#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৪
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকাল সকাল ঘুম উঠে নীরা ফ্রেশ হয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে।তখন ঠিক সাতটা বাজে।শীতের সকাল।নীরার মতো মেয়ের এই সময় কম্বল জড়িয়ে ঘুমানোর সময়।কিন্তু সে আজ রান্নাঘরে তাও কাপতে কাপতে এসেছে।মিসেস সাবিনা,মিসেস শিউলি ও দীপান্বিতা যখন নীরাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে যায়।নীরা তাদের তাকানো দেখে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসা করে,”কি হয়েছে?”
মিসেস শিউলি শাড়ির উপর চাদরটা ঠিক করতে করতে বলে,”নাতবৌ তুমি তো এত সকালে উঠবার পাত্রী না।আজ কি দেইখা উঠলা?”
দাদী রসিকতা করে বললেও পিংকি হাসতে হাসতে বলে ওঠে,”তোমার নাতবৌয়ের দেখো রাতের ঘুম ঠিক মত হয়নি।যে ডোজ দেওয়া হয়েছিল তাকে।রাতে তো না খেয়েই ভাং ধরে ঘুমিয়েছিলো।তাই হয়তো এখন এসেছে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করতে।”
নীরা কাজের রমণীদের মত করে ওড়না কোমরে বেধে বলে,”আমার বর একটু পড়ে নিজের কাজে যাবে।বউ হয়ে তো আর ঘরে বসে থাকতে পারি না।ডাইনিদের নজর পরে যাবে যে।তাই আমার জামাইয়ের উপর দিয়ে নজরদোষ সরানোর পাঁয়তারা করতে শুরু করেছি।”
কেউ বুঝলো না কথার মানে।কিন্তু এইটুকু বুঝেছে যে পিংকিকে ইঙ্গিত করে বলেছে।দীপান্বিতা বলে ওঠে,”মানে?”
“একটু পর আমার উনি ঘুম থেকে উঠবেন।এমনিতেই আমি না খেয়ে ছিলাম বলে তিনিও না খেয়ে আছেন।বউ হয়ে কি জামাইকে এত কষ্ট দিতে পারি!তাই এখন আমি নিজে আমার বরের জন্য রান্না করবো।তারপর আমি আর আমার জামাই একসাথে সকালের খাবার এক ঘরে খাবো। আশা করি কারো বদ নজর পড়বে না আমাদের নব দম্পত্তির উপর?”
মিসেস শিউলি নীরার রান্নার কথা শুনে অবাক হলেও পিংকিকে খোঁচা মারাতে খুশি হয়েছেন।তিনি বলেন,”কিসের সমস্যা হইবো নাতবৌ!কোনো সমস্যা নাই।আরে বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকে তবেই না ভালোবাসা বাড়বে।তুমি রান্না করতে পারবা নাকি আমরা সাহায্য করবো?”
“আজ প্রথম দিন রুটি বানাবো।আমাকে একটু দেখিয়ে দেও।এরপর থেকে আর দেখাতে হবে না।আমাকে শিখিয়ে দিলে আমি শিখে যাই।”
সবাই মিলে নীরাকে সাহায্য করলো।সাহায্য বলতে মুখে মুখে বলে দেয় আর নীরা সেভাবে আটা মাখিয়ে রুটি বেলতে থাকে।সবজি সিদ্ধ করতে দেয় তারপর তেলে দিয়ে ভাজি করে।পরিমাণগুলো সব মিসেস সাবিনা বলে দেন।
সবকিছু পারফেক্ট হইলেও পারফেক্ট হয়না নীরার রুটির সেপগুলো।একটি এশিয়া মহাদেশের মানচিত্র তো আরেকটি আফ্রিকা মহাদেশের।একেক রুটি একেক রকম হয়েছে।
সবাই মিটমিট হাসতে থাকে রুটিগুলো দেখে।অভ্র ঘুম ঘুম চোখে মাত্র এসেছে।রুটিগুলো দেখে বলে ওঠে,”মামী তুমি ডিজাইন করে রুটি বানিয়েছো?কি মজা আজকে অন্য রুটি খাবো।”
বলেই হাত তালি দেয়।ছোট অভ্র কি আর বুঝে যে এগুলো না পারার কারণে হয়েছে।সে তো ভিন্ন সাজের কিছু দেখলে তাতেই খুশি হবে।
পিংকি নীরাকে পিঞ্চ মেরে অভ্রকে বলে,”নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা।তোমার মামী পারেনা তো করবে কি।এগুলো করতে যোগ্যতা থাকা লগে।”
ড্রয়িং রুমে মিস্টার সমুদ্র চা উপভোগ করছেন আর খবরের কাগজ দেখছেন।পিংকির শেষের কথাটি তার পছন্দ হয়নি।তিনি সচরাচর মেয়েদের কথায় বাম হাত ঢুকায় না।তবে আজ নীরার হয়ে প্রতিবাদ করে বলেন,”আজকালকার মেয়েরা ঘরের কাজ করতে চায় না।সেই তুলনায় আমার বউমা কিছু না পারলেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পারফেক্ট বউ হওয়ার।এটাই কি কম নয়?কাউকে সাহায্য করতে না পারো কিন্তু তাকে দুর্বল করতে উঠেপড়ে লাগাটা একটা অন্যায়।পাবলিকের সামনে তুমি আজ যাকে অপমান করবে ওই পুবলিক গুলো কিন্তু একসময় তোমার দিকেও আঙুল ঘুরিয়ে দিবে।এটা মাথায় রেখো।”
পিংকি আর কোনো প্রতিউত্তর করে না।খারাপ হলেও সে মিস্টার সমুদ্রকে মামার মত করেই ভালোবাসে।মায়ের মত সম্পত্তির আশায় লোভ দেখানো সম্পর্ক পিংকি করেনি।শুধু দ্বীপের প্রতি পিংকির এক আলাদা দুর্বলতা।
নীরার বানানো রুটিগুলো প্রথমদিকে খারাপ হলেও শেষের গুলো অনেক সুন্দর হয়েছে রাউন্ড আকারে হয়েছে।ভালো ভালো রুটিগুলো নীরা মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস শিউলিকে দিয়েছে।বাকিগুলো বাড়ির অন্যান্য সবাই খাবে।সবার খাবারের ব্যাবস্থা করে নীরা নিজের ও দ্বীপের জন্য খাবার সাজিয়ে নেয়।তারপর ঘরের দিকে যেতে থাকে।কিছু একটা ভেবে ঘরে যাওয়ার আগে পিংকির কাছে এসে পিংকির কানে কানে বলে,”পাঁচ মিনিটের একটি ডোজ দেখেই তুমি এত খুশি!আফসোস,বাকি ২৩ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের ডোজ গুলো দেখতে পাও না।যে আমাকে থাপ্পড় দিয়েছে সে কিন্তু তা উশুল করেও নিয়েছে।ঘরের বাইরের লোক তুমি তাই বাইরের দিকটি দেখতে পাবে।ভিতরের কাহিনী তো ভিতরের লোকগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ।”
কথাগুলো বলেই নীরা চোখ টিপ দিলো।তারপর প্রস্থান করলো ঘরের দিকে।
ঘরে এসে নীরা দেখতে দ্বীপ ঘুমিয়ে আছে।ঘুমের ঘোরেও কি না তার চোখে চশমা।দ্বীপের পাশের যে জায়গাটিতে নীরা ঘুমায় ওখানে মিনি ঘুমিয়ে আছে।নীরা দ্বীপকে ডাকতে লজ্জা পাচ্ছে।কিভাবে ডাকবে বুঝতে পারছে না।যতই এদিক ওদিক লড়াই করুক তার কি লজ্জা কম নাকি।ডান হাত দিয়ে দ্বীপের বাহুতে আলতোভাবে নাড়া দিলো নীরা। আস্তে আস্তে কাপা কাপা হাতে দ্বীপকে ঝাকানি দিচ্ছে আর বলছে,”ক্যাডার সাহেব উঠুন।সকাল হয়েছে তো।একটু পর আপনাকে কলেজে যেতে হবে।”
বার কয়েক ডাকার পর দ্বীপ চোখ খুলে।চোখ খুলেই নীরাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,”কি হয়েছে?”
“তারাতারি ফ্রেশ হয়ে আসুন।আপনাকে কলেজে যেতে হবে না?”
অবাক হলেও দ্বীপ চলে গেলো ফ্রেশ হতে।তারপর ঘরে আসতেই নীরা বলে,”এই নিন আপনার আর আমার জন্য নাস্তা এনেছি।একসাথে খাবো আমরা।”
কি হচ্ছে না হচ্ছে সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে দ্বীপের।এক থাপ্পড়ে কি নীরা বর পাগল হয়ে গেলো নাকি!কিছু না বলে খাটে বসলো দ্বীপ।নীরা এক প্লেটে সবজি নিয়ে তাদের মাঝখানে রাখলো।তারপর বলে,”এই নিন আমরা এক প্লেটে করে দুজনে খাবো।”
এমনি শীতের ঠান্ডা তার উপর নীরার এই রোমান্টিক কথাবার্তা শুনে শুকনো কাশি উঠলো দ্বীপের।বেচারা দ্বীপ একসাথে এতকিছু মেনে নিতে পারছে না।নীরা সাথে সাথে কুসুম গরম করা পানি ফ্লাক্স থেকে বের করে দ্বীপকে দিয়ে বলে,”এই নিন পানি।আপনার ঠান্ডার সমস্যা আছে।তাই আমি গরম পানি এনেছি।”
দ্বীপ চুপ করে পানি পান করলো।পানি পান করার পর দ্বীপ নীরার বানানো রুটিগুলো দেখলো।রুটির সেপগুলো দেখে দ্বীপ মনে মনে হাসতে থাকে।তার বউ পারে না তাও চেষ্টা করে এনেছে।এখন সরাসরি কিছু বললে কষ্ট পাবে।তাই চুপ করে নীরার সাথে এক প্লেটে রুটি ও সবজি খেলো।রুটি খেতে খেতেই দ্বীপ বলে,”একদম পারফেক্ট হয়েছে।সবজির ঝাল মশলা ঠিক ঠিক এবং রুটিও খেতে মজা হয়েছে।কিভাবে করলে?”
“আমি তো শুধু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সব করেছি।পরিমাণগুলো সব মামনি বলে দিয়েছিলো।”
বিয়ের পর থেকে নীরা দ্বীপের মা মিসেস সাবিনাকে মামনি বলে ডাকে। দ্বীপ খুশি হলো নীরা তার পরিবারকে আপন করে নিয়েছে।অবশ্য দ্বীপ জানতো নীরা এমনটি করবে।
খাওয়া দাওয়ার পর দ্বীপ আলমারি থেকে শার্ট ও ব্লেজার বের করতে যাবে ঠিক তখনই নীরা এসে তাকে একটি ব্লেজার পছন্দ করে বের করে দিয়ে বলে,”আজ থেকে আমার পছন্দ করে দেওয়া ড্রেস পড়েই যাবেন।”
দ্বীপ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝিয়ে দেয়। দ্বীপ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে নীরা বলে ওঠে,”আমাকে কোন কোন চেপটার মুখস্ত করতে হবে দেখিয়ে দিবেন না?”
এবার আর দ্বীপ থমকে থাকতে পারলো না।নীরার কাছে এসে নীরার কপালে হাত দিয়ে বলে,”থাপ্পড় খেয়ে কি জ্বর টর বাদিয়েছো?কি সব উল্টা উল্টা কথা বলছো!”
“ইশ থাপ্পড়ের পর হয়ে ঔষধ দিয়েছিলেন ওটাতে ঠিক হয়েছি।”মনে মনে কথাটি বলে সরাসরি বলে,”থাপ্পড়ের সাথে মনে হয় মধু মিক্সড করা ছিলো।তাই তো এখন থেকে বরের সেবা করা শুরু করছি। আর আমার স্বামী যে কি না বিসিএস ক্যাডার আবার প্রফেসর তার বউকে কি অমনোযোগী হলে মানায়?তাই আমিও আজ থেকে পড়াশোনাতে মনোযোগ হবো।”
খুশি হলো দ্বীপ।নীরার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,”পাগলী।”
তারপর নীরাকে সবকিছু দেখিয়ে বের হয় ঘর থেকে।ঘর থেকে বের হতেই নীরা আবার পিছন থেকে ডাক দেয় দ্বীপকে।বলে,”দাড়ান ক্যাডার সাহেব।”
ড্রয়িং রুমে মিস্টার সমুদ্র বাদে সবাই ছিলেন।মিস্টার সমুদ্র কাজে চলে গেছেন।নীরার ডাক শুনে সবাই তাকালো নীরা ও দ্বীপের দিকে।নীরা দ্বীপের কাছে এসে বলে,”টাই না বেধেই চলে যাচ্ছেন!আপনাকে এই লুকে টাই ছাড়া মানায় না।”
বলেই দ্বীপের কাছে এসে টাই বেঁধে দেয়।পিংকির দিকে তাকিয়ে নীরা শয়তানি হাসি দেয়।মূলত পিংকিকে দেখাতেই নীরা এই কাজ করেছে।
মিসেস শিউলি দুষ্টুমি করে বলেন,”কি আর করবে বলো নাতবৌ!আমার নাতি তো রসকষহীন মানুষ।বিদ্যা ছাড়া কিছু বুঝেই না।একদিনে বউয়ের এত সোহাগ ঠিক মাথায় সামলাতে পারছে না।তাই দু একটা ভুল করতেছে।”
তারপর দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মিসেস শিউলি বলেন,”দেইখো,ক্লাসে পড়ানোর সময় বউয়ের সেবাযত্ন গুলো মাথায় আইনো না।তাহলে আবার সব গুলায় ফেলবা।বউ তো আর কলেজে থাকবে না তোমাকে সব সংশোধন করে দেওয়ার জন্য।”
সবাই একসাথে হেসে ওঠে। দ্বীপ গলা খাকারি দিয়ে চলে যায়।
চলবে…?
#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৫
#ইশরাত_জাহান
🦋
দ্বীপ যাওয়ার পর নীরা মিসেস সাবিনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমার উনি এখন আমাকে পড়তে বলে গেছে।দুপুরের রান্না যখন করবে আমাকে একটু ডাক দিও আমিও রান্না করবো তোমাদের সাথে।”
মিসেস সাবিনা খুশি হয়ে বলেন,”থাক মা তোমাকে আপাতত এত কষ্ট করতে হবে না।তোমার উনি যা যা বলেছে তুমি তাই কর।তোমার আর কয়েকমাস পড়েই পরীক্ষা।ভালোভাবে পড়াশোনা করে তোমার ওনার মনের মত করে রেজাল্ট কর।”
নীরা লজ্জা পেয়ে রুমে যেতে নিলে পিংকি আবারও খোঁচা মেরে বলে,”ছোট ইচড়ে পাকা মেয়েকে বিয়ে করে আনলে এমনই হবে।মামী আজকে আমি তোমাকে সাহায্য করবো,চলো।”
নীরা কিছু বলতে যাবে দীপান্বিতা ইশারা করে না বুঝিয়ে দেয়।নীরার কানের কাছে এসে বলে,”ঘরের বউদের এত তর্ক করতে নেই।কিছু সময় চুপ থেকেও প্রতিবাদ করা যায়।তুমি যেয়ে পড়তে বসো আমরা দেখছি।”
দীপান্বিতার কথার প্রেক্ষিতে নীরা ঘরে এসে পড়তে বসে।প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দ্বীপের কল আসে নীরার ফোনে।নীরা কল রিসিভ করলে দ্বীপ বলে,”ঠিকভাবে পড়াশোনা করছো তো!নাকি এখন পারফেক্ট বউ হওয়ার জন্য দুপুরের রান্না করতে গেছো?
“বাবাহ,ক্যাডার সাহেব তো তার বউয়ের প্রতি অনেক যত্নশীল।বউকে রান্না বান্না করতেই দেয় না।এত ভালোবাসা বউয়ের প্রতি?”
“ভালোবাসার পরিমাপ কি আমি বাসায় এসে দেখিয়ে দিবো?”
লজ্জা পেয়ে নীরা বলে,”আমি সব পড়েছি। আর কিছু কিছু চেপটার বুঝিনি।ওগুলো আপনি এসে বুঝিয়ে দিবেন।”
“আচ্ছা,তাহলে রাখছি আমার নেক্সট ক্লাস নেওয়ার সময় হয়ে এসেছে।”
“আচ্ছা,বাই।”
কথা বলা শেষ করে দ্বীপ ক্লাসে চলে যায় আর নীরা দ্বীপের কথা ভাবতে থাকে।হঠাৎ নীরার মনে পড়ে দ্বীপের ডায়েরির কথা।সাথে সাথে বুকশেলফ এর বইগুলোর পিছনে লুকানো ডায়েরি বের করে পড়তে থাকে।
ডায়েরির সূচনা পৃষ্ঠাতে দ্বীপ নীরাকে নিয়ে অনুভূতির কথা কবিতা আকারে লিখেছিলো। আর বাকি পৃষ্ঠাতে লিখেছে নীরাকে কিভাবে দেখলো নীরার প্রতি কিভাবে ভালোবাসার জন্ম নিলো এগুলো।
প্রথম পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা পড়লো,
আজ থেকে আট বছর আগে
‘আমরা এসেছিলাম সপরিবারে।আমি আর বাবা ঢাকাতেই থাকতাম।মা আর দীপান্বিতা ছিলেন গ্রামের বাড়িতে।ঢাকার বাড়ি কমপ্লিট হওয়ার পর আমরা জিনিস পত্র নিয়ে যেদিন প্রথম এই বাড়িতে আসি দেখতে পাই~এক দশ বছর বয়সী মেয়ে হাতে ব্যাট নিয়ে তারা করতে থাকে এক টাকলা লোককে।মেয়েটির মুখে একটাই কথা,”বুইড়া ব্যাটা কত বড় সাহস আমার গাছের ফুল চুরি করে।তাও আবার গাছ থেকে ফুল নিয়ে আরেক বাসার মহিলাকে দেয়। তোরে তো আমি আজ শেষ করছি।ঘরে মেয়ে বউ থুয়ে অন্যের বউকে ফুল দেওয়া তাও আবার আমার লাগানো গাছ থেকে।লুচ্চা,টাকলা,বুইড়া দ্বারা বলছি।”
লোকটিও ভয়তে ভয়তে দৌড়াতে থাকে।অবশেষে না পেরে লোকটি ওখানে বসে হাফাতে থাকে।সেই সময় মেয়েটি এসে হঠাৎই চোখের পলকে তার কপালে ব্যাট দিয়ে দেয় এক বারি।লোকটির টাক মাথায় বসেছিলো আলুর চাক। যার ফলে এলাকার লোকজন সবাই এক হয়।মেয়েটির মা এসে মেয়েটির কান ধরে দেয় এক টান।জিজ্ঞাসা করেন,”কেনো করেছো তুমি এমন কাজ?”
মেয়েটি লোকটির বউ ও মেয়ে সহ পুরো এলাকার সামনে বলে,”দুই দুইটা অন্যায় করেছে।এক ঘরের মেয়ে বউ বাদ দিয়ে অন্যের বউকে ফুল দেয়,দুই সেই ফুল আবার আমার গাছ থেকে ছিঁড়ে নেয়।”
দুই নম্বর অন্যায়ের কথা মানুষ পাত্তা না দিলেও এক নম্বর অন্যায়ের জন্য টাক মাথায় চাক বসানো লোকটির কাছে ব্যাট নিয়ে হাজির হলো তার বউ।কোমরে শাড়ি গুঁজে হাতে ব্যাট নিয়ে এবার সেই বৃহৎ করে দিলো ক্ষুদ্র আলুর চাক।’
নীরা এইটুকু পড়ে হাহা করে হাসতে থাকে।নীরা বুঝতে পেরেছে এটা তাকে নিয়ে বলছে।ছোটবেলায় এমন দুষ্টুমি ও অন্যায়ের প্রতিবাদ নীরা সবসময় করে।নীরাকে মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন বড় করেছেন সমাজের সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে।আশেপাশে কোন কোন মানুষ ভালো কোন কোন মানুষ খারাপ এগুলো সবকিছু কিভাবে বুঝতে হয় এটা নীরাকে ছোট বেলাতেই শেখানো ছিলো।একজন লোক মেয়েদের সাথে কিভাবে কথা বলে কোনটা কোন ইঙ্গিতে বলে এই সবকিছু মিসেস নাজনীন নীরাকে শিখিয়ে দিতেন।সমাজে যে ভালো মানুষের রূপের আড়ালেও নরপশু থাকে এটা উপলব্ধি না করলে মেয়েরা সচেতন হতে পারবে না।তাই প্রত্যেক পরিবারের উচিত মেয়েদের বয়স হওয়ার আগেই তাদের নিজেদের সচেতনতার দিকগুলো বুঝিয়ে দেওয়া।
ওপর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা পড়ে,
আজ প্রাইভেট পড়াতে যাব ওই সময় দেখলাম মেয়েটি রাস্তার এক ছেলেকে ধরে মারছে।বুঝতে পারলাম না কেনো এমন করছে।আহত অবস্থায় ছেলেটিকে দেখলে মায়া লাগে।মেয়েটি একা না সাথে তার বান্ধবীও মারতে থাকে ছেলেটিকে।আশেপাশে থেকে লোক জড়ো হয়।রাস্তার পাশের বাড়ি থেকে একজন লোক এসে জিজ্ঞাসা করে,”তুমি এভাবে নিষ্ঠুরভাবে ওকে মারছো কেনো?গরীব ঘরের ছেলে দিন আনে দিন খায়।তাকে কেউ এভাবে মারে?”
মেয়েটি রেগে বলে ওঠে,”গরীব ঘরের ছেলে চুরি করলে দিন এনে দিন খাবে না তো কি করবে?”
লোকটি বুঝতে পারে না কথাগুলো।তাই বলে,”মানে?”
“মানে এই যে এই নিরীহ গরীব দিন এনে দিন খাওয়া ছেলেটি আপনার বাড়ির জানালা থেকে আইফোন চুরি করেছে।আপনি যদি বলেন তাহলে আমি এই চোরকে না মেরে আপনার ঘর থেকে আনা দিন তাকে খাওয়ার সুযোগ করে দেই!”
মেয়েটির কথা শেষ হতে না হতেই এবার লোকটি ছুটতে লাগলো ওই চোরের পিছনে।এসব দৃশ্য দেখে যেমন মুগ্ধ হতাম ঠিক তেমন হাসতেও থাকতাম।একটি মেয়ে যেমন প্রতিবাদ করে তেমন হাসাতেও পারে।তবে তখনও আমি মেয়েটির প্রতি ভালোবাসা ফিল করতে পারিনি।শুধু একটু ভালোলাগা কাজ করেছিলো।
মাঝখানের কিছু পৃষ্ঠা নীরাকে নিয়ে এমন আরও কিছু লেখা ছিলো।এগুলো পড়ে নীরা নিজেই হাসতে থাকে।কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা পড়ে,
আজ মেয়েটির ভাই জার্মানে চলে যাচ্ছে।দেখতে দেখতে যে কিভাবে তিনটি বছর হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না।মেয়েটির বাঁদরামি একটু কমেছে কিন্তু প্রতিবাদ সে সবসময়ই করে।
রাতের আধারে আমি ব্যালকনিতে বসে পড়ছিলাম।ঠিক সেই সময় দেখি মেয়েটি চাঁদের সামনে দাড়িয়ে কান্না করতে থাকে।সারাদিনে একবারও মেয়েটি কান্না করেনি।কিন্তু রাতের বেলা চাঁদকে সাক্ষী রেখে সে ভাইয়ের জন্য কান্না করতে থাকে।মনের ভিতর তখন একটি কথাই ভেসে আসে,
“রাতের আধারে চন্দ্রকে করো তুমি সাক্ষী,
তোমাকে হইতে দেখেছি আমি উড়ন্ত পাখি।
চন্দ্রকে দেখাও তোমার চোখের পানি,
গোপনে খেলতে থাকি আমি তোমার সাথে লুকোচুরি।
চন্দ্রের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে এক পাখি,
তখনই আমার হৃদয়ে তোমার নাম লিখেছি আমি আমার চন্দ্রপাখি।
তুমি গোপনে রাখিয়াছো তোমার অশ্রুকণা,
আমি তো তাহাতেই হইয়াছি মন ভোলা।
ছুতে না পেরেও গোপনে দেখি তোমারে অল্প সল্প,
তাই তো দিয়েছি আমি আমার প্রেমের নাম লুকোচুরি গল্প।”
‘লুকোচুরি গল্প’ কথাটি নীরা পড়ছে না বরং কথাটি নীরার কানে বারবার বাজতে থাকে।দ্বীপ তাকে গোপনে এত ভালোবাসে যে যেদিন প্রথম কান্না করতে দেখে সেদিনই তার জন্য মনে মনে কবিতা লিখে।কবিতার নিচে লেখা,’ চন্দ্র পাখির চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারছি না।মন চায় এখনই ছুটে যাই তার কাছে।কিন্তু না সাহস করে উঠতে পারিনি।এখনও আমি বেকার আর চন্দ্র পাখির সাথে আমি টাইম পাস করতে চাই না।আমি চাই চন্দ্র পাখি আমার কাছে হালালভাবে আসুক।’
এরপর আরো কিছু পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা পড়ে,
আজ আমি চাকরি পেয়েছি। চন্দ্র পাখি আসার আগে আমার জীবনের উদ্দেশ্য ছিলো একজন ভালো শিক্ষক হওয়া।এই শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা আমারই কলেজের শিক্ষক থেকে এসেছে।মানুষ তো মানুষকে দেখেই নতুন কিছু হওয়ার ইচ্ছা জাগ্রত করে।ঠিক তেমন আমিও করলাম।ভাগ্য আমাকে আর কোনো জায়গায় না আমার চন্দ্র পাখির কলেজেই সুযোগ করে দিলো।চন্দ্র পাখিদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক অবসর প্রাপ্ত হওয়ায় আমাকে এখন ওই ডিপার্টমেন্টে যেতে হয়।ক্লাসে পড়ানোর সময় আমি সিরিয়াস থাকতাম।কিন্তু চন্দ্র পাখি থাকতো অমনোযোগী।আমি চন্দ্র পাখির সবকিছু সহ্য করতে পারলেও এই একটি বিষয় সহ্য করতে পারতাম না।পড়াশোনাতে এমন অবহেলা আমার আগা গোড়ায় অপছন্দের দিক।ক্লাসের ভিতর একজন এমন হলে তাকে আশকারা দিলে বাকিরা পেয়ে বসবে।তাই চন্দ্র পাখিকে পানিশমেন্ট দিতে বাধ্য হতাম।
চন্দ্র পাখি পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়াতে আন্টির যেনো চিন্তা বেড়ে গেলো।এমনি একবার এসএসসি ফেইল করে।তখন আমারও রাগ হয় খুব।কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলি না।আন্টির রিকোয়েস্টে আমি পড়াতে থাকি চন্দ্র পাখিকে।আমার ইচ্ছা ছিলো না পড়ানোর।কারণ এমনিতেই আমি তার কলেজের শিক্ষক এখন আবার হয়ে গেলাম প্রাইভেট শিক্ষক।কিন্তু আমার মা এবং আণ্টি(মিসেস নাজনীন)এর অনুরোধে না করতে পারি না।
টেনশন যেনো মাথায় উঠে ঘুরপাক খাচ্ছে।যাকে নিয়ে টানা সাত বছর করেছি লুকোচুরি প্রেমের অনুভূতি,আজ সেই হতে গেলো আমার দুই দিকের ছাত্রী।
এইটুকু পড়ে নীরার যেনো হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা শুরু হলো।তারপর শেষের দিকে এসেছে।সেখানে লেখা,
আজকে পিংকি গ্রামে যাবে।এতদিন পড়াশোনার নাম করে খুব জ্বালিয়েছে।যেহেতু ও পড়াশোনার জন্য আমার কাছে আসতো তাই না করতে পারতাম না।বাধ্য হয়ে পড়াতাম পিংকিকেও।পিংকি গ্রামের যাওয়ার আগে ফুফি ও পিংকির কিছু কথা আমি আড়ালে শুনতে পাই।
পিংকি ফুফিকে বলে,”দ্বীপ বেইবের জব তো হয়ে গেছে। এখন মামাকে বলে বিয়ের ব্যাপারটা ফাইনাল করে দেও।আমি যে দ্বীপ বেবীর জন্য অপেক্ষা করতে পারছি না।”
“হ্যা হ্যা খুব তাড়াতাড়ি বলবো। তোর চাচাতো ভাইয়ের মেয়ের আকীকা শেষ করে এসে তোর আর দ্বীপের বিয়ের ব্যাবস্থা করবো।তুই দ্বীপকে পাবি আর আমি পাবো সম্পত্তি।”
এগুলো শুনেও আমি তখন কোনো প্রতিবাদ করিনি।শুধু পিংকি ও ফুফির যাওয়ার অপেক্ষা করেছি।ওরা চলে যাওয়ার পর পরই আমি মাকে আমার মনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করি।সাথে পিংকি ও ফুফির প্ল্যানগুলো।এসবকিছু শুনে মা বাবা ও দীপান্বিতা আমার আর চন্দ্রপাখির বিয়ে ঠিক করে।আমি বুঝতে পারিনি আণ্টি এত সহজেই রাজি হবেন।বিয়ের সময় চন্দ্র পাখি আমাকে অনেকভাবে বুঝিয়ে দিতো যে সে বিয়েটা করতে চায় না।কিন্তু আমার জীবনে চন্দ্র পাখিকে নিয়ে অনেক আগেই বাসা বেধে রেখেছি।তাই যত পারতাম চন্দ্র পাখিকে এড়িয়ে যেতাম।এমন যদি হতো আমার চন্দ্র পাখি অন্য কারোর প্রতি মত্ত আমি নিজে সরে আসতাম।কিন্তু চন্দ্র পাখি তো পাগলামির জন্য বিয়েটা ভাঙতে চায়।সেখানে আমি কি করে হতে দেই আমার চন্দ্র পাখিকে আমার থেকে দূরে?দিন শেষে ভালোবাসার জালেই হার মানতে হয়েছে আমাকে।আমি ভালোবাসি খুব ভালোবাসি আমার চন্দ্র পাখিকে।শিক্ষক হয়েছি আমি এই দুই বছর ধরে কিন্তু ভালো তো বেসেছি আমি টানা আট বছর ধরে।
বিয়ের সময় গায়ে হলুদের দিন আমার ঘরে কেয়া আসে।হলুদের কিছু জিনিস নিতে।ভুল বশত আমি ডায়েরিটি টেবিলে রেখে যাই।কেয়া পড়ে নেয় আমার এই ডায়েরি।তখন থেকে সেও আমাকে সাহায্য করতে থাকে আমার আর চন্দ্র পাখির বিয়ের জন্য।এই বিয়েতে যত বাধা বিপত্তি পেরিয়েছি সব আমার বুদ্ধিতেই হয়েছে।কিন্তু আমার চন্দ্র পাখি জানতেই পারবে না তার অগোচরে তাকে কেউ ভালোবাসে।আমার এই লুকোচুরি প্রেমে থেকে যাবে আমার লুকোচুরি গল্প।’
এরপর আর কিছু লেখা নেই।হয়তো ব্যাস্ততার জন্য বিয়ের পর লিখতে পারেনি দ্বীপ।ডায়েরি বন্ধ করে নীরা বলে,”আপনার এই লুকোচুরি গল্প সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছে আপনার চন্দ্র পাখি। মাই ডিয়ার ক্যাডার সাহেব।”
চলবে…?