লুকোচুরি গল্প পর্ব-৩২+৩৩

0
334

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩২
#ইশরাত_জাহান
🦋
পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে।মিস্টার সমুদ্র ও মিস্টার রবিন মিলে মিষ্টি খাইয়ে সবাইকে খুশির আনন্দে বলছে,”আমাদের মেয়ে আজ GPA 5 পেয়েছে। নেও তোমরা মিষ্টি খাও।”

হ্যাঁ,আজকে ইন্টারের রেজাল্ট প্রকাশ পেয়েছে।দেখতে দেখতে কতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে। রেজাল্টে নীরা GPA 5 আর কেয়া একটুর জন্য মিস হয়েছে।তবে কেয়ার রেজাল্টও খুব ভালো। আইসিটিতে প্লাস মার্ক না আসাতে কেয়া গোল্ডেন মার্ক উঠাতে পারেনি।রিক ও তার পরিবার এর জন্য কেয়ার উপর খুব খুশি।কেয়া যে পরীক্ষায় পাশ করছে তাও এত ভালো এটা কেউ আশা করেনি।দ্বীপ তো শেষের দিকে কেয়ার জন্য টিউটর দেখেছিলো।পরীক্ষার ভিতর আবার বিয়ের সপ্ন জেগেছিলো কেয়ার।সে মেয়ে যে এ প্লাস পেয়েছে এটা শুনে কেয়ার মা নিজেই মেয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন।দুই বান্ধবীর এত ভালো রেজাল্টের জন্য আজ বাসায় পিকনিক করা হবে। নীরাদের বাসার সামনে ফাঁকা মাঠ আছে।ওখানে সবাই জয়েন্ট হয়ে পিকনিক করবে।

আজ সবার মুখে খুশির ঝলক।কিন্তু নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকাচ্ছে সবার দিকে।খুশি না হয়ে মুখ গোমড়া করে রেখেছে।অভ্র এসে নীরাকে বলে,”কি হয়েছে,মামী?”

নীরা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,”আজ রেজাল্ট বেড় হয়েছে কার?”

অভ্র উত্তর দেয়,”তোমার।”

“ভালো রেজাল্ট করেছে কে?”

“তুমি আর কেয়া আণ্টি।”

“তাহলে মিষ্টি খাওয়ার কথা কার?”

“তোমাদের।”

“মিষ্টি খাচ্ছে কে?”

“মামু।”

“এটা কেমন বিচার?”

“খুব বাজে।”

“এত কষ্ট করে রাত জেগে পড়াশুনা করলাম আমি,ভোরবেলা উঠে বই খাতা নিয়ে কাপাকাপা হাত পা নিয়ে পড়াশুনা করলাম আমি,শীতের মধ্যে থরথর করে কেঁপে কেঁপে পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর দিলাম আমি,অত অত কঠিন কঠিন অংক ইংরেজি মাথায় রেখে পরীক্ষার সঠিক উত্তর দিলাম আমি।রেজাল্টের উপর গোটা গোটা নাম ভেসে আসছে আমার।কিন্তু এলাকাবাসী এসে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে কাকে?”

“আমার মামুকে।”

“কেনো খাওয়াবে তাকে।রেজাল্ট তো আমার ভালো হয়েছে।লোকজন আমাকে মিষ্টি খাওয়াবে তা না,হুহ।”

“আমি শুনেছি তুমি পড়াচোর।মামু না পড়ালে তুমি ভালো রেজাল্ট করতে না।তাই মামুকে সবাই মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।”

নীরা এবার কটমট চোখে তাকালো অভ্রর দিকে।বলে,”আমি পড়াচোর?তোমার মামু আমাকে পড়াতে পারতো না যদি আমি আগ্রহ দিয়ে না পড়তাম।”

অভ্র এবার নীরার মত করে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,”আমি দেখেছি তুমি পড়াচোর।একদিন জানালা দিয়ে দেখেছিলাম মামু তোমার গালে একটা মার দিয়েছিলো।পড়াশোনা করলে তো মার খেতে না।”

এত ভালো রেজাল্ট করলো তারপরও যেনো আজ পুঁচকে অভ্রর কাছে অপমান হলো নীরা।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,”তোমার মামুর হাত একটু বেশি চলে।আমি পড়া ঠিকভাবে করতাম।তোমার মামু একটু লিমিটের বাইরে পড়াতো।”

দীপান্বিতা এসে নীরাকে মিষ্টি খাইয়ে বলে,”আমার লিটিল ভাবী।এই নেও মিষ্টি খাও।”

“বাসি মিষ্টি আমি খাই না।”

“ও মা বাসি হবে কেনো?বাবা আর ভাই মিলে সেরা দোকানের মিষ্টি এনেছে।আজকেই বানানো।”

“মিষ্টি সেরা দোকানের হলেও মিষ্টির স্বাদ অন্যজন পেয়েছে।আমি এত ভালো রেজাল্ট করলাম কিন্তু দাম পেলাম না।”

বলেই মুখ ফুলিয়ে ওঠে নীরা।দীপান্বিতা হেসে দেয়।বলে,”ওলে আমার লিটিল ভাবীর অভিমান হয়েছে।চিন্তা করো না।ভাই তোমাকে এর থেকেও সেরা মিষ্টি খাওয়াবে।”

নীরা দীপান্বিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমিও দেখছি আমাদের মতো হয়ে গেছো।”

“তোমাদের ছোয়া পেয়ে তো আমরা সবাই পরিবর্তন।”

সন্ধায় পিকনিক এর ব্যাবস্থা করা হচ্ছে।দ্বীপ কলেজে থেকে এসে সবার থেকে মিষ্টি খেয়ে খেয়ে পেট ভরিয়েছিলো তারপর মিস্টার সমুদ্রর রেস্টুরেন্টে গেছে।সন্ধায় ফিরেছে দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্র।সাথে করে পিকনিকের বাজার সামগ্রী নিয়ে।সবাই আস্তে আস্তে মাঠে উপস্থিত হয়।সবাই এক জায়গায় দাড়ানোর পর দ্বীপ খেয়াল করলো নীরা নেই।দ্বীপ দীপান্বিতাকে জিজ্ঞাসা করে,”নীরা কোথায়?”

“লিটিল ভাবী তো ঘরে।”

“কই না তো।আমি ঘর থেকেই এসেছি।”

“আমি তো লাইভ করতেছিলাম।লিটিল ভাবী বলেছিলো তার এখন ভালো লাগছে না কিছু।তাই ঘুমিয়ে ছিলো। কোথায় যাবে তাহলে?”

“ছাদে গেলো না তো?”
বলেই দ্বীপ চলে যায় ছাদে।কিন্তু নাহ কোথাও নেই নীরা।বাইরে মাঠে এসে দ্বীপ হাফাতে হাফাতে বলে,”কোথায় গেলো ও?মা বাবা সবাই তো এখানে।”

সবাই আলাদাভাবে খুঁজতে থাকে নীরাকে।কেউ খুঁজে পায় না।দ্বীপ অস্থির হয়ে গেছে।চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ।গা হাত পা কাপছে তার।ধপ করে বসে পড়ে মাঠের মধ্যে রাখা কাঠের উপর।মিসেস নাজনীন কান্না করছেন মুখে আচল গুঁজে।মিসেস সাবিনা পাশে এসে শান্তনা দিতে থাকেন।রিকের মাও সেখানে দাড়িয়ে।কেয়া ও রিক একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে কিছু কথা বলে বাইক নিয়ে বের হয় রিক।দ্বীপের করুন অবস্থা মিসেস নাজনীন এর কান্নাকাটি।অভ্র নিজেও এবার ভয় পেয়ে কান্না করছে।বাচ্চা মানুষ সবার চিন্তা দেখে ভয় তো পেয়েছে মামীকে পাচ্ছে না দুই ঘন্টা ধরে।কি হতে পারে।না বলে কোথায় যাবে নীরা।কাউকে সাথে নেয়নি।ফোন করেও পাচ্ছে না নীরাকে।কেউ কিছু বলছে না।দীপান্বিতা অভ্রকে সামলাতে ব্যাস্ত।মামু আর নানুকে কান্না করতে দেখে সেও কান্না করছে।নীরব বাইক নিয়ে বেরিয়েছে।বাকিরা এদিক ওদিক ফোন দিয়ে খোজ খবর নিতে থাকে।

থমথমে পরিবেশ। কারো মুখে নেই কোনো কথা।ঠিক সেই সময় সবার কানে ভেসে আসে,”কি হয়েছে?তোমরা এভাবে কান্নাকাটি করছো কেনো?”

দ্বীপ হাতের মুঠোয় মুখ বুঝে ছিলো।নীরার কণ্ঠ পেয়ে তাকায় নীরার দিকে।হাতের চাপ লেগে চোখের কোনায় চশমার চাপ পড়ে গেছে।শ্যামলা মুখে রক্তের জমাট,চোখমুখ লাল হয়ে আছে।চশমার ভিতর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দ্বীপের চিন্তিত লাল চোখ।তারাতারি উঠে এসে লোকসম্মুখে জড়িয়ে ধরে নীরাকে।বলে,”দুই ঘণ্টা ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাকে।না বলে কোথায় গিয়েছিলে?”

দ্বীপের কণ্ঠে ফোফানির আভাস।নীরা বুঝতে পারলো দ্বীপ খুব চিন্তা করেছে।শুধু দ্বীপ না পুরো পরিবার।নীরা তাকিয়ে দেখলো তার মা কান্না করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা বের করেছে।ছোট অভ্রর চোখ মুখ লাল।মিসেস শিউলি এখনও বুঝতে পারেনি নীরা এসেছে।তিনি ওখানে বসেই তসবি পড়ছেন।বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার দোয়া পরে যাচ্ছেন তিনি।নীরা আস্তে আস্তে হেঁটে এসে মিসেস শিউলির কাছে দাড়িয়ে একটু ঝুঁকে নেয়।তারপর মিসেস শিউলিকে বলে,”নাতবৌ হারিয়ে যায়নি গো দাদীন।নাতির ঘরে পুতিকে আনতে পেরেছে কি না এটা দেখতে গিয়েছিলো।”

নীরার ফিসফিস করে বলা এমন বাক্য শুনে অবাক হয়ে তাকান মিসেস শিউলি।নীরার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কি হলো।নীরার হারিয়ে যাওয়ার জন্য মাথায় চিন্তার মেলা বসেছিলো।তাই নীরার এমন কথার মানে বুঝতে পারছিলো না।মিনিট পাঁচ তাকিয়ে থেকে মিসেস শিউলি জোরে চিল্লিয়ে বলেন,”সত্যি কও নাতবৌ?”

নীরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দৌড় দিলো বাড়ির দিকে।সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে।মিসেস শিউলি জোরে জোরে বলেন,”এমন সময় দৌড়াইতে নাই নাতবৌ।শরীরের ক্ষতি হইবো।”

কেউ কিছু বুঝলো না।দ্বীপ নিজেও দৌড়ে চলে গেলো নীরার পিছনে।ঘরে এসে দ্বীপ দেখে নীরা জানালার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসছে।নীরার কাছে এসে বলে,”কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

“ডাক্তারের কাছে।”

চিন্তার ভাঁজ কপালে ফুটিয়ে উঠলো দ্বীপের।নীরার অতি নিকটে এসে কপালে হাত দিয়ে হাসফাস করে বলে,”আমাকে তো বলবে।আমি যেতাম তোমার সাথে।কি হয়েছে তোমার?”

নীরা উত্তর না দিয়ে মিটমিট হাসে।দ্বীপ এখনও কাপছে।দুই ঘণ্টা একজন জলজ্যান্ত মানুষ হাওয়া।না বলে কোথাও যাওয়ার দরকার তো এখন তার নেই।তারপরও গেছে নীরা।এখন আবার কি হয়েছে তা বলছে না।অবশ্য যে ক্লু নীরা দিয়েছে তাতে বুঝে যাওয়ার কথা।কিন্তু দ্বীপের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।নীরা বুঝতে পারলো।অতঃপর নীরা দ্বীপের হাত নিজের পেটের উপর রেখে বলে,”নিজের অস্তিত্ত অনুভব করার চেষ্টা করুন ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ সাথে সাথে ধরে ফেলে নীরার কথা।বুঝতে পারে তাদের ভালোবাসার ফল আসতে চলেছে।দ্বীপ নীরার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে।ওখানেই দ্বীপের ডান হাত।কোনো কথা না বলে শুধু অনুভব করছে।নীরা আবার বলে,”আমি কয়েকদিন আগে থেকেই নিজের ভিতর পরিবর্তন অনুভব করি।প্রথমে একটু চিন্তা হয়।কিন্তু আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পাই আমাদের জুনিয়র আসার লক্ষণ।কনফার্ম হওয়ার জন্য হসপিটালে যাই কেয়ার সাথে লুকিয়ে ফুসকা খাওয়ার নাম করে।আপনি কলেজে তখন।বাসায় ইচ্ছা করেই বলিনি।ভেবেছিলাম সবাইকে সারপ্রাইজ দিবো।আজকে প্রেগনেন্সি টেস্টের রেজাল্ট দিয়েছে।আনতে বেশি সময় লাগতো না।কিন্তু ডাক্তার আসায় দেরি হয়।অপেক্ষা করতে হয় অনেকক্ষণ।এদিকে ফোনেও চার্জ ছিলো না।ব্যাগ থেকে ফোন নিয়ে কেয়াকে এসএমএস করবো দেখি ফোন বন্ধ।অপেক্ষা করতে করতে একটু দেরি হয় আর রাস্তার অতিরিক্ত জ্যাম ছিলো।আমি দুঃখিত ক্যাডার সাহেব।সারপ্রাইজ দিতে যেয়ে আমি আপনাদের টেনশনে ফেলে দিয়েছি।কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনাকে আপনার বাবা হওয়ার স্বাদ একটু ভিন্নভাবে দিতে।সবসময় আপনি আমাকে সারপ্রাইজ করে দেন।আমিও চেয়েছি আজ মা বাচ্চা মিলে সারপ্রাইজ দিবো।প্লিজ রাগ করে থাকবেন না।”
কানে হাত দিয়ে রিকোয়েস্ট করে বলতে থাকে নীরা।নীরার চোখেও পানি।সে দ্বীপকে সারপ্রাইজ দিতে পারেনি বরং চিন্তায় ফেলেছে।দ্বীপ নীরার চোখের পানি দেখে হালকা হেসে জড়িয়ে ধরে তার চন্দ্রপাখিকে।বলে,”আজ আমার চন্দ্রপাখি মা হওয়ার অনুভূতি পাচ্ছে।আমি বাবা হওয়ার অনুভূতি।আমার লুকোচুরি ভালোবাসার ব্যাক্তি আমার হয়ে পরিপূর্ণ সংসারী হয়েছে।আমি পূর্ণ হয়েছি আজ।”

দরজায় দাড়িয়ে হাততালি দিতে থাকে সবাই।কেয়া বলে,”আমরা সব শুনেছি।আমি যে কতবার তোকে কল করেছি।তোর কথামত চুপ ছিলাম আমি।আমি তো পারলে এখনই বলে দিবো যে নীরা হসপিটালে।শুধু তোর ইচ্ছা পূরণের জন্য চুপ ছিলাম কিন্তু রিককে পাঠিয়েছি হসপিটালের দিকে।এখনও রাস্তায় সে।বললো জ্যাম পড়েছে খুব রাস্তায়।”

মিসেস নাজনীন এসে নীরার কপালে চুমু দেয়।নীরার হাত দুটো নিজের মুঠে নিয়ে বলেন,”এবার তো একটু বড় হ মা।চিন্তা হয় তো তোকে নিয়ে।তোদের কিছু হলে আমরা বাবা মা যে মরেই যাবো।”

সাথে মায়ের মুখ চেপে ধরলো নীরা।বলে,”আমার মা হওয়ার অনুভূতিতে তুমি এমন কথা বলছো কেনো মা?”

মিসেস নাজনীন জড়িয়ে ধরেন নীরাকে।নীরা বলে,”জানো মা!আমিও এখন মা হবো।”

সবাই হেসে দেয় নীরার কথায়।মিস্টার সমুদ্র নিজের রেস্টুরেন্ট থেকে কেক নিয়ে এসেছে।বাইরে মাঠে সুন্দর করে চেয়ার ও পাটি দিয়ে সাজানো হয়েছে।নীরা ও দ্বীপ মিলে কেক কাটে।একে অপরকে কেক খাইয়ে দিয়ে বাড়ির সবাইকে কেক দেয় নীরা।অভ্র যখন থেকে শুনেছে বাড়িতে নতুন অতিথি আসবে সে ত খুশিতে হাত তালি দিয়ে নাচানাচি করতে থাকে।

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#ইশরাত_জাহান
#পর্ব_৩৩
🦋
শীতের রাতে চারপাশে ঘন কুয়াশায় ঘেরা।সবাই সেই শীতে আগুন জ্বালিয়ে গরম উষ্ণতার উপভোগ করছে।পিকনিকে বার্বিকিউ করা হবে।নীরব রিক ও দ্বীপ মিলে মাংস পোড়ানোর ব্যাবস্থা করছে।এক পাশে গান বাজছে মিউজিক বক্সে।কেয়া এসে নীরার পাশে বসে।বলে,”দেখতে দেখতে আমার বিয়ের আজ প্রায় তিন মাস।তোর জীবনে এসেছে এক গুড নিউজ।আমরা কত তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছি তাই না?”

নীরা কেয়ার কাধে মাথা দিয়ে বলে,”আমরা মাঠে আগে কত লাফালাফি করতাম তাই না দোস্ত?”

“কয়েকদিন পর আমাদের বাচ্চারা খেলাধুলা করবে।”

“মিষ্টি মধুর দিনগুলো এত তাড়াতাড়ি যায় কেন বলতো?”

“নেক্সট জেনারেশন যে আসতে হবে তাই।”
বলেই দুই বান্ধবী ভাবতে থাকে তাদের পুরনো স্মৃতি।কেয়া ও নীরা কখনও একে অপরকে ছেড়ে থাকেনি।কেয়াকে কেউ বাজে কথা বললে নীরা তার মাথা ফাটিয়ে দেয় আর নীরাকে কেউ বাজে কথা বললে কেয়া তার মাথা ফাটিয়ে দেয়।শুধু কি তাই?নীরা ও কেয়া যাই কিনে একসাথে মিলেমিশে কেনাকাটা করেছে।ভিন্ন ঈদে ভিন্ন নামে জামা আসলে নীরা ও কেয়া মিলে কিনতো।কোনো সিনেমা বের হলে একসাথে লুকিয়ে সিনেমা দেখতো।কেউ অসুস্থ হলে আরেকজন তার বাসায় বসে থাকতো।এদের এই বন্ধুত্ব নিয়ে অনেকে চিন্তা করত এরা আলাদা হবে কিভাবে?কিন্তু ভাগ্য তাদের এক করে দিয়েছে।এই যে ফাঁকা মাঠ এই মাঠ কিনে নিয়েছে রিকের পরিবার।এখন এখানেই রিক ও কেয়ার পরিবার গড়ে উঠবে।ভাগ্য নীরার থেকে নীরার প্রিয় মানুষদের আলাদা করেনি।কিন্তু নীরার প্রিয় সময়গুলোকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এত সময় ধরে এগুলো ভেবে নীরা বলে,”মনে আছে দোস্ত?ক্লাসে স্যার পড়াতে শুরু করলে আমাদের সময় যেনো ফুরাতো না।এখন দেখ সুখের সময় কিভাবে ফুরিয়ে যাচ্ছে।”

“হ্যাঁ।স্কুল জীবনে বৃহস্পতিবার করে আমরা কত খুশি হতাম।আজ টিফিন টাইমে ছুটি হবে। কাল শুক্রবার আহ কি আনন্দ করবো।এসব থাকতো আমাদের মাথায়।”

“ক্লাসের ভিতরে টাকলু স্যার যখন পড়াতো আমরা খাতায় তার ছবি আকাতাম।”
বলেই হেসে দেয় নীরা ও কেয়া।মিসেস নাজনীন এসে বসেন নীরার পাশে।বলেন,”পুরাতন স্মৃতিগুলো এমনই হয় মা।জীবনে যত উন্নতি করবে মনে হবে আগের সময়টা কত ভালো ছিলো।মনে হয় ইশ সুযোগ থাকলে এখনই আমি সময়টা ধরবো।কিন্তু না আমরা এটা পারি না।”

“তোমার জীবনে কি এমন আনন্দের সময় আছে আম্মু?”

মিস্টার রবিন এসে স্ত্রী পাশে বসেন।বলেন,”আমাদের সময়ের মুহূর্তগুলো তো আরো মিষ্টি মধুর ছিলো মা।আজকাল প্রেম ভালোবাসা মানে বাজারের ভেজাল শাক সবজির মতো।আমাদের ভালোবাসায় এত ভেজাল ছিলো না।এই ভালোবাসা হোক বন্ধুত্ব হোক বাবা মা আর স্বামী স্ত্রী।আমরা সম্পর্কগুলো সুন্দরভাবে ধরে রাখতাম। হ্যাঁ তোমরাও তেমনটাই আছো।কিন্তু আমাদের আশেপাশে সম্পর্কগুলো এমন হয় না।ভালোবাসায় প্রচুর ভেজাল পড়ে গেছে।”

নীরা বাবার মুখে এমন কথা শুনে খুশি হয়।তার মা বাবার প্রণয়ের বিয়ে এটা নীরা জানে।বাবা তো এক কথায় তার মায়ের জন্য পাগল।নীরা তাই মাঝে মাঝে বাবাকে মনেমনে বউ পাগলা বলে ওঠে।কিন্তু এখন তার ক্যাডার সাহেব ও তো এমন।

মিস্টার রবিনের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে দীপান্বিতা।তাকিয়ে পড়ে নীরবের দিকে। নীরব নিজেও তাকিয়ে আছে দীপান্বিতার দিকে।দীপান্বিতার চাহনি দেখে নীরব দীপান্বিতাকে একটি স্মিত হাসি উপহার দেয়।

মাংসগুলো পোড়ানো হচ্ছে।এদিকে সবার একটাই আবদার।নীরবকে গান গাইতে হবে।গিটার আনা হয়েছে।নীরব গান গাইতে থাকে।দীপান্বিতা মন দিয়ে শুনছে নীরবের গান।

“যদি অভিযোগ কেড়ে নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয় সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলোতে ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার বলো কি থাকে আমার?

যদি ভালবাসা সরে গেলে মরে যেতে হয়,
কেনো সেই প্রেম ফিরে পেলে হেরে যেতে ভয়।”

নীরব এর কণ্ঠে আকুতির সুর।নীরা ও তার পরিবার বুঝতে পারছে নীরবের এই আকুতি।
____
গভীর রাতে শীত বাড়তে শুরু করে।আশেপাশে কুয়াশায় ঘেরা থাকে।আকাশের চাঁদ আস্তে আস্তে তার জায়গা পরিবর্তন করছে।নীরা জানালা দিয়ে দ্বীপের কোলে বসে দেখছে সেই চাঁদ।পিকনিক শেষ করে ঘরে বসে আছে দ্বীপ ও নীরা।দুজনে একসাথে একটি চাদর মুড়িয়ে তাকিয়ে আছে কালো আকাশের দিকে।নিরবতা পালন করে চন্দ্র বিলাস করছে দ্বীপ ও নীরা।ঘণ্টা খানেক এমন হওয়ার পর দ্বীপ বলে,”চন্দ্রপাখি।”

নীরা,”হুম।”
“ঘুমাবে না?”
“আজ আর ঘুম আসবে না ক্যাডার সাহেব।”
“কেনো?”
“আমাদের অস্তিত্ত বেড়ে উঠছে আস্তে আস্তে।আমি আজকে এটা জানতে পেরেছি।সত্যি বলতে কখনও এমন ভালো লাগার অনুভূতি আসেনি।বুঝিয়ে ওঠাতে পারবো না আমি যে মা হবো এমন একটা ফিলিং আমার কেমন যেনো লাগছে।”

“পাগলী বউ আমার।”

“জানেন ক্যাডার সাহেব!ডক্টর যখন আমাকে বলেছিলো যে, কংগ্রাচুলেশন আপনি মা হতে চলেছেন।আমার মনে হচ্ছিলো কোনো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত খুঁজে পেয়েছি।উনি বলেছেন,আমাদের সন্তান নাকি এখন ইদুদের বাচ্চার মত ছোট। আস্তে আস্তে বড় হবে।মাঝে মাঝে আমাকে পেটের ভিতরে লাথি দিবে।আমাকে বাবুর ভালোর জন্য বিভিন্ন উপদেশ দিতে থাকে ডক্টর।তখন মনে হয় আমি বাবুকে কখন কাছে পাবো।একবার ওকে ছুঁয়ে আদর করি।ওকে আমার এখনই পেতে ইচ্ছে করছে।”

দ্বীপ হাসতে থাকে নীরার কথায়।বলে,”চন্দ্রপাখি শান্ত হও।আমাদের চুনু মুনু খুব শীঘ্রই আসবে।এর জন্য তোমাকে ঘুমাতে হবে।প্রপার রেস্ট না পেলে তুমি অসুস্থ হবে আর বাবুর ক্ষতি হবে।”

“হ্যাঁ,ডক্টর বলেছিলো এমন।কিন্তু আমি কি করবো?খুশিতে আমার ঘুম আসছে না।আমি যে মা হবো এটাই আমার খুশিতে ঘুম কেড়ে নিয়েছে।”
কিছুটা মুখ ফুলিয়ে বলে নীরা।
দ্বীপ নীরার ফোলানো মুখে চুমু দিয়ে বলে,”ওলে লে আমার ছোট পাগলী বউ এখন মা হবে।আমার এই বাচ্চা বউ বাচ্চা দিতে যেয়ে ঘুম কামাই করতে চায়।”

নীরা দ্বীপের দিকে ফিরে বলে,”আপনার বউ বাচ্চা না,ক্যাডার সাহেব।বাচ্চা হলে কি আর বাবু এনে দিতে পারতাম?”

“হ্যাঁ,তাইতো।শুধু আমাদের এই এজ ডিফারেন্ট টাই বেশি।”

“অতটাও বেশি না।আমার ক্যাডার সাহেব তো হ্যান্ডসাম পুরুষ।আমার বর আমার কাছে শ্রেষ্ঠ সুন্দর।”

দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”চাঁদ মামাদের বিলায় বেলা এসেছে,সূর্যি মামাদের আগমন ঘটবে।এবার তো ঘুমোতে হবে।”
বলেই নীরার কথার অপেক্ষা না করে দ্বীপ নীরাকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়।নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”চোখ বন্ধ করো, চন্দ্রপাখি।বাবুর সাথে বাবুর মাকেও এখন রেস্ট নিতে হবে।”

নীরা চোখ বন্ধ করে।দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে থাকে।ঘরে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে রাখা আছে।দ্বীপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে তার চন্দ্রপাখিকে।ভাবতে থাকে দুষ্টু মিষ্টি পাগলী বউ কিভাবে আজ মা হওয়ার অনুভূতি পেলো সাথে তাকেও বাবা হওয়ার সুখ দিচ্ছে।দ্বীপের নিজের চোখেও ঘুম নেই।বাবা হওয়ার জন্য তার নিজের ভিতরও আলাদা খুশি কাজ করছে।কিন্তু নীরাকে বোঝানো যাবে না।রাত জেগে গল্প করতে থাকবে তাহলে।
_____
শুক্রবার দিন আজ।নীরার বাসার সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে মিস্টার সমুদ্র।দুপুরে সবাই একসাথে খাবেন।দীপান্বিতা মিসেস সাবিনা ও মিসেস শিউলি মিলে রান্না করছেন।নীরা মুখ ফুলিয়ে সোফায় বসে আছে।তাকে কেউ রান্না করতে দিচ্ছে না তাই।অভ্র খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলছে।নীরা কিছুক্ষণ পর সেদিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর পেটে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”এখানে যে আছে সেও এক সময় এভাবে খেলা করবে।তাড়াতাড়ি আয় চুনু মুনু।আমি যে তোর দুষ্টুমি দেখবো।একসাথে মিলে ক্যাডার সাহেবকে জ্বালাবো।আচ্ছা তোরা কি একজন নাকি দুইজন?দুইজন আসলে ভালো হবে।এক ডজন চুনু মুনু তাহলে আমি ছয় ছক্কায় আনতে পারবো।কিন্তু এক এক করে আসলে তো আবার বারো বছর ধরেই খালি ডেলিভারি করতে হবে।”

ছোট অভ্র খেলতে থাকে আর পিটপিট করে নীরার দিকে তাকাতে থাকে।নীরার কথার মানে বুঝছে না অভ্র। গাড়ি নিয়ে ঘোড়াতে থাকে আর নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি বলো মামী?”

“তোমার ভাই/বোনের সাথে কথা বলি।”
“কোথায় ওরা?”
“ওরা এখন আল্লাহর কাছে আছে।আসবে খুব শীঘ্রই।আমি হাওয়ায় হাওয়ায় কথা বলছি যেনো তোমার ভাই বোন শুনতে পায়।”
“ও”
বলে অভ্র।নীরা অভ্রকে বুঝাতে চায় না এসব বিষয়ে।ছোট মানুষ এসব না জানাই ভালো।
_____
মিসেস নাজনীন চলে এসেছেন আগেই।মিস্টার রবিন ও নীরব জুম্মার নামাজ পড়েই চলে আসবে দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্রর সাথে।বাড়ির মেয়েদের রান্না শেষ করে নামাজ পড়া শেষ।নীরা এখন দীপান্বিতাকে শাড়ি পড়াতে চায়।দীপান্বিতা নাকোজ করে।কিন্তু বাসার সবার কথায় রাজি হয়ে শাড়ি পরতে রাজি হয়।

নীরব দ্বীপ ও বাকি পুরুষ মানুষেরা চলে এসেছে।সবাই সোফায় বসতেই মিসেস নাজনীন ও মিসেস সাবিনা এসে বসলেন সেখানে।নীরা ও মিসেস শিউলি মিলে সাজাচ্ছে দীপান্বিতাকে।নীরবের প্রিয় রঙ বাদামি।অনেক আগেই নীরব দীপান্বিতার জন্য বাদামি রঙের একটি শাড়ি কিনেছিলো।সেই শাড়ি দিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে দীপান্বিতাকে।

বাড়ির পুরুষ মানুষরা বসে আছে প্রায় বিশ ত্রিশ মিনিট মতো।নীরব বুঝতে পারছে না জুম্মার পর অপেক্ষা কেনো।সবার তো খুদা লেগেছে।ভাবনার ভিতরেই অভ্রর চিল্লানো শুনতে পেলো নীরব।অভ্র হাত তালি দিয়ে বলে,”আম্মু এসেছে।”

নীরব ঘুরে তাকায় সেদিকে।দীপান্বিতার জন্য কিনে রাখা শাড়ি কিভাবে এখানে আসলো বুঝতে পারলো না নীরব।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে।নীরা হেসে বলে,”মা তোমার আলমারিতে দেখেছিলো শাড়িটি।আমরা তো জানি তোমার মনে আমার এই ননদের বসবাস।তাই শাড়ি যে কার হবে এটা বুঝতে পেরেছি।”

নীরব স্মিত হাসি দেয়।অভ্র নীরবের কোলে এসে বসে।দীপান্বিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নীরব ও তাকে নিয়ে বাসার সবাই জানে তাহলে।এবার কি হবে?বাবা কি বলবে? দ্বীপ কি রিয়েক্ট দিবে?ভেবে ভয় পাচ্ছে দীপান্বিতা।

দীপান্বিতাকে অবাক করে সবাই হেসে দেয়।মিস্টার সমুদ্র বলেন,”আমরা সবকিছুই শুনেছি মা।তোদের ভুল বুঝাবুঝি অনেকদূর এগিয়েছে।কিন্তু এত গ্যাপ রেখেও এই সম্পর্কে তোরা অন্য কোথাও মন দিতে পারিসনি।এটাই বড় প্রমাণ তোরা একে অপরকে কতটা ভালোবাসিস।নীরব ছেলে হিসেবে অনেক ভালো।দেখ মা মানুষ মাত্রই ভুল। আর দূর থেকে কাউকে বিচার করাও যায় না।তাই বলি যা হবার হয়ে গেছে ভুলে যা।তাছাড়া তুই নিজেই নীরব ছাড়া অন্য কারো কথা কল্পনায় আনতে পারবি না।এটা নীরা আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে।সব মিলিয়ে তোদের সুখের কথা ভেবেই আমি তোদের বিয়ে দিতে চাই।”

মিস্টার সমুদ্রের কথা শেষ হতেই মিসেস নাজনীন এসে দীপান্বিতাকে নিজের সাথে সোফায় বসান।বলেন,”আমার পুত্রবধূ হিসেবে তোমাকে খুব ভালোলাগে।তুমিও তো মনে হয় আমাকে শাশুড়ি হিসেবে পেলে অখুশি হবে না?”

দীপান্বিতা জড়িয়ে ধরেন মিসেস নাজনীনকে।মিসেস নাজনীন আবার বলেন,”আমার ছেলেটার সাথে সাথে তো তুমি নিজেকেও পোড়াতে শুরু করেছো।আমরা বাবা মা কি শুধু দর্শক হয়ে তোমাদের এই কষ্ট দেখবো?বাবা মা তো হয়েছি সন্তানদের সুখী জীবন গড়ে দেওয়ার জন্য।আমি তোমাদের সুখে দেখতে চাই মা।মাফ করে দে আমার ছেলেটাকে।দেখবি এরপর ভুল বুঝলে আমি ওর কান মোলা দিবো।শীতকালে খালি গায়ে বাড়ির বাইরে রেখে দিবো আর গরমকালে সোয়েটার পরিয়ে বাইরে গরমে দাড় করিয়ে রাখবো।”

দীপান্বিতা হেসে দেয়।নীরব নিজেকে এমন কল্পনা করে ভয় পেয়ে যায়।নীরা দীপান্বিতার কাছে এসে বলে,”তো আমার ননদজী।ননদ থেকে ভাবীতে ট্রান্সফার হতে রাজি তো?”

“হ্যাঁ আমার লিটিল ভাবী।এখন তুমিও আমার লিটিল ভাবী থেকে লিটিল ননদ হবে।”

চলবে…?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে