লুকোচুরি গল্প পর্ব-৩০+৩১

0
584

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩০
#ইশরাত_জাহান
🦋
কেয়াকে সাজানো শুরু করা হয়েছে।পার্লারের মেয়েরা এসে সাজিয়ে দিচ্ছে।সবাই নামাজ পড়ে সাজতে বসেছে।দ্বীপ নীরব অভ্রকে নিয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করতে গেছে।পুরুষ মানুষ সবাই সেখানে।রিক নিজেও জুম্মার সালাত আদায় করে কমিউনিটি সেন্টারে আসবে। রিককে ওয়েলকাম করার জন্য কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ফিতা বেধে রাখা হয়েছে।কেয়ার কোনো কাজিন নেই।কেয়ার বাবা একা ও কেয়ার মামা বিদেশে থাকেন পুরো পরিবার সহ।রিকের খালামণিরা এসেছে।কিন্তু তাদের সন্তানেরা ব্যাস্ত থাকেন তাই আসতে পারেনি।এই জন্য সবকিছু দ্বীপ ও নীরাদের করতে হয়।রিকের মায়ের সাথে নীরার মায়ের ভালো বন্ধুত্ব ছিলো এখন দ্বীপের মায়ের সাথেও হয়েছে।দ্বীপের পরিবার এক কথায় সরল সহজ এক পরিবার।সবাই বলেন মিস্টার সমুদ্র ইচ্ছা করে নিজে ঠকে যাবেন কিন্তু কোনো ঝামেলাতে জড়াবেন না।ঠিক তেমন হয়েছে দ্বীপ। কারো সাথে কোনো ঝগড়া ঝামেলা করে না বরং কারো বিপদে দুই হাত ভরে দিবে।বিশেষ করে তামান্নার বেলায় লোকজন দ্বীপদের বিষয়ে বেশি বেশি অবগত হয়েছেন।একদিকে যেমন সমাজ অভ্রর দিকে আঙুল তুলে ঠিক তেমন মা না হয়েও দীপান্বিতার মাতৃত্বের ভালোবাসার জন্য সেই সমাজ বাহবা দেয়।প্রথম প্রথম অনেকেই বলতেন,”দীপান্বিতা ঠিক করছে না।পরের সন্তানকে নিজের করে মানুষ করা ঠিক না। যার সন্তান তাকে দিয়ে দিলেই হয়।”

বাইরের লোক তো বলতো সাথে করে বলতো পিংকির মা।পিংকি নিজেও অভ্রকে ভালোবেসেছে।কিন্তু মিসেস সাদিয়া সবসময় অভ্রকে কথা শুনিয়ে দিতেন।এমনি সম্পত্তি ভাগাভাগি হবে তার উপর পরের ছেলে।তার ক্ষোভ ছিলো এখানে।কিন্তু এত হেয় কথার বিপরীতেও অভ্রকে ভালোবেসেছে দীপান্বিতা।মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস সাবিনা মিলে সাপোর্ট করেছেন দীপান্বিতাকে।মুখে দুই একবার বলেছিলো অভ্রকে আশ্রমে রাখতে।কিন্তু কোল থেকে ওই ছোট তুলতুলে নরম বাচ্চাকে সরাতেই পারছিলো না দীপান্বিতা।বারবার মনে হতে থাকে তামান্না দেখছে তার সন্তানের বেড়ে ওঠা।একজন মৃত মা তার সন্তানের সুখ হয়তো দুর থেকে দেখছে।দুর থেকে নাহয় এই সুখ দেখুক।দীপান্বিতা সবাইকে বলে,”অভ্র বড় হলে ওকে সোজা আমি বোর্ডিংয়ে ভর্তি করবো।তারপর গ্র্যাজুয়েশন করাতে বিদেশ পাঠাবো। যাতে ওর মনে এটা না আসে যে আমি ওকে আপন সন্তান ভাবি না। হ্যাঁ জীবনে চলতে গেলে নিজের সুখ দেখতে হবে তাই আমিও ওর চার বছর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।আমার ততদিনে গ্র্যাজুয়েশন হয়ে যাবে।আমার গ্র্যাজুয়েশন শেষে নাহয় তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করলে।”

বাসা থেকে সবাই মেনে নেয় দীপান্বিতার কথা।সবার প্রথমে সাপোর্ট করে দ্বীপ।তারপর দীপান্বিতার বাবা মা।প্রতিবেশী হয়ে নীরার বাবা মাও দীপান্বিতাকে অনেক সাপোর্ট করে।আশেপাশে থেকে মানুষ যখন অভ্রকে দেখে ক্ষিপ্ত হতে থাকে মিসেস নাজনীন তখন অভ্রকে কোলে নিয়ে পুরো এলাকা ঘোরাঘুরি করে। প্রায় প্রায় দীপান্বিতার কাছ থেকে অভ্রকে নিয়ে সকালের রোদ পোহাতে যায়।এদের সবার এই ভালোবাসা দেখে আস্তে আস্তে মুখ বন্ধ হয় সমাজের।নীরা ছোট হলেও চঞ্চল ছিলো খুব।নীরাকে সবাই একটু বেশি ভয় পেতো।মুখের উপর উচিত জবাব দেওয়া নীরার অভ্যাস।সবার এত এত সাপোর্ট ভালোবাসায় আজ অভ্র চোখের মণি। আর সমাজের কাছে দ্বীপের পরিবার সরল সহজ নামে পরিচিত।

___
জুম্মার নামাজ পড়ে সবাই চলে এসেছে। পাঞ্জাবী পরেই নামাজ পড়তে বের হয়েছিলো সবাই।তাই তাদের আর সাজগোজ করা লাগেনি।ছেলেরা সবাই বরকে নিয়ে এসে দেখে মেইন গেটের সামনে ফিতা দেওয়া।সবাই বুঝে যায় এটা বরের জন্য করা।কেয়াকে এখনও সাজানো হচ্ছে।কেয়ার পাশে দীপান্বিতা বসে সাজ দেখছে।নীরা ও কিছু প্রতিবেশী মেয়ে মিলে গেছে বরকে ওয়েলকাম করতে।

হাতে মিষ্টি ও শরবতের ট্রে নিয়ে নীরা বলে,”জামাইবাবু আগে আপনাকে ফিতা কাটতে হবে।”

রিকের বাবা বলেন,”তোমাদের কোনো ডিমান্ড নেই?”

“ওটা এখন না আংকেল।সময় হোক উশুল করবো।”

সবাই হেসে দেয়।রিক ফিতা কেটে দেয়।তারপর নীরা শরবতের গ্লাস নিয়ে রিকের সামনে ধরে।রিক শরবতে চুমুক দিতে যাবে তার আগে দ্বীপ গ্লাস কেরে নিয়ে রিকের সামনে ধরে।নীরা চোখ ছোট ছোট করে মনে মনে বলে,”জেলাস,ক্যাডার সাহেব।”

রিক দ্বীপের হাতেই গ্লাসে চুমুক দেয়।মিস্টার রবিন বলেন,”মেয়ে আমার সেরা জামাই পেয়েছে।কি সুন্দর করে গ্লাস নিয়ে বুঝিয়ে দিলো।”

মিস্টার সমুদ্র বলেন,”আপনি তো ট্রেইলার দেখেছেন আর আমি দেখি ফুল মুভি।”

সবাই অট্টহাসিতে মেতে ওঠে।নীরা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে পাশে থাকা মেয়েকে বলে,”জামাইবাবুকে মিষ্টি খাইয়ে দে।আমার উনি আবার জেলাস আছেন।বলা তো যায় না মিষ্টি খাওয়াতে গেলে আবার কোনো এক জায়গা থেকে পোড়া গন্ধ ভেসে আসে।”

বলেই মিষ্টির প্লেট দিয়ে দেয় পাশে থাকা মেয়েটির হাতে। রিককে মিষ্টি খাওয়ানোর পর ছেলেরা মিলে রিককে উচু করে নিয়ে যায় বরের আসনে।বাকিরা হাত তালি দিতে থাকে।নীরা চলে আসে কেয়ার কাছে।কেয়ার সাজানো কমপ্লিট।এখন শুধু গহনাগুলো পরিয়ে দেওয়া বাকি।একে একে সবাই মিলে কেয়ার গহনা দ্রুত পরিয়ে দেয়।সবার খুদা লেগেছে।বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলেই খাওয়া দাওয়ার পালা।কাজী এসেছেন বিয়ে পড়াতে সাথে একজন রেজিষ্টার।বিয়ে পড়ানো সম্পূর্ণ হলো।বর বউ দুজন দুই রুমে বসেই একে অপরকে কবুল বলে গ্রহণ করে নিলো।বড়রা সবাই খেতে বসেছে।নীরা দীপান্বিতা ও বাকি মেয়েরা বড় রক থালা নিয়ে এসেছে রিকের কাছে।রিকের পাশে বর সেজে বসে আছে ছোট অভ্র বাবু।দীপান্বিতাকে দেখে অভ্র হাত উচু করে বলে,”আম্মু আমি এখানে।”

দীপান্বিতা মিষ্টি হাসি দেয় অভ্রকে দেখে।নীরা বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের ছোট বর বাবুকে তো আমরা দেখেছি।”

নীরব তাকিয়ে আছে দীপান্বিতার দিকে। রানি গোলাপী ও সবুজের মিশ্রণে খুব সুন্দর শাড়ি পরেছে দীপান্বিতা।মাথায় গোলাপী হিজাব।মুখে কোনো প্রকার মেকআপ না দিয়ে শুধু একটু ক্রিম লাগানো আর চোখে চিকন কাজল ঠোঁটে গোলাপী লিপস্টিক।এই সাজেই দীপান্বিতার প্রতি নেশা ধরে গেছে নীরবের।নীরা নীরবের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে,”উহু উহু।”

নীরব তাকায় বোনের দিকে।নীরা বলে,”বেটার লাক নেক্সট টাইম ভাই।আপাতত বরকে খাওয়াও সবাই মিলে।আফসোস কেয়ার বিয়েটা আমার আগে হতো।আমিও মজা করতে পারতাম।”

দ্বীপের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে।দ্বীপ বলে,”খুব শখ হয়েছে না!পরের বরকে খাইয়ে দেওয়ার?”

নীরা নাক মুখ উচু করে অভিনয় করে বলে,”কোথা থেকে জানি পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে!”

অভ্র বলে,”কিছু পুড়েছে মামী?”

“হ্যাঁ বাবাই,তোমার মামুর মন।”

অভ্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্বীপকে দেখতে থাকে।কোথাও আগুন বা ধোয়া না দেখে বলে,”কোথায়?দেখতে পাচ্ছি না তো?”

“এটা দেখা যায় না বাবাই।আমি স্পেশাল মেজিক দিয়ে বুঝতেছি।”

সবাই আবার হেসে দেয়।অভ্র বেচারা হা করে তাকিয়ে আছে।তার মাথায় ঢুকছে না কোনো কিছুই।নীরব অভ্রর পাশে বসে বলে,”ওসব তোমাকে বুঝতে হবে না বাবাই।আসো আমরা একসাথে তোমার রিক আংকেলকে খাইয়ে দেই।”

“আচ্ছা।”

বলেই সবাই মিকে রিককে খাইয়ে দেয়।দ্বীপ নীরার হাত ধরে নিয়ে আসে এক কোনায়।নীরাকে দেওয়ালের সাথে আটকিয়ে বলে,”খুব শখ না বর বাদেঅন্য ছেলেকে খাইয়ে দেওয়ার?”

মিটমিট হেসে নীরা বলে,”হ্যাঁ,খুব শখ আমার।”

দ্বীপ নীরার হাত জোরে চেপে ধরে বলে,”নিজের বরকে তো খাইয়ে দেওয়ার ইচ্ছা জাগে না।”

“আউচ।লাগছে তো!”

“লিসেন দুষ্টুমি করো কিন্তু ওভার হলে…”

“কি?ওভার হলে কি করবেন?”

“এক সাথে যমজ না একসাথে এক ডজন বাবু এনে দিবো তোমার এই ছোট পেটে।”

নীরা যেনো এবার ভ্রমে চলে গেলো।কল্পনা করছে তার পেট ফুলে উঠেছে বারোটা বাবু তার এই পেটে।ডেলিভারির সময় যখন নার্স আসবে তার পেট কাটতে তখন ঘন্টাখানিক ধরে খালি বাবু বেড় হতেই থাকবে আর নীরা বেচারি বাবু গুলোকে বেড় হতে দেখবে।একসাথে বারোটা বাবু পুষবে কিভাবে?তাড়াতাড়ি নীরা কল্পনা থেকে বেড়িয়ে বলে,”বলছি কি একসাথে এতগুলো না দিয়ে বরং আস্তে আস্তে দুই একটা করে বাবু দিলে হয়না?”

দ্বীপ ঠোঁট কামড়ে হেসে দেয়।বউ তো না যেন কুবুদ্ধির ড্রাম।নীরার নাকের সাথে নিজের নাকের ঘষা দিয়ে বলে,”দুষ্টু চন্দ্রপাখি আমার।”
_____
রিকের খাওয়া দাওয়া শেষ।অন্যদিকে কেয়াকে ওর মা খাইয়ে দিয়েছে।এখন রিকের হাত ধোয়ানো হয়েছে। নীরব দ্বীপ ও বাকি ছেলেরা মিলে রিকের হাত ধুয়ে দিচ্ছে।তারপর রিক ও কেয়াকে একসাথে করে বড় স্টেজে বসিয়ে দেওয়া হলো।কেয়া মুখের উপর পাতলা ঘোমটা দেওয়া।নীরা একটি আয়না এনে কেয়া ও রিক বরাবর ধরে।তারপর বলে,”আয়নায় কি দেখছেন জামাইবাবু?”

রিক কেয়ার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার কিউট গুলুমুলু চশমিশ।”

“আরে বাহ।”

সবাই হেসে দেয়।নীরা বলে,”নেন আপনার চশমিশ বউয়ের ঘোমটা আপনি নিজেই সরিয়ে মুখোদর্ষণ করেন।”

রিক কেয়ার মুখ থেকে ঘোমটা সরায়।সাথে সাথে নীরব দীপান্বিতা অভ্র ও আরো ছেলে মেয়েরা মিলে লাল গোলাপের পাপড়ি ছিটাতে থাকে।রিক ও কেয়া দুজন দুজনকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে।নীরা দ্বীপ ও বড়রা মিলে হাত তালি দেয়।মিসেস শিউলি এসে মজা করে বলেন,”হুনো নাতিন,বউয়ের দিকে সারাজীবন চাইয়া থাইকো।এখন একটু আমাগো দেখতে দেও। আর আজ রাইতে তো বউ তোমার হইয়াই যাইবো।আমার নাতিনের মতো আবার দেরি করে বউরে ভালোবাইসো না।”

দ্বীপ ও নীরা লজ্জায় এদিক ওদিক করে।মিস্টার সমুদ্র বলেন,”আহ মা সবাই আছে তো।”

রিকের বাবা বলেন,”নানী দাদিদের কাজই তো এমন মজা করা।”

সবাই মিলে এখন নাচ গান শুরু করবে।সন্ধার দিকে বিদায় ব্যাবস্থা হবে।দীপান্বিতা ও অভ্র মিলে পাশাপাশি দাড়িয়ে আনন্দ করছে।অভ্রর শরবত খেতে ইচ্ছা করে।দীপান্বিতা অভ্রকে শরবত খাইয়ে দেয়।শরবতের গ্লাস অভ্রর হাত থেকে পড়ে দীপান্বিতার শাড়ির কিছু অংশ ভিজে যায়।দীপান্বিতা অভ্রকে দ্বীপের কাছে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়।শাড়ি ওয়াশ করার সময় দীপান্বিতা পাশে তাকিয়ে ভয় পেয়ে জোরে এক চিৎকার দেয়….

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩১
#ইশরাত_জাহান
🦋
চিৎকার দেওয়ার সাথে সাথে সেখানে হাজির হয় নীরব।নীরবকে দেখে দীপান্বিতা তাড়াতাড়ি নীরবের এক বাহু জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে।নীরব বলে,”কি হয়েছে?”
দীপান্বিতা উত্তর না দিয়ে আঙুল দিয়ে পাশে ইশারা করে দেখায়।নীরব তাকায় দীপান্বিতার আঙুল বরাবর স্থানে।ফ্লোরে জিনিসটি দেখে মুস্কি হাসি দেয় নীরব।বলে,”তেলাপোকা দেখে ভয় পাওয়ার কি আছে?”

“আপনি বুঝবেন এসবের?আমার খুব ভয় করে।প্লিজ সরান ওটা।”

“না সরাব না।”

“প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

“সরাতে পারি।আমার এক শর্ত আছে।”

“কি শর্ত?”

“বলো আমাকে বিয়ে করতে রাজি?”

“না।”

“তাহলে আমিও তেলাপোকা সরাব না।”

“প্লিজ!”

“রাজি হও আগে।তানাহলে কিন্তু আমি তোমার চুলে এই তেলাপোকা গুঁজে দিবো।”

“এই না না না।”

“তাহলে বলো আমাকে বিয়ে করবে।”

কান্না করতে করতে দীপান্বিতা বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ করবো।তোমাকেই বিয়ে করবো।”

নীরব শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,”অভ্র বাবাই চলে এসো।তোমার আম্মু রাজি,তাড়াতাড়ি ডাকো কাজী।”

খুশিতে খুশিতে অভ্র চলে আসে।নীরবের কথা শুনে দীপান্বিতা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়।অভ্র হাত তালি দিয়ে বলে,”আমার হ্যাপি ফ্যামিলি হবে।কি মজা কি মজা।”

নীরব হাসতে হাসতে বলে,”আগে তোমার আম্মুর ভয় তো কমাও।”

বলেই ইশারা করে তেলাপোকার দিকে।অভ্র দেওয়ালের কাছে গিয়ে তেলাপোকাকে হাতে নেয়।দীপান্বিতা নাক মুখ কুঁচকে বলে,”ছিঃ।এগুলো হাতে নেও কেনো,বাবাই?ফেলে দেও।”

নীরব ও অভ্র হেসে বলে,”এটা হলো তোমার বিয়েতে রাজি করানোর ঔষধ।এটা আসল নয় নকল তেলাপোকা।”

দীপান্বিতা অবাক হয়ে তাকায় অভ্রের হাতের দিকে।অভ্র বলে,”আমার আব্বু(নীরবের দিকে তাকিয়ে বলে) বলেছে তুমি রাগ করলে তেলাপোকার ভয় দেখালে রাগ ভাঙবে। আর তোমাকে একা একা এখানে পাঠাতে।তাই আমি তোমার গায়ে শরবত ঢেলে দিয়েছি।”

দীপান্বিতা অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে নীরব ও অভ্রর দিকে।অভ্র ভয় পেয়ে বলে,”আমি না আব্বু বলেছে এগুলো।তুমি নাকি আব্বুর উপর রেগে ছিলে তাই।”

“কিসের আব্বু?”

নীরব বলে,”আমি অভ্রকে প্রস্তাব দিয়েছি।আমাকে ওর আব্বু বানাবে কি না।অভ্র রাজি।”

“অভ্রর আম্মু রাজি না।”

“এই,এই মাত্রই তো রাজি হলে।দেখেছো অভ্র!তোমার আম্মু কি মিথ্যুক?”

“মিথ্যা বলতে নেই আম্মু। দাতে পোকা হয়।”

“তার জন্য বড় বড় দাতের ডাক্তার আছে।তোমাকে পাকনামি করতে হবে না,চলো।”

বলেই দীপান্বিতা অভ্রর হাত ধরে নিয়ে যায়।পিছন থেকে নীরব গলা উচিয়ে বলে,”মানতে তো তোমাকে হবেই মায়াবন বিহারিনী।”

বলেই নিজের হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো ব্রাশ করতে থাকে নীরব।দীপান্বিতা অভ্রকে নিয়ে হাঁটতে থাকে আর আনমনে হাসতে থাকে।

___
কেয়ার বিদায়ের সময় এখন।মা বাবাকে জড়িয়ে কান্না করতে থাকে কেয়া।নীরা এসে কেয়াকে বলে,”এমন ভাবে মেকআপ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।আরে ভাই বিয়ে হয়েছে মানে তো এই না যে তুই দূরে চলে গেছিস।এই তো কয়েক বাড়ি পিছনে তোদের বাসা।”

সবাই হেসে দেয়।কেয়া নিজেও হেসে ফেলে নীরার কথায়।অতঃপর ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে বসে কেয়া ও রিক। আস্তে আস্তে কমিউনিটি সেন্টার ফাঁকা হতে থাকে।কেয়া গাড়ির জানালা থেকে উকি দিয়ে দেখছে তার বাবা মাকে।এই কমিউনিটি সেন্টারের প্রত্যেক কোনায় কোনায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে কেয়া।রিক কেয়ার মাথায় আলতো হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,”এভাবে তাকিয়ে থেকো না চশমিশ।অসুস্থ হয়ে যাবে তুমি।”

“আমাদের মিলনটা এই সেন্টার থেকেই হলো তাই না,সাদা বিলাই?”

“হ্যাঁ। আর এখানেই প্রতি নিয়ত আরো লোকজন এসে আমাদের স্মৃতিগুলোকে সরিয়ে দিবে।”

“স্মৃতিরা চোখের পাতায় থেকে যায়।কিন্তু মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায়।”

“এক মুহুর্ত পেরিয়েই তো আমরা আরেক মুহূর্তে যেতে পারবো।”

বলেই কেয়ার মাথা নিজের কাধে রাখে রিক।বলে,”যতগুলো মুহূর্ত আমাদের গড়ে উঠবে সবকিছু মধুর মুহূর্ত হবে,চশমিশ।”

স্মিত হাসে কেয়া।রিক নিজেও ম্লান হাসি দিতে থাকে।

____
দ্বীপ নীরা ও তাদের পরিবার এক গাড়িতে করে আসে।মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন রিকের বাবা মায়ের সাথে আগেই বেড়িয়েছেন।নীরব ও দীপান্বিতা অভ্রকে নিয়ে ঘুরতে থাকে।অভ্রর কাছে ভালো লাগে বাইকে নীরবের সাথে ঘুরতে।সবার অনুমতি পেয়ে দীপান্বিতা নিজেও রাজি হয় বাইকে ওঠার।অবশ্য দীপান্বিতার মন তো এটাই চেয়েছিলো।

বরের গাড়ি এসে পৌঁছেছে বাসার সামনে।রিকের মা মিষ্টি ও পানি নিয়ে বৌমাকে খাইয়ে দিলেন।সব নিয়ম কানুন পালন করে কেয়াকে বাড়ির ভিতরে এনে নরমাল শাড়ি পরানো হলো।রাত অনেক হয়েছে।দীপান্বিতা ও নীরব অনেক আগেই এসেছে।রিকের ঘর সাজানো হয়েছিলো সকালেই।এখন শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে নীরা ও দীপান্বিতা।কেয়াকে নিয়ে ঘরে সজ্জিত খাটের উপর বসিয়ে দিলো নীরা।সাথে ছিলেন মিসেস শিউলি। দাদী হলেও রসিক মানুষ তিনি।নীরার জন্য বেশি সুবিধা। দাদী সবকিছু কেয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।কেয়া মাথা নিচু করে চুপ করে আছে।নীরা এবার বলেই ফেলে,”তুই এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন?”

কেয়া চশমা পরনে চোখ উচু করে তাকায় নীরার দিকে।কিন্তু কেয়াকে কিছু বলতে না দিয়েই নীরা বলে,”এমন ভাব করছিস যেনো তুই কিছু বুঝিস না।এদিকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অহরহ সিনেমা দেখেছিলাম যার বেশিরভাগ ছিলো ব্লু ফিল্ম।এখন ঢং করছিস যেনো কিছুই বুঝিস না।একদম লজ্জাবতী লাজুকতা।সেই রিকের প্রেম প্রস্তাব দেওয়া থেকে দেখছি এমন নেকু নেকু ভাব করছিস।আমি বিরক্ত এবার তোর হাবভাবে।”

দীপান্বিতা কেয়ার কাছে এসে বলে,”মেয়েটাকে লজ্জায় আর ফেলো না লিটিল ভাবী।”

“তোমার কি মনে হয় আপু?আমার বান্ধবী হয়ে ও কাচা।যেখানে আমি হলাম ক্যাডার সাহেবের ইচড়ে পাকা সেখানে এই চশমিশ হলো তার সাদা বিলাই এর ইচড়ে পাকা।

চোখের চশমা ঠিক করে বলে,”আমি ইচড়ে পাকা?তোর মতো চুমুখোর না।বিয়ের পর বরের ভালোবাসা পেতে ব্লাকমেইল করিস।”

“দেখেছো দাদীন।এই হলো আমার শাকচুন্নি বান্ধবী।আসল রূপ নিয়ে আসতে পেরেছি আমি।কিন্তু আফসোস তুই আমার বিপরীতে হতে পারলি না।আমি যেমন কথা পেটে চাপায় রাখতে পারিনা তোকে বলে দেই।তুইও তেমন নিজের বাসর ঘরে আমার বাসরের গল্প আমার দাদী শাশুড়ির সামনে বলছিস।”

কিসের লজ্জা কিসের বাসর?কেয়া এবার তেতে উঠলো নীরার কথায়। সাথে সাথে খাট থেকে নেমে সুন্দর করে সাজিয়ে পরানো শাড়ি গুজে নিলো নিজের কোমরে।বলে,”তোর বাসর আমার বাসর হবে পরে আগে তোর ব্যাবস্থা করছি দ্বারা তুই।”

বলেই আশেপাশে তাকাতে থাকে কেয়া।খুঁজে খুঁজে রিকের একটি ব্যাট পায় ঘরের এক কোনায়।কেয়াকে ব্যাট নিতে দেখেই নীরা লাফিয়ে উঠে বলে,”হয়ে গেলো রে!শাকচুন্নি আজ বাসর না করে আমাকে ধাওয়া করবে।”

“তুই শাকচুন্নি,তুই পেত্নী তুই দ্বারা।আজ তুই শেষ।”

বলেই কেয়া তাড়া করতে থাকে নীরার পিছনে।কোমরে শাড়ি গুঁজে হাতে ব্যাট উচু করে নীরার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,”দ্বারা পেত্নী তুই।তোর হেস্তনেস্ত করেই আমি তারপর বাসর করব।”

“বাসরে বান্ধবী মারতে নেই রে,বাসরে বিড়াল মারবি।অবশ্য আমার ক্যাডার সাহেব বাসরের বিড়াল না মেরে আসল বিড়াল মেরেছিলো।তুই তোর সাদা বিলাইকে মারবি।”

“আমার সাদা বিলাই আমার জামাই।আমি তাকে ব্যাট দিয়ে মারবো না মারবো ভালোবাসা দিয়ে।তোকে মারবো তার আগে।”

এদিকে ওরা চিল্লাতে চিল্লাতে ড্রয়িং রুমে চলে এসেছে।দীপান্বিতা ও মিসেস শিউলি আহাম্বক হয়ে ছিলেন।রিকের বাবা মা নীরার বাবা মা দ্বীপ ও নীরব রিককে নিয়ে বসে ছিলো ড্রয়িং রুমে। রিককে দ্বীপ ও নীরব মিলে ঘরে নিয়ে যাবে তার আগেই নীরার পিছনে কেয়াকে এভাবে দৌড়াতে দেখে সবাই অবাক।বাসর ঘরে বউ লজ্জা না পেয়ে বান্ধবীকে তাড়া করে।এবার বাসরের রেকর্ড ভেঙেই ফেললো এই দুই বান্ধবী।সবাই তাকিয়ে মিনিট দুই তিন দেখতে থাকে।কে কাকে সামলাবে বুঝতে পারছে না।কেয়াকে লোকজনের মাঝে রিক ধরে আটকাতে লজ্জা পাচ্ছে। দ্বীপ এমনিতেও বউ লাগল উপাধি পেয়ে বসে আছে।বাকি রইলো নীরব,সে জার্মানে থাকতে কোনো মেয়ে ধরলো না তার অন্য কাউকে!অতঃপর রিকের না নীরাকে ও নীরার মা কেয়াকে ধরে আটকায়।

মিসেস নাজনীন কেয়াকে ধরে বলেন,”এভাবে বাচ্চাদের মতো করছো কেন?কি হয়েছে?”

কেয়া ব্যাট নিয়ে এখনও ছোটাছুটি করছে আর বলে,”তোমার মেয়ে বলছে আমি নাকি ওর মতো নির্লজ্জ।আমি কি ওর মতো চু…”

বাকি কথা না বলে চুপ যায় কেয়া।শশুর শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে হুশ ফিরে কেয়ার।চশমা হালকা নাকের দিকে ঝুঁকে গেছে।মিসেস নাজনীন স্বাভাবিক দেখে কেয়াকে এবার ছেড়ে দিলেন।কেয়া চশমা ঠিক করে বলে,”তেমন কিছুই হয়নি।”

মিসেস শিউলি বলেন,”নাতবৌ আমার ভুল কিছু কয় নাই।তুমি আসলেই লজ্জাবতী নও।আমি তো ভাবছিলাম রিক নাতিন তোমার হাত ধরতে গেলেই তুমি নেতিয়ে যাবে।কিন্তু এখন দেখি বাসরের রেকর্ড ভাঙো।”

কেয়া বারবার রিকের বাবা মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আর লজ্জায় ফ্লোরে তাকিয়ে আছে।কেয়ার কোমরে এখনও শাড়ি গোজা আছে।নীরা হাফাতে থাকে।দীপান্বিতা এক গ্লাস পানি দেয়।পানি পান করে নীরা বলে,”নিজের রক্তকেও এত গভীর ভাবে চিনি না যতটা নিজের বেস্টুকে চিনি।গ্যারান্টি দিয়ে বলে দিচ্ছি ওর ভিতর লজ্জার ছিটে ফোঁটা নেই।”

মিসেস নাজনীন ও বাকিরা সবাই বুঝে গেলো কি বিষয়ে এত লাফালাফি।নীরা খেপিয়েছে কেয়াকে। আর কেয়া লজ্জার উপর লজ্জা পেয়ে তেতে উঠেছে।মিসেস নাজনীন নীরাকে চোখ গরম দিয়ে বলেন,”এগুলো কি নীরা?আজ ওদের বিয়ে হয়েছে।লজ্জা পাওয়া তো স্বাভাবিক।”

“হ্যাঁ তাইতো।এত লজ্জা পেয়েছিলো যে আমার সামান্য কথায় লজ্জা নিবারণ হয়ে গেলো। দেখছো না আমাকে কিভাবে ধাওয়া করছে?”

এবার রিকের মা বাবা হেসে দেন।মিসেস শিউলি বলেন,”হইছে।এবার আসো দিদিভাই।রিক নাতিন আমার কষ্ট পায়।কোমরের আচল এখন মাথায় দেও।যদিও তোমার লজ্জা মিশ্রিত মুখ না দেখে নাতিন আমার দেখলো বউয়ের অগ্নিধারণ রূপ।ভয়টয় পাইলো কি না কে জানে?”

নীরা এবার অট্টহাসি দিতে থাকে।তারপর কেয়ার কাছে এসে কেয়াকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বলে,”বাসরে বর লজ্জা নিবারণ না করে বান্ধবী লজ্জা নিবারণ করে দিলো। হ্যাপি মেরেড লাইফ দোস্ত।”

কেয়া নীরার পিঠে আলতো নরম বারি দেয়।তারপর দুজনে একসাথে হেসে ওঠে।সবাই মিলে খুশি হয়।কেয়া ও রিককে এবার একসাথে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়।তারপর নীরা দ্বীপ দীপান্বিতা ও মিসেস শিউলি সবাইকে বিদায় দিয়ে নিজের বাসায় চলে আসে।

চলবে…?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে