শক্তিময়ী পর্ব-০৩

0
2355

#শক্তিময়ী
৩য় পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

অদ্বিতীয়ার বয়স আট মাস হতে না হতে আনন্দ ভাই আবার বাবা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিথি ভাবীর কাছে। বললেন, “সমুদ্রের বয়স ছয় হতে চললো,এখনই সেকেন্ড ইস্যু নেওয়া দরকার। ও লোনলি ফিল করে।”

“আমি শারীরিক বা মানসিক ভাবে এই মুহূর্তে প্রস্তুত না নতুন করে মা হওয়ার জন্য। ”

“কেন?”

“তোমার যেমন সুবিধা অসুবিধা, ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে,আমারওতো তেমন থাকতে পারে। পারে না? আমার শারীরিক ফিটনেস দরকার, মানসিক শান্তির দরকার। নইলে আমি সন্তান পালবো কি করে?”

“তোমার ফিটনেসের ঘাটতি পড়লো কেন? তোমার প্রাণশক্তি তো অসাধারণ। রীতিমতো ঈর্ষণীয়।এখন প্রাণশক্তিতে ভাটা পড়লো কি জন্য? মানসিক শান্তিরও অভাব হয়েছে নাকি?”

“তোমার চোখ বা মন থাকলে বুঝতে পারতে।”

বাড়িতে তিথি ভাবীর যে আদর,আহ্লাদ,প্রভাব ছিলো, তার অনেক খানি হারিয়ে গেছে অদ্বিতীয়া আসার পরে। ছোট্ট একটা বাচ্চার কি যাদুকরী ক্ষমতা।

এখনো ফুপুর বাসায় দুদিন পরপর আসর বসে, আত্মীয় স্বজন,বন্ধু -বান্ধব সবাই মিলে জম্পেশ আড্ডা হয়, চা-নাশতার ছড়াছড়ি হয়, পারিবারিক ভাবে আমরা দল বেঁধে বেড়াতে যাই, এখনো ফুপা-ফুপু তিথি আম্মা কই বলে ডাকাডাকি করেন, এখনো আত্মীয় বন্ধুরা তিথি ভাবীকে চোখে হারায়,কিন্তু সেটা তিথি ভাবী একা থাকলে।ভাবীর কোলে অদ্বিতীয়া থাকলে কেউ তখন আর তিথি ভাবীকে চোখে দেখতে পায় না। বরং আসরে ছন্দপতন হয়। ভাবী তাই সহজে ঘর হতে বাইরে বের হন না।সবচেয়ে দুঃখ জনক বিষয় হলো, তিথি ভাবীর বাপ মা গোড়াতেই বলে দিয়েছেন তাদের বাসায় ঐ বাচ্চা যেন না আসে। শুনে ভাবী বলেছেন যে বাসায় উনার মেয়ের যাওয়া নিষেধ, সেখানে উনিও যাবেন না।অদ্বিতীয়া আসার পর হতে এখন পর্যন্ত ভাবী বাপের বাড়ি যান নি।

ফুপুর বাড়িতে দুইটা বড়সড় ঘটনা একসাথে ঘটলো।তিথি ভাবী প্রেগন্যান্ট হলেন, ফুপুর মেয়ে অর্থাৎ আনিলা আপুর বিয়ের সানাই বাজলো।আনিলা আপু ঠিক আমাদের মতো ভবঘুরে প্রকৃতির নন, গুরুগম্ভীর, বুয়েট থেকে সদ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন, আমরা যখন তিথি ভাবীর নেতৃত্বে নানা ধরণের পাগলামি করে বেড়াতাম, আনিলা আপা ভুরু কুঁচকে ফেলতেন। আপার আবেগ খুব কম। ভালোবাসার বহিঃ প্রকাশ নেই বললেই চলে। আপা বোঝেন শুধু পড়ালেখা আর ক্যারিয়ার। তিথি ভাবীকে নিয়ে আমরা যেমন মাতামাতি করেছি,উনি কখনোই করেন নি। আবার ভাবীকে যে ভালোবাসেন না,তাও নয়। ফুপা-ফুপু-আনন্দ ভাই আনিলা আপাকে চোখে হারান, আনিলা আপাও এই তিনজনের সাথে উচ্ছ্বল,স্বাভাবিক। অতি আহ্লাদী কন্যা, অতি আহ্লাদী বোন। সমুদ্রকে খুব আদর করেন। আর সবার সাথে তাঁর ভাসা ভাসা সম্পর্ক। খালা-ফুপু বা আমরা কেউ জড়িয়ে ধরলে পাল্টে জড়িয়ে ধরেন না, কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। অদ্বিতীয়ার আগমন নিয়ে এই যে তৃতীয় মহাযুদ্ধ চলছিল ও চলছে বাসায়, এটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা, দলাদলি নেই।

ছেলেপক্ষ প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। ফুপার বন্ধুর ভাইএর ছেলে। সমাজের উচ্চ পদে আসীন শ্বশুর বাড়ির সদস্যরা। দুলাভাই একমাত্র ছেলে, তাঁর বড় তিন বোন। খুবই জাঁকজমকের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো।

তিথি ভাবী প্রেগন্যান্ট। কিচ্ছু খেতে পারেন না। পানি খেলেও বমি হয়ে যায়।বেচারা বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না। ফুপা,ফুপু,আনন্দ ভাইয়া, ভাবীর বাপ-মা-ভাই-বোন, অন্যান্য আত্মীয়রা প্রাণপণে ভাবীর যত্ন আত্তি করেন। আদর-যত্নের সীমা পরিসীমা নেই। তবে সমুদ্র বড্ড বিরক্ত করে। ছেলেটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। অতি জেদি, অতিরিক্ত দুষ্টু, সারাক্ষণই এটা ওটার বায়না, একে ধাক্কা দেয়,ওকে লাথি মারে। ফুপুর পরিবারে বা আমাদের যে কোনো পরিবারে এমন ভয়ংকর জীব জন্মানোর কথা না। ওর এই বিপথগামী হওয়ার জন্য আনন্দ ভাইয়া, ফুপা,ফুপি,আনিলা আপার অতি আদর, অতি আশকারা দায়ী। কিন্তু দায়ী করা হয় ভাবীর হঠকারি সিদ্ধান্তকে _অদ্বিতীয়াকে দত্তক নেওয়া। আমরা তো দেখেছি এবং দেখি,সমুদ্রের স্বাস্থ্য, আনন্দ, বিনোদন,খাওয়া,লেখাপড়া,খেলাধূলার দিকে তিথি ভাবীর বরাবরই যেমন যত্ন আর নজর, একই নজর তার স্বভাবের দিকে।

ভাবীকে বিছানায় পড়া দেখে সমুদ্রের যন্ত্রণা করার সীমা পরিসীমা নেই। মায়ের কাছ ঘেঁষে সারাক্ষণ বকবক, চিৎকার,বায়না,লাফালাফি। আনন্দ ভাইয়া তাকে বেড়াতে নিয়ে যান, ফুপা নিয়ে যান, ওর মামা,খালা,চাচা,ফুপুরা কেউ নিয়ে যায়, পার্কে ঘোরানো হয়, চাইনিজ খাওয়ানো হয়, কাঁড়ি কাঁড়ি খেলনা কিনে দেওয়া হয়, আইসক্রিম -বার্গার-স্যান্ডুইচ-পেস্ট্রী-চকোলেট এগুলোর কোনো বিরাম নেই। অবিশ্রান্ত আদর।

আর থেকে থেকে ভেসে আসে ভীত, অভিমানী শিশুকন্ঠের কান্না। পরম আরাধ্য মানুষটাকে ইদানিং দেখতে পাচ্ছে না সে। কয়েকদিন ধরে সে পরিচিত বুকের উত্তাপ পাচ্ছে না, কেউ তার দু’গাল ভরে চুমু দিচ্ছে না, যে তাকে আরাম করে গোসল করিয়ে দিতো,সে কেনো যেনো আসছে না। ঐ অতি আকাঙ্খিত মুখখানা অদ্বিতীয়া দেখতে পায় না প্রায় সাত-আট দিন। ভাবী ঐ ঘরে যেয়ে দেখতে চেয়েছিলেন, অনুমতি মেলেনি। বাচ্চাটাকে নিয়ে আসতে বলেছিলেন নিজের কাছে। হয় নি।আনন্দ ভাইয়া কঠিন গলায় বলেছিলেন,”আমার ঘরে ঐ বাচ্চা ঢুকলে জাস্ট একটা আছাড় লাগাবো। এক আছাড়েই সব শেষ হয়ে যাবে।” কথাটা আনন্দ ভাইয়া এর আগেও কয়েকবার বলেছিলেন। ভাবীটার মনে থাকে না। অদ্বিতীয়ার ঘোরাফেরা মূলত নিজের ছোট্ট ঘর আর মাঝেমধ্যে ডাইনিং,ড্রইং, লিভিং, গেস্ট রুম আর বারান্দাগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। ওর জন্য নিয়োগ করা রোজীর কোলে ঘুরে বেড়ায়। এখন বয়স এক বছর নয় মাস। তুরতুরিয়ে হেঁটে বেড়ায়। কিন্তু সব ঘরের দরজা ওর জন্য খোলা না।

রোজী ওকে আদর করে নিজের মর্জি মতো। যখন মর্জি হয়না, তখন বাচ্চাটার সাথে অমানুষের মতো ব্যবহার করে। যেমন, অদ্বিতীয়া খিদের জ্বালায় চিৎকার করে, রোজী ফিরেও তাকায় না, যদিবা ফিডার দেয়, আগুন গরম না ঠান্ডা , সেটাও লক্ষ্য করে না। কয়েকবার বেশি গরমে অদ্বিতীয়ার মুখের ভিতর আর কচি দুটি হাতের পাতা পুড়ে গিয়েছিল। আমরা কতোটুকুই বা করতে পারি?অদিতির কাছে একটু বেশি থাকলেই ফুপু খুব রাগ করেন।

অদিতি ভারি মিষ্টি হয়েছে । গোল গোল হাত -পা, বড় উজ্জ্বল দুটো চোখ, একটু বোঁচা নাক, ঠোঁটটা ভারি সুন্দর। এমন বাচ্চাকে যে দেখবে,তারই মায়া লাগবে,কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছা হবে। শুধু আমাদের বাড়ির লোকদের কোনো হোলদোল নেই।

একটু সুস্থ হয়ে ভাবী আবার বাবুকে গোসল করানো, খাওয়ানো শুরু করলেন। সবার তীব্র আপত্তি স্বত্বেও। এবার ভাবী জোর গলায় বললেন,”পেটের মধ্যে একটা মানুষ আছে। সমুদ্র ঘুমের মধ্যে অনেক লাফঝাঁপ করে। তাছাড়া ওর বয়স সাতের কাছাকাছি। আমি এখন অদ্বিতীয়ার ঘরে ঘুমাবো।”

বাসার সবাই নিদারুণ অসন্তুষ্ট। ভাবী সিদ্ধান্তে অনড়। অদ্বিতীয়ার আনন্দের সীমা নেই। এবারে প্রথম দিন ভাবীর কোলে এসে চুপ করে এমন ভাবে বুকে মুখ গুঁজে রাখলো, ছোট ছোট হাত দিয়ে ভাবীকে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করলো,দেখে আমারই কান্না চলে এলো।

ভাবীর অনেক অশান্তি। বাবা ভালো করে কথা বলেন না, মা একশটা কথা শুনান, শ্বশুর-শাশুড়ীও তীব্র অসন্তুষ্ট স্বামী আর নিজের ছেলেকে ফেলে একটা আপদ শিশুর সাথে ভাবী রাতে ঘুমান বলে, আনন্দ ভাইয়ের কথা না ই বা বললাম।

ভাবী আমাদের ছাড়া আর সবার সাথে চুপচাপ হয়ে গেছেন। আমাদের সাথে আগের মতোই। নুপুর,ঝুমুর, সন্জু সবাইকে জিজ্ঞেস করেন,”কি রে, রক্ত দেওয়া কি বন্ধ? দিয়েছিস? সত্যি কথা?কার্ড দেখা।” কিংবা, “গরীব বাবুগুলোকে পড়াচ্ছিস ঠিকমতো? ওদের বইপত্র, কম করে দুই সেট জামা দিয়েছিস তো? লাইফ বয় সাবান কিনে দিয়েছিস? ওদের বাপ-মাকে বুঝিয়ে বলেছিস টয়লেট পরিস্কার রাখা,হাত ধোয়ার গুরুত্ব? নখ কাটে?দাঁত মাজে?ফলোআপ করিস ঠিকঠাক?”

ভাবীর বিয়ের পর থেকেই আমরা তাঁর নির্দেশমতো মোটামুটি পুরানো জামা, শার্ট, শাড়ি, ফ্রক কেচে ধুয়ে ইস্ত্রি করে দরিদ্রদের মাঝে দিই। ভাবী বলতেন, ” আন্তরিক বিনয়ের সাথে দিবি। যিনি নিচ্ছেন, তাঁর যেন হীনমন্যতা বোধ না আসে। ” আনন্দ ভাইয়া সহ ময় মুরব্বিরা সবাই ভাবীর কাজকর্মে প্রশ্রয় দিতেন, সাহায্য করতেন। এখনো করেন। আজ সকালেই যেমন আমার মা বললেন,”আমার কয়টা সালোয়ার কামিজ আর তোদের আব্বুর তিনটা শার্ট কেচে ইস্ত্রী করে রেখেছি। তোরা তিথির কাজকর্ম ঠিকমতো করিস তো? আর এই নে,এই মাসে আমার চাঁদা। ”

ভাবীর মেয়ে হলো। এমন সুন্দর বাচ্চা পৃথিবীতে আর একটাও আছে কিনা সন্দেহ। আমরা সবাই খুব, খুব খুশি। আনন্দ ভাইয়া বললেন,”তোমরা যা খুশি নাম রাখো, আমার মেয়েকে আমি পরী বলে ডাকবো। কি রে ব্যাটা,ঠিক আছে না? সমুদ্র আর পরী। সমুদ্রের পরী।”

পরীকে দেখতে দলে দলে মেহমান আাসে। ওকে কোলে নেওয়ার জন্য রীতিমতো সিরিয়াল দেওয়া লাগে। আবার সমুদ্র যেন নিজেকে অবহেলিত মনে না করে,সেদিকেও সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

কদর নেই শুধু একজনের। তার বয়স এখন প্রায় আড়াই বছর। ধরে রাখা যায় না।দৌড়ে দৌড়ে বেড়ায়। আমরা যে যখন থাকি, খুব সাবধানে থাকি,অদ্বিতীয়া যেন আনন্দ ভাইয়ের সামনে না পড়ে। ফুপুর সামনেও না। ফুপা তাও একটু নরম হয়েছেন। বকাঝকা দেন না, দুই একদিন বাচ্চাটার মাথায় হাতও রাখতে দেখেছি।

ভাবী আমাদের কাতর স্বরে বলেন,”যে যতোটুকু পারিস,আমার অদিতির দিকে খেয়াল রাখিস রে। এই ঠান্ডার মধ্যে রোজী কেমন বিবেকহীনের মতো মেয়েটাকে বরফ ঠান্ডা পানিতে গোসল করালো। আমি তখন পরীকে নিয়ে ড্রইং রুমে। মায়ের বান্ধবীরা এসেছিলেন পরীকে দেখতে। রোজীকে আর রাখবো না রে। মেয়েটার প্রাণে দয়ামায়া নেই। ভাগ্যিস মাজেদা বু ‘র চোখে পড়েছিলো। রোজী মগ দিয়ে ঠান্ডা পানি ঝপাঝপ অদিতির মাথায় ঢালছে আর মেয়েটা শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। একবার দু’বার না,সুযোগ পেলেই রোজী এমন করে। সবসময় পেট ভরে খাওয়ায় ও না। ”

পরীর নাম পারিজাত। সবাই আদর করে পরী ডাকে। পরীর জন্য নিত্যনতুন জামাকাপড়, খেলনাপাতি আসে, সমুদ্রের জন্য ও। আনন্দ ভাই বা অন্য কেউ অদিতির জন্য একটা সূতাও নিয়ে আসেন নি এই পর্যন্ত। আড়াই বছর বয়সী অদিতিকে দিনে একবার ডানো দুধ দেন ভাবী, অদিতি দুধ খেতে ভালোবাসে খুব। কিন্তু এর বেশি দুধ বাচ্চাটার কপালে জোটে না। আনন্দ ভাইয়ের কঠিন নিষেধাজ্ঞা। রুটি খাচ্ছে, ভাত খাচ্ছে, মাছ,মাংস,ডিম খাচ্ছে, তার আবার দুধের দরকার কি?

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে