লুকোচুরি গল্প পর্ব-১১

0
564

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১১
#ইশরাত_জাহান
🦋
দেখতে দেখতে নীরার টেস্ট পরীক্ষার আজ শেষ দিন।এই কয়দিনে দ্বীপ নিজ দায়িত্বে নীরাকে কলেজে নিয়ে গেছে আবার নিয়ে এসেছে।নীরা যেনো পরীক্ষা দিয়ে তাড়াতাড়ি না পালায় সেই জন্য ওয়ারনিং দিয়েছে।পুরো পরীক্ষা নীরা হামি দিতে দিতে দিয়েছে।টেস্ট পরীক্ষা কি আর এতো লিখতে ইচ্ছা করে?এমনি নীরা অলস পড়া চোর সেখানে এতটুকু লেখা জমা দিলেই এনাফ।কিন্তু ক্যাডার সাহেবের জন্য তাকে সম্পূর্ণ পরীক্ষার সময় বসে থাকতে হয়েছে।

আজকেও দ্বীপ নীরাকে নিয়ে যাওয়ার সময় বলতে থাকে,”পরীক্ষা শেষ করে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।একদম বাইরে যাবে না।যদি দেখেছি পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে খাতা জমা দিয়ে বের হয়েছো এই স্যার থেরাপি আবার ফিরে আসবে।”

স্যার থেরাপি কথাটি শুনেই নীরার গালে অটোমেটিক হাত চলে আসে।মিনমিন করে বলে,”বেটা খচ্চর,বিয়ের পরেও কি না স্যার থেরাপি দিবে!এই জন্য স্যারদের বিয়ে করতে নেই।হয়তো এই জন্যই সবাই বলে স্যার ম্যাম পিতা মাতার সমতুল্য।”

বিড়বিড় করতে করতে নীরা গাড়িতে ওঠে।নিজের ঘরের জানালা দিয়ে মেয়ে জামাইকে একসাথে কলেজে যেতে দেখছেন মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন।তাদের চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি।কতজন বাবা মা পারে এমনভাবে মেয়ের সুখ নিজের চোখে দেখতে? হাতে গোনা গুটি কয়েক জনের মধ্যে তারা এমন লাকি বাবা মা।এই যে যখন ইচ্ছা মেয়ের সুখ একটু উকি দিয়ে দেখছে আবার প্রায় বিকেল বেলা যেয়ে যেয়ে গল্প করছে। দ্বীপ ও নীরাদের গাড়ি দৃষ্টির বাহিরে গেলে মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন দুজন দুজনকে দেখে স্মিত হাসেন।

মিস্টার রবিন বলে ওঠে,”আমাদের মেয়ে সত্যি অনেক ভাগ্যবতী।দ্বীপের মতো কেয়ারিং স্বামী পেয়েছে।আমাদের দ্বীপ নীরাকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করবে তেমন নিজের আপন করে নিবে।বাবা মা হয়ে সেই সুখ আমরা নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবো।আবার আমাদের মেয়ে আমাদের কাছেও থাকছে।তোমার মনের আশা পূর্ণ হচ্ছে এবার।”

চোখের পানি মুছে মিসেস নাজনীন বলে,”প্রত্যেক বাবা মা চায় সন্তানের সুখ দেখতে।মৃত্যুর আগে চায় সন্তান যেনো তার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজ দায়িত্ব নিতে পারে।আমাদের নীরা অনেক বুদ্ধিমতি ও সবাইকে আপন করে নেয়।কিন্তু পড়াশোনা ও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওর তেমন মাথা ব্যাথা নেই।যেভাবে তিড়িং বিড়িং করে এভাবে তো ওর জীবন আগাবে না।দ্বীপ ওকে শাসন করবে আবার ভালো বাসবে শুধু তাই না দ্বীপ ওর সকল বিষয়ের প্রতি যত্নশীল হতে পারে।আমার পর দ্বীপ সে যে নীরাকে শাসন করে আবার গভীরভাবে ভালোবাসে।আমি দেখেছি দ্বীপের চোখে সেই ভালোবাসা।মেয়েটা বয়সের সাথে সাথে উড়তে শুরু করেছে।সমাজের নিয়ম কানুন থেকে দূরে থেকে ও নিজেকে উড়ন্ত পাখি ভেবে নিয়েছে।ব্যাক্তি স্বাধীনতা ভালো কিন্তু বেশি উড়ন্ত পাখিকে শিকার করতে সময় লাগে না।আমি দ্বীপের হাতে নীরাকে দিয়েছি যাতে আমার নীরা সুখে থাকতে পারে।নীরব আর নীরার সুখ দেখাটাই যে আমাদের শেষ চাওয়া।এরপর তো…”

আর কিছু বলতে দিলেন না মিস্টার রবিন।মিসেস নাজনীনের মুখ চেপে ধরে বলে,”ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।হুটহাট মৃত্যুর নাম উঠিয়ে সুখের মুহূর্ত কেনো দুঃখে পরিণত করবো?”

মিসেস নাজনীন সাথে সাথে মিস্টার রবিনের বক্ষে মুখ গুজে আলিঙ্গন করে নিলেন।মিসেস নাজনীন ও মিস্টার রবিন একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেন।তাদের প্রেম ভালোবাসা যেনো এখনও অফুরন্ত।

পরীক্ষা শেষ করে নীরা ও দ্বীপ গেটের বাইরে থেকে গাড়িতে ওঠে।উদ্দেশ্য বাড়িতে আসবে।দ্বীপ ড্রাইভ করতে থাকে আর নীরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ নীরা খেয়াল করলো গাড়িটি তাদের বাড়ির রাস্তায় না উল্টো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।নীরা সাথে সাথে বলে,”আমরা আজ কোথায় যাচ্ছি?”

“গেলেই দেখতে পাবে।”

নীরা আর কোনো উত্তর দেয় না।এর কিছুক্ষণ পর দ্বীপ গাড়ি থামিয়ে দেয়।নীরা বাইরে তাকিয়ে দেখে তারা শপিং মলের সামনে এসেছে।নীরা দ্বীপের দিকে ঘুরে বলে,”শপিং মলে কেনো?”

“হানিমুন করতে এসেছি।ইন্টারেস্টেড থাকলে চলো নাহলে এখানে বসে থাকো।আজিব প্রশ্ন শপিং মলে কেনো!”

বলেই দ্বীপ বের হয়ে যায়।নীরা বিড়বিড় করে বলে,”ঘাড় তেরা স্যার।”

শুনে ফেলে দ্বীপ।নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার স্যার প্লাস বর তোমার মতই তো হবে।”

নীরা আর কিছু না বলে মুখ ভেংচি দিয়ে দ্বীপের সাথে হাটতে শুরু করে।শপিং মলে এসে আগে তারা কসমেটিকসের দোকানে ঢোকে।তারপর দ্বীপ নীরাকে বলে,”তোমার মাসে কি কি লাগে আমি জানি না।এখানে মহিলা কর্মী আছে তাই এখানে নিয়ে এসেছি। যাতে করে তোমার প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিতে পারো।বিয়ের শর্ত তো দেওয়া ছিলো মাসে মাসে কসমেটিকস কিনে দেওয়া।আজ এক তারিখ নেও শুরু করো।”

এক দৃষ্টিতে নীরা তাকিয়ে আছে দ্বীপের দিকে।মনে মনে বলে,”লটারি পেয়ে গেলাম মনে হয়।না চাইতেই কেনা কাটা করতে পারছি।এরকম বর কপালে জুটলে আমি তো বলবো আমার শত্রুর কপালেও বর হিসেবে স্যার যুটুক।”

বলেই দাত বের করে হাসে নীরা।তারপর পছন্দ মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে।কসমেটিকস কেনার পর দ্বীপ নীরাকে কাপড় চোপড়ের দোকানে নিয়ে যায়।কিছু জামা কাপড় কিনতে।প্রত্যেক মাসে মাসে দ্বীপ পরিবারের জন্য জামা কাপড় কিনে।এটা দ্বীপের ভালো লাগা।আজও তাই করছে।

নীরাকে ড্রেসগুলো পছন্দ করে দিতে বলে।নীরা সবার জন্য ড্রেস দেখে নেয়।দ্বীপ চুপচাপ এদিক ওদিক দেখতে থাকে।হঠাৎ দ্বীপের নজরে আসে একটি শাড়ি নিয়ে দুইজন মহিলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন আর দাম কষাকষি করছেন।দ্বীপের কাছে শাড়িটি ভালো লাগে।নীরাকে এই শাড়িতে খুব সুন্দর লাগবে এমনটাই দ্বীপের কাল্পনিক চিন্তা।কোনো কিছু না ভেবে শাড়িটি কেনার জন্য চলে যায় সেখানে।ওই রকম দেখে আরেকটি শাড়ি নিয়ে নেয় দ্বীপ।তারপর তারা বাসায় চলে আসে।

বাসায় এসে দ্বীপ ও নীরা সবাইকে একসাথে করে ড্রেস দেয় ও কার জন্য কি কি এনেছে এগুলো দেখাতে থাকে।পিংকি ও তার মা মিসেস সাদিয়া আছে।তাদের জন্যেও আনা হয়েছে।সবার ড্রেস দেখানো হয়ে গেলে নীরার জন্য কেনা শাড়িটি সবাইকে দেখায় দ্বীপ।নীরা প্রথমে বুঝতে না পারলেও যখন দ্বীপের মুখে শুনে,”এটা আমি তোমাদের বউমার জন্য কিনেছি।”
তখন অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে ক্যাডার সাহেবের দিকে।

পিংকির হিংসা হয়।সে সাথে সাথে বলে,”কই দেখি।ওয়াও অনেক সুন্দর শাড়িটি।আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে।”

মিসেস সাদিয়া পিংকিকে সাপোর্ট দিয়ে বলে,”তোর ভালো লেগেছে।একটা কাজ করি এই শাড়ি তাহলে পিংকিকে দে আর নীরাকে পিংকির জন্য আনা ড্রেসটি দে।”
দ্বীপকে উদ্দেশ্য করে শেষের কথাটি বলে।

পিংকি খুশি মনে শাড়িটি নিতে গেলে নীরা খোপ করে নিয়ে নেয় আর বলে,”তোমার বর যদি তোমাকে কিছু কিনে দেয় তুমি নাহয় সেগুলো এক্সচেঞ্জ করে নিও।আমি তোমার মতো এতো উদার নই।যেটা আমার ওটা আমার করেই নেই।তুমি তোমার জন্য কেনা ড্রেস নিয়ে যেটা তোমার ভাইয়া দিয়েছে ওটা নিয়ে খুশি থাকো।আমি আমার স্বামীর দেওয়া উপহার নিয়ে খুশি হতে চাই।”

মিসেস সাদিয়া ভেংচি কেটে বলে,”আমার মেয়েটা শাড়ি তেমন পরে না। এই প্রথম একটি শখ করে নিতে চাইলো তাও সহ্য হলো না।”

নীরা কিছু বলার আগেই দ্বীপ বলে,”কি বলোতো ফুফি!আমি আবার বউ আর বোনকে আলাদা চোখে দেখি।যেটা বোনের জন্য এনেছি ওটা বোনের আর যেটা বউয়ের জন্য এনেছি ওটা বউয়ের।শুধু শুধু বউ আর বোনের মধ্যে বোনকে সাপোর্ট করে বউয়ের চোখে কাপুরুষ ট্যাগ নিতে চাই না।বোনের চোখে কাপুরুষ হলেও লোক সম্মুখে মুখ দেখানো যায় বউয়ের কাছে কাপুরুষ হলে পুরো জীবন ব্যর্থ।বউ আমার হুট করে বাপের বাড়ি গেলে এই বয়সে শিক্ষক থেকে আমাকে বউয়ের জন্য সন্ন্যাসী হয়ে বসে থাকতে হবে।”

দ্বীপের এমন কথায় হা হয়ে যায় নীরা,পিংকি ও মিসেস সাদিয়া।দ্বীপ তো এসব কথা বলতো না।কি হয়ে গেছে ছেলেটার।ফুফুর সাথে লাগামহীন কথাবার্তা বলছে। আর আগে কি না মুখ থেকে একটা শব্দও বের হতো না।

মিস্টার সমুদ্র ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বিষম খান।মিসেস সাবিনা মিস্টার সমুদ্রকে খোচা দিয়ে বলে,”দেখেছো আমার ছেলেই হলো প্রকৃত পুরুষ।বউকে তো সবসময় টাইট দিয়েই রাখে আবার বউয়ের জন্য লড়াইও করে।ভুল মানুষের বেলায় বউ কে আর বোন কে দেখে না।আমার ছেলেটা হিরের টুকরো।একদম বাপের থেকে ভিন্ন হয়েছে।”

মিস্টার সমুদ্র নিজের বউয়ের মুখে এতগুলো বছর পর আজ প্রথম এমন কথা শুনে যেনো ডাবল বিষম খেলেন।ইচড়ে পাকা বউমা নিয়ে এসে কি সবাইকে ছোঁয়াচে রোগ লাগিয়ে দিলো!ছেলে লাগামহীন কথা বলছে বউ আজ জীবনের কাজকর্ম নিয়ে প্রতিবাদ করছে।

দ্বীপের মুখে এমন কথা শুনে দীপান্বিতা মিসেস শিউলি ও মিসেস সাবিনা একসাথে হাততালি দিতে থাকে।এদের কেউই পিংকি ও মিসেস সাদিয়াকে পছন্দ করে না।মিস্টার সমুদ্র নিজেও পছন্দ করেন না কিন্তু মৃত বাবাকে দেওয়া ওয়াদা রক্ষার জন্য সহ্য করতে হয়।

চলবে…?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে