শক্তিময়ী পর্ব-০৯

0
2012

শক্তিময়ী
৯ম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

পরীর জ্বর সারলো প্রায় দুই সপ্তাহের মাথায়, কিন্তু অদিতি বেচারি ভুগতেই লাগলো। সমুদ্র -পরী দুজনেই খুব জেদি, জ্বরের পরে পরীর মাত্রাছাড়া রাগ আর জিদ হয়ে গেলো। সে ভাবীকে ছাড়বে না এক মুহূর্তের জন্য, সব বিষয়ে তার রাগ,কান্না কাটি। ভাবী বুঝাতে গেলে সবাই মিলে থামিয়ে দেয়,”আহা,আহা, ছোট মানুষ। কতো বড় অসুখ থেকে উঠলো। ওকে বকা দিও না। ওর কথা শোনো। যা বলে মেনে নাও।”

“এভাবে তো এরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি তো ওকে বুঝাচ্ছি, বকা দিচ্ছি না। সমুদ্র-পরী দু’জনেই কিন্তু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। ”

“ছোট মানুষটা অসুস্থ, আর তুমি আসছো বিচার সভা বসাতে।”

” ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় খারাপ হলেও মেনে নিবো,মানুষ খারাপ হলে মানবো না। আমি যতো তাদেরকে একটা ট্র্যাকে আনতে যাচ্ছি, ততো সবার অন্যায় আদরে ওরা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।”

কথাগুলো সত্য। ফুপা-ফুপু না হয় ওদের দাদা-দাদি, ভাবীর আব্বা-আম্মা বাচ্চাদের নানা-নানি, এই গ্রুপটা নাতি নাতনিদের প্রচুর অন্যায় সহ্য করেন, পারলে নাতি নাতনির জন্য চাঁদ পেড়ে আনেন, কিন্তু আনন্দ ভাইয়াকে তো একটু বুঝদার হতে হবে।

পরী বাপের কোলে বসে থাকলেও ভাবীকে পাশে বসে থাকতে হবে, দাদা-নানা যার কাছে থাকুক, মায়ের একটা হাত সে ধরে থাকবে। মায়ের খাওয়ার সময় জ্বালাবে, মা গোসলে ঢুকলে বাথরুমের দরজার সামনে বসে একটানা ঘ্যানঘ্যান করে যাবে, ভাবীর শরীর এই ক’দিনেই ভেঙে গেছে।

অদিতির গায়ে গায়ে জ্বর থাকে।ভীষণ দুর্বল। কিছু খেতে চায় না। ভাবীর মনের অবস্থা বুঝে আনন্দ ভাইয়া অদিতির জন্য চব্বিশ ঘন্টার একজন নার্স রেখে দিয়েছেন বেশ চড়া বেতন দিয়ে। নার্সিং না পড়া নার্স। ওষুধটা ভাবী নিজে খাওয়ান। মাঝেমাঝেই ভাতের প্লেট হাতে অদিতির ঘরে চলে যান,

“অদিতি সোনা,মায়ের সাথে কয়েক গাল খাও তো মা। সুন্দর একটা গল্প বলবো। নাও, এই লোকমাটা আসলে চড়ুই পাখির ডিম।”

অদিতি মায়ের কষ্ট কমানোর জন্য চেষ্টা করে, কিন্তু প্রচন্ড অরুচির জন্য চাইলেও খেতে পারে না।

“একবার খাও আম্মু সোনা।”

এদিকে শুরু হয় পরীর ঘ্যানঘ্যান। ফুপু বা ভাবীর মা বলেন,”আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের মেয়েটাকে দেখো। বাচ্চাটার কংকাল বের হয়ে গেছে একেবারে। আর তুমি পড়ে আছো আরেকজনকে নিয়ে। তার জন্য নার্স আছে না?”

কথাগুলো যথেষ্ট জোরে বলা হয়। ভাবীর মুখ রাগে টকটকে লাল হয়ে যায়। অদ্বিতীয়া ক্ষীণ গলায় মা’কে বলে,” মা,তুমি ঐ ঘরে খেয়ে নাও। আমার ঘুম
আসছে। ”

নার্স আমাকে জিজ্ঞেস করে, “নিজের মেয়েটাকে দেখো মানে? এ কি নিজের মেয়ে না? ”

অদিতিও প্রশ্ন চোখে নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

” নিজের মেয়ে না তো কি?কি যে বলেন! ”

“স্পষ্ট শুনলাম তো! ”

“আপনার কাজ অদ্বিতীয়ার খেয়াল রাখা। কে কি বললো, কে কি করলো,কে অদিতির ঘরে আসলো,কে আসলো না,এগুলো আপনার দেখার বিষয় না। ”

কিন্তু নার্স আমাদের অগোচরে অদিতির পেট থেকে কথা বের করতে চাইলো।

” তোমরা তিন ভাই বোন না? তোমার দাদি,আব্বা,নানা,নানি কখনো তোমাকে দেখতে আসে না কেন?”

“জানি না।”

“তোমার মন খারাপ লাগে না?”

“না।”

“তুমি কি তোমার আম্মুর আগের ঘরের মেয়ে?”

এই কথার মানেই অদিতি জানে না। নার্সের কৌতূহলও অসীম। সে চুপিসারে বাসার কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। ছুটা খালা, বাসার ফাই ফরমাস খাটার জন্য দুই কিশোরীকে সে জিজ্ঞেস করে কিন্তু সদুত্তর পায় না। সবারই উত্তর, অদ্বিতীয়া এ বাড়িরই মেয়ে, কিন্তু তিথি আন্টি, দাদাভাই, আর কয়েকজন চাচা-ফুপু ছাড়া “কেউ ওরে ভালা পায় না।” মাজেদা বু’র কাছে নিজের কৌতূহল মেটাতে যেয়ে নার্স জালে ধরা পড়ে গেলো। মাজেদা বু কঠিন গলায় বললেন,” কিসের জন্য আপনার মনে হলো,অদিতি এদের মেয়ে না?আপনার এতো বড় সাহস? অদিতির জন্মের দিনই আমি তাকে কোলে নিলাম। আপনি হাবিজাবি কিসব কথা বলে বেড়াচ্ছেন? দাঁড়ান, আমি খালামাকে ডাকছি।”

নার্স প্রাণপণে বাধা দেয়।অদিতি মাজেদা বু’কে তখন আটকায়,

“খালা, আমিও অনেকবার শুনেছি। ”

“কি শুনেছো যাদু? ”

“ভাইয়া আর পরী বাবা-মায়ের নিজের বাচ্চা। আমি নাকি নিজের বাচ্চা না।”

“কি মিথ্যা কথা! কে বলছে আম্মু এসব কথা?”

“দাদুমনি আর বাবা রাগ হলে বলে, আর ভাইয়া বলে, আর সূর্য ভাইয়া, প্রমি আপু, তিয়াশা আপুরা বেড়াতে আসলেই আমাকে এ কথা বলে। বলে, তুই আমাদের কেউ না। তুই ড্রেনে পড়ে ছিলি, ওখান থেকে তোকে তুলে আনা হয়েছে। ”

মাজেদা বু হতভম্ব গলায় বললেন,”তোমাকে ওরা এসব পচা আর মিথ্যা কথা বলে,তুমি আমাদের বলো নাই কেন? শুনো আম্মা, তুমি মানুষের পচা কথা শুনবা না। কেউ এসব আবার বললে আমাকে নাইলে তোমার আম্মুকে বলবা। তুমি এই বাড়িরই মেয়ে।এরাই তোমার মা-বাপ,দাদা-দাদি, ভাই -বোন।এটাই সত্য কথা। আমার কথা বিশ্বাস করেছো?”

অদিতি উত্তর দেয় না। ক্লান্ত ভাবে চোখ বুঁজে।

সব জানার পরে ভাবী নার্সকে বিদায় করলেন। তাঁর বোনদের ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন তাদের বাচ্চারা কেন এসব কথা অদিতিকে বলেছে?ছোট মানুষদেরতো এসব কথা জানার কথা না বড়রা তাদের সামনে গলা ছেড়ে আলোচনা না করলে। এই ধরণের ঘটনা যেন দ্বিতীয় বার না ঘটে। তারপরে ভাবী তাঁর বাপ-মা’কে চার্জ করলেন মুখোমুখি, সাথে ফুপুকেও,”তোমরা তাকে নিজের নাতনি বলে মানো না, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ও আমার মেয়ে।ও তোমাদের কাউকে জ্বালায় না। ওর জন্য তোমাদের কাউকে এতোটুকু কষ্ট পোহাতে হয় না। তাহলে কেন আমার মেয়ের সাথে সবসময় খারাপ ব্যবহার করো?কেন তাকে শুনিয়ে আজেবাজে কথা বলো? কোন অধিকারে? এরপরে আমার মেয়েকে নিয়ে একটা কথাও কেউ বলবে না। ভালো ব্যবহার করতে না পারো,খারাপ ব্যবহার করবে না। এরকম কিছু করলে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে সোজা অন্য কোথাও চলে যাবো। এবং আমি যা বলি,তা করি।”

সমুদ্রকে টেনে ঘরে এনে ওর দাদা দাদী,নানা নানীর সামনে ভাবী ছেলেকে কষে একটা চড় লাগালেন।

” অদ্বিতীয়া তোর কি হয়?”

“কিছু হয় না।”

“কিছু হয় না?ওকে কোলে করে আমি এ বাড়িতে ঢুকি নি? দেখিস নি তুই?পরীকে নিয়ে যেভাবে এসেছিলাম,অদিতিকে নিয়ে একই ভাবে এসেছিলাম। বলিনি বারবার যে অদিতি তোর বোন?”

“মিথ্যা বলেছো। ও নর্দমার মধ্যে পড়েছিলো। ও তোমার পেট থেকে হয় নি। ও আমার বোন না।”

“কে বলেছে তোকে এসব আজগুবি কথা?”

“সবাই জানে। আশেপাশের বাড়ির সবাই বলে।”

“সবাই বলুক। তুমি বলবে না। অদিতি আমার মেয়ে। তোমার আর পরীর বোন। তোমরা তিন ভাই বোন,এটাই বড় কথা।”

“ইস্, ও আমার বোন হতেই পারে না। নোংরা একটা মেয়ে।”

ভাবী আরেকটা চড় কষালেন।

“ওকে খালি খালি মারছো কেনো তিথি?এ কেমন কথা?সত্যি কখনো চাপা থাকে না,বুঝেছো?আসো দাদুভাই, আমার কাছে আসো। বড্ড বাড়াবাড়ি করো তিথি। একটা যা তা মেয়ের জন্য নিজের ছেলেকে মারলে! ”

“ও আমার নিজের ছেলে না। আর আমিও তোমাদের নিজেদের মেয়ে না। মানুষের চিন্তা ভাবনা এমন হতে পারে! একটা সাড়ে সাত বছরের বাচ্চা ভার্সাস পুরো পৃথিবী। হাহ্।”

ভাবী অদিতির রুমে যেয়ে দরজা আটকে দিলেন। তার আগে আমাকে বললেন,”তোমাদের নিয়ে অন্যরকম স্বপ্ন দেখতাম। ভাবতাম তোমাদের চিন্তা গতানুগতিক হবে না। কিন্তু তোমরাও এক। পরের দুঃখ -কষ্ট, যন্ত্রণা তোমাদের তেমন করে ছোঁয় না। ছুঁলে অদিতির জন্য নার্স রাখতে হতো না। ওর টয়লেটে যাওয়ার কথা শুনে মাজেদা বু’কে রান্না থেকে তুলে নিয়ে এসে অদিতিকে তোমাদের ফুপুর একগাদা কথা শোনানোর ব্যবস্থা করতে না। আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছে। আমাকে যেন ডাকাডাকি না করা হয়। আমার যতোক্ষণ খুশি আমি ঘুমাবো।যখন দরকার মনে হবে তখন উঠবো। আর ঐ মেয়ে যদি ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে এসে দরজা ধাক্কায়, আছাড় দিয়ে ওর চিৎকার আমি জন্মের মতো বন্ধ করে দিবো। ”

ভাবীর করাল মূর্তি দেখে সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। এমনকি ভাবীর ভাষায় “ট্যা ট্যাঁ” করা মেয়েটাও। তারপরে ভাবীর আব্বা-আম্মা উঠে দাঁড়ালেন, “আসি বেয়াই, বেয়াইন। তিথির হয়ে আমরা মাফ চাচ্ছি আপনাদের কাছে। মেয়েতো এমন রাগী ছিলো না, ভদ্র হাসিখুশি মেয়ে,সেধে পড়ে এক ঝামেলা ঘরে এনে এখন না পারছে এ কূল রাখতে,না পারছে ওকূল। ”

একবার ভাবলাম, বলি। সবাইকে বলি যে ভাবী ঠিকই সুন্দর ভাবে তিন ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে পারতেন, মন দিয়ে ঘর সংসার, চাকরি, সমাজ সেবা সব করতে পারতেন,আমরা সবাই যদি উনার পাশে দাঁড়াতাম, অদিতির প্রতি নির্দয় না হতাম। সমস্যাটা আমাদেরই তৈরি, ভাবীর নয়।

সন্ধ্যার পরে বাসায় এসে সব শুনে আনন্দ ভাইয়া গুম হয়ে বসে রইলেন।ফুপু বললেন,”তুই আবার তিথির সাথে রাগারাগি করিস না। ওরও কতোদিন ধরে ঘুম নেই,খাওয়া নেই, পরী সারাক্ষণ আঁকড়ে ধরে রাখে,সব মিলে ইমোশনাল আউটবার্স্টিং হয়েছে। ঝগড়াঝাটি করিস না।”

” মানলাম। কিন্তু আমার সমুদ্রকে অযথা মারলো কেনো?পরীকে সহ্য হয় না,এদিকে আরেকজনকে নিয়ে ঘরে দুয়ার দিয়ে শুয়ে আছে কেন? ”

“যাই হোক বাবা,আর অশান্তি ভালো লাগছে না। মাথা গরম করিস না।”

পরী অনেকক্ষণ ধরে তার বিখ্যাত জিদ ও কান্নাকাটি শুরু করেছে। অদ্বিতীয়ার ঘরের দরজার সামনে বসে চিল চিৎকার করছে,দরজায় থাবা দিচ্ছে। আমি ওকে সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছি। ফুপা বাইরে বেড়াতে নিজেকে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। কাজের কাজ কিছু হলো না,পরীর রাগ উত্তরোত্তর বাড়তে লাগলো।

আনন্দ ভাইয়া উঠে অদিতির দরজায় জোরে জোরে বাড়ি দিলেন,”তিথি, পরী কাঁদছে শুনছো না?দরজা খুলো। ঘুমানোর দরকার,এদিকে এসে ঘুমাও। কি হলো?”

দরজা খুললো না। আনন্দ ভাইয়া চিৎকার করে বলতে থাকলেন,”সিন ক্রিয়েট কোরো না। দরজা খুলো। আমি সারাদিন পরে বাসায় এসেছি, পরী দুর্বল শরীরে এতো কাঁদছে, এসব নিয়ে তোমার কোনো মাথাব্যথা নেই? তুমি পড়ে আছো একটা পরগাছাকে নিয়ে। যথেষ্ট হয়েছে।দরজা খুলো।”

তিথি ভাবী বের হয়ে এলেন। প্রচুর কেঁদেছেন বুঝা যায়। চোখমুখ ভয়ংকর ফোলা।

ফুপু বললেন,”তিথি,হাতমুখ ধুয়ে আসো। সারাদিন তুমি না খাওয়া। হাতমুখ ধোও, কিছু খাও।আসো,একসাথে বসে সবাই খাই। মাথাব্যথা কমেছে? ”

ফুপু নিজেই ভাবীর হাত ধরে খাবার ঘরে নিয়ে গেলেন। আমাদের সবাইকে খেতে ডাকলেন। আমি একটা প্লেটে নাশতা নিয়ে ভাবীকে বললাম,”ভাবী,তুমি ধীরেসুস্থে নিশ্চিন্তে খাও, আমি অদিতিকে খাইয়ে আসি।”

অদিতির ঘরে ঢুকে দেখলাম, অদিতি কাত হয়ে শুয়ে আছে আর দুই গাল চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে। মাথায় হাত রেখে বললাম, “অদিতি,একটু খেয়ে নাও তো।দেখো,তোমার ফেভারিট নাশতা।”

অদিতি ভাঙা গলায় বললো,”মাকে বাবা মারে নি তো?”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে