শক্তিময়ী
৮ ম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
তিন মাস হয়ে গেলো আনিলা আপা চলে যাওয়ার পরে। উনার প্রাক্তন স্বামী,শাশুড়ি, তিন ননাস রিমান্ডে খুনের কথা স্বীকার করেছেন। আসলে লোকটা একটা বিকৃত মস্তিষ্ক। বৌকে সমানে চাবুক মারা আর তার যন্ত্রণায় ছটফট করা দেখতেই তার আনন্দ। মা আর বোন তিনটা মানুষ নামের কলংক। উদ্ধত, অহংকারী,জালিম। এদের স্বামী বেচারারাও ভালো নেই, ভালো ছিলো না। এখন জেলের মধ্যে তিন বোনের সাত ছেলেমেয়ের জন্য নানী আর মায়েরা সারাদিন বিলাপ করে কাঁদে।
ঘটনার সন্ধ্যায় রুমুকে লোকটা বেল্ট দিয়ে মারাত্মক ভাবে মারে। মারার আগে মুখে রুমাল গুঁজে দিতো। হাতজোড়া পিছমোড়া করে বাঁধতো।আনিলা আপারও। আমার এখন আপাকেও পারভার্টেড মনে হয়। নইলে এমন ইতরের সংসার কেউ করে?কিন্তু রুমু প্রথম থেকেই অত্যাচারের বিরোধিতা করতো। মারটাও খেতো সেই রকম। বাবা-মা’কে শরীরের দাগ দেখিয়েছে অনেকবার, অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছে, পাথর গলে নি। শাশুড়ি বা বড় ননাস কখনো ফোনে বলেছে,” আপনার মেয়ের আগে অ্যাফেয়ার ছিল, জেনেশুনে আমাদের ঠকালেন কেন?” কিংবা “আপনারা মেয়ের গায়ে দাগ দেখতে পাচ্ছেন, আমার ভাইয়ের গায়ের দাগগুলো দেখে যান! আপনার মেয়ে কতো বড় অসভ্য, বদমাশ, জানেন? দিব কাছা খুলে? সারা পড়ায় ঢি ঢি পড়ে যাবে।” অথবা ” নিয়ে যান আপনাদের অসভ্য মেয়েকে। আমরা ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো। আমার ভাইয়ের জন্য মেয়েদের লম্বা লাইন পড়ে আছে। কি এক হাভাতে ঘরের মেয়েকে বৌ বানিয়েছিলাম!”রুমুকে উল্টা বাপের বাড়ির ভর্ৎসনাও শুনতে হতো।
ঘটনার সন্ধ্যায় মুখে রুমাল আর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্হায় বেল্টের বাড়ি খেতে খেতে রুমু নেতিয়ে পড়ে। এসময় শাশুড়ি এগিয়ে এসে
মুখ নিচু করে ঘটনা কি দেখতে গেলে রুমু একদলা থুথু শাশুড়ির মুখে ছুঁড়ে দেয়। কোনোভাবে মুখের রুমাল সরে গিয়েছিল । এরপরে শুরু হয়েছিলো সম্মিলিত মার।এলোপাথাড়ি। তারপরে যখন আর নিঃশ্বাস পড়ছিলো না, পিশাচগুলো তখন বাথটাবে পানি ভরে তাতে মৃত বা অর্ধমৃত রুমুকে শুইয়ে দেয়। একজন খুব সুন্দর করে রুমুর হাতের লেখা কপি করেছে।তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। এই মহান কাজটা করেছে বড় বোনের বড় ছেলে। কিন্তু হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্টের কাছে জাল ধরা পড়ে গেছে। বিশ বছরের ছেলেও এখন জেলে। ময়নাতদন্তে জানা যায়, বাথটাবে ডুবানোর আগেই হতভাগ্য রুমুর মৃত্যু হয়েছিলো।
আনিলা আপা চলে যাওয়ার পরে কিছুদিন ফুপু ওই ঘরেই থাকতেন সারাদিন। মেয়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইতেন। শুয়ে শুয়ে শুধু কাঁদতেন। দিন পনেরো পরে আনিলা আপা এক ভিডিও কলে বললো,”মা,যখনই ফোন দিই,তোমাকে আমার ঘরে দেখি। এটাতো আমি অদ্বিতীয়াকে দিয়ে এসেছি মা।তোমার আর বাবার জন্য মাস্টার বেডরুম, তোমার জন্য একান্ত তোমার রুম,পুরো বাড়িটাই তোমার। অদ্বিতীয়াকে আমার ঘরটা দিয়ে দাও মা।”
“না।এটা তোর রুম। তুই যখন আসবি,এই রুমে থাকবি। এটা আর কারও রুম হতে পারে না।”
“তাহলে আমি আর আসবোই না। আমার জেদ তো জানো। এতো বড় বাড়ির একদম এক কোণে ছোট ঘরে অদ্বিতীয়াকে থাকতে হয়।কেন?”
“এতোদিন তো ছিলো। তিন মাস বয়স থেকেই তো ছিলো।তখন তো এতো মায়া দেখিনি।”
“তখন আমি ঠিক মানুষ ছিলাম না। আমার এক্স শ্বশুরবাড়ি আমার চোখ কিছুটা হলেও খুলে দিয়েছে। একাকীত্ব, সারাক্ষণ ভয়, উপেক্ষার কি যন্ত্রণা, তা অদিতির মতো না বুঝলেও আমি কিছুটা বুঝেছি। ”
“তোর হাত বেঁধে নাকি নিয়মিত মারতো।প্রতিদিন। যাচ্ছে তাই ভাবে মারতো।কোনো কারণ ছাড়াই মারতো। ডাইনিগুলোও কম যেতো না। কেন চলে আসিস নি?কেন আমাদের কিছু বলিস নি?”
“ওটা একটা সাইকো ফ্যামিলি। আর আমারও কি হয়েছিল, কে জানে! কেন যে আমি লোকটাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম! ”
“ছি! কি রুচি। তুই যদি চলে আসতিস,সব বলে দিতিস, আমরা পুলিশের কাছে যেতাম, তাহলে ঐ নিরপরাধ, নিষ্পাপ মেয়েটাকে এতো ভয়ংকর ভাবে মরতে হতো না। তোর নিজেরও একই অবস্থা হতো আর কটা দিন ওখানে থাকলে। আমরা একটা গরু সদকা দিয়েছি এতিমখানায়। তোর জন্য। আর রুমু মেয়েটার জন্য কাঁদি, আহারে মেয়ে! কি হতভাগ্য মেয়ে।”
“তোমার এতো মায়া মা, শুধু তোমার না,আমার পরিবারের সব সদস্যদের, আমি ভাগ্যবতী। আমাদের বাসা থেকে কোনো ভিক্ষুক খালি হাতে ফিরে যায়নি, বাসার সব গৃহকর্মীদের ফ্যামিলি মেম্বারদের মতোই ট্রিট করেছো, অতিথি সেবা তো করেই যাচ্ছো, কিন্তু মা, এই তুমি,এই ভাইয়া সাড়ে সাত বছরের ছোট্ট একটা মেয়েকে সহ্যই করতে পারছো না, যে জন্ম থেকেই তোমাদের কাছে আছে। আইনত যে ভাইয়ার মেয়ে, তোমার নাতনি। কেন মা?”
” জানি না। সে যদি এমনি বাসায় থাকতো চার-পাঁচ বছর বয়স হতে ,আশ্রিতা হিসাবে , তাহলে তাকে বহুৎ যত্নের সাথেই রাখতাম। কিন্তু তাই বলে দত্তক? না রে মা,আমি মানতে পারি না।”
“ওর কি দোষ,মা? ওর জন্মের উপরে কি ওর হাত আছে?থাকলে ও তিথি ভাবীর কোলেই জন্মাতো আর বড় হতো প্রিন্সেসের মতো। অন্যায় করছো মা। আর অন্যায়ের শাস্তিও পাওয়া লাগে। অদিতিকে আজকেই আমার ঘরটা ছেড়ে দাও।”
তিথি সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো ঘরটা। অদ্বিতীয়ার বিভিন্ন বয়সের ছবি লাগালো দেয়ালে। কিন্তু অদিতি আড়ষ্ট। প্রকৃতিপ্রদত্ত বুদ্ধি থেকেই সে নিজের সীমারেখা জানে।
দুপুরে ফুপা-ফুপু তাঁদের ঘরে ছিলেন। দরজার এপাশ থেকে অদিতি বললো,”দাদাভাই, দাদুমনি,আসবো?”
ফুপু খড়খড়ে গলায় বললেন,”কি হয়েছে?ওখান থেকেই বলো।”
“দাদুমনি,তুমিতো ফুপির রুমটায় শুয়ে শুয়ে কাঁদো এই সময়ে, ইচ্ছা করলে এখনো এসে কাঁদতে পারো। তোমার যখন খুশি,ফুপির রুমে এসে কেঁদো। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।”
ফুপা হা,হা করে হেসে উঠলেন। ফুপু তীব্র গলায় বললেন,”যাও এখান থেকে। এঁচড়ে পাকা মেয়ে একটা।”
তিন বাচ্চার মধ্যে এতো বৈষম্য! আর সমুদ্র এবং পরী কেমন করে বুঝে গেছে,এই বাড়িতে ওরাই রাজপুত্র, রাজকন্যা। অদ্বিতীয়া কিছু নয়। ফুপা অদিতিকে আদর করেন বটে, খুবই আদর করেন, কিন্তু সমুদ্র ও পরীর প্রতি তাঁর আরেকটু বেশি টান খুব সহজেই ধরা যায়। তিথি ছাড়া এ বাড়িতে আরেকজন নিঃস্বার্থ ভাবে অদিতিকে আদর,মায়া আর সত্যিকারের ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছেন, মাজেদা বুবু।অদ্বিতীয়ার মাজেদা খালা।
ভাবীর বাপ-মা প্রায়ই আসেন, সেই আগের মতোন, তাঁরা আসলে বিরাট আড্ডা বসে, কিন্তু ভাবী আগের মতে স্বতঃস্ফূর্ত নন, আর উনারা অদ্বিতীয়াকে দেখেও দেখেন না। অদিতির অস্তিত্ব যেন তাঁদের অজানা। অদ্বিতীয়া ছোট্ট থাকতেই নিজের বাপ-মা আসলে ভাবী মেয়েকে ঘর হতে বের হতে নিষেধ করতেন। ছবি আঁকার জিনিসপত্র, তিন চারটা পুতুল দিয়ে বসিয়ে দিতেন,হোম ওয়ার্ক দিতেন বেশি করে, একটু পর পর কিছু খাবার নিয়ে আসতেন অদিতির জন্য। মাজেদা বুবু বলতেন,” ছেড়ে দেন ভাবী।আর দশটা বাচ্চা কাচ্চা খেলাধূলা করছে,আনন্দ ফূর্তি করছে, ওর প্রাণ এখানে থাকে কেমন করে ভাবী?”
” আমার মেয়ে ওখানে যাবে,কেউ তার দিকে ফিরে তাকাবে না, বাচ্চার দল খেলাধূলা করবে কিন্তু ওকে নেবে না, বাচ্চাদের একবার এই খাবার আরেকবার ঐ খাবার যত্ন করে তুলে দেওয়া হবে, কিন্তু অদিতিকে কেউ সাধবে না, দরকার নেই অদিতির এমন আনন্দ -ফূর্তি করার।”
নিজের বাপ মায়ের উপরে ভাবীর কঠিন অভিমান আছে অদ্বিতীয়াকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এ ব্যাপারে ভাবীর বাপ-মা নির্বিকার। সাধের মেয়ের সবকিছুকে গুরুত্ব দেন,নিজের নাতি নাতনিদের ভীষণ আদর করেন,কিন্তু অদ্বিতীয়ার নামই যেনো শুনেন নি তাঁরা।
জ্বর এসেছে দু’জনের, অদ্বিতীয়ার আর পরীর। দু’জনেরই উথাল পাতাল জ্বর। পরীর আলাদা একটা ঘর আছে,পরীর রাজ্যের মতোই সাজানো।আনন্দ ভাই-তিথি ভাবী পরীকে নিজেদের রুমে নিয়ে এসেছেন। পুরো বাড়িই বলতে গেলে এখন ভাবীর ঘরে থাকে। আনন্দ ভাইয়া ছুটি নিয়েছেন,ভাবীও। ফুপা-ফুপু,পরীর নানা-নানী, সমুদ্র, অন্যান্য আত্মীয় স্বজন। কেউ জলপট্টি দেয়,কেউ শরীর স্পন্জ করে, ওষুধ খাওয়াতে কতো ক্যারিকেচার করতে হয়, একটু খাওয়ানোর জন্য সবার রবার্ট ব্রুসের মতো অধ্যবসায়। আনন্দ ভাইয়া তো মেয়েকে কোল ছাড়া করেন না। ফুপু সমানে মজার মজার নাশতা আর অন্যান্য খাবার রান্না করেন,কোনটা পরীর মুখে রুচবে,পোলাও না খিচুড়ি নাকি ফ্রাইড রাইস ; গাদা চুক্তি খাবার নিয়ে আসেন পরীর নানা-নানী-মামা-খালারা। পরী একটু খেলে সবাই ধন্য হয়ে যায়।
অদ্বিতীয়া। সে পড়ে থাকে খাটের মধ্যে গুটিসুটি মেরে। তিথি ভাবী একটু পরপর আসেন। জ্বর দেখেন, মাথা ধুইয়ে দেন, শরীর স্পন্জ করে জামাকাপড় পাল্টে দেন, ওষুধ খাওয়ান,জোর করে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। এটুকুও অনেকের পছন্দ হয় না। আনন্দ ভাইয়া বলেন,”তোমার নিজের মেয়েকে নিয়ে টেনশন নেই? ”
“দু’জনেই তো নিজের মেয়ে। এক মেয়ের জন্য বাংলাদেশের পুরো জনতা আছে,আরেক মেয়ের জন্য পুরো পৃথিবীতে কেউ নেই। ”
“এখন পরীর কাছে তোমার থাকাটা খুব বেশি জরুরি। অন্য কারো কাছে নয়।”
“পরীর কাছে তুমি আছো, পরীর নানা নানি,দাদা দাদি সবাই আছেন, আমিও থাকছি।”
“সবার থাকা আর মায়ের থাকা এক না।”
” আমিতো থাকিই। আর আরেকজনওতো আমার মেয়ে। তার দেখাশোনা আমার করতে হবে না?”
“না,এই সময়ে তুমি শুধু পরীর কাছেই থাকবে। এর অনথ্যা হলে আমি… ”
“কি করবে?”
” এখন এতো কথা সহ্য হচ্ছে না। তুমি পরীর কাছ থেকে নড়বে না। এটাই ফাইনাল।”
আমি, ঝুমুর আপা, নুপূর আপা পালা করে অদিতির কাছে থাকতে লাগলাম। কিন্তু তিথি ভাবীর অভাব কি আমরা পূরণ করতে পারি? মেয়েটার জ্বর প্রায় সময় একশো পাঁচ হয়ে যায়। ওষুধ খাওয়াতে হয়। খাবার জোরজার করে খাওয়াতে হয়। রাতে ঘুমায় না।ছটফট করে। তখন আমরা যেই থাকি,তারই ঘুম হয় না। সবচেয়ে খারাপ লাগে বমি করলে। আমাদের গা ঘিনঘিন করে। মানুষটাকে ভালোবাসা যায়, তার বর্জ্যকেতো ভালোবাসা যায় না। এরই মধ্যে তিথি ভাবী আসেন, মেয়ের বমি পরিস্কার করেন, আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরেন, মেয়েকে কিছু খাইয়ে দিতে দিতে
নানা সাহসের গল্প করেন,” এক যে ছিলো ভীষণ লক্ষী, ভীষণ সাহসী মেয়ে…. “, ভাবী ওঠার সময় অদ্বিতীয়া মায়ের আঁচল খামচে ধরে,” মা,আরেকটু থাকো না।” ভাবী চোখের পানি সামলাতে সামলাতে বলেন,”একটা কাজ আছে মামনি।”
মাজেদা বুবু একদিন আমাকে আর ঝুমুর আপাকে বললেন,”এতোটুকুন মানুষের বমি করা দেখে ঘেন্না লাগে? মায়া লাগে না? তোমাদের না ফুপু ডাকে?ফুপুদের দরদের এই নমুনা? ”
ওষুধ, ডাক্তার দুই বোনের জন্য একই মানের, পথ্য নয়।
চলবে।