#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৮
#ইশরাত_জাহান
🦋
আজ সবাই একসাথে নীরাদের বাসায় আছে।নীরব আসবে সেই আনন্দে মিসেস নাজনীন সারাদিন নীরবের পছন্দের খাবার রান্না করছেন।মিসেস সাবিনা এখন তাকে সাহায্য করতে গেলো।মিস্টার রবিন ও মিস্টার সমুদ্র এক ঘরে বসে গল্প করতে থাকে।নীরার খুদা লাগে হঠাৎ।কিছু খাওয়ার জন্য খাবার টেবিলের দিকে যায়।সব ফলমূল সুন্দর করে কেটে সাজিয়ে রাখা।মিষ্টিগুলো সাজিয়েছে মিসেস নাজনীন।নীরব এভাবে খেতে ভালোবাসে তাই।এগুলোতে এখন হাত দেওয়া যাবে না।
টেবিলের মাঝে একটি ছোট ঝুড়িতে কলা ছিলো।তার ভিতর এক জোড়া কলা নীরা ছিঁড়ে খেতে যায় ওমনি মিসেস শিউলি খেয়াল করেন।রসিকতা করে বলেন,”নাতবৌ জোড়া খাবার খাইতে নাই।এতে যমজ বাচ্চা হয়।”
নীরা দাদী শাশুড়ির কথা শুনে হিসাব করলো,যদি এক জোড়া খাবার খেলে যমজ বাচ্চা হয় তাহলে আমি ছয় জোড়া কোনো খাবার খেলে এক ডজন হয়ে যাবে।সাথে সাথে নীরা দ্বীপকে বলে ওঠে,”শুনুন ক্যাডার সাহেব,আমার জন্য কালকে ছয় জোড়া কলা আনবেন।একটা ক্রিকেট টিম হবে আর একজন ওই টিমকে কন্ট্রোলে রাখবে।”
নীরার কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠেন মিসেস শিউলি।তিনি বলেন,”নাতবৌ আমার দেখি বারোটা বাচ্চার শখ করছে!”
কেউ আর কিছু বলার আগে কলিং বেল বেজে ওঠে।নীরা যেয়ে দরজা খুলে দেয়।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীরব। নীরবকে দেখার সাথে সাথেই নীরা “ভাইয়া” বলেই এক চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরে।মিসেস নাজনীন রান্নাঘর থেকে এসে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন।দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর পর আজ ছেলেকে দেখছেন তিনি।মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ তিনি নীরবকে গর্ভে ধারণ করে পেয়েছিলেন।এই ছেলে এতগুলো বছর দূরে ছিলো।কত মনে পড়তো ছেলের কথা।ছেলেকে কোলে নিয়ে কত আদর করতো সবকিছুই যেনো আজ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।সাথে সাথে নীরবের কোলে মুখ গুজলেন মিসেস নাজনীন।হাউমাউ করে কান্না করছেন ছেলের কোলে মুখ রেখে।সবাই দেখছে মা ছেলের মুহূর্ত।নীরব মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি যেদিন জার্মানে গিয়েছিলাম ঐ দিনও তো এত কান্না করনি তোমরা!আজ এসেছি আর কান্নার বন্যা বয়ে গেলো?”
নীরা মিসেস নাজনীনকে জড়িয়ে বলে,”তুমি কি করে জানবে আমরা কান্না করেছিলাম কি না।মাকে তো জোর করে খাইয়ে দিতে হতো।শুধু তোমার সপ্নের জন্য তোমাকে সুযোগ করে দেওয়া।এই জন্য মা তোমার সামনে স্ট্রং ছিল।”
নীরব বোনের মাথায় হাত দিয়ে বলে,”এবার ভাইকে ভিতরে আসতে দিবি নাকি বাইরে দাড় করিয়ে রাখবি?লম্বা একটা জার্নি করে এসেছি আমি।বাকি সবার সাথে তো সাক্ষাৎ করতে দে।”
নীরা হেসে দিলো।মিসেস নাজনীনকে নিয়ে সাইড হয়ে মিস্টার রবিনের দিকে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় নীরবকে।বাবা হলেও মিস্টার রবিন হলেন নীরবের বেস্ট ফ্রেন্ড।সব সময় বেস্ট ফ্রেন্ডের মত করেই চলাফেরা করেন তারা।নীরব ঘরে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।মিস্টার রবিন নীরবকে বুকে টেনে বলেন,”আমার কলিজার টুকরোর এক অংশ।”
মিস্টার রবিন সব সময় নীরা ও নীরবকে বলে এসেছেন,”তোমরা দুইজন আমার কলিজার টুকরো।কিন্তু আমার কলিজার একাংশ জুড়ে আছে তোমাদের মা।বয়স বাড়বে দিন শেষ হবে কিন্তু তোমাদের মাকে আমি কখনও ভুলতে পারবো না।তোমাদের মা আর তোমরা দুই ভাই বোন আমার একটি আস্ত কলিজা।তোমাদের কোনো কিছু হলে আমি ঠিক থাকতে পারবো না।”
বাবা,মা ও বোনের সাথে সুখ দুঃখের মুহূর্ত ভাগাভাগির পর নীরব মিস্টার সমুদ্র,মিসেস সাবিনা ও মিসেস শিউলিকে দেখে সালাম দিলো।তারপর দ্বীপের সাথে কোলাকোলি করে নিলো।অতঃপর দীপান্বিতার দিকে তাকালো নীরব।দীপান্বিতা এতক্ষণ নীরবের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।কতগুলো বছর পর তার প্রণয়ের পুরুষকে দেখছে।আগের থেকে আরো সুন্দর হয়েছে।বয়স বেড়েছে কিন্তু মুখের ছোপ ছোপ চাপদারী আর বডি ফিটনেস দেখলে তো একদম মিস্টার পার্ফেক্ট লাগছে।দীপান্বিতা মনে মনে বলে ওঠে,”আমারও তো বয়স বেড়েছে।বয়সের সাথে সাথে মুখের উজ্জ্বলতা কমে এসেছে। আর এনাকে দেখো উজ্জ্বলতা যেনো আমার থেকে ঢেলে ঢেলে নিয়েছে।আমাকে হয়তো এখন আর মানাবে না তার সাথে।তাই তো এতদিন কন্টাক্ট অফ রেখেছে।”
নীরব দীপান্বিতার কাছে আসতে যাবে ওমনি অভ্র এসে দীপান্বিতার হাত ধরে বলে,”খুদা লাগছে,আম্মু।”
থমকে গেলো নীরব।চেয়ে আছে দীপান্বিতার চোখের দিকে।এখন দীপান্বিতা তার নিষিদ্ধ নারী।দীপান্বিতাকে ইগনোর করে চলে গেলো ঘরের ভিতর।বুকের ভিতর জ্বলতে থাকে নীরবের।আয়নার সামনে দাড়িয়ে দীপান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”এক সময়ের ময়াবন বিহারিনী।এখন আমার হৃদয়হরণী।”
দীপান্বিতা অভ্রকে কিছু খাইয়ে দিতে চায় তাই মিসেস নাজনীনকে বলে খাবারের ব্যাবস্থা করে।দীপান্বিতা অভ্রকে খাইয়ে দিচ্ছে।এমন সময় নীরব পোশাক পাল্টে ড্রয়িং রুমে এসে দীপান্বিতাকে দেখতে থাকে।নীরা সবকিছুই খেয়াল করে দেখছে।অভ্র দীপান্বিতাকে বলে,”ওনাকে আমি কি বলে ডাকবো আম্মু?”
দীপান্বিতা চুপ থাকলেও নীরা বলে ওঠে,”মামা।মামা বলে ডাকবে আমার ভাইকে।আমার ভাই মানে তো দীপান্বিতা আপুরও ভাই।সেদিক থেকে মামা বলা যায়।”
নীরবের মাথা ঘুরতে শুরু করলো।এক সময়ের ছাইয়া এখন হয়ে গেলো ভাইয়া!নীরার মত বোন থাকলে সব সম্ভব।অভ্র নীরবের কাছে এসে বলে,”আমার নাম অভ্র।তুমি আমার নতুন মামা।আমার জন্য চকলেট এনেছো?আমি সেই বিকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”
নীরব কি করবে বুঝতে পারছে না।মন তো চাচ্ছে ঠাটিয়ে দিবে এক চড়।মামা মামা করছে সে।এগুলো সহ্য হয় নাকি তাই?মনের দুঃখ মনে রেখে নীরব “হুম” বলে মাথা নাড়ায়।
সবাই মিলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করতে বসেছে।মিসেস নাজনীন ও নীরা আজ পরিবেশন করছে।নীরব ও দীপান্বিতা টেবিলের সামনা সামনি বসে আছে।দুজন দুজনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজেদের খাওয়া দাওয়াতে মন দেয়।খাওয়ার মাঝে হঠাৎ দীপান্বিতার পায়ের সাথে ছোয়া লাগে নীরবের পা। পায়ে পায়ে ছোয়া লাগাতে দীপান্বিতা ও নীরব একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে।ভুল বশত লেগেছে পা।সারাদিন প্লেনে বসে ছিলো নীরব।পা একটু অবাস হয়ে আছে।তাই পা নাড়াতে যেয়ে দীপান্বিতার সাথে লেগে যায়।
সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে সবাই বাড়িতে চলে আসে।ঘরে এসে লাইট জ্বালানোর সাথে সাথে দ্বীপ নীরাকে বলে,”তুমি আমার থেকে কয়টা চুনু মুনু চাও?”
“এক ডজন,কেনো?আপনি দিবেন না আমাকে এতগুলো চুনু মুনু?”
দ্বীপ নীরার অতি নিকটে এসে নীরার কানে ফিসফিস করে বলে,”আমি দিতে পারবো কিন্তু তুমি নিতে পারবে তো?”
নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে দ্বীপের দিকে।দ্বীপ হাসতে হাসতে আলমারি থেকে বাড়ি পড়ার পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।পাঞ্জাবি পাল্টে টি শার্ট পরে আসে।নীরা কিছু না বলে জামা নিয়ে ওয়াশরুম থেকে শাড়ি পাল্টে ঘরে আসে।এসেই খাটে শুয়ে পড়ে।মিনিকে এখন সোফায় ঘুমোতে দেয়।
কিছুক্ষণ নিরবতা ভেঙ্গে নীরা আস্তে আস্তে দ্বীপের দিকে এগোতে থাকে।দুই কদম আগায় তো কিছুক্ষন থেমে থাকে।এরকম করতে করতে যেই নীরা দ্বীপের কাছে আসবে ওমনি দ্বীপ বলে ওঠে,”স্টপ,এখানেই থেমে থাকবে। আর এগোবে না।পরীক্ষা শেষ হয়ে যাক তারপর তোমার এক ডজন বাবু লাগে নাকি দুই ডজন লাগবে সবকিছুর ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।”
যে নীরা এতক্ষণ দ্বীপের কাছে আসছিলো সেই নীরা যখন দ্বীপের মুখে দুই ডজন বাচ্চার কথা শুনে সাথে সাথে দূরে সরে আসে।দ্বীপ মিটমিট করে হাসতে থাকে।নীরাকে শায়েস্তা করার জন্য তাকেও কি না নীরার মত হতে হয়।
চলবে…?
#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৯
#ইশরাত_জাহান
🦋
কাল নীরার পরীক্ষা।তাই আজ সকাল থেকে পড়াশোনায় ব্যাস্ত নীরা।দ্বীপ কলেজে গেছে পরীক্ষার জন্য তাদের আলাদা মিটিং করতে হয়।নীরা মনোযোগ দিয়ে বই পড়তে থাকে।কলেজে যাওয়ার আগে দ্বীপ বলেছে,”আমি এসে কিন্তু প্রত্যেকটি চেপটার থেকে প্রশ্ন করবো।সঠিক উত্তর যেনো পাই তানাহলে তো জানোই শাস্তি হিসেবে কি থাকবে।”
নীরা জানে এই আদনান কবির দ্বীপ এখন বিদ্যাসাগরের রূপ ধারণ করেছে। কাল পরীক্ষা এদিকে যে স্বামী সেই আবার তার শিক্ষক।পড়াশোনা না করলে স্বামী হয়ে যাবে তার জীবনের আসামি।তাই নীরা বলে,”হ্যা হ্যা জানি।পড়াশোনা মনোযোগ দিয়েই করবো।এমনিতেও তো এই মাস দুই ধরে তো খালি বই আর বই করেছেন।সকালে উঠে পড়তে বসেছি আর রাতে ঘুমানোর আগে বই বন্ধ করেছি।”
“হুম,কেউ কিছু বললে কান দিবে না।যদিও কেউ কিছু বলবে না যে বলার সেও আজ কলেজে যাবে।”
“আপনি কিন্তু খবরদার কোন ডাইনির দিকে তাকাবেন না। আর বুঝিনা আমি!চুলগুলো এভাবে স্পাইক করার কি দরকার?কলেজে তো পড়াতে যাচ্ছেন ফ্যাশন দিচ্ছেন কেনো?”
“তাহলে কি করবো? টেলি সামাদ হয়ে যাবো?”
“দরকার পড়লে তাই যাবেন।আজ থেকে আপনি টেলি সামাদ সেজেই যাবেন।”
বলেই নীরা দ্বীপের মাথা নারকেল তেল দিয়ে দিলো।তারপর মাঝখান থেকে সিতি করে বলে,”একদম পারফেক্ট লাগছে আপনাকে।আমাদের স্কুলে যে হেড টিচার ছিলো তার মত লাগছে।এখন কেউ নজর দিবে না।যেতে পারেন আপনি।”
দ্বীপ কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।কি বউ জুটলো কপালে। দ্বীপ ড্রয়িং রুমে আসার সাথে সাথেই দ্বীপকে দেখে সবাই হাহা করে হাসতে থাকে।পিংকি ভেবাচেকা খেয়ে থাকে।বলদ বউ পেয়ে কি জামাইও বলদ হয়ে গেলো!এ কোন লুক নিয়ে যাচ্ছে কলেজে?
পিংকির হা করে তাকানো দেখে নীরা বলে,”এভাবে দেখার কিছু নেই।এবার থেকে কলেজে যাওয়ার সময় মাথায় তেল দিয়ে যাবে আর এসে শ্যাম্পু করবে।ছেলেদের আসল সৌন্দর্য তাদের হেয়ার স্টাইল দিয়েই হয়।তাই আমার ক্যাডার সাহেবের সৌন্দর্য আমি দেখবো।”
পিংকি নীরার কথার উত্তরে বলে,”আর সিক্স প্যাক!তারপর চাপদারী এগুলো?”
“আমার জামাইয়ের সিক্স প্যাক এর দিকে তোমার এত নজর কেনো হ্যা?ওটার ব্যাবস্থা নেই বলেই তো চুলে তেল দিয়ে দিলাম।যদিও আজ থেকে ঘি দিয়ে গরম ভাত আর বেশি বেশি আলুর তরকারি খাওয়াবো।সিক্স প্যাক বেশিদিন থাকবে না।”
মিসেস শিউলি বলেন,”একদম ঠিক কথা কইছো নাতবৌ।বর মানুষ যত্ত সুন্দর লাগবো তত্ত বেশি মাইনষের নজর লাগবো।”
বলেই হাসতে থাকেন সবাই। দ্বীপ কোনো কথা না বলে বের হয়।বাড়ির বাইরে এসে তেল আলা চুলগুলো হাত দিয়ে উচু করে সেই স্পাইক আকারেই করে।নীরার সামনে আর করে না এই কাজ।যে লেভেলের ঝাজ!দ্বীপকে আজ মিটিংয়ে যেতেই দিতো না।
~~~~
বিকালে দ্বীপ আসে কলেজ থেকে।নীরা না খেয়েই আছে তার জন্য।এটা নীরার এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।দ্বীপের লাঞ্চ টাইমে নীরাকে কল দিয়ে যদি বলে দ্বীপ খেয়েছে তখন নীরা ভিডিও কলে থেকে পিংকিকে দেখিয়ে দেখিয়ে খায়।আজ দ্বীপ ক্লাস করানোর পর মিটিংয়ে ব্যাস্ত ছিলো তাই কল দিতে পারেনি। নীরাও না খেয়ে আছে।দ্বীপ গোছল করে এসে নীরার সাথে একসাথে খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়।তারপর নীরার কাছ থেকে পড়াগুলো আদায় করে।
এর কিছুক্ষণ পর কেয়া ও কেয়ার আম্মু আসে নীরার সাথে দেখা করতে।মিসেস সাবিনা ও মিসেস শিউলি মিলে গল্প করে কেয়ার আম্মুর সাথে।দ্বীপ নীরা অভ্রকে নিয়ে কেয়ার সাথে গল্প করে।কেয়া বলে,”দোস্ত বাসা থেকে আমাকে ও রিককে মেনে নিয়েছে।পরীক্ষার পর আমাদের বিয়ে।বলতে গেলে আজ পরীক্ষা শেষ তো পরশু বিয়ে।তাই আম্মু এসেছে সবার সাথে কথা বলতে।”
নীরা খুশি হয়ে হাত তালি দেয়।নীরার দেখা দেখে অভ্রও হাত তালি দেয়।দ্বীপ বলে,”বিয়ের কথা পরীক্ষার পর বললে মনে হয় ভালো হতো।তোমরা যে লেভেলের পড়া চোর।এতে করে বিয়ের আনন্দে পড়াশোনা গোল্লায়।”
নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকায় দ্বীপের দিকে।বলে,”আমার জীবনটা তো নিরামিষ বানিয়েছেন এখন আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর পিছনে লেগেছেন!আপনি কি আমাদের জীবনে একটু রোমান্টিক লাইফ স্পেন্ড করতে দিবেন না?”
“সব কিছুর একটা সময় থাকে।এখন পরীক্ষা চলছে তোমাদের।তোমার রেজাল্ট করার দায়িত্ব তো আমি নিয়েছি। আর কেয়া তোমাকে বলছি।তোমার মাকে বলে আমাদের কলেজের এক প্রফেসরকে ঠিক করে দিচ্ছি।পরীক্ষার এক মাস তার কাছে পড়াশোনা করবে।”
কেয়া কাদো কাদো মুখ করে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝায়।মনে মনে বলে,”আমি তো ভুলেই গেছিলাম!আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী এখন আমার কলেজের শিক্ষক।কোন দুঃখে যে এখন বিয়ের অ্যাডভান্স কার্ড দিতে আসলাম।বিয়ের কার্ড দিতে এসে পরীক্ষার জন্য টিউটর জুটলো।হায়রে আমার বিয়ের অ্যাডভান্স গিফট।”
কেয়ার আম্মুর সাথে কথা বলেই দ্বীপ চলে যায় নিজেদের রেস্টুরেন্টে।মিস্টার সমুদ্রর সাথে একবারে মাগরিবের নামাজ পড়ে ফিরবে।নীরা কেয়ার কাছে এসে বলে,”বুঝলি দোস্ত!তুই ক্যাডার সাহেবকে হেল্প না করলে আমিও কোনো এক রোমান্টিক জামাই পেতাম আর তুইও তোর বিয়ের জন্য আনন্দ করতে পারতি।”
কেয়া কাদো কাদো ফেস করে বলে,”কোথায় ভাবলাম টেনে টুনে পাশ করে বের হবো।তারপর সাদা বিলাইকে বিয়ে করে পড়াশোনা থেকে দশ হাত দূরে থাকবো,তা না বান্ধবীর প্রফেসর বর কি না আমাকেও বিদ্যাসাগরে ভাসিয়ে দিলো।একটা সত্যি কথা বলবি দোস্ত?”
নীরা তাকায় কেয়ার দিকে।ইশারা করে বোঝায়,”কি?”
“তোদের কি কোনো রোমান্টিক মুহূর্ত আছে?এই যে বিয়ের এতগুলো দিন হয়ে গেলো। স্যার কি তোকে ভালোবাসার কোনো প্রবাদ বাক্য শুনিয়েছে? না কি খালি বই নিয়ে বসে থেকেছে?যেভাবে আমাকে বিয়ের আগে কংগ্রাচুলেশন না জানিয়ে বিদ্যাসাগরে ঢুকিয়ে দিলো।মনে তো হয় না তোর জীবনে এত তাড়াতাড়ি কিছু হবে।”
নীরা দুঃখ প্রকাশ করতে যাবে তার আগে দেখলো পিংকি তার ঘরের পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে কথা শুনছে।নীরা জোরে জোরে বলে ওঠে,”কি যে বলিস না দোস্ত!আমার ক্যাডার সাহেব আমাকে বলেছে পরীক্ষার পর চুনু মুনু গিফট করবে।ইনফ্যাক্ট জোড়ায় জোড়ায়।শুধু কি তাই আমি যখন ঘুমাতে যাই আমাকে ভালোবাসার পরশ দিয়ে ঘুম পাড়ায়।”
কেয়া হা করে আছে।কেউ বলবে এমন মুডি শিক্ষক বউ পেলে রোমান্টিক হবে।অবশ্য স্বামী স্ত্রীর ভিতর তো রোমান্স হবেই।সে শিক্ষক হোক বা কোনো হুজুর।বউ তো বউ তাকে কি আর অন্য মেয়েদের মত ট্রিট করা যায়?
পিংকি আহত হয়ে ভিতরে ঢুকলো।রাগ উঠছে তার।এদের সম্পর্ক ভাঙার জন্য প্ল্যান করতে থাকে পিংকি।কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসি দেয়।
সন্ধায় কেয়া বাসায় চলে আসে।কেয়ার শিক্ষক সন্ধার পর আসবে।এতে কেয়ার আম্মু খুশি হয়েছে।নীরা ও কেয়ার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।সন্তানদের সফলতা বাবা মায়ের তৃপ্তির স্থান।ভালো পাত্র পেয়েছে দুই বান্ধবী।শুধু কি তাই?এরা যেমন ভালো চরিত্রের পাত্র পেয়েছে ঠিক তেমন ভালোবাসার মতোও পেয়েছে।দ্বীপকে দেখলে বোঝা যায় সে নীরার প্রতি কতটা সেনসেটিভ।আবার রিক সে যদি এতটাই খারাপ হতো তাহলে মাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতো না।রিক কয়েকদিন কেয়ার সাথে ঘোরাফেরা করলেও কেয়ার মন বুঝতে চেয়েছিলো।যথেষ্ট সম্মান করে রিক কেয়াকে।রিকের মায়েরও মনে ধরেছে কেয়াকে।বউমা হিসেবে তার কেয়াকে পছন্দ।
সন্ধ্যায় নীরাকে পড়াতে বসেছে দ্বীপ।দীপান্বিতা লাইভ করে এখন রাতের খাবার রেডি করতে এসেছে মিসেস সাবিনার সাথে। পিংকিও এসেছে হেল্প করতে।মিসেস সাবিনা বলেন,”থাক মা তোকে কষ্ট করতে হবে না।তুই গিয়ে পড়তে বস।”
পিংকি ইচ্ছা করে নীরার মাইন্ড ডাইভার্ট করতে চায়।তাই জোরে জোরে রান্নাঘর থেকে বলে,”তা বললে কি আর হয় নাকি মামী?তোমাদের ছেলেকে বিয়ে দিয়েছো এমন একজনের সাথে যে কি না পড়াশোনা তো করেই না আবার কাজও পারে না।আমি একটু হেল্প করি তোমাদের।”
দ্বীপদের বাসা তিনতলা বিল্ডিংয়ের।দ্বিতীয় ফ্লোরে দ্বীপরা থাকে।একটি ফ্লোর হওয়ায় সবার ঘরের সামনেই ড্রয়িং রুম আর ড্রয়িং রুমের কাছেই আছে রান্নাঘর।রান্নাঘর থেকে একটু জোরে কথা বলায় নীরার কানে ভেসে আসে পিংকির কথা।একটু রাগ উঠলেও পাত্তা দেয় না নীরা। কাল তার পরীক্ষা।আজকে এসব কথায় পাত্তা দিবে না।
মিসেস সাবিনা দীপান্বিতাকে রান্নার কথা বলে ঘরে যান।মিস্টার সমুদ্রের সাথে কথা বলতে।পিংকি আবারও জোরে জোরে বলে,”আহারে আমার মামীর কপাল!ছেলের বিয়ে দিলো অথচ বউমার সেবা পেলো না।উল্টো কি না ছেলের বউকে সেবা করতে হয়।পিচ্ছি ভাবী কপালে জুটেছে বলে আজ এক অসহায় ননদকেও ঘরের কাজ করতে হচ্ছে। ফেলটুশ তো ফেলটুশ তার সাথে পারে না কোনো কাজ।”
নীরার এবার আর রাগ কন্ট্রোল হলো না।দ্বীপ নীরাকে কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিয়েছিলো।বানান দেখার জন্য।নীরা উত্তর লিখে দ্বীপের কাছে খাতা দেয়।দ্বীপ সেদিকে মনোযোগ দিয়েছিলো।হঠাৎ দেখলো নীরা ধুম করে চেয়ার থেকে উঠে কোমরে ওড়না বেধে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। দ্বীপও সাথে সাথে উঠে যায় নীরার পিছনে।নীরাকে বাধা দিয়ে বলে,”তুমি রান্নাঘরে এসেছো কেনো?”
কিসের পড়াশোনা নীরার এখন মাথায় আগুন ধরে গেছে।হুংকার দিয়ে দ্বীপকে বলে,”দেখতে পারছেন না আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।রান্নাঘরে মানুষ কেনো যায়?রান্না করতে।আমিও রান্না করবো।ঘরের বউ হয়েছি আমি এখন।আগে রান্নাবান্না তারপর পড়াশোনা।”
দ্বীপ বুঝতে পারলো এই মেয়েকে এখন চড় থাপ্পড় থ্যারাপি দিলেও কাজ হবে না।তাই শান্ত হয়ে বলে,”কাল তোমার পরীক্ষা।মাথা ঠাণ্ডা রাখো।পরীক্ষার পর রান্না বান্না করো।মাত্র তো এক মাস।দরকার পড়লে বৃহস্পতিবার রাত করে রান্না করবে।আমি বাধা দিবো না।প্লিজ চলো।”
কিসের কি নীরার চোখ তো পিংকির দিকে।শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে পিংকি।পিংকি চায় দ্বীপ আজ নীরার বাড়াবাড়ি দেখে কিছু একটা করুক।যে ঝামেলা বাদিয়ে দিয়েছে এখন এরা বর বউই যা করার করবে।নীরা পিংকির দিকে তাকিয়ে বলে,”ও কেনো রান্না করবে?ও রান্না করবে ওর শশুর বাড়িতে।আমি এখন আমার শ্বশুর শাশুড়ির জন্য রান্না করবো।ননদকে ভুগতে দিবো না আমি।আমি ভালো বউ হবই হবো।”
বলেই নীরা দৌড় দিতে যায় রান্নাঘরে।ওমনি দ্বীপ নীরার কোমর জাপটে ধরে।নীরা লাফালাফি করে বলে,”ছাড়ুন আমাকে ক্যাডার সাহেব।আমার মাথা এখন আতা মাঝি ছাতাকলি হয়ে গেছে।হয় আজকে ওর মাথা ফাটবে নাহয় বাড়িতে আগুন লাগবে।”
বলতে বলতে নীরার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে।যোগ্য বউ না যোগ্য বউ না ফেলটুশ করে করে পিংকি যতটা খোটা নীরাকে দেয় এতটা নীরাকে কেউ বলেনি।তাই একটু কষ্ট হয় নীরার।দ্বীপ বুঝতে পারে নীরা আজ কষ্ট পেয়েছে।পিংকিকে কেউ একটু প্রতিবাদ করেও কিছু বলেনা।যদিও পিংকির কথার পাত্তা দেয় না কেউ।কিন্তু নীরার মন তো এতেই কষ্ট বাড়িয়ে দেয়।তাই দ্বীপ বলে,”মাথা ঠাণ্ডা করো চন্দ্রপাখি।শান্ত হও তুমি।সবাইকে বলে রাখছি আমার বউকে কেউ রাগাবে না।পরীক্ষার পর আমার বউয়ের হাতের রান্না তোমাদের পেট ভরে খাওয়াবো।এখন সে তার মত পড়তে বসবে।আমার বউ দেখিয়ে দিবে সে ফেলটুশ না। সেও একজন ব্রিলিয়ান্ট।কি বউ পারবে না দেখাতে?”
কথা বলার মাঝে দ্বীপ দীপান্বিতাকে চোখ টিপ দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে সে নীরাকে শান্ত করতে এমন বলে।দীপান্বিতা মিটমিট হাসে।নীরা এবার একটু শান্ত হলো।তাকালো দ্বীপের দিকে।দ্বীপ আবার বলে,”লোকজন কিন্তু এটা বলেও তোমাকে খোঁচা দিবে যে তুমি এসএসসি ফেলের মত ইন্টার ফেল করেছো।একটা মাস অপেক্ষা করো তারপর সংসারের কাজ করলে লোকে বলবে নীরা ইজ দ্যা বেস্ট।যে নারী রাধে সে চুলও বাঁধে।ভালো রেজাল্ট এখন ইম্পর্ট্যান্ট।তারপর ভালো বউ হও।”
বলেই নীরাকে নিয়ে ঘরে যায়।নীরা হাফাতে থাকে।দ্বীপের বুকেই মাথা রেখে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে।কিছু একটা ভেবে নীরা দ্বীপকে বলে,”আমার মুখে এখন ভালোবাসার স্পর্শ দিবেন ক্যাডার সাহেব।”
দ্বীপ অবাক হয়ে বলে,”হোয়াট?”
“হুম এই ডাইনি ননদিনীর সামনে আপনি আমার শুষ্ক গালে ভালোবাসার পরশ একে দিন।”
“পাগল হয়েছো তুমি?এখানে সবাই আছে।”
“তেমন কেউ নেই।দীপান্বিতা আপু আর পিংকি ছাড়া।আমি চাই কেউ একজন তার চাওয়ার বিপরীতে অন্য কিছু দেখে জ্বলুক।আপনি যদি এখন আমাকে ভালোবাসার পরশ না দেন আমি এই রাতেই বাড়ি চলে যাবো। আর এলাকা জুড়ে বলবো ক্যাডার সাহেব একজন টিউব লাইট।তাই বাধ্য হয়ে দুই মাস সংসার করে চলে এসেছি।আমি এই কথা রটালে আর কোনো বউ জুটবে না আপনার কপালে। আর যদি আমি যাওয়ার পর পিংকি নামক ডাইনিকে আপনি বিয়ে করেন।এই সমাজ কিন্তু ধরে নিবে আমাদের বিয়ে ভাঙার পিছনে আপনাদের দুই জনের হাত আছে।”
“যত্তসব উল্টা পাল্টা ভাবনা চিন্তা।”
“তিন সেকেন্ড সময় দিলাম।আমি যদি আমার শুষ্ক ত্বকে মিষ্টি ছোয়া না পাই তাহলে আমি চলে যাবো।”
“ঠিক আছে” বলেই দ্বীপ নীরার মুখে ভালোবাসার ছোয়া দিয়েই দেয়।
পিংকি আহত হয়ে তাকায়। কোথায় ভাবে এই গালে এখন থাপ্পড় থ্যারাপি হবে তা না হলো কি না চুম্বন থ্যারাপি।নীরা খুশি হয়ে দ্বীপের সাথে ঘরে চলে যায়।দীপান্বিতা রান্নায় ব্যাস্ত ছিলো।অবশ্য দ্বীপ ইশারা করে অন্য দিকে ফিরতে বলে দীপান্বিতাকে।
চলবে…?