লুকোচুরি গল্প পর্ব-২০+২১

0
584

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২০
#ইশরাত_জাহান
🦋
রাতের খাবার খেয়ে পিংকি ঘরে এসে বসেছে।ঠিক তখনই মিস্টার সমুদ্র আসেন পিংকির ঘরে।পিংকি মিস্টার সমুদ্রকে দেখে বলেন,”কিছু বলবে মামা?”

“হ্যা,তোমার সাথে কিছু কথা বলার দরকার আমার।”

“আচ্ছা,বলো।”

মিস্টার সমুদ্র পিংকির পড়ার টেবিলের সামনে যান।তারপর চেয়ার টেনে বসেন সেখানে।পিংকির দিকে তাকিয়ে বলেন,”জীবনের আসল সফলতা কোথায় জানোতো?”

পিংকি কিছু না বলে মিস্টার সমুদ্রর দিকে তাকায়।এমন কথার মানে কি?মিস্টার সমুদ্র পিংকিকে আবার বলেন,”জীবনের আসল সফলতা কারো জীবনে ভালোবাসার স্থান গড়ে নেওয়া।এত বিদ্যা শিখে কি লাভ যদি তুমি কোনো সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে যাও?”

পিংকি মাথা নিচু করে ফ্লোরে তাকায়।মিস্টার সমুদ্র হালকা হাসেন।পিংকি মিসেস সাদিয়ার মত হলেও পিংকির মনে এই পরিবারের প্রতি ভালোবাসা আছে।এটা মিস্টার সমুদ্র জানেন।তিনি আবার বলেন,”তোমাকে আমি আমার দ্বীপ ও দীপান্বিতার থেকে কম দেখি না। জানো তুমি যখন হয়েছিলে তোমার নাম আমি রেখেছিলাম দীপা।আমার ছোট মেয়ে হবে দীপা।কিন্তু তোমার মা আমাকে রাখতে দেয় না এই নাম।তোমাকে কখনও সৎ বোনের মেয়ের চোখে দেখিনি।যদি তাই হতো তাহলে তুমি আজ এই বাড়িতে থাকতে পারতে না।আশেপাশের লোক যখন জিজ্ঞাসা করতো এই মেয়েটি কে?আমি বলতাম ও আমার জীবনের তৃতীয় এক অংশ,আমার সন্তান।ঢাকা শহরে এত এত হোস্টেল থাকতেও তোমাকে এখানে রাখা কারণ তুমি আমাদের আরেক নয়নের মণি।তুমি দ্বীপকে ভালোবাসতেই পারো।ভালোবাসা কারোর হাতের তালা চাবি না যে কাউকে ভালোবাসতে পারবে না।কিন্তু ভালোবাসলেই তাকে পেতে অন্যায় করবে এটা কিন্তু সবথেকে খারাপ একটা দিক।দ্বীপ তোমাকে কখনও ভালোবাসার চোখে দেখেনি।আমার ছেলেটার যোগ্যতা দিয়ে সরকারি স্কুল কলেজ পড়াশোনা করে আজ ক্যাডার হয়েছে।আমার কাছে কখনও কিছু আবদার করেনি।সেদিন তোমাদের মা মেয়ের কথাগুলো শুনে আমি দেখেছিলাম দ্বীপের চোখের ভীত ভাব।কাউকে হারানোর আতঙ্ক ছিলো।সত্যি বলতে সাদিয়া আমাকে তোমার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলে হয়তো রাজি হতাম বোনের খাতিরে।কিন্তু আমার ছেলেটার ভালোবাসা ব্যতীত কি শুধু ওই সম্পত্তিতে তুমি সুখী থাকবে?”

পিংকির চোখে পানি।মিস্টার সমুদ্র সব জানেন।শুধু মিস্টার সমুদ্র না দ্বীপ এই বাড়ির সবাই সবকিছু জানেন।কিন্তু তারপরও পিংকিকে এই বাড়িতেই রেখেছে।কতটা ভালোবাসে সবাই তাকে।মিস্টার সমুদ্র পিংকির চোখের পানি মুছে বলেন,”তোমাকে আমি শাসন করিনা একটাই কারণে তোমার উপর মেয়ের অধিকারে শাসন করলে তোমার মা এটা বুঝবেন না।আমি ছোটবেলা থেকে দ্বীপকে অনেক কাজেই বকা দিয়েছি।দীপান্বিতাকে থাপ্পড় দিয়েছি।কিন্তু কেউ এসে একটা প্রতিবাদ করেনি।কিন্তু তোমাকে তোমার ভালোর জন্য কিছু বললে কথা উঠবে আমি এই কাজ করার কে?আমি ঘরের কাজে আজ পর্যন্ত কথা বলিনি।এই জন্য তোমার মা যত পেরেছে সাবিনাকে খাটিয়েছে।আমি ইনকাম করে টাকা পাঠাতাম কিন্তু সাবিনা দ্বীপ দীপান্বিতা আমার মা এরা যতটা তার ভাগ পেয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ ভাগ পেয়েছে তোমার মা।সাবিনা মানুষটি ছিলো নরম মনের।আমাকে খুব ভয় পেতো।কিন্তু আমি কখনও ওকে বকা দিতাম না বা মারতাম না।বিয়ের পর প্রথম আমি সাবিনাকে বলেছিলাম আমার বাবার দেওয়া আমানত সাদিয়া।সাদিয়াকে দেখাশোনা করা আমাদের দায়িত্ব।বাবা মারা যাওয়ার আগে হাফাতে হাফাতে বারবার বলেছেন,’ আমি তোমার মায়ের সাথে পাপ করেছি।যেদিন আমি সাদিয়ার মাকে বিয়ে করে আসি তারপর থেকে তোমার মা আমার সাথে আর একটিও কথা বলেনি।আমি এখন বুজেছি আমি অন্যায় করেছি।মাফ করে দিও আমাকে তোমরা।হয়ত আর বাঁচবো না।শরীরের ভিতর জ্বালাতন করছে খুব।আমার সাদিয়াকে কখনও সৎ বোনের চোখে দেখবে ন।ওর মা নেই আমিও হয়তো থাকবো না।আমার শরীরের অবস্থা ভালো না।তুমি ওকে ভালোবেসে আগলে রেখো।’
বলেই বাবা ওখানে আমার হাত ধরেই শেষ নিশ্বাস নেন।মৃত বাবাকে আমি বলতে পারিনি আমি ওকে ভালোবাসতে পারবো না।তবে আমি ওকে আপন বোনের মতোই দেখবো।সাদিয়াকে পড়াশোনা করাতে চেয়েছি কিন্তু ও পালিয়ে বিয়ে করে তোমার বাবাকে।তোমার বাবা এখন যতটা ভালো তখন এমন ছিলেন না।তখন ছিলেন বখাটে।তারপরও আমরা মেনে নিয়েছি।সাদিয়াকে আমি যা যা দিয়েছি তার এক কানাকড়ি আমি সাবিনাকে দেইনি।শুধু এই যে বাড়িটি দেখছো এটা আমি আমার সাবিনার নামে অর্ধেক লিখেছি আর অর্ধেক অংশ দ্বীপ ও দীপান্বিতার নামে। আর গ্রামের বাড়িটি সম্পূর্ণ তোমার আর সাদিয়ার নামে।”

বলেই গ্রামের বাড়ির কাগজ জেকেটের ভিতরের পকেট থেকে বের করে পিংকির হাতে দিলো।পিংকির বিবেকে নাড়া দিলো।হাত বাড়িয়ে নিতে পারলো না কাগজটি।এই জমিতে তার মায়ের থেকে তার মামার হক বেশি।কিন্তু তারপরও পুরো বাড়িটি মামা তার আর মায়ের নামে করে দিয়েছে।এতদিন তার মা কি না সম্পত্তির জন্যই তাকে এখানে রেখেছিলো।কিন্তু পিংকি জানে সে তো শুধু দ্বীপের জন্য ছিলো এখানে।

মিস্টার সমুদ্র বের হতে যেয়েও দরজায় দাড়িয়ে বলেন,”সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি আসলে তারা কখনও সুখে থাকে না। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।এটা শুধু একটি প্রবাদ বাক্য নয় এটি একটি বাস্তব জীবনী। আশা করি আজ থেকে তুমি আমাদের নীরাকে দ্বীপের সাথে সুখে থাকতে দিবে।”

বলেই চলে যান মিস্টার সমুদ্র।পিংকি হাউমাউ করে কান্না করে দেয়।আজ তার খুব কষ্ট লাগছে।তার মা এতদিন কত খারাপ কথা বলতো এদেরকে নিয়ে।অথচ তারা কখনও এমন কিছুই করেনি।

অপরদিকে,
ডিনার করে দ্বীপ ও নীরা ঘরে চলে আসে।নীরা একটু মাথা আচড়াবে তাই আয়নার সামনে যায়।দ্বীপ তাকিয়ে আছে নীরার দিকে।নীরা মাথা আচড়াতে আচড়াতে আয়নায় দেখতে পেলো দ্বীপ তার দিকে তাকিয়ে আছে।নীরা দ্বীপের দিকে ঘুরে বাম ভ্রু উচু করে বলে,”কি হয়েছে?”

দ্বীপ নীরার কাছে এসে বলে,”আমি টিউব লাইট?”

নীরা হালকা হাসে।সন্ধায় হওয়া কথাটি এখনও মাথায় রেখেছে দ্বীপ।নীরা বলে,”ওটাতো রাগ করে বলছিলাম।”

“দুই দুইবার শুনেছি আমি তোমার মুখে যে আমি টিউব লাইট।তাহলে চলো আজ দেখিয়ে দেই আমি টিউব লাইট কি না,বউ।”

যেই নীরা এতদিন দ্বীপকে খেপাতো আজ সেই নীরা ঘাবড়ে যাচ্ছে।তোতলাতে তোতলাতে বলে,”আ আসলে ক কাল পরীক্ষা।এখন ত তো আমাদেরকে …”

কিছু বলার আগে চশমার ভীতর দিয়ে নীরার দিকে তাকিয়ে দ্বীপ বলে,”এক ডজন বাবু আনার প্রসেসটা আজ পরিপূর্ন করে ফেলি,কি বলো?আচ্ছা তোমার এতটুকু একটা জায়গায় বারোটি বাবু ঢুকলে কেমন লাগবে?”

সাথে সাথে নীরার হাত যায় তার পেটে।কল্পনা করতে থাকে এই পেটে বারোটি বাবু ঢুকলে তো পেট ফুলে ফেটে যাবে।দ্বীপ স্মিত হেসে বলে,”আমার কাছে ভালো উপায় আছে।প্রত্যেক বছরে আমরা যমজ বাবু নিবো। এতে করে ছয় বছরে বারোটি বাবু হয়ে যাবে।”

খুক খুক করে কেশে ওঠে নীরা।ছয় বছরে যদি পেট বড় হয় আর পেট কাটতে হয় তাহলে বাঁচবে আদৌ!তার উপর আবার একেক বছরে দুইটা করে বাচ্চা।ভাবতেই নীরার মাথা ঘুরছে।দ্বীপ ঘরে ঘরম পানির জন্য ফ্লাক্স রেখে দেয়।সেখান থেকে কুসুম গরম পানি গ্লাসে ঢেলে নীরাকে দেয়।নীরা পানি নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটাই গিলে ফেলে।

দ্বীপ গায়ে থাকা নরম চাদরটি দুই হাতে নিয়ে চিকন আকারে করে।তারপর নীরার পিছনে নিয়ে নীরার কোমড়ে চাদরটি দিয়ে হালকা টান দেয় নীরাকে।নীরা হালকা নড়াচড়া করে।দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হলো বউ?এক ডজন বাবু চাই না তোমার!এত নড়াচড়া করলে হবে?”

নীরা এবার জোরে এক নিঃশ্বাস নিয়ে গড়গড় করে বলে,”ভালো রেজাল্ট করতে হবে তো।এখন পড়তে বসবো।”

দ্বীপ ছেড়ে দেয় নীরার কোমড় থেকে চাদরটি।বলে,”রাত অনেক হয়ে গেছে।এখন ঘুমাও আমি ভোরের দিকে এলার্ম দিয়ে দিচ্ছি।তখন আবার রিভিশন দেওয়া যাবে।”

দ্বীপের বলতে দেরি নীরার খাটে যেয়ে শুয়ে পড়তে দেরি হয়নি।দ্বীপ লাইট অফ করে এসে নীরার থেকে দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়ে।শুতে শুতে দ্বীপ নীরাকে বলে,”চিন্তা করো না বউ।তোমাকে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে দেওয়ার দায়িত্ব যেমন আমার,তোমাকে এক ডজন বাবু এনে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”

নীরা চোখ বন্ধ করে মিটমিট হাসতে থাকে।

সকালে,
নীরা তার রেজিস্ট্রেশন কাগজ ও প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে নিজেকে রেডি করছে।দ্বীপ নীরাকে একটি বোরকা কিনে দিয়েছে।নীরা এখন সেই বোরকা পরেছে।আজ প্রথম বোরকা পরলো।কেমন জানি লাগছে নীরার কাছে।তারপরও তার ক্যাডার সাহেব দিয়েছে তাই এক আলাদা ভালো লাগা কাজ করছে।কেয়া এসেছে নীরার কাছে।নীরা বলেছে আসতে।সবাই একসাথে যাবে।মিস্টার রবিন,মিসেস নাজনীন ও নীরব এসেছে নীরার সাথে দেখা করতে।মিস্টার সমুদ্রও আজ অফিসে যায়নি।দ্বীপ বারবার নীরাকে এক কথাই বলে,”এটা কিন্তু তোমার টেস্ট পরীক্ষা না।তাই এবার সম্পূর্ণ সময় বসে থেকে পরীক্ষা দিবে।মাথা ঠাণ্ডা রাখবে।তোমার জন্য আমি পানি দিয়েছি।গলা শুকিয়ে আসলে পানি খাবে।”

নীরা এবার বলে ওঠে,”আপনি আমাকে সেই সকাল থেকে এই এক কথা কেনো বলছেন?”

“আগেরবার টেস্টে তো হাফ এক্সাম দিয়ে বেড় হয়েছিলে।তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।”

“আপনি কিন্তু আমাকে এক্সামে যাওয়ার আগে অপমান করছেন।”

সবাই হেসে দেয় এদের কথায়।মিস্টার রবিন ও মিসেস নাজনীন মিলে নীরাকে কিছুক্ষণ আদর করেন।তারপর গাড়ির কাছে চলে আসেন সবাই।দ্বীপ ও নীরা ফ্রন্ট সিটে বসেছে।রিক ও কেয়া ব্যাক সিটে বসেছে।দ্বীপ নীরাকে নিয়ে চিন্তায় আছে।যদিও বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজ দায়িত্বে দ্বীপ নীরাকে পড়িয়েছে।কিন্তু এই মেয়ের তো ঠিক ঠিকানা নেই।পড়ার ভিতর গানের কথা ভাবে।পরীক্ষার হলে কি করবে কে জানে?

সবাই যে যার মত ঘরে এসেছে।দীপান্বিতা অভ্রকে নিয়ে হাঁটছে।নীরব বাসায় যেতে নিবে দেখে দীপান্বিতা ও অভ্র একসাথে দাড়িয়ে আছে।দীপান্বিতা তাকিয়ে আছে নীরবের দিকে।নিরব কিছু একটা ভেবে দীপান্বিতার কাছে এসে বলে,

চলবে…?

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২১
#ইশরাত_জাহান
🦋
“এগুলো আপনার ছেলের জন্য।”

বলেই কিছু চকলেট অভ্রর হাতে দিয়ে চলে যায়।যাওয়ার সময় নীরব এক পলক তাকায় দীপান্বিতার দিকে।কিন্তু কোনো কথা বলে না। দীপান্বিতাও আজ চুপচাপ।

দ্বীপ নীরাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে আসে।নীরা ও কেয়া নিজেদের মতো করে সিট খুঁজতে চলে যায়।দ্বীপের নিজস্ব কলেজেও আজ গার্ড দিতে হবে।তাই দ্বীপ চলে যায়।যাওয়ার আগে নীরাকে বলে,”আমি না আসা অব্দি দাড়িয়ে থাকবে।একটু দেরি হবে কিন্তু তুমি কোথাও যাবে না।”

নীরা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝায়।রিক কেয়াকে ‘বেস্ট অফ লাক’ বলে দ্বীপের সাথে চলে যায়।

পরীক্ষা শুরু হয়েছে।একদিকে নীরা পরীক্ষা দিচ্ছে তো অন্যদিকে দ্বীপ অন্য পরীক্ষার্থীদের গার্ড দিচ্ছে।পরীক্ষায় গার্ড দিলেও দ্বীপ শুধু নীরাকে নিয়ে ভাবছে।নীরা ঠিকভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে কি না!কোনো সমস্যা হলো কি না এগুলো ভাবতে থাকে দ্বীপ।

দুপুরে,
নীরার পরীক্ষার সময় শেষ।খাতা জমা দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেয়ার সাথে। কেয়াও দাড়িয়ে আছে রিকের জন্য।দ্বীপ ছাত্রছাত্রীদের খাতা জমা নিয়ে ওগুলো ভালোভাবে মিলিয়ে তারপর গেলো নীরার কাছে।রিক চলে এসেছে বাইক নিয়ে।এখন কেয়া ও রিক বাইকে করে যাবে আর নীরা ও দ্বীপ তাদের গাড়িতে করে যাবে।

গাড়িতে ওঠার পর দ্বীপ বলে,”পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”

“খুব খুব খুব সহজ প্রশ্ন এসেছে।কিন্তু জানি না সঠিক লিখেছি নাকি ভুল।”

“কেনো?তুমি কি লিখেছো তুমি নিজেও জানো না!”

“অতগুলো চেপটার মাথায় রাখাটাও তো লাগবে।তিন ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়েছি।লেখার তালেই ছিলাম।যেমন করছে হাত ব্যাথা তেমন করছে মাথা ভনভন।”

“খুদা লেগেছে খুব?”

নীরা মাথা উচু নিচু করে হ্যা বুঝিয়ে দিলো।দ্বীপ এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে দেয়।তারপর নীরাকে বলে,”চলো তোমার প্রিয় ফুসকা খাওয়া যাক।”

নীরা খুশি হয়ে নেমে যায়।গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দেয় ফুসকার দোকানে।দ্বীপ কিছু বলে ওঠার আগেই নীরা বলে,”বেশি বেশি ঝাল দিয়ে ফুসকা বানিয়ে দিন।”

দ্বীপ চোখ রাঙিয়ে বলে,”তোমার এখন পরীক্ষা।এই সময় এতো বেশি ঝাল খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে।”

“আরে কিছু হবে না।কতদিন পর আজ ফুসকা খাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আর আপনি কি না আমাকে বাধা দিচ্ছেন।”(বলেই কাদো কাদো ফেস করে)

দ্বীপ আর বাধা দেয় না।ফুসকা রেডি হলে দোকানদার নীরাকে ফুসকা দেয়।নীরা ফুসকা খেতে খেতে দ্বীপকে বলে,”আপনি খাবেন না?”

“না,তুমি খাও।আমি এসব খাই না।”

“আরে,আজকে একটু খেয়েই দেখেন।অনেক মজা হয় ফুসকা।”

বলেই দ্বীপের দিকে একটি ফুসকা এগিয়ে দেয়।যেই দ্বীপ হা করে নীরার হাতের ফুসকা খেতে যাবে ওমনি নীরা ওটা দ্বীপের সামনে থেকে নিয়ে নিজের গালে দেয়।দ্বীপ অবাক হয়ে আশপাশ দেখতে থাকে।নীরা হা হা করে হেসে বলে,”আপনি তো ফুসকা খান না।তাই আর জোর করলাম না।”

দ্বীপ কোনো রিয়েকশন না দেখিয়ে নীরার খাওয়া হয়ে গেলে দোকানদারকে টাকা দিয়ে গাড়ির দিকে এগোতে নেয়।ঠিক তখন নীরা একটি আইস ক্রিম স্টল দেখতে পায়।সাথে সাথে নীরা বলে,”আমি আইস ক্রিম খাবো।”

“এই শীতে একদম কোনো আইস ক্রিম হবে না।পরশু তোমার পরীক্ষা।আমি যেনো ঠান্ডা জ্বর আসতে না দেখি।”

“প্লিজ প্লিজ প্লিজ”(বলেই দ্বীপের হাত ধরে লাফাতে থাকে)

অগত্যা দ্বীপকে আইস ক্রিম কিনতে হয়।পুরো পরিবারের সবার জন্যই দ্বীপ আইস ক্রিম কিনে নেয়।বাসায় এসে সবাই মিলে আইস ক্রিম উপভোগ করে।

মিসেস সাদিয়া এসেছেন আজ।এতদিন গ্রামে নিজের শশুর বাড়িতে ছিলেন।মিসেস সাদিয়া এসে সবাইকে বলেন,”আমার মেয়েটা কি এতই বোঝা হয়ে গেছে?যে এখন তাকে মামার বাড়িতে না থেকে হোস্টেলে থাকতে হবে।”

কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারে না।ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে পিংকি এসে তার মাকে দেখে।মিসেস সাদিয়াকে দেখে পিংকি অবাক হয়ে বলে,”তুমি এখানে কেনো,মা?”

শাড়ির আচল মুখে গুজে কান্নার ভান করে মিসেস সাদিয়া বলেন,”আমার মেয়ে একা একা হোস্টেলে থাকবে।আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করবো।তাই ছুটে এসেছি।”

মিস্টার সমুদ্র দুপুরে খেতে এসেছেন।খাওয়া দাওয়ার পরই আইস ক্রিম খাচ্ছিলেন।তার পরই এই কাহিনী।মিস্টার সমুদ্র অবাক হয়ে পিংকির কাছে এসে বলেন,”তুমি হোস্টেলে যাচ্ছো!কই আমাদের তো বলোনি?”

“আসলে আমি ভেবে দেখেছি আমার এখানে থাকা উচিত হবে না। আর এমনিতেও আমি বড় হয়েছি।কতশত মেয়ে হোস্টেলে থাকে।আমি কেনো থাকতে পারবো না?”

“মেয়ের কি মাথাটা গেছে।এসব বলছে কেনো?এগুলো বললে তো সম্পত্তি পাবে না।”(মনে মনে বলেন মিসেস সাদিয়া)

পিংকিকে বলে ওঠে,”তুই এসব কি বলছিস?হোস্টেলে কেনোই বা যেতে হবে?কে কি বলেছে তোকে?”

“আমি একদম ঠিক বলেছি আর ঠিক কাজ করেছি মা। আর চিন্তা করো না তোমার সম্পূর্ণ ইচ্ছা পূরণ না হলেও অর্ধেক ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।”

কেউ কিছু বুঝলো না শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে।পিংকি ঘর থেকে সম্পত্তির কাগজ এনে মিসেস সাদিয়ার হাতে দিয়ে বলে,”গ্রামের সম্পূর্ণ অধিকার এখন তোমার আর আমার।মামা আমার নামেও কিছু অংশ লিখেছে।শুধু তোমার চাহিদার ভিতর ঢাকার সম্পত্তি পেলে না। আর পেতে বলেও মনে হয় না মা।কারণ দ্বীপ বে (আর না বলে) ভাই এত বড় শিক্ষিত একজন মানুষ আর মামা নিশ্চয়ই ছেলেমেয়েদের না দেখে খালি আমার একার দিকে দেখতো না।”

মিস্টার সমুদ্র খুশি হন।তার কথাগুলো পিংকির বিবেকে লেগেছে।এটাই তো অনেক। কত মানুষ আছে ভালো কথার মূল্য দেয় না।সেখানে পিংকি নিজে থেকে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।সব কাজে বাধা দিতে নেই।তাই আজ কেউ পিংকির কাজে বাধা দিচ্ছে না।

মিসেস সাদিয়া মেয়েকে দেখে অবাক হচ্ছেন।মেয়ের তার এত পরিবর্তন।কিভাবে সম্ভব?এইতো কালকেও তারা কত কুবুদ্ধি দেওয়া নেওয়া করছিলো।আজ এক রাতে কি হয়ে গেলো?

পিংকি সবাইকে দেখে আবার বলে,”আমি হোস্টেল ঠিক করেছি। কাল উঠে যাবো সেখানে।এখানে যত থাকবো হয়তো আমি খারাপ কিছুই করবো।”(দ্বীপের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে)

নীরার কাছে এসে নীরার হাত দুটি ধরে পিংকি বলে,”সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে আসাটা যেমন লোকের চোখে দৃষ্টিকটু,ঠিক তেমনই তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকাটা অনেক কষ্টকর।আমি এতদিনে এটা বুঝেছি।কিন্তু আমার ইচ্ছাশক্তির কাছে সবকিছু লোপ পেয়েছিলো।ভাগ্যিস তুমি স্ট্রং একজন মানুষ। আর বাসার সবাই তোমাকে অঢেল ভালোবাসে।তাই তো আজ আমার মতো তৃতীয় ব্যাক্তির সমাপ্তি হতে যাচ্ছে।পারলে ক্ষমা করে দিও ভাবী।”

নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজে থাকে দূরে সরে যাচ্ছে।তাই নীরা নিজেই আজ পিংকিকে জড়িয়ে ধরে।সবাই আজ খুশি হয়।মিসেস সাদিয়া কিছু বলেন না।মেয়ে তার ভালো এখন বুঝতে শিখেছে। আর এখন নীরাকে যা বললো তারপর তার কোনো কথা বলা মানায় না।মিসেস সাদিয়া এসে ক্ষমা চাইলো মিস্টার সমুদ্রর কাছে।মিস্টার সমুদ্র বোনকে ক্ষমা করে দেন।

পিংকি এসে দাঁড়ায় মিসেস সাবিনার কাছে।বলে,”আমার মায়ের জন্য তুমি সুখে থাকতে পারনি মামী।শুরু থেকে সুখ না পাও শেষ বয়সে এসে আশা করি তুমি হবে শ্রেষ্ঠ সুখী। এত ভালো বউমা হয়েছে তোমার।রূপবতী গুনবতী আবার চঞ্চল।হয়তো ওর জন্যই আজ আমার বিবেকবোধ ফিরে এলো।”

মিসেস সাবিনা জড়িয়ে ধরে পিংকিকে বলেন,”তোকে কখনও পর ভাবিনি মা।তুই আমার পরিবারের এক অংশ ছিলি থাকবি।”

আজ পিংকিও কান্না করে দেয় মিসেস সাবিনার কোলে মাথা গুঁজে। লোভে পড়ে এখানে থাকলেও মায়া তো মানুষের মনের মধ্যে বিরাজ করে।তাই তো পিংকির মনে এখন এই পরিবারের সবার জন্য ভালোবাসার টান কাজ করছে।পিংকির সপ্ন মিসেস সাদিয়ার থেকে ভিন্ন ছিলো।পিংকি ভেবেছিলো সে দ্বীপের বউ হয়ে শশুর শাশুড়ির সেবা করবে।মায়ের হক বুঝিয়ে সেও তার মতো সংসারী হবে।কিন্তু ভালো চিন্তার সাথে অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে তা কখনও সম্পূর্ণ হয় না।

চলবে…?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে