#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১২
#ইশরাত_জাহান
🦋
সবাইকে জামা কাপড় দিয়ে দ্বীপ ও নীরা ঘরে চলে আসে।নীরা মাথার হিজাব খুলতে থাকে।দ্বীপ হাত ঘড়ি খুলে গলার টাই হালকা লুজ করতে করতে বলে,”আর ইউ জেলাস?”
হাত আটকে যায় নীরার।দ্বীপের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,”কেনো?জেলাস হবো কেনো?”
“পিংকি আমার আশেপাশে আসলেই তুমি যেভাবে প্রতিবাদ করো মনে তো তাই হচ্ছে।”
“আপনার বুঝি ভালো লাগে ওই পিংকি আপনার গায়ে গায়ে চললে?”
“কথা সেটা না,কথা হলো তুমি কেমন ফিল করো?”
“আমি আবার কেমন ফিল করবো!কোনো ফিলই করি না।”
বলেই হিজাব খুলে আলমারি থেকে বাসায় পরার জামা নিতে থাকে।দ্বীপ আবারও জিজ্ঞাসা করে,”তাহলে প্রতিবাদ করো কেনো?”
নীরা জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের ভিতরে যায়।ওয়াশরুমের দরজা দিতে যেয়েও দরজা হালকা ফাঁকা রেখে বলে,”আমার কোনো জিনিস যখন আমার হয়েই পার্মানেন্ট থাকে আমি তা অন্য কাউকে ভাগ করি না।আপনি এখন আমার হয়ে গেছেন ক্যাডার সাহেব।আপনার প্রতি অন্য কোনো নারী আসক্ত হলে তাকে তো একটু ভুক্তে হবে।”
বলেই দরজা লাগিয়ে দেয় নীরা।দ্বীপ স্মিত হাসে।বিড়বিড় করে বলে,”চন্দ্রপাখি তার ক্যাডার সাহেবের প্রতি আসক্ত হচ্ছে।এটা সে বলবে না কিন্তু অন্য নারীকেও আসক্ত হতে দিবে না।নারীপ্রেম বুঝি একেই বলে!”
আজ বিকালে নীরা দীপান্বিতা ও মিসেস সাবিনা মিলে নাস্তা তৈরি করতে থাকে।নীরাকে আজকে ছুটি দিয়েছে দ্বীপ।বিয়ের পরেরদিন থেকেই তো বই পড়া শুরু করেছে সে।আজকের দিন রেস্ট করার সুযোগ পেলো নীরা।সন্ধায় নাস্তা বানিয়ে সবাই মিলে খাবে।সবাই কাজ করছে আর নীরা উকি দিয়ে দিয়ে দেখছে।নীরা রান্না বান্না পারে না।তাই তাকে কেউ রান্না করতেও দিচ্ছে না।
পিংকি নীরার এই দুর্বলতার সুযোগটি নিয়ে নিলো।সাথে সাথে বলে,”বাড়ির বউ হয়ে কি না রান্না পারে না!কেমন মেয়ে বিয়ে দিয়ে এনেছো তোমরা?”
দীপান্বিতা বলে ওঠে,”আমাদের তো সমস্যা নেই।তোর এত কেনো সমস্যা?”
“আমার কোনো সমস্যা নেই।দেখি আমি একটু রান্না করি।দ্বীপ বেইবী তো পাস্তা খেতে খুব ভালোবাসে।আমি রান্না করবো ওর জন্য।বউ তো রান্না পারে না আমি নাহয় করে দেই রান্না।”
পিংকি দ্বীপকে সবসময় এই বেইবী বলে ডাকতো।এখনও তাই বলে।
রাগে দুঃখে অপমানে জেলাসিতে সবকিছুতেই ফেটে পরলো নীরা।সাথে সাথে বলে,”আজকের পাস্তা আমি রান্না করবো।”
পিংকি হো হো করে হেসে দিয়ে বলে,”যে মেয়ে মুখে লিপস্টিক মেকআপ দেওয়া ছাড়া কোনো কাজ পারেনা সে মেয়ে আবার করবে রান্না।ওটা তোমার কাজ নয়।তুমি ঘর সংসার সামলাতে পারবে না।”
“আমি বলছি আমি রান্না করবো মানে করবো।এখন যদি আমাকে রান্না করতে না দেও তো..”
বলেই আশেপাশে তাকিয়ে করাই থেকে গরম খুন্তি হাতে নিয়ে বলে,”এই গরম খুন্তি দিয়ে তোমার মাথা ফাটাবো বলে দিলাম।ভালোয় ভালোয় বলছি আমার ক্যাডার সাহেবের জন্য রান্না করবি না তুই ডাইনি।ওনার জন্য এই নীরা আছে।”
কে আর কি বলবে!নীরার রণচন্ডি রূপ দেখে সবাই হা হয়ে আছে।দ্বীপ এখন একটু বাইরে গেছে।তাদের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট দেখতে। অভ্র হাত তালি দিয়ে বলে,”ঠিক হয়েছে,ঠিক হয়েছে।”
পিংকি ভয়তে দেয় দৌড়।এই মেয়ের পুরনো কিছু রেকর্ড আছে যা পিংকি খুব ভালো করেই জানে।শুধু শুধু বাঘিনীকে খেপিয়ে লাভ নেই।
পিংকি চলে যেতেই নীরা ইউটিউব দেখে পাস্তা রান্না শুরু করে। পাস্তা রান্না শেষে সবকিছু পরিষ্কার করে নিজের ঘরে যায়।দীপান্বিতা ও মিসেস সাবিনাও ঘরে যায় ফ্রেশ হবে বলে।এই সুযোগে পিংকি আসে রান্না ঘরে।এসেই পাস্তায় প্রচুর লবণ ও ঝাল মিশিয়ে দেয়।তারপর চলে যায় ঘরে।
নীরার ফোন ড্রয়িং রুমে ছিলো।অভ্র তখন ড্রয়িং রুমে আসে টিভি দেখবে তাই।ঠিক তখনই নীরার কল আসে।নীরব দেয় কল।অভ্র প্রথম কল আসাতে রিসিভ করে না।কিন্তু দুই তিনবার কল আসাতে রিসিভ করে বলে,”হেলো।”
নীরব বুঝতে পারে এটা অভ্র।পিচ্ছি কণ্ঠ আর এখন তো নীরা দ্বীপের বউ।দ্বীপের বাসায় অভ্র থাকবে এটা স্বাভাবিক।কিন্তু এতদিন কেনো আছে তাই বুঝতে পারছে না।দীপান্বিতা কি শশুর বাড়িতে যায় না?এটা এখন তাদের ব্যাপার।ভেবেই নীরব বলে,”আমি নীরব। নীরার ভাই হই।নীরাকে দেওয়া যাবে এখন?”
“মামী তো ঘরে গেছে ফ্রেশ হতে আর মামু একটু পরে আসবে।”
ঠিক সেই সময় দীপান্বিতা এসে বলে,”কার সাথে বলছো বাবাই?”
“মামীর ভাইয়া ফোন দিয়েছে আম্মু।এই নেও কথা বলো।বলেই ফোনটি দীপান্বিতার কানে দিলো অভ্র।”
আম্মু বলে সন্মোধন শুনে নীরবের মনের গহীনে কাপন ধরলো।খারাপ লাগছে তার।কিভাবে পারলো তার জন্য অপেক্ষা না করে এভাবে বিয়ে করে নিতে?দীপান্বিতা ফোন কানে নিয়ে নরম সুরে বলে,”হেলো।”
কি সুন্দর মধুর কণ্ঠ বাজতে থাকে নীরবের কানে।দীর্ঘ সময় পর আজ তারা একসাথে কথা বলতে পারছে।কিন্তু এখন তো আর আগের সম্পর্ক নেই।নীরব কাটকাট গলায় বলে ওঠে,”বোনকে বলবেন ফ্রী হলে যেনো কল দেয়।”
বলেই কল কেটে দিলো।এতগুলো বছর পর প্রিয় ব্যাক্তির কণ্ঠ শুনে শান্তি পেলেও কথার সুরে তিক্ততা অনুভব করলো দীপান্বিতা।পাল্টে গেছে তার খাদ্য বিশেষজ্ঞ পুরুষটি।নীরবের ছোট থেকে একজন নিউট্রিশন স্পেশালিস্ট হওয়ার ইচ্ছা।তাই দীপান্বিতা নীরবকে খাদ্য বিশেষজ্ঞ সাহেব বলে ডাকতো।
দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্র একসাথে চলে এসেছেন।সবাই মিলে নাস্তা সাজাতে থাকে।নীরা বাটিতে বাটিতে সবার জন্য পাস্তা দেয়।পিংকি মনে মনে অনেক খুশি। দ্বীপ ঝাল সহ্য করতে পারে না।নীরার বানানো খাবার খেয়ে দ্বীপ শিওর নীরাকে বকাঝকা করবে।
সবাই একসাথে পাস্তার খেতে থাকে।প্রথম এক চামচ খেয়ে সবাই নীরার দিকে তাকায়।পিংকি খুব খুশি এবার বোম ব্লাস্ট হবে।পিংকির আসায় পানি ঢেলে অভ্র বলে,”মামী খুব মজা।”
মিসেস সাবিনা বলেন,”হ্যা সবকিছুই ঠিকঠাক আছে শুধু সস একটু কম দিলে হতো।তাও প্রথম রান্না হিসেবে তুমি অনেক ভালো করেছো।”
সবাই নীরার প্রশংসা করতে থাকে।পিংকি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এদের দিকে।নীরা পিংকির দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হয়েছে!কিছু বুঝতে পারছো না তাইতো?”
সবাই তাকায় নীরা ও পিংকির দিকে।পিংকি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে।নীরা আবার বলে,”তুমি আমার ব্যাপারে শুধু মেকআপ করার অভিজ্ঞতা টাই জানলে!এটা জানলে না যে আমি সিনেমা প্রেমী।জীবনে কত নাটক সিনেমা দেখেছিলাম যেখানে এক ডাইনি এসে নায়িকার সমস্ত খাবার নষ্ট করে দেয়।তুমি হলে আমার জীবনের সেই ডাইনি।আমি কি আর জেনে শুনে বকা খাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারি?তাই আগেভাগে খাবার সরিয়ে রাখি। আর তোমার বাটিতে যেই পাস্তা ওটা তোমার হাতের ঝাল মশলা যুক্ত।অভ্র দেখে নিয়েছে তুমি কি কি করেছিলে।এবার ভদ্র মেয়ের মতো নিজের হাতের টেস্টি পাস্তা খেয়ে নেও।”
“আমি পাস্তা খাবো না।অন্য খাবার খাবো।তোমার মন চাইলে তুমি খাও।কি প্রমাণ আছে যে আমি এটাতে ঝাল লবণ দিয়েছি?”
“প্রমাণ অভ্র নিজে।ছোট বাচ্চা তো আর মিথ্যে বলবে না।খেয়ে নেও আমার ডাইনি ননদিনী।এটা এখন তোমাকেই খেতে হবে।”
বলেই নীরা পাস্তার বাটি নিয়ে পিংকির কাছে আসতে থাকে।পিংকি এবার চেয়ার থেকে উঠে দেয় ভো দৌড়।নীরা কি কম নাকি?সেও পিংকির পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,”একবার যখন আমার খাবার নষ্ট করতে চেয়েছিলি তার টেস্ট তো তোকে নিতেই হবে ডাইনি ননদিনী।পালাবে কোথায় আমি নীরা যখন একবার লেগেছি তোমার পিছনে তখন তোমার রেহাই নেই।আমার বরের সাথে সুপার গ্লুর মতো লেগে থাকা তাই না?এবার দেখ সুপার গ্লুর উপরে কি কি আছে।”
বলেই সারা রুম জুড়ে তারা করতে থাকে পিংকিকে।অবশেষে পিংকির দৌড়ানোর সাথে উড়ন্ত ওড়না ধরে ফেলে নীরা।তারপর সোফায় পিংকিকে শুইয়ে দিয়ে গাল টিপে হা করিয়ে পিংকির গালে ঢুকিয়ে দেয় পাস্তা।পিংকি বেচারি কষ্ট করে হলেও গিলতে থাকে।টেবিলে বসা দ্বীপ মাথায় হাত দিয়ে এদের কর্মকাণ্ড দেখে।
দীপান্বিতা দ্বীপকে আস্তে আস্তে বলে,”কে বলবে এই মেয়ে বিয়ের দিন পালিয়েছিলো?বিয়ে করবে না বলা মেয়েটি কি না এখন সেই স্বামীর ভক্ত।”
মনে মনে খুশি হয় দ্বীপ।নীরা একদম ঠিক কাজ করেছে।পিংকি যেমন তাদের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে ঢুকে পড়ছে এতে ওর এই শাস্তির দরকার।দ্বীপ নিজেও সহ্য করতে পারে না পিংকিকে।খুব তাড়াতাড়ি পিংকির জন্য ছেলে দেখা শুরু করবে।
চলবে…?
#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৩
#ইশরাত_জাহান
🦋
নাস্তা শেষ করে নীরা ঘরে আসে।দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্র মিটিং করছেন নিজেদের ব্যাবসা নিয়ে।দ্বীপ বাবার ব্যাবসায় যোগ না দিলেও বিভিন্ন পরামর্শে বাবার সাথে থাকে।
নীরা ঘরে এসে ঘরটিকে ভালোভাবে পরখ করে।দ্বীপের ঘরের পাশে একটি বড় শেলফ আছে যেখানে ভিন্ন ভিন্ন গল্পের বইতে ভরা।বিসিএস এর বইগুলো এখনও সাজানো আছে।নীরা শেলফের কাছে এসে বইগুলো দেখতে থাকে।নীরা নিজেও টুকটাক গল্প পড়ে।শেলফের ভিতর ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে একটি কালো মোটা ডায়েরি দেখতে পেলো দ্বীপ।ডায়েরিটি দেখে নীরার মনে আতঙ্ক বিরাজ করলো।সাথে সাথে ডায়েরিটি হাতে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা বের করলো।অনেক পুরনো লেখা এখানে।খুব সুন্দর করে প্রথম পৃষ্টায় লেখা,
চন্দ্রের সাথে করিতে দেখিলাম তোমাকে আলিঙ্গন।
উড়ন্ত পাখি যখন চন্দ্রকে সাক্ষী রেখে প্রকাশ করে মনের অনুভূতি।
সেই চিত্র দেখিয়া তোমাকে ডাকিলাম ‘আমার চন্দ্রপাখি’।
অশ্রু ভরা নয়নে চন্দ্রের দিকে ফিরে আছে আমার সেই কিশোরী কন্যার অনুভূতি।
আজই উপলব্ধি করেছি আমি,
ভালোবাসি ভালোবাসি তোমায় আমার চন্দ্রপাখি।”
লেখাটুকু পড়ে নীরা বুঝলো দ্বীপ কাউকে ভালোবাসে এবং তাকেই সে চন্দ্রপাখি বলে ডাকে।কিউরিসিটি নিয়ে বাকি পৃষ্ঠা পড়তে যাবে ঠিক তখনই দীপান্বিতা এসে বলে,”আমার লিটিল ভাবী আসবো কি?”
নীরা ডায়েরির পাতা বন্ধ করে শেলফে রেখে দেয়।তারপর দীপান্বিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার সুইট কিউট ননদিনী আসো।”
দীপান্বিতা ঘরে ঢুকে নীরার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,”তোমার কল এসেছিলো। আর ফোন সবসময় এদিক ওদিক রেখো না।জানোই তো না চাইতেও এক কালসাপ পুষতে হয়।আমার দাদীন আম্মু এরা তো সুখে ছিলোই না এবার উঠে পড়ে লেগেছে তোমার পিছনে।নিজের সেফটি নিজেকে বুঝতে হবে।দাদাইয়ের কথা রাখতে বাবা এগুলো সহ্য করে।যতই হোক দাদাই তো বাবার বাবা ছিলেন।রক্ত ধোঁকা দিলেও রক্তের টান ফিকে হয় না।আমার বাবা তার প্রমাণ।তাই বলছি যতটুকু পারো নিজের জিনিসগুলোর প্রতি যত্নশীল হও।”
“পিংকি এখন কেমন আছে?”
“আমি ওকে লেবুর রস খাইয়ে দিয়েছি।ঝাল কমেছে অনেকটাই।এখন ঘুমিয়ে আছে।তোমার খাদ্য বিশেষজ্ঞ ভাই কল দিয়েছিলো অনেক আগে।বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।টেবিল পরিষ্কার করার সময় তোমার ফোন দেখে মনে পড়লো।এই নেও।”
বলেই দীপান্বিতা ঘর থেকে বের হতে নিবে কিন্তু নীরার কথায় থমকে গেলো।নীরা বলে ওঠে,”আমার ভাইয়ের কথা উঠলে তোমার গলা কাপে কেনো?অন্য সময় কথা বলতে গেলে তো এমন হয় না!”
দীপান্বিতা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে হয়তো।তেমন কিছুই নেই আমার গলার ভিতর।অন্যদের বেলায় যেভাবে কথা বলি তোমার ভাইয়ের বেলায়ও সেভাবেই কথা বলি।”
বলেই প্রস্থান করে দীপান্বিতা।দীপান্বিতা পিছন ফিরে কথা বললেও আয়নায় দীপান্বিতার চোখের পানি দেখতে পায় নীরা। বুকশেলফ এর পাশেই যে আড়াআড়িভাবে আয়না রাখা আছে।সেখানে দীপান্বিতার এক পাশ খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে।দীপান্বিতার চোখ থেকে বের হওয়া অশ্রুর রহস্য বুঝতে পরলো না।কিন্তু কিছু একটি কাহিনী তো আছে এবং তা ভালোবাসার পর্যায়ে এটা উপলব্ধি করতে পারছে নীরা।
বেশি কিছু না ভেবে নীরবকে কল দেয়।সাথে সাথে কল রিসিভ করে নীরব।বোনকে দেখে বলে,”তোর জন্য একটি সারপ্রাইজ আছে শুধু তুই না বাসার সবার জন্য।বলতো কি সেই সারপ্রাইজ?”
“ক্যাডার সাহেবকে বিয়ে করে যে সারপ্রাইজ হতে হয় তাতে তোমার দেওয়া নতুন সারপ্রাইজ মাথায় আসছে না।তুমিই বলে ফেলো।”
হো হো করে হেসে দেয় নীরব।দ্বীপকে নীরব ভালো করেই জানে।একসাথে প্রায় চায়ের দোকানে আড্ডা জমাতো।নীরব যেতো দীপান্বিতার হয়ে দ্বীপকে পটাতে। বড় ভাই পটে গেলে আর তো কিছুই লাগে না।কিন্তু দ্বীপ তার বিদ্যাসাগর নিয়ে কথা বলতো বেশি।এখন সে বুঝতে পারছে নীরাকেও ঠিক কিভাবে ট্রিট করে।রসকষহীন বই পড়ুয়া দ্বীপ আর তার উড়নচণ্ডী ফাঁকিবাজি বোন যেনো বইয়ের এপিঠ ওপিঠ।নীরব হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,”আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে অনেক আগে।আজ রেজাল্ট পাবলিক হয়েছে।আমি সাকসেস হয়েছি বোন।আমার এত বছরের কষ্টের ফল পেয়েছি। আর তোদের থেকে দূরে থাকছি না।এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাক করছি।”
ভাইয়ের কথা শুনে নীরা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।সাথে সাথে বলে,”হুররে আমার ভাই খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে।”
কিছুক্ষণ মজা করে দীপান্বিতার কথা মনে পড়লো নীরার।তাই সে নীরবকে ইন্ডিরেক্টলি বলে,”তুমি বিডিতে আসার পর আমরা তোমার জন্য মেয়ে দেখবো।রূপবতী গুনবতী কর্মঠ ভদ্র দেখে মেয়ে নিয়ে আসবো।যেমনটা তুমি চাও।জাস্ট এক্সাম্পল আমার কিউট ননদ দীপান্বিতা আপু।তার মতো দেখে বউ পেলে খুশি হবে তো?”
নিজের বিয়ের কথা শুনে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে নীরবের।আবার তারউপর দীপান্বিতার নাম নিয়ে উদাহরণ।পুরো দীপান্বিতাকেই তো তার চাই।তার মতো আবার কি!কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর করলো না নীরব।লোক দেখানো এক স্মিত হাসি দিয়ে নীরব বলে,”সবে তো পড়াশোনা শেষ এখন সেটেল হয়ে নেই।তারপর দেখা যাবে।রাখছি বোন,ভালো থাকিস।”
ভাইয়ের শুকনো মুখ দেখে নীরা শিওর হলো ডাল মে কুছ কালা হে।কল কাটার পর বলে,”ভাই আর ননদের কেমিস্ট্রি খুব গভীর।আমাকে এখন ডিটেকটিভ নীরা হতে হবে।কি থেকে কি হয়েছে এগুলো আমাকে বের করতে হবে।সাথে আবার আছে ক্যাডার সাহেবের ওই চন্দ্রপাখি।কতকিছু সম্পর্কের গোয়েন্দা গিরি করবো আমি!উফ এত প্রেসার নেওয়া যায় না।”
“কিসের প্রেসার নেওয়ার কথা বলছো তুমি?”
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে দ্বীপ।নীরা তাকায় দ্বীপের দিকে।আপাতত এনাকে কিছু বলা যাবে না।ইনি থাকুক ইনার বিদ্যা নিয়ে।
“কিছুই না।এই যে আর আড়াই মাস পর আমার এক্সাম।এখন তো স্যার আমার স্বামী তাই তার শুনাম রাখতে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।এটাই ভাবছি।”
“বাব্বা এত চিন্তা আমার জন্য?”
উত্তর দেয় না নীরা।সাথে সাথেই কেয়ার কল আসে।নীরা রিসিভ করে বলে,”হ্যা বল!”
“দোস্ত আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান হবে।সবাই শাড়ি পড়বো। আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আছে।আমি নৃত্যে নাম দিবো।তুই কি করবি?”
“আমি কি করবো মানে?আমিও নৃত্য করবো।”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসার আগে নীরার কান থেকে ফোনটি নিয়ে দ্বীপ বলে,”ও কোনো নৃত্য করবে না।যাবে বক্তৃতা শুনে চলে আসবে।”
বলেই কল কেটে দেয়।কেয়া ভয় পায় দ্বীপের কর্কশ কণ্ঠ শুনে।দ্বীপ ফোন কাটার পর বলে,”সাইকো স্যার।”
নীরা কোমরে হাত দিয়ে দ্বীপের দিকে ডান ভ্রু উচু করে তাকিয়ে বলে,”আমি নৃত্য করলে আপনার সমস্যা কোথায়?”
“আমি বলেছি তো তুমি নৃত্য করবে না মানে করবে না।”
“আমি নৃত্ততে নাম দিবো এবং নৃত্য করবো।”
“আমি বলেছি তো না।”
“হ্যা দিবো নাম।আমি নাকি কোনো কিছু পারি না।অযোগ্য তাহলে নৃত্য করে দেখিয়ে দেই আমার কি কি যোগ্যতা আছে।”
“তোমাকে যতটুকু যোগ্য হওয়া লাগবে তা আমি দেখে নিবো।ভালোভাবে বলছি কোনো নৃত্য করতে পারবে না তুমি।”
“আমি নাম দিবো দিবো দিবো।”
কিছুটা চিল্লিয়ে বলে নীরা।ব্যালান্স হারা হয়ে দ্বীপ ঠাস করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় নীরার গালে।নীরা অবাক হয়ে যায়।এতদিন থাপ্পড় দিলেও অন্তত বুঝতো পড়াশোনার জন্য কিন্তু আজকের থাপ্পড় কি না সামান্য এক অংশগ্রহণের জন্য।এটাও নীরার সমস্যা না।সমস্যা হলো দ্বীপ ও নীরার কথাগুলো দরজার পাশে থেকে পিংকি আরি পেতে শুনতে থাকে।এখন দ্বীপ তাকে থাপ্পড় দিয়েছে এটাও পিংকি দেখে খুশি হয়।সবকিছু নীরা ভালোভাবেই লক্ষ্য করে কিন্তু দ্বীপ উল্টোদিকে ফিরে ছিলো বলে পিংকিকে দেখে না।
নীরা বাম গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিলো। দ্বীপ নীরাকে আদেশের সুরে বলে,”আমার কথার হেরফের হওয়া আমি পছন্দ করি না।নেক্সট টাইম যেনো কোনো অন্যায় আবদার নিয়ে তর্ক করতে না দেখি।”
বলেই ব্যালকনিতে যেয়ে দাড়ায় দ্বীপ।নীরা আজ প্রচুর কষ্ট পায়।কোনো কথা না বলে মিনিকে জড়িয়ে কম্বল মুড়ি দেয়।কম্বলের নিচে ফুফাতে থাকে।
ঘন্টাখানেক নিরবতা পালন করে দ্বীপ।রাতের খাবার কেউই খায় না।দীপান্বিতা এসে দেখে নীরা ঘুমিয়ে আছে। দ্বীপও ব্যালকনিতে চুপচাপ।ভাই রেগে থাকলে দীপান্বিতাও কোনো কথা বলে না।রাগের সময় দ্বীপের মাথা কাজ করে না।তাই তখন সবাই নিরবতা পালন করে।
এগারোটার দিকে ঘরে এসে দ্বীপ দেখে নীরা ঘুমিয়ে গেছে।কোলে মিনিকে নিয়েছে।হালকা হাসে দ্বীপ।ঘুমন্ত নীরার অতি নিকটে এসে নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”আমার চন্দ্রপাখিকে কারো সামনে যোগ্য প্রমাণ হতে হবে না।সে যেমন আছে তেমনই বেস্ট।আমিতো আমার এই দুষ্টু মিষ্টি বউকে বেশি ভালোবাসি।কেনো হতে হবে তোমাকে সবার সামনে পারফেক্ট?তুমি আমার কাছে এমনিতেও পারফেক্ট।সবার সামনে কোমর দুলিয়ে ধেই ধেই করে নৃত্য করবে আর ছেলেরা তাকিয়ে থাকবে এটা আমি কিছুতেই সহ্য করবো না।এটা তো এক অন্যায় আবদার।তুমি কেনো অন্য ছেলেদের সামনে নাচতে যাবে।তুমি আমার জীবনে আমার ব্যাক্তিগত নারী আমার চন্দ্রপাখি।”
বলেই ঘুমন্ত নীরার বাম গালে গুনে গুনে দশটি চুম্বন এঁকে দেয়।তারপর লাইট অফ করে অন্যপাশ হয়ে ঘুমিয়ে পরে।
দ্বীপ লাইট অফ করার সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায় নীরা।সে এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে হালকা নিদ্রায় ছিলো।গভীর নিদ্রা তখনও বিরাজ করেনি নীরার চোখে।অন্ধকার রুমে বাইরে থেকে আসা চাঁদের আবছা আলোয় দেখলে থাকে দ্বীপকে।তারপর তার বাম গালে হাত দিয়ে অনুভব করলো।এই মাত্র তার ক্যাডার সাহেব তাকে চুম্বন এঁকে দিলো।তাও আবার গুনে গুনে দশটি।যখন দ্বীপ এই কাজটি করেছিলো নীরার হৃদপিণ্ড কেপে উঠেছিলো।দ্বীপের মুখে চন্দ্রপাখি নাম শুনে নীরা বুঝতে পারলো ডায়েরির ওই কন্যাটি কেউ না বরং সে নিজে।সময় করে দ্বীপের অগোচরে পড়তে হবে ডায়েরিটি।জানতে হবে দ্বীপের মনে তাকে নিয়ে বিচরণ করা অনুভূতি।
চলবে…?