম্পর্কের ফুপাতো বোন। দলটার মধ্যে ও-ই একমাত্র সাঁতার জানা।

সঞ্জু ভাই, রঞ্জু ভাইও সম্পূর্ণ ভেজা। উদ্ধার কাজে তারা লাফ দিয়েছিলো পুকুরে।

এই কাহিনী শোনার পরেও পরীর কাছে বলতে গেলে সবাই, তিথি ভাবী পরীকে জাপটে ধরে আছেন, আনন্দ ভাইয়া মাটিতে ধেবড়ে বসে মেয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন সমানে, ফুপু কাঁদছেন, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন, ভাবীর থেকে ছাড়িয়ে পরীকে নিজের কাছে টানার চেষ্টা করছেন।

ওদিকে অদিতি প্রচুর বমি করে নেতিয়ে পড়েছে। কাছে আমি,ঝুুমুর আপা, রন্জু ভাই।

আমার বুকে খুব জোর ধাক্কা লাগলো। আনন্দ ভাইয়া আর ফুপুর কথা ভাবছি না। তিথি ভাবী? ঠিকই তো গর্ভজাত মেয়ের কাছেই আছেন, পরীর চেয়ে অদিতি অনেক অসুস্থ জেনেও। কোনো চরম বিপদের সময় ভাবী নিশ্চয়ই সমুদ্র আর পরীকে রক্ষা করার চেষ্টা করবেন প্রথমে। তাহলে অদিতির জন্য কে আছে পৃথিবীতে যে সব কিছু ফেলে অদিতিকেই বাঁচানোর চেষ্টা করবে?অদিতি হবে তার জীবনের ফার্স্ট প্রায়োরিটি ? আছে কেউ এমন?

চলবে।

#শক্তিময়ী
১৩ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

রাত প্রায় একটা। তিথি ভাবী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম,ভাবী নিঃশব্দে কাঁদছেন। কিছু বললাম না। কাঁদুক একটু।

পরীকে শান্ত করার চেষ্টা করে আনন্দ ভাইয়া আর ফুপুর কাছে ওকে দিয়ে ভাবী দৌড়েছিলেন অদিতির কাছে। ও তখন নেতিয়ে আছে ঝুমুর আপার গায়ে। বমি মাখা অদিতিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ভাবী।

“অদিতি, ও অদিতি, একটু তাকা মা। রঞ্জু, গাড়িটা বের কর্ না ভাই। অদিতিকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”

আমরা কয়েকজন বললাম,” ভয় নেই ভাবী,ওর পেট থেকে সব পানি বের হয়ে গেছে।”

“তাহলে চল্,তাড়াতাড়ি ওকে বাসায় নিয়ে যেয়ে জামাকাপড় পাল্টে দি। ঠান্ডা লেগে অসুখ হয়ে যাবে।”

অদিতি হেঁটেই বাড়িতে গেল। ভাবী ওকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন।

রাতে ভাবী অদিতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।।ঝড়ের বেগে আনন্দ ভাইয়া ঘরে ঢুকলেন।

“তোমাকে পরী কখন থেকে একটানা ডেকে যাচ্ছে, তুমি শুনতে পাচ্ছো না?”

“শুনছি তো। পরীর কাছে থাকলাম কয়েকবার। তার তো কিছু হয় নি। সে ভয় পেয়েছে মাত্র। তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিলাম, ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলাম,আর কি করবো? মেয়ে এতো ভীতু হবে কেন?”

“ভয় পাবে না? আরেকটু হলে কি হতো ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে। এই সময় মা হয়ে তুমি কাছে থেকে তার মেন্টাল ট্রমা কাটানোর চেষ্টা করবে না?”

“আর কি ভাবে চেষ্টা করবো? আমার এখানেও থাকা দরকার।”

“তুমি এখনই পরীর কাছে যাবে। ও ছোট একটা বাচ্চা।”

” আর অদিতি কি? বুড়ি? পরীর থেকে ও পুরোপুরি দুই বছরেরও বড় না।আমি এখানেই থাকবো।”

অদিতি ক্ষীণ গলায় ভাবীকে চলে যেতে বললো।

এই সময়ে ফুপু এসে গম্ভীর গলায় বললেন,”তিথি,পরী ডাকছে তোমাকে। কেমন মা তুমি?এসময়ে মেয়েকে ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকো কেমন করে?”

তিথি ভাবী কড়া গলায় বললেন,” আমি কেমন মা,জানেন না আপনি? আপনার সমুদ্র আর পরীর কোন্ দায়িত্বে ফাঁক রেখেছি বলতে পারবেন?তাও তাদেরকে আমি মানুষ করতে পারিনি। আপনাদের অতি আহ্লাদ আর প্রশ্রয়ের জন্য পারিনি। আপনার নাতনি ভয় পেয়েছে। এমনই ভয় যে ছয়-সাত ঘন্টা পার হওয়ার পরেও ভয় গেলো না। মাথার কাছে সারাক্ষণ বাপ,দাদা,দাদী বসে আছেন, আমি বারবার যাচ্ছি, সবাই যাচ্ছে, সে খাওয়া দাওয়া সবই করছে, তারপরও আমাকে তার মাথা কোলে নিয়ে ঠাঁই বসে থাকতে হবে। কেন? আর মা, আপনি এবং আপনার ছেলে পরীকে নিয়ে এতো ব্যস্ত,এতো টেন্সড, যে আপনাদের পরীকে বাঁচালো, তাকে তো মা-ছেলে কেউ একবার চোখের দেখাও দেখতে আসলেন না?”

“আমার পরীকে আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। ”

“মা,আপনারা কৃতজ্ঞ হওয়া শিখুন। আল্লাহ মানুষের জীবন মরণের মালিক। আল্লাহর রহমতে আর অদিতির উসিলায় পরী আজ ডুবে যায় নি। এটা মানেন তো?নাকি আমি ভুল বললাম। সেই তখন থেকে মা-ছেলে পরীকে আগলে বসে আছেন, শুনলাম, আগামীকাল পরীর কল্যাণ চেয়ে গরু জবাই করে গ্রামবাসীকে খাওয়াবেন, আপনাদের এই উদারতাটুকু হলোনা যে পরীর পাশাপাশি অদিতির নামেও সাদাকাহ দিবেন, আপনাদের নাতনিকে বাঁচাতে যেয়ে আরেকটু হলে আমার মেয়েটা মরতো, অনেক হাবুডুবু খেয়েছে সে,পরীর চেয়ে অনেক বেশি। তার গায়ে বেশ জ্বর।”

আনন্দ ভাইয়া রাগে অস্থির হয়ে বললেন,”তুমি মায়ের সাথে এইভাবে কথা বললে কেন? এতো বড় মেয়ের জ্বর বলে কি তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হবে?”

“এই ঘর থেকে তুমি যাও। অদিতির শরীর আর খারাপ করিয়ে দিও না, প্লিজ। আমি এখানেই থাকবো। আর আনন্দ, আমার মনে একসময় তোমার জন্য ভালোবাসার সাথে অনেক শ্রদ্ধা ও গর্ব ছিলো। আমার স্বামী খুব উন্নত মনের মানুষ। অদিতিকে সংসারে আনার পরে বুঝলাম, তুমি আদতে উন্নতমনা দূরের কথা, খুব মিন মাইন্ডেড একজন মানুষ। I can’t respect you. আর শ্রদ্ধা ছাড়া ভালোবাসা একেবারেই আলুনি।”

ফুপু উঁচু গলায় বললেন,”খুব বাড়াবাড়ি করছো তিথি। কথাবার্তায় কোনো লাগাম নেই। দরকার নেই তোমার পরীর কাছে আসার। আমিও বলবো,তুমি মা না, ডাইনি। বাড়াবাড়ির সীমা আছে একটা।”

“সেই সীমা তোমরাই অতিক্রম করছো মা।” রঙ্গ মঞ্চে আনিলা আপার প্রবেশ। ” কি যে শুরু করেছো তখন থেকে। ভাইয়া-ভাবীর সংসারে কোনো সমস্যা হলে সেটার জন্য সম্পূর্ণ তুমি আর ভাইয়া দায়ী থাকবে। এই যে সমুদ্র আর পরী অবিবেচক, একগুঁয়ে, জেদি তৈরি হচ্ছে, এরজন্যও তোমরা মা-ছেলে দায়ী। অথচ ভাবীর শতভাগ রাইট আছে ছেলেমেয়েদের মনের মতো করে মানুষ করার। কি না কি হয়েছে, মেয়ে একঘেঁয়ে নাকি কান্না কেঁদে যাচ্ছে। আর তোমরা ওর পা মালিশ করে যাচ্ছ। আর আসল কষ্ট পেলো যে মেয়েটা,তোমাদের প্রাণের পরীকে বাঁচালো, তাকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই তোমাদের। ”

এক কথায়,দুই কথায় মহা গন্ডগোল যা আমাদের পরিবারের জন্য স্বাভাবিক না। অদিতি বালিশে মুখ গুঁজে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকলো। তাকে কেন্দ্র করেইতো এতো ঝামেলা। তিথি ভাবী রাগের মাথায় বলে ফেললেন,”আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো। আমার মেয়েকে নিয়ে আমি আলাদা থাকবো। অনেক সহ্য করেছি, আর না। ”

পরিস্থিতি থমথমে। ভাবী অদিতিকে কাঁদতে দেখে কঠিন গলায় বললেন,”চোখ মোছো। দুনিয়া খুবই কঠিন জায়গা। তোমার জন্য আরও কঠিন। সুতরাং নিজেকে পৃথিবীর যোগ্য করে তোলো। কেঁদে কিচ্ছু হয় না। কে তোমাকে ভালোবাসলো,কে ভালোবাসলো না,তোমার তাতে কি এসে যায়? আল্লাহ তোমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন ভালো কিছু করার জন্য, তুমি নিজেকে সেভাবে তৈরি করো। আর আমি যতোদিন বেঁচে আছি,তোমার ভালোবাসার কোনো অভাব হবে না।আমি একাই তোমাকে বাবা-মা দু’জনের ভালোবাসা দিবো। এখন চোখ মোছো। এই ঝগড়া -অশান্তির জন্য তুমি দায়ী নও।”

এখন মধ্যরাতে নির্জন বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিথি ভাবীর নিঃশব্দে কান্না।

পরদিন ভাবী দুই মেয়েকে ডেকে বললেন,”আমার সাথে পুকুরে চলো। সাঁতার শিখবে।”

অদিতির জ্বর নেই। সে সাঁতার শিখতে এক পায়ে খাড়া। পরী আঁতকে উঠলো।সে কিছুতেই যাবে না। ভাবী বললেন,” কাল আরেকটু হলে কতো বড় অ্যাকসিডেন্ট হতো। সাঁতার শেখা খুব দরকার।”

“আমি জীবনেও পুকুরে নামবো না।”

“তুমি নামতে না চাইলেও জীবন তোমাকে পুকুর,নদী,সমুদ্রের কাছে নিয়ে যেতে পারে। চলো, চলো,আমি আছি তো!”

“না,না, আমি পানিতে নামবো না।”

মুরুব্বিরাও বললেন,”আহা! বাচ্চাটা ভীষণ ভয় পেয়েছে। ওর মেন্টাল ট্রমাটা কাটুক।”

আনন্দ ভাইয়া বললেন,”পরীর সাঁতার নিয়ে তোমাকে কষ্ট করে ভাবতে হবে না।এর জন্য ওর বাবা আছে।”

ভাবী কথা না বাড়িয়ে অদিতিকে নিয়ে পুকুরের দিকে রওনা হলেন।

পরের দিন পরী, আনন্দ ভাইয়া, আনিলা আপা, ফুপা-ফুপুসহ একটা বিরাট দল ঢাকা চলে গেলেন। আমরা কয়েকজন পড়ে রইলাম বাড়িতে। আনিলা আপারও থাকার খুব ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু এমিলি এতো লোকজন দেখে ভয়ে অস্হির। বাচ্চাটা এতো সুন্দর, সবাই তাকে কাড়াকাড়ি করে কোলে নিতো।এতে বাচ্চাটার জান ভয়ে উড়ে গেছে। মেয়ের জন্য আপা ঢাকায় চলে গেলেন।

অদিতি সাত দিনের মাথায় সাঁতার বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলো। মা-মেয়ে খুব খুশি, আমরাও মহা খুশি।

চলবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ